২০
পত্রটা হাতে নিয়ে বিশ্বাসই করতে পারলেন না গ্রিক রাজকুমারী কর্নেলিয়া। তিনি ভুল পড়েন নি তো? আবার পড়লেন। তাঁর এই প্রেমিক মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য!
বিস্ময় কেটে গেলে আবার পাঠ করলেন পত্রটি। পত্রটি এ রকম:
আমার প্রাণেশ্বরী,
আপনি আমার পরিচয় জানতে চেয়েছেন। ওই পরিচয়টাই যথেষ্ট নয়কি আপনি আমার সঙ্গে তুলনীয় পাগলাটে দেবতা ডায়নোসাসের যে নাম দিয়েছেন। তবু আজ আমার নাম-পরিচয় দেব। আপনাকে শুধু এ পরিচয়টা গোপন রাখতে হবে। আমি ভারতবর্ষের দীনহীন এক জনসেবক, নাম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। আপনাদের লোকজন সানড্রোকোটোস বলে ডাকে। অদ্ভুত না? আপনি শুনে থাকবেন এইমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরলাম নন্দরাজকে পরাজিত করে। তাই আপনার পত্রের উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল।
আজ থেকে আপনাকে হেলেন বলে ডাকব। আমি স্বর্গের প্রেমের দেবী আফ্রোদিতেকে চাই না, মর্তের হেলেনকে চাই। আমি যদি দেখতে হেফাসটাসের মতো কদর্য হই, আমাকে কি আর ভালোবাসবেন না? একটা পরীক্ষা দিলাম। কৃতকার্যের নম্বর ১০০ আর অকৃতকার্যের নম্বর ৯৯।
হোমারের ইলিয়াড আমি সংগ্রহ করে পড়ব। আমি হেলেনের কথা জানতে চাই। আমার হেলেনকেও জানতে চাই। আজ আর নয়।
ইতি
আপনারই
চন্দ্ৰগুপ্ত।
এই পত্র মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল রাজকুমারীকে। তাহলে তিনি ভারত সম্রাট? তিনি কি বয়স্ক না যুবক? তিনি বিবাহিত নন? কী তাঁর ধর্ম? গ্রিকরা তাঁর দেশ আক্রমণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাচ্ছে। তিনি কি তা জানেন? গ্রিক সম্রাট জানতে পারলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হবে?
অন্যদিকে রাজকুমারীর অন্তরে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তিনি যাঁকে না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছেন, তিনি দিগ্বিজয়ী একজন সম্রাট, তাঁর রুচিবোধ আছে, কৌতুকরসবোধ আছে, রাজকুমারীকে সম্মান করতে জানেন। তাঁর বাবা সেলুকাস এক পারস্য রমণীকে বিয়ে করেছেন। সে রমণী, অর্থাৎ আপামাকে কাছে থেকে দেখেছেন। কখনো তাঁকে মনে হয় নি বিমাতা, বিমাতাসুলভ আচরণ তিনি কখনো করেন নি। ইউরোপের চাইতে তাঁর বিবেচনায় এশিয়ার মায়েরা বেশি মমতাময়ী। তাঁর বহুবারই মনে হয়েছে, লাউডিসরা তাঁর চেয়ে বেশি ভাগ্যবতী। এতটা স্নেহমাখা যত্ন এরা পেয়েছে, যা কর্নেলিয়া তাঁর নিজের মায়ের কাছে পান নি। তাই পারস্য নামের দেশটির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা রয়েছে, যদিও এটি এখন তাঁদেরই দখলে। সিন্ধুর এ পাড়ের জীবন সম্পর্কে তাঁর তেমন ধারণা নেই। বাবার মুখে শুধু তক্ষশীলার গল্প শুনেছেন। এ রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাকি গ্রিসেও নেই। দাহির ও রাজা পুরুকে পরাজিত করেই তবে এঁরা তক্ষশীলায় প্রবেশ করেছিলেন।
পত্রপাঠ শেষ করেছেন রাজকুমারী। ভাবছিলেন যখন, তখনই জরুরি এক সংবাদ এল। রাজকুমারীকে ঝিলামের প্রমোদপ্রাসাদ ত্যাগ করে এখনই হিরাটের প্রাসাদের উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে। সময় খুব বেশি নেই। রাজকুমারী দূতকে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন এখনই এ প্রাসাদ ত্যাগ করতে হবে?
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আক্রমণ করতে পারেন।
ভ্রু কুঁচকে রাজকুমারী বললেন, কী বললে?
দূত মাথা নত করে রাখল কিছুক্ষণ, পরে বলল, প্রিন্সেস বিপজ্জনক জায়গার মধ্যে এটিও চিহ্নিত। মৌর্যদের আক্রমণের লক্ষ্য হবে নিশ্চিতভাবে।
রাজকুমারী প্রথমে ভাবলেন, তাহলে তো ভালোই হলো, চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। পরে একটু চিন্তা করলেন, চন্দ্রগুপ্ত যদি এখানে না আসেন, শুধু তাঁর সৈন্যরাই আসে, তাহলে ব্যাপারটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে যেতে পারে। চন্দ্রগুপ্ত অবশ্য জানেন রাজকুমারী এখানে আছেন। জানলেই-বা কী, ‘তনি তো তাঁকে ছেড়ে দেবেন না, প্রথমে বন্দী করেই নেবেন। তাই তাঁর উচিত হবে এ স্থান ত্যাগ করে চলে যাওয়া।
রাজকুমারী সহচরী ও তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র নিয়ে এখনই জাহাজে চড়তে হবে। যাত্রাকালে তিনি আবশ্যিক দ্রব্যাদির তালিকায় এক নম্বরে রাখলেন কবুতরের সোনার খাঁচাটি। এটি তাঁর সঙ্গে যাবে এবং কবুতরটিও।
রাজকুমারী কর্নেলিয়া আলেকজান্ডার অধিকৃত সিন্ধু নদের অঞ্চলসমূহের মধ্যে একটি ঝিলাম নদী অববাহিকার প্রতি দুর্বল ছিলেন। তাই এ অঞ্চল ছেড়ে যেতে তাঁর বেশ কষ্টই হয়েছে। হিরাট প্রাসাদে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাওয়ার পর রাজকুমারী জানতে পারলেন, সেলুসিয়ার নতুন রাজধানীতে তাঁর আত্মীয়স্বজন একত্র হয়ে উৎসবে মেতে উঠেছেন। তাঁকে সেখানেই যেতে হবে।
নতুন রাজধানীটি স্থাপন করা হয়েছে এক বছর আগে। তার আগে ব্যাবিলনে ছিল সেলুকাসের রাজ্যকেন্দ্র। নতুন রাজধানী স্থাপনের পেছনে সেলুকাস নতুন করে রাজ্য জয় এবং আলেকজান্ডারের উত্তরাধিকারীদের যুদ্ধের হুমকি মোকাবিলাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। উত্তরাধিকারী যুদ্ধে এন্টিগোনাস তখনো বিপজ্জনকভাবে সক্রিয়।
সেলুকাস সম্পর্কে এবার কিছু তথ্য জানা যেতে পারে। ঐতিহাসিক জুনিয়ানাস জাস্টিনাস বলেন, সেলুকাসের বাবা ছিলেন এন্টিওকাস। মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিফ দুইয়ের তিনি ছিলেন একজন আর্মি জেনারেল। এন্টিওকাসের জন্ম হয় মেসিডোনিয়ার এক উচ্চ অভিজাত পরিবারে। সেলুকাসের মাতা লাউডিসও এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। সেলুকাসের জন্ম হয়েছিল মেসিডোনিয়ার উত্তরাঞ্চলে ইউরোপ অংশে। তাঁর জন্মসাল নিয়ে মতবিরোধের মধ্যেই ধরে নেওয়া হয় ৩৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাঁর জন্ম। কিংবদন্তি আছে যে সেলুকাসের পিতা এন্টিওকাস বলতেন, তিনি দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র। এই দেবতা নোঙরের ছবিসংবলিত একটি আংটি উপহার দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী লাউডিসকে। তাই সেলুকাসের শরীরে নোঙরের একটি জন্মচিহ্ন রয়েছে। সেলুকাসের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের শরীরেও এই নোঙরের জন্মচিহ্ন রয়েছে। এ রকম জনশ্রুতি ছিল আলেকজান্ডারেরও। অ্যাপোলোর কথা মনে করেই এন্টিওকাস তাঁর কন্যার নাম রেখেছিলেন দিদাইমেইয়া। দিদাইমায় একটি অ্যাপোলো মন্দির ছিল, যেখান থেকে নাকি দৈববাণী শোনা যেত
এ নিয়ে সেলুকাস পরিবারে আভিজাত্যের পাশাপাশি একধরনের অহংবোধও আছে। সেলুকাস যে একজন জেনারেল থেকে সম্রাট হয়ে গেছেন, একেও এঁরা অ্যাপোলোর আশীর্বাদ হিসেবেই দেখেন।
কর্নেলিয়ার মা-ও গ্রিক ছিলেন না, সিরীয় রাজকন্যা ছিলেন। এশিয়ায় পারস্য বিজয়ের প্রেক্ষাপটে সেলুকাস আপামাকে সঙ্গে করে নেন এবং এক বছর পর বিয়ে করেন। এখন আপামা ছাড়া সবাই সেলুসিয়ায়। আপামা মারা গেছেন বেশ আগে।
কর্নেলিয়া সেলুসিয়ায় পৌঁছাতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে গেল। পরিবারের সবার প্রতি তাঁর টান আছে। তবে একটু বেশি আছে ফুফু দিদাইমেইয়ার প্রতি। কর্নেলিয়ার আগমনে পরিবারে উৎসবের মাত্রা বেড়ে গেল। পরিবারের ছোট মেয়ের প্রতি এমনিতেই সবার একটা আন্তরিক স্নেহের ভাব থেকে যায়। কর্নেলিয়া তার ব্যতিক্রম নয়।
সেলুকাস এই কন্যার আগমনের কথা জানতে পারেন সবার পরে। কর্নেলিয়া নিজেই বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন সম্রাটের সভাকক্ষে। সেলুকাস তখন দুই শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার পরিকল্পনা নিয়ে জেনারেলগণসহ ব্যস্ত। এক শত্রু এন্টিগোনাস, যার অধীনে রয়েছে আশি হাজার সৈন্য। অন্যদিকে চন্দ্রগুপ্তের রয়েছে ছয় লক্ষ সৈন্য। সেলুকাসের আছে তিন লক্ষের বেশি কিছু। অবস্থাটা বেশ কঠিন। পরিকল্পনা কোনোভাবে গাণিতিক হিসাব মানছে না।
এ সময় ঝড়ের মতো প্রবেশ করে কর্নেলিয়া ডাকলেন, বাবা!
সেলুকাস মাথা তুলে কন্যাকে দেখে উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন, আমার প্রিয় কর্নেলিয়া, মা আমার।
বাবা, তুমি ব্যস্ত?
যতই ব্যস্ত থাকি, আমার মেয়ের চেয়ে কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বল মা, আসতে কষ্ট হয় নি তো? তুই তোর প্রিয় জায়গায় ছিলি, অনিবার্য কারণে তোকে চলে আসতে বলতে হলো।
সব ঠিক আছে, বাবা। যুদ্ধ শেষে আবার যাব সেখানে।
নিশ্চয়ই। আর্কিমেডেসের দিকে দৃষ্টি যায় নি কর্নেলিয়ার। এবারে চোখে চোখ পড়তেই ছুটে গেলেন তার কাছে
তুমি জেনারেল হলে আমাকে না জানিয়ে। অভিনন্দন জানাতে পারলাম না সময়মতো। এখানে এসে শুনলাম।
তোমার উপহার জমা আছে, কর্নেলিয়া। এখন অভিনন্দন জানাও।
কন্যার আগমনে সেলুকাস কিছু সময়ের বিরতি দিয়ে পানাহারের ব্যবস্থা করতে বললেন। কন্যাকে উদ্দেশ করে বললেন, তোর আসতে কষ্ট হয় নি তো?
না, বাবা। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে এলাম। ক্লান্তবোধ করি নি। আর স্থানে স্থানে আমাদের লোকজন ছিল, আপ্যায়নের অভাব হয় নি। জার্নিটা ভালোই লেগেছে।
জেনারেলরা বুফেতে পানাহার করছেন। সেলুকাস নিজে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন, সঙ্গে মেয়েকেও ‘নিলেন। এখন তিনি যে সম্রাট, তা মাঝেমধ্যে ভুলে যান। নিজেকে জেনারেলই মনে করেন।
দুটো ফ্রন্ট আমাদের। সামনে মৌর্যরা আর পেছনে এন্টিগোনাস। আমরা উভয়কেই মোকাবিলা করব এবং হারাব।
বাবা, তুমি মনে হয় সামরিক যুদ্ধ নয়, মল্লযুদ্ধের কথা বলছ।
না, কর্নেলিয়া, মল্লযুদ্ধ নয়, আমরা সম্মুখসমরেই তাদের হারাব, সে শক্তি আমাদের আছে। গ্রিকরা সে জাতি, যারা পরাজয় কী জানে না, শুধু জয়ী হতে জানে। তোমরা কী বলো?
সব জেনারেল হাত মুষ্টিবদ্ধ করে হুংকার দিয়ে উঠলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সেলুকাস মৃদু হাসলেন।
কর্নেলিয়ার সামনেই আমরা যুদ্ধ পরিকল্পনাটা চূড়ান্ত করে ফেলতে পারি। কাপড়ের তৈরি একটা মানচিত্রে কয়েকটি স্পট চিহ্নিত করা আছে। একজন জেনারেল একটি স্টিক দিয়ে স্পটগুলোয় স্পর্শ করে কার বাহিনী কোথায় থাকবে এবং গ্রিকদের করণীয় কী, তা ব্যাখ্যা করলেন। সেলুকাস বললেন, মৌর্য ফোর্স আগে আক্রমণ করবে। আমরা তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেব। পরে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলব।
একজন জেনারেল বললেন, আমরা এক দিক খোলা রাখব কি এদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে?
ঠিক তাই। পালিয়ে এরা আমাদের মুঠোর মধ্যেই আসবে। এতে পরাজিত করা সহজ হবে। এখানকার প্রকৃতি, নদ-নদীকেও মাথায় রাখতে হবে। আলেকজান্ডার একবার আমাকে বলেছিলেন, সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ। এখানে বৈচিত্র্যের শেষ নেই, তবে একে বৈরী
না ভেবে কাজে লাগাতে হবে।