১১
গ্রিক রাজকুমারী পত্র পেয়ে মজা করার জন্য সহচরীদের ডাকলেন। পাঁচটা মোমবাতি জ্বালালেন। ধূপের গন্ধ ছড়ালেন। অতঃপর তুমুল হাস্যরোলের মধ্যে পত্রটি খুললেন। হতবাক হয়ে গেলেন তাঁর একটি ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি দেখে। খুব উঁচুদরের শিল্পী না হলে এ রকম ছবি আঁকা যায় না। তাঁর যে মজা করার ইচ্ছা ছিল, তা ক্রমে স্তিমিত হয়ে এল। সহচরীরাও গম্ভীর হয়ে এল। রাজকুমারীর মনোভাব বুঝতে পেরে এরা একে একে উঠে চলে গেল।
রাজকুমারী পত্র পাঠ করলেন। পত্রটি এ রকম:
হে আমার স্বপ্নের রাজকুমারী! দূরদিগন্তবাসিনী! আপনার পত্র পেয়ে কী যে উচ্ছ্বাসময় এক ঝড় বইছে, প্রকাশ করতে পারছিনে। তাতে সফেন সমুদ্র যেন উত্তাল হয়ে উঠেছে। সত্যিই কি এ পত্র আপনি লিখেছেন? আপনি বলেছেন, ভারতীয় দেব-দেবীদের কথা লিখতে।
সীতা, দ্রৌপদী—এরা ধরার সবচেয়ে সুন্দরী নারী। এদের জন্য ভারতবর্ষে দু-দুটি মহাযুদ্ধ ঘটে গেছে। লেখা হয়েছে ‘রামায়ণ-মহাভারতের মতো জগৎ বিখ্যাত মহাকাব্য। স্বর্গের দেবীরা তাদের স্বামীদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করে। উর্বশী স্বর্গের নয়, বরং কালীর পূজাই বেশি করে। কালী সবচেয়ে অসুন্দর দেবী। গ্রিসেও কি এ রকম দেবী আছে?
মর্তের মানুষই সুন্দর। স্বর্গের দেবদেবীদের আমি দেখি নি। অন্যেরা দেখেছে কি না, জানি না। মনে হয় কল্পিত। আপনাকে দেখেই মনে হয়েছে স্বর্গের এক দেবী মর্তে নেমে এসে সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। আমার মনের গভীরে আপনার জন্য একটি আসন তৈরি হয়েছে। ওই আসনে নিত্যদিন বসবাস আপনার। আমার মনে আপনার যে প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়ে আছে, তার একটি প্রতিচ্ছবি এঁকে পাঠালাম। অপছন্দ হলে ক্ষমা করে দেবেন।
আমার জীবন এক অদ্ভুত জীবন। কখনোই ভালোবাসা পাই নি। আর সবকিছুই পেয়েছি। অপূর্ণতা কিছুতেই নেই। কিন্তু আপনাকে যেদিন দেখলাম, সেদিনই মনে হলো, শুধু ভালোবাসা নয়, কিছুই পাই নি আমি। অপূর্ণ, সবকিছু অপূর্ণ। কোনো এক দূরদেশিনী, সবকিছু হরণ করে বসে বসে হাসছেন। মধুর হাসিনী। এ হাসির অর্থ কী? শ্লেষের হাসি? নাকি মুগ্ধ নিবেদনের হাসি?
আজ আর নয়। আপনারই—
প্ৰণয়প্রার্থী।
প্রথমে প্রতিকৃতি দেখে এবং পরে পত্র পাঠ করে রাজকুমারীর ভাবান্তর ঘটল। একধরনের চিন্তার আবর্তে ঢুকে গেলেন তিনি। সারাক্ষণ বিষয়টি নিয়ে ভাবেন। কেমন যেন হতোদ্যম হয়ে গেছেন। কিছুই ভালো লাগে না। সহচরীরা তাঁকে নিয়ে চিন্তিত। খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম ঘটে যাচ্ছে। খেলাধুলায় সম্পৃক্তি নেই। পত্রের উত্তর কেমন করে দেবেন, বুঝতে পারছেন না।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত যুদ্ধে যাচ্ছেন। সম্রাজ্ঞী দুরধরা খুবই বিমর্ষ। যুদ্ধের ফলাফল কী, তা তাঁর জানা নেই। যুদ্ধে সম্রাট আগেও বহুবার গেছেন, সম্রাজ্ঞী যাত্রাকালে পুষ্পচন্দন দিয়ে তাঁদের বিদায় দিয়েছেন। রীতি মেনে এবারও তাঁকে এ কাজ করতে হবে। সন্তানসম্ভবা হওয়ায় উৎসবের মতো যুদ্ধযাত্রার আনুষ্ঠানিকতায় মন সরছে না। তবু তিনি উঠে দাঁড়ালেন। উত্তমরূপে সাজসজ্জা করলেন। সম্রাটের প্রাসাদের সামনে হস্তী, অশ্ব, রথী, পতাকাবাহী ও পদাতিক বাহিনীর বিপুল সমাবেশ। সবকিছুর মধ্যে সাজ সাজ রব। নানা রঙিন বস্ত্রে সুসজ্জিত প্রতিটি বাহিনী।
সম্রাজ্ঞী ও সম্রাটকে নিয়ে প্রাসাদের সামনে এলেন মহামন্ত্রী চাণক্য ও প্রধান সেনাপতি। চাণক্য নিজেও যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়েছেন। তাঁর কোমরে শোভা পাচ্ছে ক্ষুরধার তরবারি। সম্রাট যুদ্ধের সেই সাজই গ্রহণ করেছেন, যা বরাবর করে থাকেন। মাথায় শিরস্ত্রাণ, শরীরে বর্ম, হাতে ঢাল-তরবারি, কোমরে কোমর বন্ধ, কবজি ও পেশিতে অঙ্গদ এবং পায়ে উঁচু জুতো—সবকিছুই ধাতব পদার্থ দ্বারা তৈরি।
সম্রাজ্ঞী মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিলেন বিপুল কাড়া-নাকাড়া ঢোলক ধ্বনির মধ্যে। চারদিকে উচ্ছ্বাসময় তেজদীপ্ত এক প্রাণবন্যা বয়ে গেল। জয়ধ্বনি উঠল 1
সম্রাট আস্তে আস্তে দৃঢ় পদ নিক্ষেপে সম্রাজ্ঞীর কাছে এলেন এবং বললেন, সম্রাজ্ঞী, সাবধানে থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন। আমাদের সন্তান এখন আপনার একক তত্ত্বাবধানে। বিধাতা আপনাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। আমি ফিরে আসব নিশ্চয়। বিজয়ীর বেশেই আসব।
সম্রাজ্ঞী বহু কষ্টে অমঙ্গল অশ্রু সংবরণ করলেন। সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রাণনাথ, বিজয়ীর বেশই আপনাকে মানায়। মৌর্যকুলের গৌরব আপনি। তবু কোথায় যেন যন্ত্রণা চুপ করে আছে, বিচ্ছেদ, ব্যবচ্ছেদ সে তো বিধাতারই লীলা। তাঁর লীলা বোঝা ভার।
সম্রাটের ললাটে মঙ্গল ফোঁটা এঁকে দিলেন সম্রাজ্ঞী। সম্রাটের যুদ্ধযাত্রা শুরু হলো।