মৌর্য – ৩৪

৩৪

পত্রটি আগেই লিখেছিলেন কর্নেলিয়া। এন্টিওকাস সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়ে যাওয়ার সংবাদে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। এ কথা এখন চন্দ্রগুপ্তকে জানানোর আর সুযোগ নেই। বার্তাবাহক কবুতর চলে গেছে। এ পত্র পাঠ করে সম্রাট আবার পত্র লিখবেন, এ রকমটি আশা করা যায় না। তাঁর কাছ থেকে গ্রিক কোনো বার্তাবাহক পূর্বে চন্দ্রগুপ্তের কাছে যায় নি। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এখন কাউকে পাঠানোও সমীচীন নয়।

সতর্কতামূলক যুদ্ধে দামামা বেজে উঠল সেলুসিড সাম্রাজ্যেও। এত দিন যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল না, তা নয়, ডায়াডোচিদের যে যুদ্ধ, তা রণসংগীত ছাড়াই থেকে থেকে চলছিল। একটি ভিন্ন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সতর্কতা ও প্রস্তুতিমূলক রণভেরি জাতিকে জাগিয়ে তুলবে, ঐক্যবদ্ধ করবে, সেলুসিড সম্রাটের উচিত তাই তা জোরেশোরে বাজিয়ে দেওয়া এবং তিনি তাই করছেন।

এ রকম সময়ে কর্নেলিয়ার কক্ষে এসে উপস্থিত হলেন আর্কিমেডেস। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তাঁদের যুদ্ধের পোশাকেই থাকতে হয়। কর্নেলিয়া হেসে দিয়ে বললেন, তাহলে তুমি প্রস্তুত হয়েই আছ?

হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত। যুদ্ধে যাওয়ার আগে মনে হলো তোমাকে একবার দেখে যাই। তাই আসা। অবশ্য যুদ্ধের ময়দানে আমাদের দেখা হবে বলে তুমি জানিয়েছিলে। সেখানে দেখাটা হবে ফরমাল। শুধু যুদ্ধের কমান্ড আর ব্রিফিং ছাড়া কিছু বলার সুযোগ থাকবে না।

কী বলতে চাও, বলো। বলে মুখটিপে হাসলেন কর্নেলিয়া।

কী বলতে চাই, তা তুমি জানো।

আমি কী বলেছি, তাও তুমি জানো। আমরা ভালো বন্ধু—এই হোক আমাদের সব পরিচয়। তুমি কি জানো এন্টিওকাস এ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীর স্বীকৃতি পাচ্ছে?

না, আমার তা জানা নেই। বেশ তো। সম্রাটের বড় ছেলে সম্রাট হবেন, তা-ই তো রীতি। এতে আমাদের কোনো ভাববার কিছু নেই, সৈনিক শুধু তার কমান্ডারকে সেলুট করবে, কে সম্রাট হলো, এ নিয়ে ভাববার সুযোগ কোথায়?

ঠিক বলেছ, আর তোমার মতো করেই বলেছ।

তুমি কি ভিন্ন মত পোষণ করো?

আমার মতামতে তোমার কিছু এসে যায় না।

তবু তোমার মতামতটা জানতে চাই।

‘ইডিপাস’ নাটকটা পড়েছ?

ওটা তো মায়ের সঙ্গে পাপ।

সৎমা নয়? এ পাপে তোমরা ধ্বংস হবে থিবির মতো।

সেটা হয়েছিল ইডিপাসের অজান্তে। আমাদের তো ত্রিকালদর্শী কেউ নেই।

ত্রিকালদর্শীর প্রয়োজন কী? আমরা একালদর্শীরাই যথেষ্ট নই কি?

আর্কিমেডেস এ কথার জবাব না দিয়ে বললেন, যুদ্ধের সময় এসব প্রসঙ্গ তুলবে না তো। সেলুসিড সাম্রাজ্যের মঙ্গল চাই আমি।

সে জন্য ধন্যবাদ। তবে এ যুদ্ধেই তোমাদের পরীক্ষাটা হয়ে যাবে।

পরীক্ষার্থী তো তুমিও আছ।

আমি পরীক্ষার্থী, না পরীক্ষক, সময়ই তা বলে দেবে।

সেলুসিয়ায় সেলুকাসের রাজপ্রাসাদে যুদ্ধের পতাকা ওড়ানো হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এ রকম পতাকা ওড়ানোর নিয়ম রয়েছে। তার আগে ঘণ্টাধ্বনি করা হয়। সেনাকর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হন। তাই আর্কিমেডেসকে জরুরি চলে যেতে হলো।

সর্বাধিনায়ক হিসেবে পতাকা উত্তোলন করবেন সেলুকাস নিজে। প্রাচীন গ্রিকদের দুটি জিনিস এখনো বিশ্বজুড়ে সুখ্যাতি অর্জন করে আছে। একটি মূর্তিভাস্কর্য, অপরটি যুদ্ধের পোশাক। আলেকজান্ডারের সৈন্যদের পোশাক দেখেই পুরুর সৈন্যরা বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিল। পোশাক পরিধানের পর একজন গ্রিক সৈন্যকে মূর্তিমান মনে হয়। গ্রিকদের এ পোশাকীয় মূর্তিমানতা চীনের প্রথম সম্রাট (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক) কুইন শি হুয়ানকেও দারুণভাবে উদ্দীপিত করে তোলে। সম্প্রতি চীনা প্রত্নতত্ত্ববিদেরা আবিষ্কার করেছেন, সম্রাটের বিশাল সমাধি এলাকায় মাটির নিচে হাজার হাজার সৈন্যের যেসব মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, এগুলো সম্পূর্ণ গ্রিক আদলে নির্মাণ করা হয়েছে এবং গ্রিক ভাস্কররাই এগুলো নির্মাণ করেছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে চীনা বা মঙ্গোলীয় মুখশ্রীসংবলিত প্রতিটি সেনাভাস্কর্যই আলাদা আলাদা চেহারার এবং বলিষ্ঠ দেহাবয়বের। সমকালীন কিংবা তার আগে বা পরে এ রকম ভাস্কর্য চীনে আর নির্মিত হয় নি।

পতাকা সামনে রেখে সেলুসিড সৈন্যরা চীনা টেরাকোটা আর্মি ভাস্কর্যের মতোই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে। সম্রাট দাঁড়িয়েছেন তাদের মুখোমুখি। একটি সুসজ্জিত সামরিক মঞ্চে। রণসংগীত বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাট পতাকা উত্তোলন করলেন। সমবেত সৈন্যরা তাঁকে সেলুট করে যুদ্ধপতাকাকে সম্মান জানাতে জানাতে কুচকাওয়াজ করে গেল।

প্রাসাদের ওপর থেকে দিদাইমেইয়া, লাউডিস ও কর্নেলিয়া সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখছেন। হারমিজও তাঁদের সঙ্গে আছে। হারমিজ বলল, মা, আমি যুদ্ধে যাব নানার সঙ্গে। লাউডিস হেসে দিয়ে বললেন, তুমি অনেক ছোট, হারমিজ, এবার তোমার খালামণি যাবে। তুমি যাবে পরে, ওর সমান হয়ে।

কর্নেলিয়া সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তোমার মায়ের সঙ্গে যেয়ো। আগামীবার তোমার মা যুদ্ধে যাবে।

তোমরা মজা করছ, না? আমি ঠিকই সৈনিক হব, বলল হারমিজ।

দিদাইমেইয়া হাসলেন তার কথা শুনে। বললেন, নিশ্চয়ই যাবে। তোমার সময়ে মেয়েরা শখ করে নয়, পেশাদার হিসেবেই সৈনিক হবে।

পেশাদার কী, নানু?

চাকরি হিসেবে যাবে, তোমার বাবার মতো, বললেন কর্নেলিয়া।

হারমিজের বাবাকে দেখা যাচ্ছে নিচে জেনারেলদের মধ্যে। আৰ্কিমেডেসও আছে সেখানে লাউডিস বললেন, আর্কিমেডেস খারাপ নয়। তরুণ জেনারেল। দেখ, কত স্মার্ট লাগছে। কথাটা কর্নেলিয়াকে উদ্দেশ করে।

কর্নেলিয়া বললেন, তোর স্বামীটাকে স্মার্ট বানাতে পারলি না, দিদি। দেখ সব জেনারেলের মধ্যে কেমন লেবাভুতা লাগছে।

লেবাভুতা কী, আন্টি?

কর্নেলিয়া কিছু বলার আগেই লাউডিস বললেন, সহজ-সরল।

মা, আমি বড় হয়ে লেবাভুতা হব।

এ কথা শুনে সবাই হেসে দিলেন। দিদাইমেইয়া হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, তোদের বাবাকে বলবি না যেন, আমার মনে হচ্ছে এ যুদ্ধে বোধ হয় আমরা জিতব না।

এ কথা কেন বলছ, পিসি, লাউডিস প্রশ্ন করেন।

দেবতারা মনে হয় আমাদের ওপর খুশি নন।

দেবতা নয়, পিসি, মানুষের কর্মই তার ভালো-মন্দের ফলাফল নির্ধারণ করে দেয়। দেবতারা সন্তুষ্ট না থাকাটাই মানুষের নিয়তি।

আমি খুব অবাক হচ্ছি, কর্নি, তোর কথায়। এ রকম কথা আমার মুখে মানাত, অথচ তুই তা বলছিস। দিদাইমেইয়ার কথার জবাবে কর্নেলিয়া আবার বললেন, কিছু ব্যাপার মানুষের মানসিক বয়স বাড়িয়ে দেয়। সেলুসিয়ায় ব্যাপারগুলো ঘটে যাচ্ছে, পিসি।

দুজনই আরও ঘন হয়ে এলেন কর্নেলিয়ার কাছে। কর্নেলিয়ার মাথায় হাত রাখলেন দিদাইমেইয়া। লাউডিস ওর ডান হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় পুরে বললেন, তোর মনের অবস্থা আমরা জানি, বোন। এখন তোকে ধৈর্য ধরতে হবে। তোর মতো শক্ত মনের মেয়ে এসব বললে ভয় লাগে, কর্নেলিয়া। বুঝতে পারছি না কী করা উচিত।

ধৈর্য ধারণ কর, বললেন দিদাইমেইয়া।

ভেবেছিলাম যুদ্ধ করব। আবার মনে হলো, কী লাভ যুদ্ধ করে। যে ভূমির জন্য যুদ্ধ, তা আমার নয়, আমি তার দখলদার, যে সাম্রাজ্যের জন্য যুদ্ধ, তা-ও আমার নয়, আমি এই সাম্রাজ্যে ভাসমান, কোনো অধিকার নেই।

দিদাইমেইয়া অবাক হয়ে বললেন, এ কথা কেন বলছিস?

লাউডিস বললেন, বাবা যুদ্ধযাত্রার আগে এন্টিওকাসকেই উত্তরাধিকারী নিয়োগ করে যাচ্ছেন। এ জন্য কর্নেলিয়া বাবাকে খুব শক্ত কথা বলেছে।

আমরা একেউসের কথা বলেছিলাম। তিনি উড়িয়ে দিলেন, বললেন কর্নেলিয়া।

ও, সে কথা। সেলুকাস আমার সঙ্গে কথা বলেছে। ওটি সে এখনই করছে না। তবে তার অবর্তমানে এন্টিওকাসই ক্ষমতা দখল করবে, তা আমরা চাই বা না চাই। দিদাইমেইয়া আরও বললেন, এসব নিয়ে চিন্তা করে এখন কোনো লাভ নেই। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করাই এখন প্ৰধান কাজ। প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলেন, চন্দ্রগুপ্তের কী খবর?

কর্নেলিয়া জানালেন, তিনি একটি কড়া চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, যুদ্ধের ময়দানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে। এ ছাড়া বলেছেন, ডায়নোসাসের দুর্ভোগের ওপর নির্ভরশীল যে গ্রিক ট্র্যাজেডি, চন্দ্রগুপ্তের ভাগ্যেও তা অপেক্ষা করছে।

এসব তুই বলতে গেলি? তোর মধ্যেকার বিবেক আর উদারতা কোথায় গেল, কর্নি? পিসির কথায় আরও শক্ত অবস্থান নিয়ে কর্নেলিয়া বললেন, আমি জানি, আমি আমার নিজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি।

তুই সত্যিই জানিস না কোথায় যাচ্ছিস তুই, বললেন লাউডিস।

পিসি এবার কর্নেলিয়ার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, বহু দূর তোকে যেতে হবে, কর্নি, পাগলামি করিসনে। মাথা ঠান্ডা কর। তুই কি আমার সঙ্গে যাবি? আমি দুদিনের জন্য যাব আর আসব।

লাউডিস বললেন, পিসি, এখন তোমার যাওয়া ঠিক হবে না। বাবা যুদ্ধযাত্রা করবেন আক্রমণের গোয়েন্দা সংবাদ পেলেই। যুদ্ধটা হবে ভারতীয় অংশের অধিকৃত এলাকায়। তাই আগেভাগে যেতে চাইবেন। এ সময় অন্য কোথাও না যাওয়াই ভালো। তুমি নিকোমেডেসকে আনিয়ে নাও।

নিকোমেডেস দিদাইমেইয়ার ছোট ছেলে। তাদের নামের মধ্যে প্রাচীন গ্রিসের বনেদি স্পর্শ রয়েছে।

সে তো ছোটবেলায় কর্নিকে খেপাত। এখন নির্ঘাত মারামারি হবে।

এখন তারই দরকার, বলে খুব হাসলেন লাউডিস। ময়দানের যুদ্ধ তো দেখতে পাব না, এখানকার যুদ্ধটা উপভোগ করা যাবে, যোগ করলেন তিনি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *