৩৮
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে তারিখ, দিন-ক্ষণ প্রভৃতি নির্ধারণ করে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতো। মহাভারতে বর্ণিত আছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আলোচনার মাধ্যমে কুরু-পাণ্ডবেরা যুদ্ধের স্থান, তারিখ ও সময় ঠিক করেছিলেন। ভারতীয় ও অভারতীয় যুদ্ধে মৌর্য ও গ্রিকদের মধ্যে স্থান ও তারিখ নির্ধারণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যুদ্ধটা সংঘটিত হয়েছিল সিন্ধু উপত্যকায় তখন সব দেশেই উন্মুক্ত স্থানে যুদ্ধের নিয়ম ছিল। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দুই শত্রুপক্ষ ঢাল, সড়কি, বল্লম, তরবারি প্রভৃতি নিয়ে পদব্রজে, অশ্ব কিংবা হস্তীতে আরোহণ করে মুখোমুখি দাঁড়াত। অবশ্যই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। তারপর উভয় পক্ষের একজন করে অশ্বারোহী সৈন্য মধ্যমাঠে এসে পরস্পরকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাত। এই অবস্থায় কেউই আত্মসমর্পণ করত না। ক্রুদ্ধভাব নিয়ে উভয়েই নিজের বাহিনীর কাছে ফিরে যেত এবং মাঠে অবস্থানরত সর্বাধিনায়ক রাজা, সম্রাট বা যুবরাজদের সংবাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হুংকার কিংবা চিৎকার দিয়ে অস্ত্র উঁচু করে এক পক্ষ অন্য পক্ষের দিকে প্রচণ্ড বেগে ধাবিত হতো।
মৌর্য ও গ্রিকরা বিশাল বাহিনী নিয়ে থর মরুভূমিতে উপস্থিত হয়েছে। (থর মরুভূমি ছাড়া উভয় পক্ষের প্রায় দশ লক্ষ সৈন্যের সমাবেশ অন্য কোথাও সম্ভব ছিল না, তা একমাত্র থর মরুভূমিতেই সম্ভব)। যুদ্ধের জন্য উভয়েরই এ স্থানটি পছন্দ। উভয় পক্ষের সৈন্যরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌর্যরা চন্দ্রগুপ্তের অধিনায়কত্বে পৌরাণিক সব অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাতারবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে। গ্রিকরা প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী অস্ত্রের পাশাপাশি নতুন সেলুসিড অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত হয়ে দণ্ডায়মান।
চন্দ্রগুপ্ত দূরে দাঁড়িয়ে পুরুর সঙ্গে আলেকজান্ডারের যুদ্ধ দেখেছিলেন। সে কথা তাঁর মনে হলো গ্রিক সৈন্যদের দেখে। এমনিভাবেই দাঁড়িয়েছিল ওরা পরস্পরের মুখোমুখি। সেদিন পুরুর সৈন্য ছিল কম। আলেকজান্ডারের বাহিনী ছিল বিশাল এবং দিগ্বিজয়ের অভিজ্ঞতা ছিল তাদের। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছেন তিনি। যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও তাঁর কম নয়। যুদ্ধকৌশলের অনেক উন্নতি হয়েছে।
সম্রাট হাতির ওপরে বসে পেছনের দিকে তাকালেন। বিশাল এলাকাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বাহিনী। প্রস্তুত। আদেশের অপেক্ষামাত্র। এ রকম দৃশ্য রক্তে একধরনের উত্তাপ এনে দেয়। সব সৈনিকের মধ্যে এই উত্তাপ জিঘাংসায় রূপান্তরিত হয়। শুধু শক্রনিধনের অভীপ্সা তখন মস্তিষ্কে তাড়া করে, আর কিছু নয়। এ এক অদ্ভুত দিক মানবচরিত্রের। আরও অদ্ভুত বিষয় এই যে মানবসভ্যতা অগ্রসর হয়েছে এই হিংসা ও হানাহানির পথ অনুসরণ করে। রক্তপাতের মাধ্যমে বিজয়ীর পক্ষেই সব সভ্যতার ইতিহাস রচিত হয়েছে।
সম্রাট দেখলেন, মৌর্য সেনারা স্বর্ণদণ্ড হাতে আকাশে কৌশিক পতাকা ওড়াচ্ছে। মরুপ্রান্তরে বাতাসে এক প্রাণবন্ত রূপ তার। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পতাকার এই সমারোহ। এই পতাকা মৌর্যদের বিজয়ের গৌরবময় প্রতীক। উড়ন্ত পতাকার বিশাল সমারোহ সম্রাটের হৃদয়কে প্রাণনায় উড়িয়ে দিল। পাশে ঘোড়ায় অবস্থানরত মহামন্ত্রী চাণক্যকে বললেন, দেখুন আচার্য, আমাদের পতাকা কত শোভাময় ও গৌরবদীপ্ত।
এই পতাকা আমাদের শৌর্যবীর্যের প্রতীক। দেখবেন, বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত, মহামান্য সম্রাট।
নিশ্চয়ই। আপনাকে সঙ্গে নিয়ে সব যুদ্ধই আমরা জিতেছি।
বাহিনীর সর্বাগ্রে দুন্দুভি দল। রণসংগীত বাজিয়ে চলেছে এরা। এ সংগীত যুদ্ধের স্পৃহা বাড়িয়ে দেয়। কীটপতঙ্গদের আলোর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সৈনিকদের মরণযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্দীপিত করে তোলে।
তাদের পেছনে হস্তীবাহিনী। গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। নয় হাজার হাতির বিশাল বহর। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মেগাস্থিনিসের বিবরণে আছে, প্রতিটা হস্তীপৃষ্ঠে চারজন যোদ্ধা থাকেন, তাঁদের তিনজনই তিরন্দাজ। তবে তাঁদের বীরসজ্জায় শোভা পাচ্ছে তির-ধনুক ছাড়াও অসি, বর্ম, কিরীট, মণিময় সারসন এবং স্বর্ণখচিত কবচ।
হস্তীবাহিনীর এক পাশে বাঁ-দিকে অশ্ববাহিনী। তাদের সঙ্গে রথীবৃন্দ। রথ চালনায় রয়েছে এক অশ্ব, দ্বিঅশ্ব ও চতুরশ্ব যান। আর রয়েছে ষাঁড়চালিত রথও। মেগাস্থিনিস এ সম্পর্কে বলেন, ষাঁড়চালিত রথগুলোয় চালক ছাড়াও দুজন সৈন্য অস্ত্র নিয়ে সদা প্রস্তুত থাকেন। অশ্বগুলো চঞ্চল।
তাদের পেছনে কাতারবদ্ধ পদাতিক সৈন্যরা। তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ঢাল-সড়কি ছাড়াও নানা আধুনিক পৌরাণিক অস্ত্রে সজ্জিত এরা। তাদের অবস্থান যেন মরুভূমি ছাড়িয়ে দিগন্তে গিয়ে শেষ হয়েছে।
সিন্ধু এবং তার শাখানদীগুলোয় রয়েছে নৌসেনা। নৌযানে তাদের অবস্থান। এগুলো অবশ্য এখন সম্রাট দেখতে পাচ্ছেন না।
প্রতিটি বাহিনীতে অধিনায়ক ছাড়াও নগর বিচারকের নেতৃত্বাধীন পাঁচজন কর্মাধিকারিক রয়েছেন, যাঁরা যুদ্ধকালীনও বাহিনীর সব কাজের তত্ত্বাবধান করেন। তাঁদের সৈনিক পোশাক নয়, একধরনের রাজকীয় পোশাকে দেখা যাচ্ছে। মেগাস্থিনিস বিশেষভাবে তাদের কথা উল্লেখ করেছেন।
মৌর্য বাহিনীতে আলাদা একটি কন্টিজেন্ট রয়েছে, যারা জাতিতে আদিবাসী কৌকা সোসের গভীর অরণ্যে বসবাস। প্রায় নগ্ন এসব সৈনিকের হাতে রয়েছে তাদের ঐতিহ্যিক শিকার অস্ত্র। নলে ব্যবহৃত বিষমাখা তূণ, ফুঁ দিয়ে যার দ্বারা লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করা হয়। তাদের অবস্থান সিন্ধু অববাহিকার পাহাড় ও জঙ্গলময় এলাকায়। নৌবাহিনীর মতোই এদের সঙ্গে মূল বাহিনীর একটি অংশ যোগাযোগ রক্ষা করে।
অশ্ব ও হস্তীবাহিনীর মধ্যে রাজকীয় ‘সুস্থির’ বাহিনী রয়েছে একটি। এরা সম্রাট ও মহামন্ত্রীকে ঘিরে রেখে সুরক্ষা করে। যুদ্ধকালে এ বাহিনী আলাদা পোশাকে চিহ্নিত থাকে। অন্য সৈন্যরা তাই সম্রাটের কাছে ঘেষতে পারে না। মেগাস্থিনিস তাদের সম্পর্কেও সুস্পষ্ট বিবরণ দিয়েছেন।
সম্রাটের ইঙ্গিতে একসময় রণসংগীত থেমে গেল। চারদিকে থমথমে অবস্থা। সম্রাট সামনের দিকে তাকালেন। সম্রাট সেলুকাসকে দেখা যাচ্ছে। যদিও খুব স্পষ্ট নয়, তবু তাঁকে চিনতে কষ্ট হয় না। একটি সুসজ্জিত অশ্বের ওপর উপবিষ্ট তিনি। পাশে তাঁর জেনারেলরা।
গ্রিক সৈন্যদের সাজসজ্জা প্রবাদতুল্য। তাদের অশ্ববাহিনী বিশ্ববিখ্যাত। লৌহ হেলমেট, বর্ম ও নান্দনিক জুতো তাদের এক নম্বর স্মার্ট সৈন্যের অভিধায় ভূষিত করেছে। গ্রিকদের অশ্বারোহী সৈন্য মৌর্যদের দ্বিগুণ, তবে তাদের হস্তীবাহিনী নেই। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী। দৃঢ়বদ্ধ এদের পদভার। ফ্যালাক্স রীতি পদ্ধতির যুদ্ধকৌশলের পাশাপাশি নব উদ্ভাবিত সেলুসিড কৌশল তাদের অস্ত্রের মধ্যে প্রতিফলিত। পাইক (বর্গা), দোরি (ছোট বর্গা) প্রভৃতির পাশাপাশি স্পিকস (বড় বল্লম), সারিসা (অতি লম্বা বল্লম) এবং জিফোস (ছোট এক হাতে ব্যবহারযোগ্য বল্লম) নিয়ে দণ্ডায়মান এরা। হোপলাইট শিল্ড, এসপাইজ শিল্ড ছাড়াও তরবারি এবং তির-ধনুক রয়েছে তাদের সঙ্গে। চৌকস ও রণনিপুণ সৈনিকদের শিরস্ত্রাণ ও ঢাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। সুবর্ণ ঢাল ও শিরস্ত্রাণের সৈন্যরা নিঃসন্দেহে অভিজাত। আছে রুপোর ঢাল ও শিরস্ত্রাণের সৈনিকও। পদবির নানা আভিজাত্যে রয়েছে কারও কারও সাফল্যের পালক।
তাদের মধ্যে কারও কারও হাতে লম্বা দণ্ডে শোভা পাচ্ছে গ্রিকদের সেলুসিড পতাকা। থর মরুভূমির বাতাস এই দখলদারদেরও বিমুখ করে নি। বাতাসে পতপত করে উড়ছে এই অহংকারী পতাকাও। এই পতাকার দিকে তাকিয়ে মৌর্য সম্রাট দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে চাণক্যকে উদ্দেশ করে বললেন, ওদের পতাকার এই অহংকার একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে হবে।
নন্দরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে খুব নাম করেছিল অশ্বারোহী সৈনিক দেবরাজ বণিক। সম্রাট তাকে নির্বাচন করলেন যুদ্ধদূত হিসেবে। দেবরাজ অশ্বচালনা করে থর মরুভূমির মধ্যমাঠে গিয়ে দাঁড়াল। গ্রিকদের পক্ষ থেকে সুসজ্জিত অশ্বারোহী সৈনিক থেসপাসকে পাঠানো হলো মাঝমাঠে দেবরাজের কাছে। দেবরাজ গ্রিক সৈন্যকে সরাসরি আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করল। গ্রিক সৈন্য থেসপাস উষ্মার সঙ্গে কটু কথা বলল। দেবরাজ তার অর্থ বুঝতে পারল না। ক্রুদ্ধ হয়ে তরবারি বের করে এক কোপে ওর মুন্ডু আলাদা করে মরুভূমির বালিতে ফেলে দিল। গ্রিক অশ্ব থেসপাসের মুন্ডুহীন দেহ কিয়দ্দুর পর্যন্ত বহন করে দৌড়ে পড়ে গেল। দেবরাজ গড়াগড়ি যাওয়া মুণ্ডের সামনে তরবারি উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
তা দেখে মৌর্য সম্রাট এত জোরে যুদ্ধ হাঁক দিলেন যে চারদিক কেঁপে উঠল। বজ্রনিনাদের মতো। দুন্দুভি বেজে উঠল গম্ভীর জীমূত মন্ত্রে। হস্তী, অশ্ব, রথী ও পদাতিক বাহিনী রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গেল মধ্যমাঠে। তাদের চিৎকার, অশ্বের হ্রেষাধ্বনি, হস্তীর কানফাটা বৃংহিত এবং রণবাদ্য মিলে মুহূর্তের মধ্যে চারদিক এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের রূপ নিল। থর মরুভূমিতে বালির ঝড় শুরু হয়েছে। গ্রিকরা দূর থেকে তাদের সহকর্মীর করুণ পরিণতি অবলোকন করে কোনো আদেশ ছাড়াই চিৎকার করে ছুটে এল এক হাতে তরবারি অথবা সারিসা উঁচিয়ে, অন্য হাতে জিফোস বা হোপলাইট শিল্ড নিয়ে। ঝাঁপিয়ে পড়ল একে অন্যের ওপরে। হস্তীপৃষ্ঠ থেকে দূরে নিশানা করে তির ছুড়তে থাকল তিরন্দাজগণ। অশ্বপৃষ্ঠধারীগণ তরবারি ও মুদগর চালাল বেপরোয়াভাবে পৌরাণিক অস্ত্রগুলো ব্যবহারে অভাবিত ফল পাওয়া গেল। রথে চড়ে রথী স্বর্ণচূড়, বিভায় পুরে পুরা, মন্দুরা, তাজিয়া বাহীরাজী, বক্রগ্রীবা পদাতিক ব্রজ মাথায় কনকশিরঙ্ক শিরোভাস্বর, পিদানে অসি, পৃষ্ঠে চর্ম অভেদ্য সমরে হস্তে শূল, আয়েশি আবৃত দেহ। একের পর এক শক্রনিধনে তৎপর এরা। নিষাদিরা যেন মেঘাসনে বজ্রপানি, সাদি অশ্বিনী কুমার ভীমাকার ভিন্দিপাল, বিশ্ববিনাসী পরশু আকাশমণ্ডল থেকে নেমে এসে যেন দাবানল সৃষ্টি করেছে। গম্ভীরনাদে বেজে চলেছে রণবাদ্য, হয়ব্যূহ হ্রেষাধ্বনি করছে উল্লাসে, গজের গর্জন, কোদণ্ড টঙ্কার, অসির ঝনঝন শব্দ, মানুষের হুংকার ও আর্তচিৎকার মহাকোলাহলময় হয়ে উঠেছে, কান এখন আর শব্দ শুনতে পায় না (এখানে মাইকেল মধুসূদন দত্তের যুদ্ধ বর্ণনার ছায়াপাত ঘটেছে)।
গ্রিক সৈনিকেরা সেলুসিড অস্ত্রের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। পনেরো-বিশ ফুট লম্বা সারিসার আঘাতে পর্যুদস্ত করছে মৌর্য সৈন্যদের। মৌর্যদের হস্তীপৃষ্ঠে বসে নিক্ষেপিত তিরগুলো আটকে দিচ্ছে জিফোস ব্যবহার করে। তরবারি চালাচ্ছে এবং কচুকাটা করছে মৌর্য পদাতিক সৈন্যদের। সারিসা আঘাত করছে অশ্ব, হস্তী ও রথটানার ষাঁড়দেরও। তাদের শিরস্ত্রাণ ও বর্ম এত শক্ত যে বহু চেষ্টা করেও ভেদ করা যাচ্ছে না।
মৌর্য সম্রাট তাঁর রাজকীয় অশ্ব ও হস্তীবাহিনীর মধ্যে থেকেও নানা অস্ত্রচালনা করছেন। শত্রুনিধন করছেন একের পর এক। চাণক্য শুধু শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শনচক্র অস্ত্র ব্যবহার করছেন। মাঝেমধ্যে তরবারিও তাঁর হাতে ঝলসে উঠছে। মদকল করি যেমন নলবনে প্রবেশ করে নলবন ধ্বংস করে, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তেমনি শত্রুনিধন করছেন দলে-মথে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে।
সেলুকাসও ক্ষিপ্ত পাগলা হাতির মতোই। তাঁর যুদ্ধদূতকে হত্যা করা হয়েছে। ক্রুদ্ধ এই বীর তরবারি চালনা করছেন বিদ্যুদ্বেগে। মাঝেমধ্যে আত্মরক্ষার জন্য এদিক-সেদিক ঘোরাচ্ছেন বাম হস্তে থাকা সুবর্ণ ঢাল, তাতে শক্ত আঘাত করছে মৌর্য সৈন্যরা।
একসময় তাঁর কাতুইকোই সৈন্যরা ঘিরে রাখে তাঁকে। কাতুইকোই তাদের অনিয়মিত সৈন্য। এদের পোশাকও ভিন্ন। প্রচলিত পাইক অস্ত্রই শুধু এরা ব্যবহার করতে পারে। যুদ্ধের ময়দানে তাদের হতাহতের সংখ্যাই বেশি। চাচা টলেমির অনিয়মিত বাহিনী ক্লেবুচোইয়ের অনুকরণে এ বাহিনী গঠন করেছেন সেলুকাস। তবে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে যুদ্ধক্ষেত্রে অদম্য সাহসের পরিচয় দিচ্ছে এরা। মল্লযুদ্ধেও লিপ্ত হচ্ছে। চন্দ্রগুপ্ত দেখলেন, তরবারি কিংবা মুদগর দিয়েও তাদের শেষ করা যাচ্ছে না। মহামন্ত্রীকে বললেন, আচার্য, হস্তীবাহিনীকে সম্মুখে পাঠান এরা দলে-মথে নিশ্চিহ্ন করে দিক শত্রুদের।
মহামন্ত্রী তা-ই করলেন। হস্তীর পদপিষ্ঠ হয়ে মারা যেতে থাকল অসংখ্য গ্রিক সৈন্য। হস্তীপৃষ্ঠ থেকে ভৈরব হুংকারে মেঘের গর্জনের মতো ছুটে চলেছে ভয়ংকর শর। ঘোর ঘর্ঘর এমন কোদণ্ড টঙ্কার জগতে কেউ আগে দেখে নি। হস্তীবাহিনী ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে গ্রিক সৈন্যদের।
দুই পক্ষের সৈন্যদেরই অগ্নিময় চক্ষু, সিংহের ন্যায় সরোষে দাঁত কড়মড়িয়ে লাফ দিয়ে পড়ছে শত্রুর ঘাড়ে। চারদিকে সমরতরঙ্গ উথলে পড়ছে। সিন্ধুর জলরাশি বায়ুর সঙ্গে প্রবল দ্বন্দ্বে লিপ্ত। যেন তারই নির্ঘোষ শব্দ হচ্ছে সমরতরঙ্গে।
ভয়ংকর আদিবাদ্য হচ্ছে সিংহনাদ। তার চেয়ে ভয়ংকর শব্দ আসছে শেলশক্তি, শূল, মুগর, মুদগর, পট্টিশ, নারাচ, সারসা, তির, তরবারি প্রভৃতির আঘাত থেকে। সঙ্গে আর্তচিৎকার কিংবা ভয়ংকর হুংকার। কোনো পক্ষ নয়, গজ, অশ্ব, সাদি, নিষাদি, সুরথী ও পদাতিক সৈন্যরাই জম জয়ী। তাদেরই মতো অন্য সব প্রাণীর বর্ম, চর্ম, দেহ, রক্তের প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড যুদ্ধের মধ্যে দেখা গেল দেবরাজ বণিককে। শাণিতের প্লাবন বইছে তার মুখমণ্ডল থেকে বক্ষবর্ম হয়ে উরুদেশ অবধি। হাতে রক্তভেজা সে নাঙ্গা তরবারি। ঢাল দিয়ে নিজেকে রক্ষা করে ডানে-বাঁয়ে তরবারি চালিয়ে শত্রু নিধন করছে অনবরত। সে গ্রিক জানে, তাই শত্রুদের গালি দিচ্ছে প্রতিটি আঘাতে। ওরাও ছাড়ছে না তাকে। মৃত্যুর আগে কুৎসিত কথা ছুড়ে দিয়ে যাচ্ছে পরপারে।
হস্তীবাহিনীর বহুমুখী আক্রমণে কয়েকবার যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করলেন সেলুকাস। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। মৌর্যদের আক্রমণে দিশেহারা তাঁর সৈন্যবাহিনী। বর্ষার তুমুল বর্ষণে যেমন বাঁধ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে, তেমনি অবস্থা সেলুসিড সৈন্যদের। অবশেষে সেলুকাস তাঁর সৈন্যদের কৌশলী অবস্থান এবং প্রয়োজনে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে নির্দেশ দিলেন।
অশ্ব, রথ, অশ্বযান নিয়ে পালাতে শুরু করল সেলুসিড সৈন্যরা। মৌর্য সৈন্যরা তাদের তাড়িয়ে মরুভূমির শেষ পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে গেল। সেলুসিড সৈন্যদের কেউই ঘুরে দাঁড়াল না। ‘মকল করিরাজে হেরি ঊর্ধ্বশ্বাসে’ যেভাবে বনবাসীরা পালায়, সেভাবে পালাল। হত-নিহত- আহত সসৈন্যদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ারও তাগিদ বোধ করল না। পড়ি কি মরি দৌড়াচ্ছে এরা। এই দৌড়ের মধ্যে তরবারি, মদগর, তির ও বল্লমের আঘাতে অনেকেই ধরাশায়ী হলো। ‘বজ্রঅগ্নিপূর্ণ যবে উড়ে বায়ুপথে ঘোরনাদে’ ধেয়ে পালায় বন্য পশুর দল, তেমনি পালাচ্ছে এরা পাহাড় আর জঙ্গলের দিকে। সিন্ধু উপত্যকার উঁচু পাহাড় আর জঙ্গলগুলোয় আশ্রয়ের ব্যবস্থা এরা আগেই করে রেখেছিল।
থর মরুভূমির যুদ্ধ ময়দান এখন শত্রুমুক্ত। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তাঁর মহামন্ত্রী চাণক্যকে বললেন, আচার্য, চলুন যুদ্ধক্ষেত্র ঘুরে ঘুরে দেখি। প্রধান সেনাপতিকেও সঙ্গে নিলেন। একি অবস্থা! সম্রাট বিশ্বাস করতেই পারছেন না হতাহতের সংখ্যা এত বেশি। ভীষণ আকৃতির কুঞ্জরপুঞ্জ পড়ে আছে। কোনোটির শুঁড় কাটা গেছে, শরীরে বিদ্ধ হয়েছে বিষাক্ত তির অথবা সারিসা। কোনোটি ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে কাল সময় বুঝি সমাগত। অসহায়ের মতো চোখ খুলছে আর বন্ধ করছে। গতিময় ঘোড়া গতিহীন। মারা গেছে, অথবা আহত অবস্থায় পা ছুড়ছে এবং যন্ত্রণায় মাথা পেটাচ্ছে ভূমির ওপর। চূর্ণ রথ অগণ্য। ষাঁড়গুলো হয় মারা গেছে, না হয় সিনা সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কোনো কোনোটি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে দিগ্বিদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। রথ নিয়েই দৌড়াচ্ছে দু-চারটি।
মারা গেছে লক্ষ সৈন্য। গুনে শেষ করা যাচ্ছে না। নিষাদি, সাদি, শূলী, রথী, পদাতিক গড়াগড়ি করছে। মৃতেরা নীরব। হাত নেই, পা নেই, কারও নাক কাটা গেছে, কান কানের জায়গায় নেই, শিরই গেছে বেশি, শরীর বিদ্ধ হয়েছে তির, তূণ, সারিসায়। দেহে এখনো বর্ম, শিরস্ত্রাণ এবং পায়ে পরিপাটি জুতো রয়ে গেছে। মরুভূমির বালি সব রক্ত শোষে নিতে পারে নি তাই প্লাবন বইছে, কোথাও জমা হয়ে জমাট বেঁধে আছে।
আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে, কাতরাচ্ছে কেউ কেউ। জল চাচ্ছে। যন্ত্রণায় কেউ কেউ মৃত্যু কামনা করছে। যন্ত্রণায় অনুনয় করছে, যেন তাকে মেরে ফেলা হয়।
আহত-নিহত সৈন্যদের কাছাকাছি শোভা পাচ্ছে তাদের বীরভূষণ বর্ম, চর্ম, অসি, ধনু, ভিন্দিপাল, তৃণ, মুদগর, পরশু, সারিসা, পাইক, দোরি আর কত কী! মণিময় কিরীট, শীর্ষক, শিরস্ত্রাণ, তাবিজ-কবচ, সুবর্ণ ঢাল, বীর আভরণ মহা তেজস্কর।
সুরহীন যন্ত্রীদল পাড়ে আছে বাদ্যযন্ত্রের পাশে। ‘হেমধ্বজ দণ্ড হাতে যমদণ্ডাঘাতে’ পড়ে আছে ধ্বজবহনকারী।
সম্রাট ও মহামন্ত্রী মৃত ও পড়ে থাকা আহত সৈন্যদের সম্মানে হস্তী ও ঘোড়া থেকে নেমে হেঁটে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি দেখছেন। এক জায়গায় সম্রাটের চোখ আটকে গেল। দেবরাজ বণিক পড়ে আছে। পৃষ্ঠদেশে তিরবিদ্ধ হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে তিরবিদ্ধ অবস্থায় এই বীর অনেক শত্রুসৈন্য মেরেছে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দুহাতের নিচে চেপে ধরে আছে দুজন সেলুসিড সৈন্য। এ দৃশ্য দেখলে মনে হবে রামায়ণের বীরবাহু যেন ‘চাপি রিপুচয়বলী’ পড়ে আছে। অথবা মহাভারতের সে দৃশ্য মনে পড়ে যাবে, যেখানে হিড়িম্বার স্নেহ নীড়ে পালিত গরুড়, ঘটোৎকচ কালপৃষ্ঠধারী কর্ণের একাঘ্নীবাণে হত হয়েছিল।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের হৃদয় এ দৃশ্য দেখে হু হু করে উঠল। ভাবলেন, এত বড় ধ্বংসলীলার জন্য দায়ী কে? কেন গ্রিকরা ভারতবর্ষ দখল করতে এল? আর কেনই-বা তিনি ঝিলামের প্রমোদপ্রাসাদে ছদ্মবেশে গিয়েছিলেন? এত হত্যা, এত বিনাশ, এত ধ্বংস তিনি কোনো যুদ্ধেই দেখতে পান নি। দেবরাজ বণিকের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ধন্য মৌর্য সাম্রাজ্য বীর তোমার আত্মত্যাগে। শত্রুদের সমরে ছিন্নভিন্ন করে মৃত্যুটাই সব বীরের কাঙ্ক্ষিত। নির্ভীক সৈনিক হিসেবে আজ যা দেখিয়েছ, যুগ যুগ ধরে তা গৌরব ছড়াবে, বলে নিজের গলা থেকে খুলে একটি মুক্তোর মালা দেবরাজের শরীরে রাখলেন। মহামন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, মৃত সৈনিকদের দেহ সৎকারের ব্যবস্থা নিন। যুদ্ধবিরতি চাইলে, মৃতদেহ সৎকার করতে চাইলে গ্রিকদের সময় দিন। বলে তিনি মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন।
চাণক্য বললেন, সব ব্যবস্থাই হবে, মহামান্য সম্রাট। প্রধান সেনাপতির কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ স্বরে বললেন, আহত গ্রিকদের হত্যা করো। সম্রাট যা-ই বলুন, এদের প্রশ্নে কান দেবে না। প্রতিটি বাহিনীর আধিকারিকদের কাছে সংবাদ পৌঁছে দাও, দ্রুত। আবার সম্রাটকে উদ্দেশ করে বললেন, সম্রাট, আপনি ক্লান্ত, চলুন বিশ্রাম নেবেন। এরা চিকিৎসা ও শেষকৃত্যের কাজগুলো শেষ করুক।
শেষকৃত্যের আয়োজন করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ইতিমধ্যে হাজার হাজার মৃতদেহ জড়ো করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে মৌর্য সৈন্য ও গ্রিক সৈন্যদের আলাদা আলাদাভাবে পুড়িয়ে এবং মাটি চাপা দিয়ে সৎকার করার উদ্দেশ্যে চিতা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। অন্ধকার রাত। চিতার আগুনে আলোকিত হয়ে উঠেছে সমস্ত থর প্রান্তর। স্থানে স্থানে জ্বলছে চিতা, বহু দূর থেকেও দেখা যায়, যেন মরুপ্রান্তরে লক্ষ আগুনফুলের মেলা। চিতার আলোয় সৈনিকেরা মৃত গ্রিক সৈন্য ও হাতি, ঘোড়া ও ষাঁড়দের মাটিচাপা দিল।
যারা বেঁচে আছে, তাদের অনেক কিছুর প্রয়োজন। কাড়াকাড়ি করে এরা নিহতদের অস্ত্র ও বীর আভরণ নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিল এবং রাত্রি শেষের আগে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের আলোয় ক্লান্ত দেহে ফিরে গেল স্ব স্ব শিবিরে।
সম্রাট তাঁর ছাউনি থেকে সেসব দৃশ্য দেখলেন জেগে থেকে। প্রথম দিনের যুদ্ধজয়ের আনন্দে তাঁর উল্লসিত হওয়ার কথা, কিন্তু তার পরিবর্তে একধরনের বিষণ্ণতা পেয়ে বসল ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের মতো। সম্রাট কি যুদ্ধের ভয়াবহতায় তলিয়ে যাচ্ছেন? নাকি বিরাট এক মানবিক বিপর্যয়ে তার কারণ অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন? আচার্য ভদ্রবাহু এ সময় তাঁর পাশে থাকলে ভালো হতো। তাঁর অন্তর্জাগতিক ব্যাপারগুলো শুধু আধ্যাত্মিক গুরু ভদ্রবাহুকেই অবহিত করেন, অন্য কাউকে নয়।