১২
ভদ্রবাহু দীর্ঘদিন হলো পুণ্ড্রবর্ধন গেছেন। সেখান থেকে তাঁর কোটিবর্ষ যাওয়ার কথা রয়েছে। যুদ্ধের সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করে নেওয়া হয়েছে, তিনি এ যুদ্ধের কথা জানেন না। তাই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের তাঁর আধ্যাত্মিক গুরুর কাছ থেকে কোনো উপদেশ বা পরামর্শ নেওয়া হয় নি। সাম্রাজ্যের ভেতর থেকে বেশ তাগাদা ছিল, অপেক্ষা করা তাই সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া গ্রিক রাজকুমারীর ব্যাপারে আধ্যাত্মিক গুরুর ইতিবাচক অভিমত রয়েছে। চন্দ্রগুপ্ত একেই যুদ্ধেরও আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
আচার্য ভদ্রবাহু বছরে একবার অন্তত নিজের জন্মভূমিতে যান। বেড়ানোর জন্য নয়, পুণ্ড্রবর্ধনের চতুর্মুখ জৈন মন্দিরে জৈন দর্শন সম্পর্কে বেশ কতগুলো অভিভাষণ দেওয়াই লক্ষ্য। কোটিবর্ষেও একই আয়োজন থাকে। তবে পুণ্ড্রবর্ধনের আয়োজনটা থাকে বেশ বড়সড়। এবার তিনি জৈন ও আজীবিক দর্শনের তুলনামূলক একটা বক্তৃতা তৈরি করে নিয়ে গেছেন। পুণ্ড্রবর্ধন, কোটিবর্ষ প্রভৃতি স্থানে প্রচুর আজীবিকের বাস।
আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। এ কথা দিয়ে শুরু করলেন তাঁর বক্তৃতা। তাকালেন চারদিকে। প্রচুর দিগম্বর জৈন ও দিগম্বর আজীবিকের সমাবেশ ঘটেছে, সবাই পদ্মাসনে বসেছেন। অদ্ভুত সে দৃশ্য। পাশাপাশি বসেছেন এঁরা, আলাদাভাবে। দুই ধর্মের আচার্যরা সামনে বসেছেন। তাঁদের পেছনে শ্রমণ ও উভয় ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষ। ভদ্রবাহুর প্রতি ধর্ম- বর্ণনির্বিশেষে সবারই শ্রদ্ধা ও ভক্তি রয়েছে।
জৈনধর্মের নামকরণের মধ্যে তার আধ্যাত্মিকতার বীজ লুক্কায়িত আছে। সংস্কৃত জিনা, অর্থাৎ বিজয়ী শব্দ থেকে জৈন শব্দটি এসেছে। বিজয়ী কার বিরুদ্ধে? নিজের ভেতরকার ক্ষতিকর ইচ্ছা, বোধ, গর্ব, লোভ প্রভৃতি থেকে। লক্ষ্য স্বর্গীয় বিশ্ব।
অন্যদিকে সংস্কৃত আজীব শব্দ থেকে ‘আজীবিক’ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ জীবিকা বা জীবনচর্চা। আজীবিক জৈনধর্মের মতোই ভারতীয় দর্শনের নাস্তিক্যবাদী ধর্মসম্প্রদায়। বৌদ্ধরাও তাই। জৈনধর্মের মতো এই ধর্মও কৃচ্ছ্রব্রতী, ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী ও কিছুটা হতাশাপ্রবণও। শ্রমণ আন্দোলন থেকে এই ধর্মের জন্ম। এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গোশালা জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের বন্ধু ছিলেন। বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি, যেমন আমাদের মহামন্ত্রী চাণক্য এ ধর্মমত বিশ্বাস করেন। আজীবিক দর্শন চার্বাক দর্শনের মতো বিজেতা, শিল্পপতি ও বণিকশ্রেণির প্রাচীন ভারতীয় সমাজের কাছে বেশি সাড়া জাগিয়েছে।
দার্শনিক পর্যায়ে এ ধর্ম নিয়তিনির্ভর, পরাধীন, ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই এখানে, সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত, এমনটা বিশ্বাস করে। পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যে বিশ্বাস পরজীবনকে প্রভাবমুক্ত রাখে। মোক্ষলাভের ক্ষেত্রে সাধারণ জীবনযাপন কোনো উপায়ই নয়, তর্কেরও কর্তৃত্ব নয়, সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত মহাবিশ্বের নিয়মে চলছে। ধর্মকর্ম ভাগ্যের পরিবর্তন আনতে পারে না। নীতির প্রশ্নও ও অবান্তর। মানুষ তার নিজের ইচ্ছায় নয়, যা কিছু করছে, মহাবিশ্বের নিয়মই তা করাচ্ছে, যা ঘটছে ভবিষ্যতেও তা ঘটবে। কর্ম নয়, নিয়তিই চূড়ান্ত। আজীবিকেরা মনে করেন, কর্মফলবাদ হচ্ছে ভুল ও বিভ্রান্তিকর মতবাদ। এঁদের মতে, সত্তার প্রকৃতি ও জ্ঞানসংক্রান্ত দর্শন বা অধিবিদ্যা পরমাণুতত্ত্বের সঙ্গে সংযুক্ত। সেখানে সবকিছুই পরমাণুর সমন্বয়, গুণাগুণটা নির্ধারিত হয় পরমাণুর যৌগকর্মেই, কিন্তু যৌগিক কিংবা প্রাকৃতিক এসব পরমাণুর এ কর্মগুলো মহাজাগতিক শক্তির পূর্বনির্ধারিত।
আজীবিকেরা আমাদের মতোই নাস্তিক ও বেদের কর্তৃত্ববিরোধী। তবে হিন্দু ও জৈনধর্মের মতোই এঁরা বিশ্বাস করেন, সব জীবই হচ্ছে এক একটি আত্মা।
এ কথা বলে জল পান করলেন ভদ্রবাহু। তারপর আজীবিকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভুল কিছু বলেছি কি?
সামনের সারিতে উপবিষ্ট আজীবিক আচার্যরা উৎফুল্লসহকারে বললেন, না, কিছু ভুল বলেন নি। একজন বললেন, এত সুন্দরভাবে বোধ হয় আমরাও বলতে পারব না।
আচার্য ভদ্ৰবাহু সৌম্য হাসি হাসলেন। এবার শুরু করলেন জৈন দর্শনের ব্যাখ্যা। মাঝখানে বললেন, উভয় ধর্ম সম্পর্কে আপনাদের জিজ্ঞাস্য থাকলে আমাকে প্রশ্ন করবেন বক্তব্য শেষ হওয়ার পর। তিনটি প্রধান নীতি আছে জৈনধর্মে। অহিংসা, অন-একাত্মবাদ ও অপরিগ্রহ। ব্রত আছে পাঁচটা অহিংসা, সত্য, অসত্য, ব্রহ্মাচারিত্ব, অপরিগ্রহ। প্রার্থনা: আত্মার মুক্তির জন্য আধ্যাত্মিক ধ্যান। নামোকার, মন্ত্রপাঠ। প্রার্থনা বস্তুগত প্রাপ্তি কিংবা শত্রুর বিনাসের জন্য নয়, আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য। ধ্যান সাময়িক, মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ।
জৈনধর্মে জীব বলা হয় আত্মা-দ্রব্যকে। তার পাঁচটা দ্রব্য (বস্তু, সময়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, ধর্ম ও অধর্ম) থেকে আলাদা। সামগ্রিকভাবে এদের বলা হয় অজীব। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আত্মা বস্তু হচ্ছে আত্মগত, যা অন্য দ্রব্যে পাওয়া যাবে না। আত্মা প্রকৃতিগতভাবে মুক্ত। জ্ঞান, ভোগ, উপভোগ, দুর্ভোগ—সবই হচ্ছে পরিবর্তন বা সংযোজন। অবস্থাভেদে তার তারতম্য ঘটে। জৈনসূত্রগুলো মনে করে, সব জীবিত প্রাণীই আত্মা, অন্তর্নিহিতভাবে নিখুঁত ও অমর। আত্মা এক দেহ থেকে অন্য দেহে বন্দী থাকে।
অজীব (অনাত্মা) নির্বোধ বস্তু, কণা বা পরমাণু দ্বারা তৈরি। এ পরমাণুগুলোর অস্তিত্ব গুণগতভাবে নাম, স্বাদ, গন্ধ, রং, নির্দিষ্ট আকার, স্পর্শ ও শব্দে উপলব্ধিযোগ্য এবং সংবেদনশীল। সময় হচ্ছে বহমান অশেষ এক উত্তরাধিকার। জৈনরা দুরকম সময়ে বিশ্বাস করে— নিশ্চয় ও ব্যবহারী। আকাশ বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দুভাগে বিভক্ত—লোক আকাশ (বিশ্ব) এবং আলোকাকাশ (বিশ্বের পশ্চাতে) (নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর সালাম বলেছেন, এ বিশ্বের বিপরীতে আরেকটি বিশ্ব আছে)। লোকাকাশে আত্মা, বস্তু, সময়, ধর্ম ও অধর্মকে পাওয়া যাবে। অন্যদিকে আলোকাকাশে রয়েছে বিশুদ্ধ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, যেখানে কোনো বস্তুর পরিবর্তন বা টেনে বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়।
জৈন দর্শন মনে করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কেউ সৃষ্টি করে নি। তার অস্তিত্বও শেষ বা বিলুপ্ত হবে না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার জন্য কোনো অলৌকিক ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। জৈন গ্রন্থগুলোয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার বিস্তৃতি, আকৃতি, কাল, বাস্তব-অধিবাস্তব অবস্থা, মহাবিশ্বের গঠন, তার শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। এত কম সময়ে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।
জৈন দার্শনিকেরা মনে করেন, বিশ্ব তিন ভাগে বিভক্ত, ঊর্ধ্বলোক, মধ্যলোক ও অধঃলোক। ত্রিলোকব্যাপী ছয়টি বিষয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান। জীব, বস্তু (জড়), ধর্মত্ত্ব, গতিমান বস্তু, অধর্ম তত্ত্ব, বাকি আকাশ ও কাল। কাল বা সময়ের শুরু বা শেষ নেই। এটা স্বর্গীয় নয়, এটা মহাজাগতিক, চাকা-কালচক্র। কাল মহাবিশ্বের একটি অংশ। সেখানে (মহাবিশ্বে) উত্থান-পতন আছে, পুনর্জন্ম এবং অধঃপতন আছে। আছে বিশ্বচক্র, অর্ধচক্র, উৎসর্পিণী ও অবসর্পিণী। উৎসর্পিণী প্রগতি ও সমৃদ্ধি বাড়ায়, সেখানে সুখ বৃদ্ধি পায়। অবসর্পিণী দুঃখ এবং অনাদর্শ বৃদ্ধি করে। মহাকাশবিদ্যা মতে, আমরা পঞ্চম যুগে অবস্থান করছি। বর্তমান সময়টা অবসর্পিণীর, দুঃখ ও দুর্দশার। এ সময় মুক্তি সম্ভব নয়। অবসর্পিণীর অবসান হলেই শুধু বিয়াল্লিশ হাজার বছর পর আবার ধর্ম দেখা দেবে, মুক্তির সুখ ফিরে আসবে। আমাদের স্বস্তিকা প্রতীকটা সে বার্তাই দিচ্ছে।
আমাদের দর্শনে দেহ বা বস্তু—দ্রব্য থেকে আলাদা। দার্শনিকেরা বলেন, অনুঘটক সামান্য উপাদান হতে পারে। এটা সহজ বাস্তবতা। আর পরবর্তী সময়ে তাই এক বা একাধিক দ্রব্য বা পরমাণুর সংমিশ্রণ। শরীর বা বস্তু আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, পুরোটা নয়।
মানবাত্মা নিয়ে দু-একটি কথা বলা দরকার। পরস্পরের আত্মার বন্ধন সৃষ্টি জৈনধর্মের একটি পালনীয় কর্তব্য। সাম্য বা সাম্যয়িকাধ্যান শুধু মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি নয়, একাধিক আত্মার মধ্যে আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করে।
মানবপ্রেম ও ভ্রাতৃত্বের এর চেয়ে বড় উপায় আর বোধ হয় নেই।
(ভারতীয় নাস্তিক্যবাদী দর্শন অনুসরণ করে এ সময়ের তিনটি প্রধান ধর্ম—জৈন, আজীবিক ও বৌদ্ধধর্ম। মৌর্য সাম্রাজ্যে তিনজন সম্রাটের রাজত্বকালে তিনটি ধর্ম রাজকীয় ধর্মের মর্যাদা পায়। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় জৈনধর্ম, সম্রাট বিন্দুসারের সমযে আজীবিক ধর্ম এবং সম্রাট অশোকের সময়ে বৌদ্ধধর্ম। সম্রাটগণ উল্লিখিত ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।) ঈশ্বরে বিশ্বাস না করার অর্থ হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা। কোনো দেবতা নয়, মানুষই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে। কর্মে, আধ্যাত্মিক শক্তিতে নিজেকে আবিষ্কার করে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে। মানব সম্ভাবনার অন্ত নেই। মানুষ যা ভালো বুঝবে, তা-ই করবে। ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকবে। মহাজাগতিক নিয়ম আমরা পাল্টাতে পারব না ঠিক, কিন্তু তার কাছে আত্মসমর্পণও করব না। সত্তার প্রকৃতি ও জ্ঞানসম্পর্কিত দর্শনশাস্ত্র বা অধিবিদ্যা পরমাণুতত্ত্বের সঙ্গে সংযুক্ত, আজীবিকদের এ তত্ত্ব সঠিক। তবে সব সময় মেনে নেওয়া কঠিন যে, যৌগিক ও প্রাকৃতিক পরমাণুতত্ত্ব মহাজাগতিক চাকা সচল রাখছে ও থাকবে। অন্যথায় বিশ্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এ পর্যন্ত বলেই ক্ষান্ত হলেন ভদ্রবাহু, তাকালেন সবার দিকে। যদি কেউ প্রশ্ন করে। না, কারও কোনো প্রশ্ন নেই। হয়তো সবাই মুগ্ধ অথবা এমন কেউ নেই, যার মনে কোনো প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে সবাইকে ভারতীয় রীতিতে হাত জোড় করে অভিবাদন জানালেন আচার্য। তাঁর প্রতি বিনতভাবে দাঁড়িয়ে সবাই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলেন।