মোহিতচন্দ্র সেনের সহিত আমার পরিচয় অল্পদিনের।
বাল্যকালের বন্ধুত্বের সহিত অধিকবয়সের বন্ধুত্বের একটা প্রভেদ আছে। একসঙ্গে পড়া, একসঙ্গে খেলা, একসঙ্গে বাড়িয়া ওঠার গতিকে কাঁচাবয়সে পরস্পরের মধ্যে সহজেই মিশ খাইয়া যায়। অল্পবয়সে মিল সহজ, কেননা, অল্পবয়সে মানুষের স্বাভাবিক প্রভেদগুলি কড়া হইয়া ওঠে না। যত বয়স হইতে থাকে, আমাদের প্রত্যেকের সীমানা ততই নির্দিষ্ট হইতে থাকে– ঈশ্বর প্রত্যেক মানুষকে যে একটি পার্থক্যের অধিকার দিয়াছেন, তাহা উত্তরোত্তর পাকা হইতে থাকে। ছেলেবেলায় যে-সকল প্রভেদ অনায়াসে উল্লঙ্ঘন করিতে পারা যায়, বড়ো বয়সে তাহা পারা যায় না।
কিন্তু এই পার্থক্য জিনিসটা যে কেবল পরস্পরকে প্রতিরোধ করিবার জন্য, তাহা নহে। ইহা ধাতুপাত্রের মতো– ইহার সীমাবদ্ধতাদ্বারাই আমরা যাহা পাই, তাহাকে গ্রহণ করি– তাহাকে আপনার করি; ইহার কাঠিন্যদ্বারা আমরা যাহা পাই, তাহাকে ধারণ করি– তাহাকে রক্ষা করি। যখন আমরা ছোটো থাকি, তখন নিখিল আমাদিগকে ধারণ করে, এইজন্য সকলের সঙ্গেই আমাদের প্রায় সমান সম্বন্ধ। তখন আমরা কিছুই ত্যাগ করি না– যাহাই কাছে আসে, তাহারই সঙ্গে আমাদের সংস্রব ঘটে।
বয়স হইলে আমরা বুঝি যে, ত্যাগ করিতে না জানিলে গ্রহণ করা যায় না|। যেখানে সমস্তই আমার কাছে আছে, সেখানে বস্তুত কিছুই আমার কাছে নাই। সমস্তের মধ্য হইতে আমরা যাহা বাছিয়া লই, তাহাই যথার্থ আমাদের। এই কারণে যে বয়সে আমাদের পার্থক্য দৃঢ় হয়, সেই বয়সেই আমাদের বন্ধুত্ব যথার্থ হয়। তখন অবারিত কেহ আমাদের নিকটে আসিয়া পড়িতে পারে না– আমরা যাহাকে বাছিয়া লই, আমরা যাহাকে আসিতে দিই, সে-ই আসে। ইহাতে অভ্যাসের কোনো হাত নাই, ইহা স্বয়ং আমাদের অন্তর-প্রকৃতির কর্ম।
এই অন্তরপ্রকৃতির উপরে যে আমাদের কোনো জোর খাটে, তাহাও বলিতে পারি না। সে যে কী বুঝিয়া কী নিয়মে আপনার দ্বার উদ্ঘাটন করে, তাহা সে-ই জানে। আমরা হিসাব করিয়া, সুবিধা বিচার করিয়া তাহাকে হুকুম করিলেই যে সে হুকুম মানে, তাহা নহে। সে কী বুঝিয়া আপনার নিমন্ত্রণপত্র বিলি করে, তাহা আমরা ভালো করিয়া বুঝিতেই পারি না।
এইজন্য বেশি বয়সের বন্ধুত্বের মধ্যে একটি অভাবনীয় রহস্য দেখিতে পাই। যে বয়সে আমাদের পুরাতন অনেক জিনিস ঝরিয়া যাইতে থাকে এবং নূতন কোনো জিনিসকে আমরা নির্বিচারে গ্রহণ করিতে পারি না, সেই বয়সে কেমন করিয়া হঠাৎ একদা একরাত্রির অতিথি দেখিতে দেখিতে চিরদিনের আত্মীয় হইয়া উঠে, তাহা বুঝিয়া উঠা যায় না।
মনে হয়, আমাদের অন্তরলক্ষ্মী– যিনি আমাদের জীবনযজ্ঞ নির্বাহ করিবার ভার লইয়াছেন, তিনিই বুঝিতে পারেন, এই যজ্ঞে কাহাকে তাঁহার কী প্রয়োজন, কে না আসিলে তাঁহার উৎসব সম্পূর্ণ হইবে না। তিনি কাহার ললাটে কী লক্ষণ দেখিতে পান–তাহাকে আপনার বলিয়া চিনিতে পারেন, তাহার রহস্য আমাদের কাছে ভেদ করেন নাই।
যেদিন মোহিতচন্দ্র প্রথম আমার কাছে আসিয়াছিলেন, সেদিন শিক্ষাসম্বন্ধে তাঁহার সঙ্গে আমার আলোচনা হইয়াছিল। আমি শহর হইতে দূরে বোলপুরের নিভৃত প্রান্তরে এক বিদ্যালয়স্থাপনের ব্যবস্থা করিয়াছিলাম। এই বিদ্যালয়সম্বন্ধে আমার মনে যে একটি আদর্শ ছিল, তাহাই তাঁহার সম্মুখে ধরিবার চেষ্টা করিলাম।
তাহার পরে তিনি অবকাশ বা উৎসব উপলক্ষে মাঝে মাঝে বোলপুরে আসিতে লাগিলেন। ভারতবর্ষ বহুকাল ধরিয়া তাহার তীব্র-আলোক-দীপ্ত এই আকাশের নীচে দূরদিগন্তব্যাপী প্রান্তরের মধ্যে একাকী বসিয়া কী ধ্যান করিয়াছে, কী কথা বলিয়াছে, কী ব্যবস্থা করিয়াছে, কী পরিণামের জন্য সে অপেক্ষা করিতেছে, বিধাতা তাহার সম্মুখে কী সমস্যা আনিয়া উপস্থিত করিয়াছেন, এই কথা লইয়া কতদিন গোধূলির ধূসর আলোকে বোলপুরের শস্যহীন জনশূন্য প্রান্তরের প্রান্তবর্তী রক্তবর্ণ সুদীর্ঘ পথের উপর দিয়া আমরা দুইজনে পদচারণ করিয়াছি। আমি এই-সকল নানা কথা ভাবের দিক দিয়াই ভাবিয়াছি; আমি পণ্ডিত নহি; বিচিত্র মানবসংসারের বৃত্তান্ত সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ। কিন্তু রাজপথ যেমন সকল যাত্রীরই যাতায়াত অনায়াসে সহ্য করে, সেইরূপ মোহিতচন্দ্রের যুক্তিশাস্ত্রে সুপরিণত সর্বসহিষ্ণু পাণ্ডিত্য আমার নিঃসহায় ভাবগুলির গতিবিধিকে অকালে তর্কের দ্বারা রোধ করিত না– তাহারা কোন্ পর্যন্ত গিয়া পৌঁছে, তাহা অবধানপূর্বক লক্ষ্য করিতে চেষ্টা করিত। যুক্তি-নামক সংহত-আলোকের লণ্ঠন এবং কল্পনা-নামক জ্যোতিষ্কের ব্যাপকদীপ্তি, দু-ই তিনি ব্যবহারে লাগাইতেন; সেইজন্য অন্যে যাহা বলিত, নিজের মধ্য হইতে তাহা পূরণ করিয়া লইবার শক্তি তাঁহার ছিল; সেইজন্য পাণ্ডিত্যের কঠিন বেষ্টনে তাঁহার মন সংকীর্ণ ছিল না, কল্পনাযোগে সর্বত্র তাঁহার প্রবেশাধিকার তিনি রক্ষা করিয়াছিলেন।
মনের আদর্শের সঙ্গে বাস্তব আয়োজনের প্রভেদ অনেক। তীক্ষ্নদৃষ্টির সঙ্গে উদার কল্পনাশক্তি যাঁহাদের আছে, তাঁহারা প্রথম উদ্যোগের অনিবার্য ছোটোখাটো ত্রুটিকে সংকীর্ণ অধৈর্যদ্বারা বড়ো করিয়া তুলিয়া সমগ্রকে বিকৃত করিয়া দেখেন না। আমার নূতনস্থাপিত বিদ্যালয়ের সমস্ত দুর্বলতা-বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করিয়া মোহিতচন্দ্র ইহার অনতিগোচর সম্পূর্ণতাকে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। তখন আমার পক্ষে এমন সহায়তা আর কিছুই হইতে পারিত না। যাহা আমার প্রয়াসের মধ্যে আছে, তাহা আর-একজনের উপলব্ধির নিকট সত্য হইয়া উঠিয়াছে, উদ্যোগকর্তার পক্ষে এমন বল– এমন আনন্দ আর কিছুই হইতে পারে না। বিশেষত তখন কেবল আমার দুই-একজন-মাত্র সহায়কারী সুহৃৎ ছিলেন; তখন অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা এবং বিঘ্নে আমার এই কর্মের ভার আমার পক্ষে অত্যন্ত দুর্বহ হইয়া উঠিয়াছিল।
একদিন কলিকাতা হইতে চিঠি পাইলাম, আমার কাছে তাঁহার একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে, তিনি বোলপুরে আসিতে চান। সন্ধ্যার গাড়িতে আসিলেন। আহারে বসিবার পূর্বে আমাকে কোণে ডাকিয়া লইয়া কাজের কথাটা শেষ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। নিভৃতে আসিয়া কুণ্ঠিতভাবে কহিলেন– “আমি মনে করিয়াছিলাম, এবারে পরীক্ষকের পারিশ্রমিক যাহা পাইব, তাহা নিজে রাখিব না। এই বিদ্যালয়ে আমি নিজে যখন খাটিবার সুযোগ পাইতেছি না, তখন আমার সাধ্যমতো কিছু দান করিয়া আমি তৃপ্তিলাভ করিতে ইচ্ছা করি।’ এই বলিয়া সলজ্জভাবে আমার হাতে একখানি নোট গুঁজিয়া দিলেন। নোট খুলিয়া দেখিলাম, হাজার টাকা।
এই হাজার টাকার মতো দুর্লভ দুর্মূল্য হাজার টাকা ইহার পূর্বে এবং পরে আমার হাতে আর পড়ে নাই। টাকায় যাহা পাওয়া যায় না, এই হাজার টাকায় তাহা পাইলাম। আমার সমস্ত বিদ্যালয় একটা নূতন শক্তির আনন্দে সজীব হইয়া উঠিল। বিশ্বের মঙ্গলশক্তি যে কীরূপ অভাবনীয়রূপে কাজ করে, তাহা এমনিই আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হইল যে, আমাদের মাথার উপর হইতে বিঘ্নবাধার ভার লঘু হইয়া গেল। ঠিক তাহার পরেই পারিবারিক সংকটে আমাকে দীর্ঘকাল প্রবাসে যাপন করিতে বাধ্য হইতে হইয়াছিল এবং যে আত্মীয়ের উপর নির্ভর করিবার প্রয়োজন ছিল, সে এমনি অকারণে বিমুখ হইল যে, সেই সময়ের আঘাত আমার পক্ষে একেবারে অসহ্য হইতে পারিত। এমন সময় নোটের আকারে মোহিতচন্দ্র যখন অকস্মাৎ কল্যাণবর্ষণ করিলেন, তখন স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, আমিই যে কেবল আমার সংকল্পটুকুকে লইয়া জাগিবার চেষ্টা করিতেছি, তাহা নহে– মঙ্গল জাগিয়া আছে। আমার দুর্বলতা, আমার আশঙ্কা, সমস্ত চলিয়া গেল।
ইহার কিছুকাল পরে মোহিতচন্দ্র বোলপুর-বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষপদ গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু কঠিনপীড়াগ্রস্ত হইয়া ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ইঁহাকে পুনরায় কলিকাতায় আশ্রয়গ্রহণ করিতে হইল।
যাহারা মানবজীবনের ভিতরের দিকে তাকায় না, যাহারা বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে শুভদৃষ্টিবিনিময় না করিয়া ব্যস্তভাবে ব্যবসায় চালাইয়া যায় বা অলসভাবে দিনক্ষয় করিতে থাকে, পৃথিবীর সঙ্গে তাহাদের সম্বন্ধসূত্র কতই ক্ষীণ। তাহারা চলিয়া গেলে কতটুকু স্থানেই বা শূন্যতা ঘটে! কিন্তু মোহিতচন্দ্র বালকের মতো নবীনদৃষ্টিতে, তাপসের মতো গভীর ধ্যানযোগে এবং কবির মতো সরস সহৃদয়তার সঙ্গে বিশ্বকে গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাই আষাঢ় যখন এই নবতৃণশ্যামল মাঠের উপরে ঘনীভূত হইয়া উঠে এবং মেঘমুক্ত প্রাতঃকাল যখন শালতরুশ্রেণীর ছায়াবিচিত্র বীথিকার মধ্যে আবির্ভূত হয়, তখন মন বলিতে থাকে, পৃথিবী হইতে একজন গেছে, যে তোমাদের বর্ষে বর্ষে অভ্যর্থনা করিয়াছে, যে তোমাদের ভাষা জানিত, তোমাদের বার্তা বুঝিত; তোমাদের লীলাক্ষেত্রে তাহার শূন্য আসনের দিকে চাহিয়া তোমরা তাহাকে খুঁজিয়া পাইবে না– সে যে তোমাদের দিকে আজ তাহার প্রীতিকোমল ভক্তিরসার্দ্র অন্তঃকরণকে অগ্রসর করিয়া ধরে নাই, এই বিষাদ যেন সমস্ত আলোকের বিষাদ, সমস্ত আকাশের বিষাদ। সকলপ্রকার সৌন্দর্য, ঔদার্য ও মহত্ত্ব যে হৃদয়কে বারংবার স্পন্দিত-উদ্বোধিত করিয়াছে, সাম্প্রদায়িকতা যাহাকে সংকীর্ণ করে নাই এবং সাময়িক উত্তেজনার মধ্যে চিরন্তনের দিকে যে লক্ষ্য স্থির রাখিয়াছে, আমাদের সকল সৎসংকল্পে, সকল মঙ্গল-উৎসবে, সকল শুভপরামর্শে আজ হইতে তাহার অভাব দৈন্যস্বরপে আমাদিগকে আঘাত করিবে। উৎসাহের শক্তি যাহাদের পক্ষে স্বাভাবিক, আনুকূল্য যাহাদের নিকট হইতে সহজে প্রবাহিত হয়, যাহারা উদার নিষ্ঠার দ্বারা ভূমার প্রতি আমাদের চেষ্টাকে অগ্রসর করিয়া দেয় এবং সংসারপথের ক্ষুদ্রতা উত্তীর্ণ করিয়া দিবার যাহারা সহায় পারে– এমন বন্ধু কয়জনই বা আছে!
দুইবৎসর হইল, ১২ ডিসেম্বর মোহিতচন্দ্র তাঁহার জন্মদিনের পরদিনে আমাকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহারই এক অংশ উদ্ধৃত করিয়া লেখা সমাপ্তি করি।–
“আজকাল সকালে-সন্ধ্যায় রাস্তার উপর আর বাড়ির গায়ে যে আলো পড়ে, সেটা খুব চমৎকার দেখায়। আমি কাল আপনাদের বাড়ির পথে চলতে চলতে স্পষ্ট অনুভব করছিলাম যে, বিশ্বকে যদি জ্ঞানের সৃষ্টি বলা যায়, তবে সৌন্দর্যকে প্রেমের সৃষ্টি বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে যে ভাবগুলো মনের ভিতর প্রবেশ করে, আমাদের প্রজ্ঞাজাত সংস্কারগুলি সেগুলিকে কুড়িয়ে-নিয়ে এই বিচিত্র সুসংহত বিশ্বরূপে বেঁধে দেয়। এ যদি সত্য হয় তবে যে-সৌন্দর্য আমাদের কাছে উদ্ভাসিত, সেটা কত-না ক্ষুদ্র-বৃহৎ নিঃস্বার্থ-নির্মল সুখের সমবেত সৃষ্টি! associationকথাটার বাংলা মনে আসছে না, কিন্তু একমাত্র প্রেমই যে এই association-এর মূল, একমাত্র প্রেমই যে আমাদের সুখের মুহূর্তগুলোকে যথার্থভাবে বাঁধতে পারে, আর তা থেকে অমর সৌন্দর্য উৎপাদন করে, তাতে সন্দেহ হয় না। আর যদি সৌন্দর্য প্রেমেরই সৃষ্টি হল, তবে আনন্দ তাই– প্রেমিক না হলে কেই বা যথার্থ আনন্দিত হয়!
এই সৌন্দর্য যে আমারই প্রেমের সৃষ্টি, আমার শুষ্কতা যে একে নষ্ট করে– এই চিন্তার ভিতর আমার জীবনের গৌরব, আর দায়িত্বের গুরুত্ব একসঙ্গে অনুভব করি। যিনি ভালোবাসার অধিকার দিয়ে আমার কাছে বিশ্বের সৌন্দর্য, আর বন্ধুর প্রীতি এনে দিয়েছেন, তাঁকে ধন্যবাদ দিই; আর শুধু আমারই শুষ্কতা-অপরাধের দরুন আমি যে আনন্দ হ’তে বঞ্চিত হই, এ কথা নতমস্তকে স্বীকার করি।’
বঙ্গদর্শন, শ্রাবণ, ১৩১৩