মৌর্য – ১৮

১৮

মন্দাকিনী সম্রাটের হাতে রাজকুমারীর প্রেরিত পত্রখানি তুলে দিল।

সম্রাট বললেন, তুমি পত্রটি যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিতে পারতে।

মহামান্য সম্রাট, ক্ষমা করবেন, গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে তা করি নি। সব পত্রই মহামন্ত্রীর মাধ্যমে আপনার কাছে যায়।

তা তুমি ঠিকই বলেছ। নাও, খুলে এটি পাঠ করো।

মন্দাকিনী পত্র পাঠ করে তার সংস্কৃত অনুবাদ করে শোনাচ্ছে। পত্রটি এ রকম:

হে হৃদয়তম,

আপনার পত্রটি পেয়ে কয়েকবার পাঠ করেছি, জানি না কোথা দিয়ে কী হয়ে গেছে। আপনাকে আমি কখনো দেখি নি। আপনার পত্র পাঠ করে আমি কল্পনা করে আপনার যে মূর্তি হৃদয়ে ধারণ করেছি, তা দেবতা ডায়নোসাসের মতো। ডায়নোসাস দেবরাজ জিউসের পুত্র। কৃষির দেবতা, পাগলামির দেবতাও। গ্রিক দেবতাদের যে ভাস্কর্য আছে, সেগুলো খুবই পেশিবহুল ও সুদর্শন। ডায়নোসাস সবার মধ্যে সুদর্শনতম। আমার বিশ্বাস, আপনি সে রকমই। অনেকটা পাগলাটে। না হয়, কোনো অচেনা, বিদেশি রাজকুমারীকে কেউ অন্ধের মতো ভালোবেসে ফেলে? আপনাকে ডায়নোসাস ভাবার আরও কারণ আছে, সে কথা আমি আজই বলতে চাই না।

আমাদের পুরাণে আফ্রোদিতে প্রেম, সৌন্দর্য ও ভোগের দেবী। জিউসের কন্যা। অলিম্পাস পর্বতে থাকেন। আপনার পাশাপাশি এই দেবীর কথাও ইদানীং ভাবছি আমি। পৌরাণিক মতে, এ দেবীর একজন কদৰ্য স্বামী আছেন। আপনি সে রকম নন তো? তবে তার অনেক প্রেমিকও আছেন। দেবতা জিউস ভাবলেন, তাঁর এই অনন্যসুন্দরী কন্যাকে নিয়ে স্বর্গপুরীতে দেবতাদের মধ্যে হানাহানি হবে, অশান্তি হবে। দেবরাজের দায়িত্ব আছে তো, তাই দেখেশুনে একজন কদর্য দেবতা হেফাসটাসের সঙ্গে কন্যাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। ভেবেছিলেন সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, আসলে তা হয় নি

আমার সম্পর্কে আবার সে রকম ভাববেন না যেন। আমি অত সুন্দরী নই যে আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে। আমাদেরও ট্রয়ের যুদ্ধ হয়েছে হেলেনকে নিয়ে। হেলেন মরণশীল পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দরী নারী। তাঁর স্বামী ম্যানিলাস। কিন্তু তাঁকে দেখে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যান যুবরাজ প্যারিস। প্যারিসের সঙ্গে পালিয়ে যান হেলেন। ট্টজান ও এনিয়ানদের মধ্যে এ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি মহাযুদ্ধ বাধে। মহাকবি হোমার এই যুদ্ধের পটভূমিতে এক বিখ্যাত মহাকাব্য লেখেন। নাম ‘ইলিয়াড’।

আমার জন্য কি আপনি যুদ্ধ করবেন? হা হা হা। মজা করলাম। এবার আপনার পরিচয় কি আপনি দেবেন? পরিচয় জানার জন্য উন্মুখ হয়ে রইলাম।

ইতি
আপনারই
প্রিন্সেস।

পত্রটি শেষ করার পর রাজকুমারী ভাবলেন, মনের কথা কিছুই তো বলা হলো না। ভেতরে যা ঘটছে দিন-রাত, তার ছিটেফোঁটাও লেখা হলো না।

কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত এই পত্রের মধ্যেই দেখলেন এক নারী তাঁর জন্য ছটফট করছেন। তিনি কি তাঁর পরিচয়টা দিয়েই দেবেন?

মন্দাকিনীকে বললেন, আজ থেকেই তুমি আমাকে গ্রিক শেখাবে। ঠিক আছে?

জি।

আমি কিন্তু কিছুটা গ্রিক জানি। আলেকজান্ডারের বাহিনীতে থাকাকালে শিখেছিলাম। তবে লিখতে পারি না। তুমি লিখতেও শেখাবে। আর এ পত্রের উত্তর যাবে, তুমি পরে নিয়ে যেয়ো।

চন্দ্রগুপ্ত এ পত্র পাঠের পর ফুরফুরে মেজাজে আছেন। এ সময় সম্রাজ্ঞী দুরধরা তাঁর কাছে এলেন। যুদ্ধজয়ের জন্য সম্রাটকে অভিনন্দন জানালেন। সম্রাট বললেন, সম্রাজ্ঞীর ত্যাগ এ যুদ্ধজয়ের মাহাত্ম্যকে অনেক পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি মুহূর্তে আমার সম্রাজ্ঞীর কথা মনে হয়েছে। আমি খোঁজখবর নিয়েছি। বড় অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম।

ওরা এসব কথা বলেছে আমাকে আমার প্রাণপ্রিয় সম্রাট। একটু থেমে আবার বললেন, সম্রাট, আপনি যুদ্ধে যাওয়ার আগে আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে কথা বলেন নি কেন?

তিনি তো পুণ্ড্রবর্ধনে গিয়েছিলেন। তাঁর আশীর্বাদ সব সময়ই আমার সঙ্গে আছে।

সম্রাট, তবু তাঁর সঙ্গে কথা বলে নিন।

কোন ব্যাপারে?

যুদ্ধ জয় করে এসেছেন, সে কথা জানান। আমাদের অনাগত সন্তানের ভাগ্যে কী আছে, তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে, এসব জেনে নিন।

সম্রাজ্ঞী, আপনিও চলুন। আজ রাতেই সাক্ষাৎ করি।

.

আর্কিমেডেস এসেছেন। গ্রিক রাজকুমারী মনের সব নির্জীবতাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলেন। প্রিন্সের সঙ্গে আগের মতোই স্বাভাবিক ব্যবহার করলেন। প্রিন্স সব সময়ই প্রাণবন্ত। রাজকুমারীও তা-ই ছিলেন। এক বিকেলে ঝিলাম নদীতে নৌবিহারের ব্যবস্থা করা হলো। রাজকীয় নৌবহরের একটি নৌযান উত্তমরূপে সাজিয়ে প্রমোদভ্রমণের জন্য প্রমোদপ্রাসাদের পাশে ঝিলামের শানবাঁধানো ঘাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আজ বাতাস বইছে। তাই ঢেউ জাগছে নদীবুকে। শানবাঁধানো ঘাটে এসে ঢেউ আছড়ে পড়ছে।

প্রিন্স গ্রিসের অভিজাত পোশাকে নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে এলেন। রাজকুমারী নেমে এলেন তাঁর সহচরীদের নিয়ে। এটি রাজকীয় আভিজাত্যের রাজাচার। বিকেলের রোদ-ঝলমল পরিবেশে প্রকৃতির চিরাচরিত সৌন্দর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাগানের সব ফুল আর নদীর সব হিরে ঝরা ঢেউ ও জলরাশিকে ম্লান করে একঝাঁক তরুণী প্রমোদতরির দিকে এগিয়ে গেল। তাঁদের মধ্যমণি রাজকুমারী কর্নেলিয়া সেলুকাস।

রাজকুমারী ইচ্ছার বাইরেও হাসতে পারেন। মুক্তোঝরা হাসি। প্রিন্স আর্কিমেডেসও সহাস্যে বরণ করলেন তাঁর স্বপ্নের রানিকে। ডান হাতে রাজকুমারীর বাঁ হাতের আঙুল মধ্যমাকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে রাজকীয় নৌযানে পদার্পণ করলেন। সহচরীগণ তাঁদের অনুসরণ করল।

নৌযানটা চমৎকারভাবে সাজানো। বিলাসবহুল। অভিজাত আসবাব। মেঝেতে ইরানি গালিচা। দেয়ালে তৈলচিত্র। স্থানে স্থানে ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে। গ্রিক ঐতিহ্য দেখার জন্য কারও এথেন্স যাওয়ার দরকার নেই, এ প্রমোদতরিটা দেখলেই হবে। এটা যেন একটা মিনি গ্রিস। গ্রিক তরুণ-তরুণীদের পোশাক-পরিচ্ছদও সে ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই।

সবকিছু মিলিয়ে প্রমোদভ্রমণটা একটা উচ্চমাত্রা পেয়েছে। প্রমোদতরি ভাসিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালে ভীষণ হাওয়া লেগে তার গতি বেশ বেড়ে গেল। তরিটা ঝিলামের মাঝখানে। কিছুটা দূরে তাঁদের নিরাপত্তার জন্য ভাসছে চারটি রণতরি!

প্রিন্স রাজকুমারীকে উদ্দেশ করে বললেন, দারুণ লাগছে। এ রকম আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ।

রাজকুমারী মৃদু হাসলেন। বললেন, তুমি তা উপভোগ করছ, এটা জেনে আমার ভালো লাগছে।

সেলুসিড রাজবংশের লোকদের উপভোগ শক্তি প্রবল। এরা অনুষ্ঠান-উৎসবে মেতে থাকে সব সময়। রাজকুমার একজন সামরিক অফিসার। সেনা অফিসাররা সব সময় উৎসবপ্রবণ। নৌযানে গান হবে, নাচ হবে। আহার হবে, বিহার হবে। আজ এসবে আর্কিমেডেস কিংবা কর্নেলিয়ার কোনো উৎসাহ নেই। দুজনের কারণ অবশ্য ভিন্ন। সবকিছুর মধ্যেই রাজকুমার রাজকুমারীকে দেখেন। অন্যদিকে রাজকুমার ভাবছেন অন্য কারও কথা। দিগন্তবিস্তৃত। রাজকুমার একান্তে কথা বলতে চান। কত কথা জমে আছে তাঁর বুকে। ব্যক্ত করতে চান। এ রকম পরিবেশে কত কী বলা যায়।

কিন্তু শুরু করবেন কীভাবে? একটু ভেবে বললেন, গত মাসে লাউডিসের সঙ্গে দেখা হলো। লাউডিস রাজকুমারীর বৈমাত্রেয় বোন। বাবা তাঁর মায়ের নামে নাম রেখেছেন। আপামার এই কন্যা নাকি সেলুকাসের মায়ের মতো হয়েছে।

কেমন আছে সে?

দেখে মনে হলো বেশ ভালো আছে। স্বামী নিয়ে সুখে আছে।

স্বামী তো তোমার মতো সেনা অফিসার।

আমার চেয়ে বড় পদধারী। আগামী মাসেই দিয়াডোচি জেনারেল হয়ে যাবে।

সেলুসিড রাজবংশের ধরন এই যে রাজকুমার ও রাজকুমারীর স্বামীদের সেনা অফিসার হতেই হবে।

তোমার স্বামীও নিশ্চয়ই সেনা অফিসারই হবেন।

না, আমি এক ভেগাবন্ডকে বিয়ে করব, যার চালচুলা কিছুই থাকবে না, একেবারে ভবঘুরে বলে খুব হাসলেন রাজকুমারী।

রাজকুমারও তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। একসময় হাসি থামিয়ে বললেন, এ রকম ইচ্ছা হলো কেন, প্রিন্সেস?

কোনো সেনা অফিসার রাজকুমার যেন আমার জন্য অপেক্ষা না করে, সে জন্য। বলে আবার উচ্ছ্বসিত হাসি হাসলেন।

রাজকুমার ভাবলেন, রাজকুমারী মজা করার জন্য এসব বলছেন। লাউডিসের মেয়েটা কেমন হয়েছে?

রাজকুমার বললেন, অদ্ভুত সুন্দর। নাচ, গান, অভিনয়ে মাতিয়ে রাখে। মনে হয় সফোক্লিসের ‘ইলেকট্রা’ নাটকের নায়িকার অভিনয়ের জন্যই তার জন্ম হয়েছে।

দুষ্টুটাকে তো একবার দেখতে হয়।

তাহলে চলো আমার সঙ্গে।

যাব যাব, তবে এবার নয়।

তুমি কি ঝিলামের প্রেমেই পড়ে গেলে?

বলতে পারো।

সিন্ধু নদের কাছে চলো, প্রেমে পড়বে তো সিন্ধু নদের প্রেমেই পড়ো।

প্রতিক্রিয়ার জন্য যেমন আদেশের প্রয়োজন হয় না, প্রেমের জন্যও তেমনি পরামর্শের দরকার হয় না।

ঠিক বলেছ। চলো একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।

দুজন নৌযানের রেলিং ধরে দাঁড়ালেন।

আমরা কি এ রকম এক সুন্দর বিকেলে আমাদের কথা ভাবতে পারি না?

রাজকুমারের এ রকম প্রশ্নের জবাবে হেসে দিয়ে রাজকুমারী বললেন, ভাবছি তো, আমাদের কথাই ভাবছি।

রাজকুমার রাজকুমারীর হাতের ওপর হাত রেখে বললেন, তাহলে—

তাহলে?

তাহলে—

তাহলে—বলে রাজকুমারী খুব হাসলেন।

রাজকুমার হাতটি সরিয়ে নিয়ে বললেন, তুমি কি কখনো সিরিয়াস হবে না?

সিরিয়াসই তো।

রাজকুমার গোপনে একটি নিঃশ্বাস চেপে ওপরে আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশটা ঘন নীল। সাদা মেঘ ভাসছে। ভারতবর্ষে এটা শরৎকাল। নদীর দুপাশে সাদা মেঘের মতোই যেন বাতাসে উড়ছে কাশফুলগুলো।

আর্কিমেডেস, তুমি কি সারা জীবনই ছেলেমানুষ থাকবে?

এ কথা বলছ কেন?

সেলুসিড সেনা অফিসার, তা বুঝবে না, এটা কী করে হয়? কী চাও তুমি?

আমি লাউডিসের মতো নই।

তুমি কাউকে বিয়ে করবে না?

এখনো আমি তা জানি না। আমরা দুজন ভালো বন্ধু, এটা কম কী

লাউডিস তো বিয়ে করে সুখে আছে। অ তুমি চাও না?

লাউডিস খুব ভালো বোন আমার। তার সুখে আমিও সুখী।

আমি চাই তুমিও তার মতো সুখী হও।

এবার রাজকুমারী হেসে দিয়ে বললেন, কোথায় যে কার সুখ, তা ভবিতব্যই জানে।

নিজের কথা নিজেকেও ভাবতে হয় কর্নেলিয়া, সবটুকু ভবিতব্যের ওপর ছেড়ে দিতে হয় না।

পশ্চিম সাগরতীরে সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। দুজন চেয়ে চেয়ে দেখছেন। এ রকম অস্তরাগের সন্ধ্যায় কর্নেলিয়া যেন আবার কিসের শূন্যতা অনুভব করেন। আর্কিমেডেস অস্তরাগটাকেই জীবনের অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর ভেবে কঠিন কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চান। কিন্তু আশা ছাড়ছেন না এ ভেবে যে আগামীকাল সকালে আবার সূর্য উঠবে। এ ছাড়া একটু পর আকাশকে আলোকিত করে উঠবে শরতের পূর্ণিমার চাঁদ, এসব হয়তো রাজকুমারীর মনকে গলাতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *