১৭
চাণক্যের নির্দেশে নকলনবিশ শক্তদাসকে হত্যা করা গেল না। সিদ্ধার্থক জানতে পেরে তাকে মৃত্যু থেকে বাঁচাল। সিদ্ধার্থকও এক গোয়েন্দা। চন্দন দাসের চর। রাক্ষসপত্নীর আশীর্বাদপুষ্ট।
সম্রাটের ইচ্ছেমতো চাণক্য মুদ্রাসিলটি রাক্ষসের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। তিনি তাঁর গোয়েন্দাকে মুদ্রাসিলটি রাক্ষসের কাছে পৌঁছে দিতে বললেন। সে শক্তদাস ও সিদ্ধার্থককে নিয়ে রাক্ষসের সঙ্গে দেখা করতে যায়। চাণক্যের পরামর্শমতো গোয়েন্দার ইচ্ছাতে সিদ্ধার্থক রাক্ষসকে বলে, মুদ্রাসিলটি চন্দন দাসের বাড়িতে পাওয়া গেছে।
চন্দন দাস ফেরত দেয় নি কেন? তার উদ্দেশ্য কী? খুব খেপে যান রাক্ষস। তবে রাক্ষস সিদ্ধার্থককে প্রচুর গয়না উপহার দেন। এগুলো তিনি পেয়েছিলেন মলয়কেতুর কাছ থেকে। সিদ্ধার্থকের এ রকম রাজকীয় গয়নার প্রয়োজন নেই। সে এগুলো বিক্রয় করবে। চাণক্যের গোয়েন্দা চটজলদি গয়নাগুলো কিনে নেয়। না হয় চন্দন দাস গয়নাগুলো কিনে নিত।
মলয়কেতুদের মৈত্রী বন্ধন শিথিল হলেও এখনো ছিন্ন হয় নি। যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে তাতে ফাটল ধরাতেই হবে। চাণক্য এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হলেন। সময় ক্ষেপণের জন্য এদিকে সম্রাট দিনে দিনে বিরক্ত হয়ে উঠছেন। আর কত অপেক্ষা করতে হবে। চাণক্য এবার গয়না নিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করলেন। সিদ্ধার্থকের কাছ থেকে কেনা গয়নাগুলো দিয়ে মলয়কেতুর কাছে তাঁর এক গুপ্তচর পাঠান। তার গায়ে মলয়কেতুর দেওয়া অলংকার।
পোশাক ও গয়না দেখে মলয়কেতু নিশ্চিত হন যে এ রাক্ষসের লোক। কিন্তু কথাবার্তায় কেমন যেন অসংলগ্ন। মলয়কেতুর দুই কারণে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। রাক্ষসের ওপর ক্ষুব্ধও হলেন তিনি। তাঁর বাবার দেওয়া অলংকার রাক্ষস সাধারণ একজন দূতকে প্ৰদান করেছেন, এটি পর্বতেশ্বরকে ইচ্ছা করেই অমর্যাদা করা। তিনি দূতকে আটকে তার শরীর তল্লাশি করতে বললেন। শরীর তল্লাশি করে রাক্ষসের মুদ্রাসিলযুক্ত একটি পত্র পাওয়া গেল। পত্রটি সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে লেখা। এই পত্রে রাক্ষস লিখেছেন,
মহামান্য সম্রাট,
আপনার বিচক্ষণতা আপনাকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাটের বিজয়মুকুট পরিয়েছে। আপনার তুলনা শুধু আপনিই। আপনার রাজসভায় পাঠানো আমার সংগীতজ্ঞ যথাযোগ্য সম্মান পেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু আপনার মহামন্ত্রী একজন আত্ম-অহংকারী ব্যক্তি, তিনি গুণী ও সম্মানী মানুষের সম্মান দিতে জানেন না। আপনার সঙ্গেও নাকি তর্ক করেন, কী সাংঘাতিক। তার আস্পর্ধা দেখে আমার মাথা নত হয়ে আসে। একজন মহামন্ত্রী হিসেবে আমি লজ্জিত। আপনি তাকে সমুচিত শাস্তিই দিয়েছেন। সম্রাটের সঙ্গে বেয়াদবি! তাকে মহামন্ত্রীর পদে মানায় না। আপনি তাকে পদচ্যুত করে উচিত কাজই করেছেন।
মহামান্য সম্রাট, আমি জানি, এখন আপনার একজন নম্র, ভদ্র, অনুগত ও বিশ্বাসী মহামন্ত্রী প্রয়োজন। আমি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে নন্দরাজের এতকাল মহামন্ত্রীর কাজ করেছি। আমার যোগ্যতা সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই অবহিত আছেন। আমার এখন একটাই ইচ্ছা, মহামন্ত্রী হিসেবে সম্রাটের সেবা করা। আমি বাকি জীবন আপনার সেবা করে কাটাতে চাই।
আমি আমাদের মিত্রদের সঙ্গে গোপনে সভা করেছি। এরা মলয়কেতুর আচরণে ক্ষুব্ধ এবং এঁরা জানেন যে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় মলয়কেতুর মতো কাপুরুষ রাজের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এঁরা আপনাকে অধিকৃত ভূমি ও সম্পদ ফেরতদানসহ আপনার বশ্যতা স্বীকারে রাজি আছেন। আমাকে মহামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদানের সঙ্গে সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতার এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
আপনারই
দাসানুদাস
রাক্ষস।
এ পত্র পেয়ে মলয়কেতু বিশ্বাসই করতে পারছেন না। তা কীভাবে সম্ভব? এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা!
চাণক্য নিজে এ পত্র লিখেছেন। সম্রাটের নির্দেশে মুদ্রাসিলটি রাক্ষসকে ফেরত দেওয়ার আগে চাণক্য কয়েকটি কাপড়ে সিল মেরে রাখেন এবং সময়মতো এটি কাজে লাগান। রাক্ষসের পাঠানো সংগীতজ্ঞ যে একজন গুপ্তচর, চাণক্য তা বুঝেছিলেন। সম্রাটের সঙ্গে তাই তর্ক-বিতর্ক এবং পদচ্যুতির নাটক মঞ্চস্থ করেন। রাক্ষসের গুপ্তচর তাকেই সত্য ভেবে রাক্ষসকে ভুল তথ্য প্রদান করে। গুপ্তচরকে চিনতে পেরেও চাণক্য তাকে বন্দী বা হত্যা না করে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেন।
এদিকে পত্রপাঠের পর রাগে ও ক্রোধে মাথা গরম করে মলয়কেতু রাক্ষসকে ডেকে পাঠান। রাক্ষস মলয়কেতুকে খুশি করার জন্য তার পিতার পুরস্কার হিসেবে দেওয়া শিরস্ত্রাণ পরে উপস্থিত হন। তা দেখে মলয়কেতু তাকে আরও ভুল বুঝলেন। পিতার অলংকার পরিহিত অবস্থায় দেখে আনুগত্যের পরিবর্তে ভাবলেন, রাক্ষস ও মিত্ররা বিশ্বাসঘাতকতার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে।
তিনি মিত্রদেরও ডাকলেন। কেউ কেউ উপস্থিত হলে তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেন, দুজন অনুপস্থিত ছিলেন। এঁরা মৈত্রী চুক্তি বাতিল করে তাঁকে ত্যাগ করলেন। রাক্ষস পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। মলয়কেতু অপরিপক্ব বয়সে রাজা হয়ে চাণক্যের জালে পা দিয়ে কোনো যাচাই ছাড়াই মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এক ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনলেন।
চাণক্য এখানে রাক্ষসের মৃত্যুটা চান নি। তিনি চেয়েছিলেন তাদের জোট ভাঙতে। রাক্ষসকে তিনি নিজে হত্যা করতে সংকল্পবদ্ধ। তাই তাঁর গোয়েন্দাই রাক্ষসকে পালাতে সাহায্য করে। যে লোকটি রাক্ষসের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে, রাক্ষস এ জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ। চাণক্য এই গুপ্তচরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন চন্দনদাসকে হত্যা করার জন্য। গুপ্তচর রাক্ষসকে আত্মপরিচয় দিয়ে বলল, আমি চাণক্যের পক্ষ ত্যাগ করেছি এবং আপনাকে পালাতে সাহায্য করেছি, এ কথাটি গোপন রাখতে হবে। মৌর্যদের যেসব গোপন তথ্য জানি, সেগুলো আপনি সব সময় পাবেন, মহামন্ত্রী। আপনাকে জানানো উচিত হবে বলে মনে করি যে চন্দন দাস গোপনে আপনার সব তথ্য মন্ত্ৰী চাণক্যকে পাচার করছে। আপনার পরিবারের অবস্থান চামুন্ডায় এ তথ্য সে আমাকেই দিয়েছে। আমি অবশ্য চাণক্যকে এ তথ্য দিই নাই।
রাক্ষস বিশ্বাস করলেন। কারণ, তাঁর পরিবারের অবস্থানের কথা শুধু চন্দন দাসই জানে। গুপ্তচর জায়গাটার নামও সঠিক বলেছে। তিনি স্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করে চন্দন দাসের শিরশ্ছেদ করলেন। এদিকে ক্ষুব্ধ মলয়কেতু মিত্রদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হলেন না, জীবসিদ্ধির পরামর্শে পাটালিপুত্র আক্রমণ করে বসলেন। চাণক্যের কৌশলে এ যুদ্ধ ছিল খুবই প্রত্যাশিত। দুর্বল মলয়কেতু মিত্রহীন অবস্থায় সহজেই পরাজিত হলেন। মলয়কেতুর পরাজয়ে রাক্ষস এবং তার দুই মিত্র খুবই হাসলেন। রাক্ষস জানতেন না তার জন্য কী পরিণতি অপেক্ষা করছে।
গুপ্তচরের তথ্য পেয়ে চাণক্য লোক পাঠিয়ে রাক্ষসকে ধরে নিয়ে এলেন। রাক্ষস কাপুরুষ নন। চাণক্যকে বললেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যাকে পরাজিত কিংবা বন্দী করতে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন, বীরোচিত নয়, এমন ঘৃণ্য পথ অবলম্বন করে তাকে বন্দী করলেন। মহামন্ত্রী, ধিক আপনাকে।
চাণক্য বললেন, আপনি তো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়েছেন কাপুরুষের মতো।
সেটি ছিল কৌশল।
এটিও কৌশল, মন্ত্রী। যুদ্ধে সবই গ্রাহ্য।
যেদিন নন্দরাজ চাণক্যকে অপমান করে আসন ছেড়ে যেতে বলেছিলেন, সেদিন রাক্ষস রাজার পেছনে দাঁড়িয়ে তাতে সায় দিয়েছিলেন। চাণক্য আজও সে কথা মনে রেখেছেন। সম্রাটকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনি অনুমতি দিলে রাক্ষসের শিরশ্ছেদ আমি স্বহস্তে করতে চাই, মহামান্য সম্রাট। রাক্ষসই এ যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছে। মহামান্য সম্রাটের ক্ষোভ সেখানে। তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।
বধ্যভূমিতে শিরশ্ছেদ করা হবে রাক্ষসকে। মঞ্চ সাজানো হয়েছে। পাশে ছিদ্রযুক্ত একটি ওয়াচিং টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। সম্রাট তাতে দাঁড়িয়ে হত্যাদৃশ্য দেখবেন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে সম্রাটকে হত্যা-ষড়যন্ত্রের অভিযোগ।
এ ধরনের অপরাধের বিচারকার্যে অপরাধীকে তার অপরাধ স্বীকার করানোর চেষ্টা করা হয়। রাক্ষসকে জিজ্ঞেস করা হয় নন্দরাজের মৃত্যুর পরও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, লোকজন হত্যার জন্য তিনি দোষী কি না, সম্রাটকে হত্যার নানা ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকা কী, এসব। রাক্ষস বলেছেন, মাতৃভূমি রক্ষার জন্য তিনি যুদ্ধে লড়েছেন, সম্রাটকে হত্যার চেষ্টা যুদ্ধের কৌশল এবং মৃত্যুদণ্ডের জন্য তাঁর কোনো ভয় নেই, অনুশোচনা করার মতো কোনো কাজ তিনি করেন নি। যা করেছেন, তাঁর অবস্থান থেকে ঠিক কাজই করেছেন।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে অপরাধ স্বীকার করলে, সম্রাট দণ্ডপ্রাপ্তকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, এ রকম দৃষ্টান্তও আছে। এ রকমভাবে ক্ষমা চেয়ে বাঁচতে চান নি। নৈতিকভাবে পরাজয় তিনি চান না। মহাদণ্ড নায়কের কাছে তিনি তা পরিষ্কার জানিয়ে দেন।
ন্যায়বিচারের শেষ একটি ধাপ আছে। সম্রাট অর্থশাস্ত্র থেকে তা রপ্ত করেছেন। সেখানে বলা আছে, ‘এটা ক্ষমতা, একক ক্ষমতা, যখন রাজা নিরপেক্ষভাবে অপরাধের মাত্রা অনুসারে রাজপুত্র ও রাজশত্রু উভয়ের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করেন।’ কিন্তু মহামন্ত্রী চাণক্য তা মানতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, শাস্ত্র মেনে শাসন চলে না, ‘ন্যায়’ শব্দটি অর্থশাস্ত্রে এক রকম, প্রশাসনে অন্য রকম। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে এখানে তাঁর ন্যায়-অন্যায়বোধ নিয়ে তর্ক হয়। আজীবিক দর্শনের রেশ টেনে চাণক্য বলেন, যা কিছু পূর্বনির্ধারিত, তা পরিবর্তনের নিয়তি মানুষ হতে পারে না। যুদ্ধাপরাধীর নিয়তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড, এ নিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন অবান্তর। রাজহত্যা ষড়যন্ত্রে তো কথাই নেই।
গলায় চামড়ার বেল্ট লাগিয়ে দুদিক থেকে রশি টেনে ধরে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাক্ষসকে। পেছনে তার দুহাত বাঁধা। রাক্ষসের মুখে কোনো ভীতির চিহ্ন নেই। হাসি লেগে আছে।
বধ্যভূমিতে কাঠের একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যেখানে মস্তক আটকে গর্দানে তরবারির আঘাত করে শিরশ্ছেদ করা হবে।
চারদিকে প্রচুর দর্শনার্থী ভিড় করেছে। আজকে মন্ত্রী স্বয়ং শিরশ্ছেদ করবেন, তাই উৎসাহী দর্শকের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। রাক্ষসকে নিয়ে আসতে দেখে তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি যেন উল্লাসের রূপ নিয়েছে। রাক্ষসকে তারই মধ্যে কাষ্ঠকাঠামোয় নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দেওয়া হলো। অতঃপর শির নত করে কাঠের কাঠামোয় আটকে দেওয়া হলো। চাণক্য তরবারি নিয়ে প্রস্তুত। সম্রাট এসে উপস্থিত হয়েছেন। এখনই এক আঘাতে রাক্ষসের মস্তক বিছিন্ন করে দেওয়া হবে।