মৌর্য – ২৩

২৩

চন্দ্রগুপ্তের সন্তান হওয়ার কথা গ্রিক শিবিরে গুপ্তচররা জানিয়ে দিয়েছে। তার অর্থ এই, চন্দ্রগুপ্ত এখনই গ্রিকদের আক্রমণ করছেন না। তাতে গ্রিকরা আরও সৈন্য সংগ্রহ ও যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে ভাবতে পারবে।

একজন জেনারেল বললেন, এখন এই সুযোগে আমরাই তাদের আক্রমণ করে বসি।

সেলুকাস বললেন, তুমি কি পিতা হও নি? এর আনন্দটা তাকে উপভোগ করতে দাও। এ ছাড়া আমাদের অবস্থান ও পরিকল্পনা আক্রমণাত্মক নয়, প্রতিরক্ষামূলক। মূল যুদ্ধকৌশলের সঙ্গে তা যায় না। ওরা নিশ্চয় সেনাবাহিনীকে ঘুমোতে দিয়ে জন্মোৎসব করছে না। ভূপ্রাকৃতিক কারণে আমরা আক্রমণ করলে আমাদেরই ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে। আমাদের পেছনে ঘরের শত্রুরা ওত পেতে বসে আছে সুযোগের জন্য, তাদের আমরা সুযোগ তৈরি করে দিতে পারি না। আমাদের বর্তমান কৌশল হবে প্রতিরক্ষামূলক এবং এটাই চূড়ান্ত। আমরা বরং সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে একটা অভিনন্দনবার্তা এবং প্রিন্সের জন্য কিছু উপহার পাঠিয়ে দিই।

কর্নেলিয়া শেষের কথাটা শুনতে পেলেন। ভেতরে প্রবেশ করেই বললেন, বাবা কাকে তুমি উপহার পাঠাচ্ছ?

সেলুকাস বললেন, মৌর্য শিবিরের একটা সুখবর পেলাম কর্নেলিয়া। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পুত্র সন্তান হয়েছে, ওরা চল্লিশ দিনব্যাপী জন্মোৎসব পালন করছে।

কে বলল?

গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া গেছে।

এ কথা শুনে কোনোরূপ আগ্রহ না দেখিয়ে কর্নেলিয়া নিজের কক্ষে চলে এলেন। তাহলে সম্রাট বিবাহিত? কয়টি স্ত্রী আছে তাঁর? প্রেমপত্র পাঠানোর অর্থ কী? প্রেম প্রেম খেলাও কি তাঁর শখ না নেশা? রাজকুমারী অনেক বড় আঘাত পেয়েছেন। কষ্টে তাঁর হৃদয় ভেঙে কান্না চলে এল। বালিশে মুখ লুকিয়ে তিনি অনেক কাঁদলেন। তাহলে চন্দ্রগুপ্ত তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন? প্রতারক, শঠ, প্রবঞ্চক। কেন সে আত্মপরিচয় দিল। না জেনে যে প্রেম সত্য ছিল, তা আজ মিথ্যে হয়ে গেল। মিথ্যে, সবই মিথ্যে। তাঁকে প্রতিশোধ নিতে হবে, মধুর প্রতিশোধ। যে দূত সম্রাটের উপহার নিয়ে যাবে, তাকে ডেকে পাঠালেন কর্নেলিয়া। নিজেও একটা অভিনন্দনপত্র লিখলেন সম্রাটকে। উপহারটা সম্রাটকেই পাঠালেন।

দরজা বন্ধ করে একাকী দিন কাটালেন রাজকুমারী। এত বড় ভুল তিনি কী করে করলেন, এ কথা ভেবে নিজেই নিজের চুল টানলেন। সঙ্গে আনা চন্দ্রগুপ্তের পত্রগুলোয় চোখ বোলালেন। চিঠিই এখন স্মৃতি। স্মৃতিগুলো কি প্রতারণার? ভাবতে পারছেন না তিনি। মন শক্ত করতে পারছেন না। শুধু এপাশ-ওপাশ করছেন। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

এ সময় কক্ষের দরজায় কারও করাঘাত শোনা গেল। কর্নেলিয়ার দরজা খুলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। দুবার তিনবার করাঘাত। শেষে শোনা গেল কণ্ঠস্বর, কর্নেলিয়া আমি লাউডিস, দরজা খোলো।

কর্নেলিয়া দরজা খুললেন, চোখেমুখে হতাশা আর ক্লান্তির ছাপ।

তোর এ অবস্থা কেন, কর্নেলিয়া?

দিদি তুই বস, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। লাউডিসের সঙ্গে তার মেয়ে এসেছে। সারাক্ষণই সে এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এখানেও ব্যস্ত আছে। সাধারণত কন্যাশিশুদের এত চঞ্চল হতে দেখা যায় না।

লাউডিস কক্ষটায় চোখ বুলিয়ে কন্যা হারমিজকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, কর্নেলিয়া আন্টিকে কেমন মনে হয় তোমার?

আন্টি আমাকে হ্যালো বলে নি কেন?

ঘুম থেকে উঠেছে তো, তাই। তুমি কেন কথা বলো নি?

ভুল হয়ে গেছে মা।

ঝটপটই ফ্রেশ হয়ে এলেন কর্নেলিয়া। এবারে হাস্যোচ্ছল মুখশ্রী। হারমিজ সোনামণি আমার। তুমি নাকি গান করো, নাচ করো, নাটক করো—দেখাবে আমাকে এক এক করে? বলে কাছে টেনে নিলেন এবং লাউডিসের পাশে বসলেন।

হারমিজ ঘাড় কাত করে বলল, হ্যাঁ। তাহলে শুরু করো, বললেন লাউডিস। হারমিজ গান, নাচ, নাটক—সবই করল। তার অভিনয় বেশি মুগ্ধ করল কর্নেলিয়াকে। হাততালি দিয়ে বললেন, আর্কিমেডেস ঠিকই বলেছিল।

তাকে কোথায় পেলি?

ঝিলামের আপামা প্রাসাদে সে বেড়াতে গিয়েছিল।

সে তোকে পছন্দ করে।

করতে পারে। কিন্তু আমি তা চাই না।

কেন?

দিদি, জগৎটা বড় বিচিত্র। আমি জীবনের কিছু কিছু অভিজ্ঞতায় নিজের ওপরই বিরক্ত।

তোর প্রাণবন্ত রূপ দেখে কখনো তা মনে হয় নি, এখন এসব বলছিস কেন? তোর কি কোনো সমস্যা, কর্নেলিয়া?

আমি ঠিক আছি।

না, তুই ঠিক নেই। তোকে প্রথম দেখেই সে কথা মনে হয়েছে আমার। আমাকে কি বলা যায়?

কী বলব দিদি তোকে, যে ব্যথা লুকিয়েছিল এত দিন অন্তরের ভেতর, তা আবার আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার মতো বের হয়ে আসছে।

কিসের কথা বলছিস?

ভাই এন্টিওকাস, কী করে পারল মাকে বিয়ে করতে? সত্মা কি মা নয়?

এত দিন পর আবার এ কথা কেন?

তুই কি তা মেনে নিয়েছিস?

লাউডিস তা কখনোই মেনে নেয় নি। আপন ভাই তার, কিন্তু এ কাজের জন্য ভাইকে কখনো ক্ষমা করে নি। সে ঘটনা মনে হলো তার। বাবা সেলুকাস জানতে পারেন ছোট মার সঙ্গে এন্টিওকাসের গভীর প্রেম। হয়তো তাঁদের শারীরিক সম্পর্কও হয়ে গেছে। বৃদ্ধ বয়সে সেলুকাস আপামার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন সিরিয়ার কন্যা স্ট্রেটোনিসকে। তাঁদের একটি কন্যাসন্তান হয়। তার নাম রাখেন শাশুড়ির নামে–ফিলা। এই ফিলাই কর্নেলিয়া। প্রিন্স এন্টিওকাস এমন আচরণ করে যে সে স্ট্রেটোনিসকে ছাড়া বাঁচবে না। সেলুকাস যেকোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে এন্টিওকাসের সমবয়সী স্ত্রীকে পুত্রের সঙ্গে চলে যেতে সম্মতি দেন এবং সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের একটি প্রদেশের শাসনভার দেন তাকে।

এ কলঙ্কময় ঘটনা অনেককাল ভুলেছিলেন লাউডিস ও কর্নেলিয়া। কর্নেলিয়া সে প্রসঙ্গ তোলায় লাউডিসও ভেঙে পড়েন। ভাইয়ের এ অনৈতিক কর্ম তাঁকে সাংঘাতিকভাবে আহত করেছে।

আমি দুঃখিত দিদি, সে প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলাম বলে।

না, দুঃখ করার কিছু নেই বোন। ইডিপাসদের জন্ম যুগে যুগে হয়েছে গ্রিকদের মধ্যে।

রাজা ইডিপাস না জেনে মাকে বিয়ে করেছিল, আর এন্টিওকাস—ভাবতে পারছি না, দিদি | বাদ দে সে প্রসঙ্গ। ‘কে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’?

লাউডিস উঠে যাচ্ছিলেন। কর্নেলিয়া থামালেন তাঁকে। দিদি, তুই বস। আরও কথা আছে। বলে কাঁদলেন কর্নেলিয়া। পরে চন্দ্রগুপ্তের লেখা শেষ চিঠিটি লাউডিসকে পড়তে দিলেন।

এ তুই কী করেছিস?

গ্রিসের সাম্রাজ্য থেকে পালাতে চেয়েছিলাম, দিদি, ওই অধ্যায়টা ভোলার জন্য। কিন্তু বিধি বাম।

বিধি বাম কেন?

আজ জানতে পারলাম সম্রাট বিবাহিত। তিনি চল্লিশ দিনব্যাপী সন্তানের জন্মোৎসব পালন করছেন।

সম্রাট অবিবাহিত, সে কথা ভাবলি কী করে?

আমার ভুল হয়ে গেছে, দিদি।

তুই কি তাকে ভালোবাসিস?

আমি তাকে তীব্র ঘৃণা করি, ঘৃণা। সে একটা প্রতারক

তুই তাকে ঘৃণা করিস না কর্নেলিয়া, ভালোবাসিস। এখন তোর সাময়িক খারাপ লাগছে, পরে ধীরস্থিরভাবে চিন্তা কর। যদি সত্যিই চন্দ্রগুপ্তকে ভালোবাসিস, আমি তোর সঙ্গে আছি। তুই কি কখনো সম্রাট সম্পর্কে জানতে চেয়েছিস?

সে সম্রাট, এটাই তো জানলাম শেষ চিঠিতে।

হতভাগী! ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রচুর সময় আছে।

তুই জানিস না?

কী?

ওরা গ্রিক সাম্রাজ্য আক্রমণ করছে।

ট্রয়ের যুদ্ধের মতো হেলেনকে উদ্ধার করতে?

মজা করিস না তো দিদি, আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত। আমি বোধ হয় তরবারি নিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়ব।

এতক্ষণ কোনো কথা না বলে এটা-ওটা করছিল হারমিজ। এবার যুদ্ধের কথা শুনে বলল, খালামণি, আমিও তোমার সঙ্গে যুদ্ধে যাব।

বেশ, যেয়ো। তোমার মা যুদ্ধে যাওয়ার সাহস রাখে না। জেনারেলের স্ত্রী। তার কন্যা তুমি, অবশ্যই যুদ্ধে যাবে।

শোন কর্নেলিয়া, তুই তো এখন হেলেন হয়ে গেছিস, তুই সবকিছু একটা ঠান্ডা মাথায় গভীরভাবে ভাব। পরে আমরা চিন্তা করব কী করা যায়।

মা, পাগলামিটা কী, প্রশ্ন করে হারমিজ।

তোর খালামণির কাছ থেকে জেনে নে।

খালামণি, বলো না পাগলামি কী?

তোর খালামণি কেবল নতুন নতুন নাম পায়। একসময় ছিল ফিলা, পরে নিজেই নাম বদলে রাখল কর্নেলিয়া। এখন হেলেন।

খুব সুন্দর নাম, মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *