১
তক্ষশীলা। কাটা পাথরের নগরী। পাথর কেটে কেটে নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক কিংবা তারও আগে। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের একিমেনিড সাম্রাজ্যের স্মৃতিচিহ্নটাই প্রবল। প্রাচীন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার আবর্তন কীলক। বহু পথ এসে মিলিত হয়েছে এখানে। উত্তরা পথ গান্ধারা রাজ্যকে মগধ ও পাটালিপুত্রের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এখানেই পূর্ব ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকা। মেগাস্থিনিস এই পথকেই বলেছেন রয়াল হাইওয়ে। এককালে গান্ধারা রাজ্যের রাজধানী ছিল এই তক্ষশীলা। মৌর্য সম্রাটের প্রাদেশিক রাজধানী। পাটালিপুত্রে এদের রাজধানী। তাহলেও দুটি কারণে এ প্রাদেশিক রাজধানীর গুরুত্ব অত্যধিক। একটি হলো বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ভারতবর্ষের বাইরেও তার বহুল পরিচিতি, অপরটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাচীন ভারতের সর্বপ্রাচীন ও প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র। আলেকজান্ডারের লোকজন তক্ষশীলায় এসে এ রকম একটি শিক্ষাকেন্দ্র দেখে একেবারে অভিভূত। এ রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সারা গ্রিসে তো নেই-ই, আলেকজান্ডারের অধিকৃত অপর কোনো দেশেও নেই।
পাটালিপুত্র থেকে তক্ষশীলার দূরত্ব হাজার মাইলের বেশি। এই সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মহামন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এখানে এসেছেন। এ আগমনে অবশ্য মহামন্ত্রীর উৎসাহই ছিল বেশি। বয়স বাড়লেও প্রধান উপদেষ্টা চাণক্যকে দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত মনে হচ্ছে না। একসময় তিনি ছিলেন এই তক্ষশীলার অন্যতম আচার্য। এখানে এসে তিনি যেন পুনর্যৌবন প্রাপ্ত হয়েছেন, তেমনি গতিবিধি তাঁর। সম্রাটও ক্লান্ত নন, তার কারণ অবশ্য ভিন্ন। উত্তরা পথের দুপাশের দৃশ্য তাঁকে এতটা মুগ্ধ ও ব্যাকুল করে তুলেছে যে এতটা পথ কখন শেষ হয়েছে, তা তিনি টেরও পান নি। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি তাঁকে স্মৃতিকাতর করে তুলেছে। ভ্রমণকালে তাঁর মনে হয়েছে, বেদ-পুরাণে তিনি যে স্বর্গের কথা শুনেছেন, ভারতের ভূস্বর্গের কাছে তা কিছুই না। পথে তার মনে সাধ জেগেছে, এ রকম নিসর্গ সংসর্গে যদি দুরন্ত কৈশোরের মতো দৌড়ানো যেত। রাজার পক্ষে তা সম্ভব নয় বলে সাধটা বিসর্জন দিতে হয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে রাজকীয় বহর থামিয়ে চতুরাশ্বযান থেকে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য হৃদয় ভরে উপভোগ করেছেন। সম্রাট এখনো যৌবনের কোঠায়। মনে দারুণ তারণ্য। সবকিছুর মধ্যেই উপভোগের উপাদান খুঁজে পান বহুল মাত্রায়। হৃদয়ে উচ্ছ্বাসও আছে। কৌতূহলে ক্লান্তি নেই।
চাণক্য একসময় আচার্য ছিলেন। বয়সও কিছুটা হয়েছে। তাই গাম্ভীর্য তাঁর ভূষণ। উচ্ছ্বাস ও কৌতূহল চেপে রাখেন। তাঁর চালচলন কতকটা বুদ্ধিবৃত্তিক, বাকিটা কূটরাজনৈতিক মোড়কে আঁটা। সম্রাটকে তক্ষশীলায় নিয়ে আসবার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম দৃষ্টি কাজ করেছে। তক্ষশীলার দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্রাটকে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দেশের ব্যবসায়িক উন্নতি দৃশ্যত প্রধান লক্ষ্য হলেও তার আড়ালে বড় আয়োজনটা হয়েছে তক্ষশীলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সম্রাটেরও কৌতূহল আছে। এর অনেক গল্পই শুনেছেন চাণক্যের মুখে
সম্রাট চাণক্যকে মান্য করেন। এককালের এই অভিভাবকতুল্য আচার্যকে সমীহ করে চলেন। তার কারণও আছে। প্রায় রাস্তার বালক ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত। পিতৃহীন ও মাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত চন্দ্রগুপ্ত এক শিকারির কাছে লালিত-পালিত হচ্ছিলেন। এ রকম সময় একদিন বালকদের সঙ্গে খেলছিলেন। খেলাটা এ রকম: তিনি রাজা, অন্যরা মন্ত্রী কিংবা অমাত্য। নিরাপত্তা প্রহরীরা কতগুলো ডাকাতকে রাজার সামনে নিয়ে এসেছে। রাজা তাদের বিচার করছেন। তিনি উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনলেন। মন্ত্রী-অমাত্যদের মতামত নিলেন। এরা কারাদণ্ডের পক্ষে। রাজা কঠোরভাবে বললেন, এরা রাজ্যের প্রজাদের আতঙ্ক। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন, যাতে কেউ ডাকাতি করতে সাহস না পায়। তিনি তাদের মৃত্যুদণ্ড দিলেন।
চাণক্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলেন। তাঁর মনে হলো, যাকে তিনি খুঁজছেন, তাকে পেয়ে গেছেন। চাণক্য একজন রাজা খুঁজছেন। মগধের রাজা ধনানন্দ তাঁকে অপমান করেছেন। ব্রাহ্মণদের সভায় সামনের একটি আসনে বসেছিলেন তিনি। দেখতে সুপুরুষ নন বলে রাজা তাঁকে আসন থেকে তুলে দেন। রাগে ফেটে পড়েন চাণক্য। রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করবেন বলে চিৎকার করে প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে দেন। রাজার লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে বন্দী করতে গেলে তিনি দিগম্বর আজীবিকের ছদ্মবেশে সেখান থেকে পলাতক হন। তার পর থেকে তিনি রাজা খুঁজছেন। নিজে রাজা না হতে চেয়ে কেন রাজা খুঁজছেন, সে এক মজার কাহিনি। তাঁর ছেদন দন্ত ছিল। লোকবিশ্বাস, ছেদন দন্ত যাঁদের থাকে, এঁরা রাজা হন। চাণক্যের মা ভাবলেন, ছেলে রাজা হলে তাঁকে অবহেলা করবেন। প্রায়ই এ নিয়ে তাঁর খুবই অশান্তি। চাণক্য মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ছেদন দন্তগুলো ভেঙে ফেললেন। কিন্তু দাঁতের গোড়াগুলো মাড়ির মধ্যে থেকে গেল। লোকবিশ্বাস, যেহেতু ছেদন দত্ত উপড়ে না ফেলে ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং দন্তের গোড়াগুলো মাড়িতে আড়াল হয়ে আছে, তাই এই ব্যক্তি পেছন থেকে রাজাকে সাহায্য করবেন, অর্থাৎ তিনি রাজার মন্ত্রী হবেন, এ বিশ্বাসেই চাণক্য রাজা খুঁজছেন।
তিনি চন্দ্রগুপ্তের শিকারি পালক পিতার কাছ থেকে চন্দ্রগুপ্তকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় করে নিলেন। তার আগে চাণক্য রাজা ধনানন্দের ছেলে পর্বতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন এবং তাঁকে রাজসিংহাসন দখলের প্ররোচনা দেন। রাজপুত্র উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনি চাণক্যের কথায় সায় দেন এবং চাণক্য যাতে রাজবাড়িতে এসে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, সে জন্য গোপন দরজায় প্রদর্শনযোগ্য সিলমোহরের একটি অঙ্গুরি প্রদান করেন। দুজন সম্ভাব্য রাজা পেয়ে যাওয়ায় চাণক্য তাঁদের মধ্যে কে বেশি যোগ্য, তার পরীক্ষা নিতে চাইলেন। দুজনকে দুটো উলের সুতোয় বোনা গলাবন্ধ উপহার দিলেন। একদিন বালক চন্দ্রগুপ্ত গলাবন্ধ পরিহিত অবস্থায় ঘুমোচ্ছিলেন, চাণক্য পর্বতকে বললেন, এটি না ছিঁড়ে এবং চন্দ্রগুপ্তকে না জানিয়ে গলাবন্ধটি বের করে আনতে হবে। যুবরাজ ব্যর্থ হলেন। কিছুদিন পর একই দায়িত্ব দেওয়া হলো চন্দ্রগুপ্তকে। চন্দ্রগুপ্ত ঘুমন্ত অবস্থায় পর্বতের গলা কেটে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে গলাবন্ধ বের করে আনলেন। চাণক্য এতে চন্দ্রগুপ্তকে শাস্তি না দিয়ে তাঁর সাহসিকতায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি রাজকুমারকে হত্যা করলে?
চন্দ্রগুপ্ত সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সম্ভাব্য রাজার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে নেই।
চাণক্য বুঝতে পারলেন, এই বালকই রাজা হওয়ার উপযুক্ত। তিনি তাঁকে সাত বছর যাবৎ নানা শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুললেন। পাশাপাশি তরবারি চালনার প্রশিক্ষণ দিলেন। এ সময়ে চাণক্য অর্থ সংগ্রহে তৎপর হয়ে উঠলেন। রাজার বিরুদ্ধে হবু রাজার যুদ্ধের জন্য অর্থের প্রয়োজন, সৈন্যবল প্রয়োজন, তিনি জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকা অবস্থায়ই আশি কোটি স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করে জঙ্গলের ভেতর মাটির নিচে লুকিয়ে রাখলেন। চন্দ্রগুপ্ত রাজা হওয়ার উপযুক্ত হয়ে উঠলে মাটির নিচ থেকে ক্রমান্বয়ে স্বর্ণমুদ্রা বের করে আনলেন এবং শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী গঠন করলেন।
বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের নেতৃত্বে নন্দরাজ্য আক্রমণ করলেন। কিন্তু সাংঘাতিকভাবে পরাজিত হলেন। প্রচুর সৈন্য হতাহত হলো, বাকিরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেল। চাণক্য হতাশ হয়ে চন্দ্রগুপ্তকে নিয়ে ছদ্মবেশে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন। শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের কারণ খুঁজলেন। ব্যর্থতার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ভাগ্যকেই দায়ী করলেন দুজন। ঘুরে বেড়ানোর কালে একদিন এক মহিলার সঙ্গে তাঁর ছেলের কথোপকথন শুনতে পেলেন। মহিলা বলছেন, তুই রুটির মাঝখান দিয়ে খাচ্ছিস কেন? বোকা চাণক্য এভাবে মাঝখান দিয়ে নন্দরাজ্য আক্রমণ করেছিল বলে পরাজিত হয়েছে। সবকিছুই একদিক দিয়ে শুরু করতে হয়। ওদের উচিত ছিল সীমান্তের গ্রাম থেকে আক্রমণ শুরু করা। তোরও উচিত ছিল রুটির এক প্রান্ত থেকে খাওয়া শুরু করা।
চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত তাঁদের ভুল বুঝতে পারলেন। আবার সৈন্য সংগ্রহ করলেন এবং সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করে সীমান্ত গ্রাম থেকে আক্রমণ করে নন্দরাজের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের ভিত্তি এভাবেই রচিত হলো। এ কথা সম্রাটের ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই চাণক্যের প্রতি তাঁর সমীহভাব সব সময়ই আছে।
সম্রাট তক্ষশীলার বাহ্যিক সৌন্দর্যেও মুগ্ধ হলেন। পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ পাথুরে অবকাঠামোর সঙ্গে এখানে কোনো বিরোধ বাধায় নি। বরং নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা যেন পাহাড়কে বান্ধব মেনেই ভূমি ও অবকাঠামো-নকশা প্রণয়ন করেছেন। পুরপ্রকৌশলীদের মেধা ও মনন খাটিয়ে যে নির্মাণশৈলী তৈরি হলো, তা এককথায় চমৎকার। এখানে বিদ্যার ভারী ও সমুন্নত বিস্তার পাহাড়ের গাম্ভীর্যের সঙ্গে বুক মিলিয়েছে। প্রাসাদের পীঠ হেলান দিয়ে আছে পাহাড়ের কোলে। সবুজ পাহাড় নীল আকাশের ছাদকে ছুঁয়ে উপভোগ করছে মৌসুমি বাতাসের বেসামাল দোলাচল। তার মধ্যে মানবীর মূর্তি পাওয়া ভেসে যাওয়া দু-চার খণ্ড সাদা মেঘ যেন ওড়নার মতো উড়ছে। কালিদাস এ দৃশ্য দেখলে হয়তো লিখতেন, শ্বেতাম্বর ধরে আছে শিথিল হাতে যেন তেমনি উড়ে যাচ্ছে মেঘের পাল, রক্ষা করো সখা বক্ষ দিগম্বরে জড়িয়ে দিয়ে নীল বস্ত্রাবাস।
সম্রাটকে নিয়ে চাণক্য সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন। প্রাদেশিক রাজধানীর এই সভাকক্ষ ঐতিহ্যমণ্ডিত। গান্ধারা রাজ্যের শান-শওকত এখনো বেশ বর্তমান। চোখধাঁধানো। সভাকক্ষে ইতিমধ্যেই উপস্থিত হয়েছেন প্রদেশ পাল, নাগরিকা, অস্তপাল, দৌবারিক, প্রশাসক, পৌরব্য বাহরিক, কর্মান্তিক, গোপ, প্রদেশত্রি, অধ্যক্ষবৃন্দ আর ব্যবসায়ী নেতৃবর্গ।
প্রদেশপাল উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে সম্রাটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, মহামান্য সম্রাট, তক্ষশীলা যোগাযোগের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে এখানে কোটি কোটি স্বর্ণমুদ্রা আয় হয়, যা রাজকোষে পাঠানো হয়। যে ব্যবসায়ীরা এখানে উপস্থিত হয়েছেন, এঁরা শুধু মগধ নয়, সারা ভারতবর্ষের বাইরে ব্যবসা করেন। এঁরা মহামান্য সম্রাটকে তাঁদের কৃতজ্ঞতার কথা জানাবেন, ব্যবসায়িক সুবিধা-অসুবিধার কথা বলবেন।
রাজা চাণক্যের দিকে তাকালেন। চাণক্য বললেন, এঁরা নিশ্চয়ই মহামান্য সম্রাটকে কৃতজ্ঞতা জানাবেন। তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার কথা আমরা জানি। তা দেখা হবে। তবে আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সততা আশা করব। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে অর্থসম্পর্কিত অপরাধের একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। এতে বলা হয়েছে, একদল ব্যবসায়ী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পদ্ধতিগতভাবে প্রজাদের স্বার্থ ও স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করে। প্রদেশত্রি (ম্যাজিস্ট্রেট) তাদের দলগতভাবে কঠোর শাস্তি দেন। আমরা এ রকমটি আর চাই না। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমরা একটি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে চেয়েছি। কৃষিসম্পদ, প্রাণিসম্পদ, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ প্রভৃতির ব্যবসায়িক দায়িত্ব সরকারি, বেসরকারি যৌথ এবং এককভাবে পরিচালনার সুযোগ রয়েছে। উৎপাদন ও প্রস্তুতকরণের বেলায়ও সুযোগটি একইভাবে দেওয়া আছে। যেসব বিধিবিধানের আলোকে সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সেসব বিধিবিধানের আলোকেই চলছে। তবে তাদের কর দিতে হয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হয় না। খনিজ সম্পদ রাষ্ট্রের, কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগুলো বন্দোবস্ত নিতে পারে। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব, অধ্যক্ষ ও রাজকর্মচারীগণ তা দেখছে।
আপনারা যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান, তা নিশ্চয়ই কর ব্যবস্থা। রাষ্ট্র চালানোর জন্য কর ধার্য করার বিকল্প নেই। সেনাবাহিনী পোষণ, রাজকর্মচারীর বেতন, রাজকীয় খরচ প্রভৃতি কাজে কর লাগে। তবে কর ধার্য হতে হবে ন্যায়সংগতভাবে। আমরা করের পরিমাণ, কোন মানদণ্ডে কর ধার্য করা হবে, আদায় নিশ্চিতকরণ বা কীভাবে হিসাব করা হবে, সুবিধাজনকভাবে প্রদান করা যাবে কি না, কর প্রশাসন ন্যায়সংগত কম খরচে কর আদায় নিশ্চিত করছে কি না, অবিকৃত ও প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না, এসব নিশ্চিত করব। কর অবশ্যই আদায় করা হবে পরিপক্ব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। কৃষিক্ষেত্রে কর ১৬.৬৭ শতাংশ। দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ, নতুন আবাদ কিংবা যুদ্ধবিধ্বস্ত ফসলের কোনো কর নেওয়া হবে না। সেচ ও অপরাপর জলজ কাজের জন্য পাঁচ বছর কর রেয়াতের ব্যবস্থা আছে, মঠ ও গুরুকুল ভূমির কর সব সময়ের জন্য মওকুফ থাকবে। কোনো জরিমানাও নেই। কিছু ব্যবসায়ী ও প্রক্রিয়াকারী প্রতিষ্ঠান একই রকম কর প্রদান করবে। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের দেশে বা দেশের বাইরে অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের পর বিজ্ঞাপিত হারে ১০-১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। এই কর উৎপাদিত বস্তুসামগ্রী, শ্রম অথবা নগদ অর্থে পরিশোধ করা যাবে।
ব্যবসায়ী নেতারা চাণক্যের বক্তব্যের পর কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। দাঁড়িয়ে শুধু কৃতজ্ঞতা জানালেন। কারণ, করের হার এত কম হবে, ভাবতেই পারেন নি।
সম্রাট বললেন, ন্যায়সংগত করারোপ রাজাকে কল্যাণকামী প্রমাণ করে এবং রাজা তাতে প্রজাদের সমর্থন লাভ করেন। আমরা রাজ্যে প্রজাদের কল্যাণ ও স্বার্থ রক্ষা করতে চাই। আমরা বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে দেশকে বাঁচাতে চাই এবং ভারতবর্ষ থেকে তাদের তাড়াতে চাই। তাই প্রজাদের সহযোগিতা দরকার। আমার কাছে জনগণের শক্তির চেয়ে অন্য কোনো শক্তি বড় নয়। বিশ্বাস ও আস্থার ওপর জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ভর করে। আমরা বিশ্বের কাছে রাজা ও প্রজার সম্পর্কের নতুন ধ্যানধারণা তুলে ধরতে চাই। এই লক্ষ্যে আমার নতুন প্রশাসন কাজ করছে। আমি একজন যোগ্য ও বহুমাত্রিক গুণসম্পন্ন মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছি। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দিয়ে শক্তিশালী প্রশাসন গড়ে তুলবেন, সে ক্ষমতা আমি তাঁকে দিয়েছি। আপনারাও সহযোগিতা করবেন।
রাজার দীর্ঘায়ু কামনা করে ব্যবসায়ীরা বিদায় নিলে রাজা বিশ্রামের জন্য গান্ধারাদের প্রাচীন রাজপ্রাসাদে গমন করলেন। বিশ্রামকালে হঠাৎই তাঁর মনে হলো, তিনি ছদ্মবেশে প্রজাদের অবস্থা দেখবেন, তাঁর নিজের রাজকর্মচারীদের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করবেন, প্রজারা তাঁর সম্পর্কে কী ভাবছে এবং ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে কি না, তা নিজের চোখে দেখবেন।
চাণক্য রাজার ইচ্ছার কথা শুনে সেভাবে সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বললেন। তিনি নিজের কক্ষে গিয়ে পাচক জনান্তিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, আমি তোমার পাকশালায় যাব, পাকের কী ব্যবস্থা, নিজে দেখে আসব। সেখানে চাণক্য রাজার খাবারের সঙ্গে বিষ মেশালেন। তা দেখে পাচকের গলা শুকিয়ে গেল। সে ঘামতে শুরু করেছে। তা দেখে চাণক্য শাসনের স্বরে গলা চেপে বললেন, এ কথা দ্বিতীয় কেউ জানলে তোমার শিরশ্ছেদ করা হবে। চাণক্য রন্ধনশালা থেকে চলে গেলে পাচক কাঁপতে কাঁপতে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। তাকে চিকিৎসার জন্য চরকের শিষ্যের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। চরক বিখ্যাত চিকিৎসক। তক্ষশীলায় অধ্যয়ন করেছেন, এখানে অধ্যাপনাও করেন চিকিৎসাশাস্ত্রে।
চরকের চিকিৎসায় পাচক সংবিৎ ফিরে পেল। তবে শারীরিক দুর্বলতার জন্য চিকিৎসক তাকে ঘুমের ওষুধ সেবন করালেন। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে মিথ্যে করে চরকশিষ্যকে বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি, রাজার হস্তী ধুতুরা ফল খেয়ে ফেলেছে। আপনি রাজার দিকে খেয়াল রাখবেন।
তার স্বপ্নের কথা শুনে চরকশিষ্য হেসে দিলেন। আগামীকালের অনুষ্ঠানে নিশ্চয় রাজার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটবে।