মৌর্য – ১০০

১০০

সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিটি এ রকম :

আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই ‘ওষুধ’ পাঠানোর জন্য। এ ওষুধ সেবন করে আমি যুবকের জীবন যাপন করছি। আমি আগামী সপ্তাহে ইজিপ্ট আক্রমণ করব। ভাবছেন যুদ্ধহস্তী চাইব, না, তার প্রয়োজন হবে না। একটা বাচ্চা ছেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাচ্ছি, তবু ইজিপ্ট বলে কথা।

আমি এখন এশিয়ামাইনরে। আমার যুদ্ধসঙ্গী আরসিনোয়ের আতিথ্যে চমৎকার দিন কাটছে। সে টলেমির মেয়ে। এশিয়া মাইনরের একাংশের রানি। লাইসিমেসিয়া জায়গাটার নাম। লাইসিমেকাস নিজের নামে এর নামকরণ করেছিল। তাকে আমি হত্যা করেছি। আরসিনোয়ের অযোগ্য স্বামী ছিল সে। এখন আমি ইজিপ্ট ছাড়া আলেকজান্ডারের সমস্ত অধিকৃত এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নেই। ইজিপ্ট অধিকার হয়ে গেলে একবার ভাবুন কত বড় সাম্রাজ্য হবে আমার। এখানেই শেষ নয়, গ্রিস আক্রমণের পরিকল্পনা আছে। বাকি জীবনটা গ্রিসে কাটাতে চাই, সেটি আমার পিতৃভূমি। তখন আপনার হাতির প্রয়োজন হতে পারে। ওরা আমাকে নাগরিকত্ব দিয়ে রেখেছে। নাগরিক হিসেবে সে দেশ আক্রমণে পাপ নেই।

এযাবৎ যতগুলো যুদ্ধে আমি জয় লাভ করেছি, সবগুলোরই জয়ের স্মারক মুদ্রা রয়েছে। এগুলোর একটি করে আপনার জন্য এবং একটি করে কর্নেলিয়ার জন্য পাঠালাম। এসব মুদ্রা দেখে সে গর্ববোধ করবে। আপনিও শ্বশুরের সাফল্যস্মারক মুদ্রা দেখে উৎসাহবোধ করবেন এবং নতুন নতুন রাজ্য জয়ে প্রাণিত বোধ করবেন।

প্রথম বিজয়ের স্মারকমুদ্রা হিসেবে আলেকজান্ডারের অশ্ব বুচফালাসের মস্তকচিহ্নিত উজ্জ্বল স্বর্ণ মুদ্রাটি অবমুক্ত করি। ব্যাবিলন জয় করে মুদ্রায় আলেকজান্ডারের প্রতিকৃতি ব্যবহার করি। আপনি যুদ্ধহস্তী দিয়েছিলেন। সে হস্তী মুদ্রিত করি ইপসাসের যুদ্ধজয়ের পর। এরকম দুটো রুপার মুদ্রা অবমুক্ত করি। লাইসিমেকাসকে পরাজয়ের আগে দিমিত্রিয়াসকে পরাজয়ের পর দুটি। এ মুদ্রাও স্বর্ণের, তবে এত উজ্জ্বল নয়। জীবনের সাফল্যের স্মারক ও একসময় বর্ণ হারায়। ব্যাপারটা প্রতীকী। তবে আবার ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে আমার ইজিপ্ট জয়ের সাফল্য এবং তা অচিরেই।

আমি জানি না কী কারণে কর্নেলিয়া আমার ওপর অভিমান করে আছে। অভিমানী মেয়ে আমার। শুনেছি পাটালিপুত্রে তার বেশ জনপ্রিয়তা, হয়তো প্রভাবও। একটি কথা, সে জানে না, ওষুধ খাইয়ে আমি তার প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছি। আমি চাইনি আমার গ্রিক প্রিন্সেস কোনো ভারতীয়ের সন্তান গর্ভে ধারণ করুক। তাতে সংকর একটি জাতির সৃষ্টি হোক। এটি অন্যায় স্বীকার করছি, তার চেয়েও বড় জাতি হিসেবে গ্রিকদের আভিজাত্য ও মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে রাখা উচিত বলে মনে করি। আপনি ব্যাপারটা কীভাবে নেবেন জানি না, তবে উদারতার দৃষ্টিতে দেখলে সংকট থাকবে না।

আপনার দাক্ষিণাত্যে অভিযানের কথা শুনেছিলাম, তার ফলাফল জানাবেন।

ইতি
সেলুকাস।

চন্দ্রগুপ্ত পত্রটি হেলেনের হাতে তুলে দিলেন। হেলেন একবার চোখ বুলিয়ে নির্বিকার অবস্থায় পত্রটি আবার ফেরত দিলেন। মুখে বললেন, এ ঘটনার কথা আমি জানি।

তুমি জানতে হেলেন! অবাক হন চন্দ্ৰগুপ্ত 1

হ্যাঁ, কিছুদিন আগে শুনেছি।

জেনে তুমি এত নির্বিকার থাকতে পারলে?

কান্নাকাটি করলে, আপনাকে জানালে কী হতো? আপনি কষ্ট পেতেন। কষ্টটা তার চেয়ে আমিই একা বয়ে বেড়াই, তা উত্তম নয় কি?

কেন তুমি একা বয়ে বেড়াবে? তোমার তো কোনো দোষ নেই।

আছে। আমি সিরীয় মায়ের সন্তান গ্রিক কুলে জন্মেছি, এটাই তো বড় দোষ।

তোমার এটা দোষ হতে যাবে কেন?

আমাদের গ্রিক পুরাণে আছে, কেউ পাপ করলে বংশপরম্পরা সে পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এটাই নিয়তি।

চন্দ্রগুপ্ত হেলেনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হেলেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি, এ কষ্ট তোমার একার হবে কেন? আমাকেও ভাগ দাও।

হয়তো আমার মায়ের পাপেই এ শাস্তি।

আমার মাও তো একই রকম পাপ করেছেন। পাপের সন্তান মনে করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছেন।

হেলেন বললেন, এতে বড় পাপ নেই আর এটা নিয়তিও নয়, বড়জোর ভারতীয় কর্মফলবাদ।

ভারতীয় কর্মফলবাদ তুমি জানো?

হেলেন এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না।

একটু ভেবে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, এ জন্যই কি তুমি সম্রাটের পূর্বে প্রেরিত পত্রের প্রতি আগ্রহ দেখাও নি?

হেলেন এবারও চুপ করে থাকলেন। পরে বললেন, আমি লজ্জিত, সম্রাট, আপনাকে মনে হয় আঘাত করার জন্যই আমার পিতা এ কথা লিখেছেন, আমি দুঃখিত।

আমার মনে হয় তিনি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। কী বলছেন হয়তো তিনিও জানেন না। হতে পারে। কোনো সুস্থ মানুষ এ রকম লিখতে পারে না। আরসিনোয় বোধ হয় তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে।

আমিও কিছু ভুল করেছি, হেলেন। তোমাকে না জানিয়ে উত্তেজক ওষুধ পাঠিয়েছিলাম। যাক, আমাদের সন্তান তো আছে। তুমি তাকে আপন করে নাও। আমার অবর্তমানে তুমিই তো তার অভিভাবক।

সম্রাটের মুখে এ কথা শুনে হেলেন কাঁদলেন। অঝোরে কাঁদলেন। সম্রাট মনে মনে বললেন, কাঁদো হেলেন, কাঁদো। আমি তোমার এ কান্নাটিই চেয়েছি।

.

মেগাস্থিনিসকে এগিয়ে দিতে এসে শর্মিলা বৃক্ষ-উদ্যানে প্রবেশ করলেন। উদ্যানের সরোবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন দুজন। প্রথম দিনের দৃশ্য মনে পড়ে গেল মেগাস্থিনিসের। বত্তিচেল্লীর ভেনাস যেন আবার দণ্ডায়মান। ডান হাতে বুকের দুই আদিম পাথর এবং বাঁ হাতে লজ্জার স্থান মাথার চুল দিয়ে ঢাকা। জলে ভাঙছে মূর্তিমান শরীর। আজ মেগাস্থিনিস এসবের মধ্যে শুধু শিল্প অথবা দেবতার দেববিলাসকে উপলব্ধি করলেন, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করলেন তিনি। তা কি স্বর্গীয় প্রেম? কাম কিংবা দেহাতীত অনুভবে যার জন্ম। এ রকম ভাবনার মধ্যেই শর্মিলা মেগাস্থিনিসের হাত ধরলেন এবং টেনে নিয়ে গিয়ে বসলেন প্রস্তাবিত শিলার ওপর। পদ্মাসন। মেগাস্থিনিস বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি কি মানবীর হাত ধরে আছেন, না আফ্রোদিতের। এত নরম মানুষের হাত হয় কেমন করে?

হাত ছেড়ে দিয়ে শর্মিলা বললেন, আপনি অবাক হচ্ছেন, নাকি ভয় পাচ্ছেন? অবাক হওয়া কিংবা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আচার্য আমাকে বলেছেন, আমার ওপর তাঁর বিশ্বাস আছে। আপনার ওপরও আমার বিশ্বাস আছে। তাই হাত ধরতে কিংবা সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে কোনো বাধা নেই। এতে আমার সন্ন্যাসব্রতের কোনো ক্ষতি হবে না। আপনার লাভক্ষতির ব্যাপার নিতান্তই আপনার। কী, ঠিক বলি নি?

মেগাস্থিনিসের ঘোর কাটছে না। গ্রিসে থাকতে একবার শুনেছিলেন, ভারতীয়রা জাদুটোনা জানে, তা কি প্রমাণ হয়ে গেল? এ ছাড়া এখানকার মানুষেরা জাদুবলে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে, শর্মিলার রূপ কি সে রকম কিছু?

আপনি জাদুবিদ্যার কথা ভাবছেন, এই তো?

মেগাস্থিনিস অবাক হয়ে বললেন, আপনি জানলেন কেমন করে?

আত্মার সংযোগ ঘটিয়ে। কঠিন কিছু না, আপনি আত্মার ধ্যান করলে আপনিও জানতে পারবেন, শুধু একাগ্রতার প্রয়োজন হয়। তবে জাদুটোনার ব্যাপারও আছে, সম্মোহনের ঘটনাও ঘটে, বেশি ঘটায় কামরূপের মেয়েরা, আমরা না, আপনি কখনো সেদিকে যাবেন না। না হয়…বুঝতে পেরেছেন?

আমি এখন আসি?

চলে যাবেন? আরেকটু বসুন।

না, বসব না। সম্রাটের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যাপার আছে।

সম্রাটকে কী বলবেন? উল্টো পা’দের মুক্তি দিতে?

এরা তো মুক্তই আছে, শুধু লোকালয়ে বসবাসের অধিকার, সমাজে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি।

ভালো কাজ, করুন। আচার্যও দেখছি সমর্থন দিচ্ছেন। আপনিই জাদুটাদু জানেন। সবাইকে মোহাবিষ্ট করে ফেলছেন।

মনে মনে মেগাস্থিনিস বললেন, আপনি ছাড়া।

কী বললেন, আমি ছাড়া?

এবার মেগাস্থিনিস ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, আমি উঠি। শর্মিলার সম্মতির অপেক্ষা না করেই উঠে হাঁটতে শুরু করলেন।

আমাকে সঙ্গে নেবেন না? দাঁড়ান।

.

আরসিনোয় সেলুকাসের জন্য নিয়মের বেশি আরও এক প্যাক পানীয় নিয়ে বসে আছেন। সেলুকাস ওয়াশরুমে গেছেন। ফিরে এসে অবাক হয়ে বললেন, তুমি কী করে জানলে ডিনারে আমি এক প্যাক বেশি পান করি?

জানতে হয় সম্রাট, আমাদের সবকিছু জানতে হয়। নিন, শুরু করুন।

কক্ষে আলো-আঁধারি একটা অবস্থা। তার মধ্যেও আরসিনোয়ের চোখ যেন ঝলমল করছে। দুজন সামনাসামনি বসেছেন। সেলুকাস সুরাপাত্র হাতে নিয়ে আরসিনোয়ের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করলেন। কিছু একটা বললেন। তারপর এক ঢোক গিলে বললেন, চমৎকার সবকিছু। তোমার কৈশোরের মতো চমৎকার।

আমার কৈশোর মনে রেখেছেন?

নিটোল ছিলে তুমি। শুধু টোল পড়ত গাল আর হাঁটুতে, এখন আছে?

দেখবেন?

গাল তো পাকা আপেল হয়ে আছে। হাঁটুর টোল?

আরসিনোয় হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে টোল পড়া দেখলেন।

এটা আগের মতোই আছে।

স্পর্শ করে দেখবেন না?

এত জরুরি কি?

শূকরের মাংসটা ভালো হয়েছে।

আরও একটু দিই?

আস্তে, বলে সেলুকাস হাত ধরলেন।

আরসিনোয় বললেন, আপনার কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি পানপাত্র শেষ করুন। ধৈর্য ধরতে হবে।

বাঘের সামনে টোপ দেওয়ার মতো আরসিনোয় বুকের কাপড় টেনে নিলেন একটু। তা দেখে সেলুকাসের চোখ বড় হয়ে উঠল। তিনি তিন প্যাকের অতিরিক্ত এক প্যাকও একপলকে শেষ করে যেন আরসিনোয়ের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আরসিনোয় কাচে ঘেরা সলতের বাতিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন। লাইসিমেসিয়ায় তখন ঘোর অন্ধকার। সে অন্ধকার রানির কুটিরও গ্রাস করে ফেলেছে।

.

সেলুকাস কোথায় এখন?

কেন, সেলুসিয়ায়। আমি প্রথমে সেখানেই যাব কি না ভাবছি।

সেখানে তোমাকে একা যেতে হবে না।

একা যেতে হবে না কেন?

তোমার সঙ্গে সেলুকাসের সাক্ষাৎ হচ্ছে এশিয়া মাইনরে।

কী বলছ তুমি?

এবার হেসে দিয়ে স্ট্রেটোনিস বললেন, তোমার জন্য অযথাই খেটে মরছি। সেলুসিড সম্রাট হলে কীভাবে সাম্রাজ্য চালাবে তুমি?

এন্টিওকাস ভেবে পেলেন না স্ট্রেটোনিস কেন হেসে কথা বলছেন, ইদানীং রুক্ষ মেজাজে কথা বলেন এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেও ছাড়েন না। এ ছাড়া সেলুকাসের অবস্থান জানেন কী করে? বললেন, তোমাকে এ সংবাদ দিল কে?

তুমি ছাড়া কি আমার সংবাদদাতা নেই? এবার মন দিয়ে শোনো লক্ষ্মীটি। প্রস্তুতি নাও, আমরা সবাই সেলুসিয়ায় যাব। সেখানে আমাদের অনেক কাজ।

তোমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? সেখানে আমাদের কী কাজ?

আমাদের সাথে জেনারেল মোলনও যাবে।

মোলন যাবে কেন? সম্রাট তাকে যেতে বলেননি। তুমি ভুলে যাচ্ছ মূল কমান্ড সম্রাটের হাতে।

আমি জানি, সম্রাটের কাছেই মূল কমান্ড থাকে। তিনি সর্বাধিনায়ক।

তাহলে?

যা বলছি, তা-ই করো, লক্ষ্মীটি।

সম্রাট আমাকে আদেশ করেছেন এপিলেকটোই বাহিনী নিয়ে ইজিপ্ট সীমান্ত পয়েন্টে থাকতে।

এ কথা আগেও বলেছ তুমি। তুমি ইজিপ্ট সীমান্ত পয়েন্টে যাচ্ছ না, আমরা সেলুসিয়ায় যাচ্ছি।

তুমি কী বলছ, আমি বুঝতে পারছি না। সেখানে আমাদের কেউ পছন্দ করে না, মুখ পর্যন্ত দেখতে চায় না। কেন যাব আমরা সেখানে? তুমি হাসছ? কী রহস্য এ হাসিতে!

স্ট্রেটোনিস এন্টিওকাসের কাঁধে হাত রাখলেন। ঝুঁকে চুমো খেলেন, মুখ ওপরের দিকে তুলে নাকে নাক ঘষে বললেন, আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো সুইট, ওরা কেউ আমাদের অপছন্দ করবে না।

আচ্ছা, তুমি বলো তো কী হতে যাচ্ছে?

আমার সপরিবার সেলুসিয়ায় যেতে ইচ্ছে করছে। তুমি নিয়ে যাবে না?

তাই বলো। কিন্তু আমার ওপর আদেশ যে ইজিপ্ট সীমান্ত পয়েন্টে থাকা। বেশ তুমি তৈরি হয়ে নাও। এপিলেকটোই বাহিনীতে দ্রুত ফেরা যাবে। এন্টিওকাস মনে মনে ভাবলেন, পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার হলে সমস্যাই ছিল।

স্ট্রেটোনিস বললেন, আমাদের সন্তানেরাও যাবে।

কেন? ওরা যাবে কেন?

আমার সাধ সবাই একসঙ্গে যাব। আর আমরা এখনই সেলুসিয়ায় যাচ্ছি না। কাল যাচ্ছি।

কী হেঁয়ালি করছ তুমি? প্রথমে বললে তৈরি হয়ে নিতে, আবার বলছ কাল যাচ্ছ। তুমি তো রাতে কিছু পান করো না, আজ কি….

আরে না না। আমি সকালে একবার পান করি, আর বিকেলে একবার, রাতে পান করা আমার পছন্দ নয়, তাহলে উপভোগটা ভালো হয় না। মাতালের রতিক্রিয়া অর্থহীন।

তাহলে কথা এলোমেলো কেন?

আমি তো একবারও বলি নি আজই যাচ্ছি। রাতে কোথায় যাব। মোলনের তৈরি হতে সময় লাগবে না? মোলন তো আর একা যাবে না, সঙ্গে তার লোকজন যাবে।

ওর লোকজন যাবে মানে?

প্রয়োজন আছে, এ জন্য যাবে। আমরা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় যাব নাকি? আহ্, কতকাল হলো সেলুসিয়া ছেড়ে এসেছি, সে প্রাসাদ, সে বাগান, সে দিঘি, আবার দেখা হবে।

প্রথমে যে বললে সম্রাটের সঙ্গে এশিয়া মাইনরে দেখা হচ্ছে।

দেখা তো হচ্ছেই। তাঁকে নিয়েই যাব।

হেঁয়ালি রাখো তো।

হেঁয়ালি নয়।

তাহলে?

রেগে যাচ্ছ কেন? ঠিক আছে, আমিই মোলনের সঙ্গে কথা বলব।

সম্রাট এখানে কী জন্য এসেছেন?

আরসিনোয়ের সঙ্গে ফুর্তি করতে।

ধ্যাৎ, যা-তা বলছ। যাও, ঘুমোও এখন।

আমি আজ রাত শুধু জেগে থাকব। পরিকল্পনা করব, মহাপরিকল্পনা।

বেশ, তা-ই করো, এখন আমাকে ঘুমোতে দাও।

.

দিদাইমেইয়া কথা শেষ করে চুপ করে বসে আছেন। নিকোমেডেস আর ফাওলিনও চুপ করে আছে। তাদের চার বছরের ছেলে অস্থিরভাবে এটা-সেটা করছে। এক পর্যায়ে সে বলল, তোমরা চুপ করে আছ কেন? তোমরা চুপ করে থাকলে আমার কাছে ভুতুড়ে অবস্থা মনে হয়। তোমরা কি মরে ভূত হয়ে গেছ?

দিদাইমেইয়া তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, না ভাইয়া, এ রকম বলতে নেই। তুমি বুঝবে না আমরা খুব সংকটে আছি।

সংকট কী, মা?

ফাওলিন বলল, মনে করো মনখারাপ।

তুমি ওকে ভুল বললে, আমরা কী করব যখন বুঝতে পারি না, তখন তাকে সংকট বলা হয়। তুমি বাইরে একটু খেলা করো, যাও। বলল নিকো। তার মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি বুঝতে পারছি না খেলা করব কি না, আমি সংকটে আছি।

শুনে সবাই কষ্টের মধ্যেও হাসলেন।

ফাওলিনের বাবা টলেমির সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। ক্রোউনোস সম্রাট হওয়ায় চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন। তিনি সেলুসিয়ায় আসছেন। দিদাইমেইয়া এবং নিকোমেডেসরা একই সংকটে। সেলুকাসের কাজকর্মে এরা খুবই অসন্তুষ্ট। এঁরাও সেলুসিয়া ছাড়তে চাইছেন। কিন্তু যাবে কোথায়, ইজিপ্ট আর গ্রিস ছাড়া সবটাই সেলুকাসের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। একচিলতে জায়গা নিয়ে আছেন আরসিনোয়। কিন্তু যে অবস্থার সৃষ্টি করেছেন, ঘৃণা ছাড়া তাঁর আর প্রাপ্য কিছু নেই।

নিকোমেডেস বলল, মা, যাও, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ফাওলিনের বাবা পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হবে।

দিদাইমেইয়া শিশুটিকে নিয়ে নিজের কক্ষে গেলেন।

ফাওলিন বলল, মা খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমাদের ভবিষ্যৎটা সত্যিই অজানা এবং অনিশ্চিত।

নিকোমেডেস বলল, আমিও সেলুকাসের আর্মির চাকরিটা ছেড়ে দেব। মা আমাকে বলে নি, কিন্তু তাই বোঝাতে চেয়েছে।

ফাওলিন নিকোমেডেসের কাছে ঘন হয়ে বসল। তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, বিপদ যখন আসে, সবদিক থেকে আসে। তবে কি জানো, একসঙ্গে আসাই ভালো, একসঙ্গে মোকাবিলা করা সহজ হয়।

আরও বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।

কী রকম?

সেলুকাস মারা গেলে একমুহূর্তের জন্যও এন্টিওকাসের সাম্রাজ্যে থাকা সম্ভব নয়। স্ট্রেটোনিস আর এন্টিওকাসকে সহ্য করা অসম্ভব।

ফাওলিন বলল, লাউডিস তো আরও ক্ষুব্ধ।

ঠিক বলেছ। জেনারেল কিউকেকাস যে রকম স্পষ্টবাদী অফিসার, এন্টিওকাসের বাহিনীতে এক দিনও কাজ করবেন না।

আরও সমস্যা পাকাচ্ছে, বলল নিকো। সবারই বিপদ। অনেক অফিসার পদত্যাগ করবে। কর্নেলিয়া কেমন আছে কে জানে? কী মধুর ছিল ভারতে দিনগুলো, বলে নিঃশ্বাস ফেলল ফাওলিন।

ফাওলিনকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে নিকোমেডেস বলল, মা আছে, তোমার বাবা আছেন, লাউডিসরা আছে। সবাই মিলে এ দুঃসময়টা মোকাবিলা করব। মরতে হলে সবাই একসঙ্গে মরব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *