মৌর্য – ২২

২২

যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। এই সময় সম্রাজ্ঞী দুরধরা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাজবৈদ্য ডাকা হলো। তিনি সম্রাজ্ঞীকে পরীক্ষা করে বললেন, সম্রাট, সম্রাজ্ঞীর সন্তান প্রসবকাল সমাগত। প্রসব যন্ত্রণা হচ্ছে তাঁর।

সম্রাটের প্রাসাদ ও রাজপুরীতে স্তব্ধতা। সম্রাটের কী সন্তান আসছে, রাজকুমার, না রাজকুমারী, এ নিয়ে কৌতূহল সবার। রাজকুমার হলে তিনি হবেন এই সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী।

নারীরাজবৈদ্য তাঁর সহকারীদের বললেন, শুধু জল ভাঙছে। সন্তানের মাথা দেখা যাচ্ছে না। এভাবে জল ভাঙতে থাকলে জলশূন্য হয়ে পড়বেন সম্রাজ্ঞী। তা বিপজ্জনক। তোমরা তাঁকে জল পান করাও বেশি বেশি করে। সম্রাজ্ঞী কী তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। সম্রাট বাইরে পায়চারি করছেন নানা দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে। কখন তিনি সন্তানের কান্না শুনবেন?

এভাবে অস্বাভাবিক বিলম্বের জন্য সম্রাটের এক দূত ছুটে গেল অরণ্যে এক আদিবাসী দিগম্বর ওঝার কাছে। প্রসবের জলপড়া দেন সে ওঝা। জলটা নিতে হয় চলমান কোনো জলের নালা থেকে। সাতটি কচুপাতায় খালাসের জল নিয়ে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিতে হয় তাতে। ওঝা মন্ত্রপাঠ করেন ঘরের চাল থেকে যে স্থানে জল পড়ে, সে স্থানে বসে। আরেকজন কচুপাতায় জল নিয়ে তাঁর সামনে ধরে বসে থাকেন। মন্ত্র পড়ে তিনি সে জলে সাতটি ফুঁ দেন।

এদিকে সম্রাজ্ঞী যন্ত্রণায় খুবই অস্থির হয়ে উঠেছেন। জলও স্পর্শ করতে চাইছেন না। দূত এ সময় ওঝার মন্ত্রপড়া জল নিয়ে এল। সম্রাজ্ঞী এখন জলশূন্যতায় ভুগছেন। শরীরের শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। তাঁকে জোর করেই মন্ত্রপড়া জল পান করানো হলো। জল পানের পর সম্রাজ্ঞী শক্তি ফিরে পেলেন এবং এবারের চেষ্টায় সফল হলেন। পৃথিবীতে এসেই বাচ্চা চিৎকার করে উঠল।

উপস্থিত সবার সঙ্গে প্রাসাদও যেন আনন্দে ফেটে পড়ল। পুত্রসন্তান হয়েছে সম্রাটের।

এ সংবাদ শুনে ছুটে এলেন বরাহ মিহির। সম্রাটের সঙ্গে সম্রাজ্ঞীর কক্ষে প্রবেশ করলেন। শিশুটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এই রাজকুমার শত বছর বাঁচবেন। জগৎ আলো করে মৌর্য সাম্রাজ্যের অধিপতি হবেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের উচ্চপর্যায়ের সবাই শিশুকে আশীর্বাদ এবং সম্রাটও সম্রাজ্ঞীকে অভিনন্দন জানাতে এলেন।

সম্রাট চল্লিশ দিনব্যাপী উৎসবের ঘোষণা দিলেন।

(সম্রাটের রাজপুত্রদের ঘটা করে মাসের পর মাসব্যাপী জন্মোৎসব পালনের কথা আছে বিশ্ববিখ্যাত লেখিকা মুরাসাকি শিকিবুর ডায়েরিতে এবং অতীশ দীপঙ্করের পিতা কল্যাণচন্দ্র ও দাদা শ্রীচন্দ্রের জন্মোৎসবের কথা আছে মহারাজ শ্রীচন্দ্রের শ্রীহট্ট তাম্রশাসনে। উভয়ের সময়ই একাদশ শতক।) ধন-সম্পদ, স্বর্ণমুদ্রা বিলালেন দাস-দাসী এবং প্রজাদের মধ্যে। মহাভোজ দেওয়া হলো পাটালিপুত্র নগরের লোকজনকে। এতে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ অংশ নিল। কিন্তু আচার্য ভদ্ৰবাহু এলেন না। সম্রাট লোক পাঠালেন জৈন মঠে। তবু এলেন না। বরাহ মিহির তার সুযোগ নিলেন। সম্রাটকে ভদ্রবাহুর বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুললেন, বললেন, ভদ্রবাহু আপনি ও আপনার সন্তানের মঙ্গল চান না, তাই আসেন নি। সম্রাটের প্রাসাদ পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন। আপনাকে জানান নি পর্যন্ত। মহামান্য সম্রাট যুবরাজকে আড়ালে কোথাও রাখুন। অনিষ্ট হতে পারে। তবে আমি আছি। কোনো ভয় নেই আপনার। ওর কিছুই হবে না।

এ রকম অবস্থায় একদিন চাণক্য গেলেন জৈন মঠে। ভক্তরা উঠে গেলে ভদ্রবাহুর সঙ্গে একান্তে কথা বললেন।

সম্রাটপুত্রের কথা বলছেন? তার আয়ু মাত্র সাত দিন।

অবাক হয়ে চাণক্য বললেন, বলছেন কী, আচার্য, মাত্র সাত দিন বাঁচবেন রাজকুমার!

আমি তো উৎসব করতে সম্রাটকে না করতে পারি না। আমি পারি উৎসবে অংশ না নিতে।

কোনোভাবেই কি…

আপনি বলছেন এ কথা?

দেখুন, বিশ্বাসের সঙ্গে বাস্তব প্রয়োজন কতটা আড়াআড়িভাবে চলে। আমি জানি পূর্বনির্ধারিত নিয়তিকে, ভাগ্যকে অতিক্রম করা যায় না, অথচ বলতে যাচ্ছিলাম কী! আমিও উৎসবের বিরুদ্ধে ছিলাম। কিন্তু সম্রাটকে বলি নি। কারণ, সম্রাট তা শুনবেন না। আমাকে বরং গ্রিক আক্রমণের আশঙ্কায় বাড়তি নিরাপত্তাসহ অনিদ্রায় সময় কাটাতে হচ্ছে।

আমার শিষ্যদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্তকে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। কারণ, তার নিরহংকার মনোভাব, বুদ্ধিমত্তা, একনিষ্ঠতা, ধ্যানজ্ঞান ও বিশুদ্ধচিত্ততা আমাদের মুগ্ধ না করে পারে না।

আমি আপনার সঙ্গে একমত। সেই শৈশব থেকে তাকে দেখছি। পাপের পথে সে হাঁটবে না, শুধু নিজেকেই রক্ষা করবে না, অন্যদেরও বাঁচাতে চাইবে। কোনো শঠতা-কূটকৌশল তাকে স্পর্শ করে না। আমি যা অনায়াসে করি। আপনি তার আত্মাটাকে আরও শুদ্ধ করে দিয়েছেন।

আপনার থেকে যা পেয়েছে, সততার সঙ্গেও তার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার চলে, সেটা সে প্ৰমাণ করেছে।

ঠিক বলেছেন। আমি হাতে ধরে ধরে তাকে রাজনীতি শিখিয়েছি। সবই জানে, কিন্তু গ্রহণ করেছে যেটা সে পছন্দ করে, যার জন্য গায়ে কোনো ময়লা লাগে নি তার। তারপরও মানুষের স্বভাবগত কিছু ভুলভ্রান্তি থেকে যায়। কাম, ক্রোধ, বাৎসল্য—এসবের ঊর্ধ্বে নয় কেউ। সম্রাটও তার ব্যতিক্রম নয়। এখন পুত্রবাৎসল্যে সব ভুলে আছে। এ বাৎসল্য-স্নেহ তাকে সাময়িক অন্ধ করে দিয়েছে। আপনি ক্ষমা করে দিন।

চাওয়ার আগেই যাকে ক্ষমা করা যায়, তার জন্য আপনি আচার্য ক্ষমা চাচ্ছেন। তার প্রতি আপনার স্নেহ-ভালোবাসা কখনোই শেষ হওয়ার নয়।

.

সম্রাট মহা আনন্দে আছেন। হঠাৎ করেই আনন্দের মধ্যে তার শৈশবের কথা মনে হলো। রাজপরিবারে নাকি জন্মেছিলেন। কিন্তু রাজপ্রাসাদে তাঁর স্থান হলো না গণিকা মায়ের সন্তান বলে। মা আজ কোথায় আছেন। কেন সঙ্গে নিলেন না, এক শিকারির কাছে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। আমাকে তাঁর সন্তান পরিচয় দিতে চাইলেন না। এখন তিনিও এ রকম একটি সন্তানের বাবা। তাঁর মায়ের পরিচয় আছে, সম্রাটের মায়ের পরিচয় নেই। কী অদ্ভুত জগৎ! আনন্দের মধ্যেও তাঁর আবেগ ঘন হয়ে উঠল। মাকে যদি আজ কাছে পাওয়া যেত। মা তাঁর কথা জানেন না? একবারও তো আসতে পারতেন। কেন এলেন না? মাকে খুঁজে বের করবেন কীভাবে? তাঁর একটি কথা মাকে জিজ্ঞাস্য আছে। সারা জীবনই চন্দ্রগুপ্ত সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। কখনো কেঁদেছেন। এখন তো কাঁদতেও পারেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *