মোহিতলালের কাব্যের মূল সুর

মোহিতলালের কাব্যের মূল সুর

বাঙলা দেশে রবীন্দ্রযুগে যত কবি আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের উপর রবীন্দ্রনাথের কিছু-না কিছু প্রভাব রয়েছে, তবে তাঁদের স্বকীয় বিশেষত্বও কিছু যে না আছে তেমন নয়। বস্তুত অল্পবিস্তর প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাব-চিন্তা ও প্রকাশের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রকট, তারা হচ্ছেন–অক্ষয়কুমার বড়াল, দেবেন্দ্রনাথ সেন, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন।

এঁদের মধ্যে আবার মোহিত মজুমদার ক্লাসিকধর্মী বলে, যতীন্দ্রনাথ নতুন জীবন-দৃষ্টির জন্যে, কাজী নজরুল নতুন ভাব-চিন্তা-আদর্শ ও আঙ্গিকের প্রবর্তক হিসেবে এবং জসীমউদ্দীন প্রাচীন পল্লী-সাহিত্য ধারার অনুসারীরূপে বিশেষভাবে খ্যাতিমান।

মোহিত মজুমদার ক্লাসিকধর্মী হলেও তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাষা এবং য়ুরোপীয় ভাবাদর্শের প্রভাব কম নয়, তবু তাঁর একটা নিজস্ব ভাবলোক, মতপথ এবং গতি ও ভঙ্গি রয়েছে, যা অন্যত্র সুদুর্লভ। তাই তিনি অনন্য ও তাঁর কবিতা বিশিষ্ট। তাঁর কাব্যে সবচেয়ে যে বস্তুটা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে কাব্যের আঙ্গিক বা কবিতার Diction. শব্দ চয়নে আভিজাত্য, ছন্দে গাম্ভীর্য ও লালিত্য, ভাবাদর্শের অনন্যতা, প্রকাশ-ভঙ্গির-বৈশিষ্ট্য ও সংযম তাঁর কাব্যকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এককথায় মোহিতলালের কাব্য Classical in form আর Romantic in Spirit.

কবি আদর্শবাদী ও শিল্পী। তাঁর কাব্যে ব্যবহারিক জীবনের রোগ-শোক, জরা-মৃত্যু-ব্যথা, অথবা নিজের বা মনুষ্য-সাধারণের দৈনন্দিন জীবনের আনন্দ-বেদনা, অভাব-অনটন, অত্যাচার নিপীড়নের কাহিনী স্থান পায়নি–কারণ তাঁর মতে:

জীবন যাহার অতি দুর্বহ, দীন দুর্বল সবি,
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ সেই জন বটে কবি।

অতএব তাঁর কাব্য-প্রেরণার উৎস–ব্যবহারিক জীবন কিংবা মনুষ্য-সাধারণ নয়। তাঁর কাব্যে কোথাও বৈষয়িক জীবন-চেতনার অভিব্যক্তি নেই। কবি রসাদর্শের (art for arts sake) অনুসারী। তাঁর ভাব-চিন্তার ধারা তন্ময় নয়–মন্ময়। ব্যবহারিক জীবনে সুখ-দুখ, আনন্দ-বেদনা ও কলকোলাহলের ঊর্ধ্বে মনোময় কল্পজগৎ সৃষ্টি করে তাতে তিনি বিহার করেন। বাস্তব জীবনকে আড়াল করে স্বপ্নের স্বর্গলোকে কামনার কামিনী-সাধনায় তার শিল্পীমন পরিতৃপ্তি খোঁজে। তাঁর নিজের কথায়:

১. এ হৃদয়ে আজো তাই রহিয়াছে অমৃতের তৃষ্ণা।…
… সকল কল্লোল মাঝে নীরব নিকুঞ্জ গড়ি করিতেছে নিভৃত কূজন।
—(উৎসর্গ–স্বপন পসারী)

২.  যে স্বপন তুমি দেখিয়াছ রাতে–
 মনে নাই যাহা জাগিয়া প্রাতে,
তবু আঁকা আছে হৃদয়ের পাতে
জল-রেখা রঙ্গিলা–
সেই জলছবি ফুটাইবে কবি।
–অপরূপ সেই লীলা।
 আনন্দ ধন-রস-সরসিত,
দিবসের জ্বালাহরা
ঘুচে যাবে খেদ, যত ভেদ-ভয়,
কায়া আর ছায়াবৃথা সংশয়,
স্বর্গ হইবে ধরা। (স্বপন পসারী)

৩. ভুলের ফুলের মোহন মালিকা
গাঁথিয়াছে হের স্বপ্ন বালিকা।
 যে বীণা বাজাতে আলো-নীহারিকা
ছায়া পথে যায় থামি–
 তারি সুরে হেঁকে পথ চলি ডেকে।
স্বপন-পসারী আমি। (স্বপন পসারী)

৪। যত ব্যথা পাই, তত গান গাই–গাঁথি যে সুরের মালা!
 ওগো সুন্দর! নয়নে আমার নীল কাজলের জ্বালা!
আঁখি অনিমিখ, মেটে না পিপসা, এ দেহ দহিতে চাই!
সুখ-দুঃখ ভুলে যাই। (ব্যথার আরতি)

৫. দেহী আমি, মন্দিরে মন্দিরে তাই পরশ ভিখারী,
…. পরশ-রসিক আমি, অন্ধ আঁখি তারা
আমার আকাশ তাই শশী সূর্য হারা।
 পদতলে পৃথ্বি আছে আলিঙ্গনে চৌদিকে বিথারি–
আলো নাই, আছে শুধু প্রাণের আরাম। (স্পর্শ রসিক)

৬. ঘোমটা-পরা মিথ্যাময়ী সেই যে আমার সর্বজয়ী!
জনমকালে কখন সে যে জড়িয়েছিল কণ্ঠহারে–
একটি চুমায় বন্ধ করে রাখল প্রাণের নিশানটারে! (অ-মানুষ)

৭. সুখ-দুঃখের বিলাস-বাঁশরী তানে,
 সুর দিব আমি হাস্য-অশ্রু-গানে,
 ফুটাব ঝরাব ফুল-পল্লব বারোমাস। (মৃত্যু)

৮. রূপ-মধু সৌরভের স্বপন সাধনা
করিনু মাধবী মাসে; ইন্দ্রিয় গীতায়
রচিনু তনুর স্মৃতি। (ফুল ও পাখী)।

তাঁর এই কল্পলোকে তিনি যে রস পান করেন–তা এ জগতে দুর্লভ। এই ভাব-সর্বস্ব কল্পলোকাশ্রয়ীদের সুবিধে এই যে, এখানে জীবন সংঘাতমুখী নয়–একেবারে নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন।

মোহিতলালের অনুভূতির সে-জগৎ প্রশস্ত নয়। তাই সেখানে তাঁর জীবন-লীলায় বৈচিত্র্য বিরল। নানা ভাবে, নানা ধারায় জীবনকে উপলব্ধি করবার প্রয়াস তাতে অনুপস্থিত। তাঁর প্রাণও উচ্ছল নয়–এ জন্যে তাঁর ভাবাবেগে উদ্দামতা নেই, তবে তাঁর অনুভূতি তীক্ষ্ণ ও গভীর। এ কারণে কবি সর্বত্র সংযতবাক ও গম্ভীর। আঙ্গিকের আভিজাত্য, বাভঙ্গির গাম্ভীর্য, অনুভূতির অনুচ্ছলতা, মননশীলতা প্রভৃতি তাঁর কাব্যমাধুর্যকে ফল্গুধারার মতো গুপ্ত ও মন্দ-প্রবাহিণী করে রেখেছে। ঊর্মিমুখর স্রোতস্বিনী করে তোলেনি। ফলে তাঁর কাব্যে শুধু বিশেষের অধিকার আছে, তার দুর্গম কাব্যবীথি সাধারণের জন্যে দুরতিক্ৰমণীয়। এসব কারণে উঁচুদরের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাঁর কবিখ্যাতি সাধারণ্যে বিস্তৃত হয়নি। কবিও এ ব্যাপারে সচেতন : তিনিও বলেছেন,-I shall dine late but the dining room will be well lighted, the guests few and select.

কবি কল্পলোকে যে পিপাসা নিয়ে বিচরণ করেন, সে পিপাসা হচ্ছে–রূপ ও প্রণয় পিয়াস। কবি উপলব্ধি করেছেন–দেহে রূপ, রূপে প্রণয় এবং প্রণয়ে সম্ভোগ লিপ্সা জাগে। অতএব, রূপ। প্রণয় ক্ষুধা চরিতার্থতা লাভ করতে পারে একমাত্র দেহকে অবলম্বন করেই। এই দেহ-কেন্দ্রী রূপ ও প্রণয় সাধনাই হচ্ছে তার প্রথম দিককার কাব্যের মূল সুর।

যে রূপের পিপাসায় প্রেম হল জীবন অধিক (প্রেম ও জীবন)

 এ ব্যাপারে মোহিতলাল কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের ভাবশিষ্য। দেবেন্দ্রনাথের সাধনাও ছিল রূপ সাধনা। তবে তিনি প্রধানত নিসর্গ রূপপিয়াসী।

চিরদিন চিরদিন।
রূপের পূজারী আমিরূপের পূজারী।

মোহিতলালও বলেছেন–আমি কবি অন্তহীন রূপের পূজারী।

কবি-চিত্তে রূপের পিপাসা–রূপ আগে পরে ভালবাসা (রতি ও আরতি)। Taso বলেছেন, That thou art beautiful and I am not blind; মানে, তোমার রূপ আছে আমারও আছে পিপাসা। রবীন্দ্রনাথের কথায় : ও রূপের কাছে এ ক্ষুধা তাই চিরদিন জাগিয়া রবে। Keats-8 657676901-A thing of beauty is a joy forever. মোহিতলাল মননশীল, তাই তিনি মানস রূপের পূজারী :

যেই আমি আমা হতে মুক্তি চাই কল্পনার নিশীথ স্বপনে,
 সেই আমি বাঁধি পুন আপনারে চেতনার জাগ্রত ভুবনে।
আমারি ঐশ্বর্য তাই হেরি আমি তার দেহ মাঝে,
তাই সে সুন্দর হেন, সাজিয়াছে মোর দেওয়া ফুল্লফুল সাজে। (রতি ও আরতি)

মোহিতলালের সাধনায় তিনটি স্পষ্ট স্তর রয়েছে। স্বপন পসারী-বিস্মরণী স্তর, স্মরগরলের স্তর এবং হেমন্ত গোধূলির স্তর। স্বপন পসারীতে উন্মেষ, স্মরগরলে পূর্ণ বিকাশ এবং হেমন্ত গোধূলিতে অবসান। প্রথম স্তরকে রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমলের যুগের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরকে মানসীর সঙ্গে মিলানো যায় না। কারণ মানসীর নিষ্ফল কামনা ও সুরদাসের প্রার্থনায় কবির দেহ-সম্ভোগ লিপ্সার ইতি ঘটেছে এবং অনন্ত প্রেম কবিতায় প্রেমের বিকাশ, বিস্তার ও চরম পরিণতি সম্বন্ধে অপরূপ উপলব্ধি রয়েছে।

কবি বুঝে নিয়েছেন–

ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব
 কেহ নহে তোমার আমার।

এবং

আকাক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের। (নিষ্ফল কামনা)

আরো উপলব্ধি করেছেন :

বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার চিরকাল রবে সে কি
ক্রমে ধীরে ধরে নিবিড় তিমিরে ফুটিয়া উঠিবে নাকি
পবিত্র মুখ, মধুর মূর্তি স্নিগ্ধ আনত আঁখি?
হৃদয় আকাশে থাক না জাগিয়া দেহহীন তব জ্যোতি।
 তোমাতে হেরিব আমার দেবতা হেরিব আমার হরি
তোমার আলোকে জাগিয়া রহিক অনন্ত বিভাবরী। (সুরদাসের প্রার্থনা)

 এ উপলব্ধির চরম বিকাশ অনন্ত প্রেম কবিতায় :

তোমারেই আমি বাসিয়াছি ভাল শতযুগে শতবার
যুগে জনমে জনমে অনিবার।
আমরা দুজন করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
আজ সেই চির দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে।
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।

 এর পরে রবীন্দ্রনাথ এক অশরীরী রূপ-সৌন্দর্যকে ভালবেসে প্রণয়-ক্ষুধায় চরিতার্থতা লাভ করেছেন। মোহিতলাল কিন্তু এই মার্গে পৌঁছতে পারেননি। তিনি স্বপনপসারী ও বিস্মরণীতে দেহ সম্ভোগে রূপ-সৌন্দর্য-প্রণয় পিপাসা মেটাতে চেয়েছেন। অবশ্য ভাবের ঘোরে ধ্যানের চোখে কায়া কখনো কখনো ছায়াতে এবং মায়াতে মিলিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের রাহুর প্রেম-এ যে প্রবৃত্তি বেগ প্রকাশ পেয়েছে, এ স্তরে মোহিতলালও প্রায় সেই আবেগে চঞ্চল এবং লিপ্সায় মুখর। তার কয়েকটি অভিব্যক্তি :

১. কনক-কমল রূপে প্রেম যদি ফুটি উঠে
 তবেই আমার মানস-মরাল অলস পক্ষপুটে
চকিতে জাগিয়া উঠে। (রূপতান্ত্রিক)

২. আমার দেবতা–সুন্দর সে যে!
পূজা নয়, ভালোবাসি!
সুন্দর লাগি ভালোবাসা মোর,
অন্তর আঁখি ফুটে!–(রূপতান্ত্রিক)

৩. থাক্ তোলা আলবোলা পেয়ালায় মুখ ধর!
চেয়ে দেখ মন-ভোলা দুনিয়া কি সুন্দর! (দিলদার)

৪. দিকে দিকে প্রিয়ারি পিরীতি।
উথলিছে লাবণ্যের মত! সে মিলন
অহরহ কোথা নাই বিরহ কল্পনা!…
 আলোক আঁধারে দ্বন্দ্ব।
ঘুচে গেল মানবেরি পিপাসার সাথে। (পুরূরবা)

৫. রানীর মুকুটখানির কথা প্রেমির মনে জাগে
 নারীর পূজার তরেই সে যে রাজার বিভব মাগে। (নারী)

৬. রস–সে যে রূপে পড়িয়াছে ধরা, কোথা নহে নিরাকার,
অরূপ রূপের উপাসনা–সে যে অন্ধের অনাচার! (একখানি চিত্র দেখিয়া)

৭. পাপের লাগিয়া ফুটিয়াছে হেন অতুল অবনী ফুল (প্রেম)?
রসে রূপে আর সৌরভে যার চরাচর সমাকুল!
পরতে পরতে দলে দলে যার অমৃত পরাগ ভরা–
 মধুহীন যারে করিবারে নারে শোক তাপ ব্যাধি জরা। (পাপ)

৮. নীল ফুলে ভরা কুঞ্জ বিতানে।
চেয়ে আছি আমি কার মুখপানে
 হয়ে গেছি ভোর রূপ সুধা পানে,
চেয়ে আছি অনিমেষ…
রূপের প্রভায় ঝলসে নয়ন
সীমা নাই, সীমা নাই।…
 সেতো নহে শুধু দেহ বিভঙ্গ
কালো আঁখি আর কেশ তরঙ্গ,
বিষ অধরে মুকুতা সঙ্গ,
সে যে সবই রূপ! সে যে অনঙ্গ
দিব্য আলোক বিভা। (পূর্ণিমা স্বপ্ন)

৯. সৃষ্টি হতে এতকাল এই যে পীড়ন–
 এত কালি, এত ধূলা এত পাপ তাপে,
তবু কি মরেছি আমি? নবীন জীবন।
 জন্মে জন্মে লভিয়াছি প্রেমের প্রতাপে। (ভ্রান্তি বিলাস)

১০. মধু সৌরভ-সৌরভ মধু। মধু আর শুধু মধু,
আপনারি প্রাণ দুইখানি হয়ে হল বর হল বধূ!
 পাপড়ি কি পাখা চেনা নাহি যায়, কার মধু
 নাহি গুঞ্জন, শুধু সুধা পান শুধু সুখ! (আঁধারের লেখা)

১১. আকাশের তারা যেমন জ্বলিছে জ্বলুক
অসীম রাতি,
ওর পানে চেয়ে ভয়ে মরে যাই, চাহি না
অমৃত ভাতি।
 ধরার কুসুম বার বার হাসে, বার বার কেঁদে
আঁধারে আলোকে শিশিরে কিরণে আমি
হব তার সাথী। (কামনা)

এখানে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। তিনিও ভালবাসি নারী নরে, ভালবাসি চরাচরে সুখ পেতে চেয়েছেন এই হাসি-অশ্রুময় ধরণীতে। তিনিও স্বর্গের অনন্ত সুখ ভীরু!স্বরগে অন্ অনন্ত সুখ! ওহো, এ কি যাতনা!

১২. আমার মনের গহন বনে
পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী
নারী অপ্সরী সঙ্গোপনে!
সেথা সুখ নাই, দুঃখ নাই সেথা
–দিবা কি নিশা।
গানেরি আড়ালে সাড়া দেয় শুধু সে অমরা
 বাহির ভুবনে এই বাহু পাশে দিবে না ধরা। (বিস্মরণী)

১৩. আমারে করেছে অন্ধ গন্ধ ধূমে দেহ-ধূপধার,
 মাদক সৌরভে তার চেতনা হারায়।
বিষরস পান করি স্বাদ পাই স্বরগ সুধার,
চির বন্দী আছি তাই স্বপ্ন কারায়। (স্পর্শ রসিক)

১৪. দেহ ভরি কর পান কবোষ্ণ এ প্রাণের মদিরা
ধূলা মাখি খুঁড়ি লও কামনার কাঁচমণি হীরা।
অন্ন খুঁটি লব মোরা কাঙালের মত
 ধরণীর স্তন যুগ করে দিব ক্ষত।
নিঃশেষ শোষণে, ক্ষুধাতুর দশন-আঘাতের করিব
জর্জর–আমরা বর্বর।
ওরে মূঢ়! জ্বেলে নে রে দেহ-দীপে স্নেহ
ভালোবাসা নব জন্ম আশা (মোহমুদার)

১৫. দেহে মোর আকণ্ঠ পিপাসা। ……. নিষ্ফল কামনা
মোরে করিয়াছে কল্প সহচর
সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি
মিথ্যা সনাতনী।
 সত্যেরে চাহি না তব, সুন্দরের করি আরাধনা।
 জানিতে চাহি না আমি কামনার শেষ কোথা আছে।
ব্যথায় বিবশ, তবু হোম করি জ্বালি কামানল!
এ দেহ ইন্ধন তায়–সেই সুখ।
 চিনি বটে যৌবনের প্রেম দেবতারে,
নারীরূপা প্রকৃতিরে ভালবেসে বক্ষে লই টানি,
রহস্যময়ী স্বপ্ন সখী চির অচেনারে
 মনে হয় চিনি যেন–এ বিশ্বের সেই ঠাকুরানী। (পান্থ)

১৬. সেই রূপ ধ্যান করি অঙ্গে মোর জাগিল
যে স্কুরৎ কদম্ব শিহরণ।
 দেহ হতে দেহান্তরে বাধিলাম কি সহজে প্রীতি
প্রেম সেতুর বন্ধন।
পাপ-মোহ-লালসার লাল নীল রশ্মিমালা বরতনু
ঘেরিয়া তোমারি
লাবণ্যের ইন্দ্র ধনু শোভা ধরে–নাই জ্বালা,
মুগ্ধ হনু আনন্দে নেহারি। [অকাল সন্ধ্যা

১৭. ভালো যারা বাসে তারাই চিনেছে,
তুমি আঁকিয়াছ তারে–
সে দিনের সেই তরুণীরে নয়–নিখিলের
বনিতারে।
 যার তনু ঘেরি, আরতি করিল শরতের
আলোছায়া–
মানস বনের মাধবী সে হল? ফাগুনের ফুল
কায়া! (মাধবী)।

১৮. বধূও জননী পিপাসা মিটায় দ্বিধাহারা–
রাধা ও ম্যাডোনা একাকারা!
অধরে মদিরা, নয়নে নবনী,
একি অপরূপ রূপের লাবণী।
 সুন্দর! তব একি ভোগবতী
 মরম পরশী রসধারা। (বাধন)

১৯. (হে দেহ) হাসি ক্রন্দন তব উৎসব!
পিরীতির পারাবার
অধরে, উরসে, চরণ সরোজে
আরতি যে অনিবার। (মৃত্যুশোক)

২০. রূপের আরতি করিনু আঁধারে।
আবেশে নয়ন মুছি–
হেরি দেহে মনে বাধা নাই আর,
–উদ্বেল অম্বুধি! (বিস্মরণী)

স্মরগরলে কবি বুঝেছেন : শুধু দেহে ও রূপে এ ক্ষুধা মিটবার নয়, যেন দেহাতীত এমন কিছু আছে যা সত্যিকার তৃপ্তি–নিবৃত্তি দিতে পারে, কিন্তু তা কি তিনি স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন নি!

বুঝি না, দোহার মাঝে কেবা নিদ্রা যায়,
কেবা জাগে কার চেতনা হরিয়া। (রূপ মোহ)

 দেহ ও দেহস্থিত আত্মাকেও তিনি এক বলে উপলব্ধি করেছেন :

দেহের মাঝে আত্মা রাজে–
 ভুল সে কথা, হয় প্রমাণ,
আত্মা-দেহ ভিন্ন কেহ
নয় যে কভু এক সমান। (পরমক্ষণ)

তিনি এই জীবনকে এবং যৌবন-ধর্মের স্বাভাবিক চাহিদা রূপ-দেহ-প্রণয়-সম্ভোগকে অস্বীকার করেননি। তিনি একান্তভাবে, জীবনধর্মী বলেই মৃত্যুর পরপারে আর জীবনের–চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। মৃত্যু তাঁর নিকট অন্ধকার ও ধ্বংসের প্রতীক। তাই বলে তাঁর এই রূপ-প্রণয়ের সাধনাকে কামজ মনে করবার হেতু নেই। একে তো তিনি দেহাতীত ও রূপাতীত সৌন্দর্য এবং সম্ভোগ বাসনাকে স্বীকার করেছেন, অধিকন্তু তাঁর রূপ ও প্রণয় পিপাসার মধ্যে এমন এক তীব্র ও গভীর অনুভূতি, এমন এক অনন্য সৌন্দর্য দৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে, যা ভূমির হয়েও ভূম্যেতর। এই প্রকার রূপ-সৌন্দর্য পিপাসা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–যারা সৌন্দর্যের মধ্যে সত্যি সত্যি নিমগ্ন হতে অক্ষম, তারাই সৌন্দর্যকে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের ধন বলে অবজ্ঞা করে–কিন্তু এর মধ্যে সে অনির্বচনীয় গভীরতা আছে, তার আস্বাদ যারা পেয়েছে, তারা জানে সৌন্দর্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ান্ত শক্তিরও অতীত–কেবল চক্ষু কর্ণ দূরে থাক, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না।–(ছিন্নপত্র)

এই উক্তি মোহিতলাল সম্বন্ধে সর্বৈব প্রযোজ্য। এমনিতর ব্যাকুলতাই তার কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে। এ স্তরে তিনি জেনেছেন দেহে রূপ, রূপে রতি ও কামে প্রেম জন্মায়। সে প্রেম। সম্ভোগলিন্দু নয়, একপ্রকার মানসোপভোগই কাম্য। তখন দৈহিক রূপ সৌন্দর্যানুধ্যানের সোপান কিংবা অবলম্বন মাত্র।

এ বোধে উত্তরণের পর মোহিতলাল যথার্থই শিল্পী–নিষ্কাম সৌন্দর্যের সাধক। কিন্তু তাতেও যেন কোথায় অতৃপ্তির বেদনা জেগে থাকে। যেন কামে-প্রেমে একটা দ্বন্দ্ব, রূপে-অপরূপে যেন টানাটানি–একটা আলো-আঁধারি কিংবা কায়া-ছায়ার মায়াপ্রপঞ্চ তাঁকে অস্থির ও উদ্বিগ্ন রাখছে। তবু স্বীকার করতে হয় Byron-এর মতো উচ্ছলতা, Shelley-র মতো উদ্দামতা এবং Keats-এর মতো আকুলতা তার নেই। তবে Keats যেমন বুঝেছেন–

Heard melodies are sweet
But those unheard are sweeter

 তেমনি মোহিতলালও উপলব্ধি করেছেন–এই যৌবন এই রূপ এই দেহ সত্য হলেও স্বপ্ন এবং রূপের আরতি সুন্দরতর।

বল দেখি, কমলের বঁধূ অলি, না সে ওই আকাশের রবি?
রূপ যে স্বপ্ন তারকামনার ধন নয় বাসনার ছবি।
রূপসীরে করে পূজা, প্রেয়সীরে ভালবাসে কবি।
 রূপ নহে সেই রস, রতি নয় সে শুধু আরতি,
মনের নিশীথে সে যে চিত্তাকাশে অপরূপ জ্যোতি।
সে তো নহে ভোগ প্রয়োজন,
সে নয়, প্রাণের ক্ষুধা প্রেম নয়, সে তো দেহ পদ্মে মধু আস্বাদন।
উঁহু দোঁহা ভুঞ্জে শুধু, দুই আমি এক আমি হয়,
আত্মরস রসাতলে স্বর্গ-মর্ত নিখিলের লয়! (রতি ও আরতি)

এইরূপে মোহিতলালের সকাম রূপপিপাসা ও প্রণয়ক্ষুধা নিষ্কাম বিদেহ রূপ সাধনার আভাস দিয়ে থেকে গেছে; তা রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদোষের দেশে জগতের গিরি নদী সকলের শেষে কামনার মোক্ষধাম অলকার তীরে পৌঁছতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ যেমন রূপসাগরে ডুব দিয়েছেন অরূপরতন আশা করি, তেমনি আশ্বাস মোহিতলাল কোথাও পাননি। তাই তাঁর ক্রন্দন

মোর কামকলা কেলি উল্লাস
নহে মিলনের মিথুন বিলাস–
 আমি যে বধূরে কোলে করে কাঁদি, যত
হেরি তার মুখ…
আমার পিরীতি দেহরীতি বটে, তবু সে যে বিপরীত
ভক্ষ্ম-ভূষণ কামের কুহকে ধরা দিল স্মরজিত!
ভোগের ভবনে কাঁদিছে কামনা
লাখ লাখ যুগে আঁখি জুড়াল না।
দেহের মাঝারে দেহাতীত কার ক্রন্দন সঙ্গীত (স্মরগরল)

[কবি শেখরের সখি, কি পুছসি অনুভব মোয় পদ স্মরণীয়।

২. একে দুই কাজ নাই, দুয়ে এক ভালো
তুমি আমি বাঁধা রব নিত্য আলিঙ্গনে।
 নিভে যাক রাধিকার নয়নের আলো
 রাধার মরণ হোক তোমার জীবনে।
আমি প্রেম, তুমি প্রাণ-বারি ও পিয়াস
এক পাত্রে রহে যেন দ্বন্দ্ব যাক থামি। (ভ্রান্তি বিলাস)

৩. একদিন আছিল যা সফেন তরল।
আজ সে যে নিরুজ্জাস! (উৎসর্গ)

৪. আমি মদনের রচিনু দেউল দেহের দেহেলী পরে
 পঞ্চশরের প্রিয় পাঁচফুল সাজাইনু থরে থরে।
দুয়ারে প্রাণের পূর্ণ কুম্ভ
পল্লবে তার অধীর চুম্ব,
রূপের আধারে স্বস্তিক তার আঁকিনু যতন ভরে। (স্মরগরল)

 ৫. আমার অন্তর লক্ষ্মী দেহ-আত্মা-মানসের
শেষ তীর্থে শুচি স্নান করি দাঁড়াইল।
মুক্ত লজ্জা,
সর্বরাগহারা এবে, তাই তার রূপরেখা
অনিন্দ্য সুন্দর।
 প্রাণের সঙ্গীত রসে একপাতে ধরেছিনু
ইন্দ্রিয়ের পঞ্চ উপাচার
বুঝি না দোহার মাঝে কেবা নিদ্রা যায়,
কেবা জাগে কার চেতনা হরিয়া

 ৬. দেবী সে প্রেয়সী নয়। এ যে তাই
আরো রূপ।
একি মোহ স্নেহ অবসানে– (রূপ মোহ)

 ৭ সৃষ্টির ভরা ভারি হয়ে এল, ভেঙ্গে যায় রূপের চাপে
তবু রূপ চাই স্নায়ু চিরে চিরে, আয়ু যে ফুরায় তাহারি দাপে!
 রূপ নয় আর প্রিয়েরি লাগিয়া প্রেমের ছলা
সে যে নিজ তরে কামনা নটীর নৃত্যকলা। (রুদ্রবোধন)

৮. সুখের স্বপনে সুমধুর ব্যথা কেন জেগে রয়! (বসন্তবিদায়)

 ৯. কোথা সেই রূপ চোখ দিয়ে যারে যায় না ধরা,
যে রূপ রাতের স্বপন-সভায় স্বয়ম্বরা।
কোথা সেই তুমি দেখেছিনু যারে দেখারও আগে। (নিশিভোর)

১০. শত যুগ ধরি রূপসী বসুধা
মিটাইতে নারে অসীম যে ক্ষুধা
 এক যৌবনে ফুরাবে সে সুধা?
 তারি পরে যমকূপ।
 হায় সখি, হায়! তবু এ ধরায় এত রঙ এত রূপ।
অসীম ক্ষুধার একটু সে সুধা যে করে পুলকে পান,
সে যে জীবনের বনে বনে পায় সুমধুর সন্ধান! (দিনশেষ)

এবার কবি জেনেছেন :

১১. জেনেছি কোন্ সাগর-কূলে।
আলোক লতা উঠছে দুলে
পেয়েছি সেই জ্যোতির আভাস
আর কিছু না চাই। (নতুন আলো)

১২. নয়নে লেগেছে আজ অবনীর বৃন্দাবনী মায়া,
যে জীবন যৌবনের ক্ষয় নাই, খেদ নাহি যায়–
 হাসি অশ্রু দুই-ই-এক, একই শোভা গোলাপে শিশির!
 জীবন বসন্ত শেষ–শেষ নাই পূর্ণিমা নিশির।… …
জীবনের মতো প্রেম উবে যায় যাদুমন্ত্র বলে,
 ভাসে শুধু এক সুর–সুখহীন একান্ত উদাস।

১৩. সেই প্রেম! জন্ম জন্ম তারি লাগি ফিরিছে সবাই!
এই দেহ পাত্র ভরি যেই দিন উঠিবে উছলি–
যুচিবে দুরূহ দুখ মৃত্যুভয় রবে না যে আর। (বুদ্ধ)

১৪. মৌনবতী সে রাজকন্যারে আর কেহ চিনিল না–
শুধু মোর লাগি সে মূক অধরে মনোহর মন্ত্রণা!
 তনুর প্রভায় অতনুরে নাশি
মোরে চিরতরে করিল উদাসী।…
অয়ি সুন্দরী ভুবনেশ্বরী!
 আমার জগতে তবু হায় বাণীরাগ রঙ্গিণী,
 হেরিনু তোমারে মনোমন্দিরে রূপ রেখা বন্দিনী।
আমারে লইয়া একি লীলা তব? (শেষ আরতি)

কবি ভুবেনশ্বরীর লীলা বুঝেও শান্তি পেলেন না–

১৫. এ যে মৌন অট্টহাস মরণের জ্যোৎস্না জাগরণ।
যৌবন দেহের ব্যাধি, রূপে যেন তাহারি বিকার!
মনে হয়, খুলে গেছে প্রকৃতির মুখ-আবরণ—
দিবসের লীলা শেষে নিশাকালে একি হাহাকার। (নিযুতি)।

 সুতরাং এই স্তরে কবির তৃপ্তি–অতৃপ্তির, জানা-অজানার দ্বন্দ্বের নিরসন আর হল না, তাই আমরা বলেছি, কবি সাধন-মার্গের শেষপ্রান্তে অলকার তীরে পৌঁছতে পারেননি। কবি বুঝেছেন দেহাতীত রূপ–কামাতীত সৌন্দর্যই যথার্থ চাওয়ার ও পাওয়ার বস্তু। উপভোগ, তৃপ্তি কিংবা প্রশান্তি মেলে তখনই যখন রূপ নিরূপে পায় সূক্ষ্মতা, সৌন্দর্যানুভূতি নিরবয়বে পায় স্থিতি। কিন্তু তা তাঁর বোধে স্থায়ীভাবে ধরা দেয়নি। কায়ার প্রতিভাস ছায়ারূপে মাঝে মাঝে জেগেছে বটে, কিন্তু সে ছায়াও মায়া বিস্তার করে পালিয়েছে–জ্যোতিষ্মন হয়ে তার অন্তর্লোকে স্থিতি লাভ করেনি। আকূতি ও বেদনাতেই তাই কবির সাধনা অবসিত প্রশান্তিতে পরিসমাপ্ত নয়। মোহিতলাল ভোগের কবি– ত্যাগের নন-বেদনারও নন, তিনি জীবনধর্মী। প্রাণ-ধর্মের প্রাচুর্যে তাঁর বেদনাও মাধুরী হয়ে ফুঠে উঠেছে। তার কাছে জীবনের বড়ো প্রেম:

হায় প্রেম ক্ষণপ্রভা! এ জীবন আঁধার বিধুর!
জীবনের চেয়ে ভালো সে প্রেমের ক্ষণিক পুলক। (প্রেম ও জীবন)

তিনি একান্তভাবে জীবনধর্মী বলেই মৃত্যুর পরপারে আর জীবনের চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। মৃত্যু তাঁর নিকট অন্ধকার ও ধ্বংসের প্রতীক। এমনকি স্বর্গের নিত্য অনন্ত সুখও তাকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে তিনি বিহারীলালের ভাবশিষ্য। এ হাসি-অশ্রুময় জগতের আকাশ জল বাতাস আলোতে যে আরাম, যে সুখ, যে মাধুরী তা স্বর্গে নেই। তাই স্বর্গসুখ অনভিপ্রেত। এ সূত্রে রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপও স্মরণীয়। কবি বলেন

১. অজর অমর হয়ে নিত্যের নন্দনে।
থেকো না অরূপ রূপে।…
নব নব জন বিবর্তনে আঁখি যুগ
চিনি লবে আঁখি যুগে, চির পিপপাসায়।
বার বার হারায়ে হারায়ে ফিরে পাব
দ্বিগুণ সুন্দর।…
নিত্যেরে কে বাসে ভালো? চিরস্থির ধ্রুব
অন্তর রজনী কিম্বা অনন্ত দিবস?
নহি তাই অনুরাগী। আমি চাই আলো
 ছায়ারি পশ্চাতে; চাই ছন্দ, চাই গতি
রূপ চাই ক্ষুব্ধ সিন্ধু তরঙ্গ শিয়রে—
ধরিতে না ধরা যায়, পুলকে লুটায়। (পুরূরবা)

২. আমি চাই এই জীবনেরে জুড়ে বুকে করি লব সব,
 জীবনের হাসি জীবনের কলরব।
জীবনের হাসি জীবনের দুখ
জীবনের আশা, জীবনের সুখ
পরাণ আমার চির উৎসুক
লইতে পাত্র ভরি
 অধরে তুলিব ধরি
 ধরণীর রস জীবনের রস যত।…
তারপর–আমার আমিটা একেবারে শেষ হোক
করিব না কোনো শোক,
মৃত্যুর পরে চাহিব না কোনো সুন্দর পরলোক। (মৃত্যু)

৩. জীবন মধুর! মরণ নিঠুর তাহারে দলিব পায়,
যত দিন আছে মোহের মদিরা ধরণীর পেয়ালায়!
দেবতার মতো কর সুধা পান।
 দূর হয়ে যাক হিতাহিত জ্ঞান।…
অপরূপ নেশা অপরূপ নিশা
রূপের কোথাও নাহি পাই দিশা। (অঘোর পন্থী)

৪. ত্যাগ নহে, ভোগ–ভোগ তারি লাগি যেই জন বলীয়ান,
নিঃশেষে ভরি লইবারে পারে, এত বড় যার প্রাণ। (পাপ)

৫. জানি শুধু–যাব বহুদূর, আসিয়াছি বহদূর হতে!
জানি না কোথায় কবে।
পথ চলা শেষ হবে
লুকাইবে লোক-লোকান্তর অন্তহীন অন্ধকার স্রোতে। (পথিক)

৬. (দেহ) তোমারি সীমায় চেতনার শেষ,
তুমি আছ তাই আছে কাল দেশ,
 দুঃখ-সুখের মহা পরিবেশ!
দেহলীলা অবসানে
যা থাকে তাহার বৃথা ভাগাভাগি
দর্শনে-বিজ্ঞানে।…
আর তুমি প্রেম!–দেহের কাঙ্গাল!
 হারাইলে আর পাবে না নাগাল।
…. পড়িবে না চোখে সেই রূপ-রেখা–

স্বপনের সঙ্গিনী। (মৃত্যুশোক) শুধু এখানেই শেষ নয়, কবি মনে করেন, হৃদয়ের রূপ প্রণয় স্নেহ ভালবাসার ক্ষুধা ভবতৃষ্ণা জাগিয়ে রাখে। তাতেই জন্মান্তর হয় এবং স্বর্গের নিত্য আনন্দ-ভোগের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি মেলে। গৌতম বুদ্দের ভব তনহার শাস্তিস্বরূপ জীবজন্ম বা হিন্দুমতের পাপজনিত জন্মান্তর এ নয়, এ হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে জীবনের আনন্দ উপভোগ করবার জন্যে ধূলার ধরায় ফিরে ফিরে আসা।

১. শিয়রে মৃত্যুর ছায়া, চক্ষে ভাসে তবু
নন্দনের চিরন্তন আনন্দ স্বপন!…
 প্রেম যে আত্মার আয়ু! ক্ষয় নাহি তার
জন্মে জন্মে তাই মোরা একই বধূ বর। (জন্মান্তরে)

 ২. এ ধরার মর্মে বিধে রেখে যাব স্নেহ ব্যথা, সন্তান পিপাসা,
তাই রবে ফিরিবার আশা।
তারি তরে, ওরে মূঢ়। জ্বেলে নেরে দেহ-দীপে
স্নেহ ভালবাসার নবজন্ম আশা। (মোহমুঘর)

 স্বর্গও মিথ্যা–

৩ সত্য শুধু কামনাই মিথ্যা চিরমরণ পিপাসা।
দেহহীন, স্নেহহীন, অর্থহীন বৈকুণ্ঠ স্বপন।
 যমদ্বারে বৈতরণী, সেথা নাই অমৃতের আশা
ফিরে ফিরে আসি তাই, ধরা করে নিত্য নিমন্ত্রণ (পান্থ)।

৪. নবীন জীবন জন্মে জন্মে লভিয়াছি প্রেমের প্রতাপে। (ভ্রান্তি বিলাস)

শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ হেমন্ত গোধূলির আমলে কবি তার আত্মভাব সাধনার মূল সুরটি হারিয়ে ফেলেছেন; লীলা চঞ্চল, দৃপ্ত-দুরন্ত সে যৌবন আর নেই। যৌবনের পুরোহিত প্রেমদেবতার আধিপত্য লুপ্ত হয়ে গেছে। যৌবন মদমত্তায় যে রূপ-প্রণয়কে জীবনে চরম ও পরম কাম্য বলে মনে করেছিলেন, যৌবনাবসানে কবির মোহ যখন গেল ছুটে, স্বপ্ন গেল ভেঙে, কঠোর বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে কল্পলোকবিহারী কবি তখন উপলব্ধি করলেন, রূপ প্রণয় সম্ভোগ প্রেম প্রভৃতি সব অনিত্য এবং নিঃসার। ফলে তার হৃদয়-মনে এল হাহাকার, ক্লান্তি, অবসাদ। যৌবনের সেই মিথ্যা ভোগেচ্ছাকে জীবনধর্ম বা দেহের নিয়তি বলে স্বীকার করে নিলেন। বিগত জীবনে ফেলে আসা দিনগুলোর জন্যে কোথায় যেন একটু ব্যথা বাজে, কেন যেন অনুশোচনা হয়। স্বপ্ন ভঙ্গে, আহত কবির চিত্ত বিক্ষুব্ধ অশান্ত ও ব্যথিত। তাই তিনি আকুলভাবে অকূল শান্তি ও বিপুল বিরতি আশায় গঙ্গাতীরে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছেন।

৩ যৌবন নিশার সেই স্বপন সঙ্গিনী,
সহসা উষার সাথে মিলাইল ত্বরা,
অন্তরীক্ষে, পূরূরবা মায়া বসুন্ধরা
 কাঁদিয়া খুঁজিছে তারে দিবস যামিনী।
হায় নর! বৃথা আশা, বৃথা এ ক্রন্দন!
উর্বশী চাহে না প্রেম প্রেমের অধিক
 চায় সে দৃপ্ত আয়ু, দুরন্ত যৌবন!
 ফাগুনের শেষে তাই সে বসন্ত পিক
পলায়েছে; মরু পথে, হে মৃত্যু
কে রচিবে পুনঃ সেই প্রফুল্ল নন্দন? (স্বপন সঙ্গিনী)

৪. অসময়ে ডাক দিল হায় বন্ধু একি পরিহাস।
ফাগুন হয়েছে গত, জানো নাকি এ যে চৈত্র মাস?
 বাতাসে শিশির কোথা ফুলেদের মুখে হাসি নাই,
কোকিল পলায়ে গেছে, গোলাপ যে বলে–যাই।
একদিন এ জীবনে পূর্ণিমার ছিল না পঞ্জিকা!
নিত্য জ্যোত্সা ছিল নিশা হেমন্ত ও শারদ চন্দ্রিকা!
শ্রাবণে ফাগুন রাতি উদিয়াছে বহু বহু বার
শীতে রৌদ্রে গাঁথিয়াছি চম্পা আর চামেলীর হার।
জীবনের সে যৌবন মরু পথে সেই মরুদ্যান
পার হয়ে আসিয়াছি আজ শুধু করি তার ধ্যান।
 দুদিনের এই সুখ, দুদিনের এই সুন্দর ভুল
এরি লাগি সৃষ্টিপথ অহরহ মেলিছে মুকুল। (অকাল বসন্ত)

 ৫. রূপ মধু সৌরভের স্বপন সাধনা।
করিনু মাধবী মাসে, ইন্দ্রিয় গীতায়।
রচিনু তনুর স্তুতি। প্রাণ সবিতায়।
অঞ্জলিয়া দিনু অর্ঘ্য-প্রীতি নির্ভাবনা,
নিষ্ফল ফুলের মতো অচির শোভনা
সুন্দরের কামনারে গাঁথি কবিতায়। (ফুল ও পাখি)

৬. তুমি নাই, প্রাণে মোর পিপাসাও নাহি
প্রিয়া নাই–প্রেম সেও গেছে তারি সাথে।
সংসার শর্বরী।
তব রূপ স্বপ্নে আমি করেছিনু ভোর।
গৃহ পরিহরি চলেছিনু কল্পবাসে। (নির্বেদ)

৭. ঘুচিল সংশয় মোহ–সত্য আর সুন্দরের ছল
 বুঝিলাম দুই-ই মিথ্যা। সৎ শুধু প্রকাশ মহিমা ।
প্রাণস্পর্শী বিরাটের; তারি ধ্যানে সঁপিনু সকল। (প্রকাশ)

 ৮.। পরশ হরষে মজি নাই তাই গেয়েছি দেহের গান,
জেগে রব বলে করি নাই তার অধরের মধু পান।
 রুদ্রের সাথে রতির সাধনা করিয়াছি একাসনে,
 প্রাণের পিপাসা আঁখিতে ভরেছি রূপের অন্বেষণে।

সব যখন মিথ্যে হল, তখন :

অকূল শান্তি, বিপুল বিরতি আজিকে
মাগিছে প্রাণ।

৯. এমন প্রহর ভ্রমিবে না আর, ঠাই তার লবে চিনি
আর রবে না রূপের পিপাসা
 আজি অ-ধরার অধর লাগি সারা প্রাণ উৎসুক
 সে রসে বিবশ ঘুমাইবে মোর বাণী হারা
সুখ দুখ। (বাণী হারা)

প্রতিভাবান কবিদের রচনাবলীতে ভাবধারার একটা ঐক্য থাকে, একটি ভাব-সূত্রে গ্রথিত হয়ে রূপ রস ও ভাবের একটি অপূর্ব রসময় মানসমূর্তি অঙ্কিত হয়। অন্যকথায় সব রচনায় কবির আত্মভাব সাধনার বা কাব্যের মূল সুরের ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। মোহিতলালের কবিতায়ও এরূপ একটি যোগসূত্রের সন্ধান মিলে। এইজন্যই আমরা কবির কাব্য-প্রেরণার উৎস-রূপ ও প্রণয় পিপাসা আদিম বর্বর প্রবৃত্তির প্রতীক নাদির শাহ এবং বেদুইনের মধ্যেও দেখতে পাই। নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর এবং মৃত্যুশয্যায় নূরজাহান কবিতাদ্বয়েও রূপ ও প্রণয় পিপাসাই শেষ কথা :

১. তাহমিনা। তাহমিনা!
চাও, কথা কও! কোথা সুখ নাই
নাদিরের তোমা বিনা।
আজ নওরোজ রাতে
 অশোক এসেছে, যৌতুক দিতে দিল তার ওই হাতে।
লুটাইনু পায়, বলিনু বাঁচাও! তুমি জানো সেই পাতা
 যার রসে এই যাতনা জুড়ায়, আর কেহ জানে না তা। (নাদির শাহের শেষ)

২. এ বিশ বছর ধ্যান করি, কালি তার দেখা পেয়েছি ভাই।
মাফ পেয়েছি যে–ছুটি আজ থেকে,
হুকুম মিলেছে খোদাতালার,
সকল যাতনা জুড়াইয়া গেছে,
অবসান আজ সব জ্বালার। …
 আমার কাহিনী তুই বুঝিবি না, বুঝেছে
সে কথা আর একজন।
দুনিয়ার মাঝে দরদী যেথায় করিবে।
অশ্রু বিসর্জন।
 যেদিন চেয়েছি কবরে তাহার ব্যথায়
গুমারি গভীর রাতে,
অমনি আলো যে জ্বেলেছে দ্বিগুণ আগুনের ঝঞ্ঝাবাতে।  (শেষ শয্যায় নূরজাহান)

৩. সেই মুখ, আর সেই চোখ, আর ছাউনি যে–
বাচ্চার পানে হরিণীর মত ফিরে চাওয়া পথের মাঝে।…
তারি মুখখানি মনে করে আমি গান বেঁধেছিনু
দিওয়ানা হয়ে
তেমন ব্যথা যে পাইনি কোথাও –ছুরি–ছোরা?
সে তো গেছেই সয়ে।
 দারাত জ্বলের নামে গাঁথা সেই সুরটি পরাণ ছাইয়া আষে। (বেদুঈন)

৪. ভালো করে কাঁদো! ঢাকিওনা মুখ–
 এত শোভা, মরি মরি
হাহাকার প্রাণ, তবু মনে হয় দেখে লই আঁখি ভরি!
ওই মুখ যবে জলে ভেসে যাবে আল্লার দরবারে,
রোজ কেয়ামত ভেরীর আওয়াজ থেমে যাবে একেবারে। (নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর)

মোহিতলাল ফারসি সাহিত্যের সূফীধারার অনুরাগী। জীবনকে সূফীদের ন্যায় প্রত্যক্ষ করতে তিনিও প্রয়াসী :

১. থাক তোলা আলবোলা পেয়ালায় মুখ ধর
চেয়ে দেখ মন ভোলা, দুনিয়া কি সুন্দর! (দিলদার)

২. যত নেশা হৌক রাতটি ফুরালে রয় তা কি?
তোমার সুর-সুরায় যে জন মস্তানা,
 হুঁশ হবে তার আখেরি জামানা শেষ-দিনে।
 বড় মিঠা মদ! ফের পেয়ালা ভর সাকী।
হরদম্ দাও! আজ বাদে কাল ভরসা কি? (গজল গান)

৩. য়ুসুফের রূপ দিনদিন যে গো ফুটে ওঠে,
কুমারী ধরম-শরম যে তার পায়ে লোটে।
 জুলায়খার ঐ আবরু এবার গেল টুটে,
ইজ্জত রাখা ভার হল সেই লজ্জিতার। (হাফিজের অনুসরণে)

শব্দ, ভাষা ও ছন্দযোগে বিষয়ানুরূপ পরিবেশ সৃষ্টিতে মোহিতলালের কৃতিত্ব অসাধারণ। ফারসি সাহিত্যানুগ কবিতা রচনায় বা মুসলিম জীবনালেখ্য চিত্রণে তাঁর কৃতিত্ব লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে মোহিতলাল সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুসারী এবং এঁদের এ ধরনের কবিতাই নজরুল ইসলামকে উৎসাহিত করেছিল আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগে।

মোহিতলালের আর একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য এই যে তার মধ্যে ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতি প্রীতি যেমন প্রবল, তেমনি নতুন ভাব-চিন্তার অগ্রনায়ক বাঙালির মননও প্রচুর। এইজন্যে একদিকে অগ্নিবৈশ্বানর, পুরূরবা, মৃত্যু ও নচিকেতা, আবির্ভাব, রুদ্রবোধন, কন্যা প্রশান্তি প্রভৃতি কবিতায় যেমন তিনি হিন্দু তত্ত্ব-চিন্তার অনুসারী; তেমনি নারী স্তোত্র, বুদ্ধ, প্রেম ও সতীধর্ম অঘোর পন্থী, দেবদাসী, প্রেম ও জীবন প্রভৃতি কবিতায় বাঙালি সুলভ নতুন মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। এখানে কবির নিজস্ব মনন ও চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে। আমরা জানি মোহিতলাল মনেপ্রাণে স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বধর্মনিষ্ঠ। দেশাত্মবোধ ও ভারতীয় দর্শন-সংস্কৃতি প্রীতি তাঁর অস্থিমজ্জায়। তাঁর গদ্য রচনাবলীর মূল ব্যঞ্জনাই এসব। ফলে তাঁর মননশীল মন গ্রহণ বর্জনের একটি সুনির্দিষ্ট ধারা মেনে চলেছে। অন্য কথায় তিনি তার মনীষা ও রুচি অনুসারে হিন্দু তত্ত্ব-চিন্তা ও দর্শনের কিছু গ্রহণ কিছু বর্জন করে নিজস্ব একটা আদর্শ বা মতপথ খাড়া করেছেন। এজন্যে তাঁর কবিতার দু-এক জায়গায় সনাতন আদর্শ বিরোধিতা ও মতদ্রোহিতা প্রকাশ পেয়েছে :

১. মাটির প্রতিমা বটে, মাটি বিনা সবই যে নশ্বর
দেহই অমৃত ঘট, আত্মা তার ফেন অভিমান।
 সেই দেহ তুচ্ছ করে, আত্মা ভয়-বন্ধন জর্জর
এসেছে প্রলয় পথে, অভিশপ্ত প্রেতের সমান
 আত্মার নির্বাণ তীর্থ নারীদেহে চায় তবু আত্মার সন্ধান। (নারীস্তোত্র)

২. করাইলে আত্মবলিদান।
শূন্য সুখ তবে শুধু ঘুচাইয়া প্রাণের পিরীতি
 সেকি নহে দুর্বলেরে লয়ে সেই সবলের খেলা! …
রুদ্ধ করি আঁখি জল স্নান করি অধরের হাসি।
প্রাণ হত্যা করিবারে কেবা তোমা দিল অধিকার?
তার চেয়ে ক্রুর সেকি তৈমুরের লক্ষ জীব নাশ? …
দেহ মিথ্যা, প্রাণ মিথ্যা, একমাত্র দুঃখ সত্য হবে?
… সেই প্রেম। জন্ম জন্ম তারি লাগি, ফিরিছে সবাই।
এই দেহ পাত্র-ভরি সেই দিন উঠিবে উছলি–
ঘুচিবে দুরূহ দুঃখ, মৃত্যু ভয় রবে না যে আর। (বুদ্ধ)

মোহিতলালের কবিতায় নিসর্গ বা প্রকৃতির অনাবিল শোভা সৌন্দর্য উপলব্ধির প্রয়াস চিহ্ন নেই। কারণ কবি মননশীল, তিনি প্রকৃতির রূপ শোভার অন্তরালের রহস্য উদঘাটন প্রয়াসী এবং তৎসঙ্গে মানবজীবনের সামঞ্জস্য ও যোগসূত্র আবিষ্কারে আগ্রহশীল। ফলে তাঁর শ্রাবণ রজনী, বসন্ত আগমনী, ভাদরের বেলা, পূর্ণিমা স্বপ্ন, বিভাবরী, বসন্ত বিদায় প্রভৃতি কবিতায় নাম-মাহাত্ম্য রয়েছে শুধু, নিসর্গ শোভা তার মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তাই তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হিসাবে নিসর্গের স্থান নগণ্য। পূর্বেই বলেছি তিনি বস্তুতান্ত্রিক নন, মর্মরস রসিক বা গ্রাহী। তাই প্রকৃতি-প্রেরণার অভাব তাঁর কবিমনের মাধুর্য নষ্ট করতে পারেনি এবং কবিমন বিকাশেও বাধা জন্মায়নি। দেহ ও রূপ কবির কাব্যশিল্পের উপকরণ, তাঁর কাব্যসৌধের উপাদান।

কবি ও মনীষী-প্রশস্তিমূলক কবিতাবলীতে কবির গুণগ্রাহিতা, ঐতিহ্যানুরাগ, স্বদেশ, স্বজাতি ও সংস্কৃতি প্রীতি মূর্ত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্র জয়ন্তী, মধু উদ্বোধন, বঙ্কিম চন্দ্র, বিবেকানন্দ প্রভৃতি কবিতা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

আঙ্গিক (Form) ও বক্তব্য বিষয়ের প্রাঞ্জলতায় মোহিতলালের সনেট পরম্পরায় রচিত দীর্ঘ কবিতাও তাঁর কৃতিত্বের পরিচায়ক। যথা–শরৎচন্দ্র, কবিধাত্রী ও এক আশা।

সাধারণভাবে বলতে গেলে মোহিতলাল কবিতার Form (আঙ্গিক) ও diction (ভঙ্গি) সম্বন্ধে বিশেষভাবে যত্নশীল। স্মরগরলের ভূমিকায় তিনি এ-কথা সগর্বে বলেওছেন। আমরা লক্ষ্য করেছি, তাঁর কবিতায় বিষয় ও ভাব-গাম্ভীর্যানুযায়ী শব্দ ও ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ভাবের দীনতা, ছন্দে শৈথিল্য, শব্দে ব্যঞ্জনার অভাব কোথাও তেমন দেখা যায় না। মননশীলতায় তাঁর দীনতাও বিরল। এইজন্যে ভাবের উচ্চতায়, শব্দের ব্যঞ্জনায়, ভাষার আভিজাত্যে, ছন্দের ললিত মন্থরতায় ও গাম্ভীর্ষে, মননশীলতার চমঙ্কারিত্বে তার এক-একটি কবিতা অনবদ্য শিল্পকর্মে রসমূর্তি লাভ করেছে।

আমরা কবি মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যের মূলসুর বা আবেদন কী তাই শুধু জানতে চেয়েছি। এই ব্যাপারে আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে বহু উদ্ধৃতি দিয়েছি, তা পাঠকের কাছে বিরক্তিকর; তৎসত্ত্বেও আমরা দিয়েছি–এই আশঙ্কায় পাছে আমাদের বক্তব্য অস্পষ্ট থেকে যায়। সুতরাং তার বিশিষ্ট কবিতাগুলোর ভাব ও রূপ প্রতাঁকের সৌন্দর্যের আলাদা আলোচনা সম্ভব হল না। তাঁর কবিতার ভাষা ও ছন্দ-সৌন্দর্য বিশ্লেষণও এখানে অপ্রাসঙ্গিক হত।

জানি, এই গণ-সংগ্রামের যুগে মোহিতলালের কবিতার কদর হবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন দিনও হয়তো আসবে, যখন মানববাদীর গণ-সাহিত্য কেবল ঐতিহাসিক মর্যাদায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে, আর মোহিতলালের কাব্য-সুধা মানস-রস-রসিকদের দেবে তৃপ্তি।

যদিও মোহিতলালের জীবন-দৃষ্টি কোনো শ্রেয়সের সন্ধান দেয় না, তবু তার নির্মিত এই বাসনা-জগৎও যে মানব-কাম্য তা অস্বীকার করা যাবে না। তাঁর সৃষ্ট রস-সরোবরের সার্থকতা এখানেই। তাঁর কাব্যের স্থায়ী আবেদন-তত্ত্বও এতেই নিহিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *