মৌর্য – ৩

পাচক সংবিৎ ফিরে পেয়েছে। চোখ ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে, মনে হয় কিছু একটা খুঁজছে। একসময় অতি কষ্টে বলতে পারল, সম্রাট কোথায়?

তার সহকারী বলল, তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেছেন।

পাচক অনুচ্চ স্বরে বিড়বিড় করে বলল, তাহলে মারা যান নি।

তার সহকারী তা শুনতে পেলেও বুঝতে পারে নি।

কোনো কোনো সূত্র বলছে, তক্ষশীলাই পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য কেউ কেউ তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, একে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিত্র এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেই। এখানে কোনো শিক্ষকের অফিশিয়াল সদস্যপদ ছিল না। কোনো নির্দিষ্ট কলেজ ছিল না। কারও কোনো লেকচার হলঘর ছিল না, দেখা যায় নি ছাত্র- শিক্ষকের আবাসিক ভবন, নালন্দায় যে রকমটি ছিল।

সম্রাটের আগমনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে যে রকম উত্তাপ আশা করা হয়েছিল, লক্ষ করা গেল, সে পরিমাণেই তা যেন শীতল। এখানে কে এসেছেন, এ নিয়ে কারও কোনো উচ্ছ্বাস বা হুড়োহুড়ি নেই। নিত্যদিনকার মতোই তার কর্মসূচি চলছে। বাড়তি আয়োজন এটুকুই যে এখানে আজ একটা বিশেষ বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছে সম্রাটের আগমন উপলক্ষে। তবে একটু উচ্ছ্বাস আছে আচার্য চাণক্যকে কেন্দ্র করে। এই কেন্দ্রের একসময়ের নামকরা আচার্য এখানে এসেছেন, তাই তাঁর ছাত্র ও প্রবীণ আচার্যদের মধ্যে নানা কৌতূহল, নানা গুঞ্জন, তিনি এখন সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী বা উপদেষ্টা।

এই শিক্ষাকেন্দ্রটি স্বায়ত্তশাসিত। একে বলা হয় বুদ্ধিজীবীদের অধিরাজত্ব। এরা কারও ধার ধারে না। বহু রাজপুত্র এখানে আচার্যদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে রাজা হয়েছেন এবং এখনো ‘গুরুদক্ষিণা’ দিয়ে চলেছেন। রাজা বা প্রভাবশালী কেউ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করেন না। প্রত্যেক শিক্ষক তাঁর ইনস্টিটিউশন তৈরি করেছেন এবং স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছেন। তিনি বহু ছাত্রকে শিক্ষা দেন নিজের ইচ্ছেমতো। বিষয় নির্বাচন করেন তিনি। কেন্দ্রীয় কোনো সিলেবাস নেই। ছাত্রের সন্তোষজনক কৃতিত্ব দেখার পর শিক্ষা শেষ হয়। ষোলো বছর বয়সে একজন ছাত্র এখানে আচার্যের কাছে আসেন এবং আট বছর শিক্ষা নেন। শিক্ষকের ব্যক্তিগত আবাসস্থলেই ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হয়। মেধাবী ও অমেধাবী দেখে শিক্ষার রূপরেখা তৈরি করা হয়। যেমন আচার্য বিষ্ণুশর্মা রাজনীতি বিষয়ে অমেধাবী রাজপুত্রদের জন্য লিখেছিলেন পঞ্চতন্ত্র বা পাঁচ কৌশল। এখানে তিনটি বেদ ও আঠারো কলাসহ ধনুকচর্চা, হস্তীবিদ্যা, আইন চিকিৎসা, তথ্যায়ন, সামরিক বিজ্ঞান, রাজনীতিবিজ্ঞান প্রভৃতি শেখানো হয়। আজ সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আগমন উপলক্ষে যে বক্তৃতা দেওয়া হবে, তা রাজনীতিবিজ্ঞানের ওপর।

শিক্ষার্থী ও আচার্যরা আগেই এসে আসন গ্রহণ করেছেন। সম্রাটকে নিয়ে পরে এলেন চাণক্য। দাঁড়িয়ে মাথা নত করে অভিবাদন জানানোর পর সবাই আসন গ্রহণ করলেন। পিনপতন নীরবতা। এই অবস্থায় চাণক্য উঠে দাঁড়ালেন। সবাই তাঁকে করতালির মাধ্যমে বরণ করে নিলেন।

সম্বোধনের পর আচার্য চাণক্য বললেন, পুরাণে বলা হয়েছে, তক্ষশীলা এসেছে ‘তক্ষ’ থেকে। তক্ষ ছিলেন ভরতপুত্র। অর্থাৎ রামের ভ্রাতুষ্পুত্র। তাঁর রাজ্য ছিল তক্ষখণ্ড এবং রাজধানী ছিল তক্ষশীলা। অন্য সূত্র বলছে, তক্ষ তাসাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। সংস্কৃতে সূত্রধর এবং তা নাগাদের অন্য নাম। এরা প্রাচীন ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একটি শাখা। মহাভারতের কুরু রাজ্যের অধিষ্ঠানও এখানে। অর্জুনের দৌহিত্র পরীক্ষিত তক্ষশীলায় রাজা ছিলেন। বৈসম্পায়ন ছিলেন ভিয়াসের শিষ্য। তিনি তক্ষশীলায় প্রথম মহাভারত আবৃত্তি করেন। এই তক্ষশীলা বেশ প্রাচীন। শিক্ষাকেন্দ্রটি গৌতম বুদ্ধের সময় থেকে নাম করেছে। জিবক ছিলেন মগধের রাজা বিম্বিসারের চিকিৎসক। তিনি একবার গৌতম বুদ্ধকে সুস্থ করে তোলেন। তিনি তক্ষশীলায় পড়েছেন। পাণিনি ও চরক এখানে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁদের সুখ্যাতি নিশ্চয়ই এ শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।

রাজনীতি বিষয়ে আজকের নির্ধারিত বক্তৃতা দেবে আমার এক ছাত্র অংশুমান খড়গ। রাজনীতি বিষয়ে শিক্ষাদান তক্ষশীলার একটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহামান্য সম্রাট, আপনি হয়তো অবাক হবেন শুনে যে শতাধিক রাজপুত্র এখানে বিভিন্ন আচার্যের কাছ থেকে রাজ্য পরিচালনা ও রাজনীতিবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। আদিতে এটি শুধু বেদ ও বৈদিক অষ্টাদশ কলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখন রাজনীতির মতো আধুনিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন করা হয়। এখন আমরা বক্তব্যটি শুনি।

আচার্য চাণক্যের ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে যথারীতি সম্বোধন শেষে বললেন, আমি আজ যে বক্তব্য পেশ করব, তা আমার নয়, পণ্ডিত আচার্য কৌটিল্যের। কৌটিল্য আসলে কে, তা আমি জানি না। তিনি নিজেও তাঁর পরিচয় প্রকাশ করেন নি। কেন করেন নি, তার জবাব তাঁর গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’ই রয়েছে। অনুমান করি, তিনি নিজেই আশঙ্কার মধ্যে ছিলেন যে এ গ্রন্থ পাঠ করে ক্ষমতাশালীরা কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন!

প্রাচীন সংস্কৃত সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন তত্ত্বের জন্য নানা মত রয়েছে, নানা রকম জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাও আছে। তারপরও পণ্ডিত ব্যক্তিরা সবাই একমত যে জ্ঞানার্জনের জন্য রাষ্ট্র বা সরকারের বিজ্ঞান একটি অপরিহার্য ক্ষেত্র। বৃহস্পতির মত, উসানের মত, মনুর মত এবং কৌটিল্যের অভিমত এগুলোর উদাহরণ। কৌটিল্য বলেন, সুখের মূল হচ্ছে ধর্ম (নীতি), ধর্মের মূল অর্থে, অর্থের মূল সঠিক সরকারি ব্যবস্থাপনায়, সঠিক সরকারি ব্যবস্থাপনার মূলে থাকে বিজয়ীর অন্তর নিয়ন্ত্রণ এবং তার মূলে থাকে মানবতা।

উসানের মত অনুসারে একমাত্র প্রয়োজনীয় জ্ঞান হচ্ছে সরকারের বিজ্ঞান। কারণ, অন্য কোনো বিজ্ঞানই এ বিজ্ঞান ছাড়া বাঁচতে পারে না। বৃহস্পতির মতে, জ্ঞানক্ষেত্র দুটি: একটি সরকারসম্পর্কিত বিজ্ঞান, অপরটি অর্থনীতি। মনু তার সঙ্গে বেদকে যুক্ত করেছেন। অর্থশাস্ত্ৰ চারটি জ্ঞানক্ষেত্রের কথা বলেছে। বেদ, আণবিক শক্তি (সংখ্যাদর্শন, যোগ ও লোকায়ত), সরকারের বিজ্ঞান ও অর্থনীতির বিজ্ঞান। অর্থশাস্ত্র মনে করে, এ চার রকমের জ্ঞান থেকে অন্য সব জ্ঞানসম্পদ অর্জন এবং মানুষের অগ্রগতি সাধিত হয়।

বেদ ধর্ম ব্যাখ্যা করে (কোনটি সঠিক, নৈতিক ও আদর্শিক), অধর্মও ব্যাখ্যা করে। বেদ বার্তা বা ব্যাখ্যা দেয় সম্পদ কীভাবে সৃষ্টি হয়, সম্পদ কীভাবে ধ্বংস হয়। এটা আসলে সরকারেরই বিজ্ঞান, যা ন্যায়-অন্যায় ও দর্শন ব্যাখ্যা করে, বলে বিজ্ঞানের আলো কী, জ্ঞানের উৎস কোথায়, মহৎ গুণের পথপ্রদর্শক কে এবং সব রকম কর্মকাণ্ডের অর্থ-অনর্থ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়।

রাজা সম্পর্কে অর্থশাস্ত্র বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। সেরা রাজা হচ্ছেন রাজাঋষি, প্রাজ্ঞরাজা। তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন এবং কখনো প্রলোভনে পড়েন না। তিনি সব সময় জ্ঞানচর্চা করেন, নিজের চিন্তাকে কর্ষণ করেন। তিনি মূর্খ এবং কার্যকর ও দুষ্টু প্রকৃতির উপদেষ্টাদের উপেক্ষা করেন। তাঁর সত্যের সঙ্গে সংযোগ, বড়দের সঙ্গে সংযুক্তি। তিনি জনগণ ও দেশের নিরাপত্তা জোরদার করেন এবং জনগণের কল্যাণ সাধন করেন। তিনি তাঁর প্রজাদের ক্ষমতায় ও উন্নয়নে কাজ করেন এবং অহিংসার চর্চা করেন। তিনি অতি সাধারণ জীবন যাপন করেন এবং ক্ষতিকর লোকদের ও ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলেন। তিনি অন্যের স্ত্রী থেকে নিজেকে দূরে রাখেন এবং অন্যের সম্পদের জন্য ব্যাকুল হন না। রাজার ছয়টি শত্রু আছে—কাম, ক্রোধ, লোভ, আত্মগর্ব বা অহংকার, একরোখামি এবং শক্ত বা অতি শক্ত অবস্থান। ঋষিরাজা এ শত্রুদের এড়িয়ে চলেন। তিনি নমস্য, রাজা বলে নয়, ন্যায়পরায়ণ বলে।

এই পর্যন্ত বলে বক্তা জল পান করলেন। শ্রোতাদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন অনুরণিত হলো। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চাণক্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, কৌটিল্য কথা তো ভালোই বলেছেন।

বক্তা আবার কথা শুরু করলেন। আবার সবাই চুপ হয়ে গেলেন।

ভবিষ্যতে রাজা হবেন, এমন যুবরাজদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগেই তৈরি করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন তো অবশ্যই রয়েছে। উপদেষ্টা, রাজকর্মচারী ও সরকার পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কৌটিল্য বলেন, রাজার নিজেরও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। তিনি উন্নয়ন করবেন, কিন্তু উন্নয়ন কীভাবে করতে হয়, তা জানবেন না, তা হয় না। উন্নয়ন প্রশাসন, বিচার প্রশাসন, সাধারণ প্রশাসন সম্পর্কে তাঁর পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে।

তিনি জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন উপদেষ্টা নিয়োগ দেবেন, যার প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা তিনি জানবেন ও শ্রদ্ধা করবেন। তিনি রাষ্ট্রের মূল কর্মচারীদের কীভাবে নিয়োগ দেবেন? কৌটিল্য বলেন, প্রথমে তিনি বিকল্পসহ একটি তালিকা তৈরি করবেন। তালিকায় থাকবে রাজার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত সৎ ও সামর্থ্যবান লোকজন। বিভিন্ন মতের হতে পারেন এঁরা, কিন্তু সং ও জ্ঞানী হতে হবে। অতঃপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ লোকজনের পরামর্শ নেবেন তাদের নিয়োগের ব্যাপারে। ভরদ্বাজ পরামর্শ দিয়েছেন সততা ও জ্ঞানের মাপকাঠিতে মূল কর্মচারীদের নির্বাচন করতে। কৌনপদত্ত বলেছেন, বংশ দেখে নিতে হবে। বিশালক্ষের মতে, রাজা তাদেরই নিয়োগ করবেন, যাদের নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবেন। পরাশর সতর্ক করে বলেন, ওই সব আকামা লোকদের নেওয়া যাবে না। কারণ, এরাই রাজাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করবে। কেউ কেউ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, তাত্ত্বিক জ্ঞান, চারিত্রিক গুণ কোনো অবস্থায়ই প্রাথমিক নির্বাচনের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। কৌটিল্য বলছেন, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে রাজা তাঁর রাজকর্মচারী নিয়োগ দেবেন। অমাত্য (মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা) নিয়োগ দেবেন তাঁর সক্ষমতা ও পূর্বে স্থাপিত দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করে। তাঁর অতীত ভূমিকায় স্বচ্ছতা ও মূল্যবোধের প্রতিফলন থাকতে হবে। অমাত্যরা হবেন ভালোভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁদের থাকবে ক্ষুরধার স্মরণশক্তি, হবেন সাহসী, ভালো বক্তা, দক্ষ, তাত্ত্বিক ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন। তাঁদের থাকবে নিষ্কলুষ চরিত্র, উত্তম স্বাস্থ্য, এঁরা হবেন দয়ালু, লোকহিতৈষী, কর্মোদ্যোগী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দীর্ঘসূত্রতামুক্ত, প্রায়শ পরিবর্তনশীল চিন্তা বা সিদ্ধান্তমুক্ত, ঘৃণামুক্ত, শত্রুভাবাপন্নমুক্ত, ক্রোধমুক্ত ও ধর্মানুরক্ত। যার এসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি বা একাধিক অনুপস্থিত থাকবে, এঁদের উচ্চ পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, বড়জোর নিম্ন পদের কথা ভাবা যেতে পারে।

কৌটিল্য বলেন, তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে, তাঁদের অধীনে কাজ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাদের ক্রমাধিকারতন্ত্রে আনুগত্য বা আধিপত্যপরম্পরায় কর্তৃত্বের জন্য নিবেদিত হতে হবে।

কর্মচারীদের কঠোর শাসনের মধ্যে রাখতে হবে। অসৎ কর্মচারীদের অবশ্যই আটক করে শাস্তি দিতে হবে। অসৎ লোকেরা দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে কখনোই কাজ করবে না। অসৎ লোকদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, অর্থাৎ রাজস্ব আদায় ও কোষাগারে রাখা যাবে না। সর্বোচ্চ পর্যায়ে মন্ত্রীদের সততায় পরীক্ষিত হতে হবে। সাফল্যজনকভাবে সব পর্যায়ে সততার পরীক্ষা প্রমাণযোগ্য হতে হবে। সাফল্যজনকভাবে নিজের পরিশুদ্ধতার জন্য উপদেষ্টা, পুরোহিত ও আধ্যাত্মিক গুরু থাকতে হবে। পুরোহিতকে বেদজ্ঞানে ও বেদের ছয় অঙ্গে শিক্ষিত হতে হবে।

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে থামলেন বক্তা। আবার জল পান করলেন। সম্রাট চাণক্যকে মৃদুভাবে কী যেন বললেন। চাণক্য বক্তাকে রাজনৈতিক অসন্তোষ বিষয়ে কথা বলে বক্তব্য শেষ করার নির্দেশ দিলেন।

ভালো লোকদের প্রতি সরকারের অবজ্ঞামূলক আচরণ, দুষ্টু লোকদের আলিঙ্গন, সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা ও মানসিক চাপ বাড়ায়। যখন কর্মচারীরা নজিরবিহীন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ান অথবা আতঙ্ক সৃষ্টি করেন, তখন রাজনৈতিক অসন্তোষের জন্ম হয়। রাজা যখন ধর্ম ত্যাগ করেন, যা করা শোভন নয়, তা করেন; যা করা শোভন, তা করেন না; যা দেওয়া উচিত, তা দেন না এবং যা দেওয়া উচিত নয়, তা প্রদান করেন, রাজা তখন প্রজাদের উদ্বিগ্ন করে তোলেন এবং নিজে অপছন্দের পাত্রে পরিণত হন।

প্রজাদের জরিমানা করা হয় কিংবা সাজা দেওয়া হয়, যখন তাদের সাজা দেওয়া কিংবা অমর্যাদা করা উচিত নয়। যাদের সাজা দেওয়া প্রয়োজন, সাজা দেওয়া হয় না; যাদের আটক করা দরকার, করা হয় না; যাদের আটক করা উচিত নয়, আটক করা হয়, তখন রাজা এবং তাঁর কর্মচারীরা প্রজাদের মানসিক চাপ ও অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ান। যখন কর্মচারীরা চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হয়, ডাকাতদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা বাদ দিয়ে তাদের দুষ্কার্যকে উপেক্ষা করা হয়, তখন প্রজাদের অসহায় মনে হয়, এরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং সরকারের ওপর থেকে আস্থা ও শ্রদ্ধা হারায়। যখন সাহসী কর্মকাণ্ডকে কালিমা লেপন করা হয়, গুণগতভাবে নিষ্পন্ন কাজকে অবমূল্যায়ন করা হয়, অগ্রগামীদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা হয়, সম্মানিত ব্যক্তিদের অসম্মান করা হয়, যখন প্রত্যাশিত ও উপযুক্ত ব্যক্তি পুরস্কৃত হয় না, স্বজনপ্রীতির জন্য অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করা হয়, তখন প্রজাগণ উদ্বুদ্ধ নয়, হতাশ, নিপীড়িত, হতোদ্যম হয়ে পড়ে ও আনুগত্যহীন হয়ে যায়।

চাণক্য উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিলে সবাই তাঁকে অনুসরণ করলেন। চাণক্য বললেন, কৌটিল্য যথার্থই রাজা, রাষ্ট্র, সরকার ও প্রজাদের সম্পর্ক বিষয়ে যৌক্তিক ও বাস্তবধর্মী কিছু কথা বলেছেন। মন্ত্রী, উপদেষ্টা, রাজকর্মচারী নিয়োগ এবং তাদের কর্ম সম্পর্কে বলা কথাগুলোর গুরুত্ব অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে। বাগান থেকে যেমন একজন একটির পর একটি পাকা ফল পাড়ে, তেমনি রাজাকেও তাঁর রাজ্য থেকে পাকা ফল আহরণ করতে হয়, ভয়ের জন্য, ভুলের জন্য তাঁর ধ্বংস, তাই তাঁকে কাঁচা ফল আহরণ পরিত্যাগ করতে হবে, অন্যথায় বিপ্লব উৎপন্ন হবে, বিদ্ৰোহ সৃষ্টি হবে। কৌটিল্য এ কথাটিও বলেছেন চিন্তাভাবনা করেই। তাঁর ভয় ছিল, তিনি নিজের পরিচয় গোপন করেছেন। তক্ষশীলা বুদ্ধিজীবীদের অধিরাজত্ব, কিন্তু তার বাইরে তিনি নিরাপত্তাহীন, সবাই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত নন যে সবকিছু উদারতার সঙ্গে দেখবেন। এবারে মহামান্য সম্রাট অনুগ্রহ করে কিছু বলবেন।

সম্রাট রীতিসিদ্ধভাবে শুরু করলেন, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আচার্য চাণক্য, আচার্য ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। আমি কৃতার্থ বোধ করছি তক্ষশীলার মতো একটি বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে পেরে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভারতবর্ষের প্রধান বাতিঘর। এখানে যাঁরা বাতি জ্বালান, আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করেন, এঁরা সবাই শ্রদ্ধাই। এখানে আচার্য চাণক্য ছাড়াও শিক্ষক ছিলেন আচার্য পাণিনি ও আচার্য চরক। আমার সৌভাগ্য, আমি দেশবরেণ্য আচার্য চাণক্যকে দেখতে পেয়েছি। আমি অন্য দুজনের প্রত্যক্ষ শিক্ষার্থী নই বটে, কিন্তু এঁরা জাতীয় শিক্ষক, তাই আমারও শিক্ষক। আচার্য চাণক্য এখন আমার প্রধান উপদেষ্টা হলেও প্রতিদিনই তিনি আমাকে শেখাচ্ছেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, আজও একই উদ্দেশ্যে তিনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।

এ কথা শুনে চাণক্যসহ সবাই হেসে দিলেন। সম্রাট আবার বলতে শুরু করলেন, প্রচুর রাজকুমার এবং ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সন্তান এখানে গুরুর কাছে শিখতে আসে। বেদ ও বেদান্ত পাঠের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয় আরও অনেক বিজ্ঞান বা বিদ্যা শিখতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান দু-তিনশত বছরে শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছে এবং ভারতবর্ষ ও তার বাইরেও যে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করে আলোকিত মানুষ তৈরি করেছে, তা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, গৌরব করতে পারি।

কৌটিল্য নিঃসন্দেহে একজন অভিজ্ঞ পণ্ডিত। তাঁর প্রতিটি কথা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। প্রতিটি কথাই গুরুত্বপূর্ণ। আমি তাঁর পুরো গ্রন্থটিই পাঠ করতে চাই। আচার্য চাণক্য সে ব্যবস্থা নেবেন। আমার সাম্রাজ্যে কৌটিল্যের কোনো ভয় নেই, আমি নিজেই তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। বলে খুব হাসলেন সম্রাট।

আমাদের কাছে কঠিন ব্যাপার হচ্ছে আমরা যা লিখি, তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারা। রাজার ক্ষেত্রে তো তা আরও কঠিন। কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্রে’ যা বলেছেন, বাস্তবে তিনি রাজা হলে কি তা বাস্তবায়িত করতে পারতেন? পারতেন না, সে কথা আমি বলব না। আমরা জানি, বাস্তব অনেক বেশি কঠিন। তাহলে কি তাঁর কথাগুলোর মূল্য নেই? অবশ্যই আছে। এই গ্রন্থ আমার দৃষ্টিতে বেদতুল্য। মানুষের লিখিত কোনো গ্রন্থের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।

তক্ষশীলার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যুগ যুগ ধরে আচার্যদের নিয়ে, শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্বশাসিত ও ক্ষমতাশালীদের প্রভাবমুক্ত যে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেছে, তাদের অধিরাজত্ব মৌর্য সম্রাটদের শাসনকালে অক্ষুণ্ণ থাকবে, এ প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদের দিচ্ছি। আমি জানি, পণ্ডিত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজা ও তাঁর রাজ পারিষদের একটি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক তৈরি হয়। পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রশ্রয়ে প্রজাদের মধ্যে বিপ্লব উৎপন্ন হয়। সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান না দিলে তা হওয়াই স্বাভাবিক। মৌর্যরা পণ্ডিত, আচার্য, দার্শনিক প্রমুখ গুণী ব্যক্তিদের অবশ্যই সম্মান করবে, তাঁদের স্থান দেবে সবার ওপরে। ধর্মীয় পুরোহিত, ব্রাহ্মণ, সন্ন্যাসী, শ্রুতকেবলী—এঁরা সবাই স্ব স্ব স্থানে মর্যাদার উচ্চ আসন লাভ করবেন। তক্ষশীলা সব সময়ই সম্রাটের আনুকূল্য লাভ করবে। সম্রাট তাঁর বক্তব্য শেষ করার আগে বক্তাকে ডেকে পাঠালেন এবং নিজের গলা থেকে একটি মুক্তোর মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দিলেন।

সর্বত্র সম্রাটের জয়ধ্বনি শোনা গেল। আচার্য চাণক্যের চোখেমুখে তখন পরিতৃপ্তির হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *