মৌর্য – ১৪

১৪

আলোচনা চলাকালেই মিত্রশক্তি নন্দরাজ্য আক্রমণ করে বসে। প্রথম আক্রমণেই নন্দরাজের মৃত্যু হয়। তাঁর মহামন্ত্রী রাক্ষস যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচেন। তবে তিনি দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধের সূচনা করেন।

যুদ্ধশিবিরে মহামন্ত্রী চাণক্যের সঙ্গে নির্জলার সাক্ষাৎ ঘটে। চাণক্য নির্জলার কাছ থেকে সব তথ্য জেনে জরুরিভাবেই পরিকল্পনা স্থির করে ফেলেন। সম্রাটের ছাউনিতে গিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানানো কি ঠিক হবে, ভাবলেন তিনি।

না। তাঁকে সেসব জানানো ঠিক হবে না। ব্যাপারটা সহজে সম্রাট মেনে নেবেন না। তিনি পর্বতেশ্বরের একজন শুভার্থী। চাণক্য সম্রাটের কাছে পর্বতেশ্বরকে অভিনন্দন জানাতে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন।

নন্দরাজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য তাঁর নিকটজনেরা সম্রাটের কাছে দূত পাঠালে সম্রাট কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। ব্যাপারটা বেশ স্পর্শকাতর। মহামন্ত্রী চাণক্য নন্দরাজের ব্যাপারে আপসহীন। কিন্তু মানবিক দিক থেকে এটা বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। তিনি পর্বতেশ্বরের পরামর্শ চাইলেন। পর্বতেশ্বর একজন রাজার প্রতি সব সময়ই শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের পক্ষপাতী। তিনি বললেন, অবশ্যই মৃত রাজার সৎকারের জন্য সময় দিতে হবে, যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়া আমাদের নৈতিক ও রাজকীয় দায়িত্ব। চাণক্য তা মেনে নিতে পারলেন না। ভেতর-ভেতর পর্বতেশ্বরের ওপর খেপে উঠলেন। কিন্তু উভয় রাজের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। নন্দরাজ শিবিরে শোক পালন চলল কয়েক দিন।

তবে নন্দরাজের মহামন্ত্রী চুপ করে বসে রইলেন না। তিনি ষড়যন্ত্রের নানা জাল বুনতে সচেষ্ট হলেন।

.

এদিকে গ্রিক রাজকুমারী নিজের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাম-ঠিকানাবিহীন চিঠিটা আবার বার কয়েক পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন, লোকটা তার নাম-ঠিকানা গোপন করেছে। যার জন্য দেহ-মন নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের শিকার, তার নাম-ঠিকানা, বংশপরিচয় কিছুই জানা নেই। অদ্ভুত মানুষ। কিন্তু সে একজন গুণী ব্যক্তি। ছবি আঁকতে পারে, ভালো করে পত্র লিখতে পারে। যা-ই হোক, রাজকুমারীকে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তাঁর এ অবস্থায় সহচরীরাও বিমর্ষ ও হতোদ্যম। তিনি তাদের ডেকে পাঠালেন। আবার ঝিলাম নদীর তটে, শানবাঁধানো ঘাটে নিজেরা হাস্য-কোলাহলে মত্ত হয়ে উঠলেন।

ঝিলাম বইছে তার নিজস্ব নিয়মে। বাতাস তার বুকে ছোট ছোট ঢেউ তুলে বহমানতার নিয়মের কোথায় যেন ব্যত্যয় ঘটিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ রাজকুমারী নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। সহচরীরাও স্তব্ধ। সহচরীরা ঘিরে ধরল তাঁকে। রাজকুমারী বললেন, চলো প্রাসাদের ভেতরে যাই। যেতে যেতে বললেন, বার্তাবাহক কবুতরটা কোথায়?

দিমিত্রি বলল, আছে, আমার যত্নেই আছে।

এটি নিয়ে এসো।

দিমিত্রি কবুতরটি নিয়ে আসতে গেল। এঁরা এরই মধ্যে প্রাসাদে পৌঁছে গেলেন। কবুতরটি রাখা হয়েছে সাধারণ খাঁচায়। রাজকুমারীর দেখে বড় নিঃস্ব মনে হলো কবুতরটিকে। রাজকুমারীর বার্তাবাহক এত দীনক্ষীণ। হু হু করে উঠল তাঁর বুক। বললেন, দিমিত্রি, আজই একটি স্বর্ণের খাঁচা বানাতে বলো। এখানে যত দিন সে থাকবে, স্বর্ণের খাঁচায় থাকবে, স্বর্ণের পাত্রে খাবে, স্বর্ণের পাত্রে পানি পান করবে। তোমরা ওর গলায় একটি পুণ্ড্রবর্ধনিয়া হিরের হার পরিয়ে দেবে।

এসব কথা শুনে সহচরীরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করল। রাজকুমারী কবুতরটিকে আদর করলেন, চুমু খেলেন। তারপর বললেন, আজই তার সোনার খাঁচা চাই। সে আমার সঙ্গেই থাকবে।

সহচরীরা চলে গেলে রাজকুমারী পত্র লিখতে বসলেন। আজ সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লিখছেন আর প্যাপিরাসের পাতাগুলো ছিঁড়ছেন। দলা করে ফেলছেন এদিক- সেদিক। এবার ওপরের দিকে তাকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন। এত ঐশ্বর্য চারদিকে, তবু মনে হলো তাঁর কিছু নেই, একেবারে শূন্য।

আচার্য ভদ্ৰবাহু পাটালিপুত্রে প্রত্যাবর্তন করেছেন। সম্রাজ্ঞী দুরধরা গেছেন তাঁর কাছে। যুদ্ধযাত্রাকালে সম্রাট তাঁকে পান নি। যুদ্ধের ফলাফল কী হবে এবং তাঁর গর্ভে যে সন্তান, তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে, এ নিয়ে ভবিতব্য জানতে চান তিনি।

ভদ্রবাহুকে উদ্দেশ করে সম্রাজ্ঞী বললেন, আচার্য, আপনার অনুপস্থিতিতে বরাহ মিহিরের সঙ্গে পরামর্শ করে সম্রাট যুদ্ধে গেছেন। আমি তাঁকে যেতে দিতে চাই নি। কিন্তু অনিবার্য এ যুদ্ধে নাকি তাঁকে যেতেই হবে।

ধ্যানাসনে বসে আচার্য ভদ্রবাহু চোখ বন্ধ করে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। পরে বললেন, দেবী চন্দ্রগুপ্তাম, যুদ্ধে মৌর্যদের জয় হবে। তবে প্রচুর ঘটনা ঘটে যাবে এ যুদ্ধে।

সম্রাটের কোনো ক্ষতি হবে না তো?

না, তা হবে না। বলে ভদ্রবাহু নিশ্চিত ভয়াবহ এক দৃশ্য দেখতে পেলেন। সম্রাটকে বহনকারী হাতিটি একটি বিড়ালকে পদদলিত করে চলে গেছে। ভদ্রবাহু তার পরিণাম কী হবে, তা-ও দেখলেন এবং শিউরে উঠলেন। সম্রাজ্ঞী তা লক্ষ করে বললেন, কোনো খারাপ কিছু?

আচার্য প্রথম অর্ধেকটা সম্রাজ্ঞীকে বললেন। বাকিটা গোপন করলেন। পরে পুণ্ড্রবর্ধন থেকে নিয়ে আসা একটি দুকুল বস্ত্র সম্রাজ্ঞীর হাতে তুলে দিলেন। সম্রাজ্ঞী খুশি হয়ে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *