মৌর্য – ২১

২১

একজন ভারতীয় নারী সম্রাট সেলুকাসের সঙ্গে দেখা করতে চান। গ্রিকদের এক গুপ্তচর তাঁকে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতে সাহায্য করছে। গুপ্তচরের নাম রাস্কিলাস।

তুমি তাকে চেনো বলছ, কত দিন যাবৎ? সেলুকাসের প্রশ্নের জবাবে রাস্কিলাস বলল, দীর্ঘদিন যাবৎ, সম্রাট। প্রয়াত মগধরাজ ধননন্দের মহামন্ত্রী রাক্ষসের স্ত্রী তিনি। মহামন্ত্রী রাক্ষসকেও মৌর্যরা যূপকাষ্ঠে বলি দিয়েছে। তাই তিনি ক্ষুব্ধ এবং প্রতিশোধ নিতে আপনার সাহায্য চাইছেন।

ভেতরে আসতে বলো।

রাস্কিলাস তাঁকে ভেতরে নিয়ে এল।

আপনার পরিচয়? ভালোভাবে তাকিয়ে সেলুকাস প্রশ্ন করলেন।

আমি সর্বাণী দেবী। প্রয়াত মহামন্ত্রী রাক্ষসের স্ত্রী। রাক্ষস ধননন্দের মহামন্ত্রী ছিলেন।

এ তথ্য আমার কাছে আছে। আপনি কী চান আমার কাছে? আশ্ৰয়?

আশ্রয় নয়, মহামান্য সম্রাট। আমি আমার নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখি। আমি মৌর্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে চাই। এ অভিযানে আপনার সামরিক সাহায্যপ্রার্থী।

আপনি কি নন্দরাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষমতা রাখেন? আপনাদের সৈন্যরা পর্যুদস্ত, ছত্রভঙ্গ। আপনাদের নাগরিক লোকজন মৌর্যদের অনুগত হয়ে গেছে। কাদের ভরসায় আপনি যুদ্ধাভিযানে যেতে চান?

নগরের সম্ভ্রান্ত লোকজন মৌর্য সম্রাটকে নয়, এখনো প্রয়াত মহারাজ নন্দের পক্ষেই আছে। আর সৈন্যদের একত্র ও সংগঠিত করা কঠিন কাজ নয়, শুধু আপনার ইঙ্গিত পেলেই আমি তৎপরতা শুরু করব।

অর্থ পাবেন কোথায়? সেনাবাহিনী সংগঠিত করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে।

আমার কাছে প্রচুর গয়না আছে, প্রচুর স্বর্ণমুদ্রাও আছে। জঙ্গলে মাটির নিচে পুঁতে রেখেছি।

তা কি সেনা পোষণের জন্য পর্যাপ্ত?

হিসাব করে রাখি নি। তবে কোনো রাজা-মহারাজারও এত ধন-সম্পদ নেই।

আচ্ছা, আপনি অন্য কক্ষে অপেক্ষা করুন। আমি আবার আপনার সঙ্গে কথা বলব। সৰ্বাণী দেবী কক্ষ থেকে বের হলে সম্রাট গুপ্তচরকে বললেন, তোমাদের তথ্য কী বলে?

মহান সম্রাট, তিনি বড় শৌখিন মন্ত্রীপত্নী। তাঁর একজন অনুচর ছিল চন্দন দাস, গয়না ও স্বর্ণমুদ্রা নির্মাতা ও সরবরাহ সমিতির সভাপতি। তার কাজ ছিল মন্ত্রীপত্নীকে শুধু গয়না ও স্বর্ণমুদ্রা সরবরাহ করা। মন্ত্রীপত্নীর কথা সত্য বলে মেনে নেওয়া যায়। এ ছাড়া সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এখনো নন্দরাজের পক্ষে আছে। তবে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে, নন্দরাজ্য উদ্ধার করে তাঁকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না।

এ নিয়ে তোমাকে পরামর্শ দিতে কে বলেছে?

ক্ষমা করবেন, মহামান্য সম্রাট।

তুমি গিয়ে সর্বাণী দেবীকে পাঠাও।

সর্বাণী দেবী আসার পর সেলুকাস একটু ভাবলেন, পরে বললেন, আপনি আপনার সৈন্যদের সংগঠিত করুন। আমার লোকজন আপনাকে সাহায্য করবে। আর আপনার এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে নিজস্ব লোকদের দিয়ে মৌর্যদের তথ্য সংগ্রহ করা এবং আমাদের সঙ্গে সে তথ্য ভাগাভাগি করা। আমি আপনাকে সাহায্য করব।

রাক্ষসপত্নী খুশি হয়ে ফিরে গেলেন।

সেলুকাস রাস্কিলাসকে আবার ডাকলেন। বললেন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমাদের গোয়েন্দারা এই রমণীর গতিবিধি লক্ষ রাখবে। তাঁকে সার্বক্ষণিক অনুসরণ করবে। ভারতীয় অংশে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। তক্ষশীলায় ব্যবসা আছে, এমন এক গ্রিককে নিয়ে আসবে। আমি তার সঙ্গে কথা বলব।

.

মন্দাকিনী সম্রাটকে গ্রিক শেখাচ্ছেন। সম্রাট মেধাবী, তাই সহজেই ভাষা শিখতে পারছেন। আগেও এ ভাষা সম্পর্কে কিছুটা অভিজ্ঞতা ছিল। ভাষা শিখতে তা তাঁকে সাহায্য করছে। মাঝখানে সম্রাট বললেন, মন্দাকিনী, অনেক দিন হয়ে গেল, পত্রের উত্তর আসছে না কেন?

কবুতরটাও আসে নি, সম্রাট, আমাদের মনে হয় অপেক্ষা করতে হবে।

হেলেনকে তোমার কেমন মনে হয়?

তিনি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছেন, সম্রাট।

সে তো পরিচয় জানার আগে, এখন?

আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, সম্রাট। এ ছাড়া গ্রিকদের তো আক্রমণ করছেনই। যুদ্ধ জয় করে ইলিয়াডের হেলেনের মতো তাঁকে নিয়ে আসবেন।

তুমি হবে তাঁর প্রধান সহচরী।

শুনে মন্দাকিনী মৃদু হাসল। বলল, মহামান্য সম্রাটের আজ্ঞা বহন করেই দাসীর শান্তি। আপনার স্নেহই আমার জন্য আশীর্বাদ।

এখন তুমি এসো, মন্দাকিনী।

মহামন্ত্রী চাণক্য আর প্রধান সেনাপতি বিজয়গুপ্তকে সময় দেওয়া ছিল। এঁরা তিনজন যুদ্ধ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবেন। তার আগে চন্দ্রগুপ্ত ভদ্রবাহুর কথা স্মরণ করলেন। এ যুদ্ধ তাঁকেই পরিচালনা করতে হবে, আধ্যাত্মিক গুরুর এই নির্দেশ। সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা প্রায় ছয় লাখ, এদেরও ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর রাখতে হবে। কাজটা বেশ কঠিন। রাজনীতির কূটকৌশল আর সামরিক যুদ্ধকৌশল এত দিন সম্রাট মহামন্ত্রী চাণক্যের ওপর ছেড়েই দিয়েছিলেন। তাই চাণক্যের প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে কৌশলে।

যুদ্ধে রক্তপাত আছে। তবে অনাবশ্যক রকম রক্তপাত চন্দ্রগুপ্তের পছন্দ নয়। কূটকৌশলের প্রয়োগও তাঁর ইচ্ছাবিরোধী। দুটো ব্যাপারেই চাণক্য উৎসাহী। কূটকৌশল ও রক্তপাতে চাণক্যের ভারি আনন্দ। গ্রিকদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারগুলোর রসায়ন কী হবে, চন্দ্রগুপ্ত এ নিয়ে চিন্তিত। এ ব্যাপারে আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভদ্রবাহুর উক্তি তাঁর ভালো লাগে নি। তাই এখন সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন না।

চাণক্যের আসতে বিলম্ব হচ্ছে ভদ্রবাহুর জন্য। হঠাৎ করেই ভদ্রবাহু চাণক্যকে দেখতে গেলেন। সেদিনের কথাগুলো তাঁকে দারুণভাবে চাণক্য সম্পর্কে ভাবিয়েছে। হোন না চাণক্য কূটকৌশলী, ধূর্ত রাজনীতিবিদ, কিন্তু তাঁর মতো প্রতিভা তো আর নেই। তাঁকে রক্ষা করতে হবে। তাঁর ধর্মমত, তাঁর রাজনৈতিক নেতিবাচক ভূমিকা তাঁর একান্তভাবেই নিজস্ব। ভদ্রবাহু তা পছন্দও করেন না, কিন্তু বহুমুখী প্রতিভার জন্য সমীহ করেন। তাঁকে আত্মঘাতী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হবে না। বাঁচিয়ে রাখতে হবে। হয়তো তিনি কোনো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবেন না। তারপরও খোঁজখবর রাখতে হবে।

এ সময়ে আচার্য ভদ্রবাহুকে পেয়ে চাণক্য খুব খুশি হলেন। প্রধান সেনাপতিকে বললেন, তুমি কিছুক্ষণ পরে আসো।

যুদ্ধের পরামর্শ করছিলেন মনে হয়।

পরামর্শ করতে সম্রাটের ওখানে যাব।

তাহলে আমি এসে বিলম্ব ঘটিয়ে দিলাম।

না না, কিছু বিলম্বে তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই, বরং ভালো হলো যে এ সময়ে আপনার সাক্ষাৎ পেলাম।

আপনার শরীর আর মানসিক অবস্থার কথা বলুন।

বেশ আছি, ভালো আছি, বলে হাসলেন চাণক্য।

সেদিন বড় চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে ভাবি নি তা নয়, প্রত্যেক প্রতিভার মধ্যেই যন্ত্রণা আছে। তাকেও কাজে লাগাতে হয়। আপনাকে অবশ্য আমার পরামর্শ দেওয়া ঠিক নয়।

না না, আচার্য, এখানে আপনিই আমার একমাত্র শুভার্থী। ধর্মের-দর্শনের মিল নেই, চিন্তা ও কর্মের মধ্যেও বিরাট ফারাক। দুজন দুই মেরুর, তারপরও আপনার কাছ থেকে যে সহানুভূতি ও দিগ্‌দর্শন পাই, তার জন্য আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই।

এভাবে বলছেন কেন? আমি অস্বস্তি বোধ করছি, বলে সৌম্য হাসি হাসলেন ভদ্রবাহু। যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলুন। যোগ করলেন।

এবারের যুদ্ধটা বেশ কঠিন হবে। গ্রিকদের রণকৌশলটা আমার ভালো জানা নেই। অবশ্য সম্রাট একসময় গ্রিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড কাছ থেকে দেখেছেন।

তাহলে কি তিনি এবার যুদ্ধ পরিচালনা করবেন?

চাণক্য উৎসাহী হয়ে বললেন, তাহলে তো খুব ভালো হয়।

আপনি নন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে এলেন, এ প্রশান্তিটা নিশ্চয়ই এখনো উপভোগ করছেন।

জানেন, কোথায় যেন একটা সংকট আছে। প্রশান্তির পাশাপাশি একটা অতৃপ্তি, একটা অবসাদ এসে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। তাই কাজের মধ্যে থাকতে চাই, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশ নিয়ে ডুবে থাকতে চাই।

এই যুদ্ধে আপনাকেই বড় ভূমিকা নিতে হবে।

আমি এবার সম্রাটকেই মূল দায়িত্বটা পালন করতে দেব। তার কারণও আছে। অন্য যুদ্ধের চাইতে এই যুদ্ধে তাঁর আগ্রহ বেশি, বলে চাণক্য হা হা করে হাসলেন।

ভদ্রবাহু ব্যাপারটা জানেন। চাণক্য তা জানেন না।

ভদ্রবাহু বললেন, আপনার তাড়া আছে। সম্রাটকে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও রণকৌশল সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। আমি কিছুদিন এই প্রাসাদের বাইরে নগর জৈনবিহারে থাকব। সম্রাটকে এ কথা বলার দরকার নেই, শুধু আপনাকেই জানালাম।

আমি বুঝতে পারি, আচার্য। আপনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, আমি বর্তমানকে দেখি। কিন্তু যা অনিবার্য, পূর্বনির্ধারিত, সে নিয়তিকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না, এমনকি সম্রাটও পারবেন না। আমিও না।

আসি তাহলে? আপনাদের যুদ্ধযাত্রা সফল হোক।

ভদ্রবাহু উঠে চলে এলেন। তিনি প্রাসাদ থেকে বের হয়ে নগর জৈনবিহারে উঠলেন। এখানে তাঁর স্থায়ী একটা আবাস রয়েছে, শ্রুতকেবলীদের জন্য তা নির্ধারিত। তার আগে এখানে কেউ কেউ ছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *