মৌর্য – ১৫

১৫

পূর্বপরিকল্পনামতো পর্বতেশ্বর ও মৌর্য সম্রাটের যুদ্ধশিবির খুব কাছাকাছি স্থাপিত হয়েছে। দুটি শিবিরই নিজ নিজ নিরাপত্তা জোরদার করে রেখেছে। বাইরে এদের মৈত্রী বন্ধন অটুট দেখা গেলেও ভেতরে-ভেতরে কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। শত্রুদের থেকে মিত্ররা নিজেরাই এখন বেশি নিরাপত্তাসংকটে।

একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ে মৌর্য শিবিরে এসে উপস্থিত হলো। ছদ্মবেশী এক পার্বত্য আদিবাসী রমণী আর কেউ নয়, মহামন্ত্রী চাণক্যের এক গোয়েন্দা ভাগুরজান। ভাগুরজান লজ্জাস্থান বৃক্ষবাকল দ্বারা আবৃত এক উন্মুক্ত-বক্ষা রমণী। কুরু বক মাথায় চুল উঁচু করে বাঁধা। বয়স বোঝার কোনো উপায় নেই, তেমনি সুঠাম দেহ। তার এই সাজটা মূলত শত্রুপক্ষের পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তার জালে আটকা পড়েছে এক অতিশয় সুসজ্জিত সুন্দরী রমণী। নাম বিশাখা বাত্তিক।

বিশাখা বাত্তিকের সৌন্দর্য বর্ণনায় মহাকবি কালিদাসের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। কালিদাসের শকুন্তলার মতোই বিনম্র এ রমণী। হরিণশাবক, বন্য পাখি, এমনকি বৃক্ষের সঙ্গে কথা বলার সরলতা তার। এমন সরল যে যেন লকলকে কচি বৃক্ষলতা, এখনই ভেঙে পড়বে।

মায়া হরিণের চোখ থেকে যেন মায়া ঝরছে চক্ষু দুটো থেকে। এই রমণী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

বাত্তিক ভাগুরজানের কাছেই জানতে চায় সম্রাট কোন শিবিরে থাকেন।

ভাগুরজান ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে চাণক্যের কাছে নিয়ে আসে।

তাহলে তোমার নাম বিশাখা বাত্তিক।

খুব সরলতায় জবাব দেয় সে, জি।

সম্রাটকে তোমার কী প্রয়োজন?

তাঁকেই বলব আমি।

সম্রাটের সঙ্গে তোমার দেখা হবে না

আমাকে যে দেখা করতেই হবে।

তাহলে প্রয়োজনটা বলো।

আপনি কি সম্রাটের অনুগত?

এখানে বেকায়দায় পড়ে গেলেন চাণক্য। কী বলবেন তিনি? যদি বলেন অনুগত, তাহলে সে আসল সত্য লুকোতে পারে। মেয়েটাকে চাণক্য ব্যবহার করার কথা ভাবছেন। একটু ভেবে বললেন, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। তুমি যদি সত্যটা বলো, অর্থাৎ কী জন্য সম্রাটের সাক্ষাৎ চাও, তাহলে আমি সম্রাটকে বলে তোমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেব।

তার আগে বলুন আপনি সম্রাটের মঙ্গল না অমঙ্গল চান?

বুঝতে পেরেছি আমি, তুমি সম্রাটের একজন অনুগত। মোটেই না।

কী বলছ তুমি? এখনই তোমার শিরশ্ছেদ করা হবে।

আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। আমার স্বামীকে সম্রাটের লোকেরা হত্যা করেছে। আমি সহমরণে যাব।

তোমাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?

মহামন্ত্রী রাক্ষস। আমি স্বামী হারিয়ে কাঁদছিলাম। রাক্ষস বললেন, যাও, প্রতিশোধ নিয়ে এসো।

তোমার স্বামী কী করতেন?

নন্দরাজার সৈন্য ছিলেন।

বুঝতে পেরেছি। তোমার মতো আমারও অনেক দুঃখ জমা আছে। আমিও সম্রাটের ধ্বংস চাই, বোন। তুমি কীভাবে তাঁকে মারবে?

বিষ দিয়ে।

বিষকন্যা তুমি! ঠিক আছে। ভাগুরজান সম্রাটের কাছে নিয়ে যাবে তোমাকে, বাত্তিক। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। পাশের ছাউনিতে অপেক্ষা করো তুমি।

গোয়েন্দা ভাগুরজানকে ভেতরে ডাকলেন চাণক্য। এই মেয়ে বড় কাজে লাগবে। বললেন, তুমি রাজা পর্বতেশ্বরের কাছে তাকে সরাসরি নিয়ে যাবে। বলবে সম্রাজ্ঞী পাঠিয়েছে রাজার সেবার জন্য। তোমাদের সঙ্গে আমাদের দুজন সৈন্যও যাবে।

রাজকীয় পোশাকে সাজল এরা রাজদূতের সাজে। পৌঁছে গেল সম্রাটের উপহার নিয়ে পর্বতেশ্বরের কাছে। পর্বতেশ্বর উপহার পেয়ে খুশি। ভাগুরজানকে গলা থেকে খুলে একটি মুক্তার মালা পরিয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, মন্ত্রীপত্নী কেমন আছেন?

ভাগুরজান এ প্রশ্নের মর্মার্থ কিছু বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। রাজা বললেন, মন্ত্রী কাজে এমন আন্তরিক যে তিনি তাঁর স্ত্রীকে আমার কাছে রেখে এসেছিলেন, আমি তাঁকে এখানে এসে মন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিনি ভালো আছেন। আপনাদের অনেক সুখ্যাতি করেছেন। আসলে ভাগুরজানের এ সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। মনে মনে ভাবল, এখানেও তোমাদের ধোঁকা দিয়েছেন চাণক্য। এ উপহারও কি সে রকম কিছু?

সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে এসবের কিছুই জানানো হয় নি। পরদিন সকালে সংবাদ এল পর্বতেশ্বরকে এক বিষকন্যা হত্যা করেছে। বিষকন্যারও মৃত্যু হয়েছে।

মিত্ররাজার মৃত্যুতে মৌর্যশিবিরে শোকের ছায়া। তাঁকে যুদ্ধজয়ের অভিনন্দন জানাতে সম্রাটের বিশাল ফুলের তোড়া নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। থাকত রঙিন সব ফুল। এখন সাদা ফুলের তোড়া বানাতে আদেশ দেওয়া হলো। সম্রাট অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন। চাণক্য স্বয়ং সবকিছুর ব্যবস্থা করছেন। তার আগে তিনি একবার পর্বতেশ্বরের শিবিরে গেলেন। যথারীতি শোকের কালো পোশাক পরেছেন। সর্বত্র শোকের ছায়া। নন্দরাজের মৃত্যুতে যুদ্ধবিরতি চলছিল। নতুন করে তার প্রয়োজন হলো না।

পর্বতেশ্বরের পুত্র মলয়কেতু ও ভ্রাতা বৈরোধককে নিয়ে একত্রে বসলেন। সবাই অধোমুখে চুপ করে আছেন। চিতার নীরবতা যেন রাজশিবিরকে গ্রাস করেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে চাণক্য দুজনের দিকে তাকালেন এবং গভীর শোক ব্যক্ত করে বললেন, সম্রাট এ ঘটনায় মর্মাহত। তিনি সব সময়ই রাজা পর্বতেশ্বরের ভক্ত ছিলেন, সেই আলেকজান্ডারের সময় থেকে। তিনি মনে হয় ভেঙে পড়েছেন। তিনি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেবেন। আমরা সবাই গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

এ কথা বলে চাণক্য দুজনের সঙ্গে আরও ঘন হয়ে বসলেন। বললেন, আমার লোকজন সংবাদ সংগ্রহ করেছে, এটি নন্দরাজের মন্ত্রী রাক্ষসের কাজ। বিষকন্যা নন্দরাজের এক সৈনিকপত্নী। রাক্ষস মেয়েটির ক্রোধকে ব্যবহার করেছে। আমরা তার প্রতিশোধ নেব।

চাণক্য এমনভাবে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে বললেন যে ওঁরা দুজন তা বিশ্বাস করলেন। যুবরাজ মলয়কেতু এখনই রাক্ষসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে চাইলেন। চাণক্য বললেন, এখনই নয়। সময় আছে। আগে দুটো কাজ করতে হবে। প্রথমটি রাজা নির্বাচন। সেটি আপনারাই করবেন। অন্যটি মহান রাজার যথাযোগ্য মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন। এটি আমরা সবাই মিলে করব।

আপনার সম্মুখে রাজা নির্বাচনে কোনো বাধা নেই। আপনি আমাদের দুঃসময়ের অকৃত্রিম বন্ধু। সম্রাট আমাদের পাশে আছেন। আপনারা না থাকলে আমরা হয়তো রাজ্যও হারাতাম। আবেগে কথাগুলো বললেন মলয়কেতু।

চাণক্য বললেন, আমরা এ শপথ নিয়েছি যে পরস্পরের সুখে-দুঃখে একসঙ্গে থাকব। একে আক্রান্ত হলে অন্যে তাকে রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ব। এ শপথ ও চুক্তি কখনো ভঙ্গ হওয়ার নয়।

মলয়কেতু বললেন, রাজা মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, তাঁর অবর্তমানে কাকা বৈরোধক রাজা হবেন। আমি কথা দিয়েছি। এখন পিতৃসত্য রক্ষা করার সময়, মাননীয় মহামন্ত্রী, বলে কেমন যেন ভেঙে পড়লেন রাজপুত্র। বৈরোধক তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, জগতে কিছুই স্থায়ী নয়, সবই নশ্বর। আমার কোনো সন্তান নেই, তুমিই আমার সন্তান, ভবিষ্যৎ রাজা।

চাণক্যের সামনে গলা জড়িয়ে দুজনই কাঁদলেন। আবেগে হয়তো সে সময় চোখে জল এসে যেত চাণক্যের, কিন্তু তা এল না, নিষ্ঠুরতার জন্য নয়, তিনি এতটা নিষ্ঠুর নন, তাঁর মাথায় অন্য এক প্লট। তাহলে এবার টার্গেট নতুন রাজা নৈরোধক।

মৌর্য শিবিরে ফিরে যাওয়ার পর রাত্রিবেলায় ছদ্মবেশে পর্বতেশ্বরের প্রধান সেনাপতি চাণক্যের ছাউনিতে উপস্থিত হলেন। ঘটনার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে চাণক্যের। তাই আগেই সেনাপতির কথা ভেবে রেখেছেন তিনি। প্রধান সেনাপতিকে খুব সমাদর করলেন। সেনাপতি বললেন, আপনার স্ত্রীর প্রস্তাব আমি গ্রহণ করেছিলাম। তিনি আপনাকে তা বলেছেন বোধ হয়।

বলেছেন, বলে থামলেন চাণক্য। পরে বললেন, আপনি কী চান?

আমি ক্ষমতা গ্রহণে আপনাদের সহযোগিতা চাই। আপনি সম্মতি দিলে ক্ষমতা গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময়। রানি কোনোভাবেই চান না বৈরোধক রাজা হোন।

রানি নিশ্চয় তা-ও চাইবেন না যে যুবরাজের পরিবর্তে আপনি রাজা হোন

তা চাইবেন না। না চাইলেই-বা কী?

এখন সেনাবিদ্রোহ পুরো ঘটনার জন্য দায়ী, অর্থাৎ রাজা হত্যার দায়ও আপনার ওপর বর্তে দিতে পারে। রাজ্যের প্রজা, বেশ কিছু সেনাসদস্য রাজার অনুগত, তা কি আপনি স্বীকার করেন? এরা রানির কথাই শুনবে।

আপনার অনুমান সঠিক। বৈরোধককে রানি পছন্দ করেন না।

কিন্তু রানি জানেন বৈরোধক নিঃসন্তান, প্রয়াত রাজার ইচ্ছাতেই রাজা হচ্ছেন এবং যুবরাজ মলয়কেতু তাঁর সঙ্গে আছেন। পরবর্তী রাজা মলয়কেতু, তা অনিবার্য।

রানিকেই না হয় সিংহাসনে বসান।

তাতে আপনার লাভ?

ওদের ক্ষমতা খর্ব হবে। রানি আমার ওপর নির্ভরশীল হবে।

না, হবেন না। এটা আপনার ভুল ধারণা। এরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবেন। আপনি অপেক্ষা করুন। এ সংকটকালটা পার করে দিন। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখুন। এদের সঙ্গে মিলে যান। সময় ও পরিস্থিতি নায়ক বানায়, মানুষ নয়। সে সময় ও পরিস্থিতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ রাখা লাগে। হিসাবে ভুল করলেই মারাত্মক পরিণতি।

প্রধান সেনাপতি চলে গেলে চাণক্য সম্রাটের ছাউনিতে গেলেন। পর্বতেশ্বরের মৃত্যুর ঘটনায় সম্রাট আসলেই মর্মাহত। তাঁকে এত বিমর্ষ কখনোই দেখা যায় নি। তিনি জানেন না যে বিষকন্যা চাণক্যের হাতে না পড়লে এ পরিণতি তাঁরই হতো। চাণক্য এটা কখনোই তাঁকে বলবেন না। চাণক্য কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, ওদের পরবর্তী রাজা বৈরোধক।

রাজপুত্র ময়লকেতু নয়? অবাক হলেন সম্রাট।

রাজাই নাকি বলে গিয়েছিলেন। অভিষেকের পরপরই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।

দুটোয় আমরা উপস্থিত থাকব, বললেন সম্রাট।

চাণক্য বললেন, তার আগে মলয়কেতু চাইছিলেন রাক্ষস শিবির আক্রমণ করতে।

যৌথ অভিযান?

না, এককভাবে।

প্রতিশোধস্পৃহা থেকে চাইছে। যৌথ অভিযানের কথা ভাবুন। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে?

তাঁরা জানতে পেরেছেন রাক্ষসই দায়ী।

আচ্ছা। যুদ্ধবিরতির পরই অভিযান শুরু করুন। যুদ্ধবিরতি আমরা লঙ্ঘন করব না।

নির্দিষ্ট সময়ে নতুন রাজার অনাড়ম্বর অভিষেক এবং প্রয়াত রাজার জাঁকজমকপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়ে গেল। রানি ও নতুন রাজার সঙ্গে সম্রাট স্বয়ং শেষ যাত্রায় অংশ নিলেন। বিউগলের করুণ সুর যেন সবাইকে কাঁদিয়ে দিল। সম্রাট বারবার ভাবছিলেন সে স্মৃতিবহ দিনের কথা, যেদিন রাজা পুরু আলেকজান্ডারের কাছে রাজার মর্যাদা দাবি করেছিলেন। এ রকম ভারতরত্নের এ রকম মৃত্যু! তিনি মানতে পারছিলেন না।

রাজার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরদিনই মলয়কেতু অতর্কিতে রাক্ষসের শিবির আক্রমণ করে বসেন। প্রধান সেনাপতি তাঁর সঙ্গে অংশ নিলেন বটে, তবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয়। ফলে মলয়কেতু পরাজিত হলেন। রাগে-ক্ষোভে মলয়কেতুর ফেটে পড়ার মতো অবস্থা। চাণক্য গিয়ে তাঁকে বোঝালেন যে এ সময়ে এককভাবে আক্রমণ না করে যৌথভাবে আক্রমণ করলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত। রাক্ষস এখন নিজেকে শক্তিশালী ভাববে এবং নানা রকম ফন্দি আঁটবে। তবে ভয় নেই, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। এখন থেকে যৌথভাবে অভিযান চলবে।

এ কথার মধ্যেই শেষ নয়, চাণক্য তাঁর গোয়েন্দা ভাগুরজানকে মলয়কেতুর কাছে সব সময় থাকতে নির্দেশ দিলেন। সে মলয়কেতুর সঙ্গে ভাব করে ফেলল। এতে চাণক্যের তথ্য পাওয়া সহজতর হলো এবং মলয়কেতুকে হত্যা করতে চাইলে তা-ও সহজ করার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠল

রাক্ষস সব খোঁজখবরই রাখেন। তিনি আবার চন্দ্রগুপ্তকে গুপ্তঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। নিজের সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ অবস্থা থেকে আগেই শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। এখন শক্তি সংগ্রহ করার চেষ্টায় আছেন।

চাণক্য একদিন গোয়েন্দার মাধ্যমে জানতে পারলেন রাক্ষস সুড়ঙ্গপথ তৈরি করছে সম্রাটকে মারার জন্য। তিনি নিজেই এ তথ্যের সত্যতা যাচাই করলেন। কিন্তু সম্রাটকে কিছু জানতে দিলেন না। সুড়ঙ্গের মুখে পাহারাদার বসাতে পারতেন, তা-ও করলেন না। কারণ, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে একসময় সম্রাটের কানে যেতে পারে। তিনি সুড়ঙ্গ পথের ওপর ছোট ছোট ছিদ্র করালেন। সেখানে মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য ফেললেন। তাতে বিষপিঁপড়ার ব্যাপক আমদানি ঘটল। গুপ্তঘাতকের দল বিষপিঁপড়ার কামড়ে পালিয়ে গেল।

এ যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। সম্রাট চাণক্যকে বারবার তাগাদা দিলেন। কারণটা চাণক্যও জানেন। এ নিয়ে তিনি কিছু বললেন না। বললেন, সম্রাট আমাদের নতুন মিত্র রাজের জন্য একটি মঙ্গল শোভাযাত্রা করা প্রয়োজন। এ মঙ্গলযাত্রা আমাদের মৈত্রীবন্ধন সুদৃঢ় করবে এবং যুদ্ধজয়কে সহজ করে তুলবে।

তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করার স্বার্থে সম্রাট তাতে সম্মতি দিলেন। চাণক্য এবার গেলেন রাজা বৈরোধকের কাছে। বৈরোধককে বললেন, রাক্ষসকে শেষ করতেই হবে। সে-ই রাজাকে হত্যা করিয়েছে। আবার মলয়কেতুকে পরাজিত করে আমাদের সম্মানহানি ঘটিয়েছে।

এখন কী করতে হবে আমাদের?

আমরা যৌথভাবে আক্রমণে যাব। তার আগে যৌথভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা করে আমরা শক্তির মহড়া দেব এবং ইষ্টদেবতাকে সন্তুষ্ট করব।

প্রস্তাব মন্দ নয়, করুন।

আপনাকে অবশ্যই এ মঙ্গল শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে হবে।

সম্রাট নেতৃত্ব দেবেন, আমি কেন?

এটি আপনার সম্মানে হচ্ছে, সম্রাটের ইচ্ছাও তা-ই।

বেশ। যা মনে করছেন।

আরেকটা কথা, অধিকৃত রাজ্য ও অঞ্চলসমূহ শোভাযাত্রার পরপর ভাগ করে দিতে চাই সম্রাটের সদিচ্ছার জন্য ধন্যবাদ!

নিজের ছাউনিতে ফিরে এসে চাণক্য অধিকৃত নন্দরাজের প্রধান স্থপতিকে ডেকে পাঠান। তাঁর কাছে খবর আছে, এই লোকটি রাক্ষসের হয়ে এখনো কাজ করছেন। প্রধান স্থপতি আসার পর তিনি বলেন, এমন একটি অভিজাত ধনুক প্রস্তুত করুন, যা দেখে লোকজন আমাদের গৌরব করবে।

যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য? স্থপতি জানতে চাইলেন।

না, এটি সম্রাটের মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহন করা হবে।

শোভাযাত্রাটি কখন হবে, মাননীয় মহামন্ত্রী।

চাণক্য তাঁকে দিন-ক্ষণ বলে দিলেন। তাঁর কেন এই নাটক, তা পরিষ্কার। তিনি চান যে শোভাযাত্রার সংবাদ রাক্ষসের কাছে পৌঁছুক।

কাঙ্ক্ষিত লোকজন নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু শোভাযাত্রা শুরু হচ্ছে না। একসময় চাণক্য বললেন, জ্যোতিষ আচার্য বলেছেন, শোভাযাত্রার উত্তম লগ্ন হচ্ছে মধ্যরাত। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কেউ কেউ অপেক্ষা করতে করতে হাই তুলল। কেউ কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে নিল। কেউবা আকাশের তারা গোনার চেষ্টা করল।

সম্রাট বললেন, আচার্য, আর কখন, দেখবেন শুভলগ্ন যেন পার না হয়ে যায়।

আমি লক্ষ করছি, মহামান্য সম্রাট।

আসলে দেরিটা আলো-আঁধারি সময়ের জন্য। ওই সময়টাই তাঁর দরকার।

সময় হলো। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের হাতিতে বসানো হলো নতুন রাজা বৈরোধককে। সঙ্গে দেওয়া হলো সম্রাটেরই নিরাপত্তাকর্মীদের। চাণক্য বললেন, নতুন রাজাকে সম্মান জানানোর জন্য এ ব্যবস্থা। সম্রাট চড়লেন বৈরোধকের হস্তীতে। পাশাপাশি যাচ্ছেন। দুজন সামনে, অন্যেরা পেছনে। বিশাল শোভাযাত্রা। রাজা বৈরোধক দারুণ খুশি। তিনি সম্মানিত বোধ করছেন, এ কথা সম্রাটকে জানালেন। সময়টাও তাঁর পছন্দ। দেশের, নিজের ও প্রজাদের মঙ্গলের জন্য এ সময়টাই তাঁর কাছে মূল্যবান মনে হলো। বিউগলে সামরিক সংগীতের সুর ধ্বনিত হচ্ছে। সৈনিক ও সাধারণ মানুষ সবাই এ সুরের মূর্ছনায় উজ্জীবিত ও প্রাণিত বোধ করছে। মধ্যরাতের নীরবতা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে। নিশাচর পাখিরা, বিশেষ করে লক্ষ্মীপ্যাঁচা আড়ালে থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কোনো কোনো প্রাণী অবশ্য বিরক্ত হয়েছে। এরা নির্ভয়ে প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করছে। অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না মঙ্গল শোভাযাত্রাকারীদের।

হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে কতগুলো তির উপর্যুপরি বিদ্ধ হলো রাজা বৈরোধকের মুখে ও বুকে। বিষাক্ত তির। হস্তীর ওপর থেকে নিচে পড়ে গেলেন তিনি। রাজকীয় চিকিৎসক এলেন। তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হলো।

বিভিন্ন জায়গায় চাণক্য লোক নিয়োজিত করে রেখেছিলেন। তির নিক্ষেপকারীদের ধনুকসহ ওরা ধরে নিয়ে এল সম্রাটের সামনে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এরা প্রধান স্থপতির কথায় এ কাজ করেছে। প্রধান স্থপতি ঘটনার পরই পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। তাকে পালাতে দেওয়া হয় নি। চাণক্যের চোখ তাকেও অনুসরণ করছিল।

জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করল, তাকে রাক্ষস বলেছেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হত্যা করতে। তিরন্দাজরা আলো-ছায়ায় বুঝতে পারে নি সম্রাট তাঁর নিজস্ব হাতিতে নেই।

তুমি বুঝতে পেরেছিলে? প্রশ্ন করেন চাণক্য।

যখন বুঝতে পারি, তখন কিছু করার আর সময় ছিল না।

এসব জিজ্ঞাসাবাদ হলো যুবরাজ মলয়কেতুর সামনেই। চাণক্য বললেন, এ দুর্ঘটনার জন্য আমরা লজ্জিত ও দুঃখিত।

সম্রাট যুবরাজের হাত চেপে ধরে বললেন, আমি মর্মাহত, দুঃখিত ও লজ্জিত। আমার মৃত্যু হলেও এত কষ্ট হতো না, রাজার মৃত্যুতে আমি এতটা ব্যথিত। হত্যার লক্ষ্য ছিলাম আমি, অথচ নির্দোষ একজন রাজা আমার জন্য প্রাণ হারালেন। রাক্ষসকে আমরা ধরে আনবই। তার উপযুক্ত সাজা হবেই।

এ ঘটনার পর তিরন্দাজ দুজন এবং প্রধান স্থপতিকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। তারপরও পর্বতরাজদের সঙ্গে মৌর্যদের ঐক্য ও মৈত্রী বন্ধন শিথিল হতে থাকে। সম্পর্ক একপর্যায়ে ভেঙে যায়। ভেঙে যাওয়ার একটি প্রত্যক্ষ কারণ আছে। মলয়কেতু রাজসিংহাসনে বসেছেন। তাঁর মাতা পর্বতেশ্বরের রানি যুদ্ধশিবিরে এলেন। এখানে নির্জলাকে তিনি দেখতে পান। চাণক্যপত্নী ব্রাহ্মণীকেও দেখতে পান। পুরো ঘটনা জেনে বড় মর্মাহত হন এবং ছেলেকে ব্যাপারটা অবহিত করেন। ছেলে শুধু উচ্চারণ করেন, ‘বিশ্বাসঘাতক’।

রানি বললেন, এরা সবই করতে পারে। আর নয়, মলয়। তুমি নিজে সামনে এগোনোর পথ দেখো।

অধিকৃত অঞ্চল আর ভাগ হলো না। মলয়কেতু এবার রাক্ষসের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন। পাশের প্রতিবেশী পাঁচটি রাজ্যের রাজারা মলয়কেতুর নেতৃত্বে তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেন। এ সংবাদ ছিল মৌর্যদের জন্য ভয়ংকর। তারই মধ্যে চাণক্যের লোকেরা জানায়, পাটালিপুত্রে রাক্ষসের তিনজন অনুগত এখনো অবস্থান করছে। এরা হচ্ছে জৈন সন্ন্যাসী জীবসিদ্ধি, নকলনবিশ শক্তদাস এবং অলংকার নির্মাতা সংঘের প্রধান চন্দন দাস।

চাণক্য বুঝতে পারেন না জীবসিদ্ধি কী করে রাক্ষসের লোক হয়। সে তো তাঁরই গোয়েন্দা। চাণক্য এদের পেছনে লোক লাগান এবং কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সংকল্প গ্রহণ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *