মোহন দারোগার গবেষণাগার – বাসুদেব মালাকর
চোর ধরা যত কঠিন, চোর ধরে আটকে রাখা তার থেকেও কঠিন কাজ—পুলিশের চাকরিতে ঢোকার পর এই কথাটা বুঝতে মোহন দারোগার তিনবছর সময় লেগেছিল। পুলিশে চাকরি পাওয়ার আগে মোহন একটা ইস্কুলে মাস্টারি করতেন। ইস্কুলটা খারাপ ছিল না, কিন্তু কী যে এক আদর্শবোধ তাঁকে ক্রমাগত খোঁচাতে লাগল যে শেষপর্যন্ত মাস্টারি ছেড়ে পুলিশে ঢুকে গেলেন মোহন।
মোহনের ঠাকুরদা ছিলেন অহিংস আন্দোলনের নেতা গোছের একজন। মোহন তাঁকে দেখেননি, কিন্তু তাঁর বাণী নানা পত্রপত্রিকায় পড়েছেন। তিনি বলতেন, কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না, এই সমাজ তাকে অপরাধী তৈরি করে … হিংসা ত্যাগ করে ভালোবেসে অপরাধীর হৃদয় পরিবর্তন করতে পারলে সে দ্বিগুণশক্তি নিয়ে ভালোত্বে ফিরে আসবে ইত্যাদি। ঠাকুরদার বাণীতে প্রভাবিত হয়ে মোহনও সেরকম ভাবতেন। আর পুলিশের চাকরি ছাড়া অপরাধীদের সঙ্গে ওঠবোস করার স্কোপ আর কোথায় পাওয়া যাবে? অতএব—।
মাস্টারি জীবনে মোহন কালু নামে একটি ছাত্রের সংস্পর্শে এসেছিলেন। অপরাধী হওয়ার মতো সমস্ত মালমশলা তার মধ্যে মজুত ছিল, একটু সারজল পেলেই ডালপালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠত। সেই যে কথায় বলে না, কচুগাছ কাটতে কাটতে গলাকাটা হয়—তেমনি।
কালুর একটিমাত্র নেশা ছিল, লোকের গাছে ঢিল ছুড়ে আম জাম আমড়া কুল ঝুনো নারকেল পাড়া। অব্যর্থ টিপ ছিল কালুর হাতে। কোনো গৃহস্থ তাড়া করলে বা বাধা দিলে সন্ধেবেলা সেই বাড়ির টিন বা টালির চালে ইট মেরে শোধ নিত কালু। তাড়া করলে বিদ্যুৎগতিতে পালিয়ে যেত। একবার হেডস্যারের পিসির চালে ইট মেরে কালু স্যারের হাতে গোবেড়েন খেল। সেই করুণ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে মোহনের ভিতর তাঁর ঠাকুরদা নির্দেশিত আদর্শ তথা কর্তব্যবোধ চাগাড় দিয়ে উঠতে তিনি সন্ধেবেলা কালুকে ডেকে নিয়ে প্রথমে পেনকিলার খাইয়ে একপ্লেট সন্দেশ খেতে দিলেন! কালু প্রথমে খেতে চায়নি—কী জানি বাবা, অতি যত্ন কীসের লক্ষণ বলে একটা কথা আছে না? মোহন কালুর মাথায় হাতটাত বুলিয়ে দিতে কালু সেই সন্দেশ খেল শেষপর্যন্ত।
এরপর মোহন কালুকে নিয়ে পড়লেন। যার হাতে এমন অব্যর্থ টিপ তার তো অর্জুন হওয়ার কথা! কালুকে মাঠের ধারে নিয়ে গিয়ে মোহনও কালুর সঙ্গে ইট ছোড়া শুরু করলেন। তারপর দুটো তালগাছের গায়ে দড়ি টাঙিয়ে সেই দড়িতে প্লাস্টিকের বোতল ঝুলিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ইট মেরে প্র্যাকটিশ শুরু করল! কালুর কাছে ওসব বোতল ফাটানো জলভাত—তেমন মজা পেল না কালু। মোহনও ছাড়বার পাত্র নন, সন্দেশের প্লেট ওদিকে উজাড় হয়ে যাচ্ছে, ইট ছেড়ে এবার বর্শা নিক্ষেপ অনুশীলন শুরু হল। কালুর ওটাও ভালো লাগল না। গাছে ইট মেরে ফলপাকুড় পাড়ার মধ্যে যে থ্রিল, বর্শা ছোড়ার মধ্যে সে থ্রিল কোথায়? কিন্তু অনুশীলন শেষে গুণময় ময়রার দোকানের একপ্লেট মাখা সন্দেশের আকর্ষণও কম নয়।
একটা কলাগাছের গুড়ি মাটিতে পুঁতে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে বাঁশের চটার বর্শা দিয়ে গুড়িটাকে বিদ্ধ করতে হবে। ক্রমাগত পিছিয়ে গিয়ে গুড়ি থেকে দূরত্ব বাড়াতে হবে। তা-ও হল। কালু সসম্মানে গুড়িভেদ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। এরপর একদিন দেখা গেল, বিদ্যাসাগর স্টেডিয়ামে আন্তঃজেলা স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অনূর্ধ্ব ষোলো-র গ্রুপে কালু জ্যাভেলিং থ্রোয়িং-এ নামছে! ডানহাতের কবজিতে, কপালে চওড়া নীলরঙের ব্যান্ড, স্পোর্টস শ্যূ। স্যান্ডোগেঞ্জি পরে কালু যখন একটা ছোট্ট দৌড় দিয়ে জ্যাভেলিনটা ছুড়ল, স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হাততালির খই ফুটতে লাগল!
নীল আকাশ ফুঁড়ে জ্যাভেলিন উঁচুতে উঠছে উঠছে … এবার মুখটা নামল … জ্যাভেলিন সোজা হল … সাঁ সাঁ এগোচ্ছে … কালু দু-হাতে চোখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ল—জ্যাভেলিন গ্যালারির মধ্যে গিয়ে পড়লে খুনের দায়ে পড়তে হবে আজ! পাঁচ সেকেন্ড পরে ঠং করে শব্দ হতে চোখ খুলল কালু। গ্যালারির একদম নীচের ধাপে আঘাত করে কালুর জ্যাভেলিন শুয়ে পড়েছে। অন্যদের জ্যাভেলিনগুলো মাঠের মধ্যে মাটিতেই নব্বই কিংবা আশি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পুঁতে যাচ্ছিল!
মাঠের মধ্যে বন্যার জলের মতো ইস্কুলের ছেলেরা ঢুকে পড়ল। সবার আগে হেডস্যার! ধুতি তুলতে তুলতে কখন জাঙিয়ার মতো করে ফেলেছেন, খেয়াল নেই! কালুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এইটুকু কবজিতে এত শক্তি! তুই একলব্য, আমার ইস্কুলের গর্ব! আজ থেকে পিসির পেয়ারাগাছটা তোকে দিয়ে দিলাম!’
2
কালু তো আর গন্ডায় গন্ডায় মেলে না, তা ছাড়া কালু আই এস ও সার্টিফিকেটওলা ক্রিমিনালও নয়। ওর কথা বাদ দিলে, দীর্ঘ চাকরিজীবনে মোহন বুঝে গেছেন, দাদুর কথাগুলোর আবেগ ছিল, যুক্তি ছিল না। চোরডাকাত খুনেদের হৃদয় পরিবর্তন সোজা ব্যাপার নয়। থানায় ধরে এনে ধোলাই দিলে সুড়সুড় করে দোষ স্বীকার করবে, কোর্টে হাজির করলে বলবে, ‘হুজুর, আমি শালার বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছিলাম, দারোগাবাবু তখন গিয়ে ধরলেন!’ ভাড়া করা শালা এসে মাথা নীচু করে বলবে, ‘হ্যাঁ হুজুর, আমার বাড়িতে ছোটোমতন একটু বউভাত ছিল বটে ওদিন।’ এরপর মোহনের বাড়ি যাওয়ার পালা। ডাকাতটা তখন দাঁত বের করে হাসতে হাসতে মোহনের নাকের সামনে খইনি চাপড়ে চলে গেল।
তাই বলে একেবারে হাল ছেড়েও দেননি মোহন। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। কে যেন ভিতর থেকে বলে উঠত, ‘বেশ, তুমি তাহলে তোমার কাজ করে যাও, বাপ!’ এই তো বছর সাতেক আগের কথা। মোহন তখন আরামপুরের দারোগা। ওখানে জটাই বলে একজন ছিল চ্যাম্পিয়ন চোর। দিনের বেলা একপাল ছাগল চরিয়ে বেড়াত আর আড়চোখে গেরস্তর বাড়ির উপর নজর রেখে স্টাডি করত। তার দু-তিন দিন পরে রাতের বেলা সিঁদ কেটে গেরস্তকে একেবারে গামছাসম্বল করে দিয়ে আসত! সেই জটাইকে একদিন তলব দিলেন মোহন। জটাইকে যদি রত্নাকর থেকে বাল্মীকি বানানো যায় তো দারোগাগিরির ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। হাতে একটা চালকুমড়ো ঝুলিয়ে যথাসময়ে গামছায় মুখ ঢেকে জটাই এসে প্রণাম করে মোহনের জুতোর ধুলো মাথায় ঠেকাল।
জটাইকে আপাদমস্তক দেখে কী যেন ভাবলেন মোহন। কল্পনায় দেখে নিলেন। লম্বা চুলদাড়িতে জটাইকে বাল্মীকি হিসেবে কেমন মানাতে পারে। খুব খারাপ লাগবে না বলেই মনে হল মোহনের। বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা জটাই, এ লাইনে আসবার আগে তুমি কী করতে?’
‘কেন স্যার? আগেপিছে কিছু নেই—আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এলাইনে।’
‘জ্ঞান হওয়ার পর থেকে! কী রকম? কী করতে তখন?’
‘মা হয়ত ঘরের পেছনের নারকেলগাছের গায়ে ঘুঁটে দিচ্ছে—আমি সেই ফাঁকে রান্নাঘরে ঢুকে গুড়ের ভাঁড় ফাঁক করে দিতাম! ভাঁড়টাকে কাত করে রেখে দিতাম, মা ভাবত বিড়ালে খেয়েছে।
‘বিড়ালে গুড় খায়?’
‘খায় স্যার। দু-একটা ছোঁচা লোভা বিড়াল থাকে।’
‘আর কী করতে?’
‘মাঠের ছাগল ধরে নিয়ে বকচরার হাটে বেচে দিতাম। সান্ডেলদের পুকুর থেকে ছিপ ফেলে মাছ ধরে আনতাম’।
মাছের কথা শুনে মোহনের মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। মোহন বললেন, ‘আচ্ছা জটাই, তুমি তো ভালো মেছুড়ে শুনলাম। তা তোমাকে যদি একগাছা ভালো খেপলাজাল কিনে দিই—খালবিল থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করলে আর রাতবিরেতে কুকুর চৌকিদার গেরস্তর তাড়া খেয়ে মরতে হবে না। মন্দ হবে না, কী বলো?’ জটাই বলল, ‘না বাবু, ও সব হল ছোটো কাজ। লোকে নিন্দে করবে, বলবে, জটে কিনা মাছ বিক্রি করছে! আমার শ্বশুরমশাই-এর বয়স এখন আশিবছর—আমাদের এই লাইনের হাই স্কুলের হেডমাস্টার—ঘুমন্ত মানুষের গা থেকে চামড়া খুলে নিয়ে আসতে পারতেন! তিনি শুনলে আমাকে ত্যাজ্যপুত্তুর করবেন! বলবেন, তুমি হলে আর্টিস্ট জটাধর—সেই তুমি শেষপর্যন্ত মেছো হলে! ও আমার দ্বারা হবে না বাবু।’
মোহন ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন, নাহ, এ ব্যাটা বাল্মীকি হতে চায় না!
গোকুলপুর থানাতেও এরকম চেষ্টা করেছিলেন মোহন। জাপানি বলে এক পাকা ওস্তাদকে পাকড়াও করে তার সিঁদকাঠি জমা রেখে তাকে একটা রিকশাভ্যান জোগাড় করে দিয়েছিলেন। তা সাতদিন পরে জাপানি সেই রিকশা নিয়ে এসে বলল, ‘বড়োবাবু, এই নিন আপনার রিকশা!’ মোহন আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কেন, কী হল?’ জাপানি বলল, ‘কী হল, শোনেন তবে। আজ বাইশ বচ্ছর রেতে ঘুমোনোর ওব্যেস নেই আমার। সারাদিন ওই রিকশা টেনে এখন রাতে ঘুম পাচ্ছে! রাতে ঘুমিয়ে আমার শরীল খারাপ হতে লেগেছে, মাথা ভার, মুখে অরুচ। আমাদের নিয়ম হল দিনে ঘুম, রাতে কাজ। কত কষ্ট করে বিদ্যেটা শিখলাম, এই করে মেয়ের বে দিলাম, সব ব্রেথা যাবে? আপনার ভ্যান থাকল। আমার লক্ষ্মীকাঠি ফেরৎ দ্যান।’
মোহন মেজাজ হারিয়ে পুলিশকণ্ঠে গর্জে উঠলেন, ‘ভালো কথায় সোজা পথে আসবার পাত্তর নোস তোরা! যদি একবার হাতেনাতে ধরতে পারি, বাপের নাম জার্মানি করে ছেড়ে দেব, বুঝলি জাপানি?’ জাপানি মুচকি হেসে বলল, পোমান পাবেন কোথা? পোমান? আমারও তিনকড়ি উকিল ধরা আছে—সব পোমান ফুঁকে দেবে! আপনি হাকিমের ঝাড় খাবেন তখন। বড়োবাবু, আপনার বোধহয় বায়ুকুপিত হয়েছে। তেলাকুচোপাতার রস মাথার মদ্যিখানে লাগান।’ বলে জাপানি চলে গেল।
3
ঠাকুরদার ওই নীতিকথায় বিশ্বাস করে, হৃদয় পরিবর্তনের বাতিকে মোহনের প্রমোশন-টনও হল না বিশেষ। লোকে পুলিশের চাকরি করে সোনার খনির হদিশ পেয়ে যায়, রাজভবনের মতো বাড়ি করে। সে সব হল না মোহনের। ওই মেজোবাবু ছোটোবাবু সারামাসে যা আদায়পত্তর করেন, তার একটা ভাগ পান মোহন। সে-ও দয়ার দান। না-দিলেও বলার কিছু নেই। এতবছরে এক ব্যাটারও হৃদয় পরিবর্তন ঘটানো গেল না! মাঝখানে পড়ে আম-ছালা-দুটোই গেল!
এই ভক্তনগর থানাটা মোহনের বেশ পছন্দ হয়েছে। গাছপালা ঝোপঝাড় পুকুর মাঠ নিয়ে পল্লিপ্রকৃতি ব্যাপারটা এখনও বজায় আছে। থানার বাড়িটাও বেশ সুন্দর। একটা ঝাকড়া তেঁতুলগাছের নীচে গোটাচারেক ছোটো ছোটো একতলা বাড়ি। একটায় বড়োবাবুর অফিসঘর, তার পাশেই লোহার খাঁচামতো লকআপ। ডানদিকের ঘরটা মালখানা, বাঁ-দিকের ঘরে কনস্টেবলদের বিছানা, পাশে রান্নাঘর, পিছনের দুটো ঘরে বড়োবাবু মেজোবাবুর থাকার জায়গা।
এলাকাটা ঘুরে দেখবেন বলে তেঁতুলতলার জিপগাড়িটার কাছে গিয়ে দেখলেন, ছোবড়ার গদির উপর একটা কুকুর শুয়ে আছে, চাকার পাশে ঘাস গজিয়ে গেছে! তার মানে ওটা অকেজো। মেজোবাবুকে বলতে তিনি বললেন, একবছর আগে সদরে রিপোর্ট করা হয়েছে, কোনো উত্তর আসেনি!
‘ইনসিডেন্ট ঘটলে স্পটে পৌঁছোন কী করে?’
‘কেন স্যার, ভ্যানরিকশায় পা ঝুলিয়ে বসে হাওয়া খেতে খেতে চলে যাই! তা ছাড়া বেশি যেতেটেতেও হয় না তেমন।’
‘এখানকার লোকগুলো স্যার খুব সভ্যভদ্র। চুরি-ডাকাতি নেই বললেই চলে—কে কার জিনিস চুরি করবে? সবই তো নেংটি সম্বল। দু-চার পিস যা ছিল, কলকাতার দিকে চলে গেছে। ওখানে ক্লায়েন্ট বেশি। কেউ কাউকে চেনে না, বিপদে ঝাঁপায় না। সেফ এরিয়া। তবে স্যার লাঠালাঠি খুনোখুনি আছে। একজনের মুরগি অন্যজনের বাড়ি গেলেও খুনোখুনি হয়! তবে বেশি না, বছরে একটা দুটো।’
তা মোহন সত্যিসত্যিই দেখলেন, সারাদিন একটা ডায়েরিও করতে আসে না কেউ! কনস্টেবল চারজন লুঙি কাছা দিয়ে লোকাল ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল বা ডাংগুলি খেলে জনসংযোগ বজায় রাখে। একজন গেটে পাহারায় থাকে আর মোবাইলে এফ. এম. শোনে। এফ. এম শুনে শুনে এখন কানেও কম শোনে। ‘প্রসূন, শুনে যাও’ বলে ডাকলে উত্তর দেয়, ‘রসুন? বুনে যাব? রসুন বুনে কী হবে, স্যার?’
শূন্য লকআপের ভেতর একটা বেড়াল দুটো বাচ্চা নিয়ে শুতে আসে রাতে। একদিন সেখানে একটা ভাম ঢুকে পড়তে সে কী লড়াই ভাম-বিড়ালে! মোহন টর্চের আলো ফেলতে ভামটা পালিয়ে গেল। ঠিক গোকুলপুর থানার কেস—লকআপের ভেতর এক পকেটমার আরেক পকেটমারের পকেট থেকে বিড়ি দেশলাই বের করে নিয়েছিল! তাই নিয়ে মাঝরাতে মহাদাঙ্গা! দুটোকেই ঠ্যাঙানি দিতে তবে থেমেছিল।
তখন অনেক রাত। হেরিকেনটা ডিম করে শুয়ে পড়েছেন মোহন, ঘুমটা সবে ধরে এসেছে, হঠাৎ বারান্দায় যেন ধুপ করে একটা শব্দ হল! মোহন চোখমেলে সতর্ক হয়ে উঠে বসলেন। একটা ক্ষীণ পায়ের শব্দ তাঁর ঘরের দরজার সামনে এসে থেমে গেল। ফিসফিস করে কে যেন দুবার ডাকল, ‘বড়োবাবু! বড়োবাবু!’ মোহনও ফিসফিস করে সাড়া দিলেন, ‘হ্যাঁ, জেগে আছি, তুমি কে?’
‘দরজাটা খুলুন, বলছি।’
‘দরজা ভেজানো আছে, ঠ্যালা দাও।’
একটা আবছা ছায়ামূর্তি, সিড়িঙ্গে চেহারা, খাটো ধুতি পরা, কাঁধে একটা গামছা—ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। মোহন চাকরি জীবনে এরকম জিনিস ঢের দেখেছেন। হয় ইনফর্মার, নয় অন্য থানার ওয়ান্টেড, না-হলে মাসচুক্তির প্রস্তাব নিয়ে আসা ভগ্নদূত। সেই ছায়ামূর্তি হাত জোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে, নাম শুনে থাকবেন, আমার নাম খাটাই। দু-পুরুষের কারবার—ছেলেকে ধরলে তিনপুরুষ।’
‘কীসের কারবার তোমার, খাটাইদা?’
‘আজ্ঞে, একসপোর্ট ইমপোর্টের কারবার। লোকের বাড়ির মাল নিজের বাড়িতে ইমপোর্ট করি, সেই মাল আবার মহাজনের ঘরে একসপোর্ট করি।’
‘বুঝলাম! চুপি চুপি না কি রামদা ভোজালি নিয়ে?’
‘আজ্ঞে, চুপিচুপি। গেরস্থ ঘুমিয়ে পড়লে।’
‘তা এতরাতে আমার কাছে কী মনে করে? এখানে ইমপোর্ট করবার মতো কিছু আছে না কি?’
‘কী যে বলেন স্যার! আমি খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি!’
‘কী বিপদ?’
‘আজ্ঞে, আমার ছেলে পেল্লাদ এবার মাধ্যমিক পাস করেছে। ছোটোবেলা থেকেই রাতে ওকে সঙ্গে নিয়ে বের হতাম, ছোট্ট শরীর তো, সিঁদ দিয়ে ঢুকে দরজা খুলে দিত। তা লজ্জার কথা কী বলব স্যার, ও ব্যাটার টাকাপয়সা গয়নাগাটির থেকে বইপত্তর হাতানোর দিকেই বেশি ঝোঁক ছিল। আমার বাড়ি গিয়ে দেখবেন, বই-এর পাহাড়! এখন পাস করে বলছে, আমার লাইনে আসবে না, আরও পড়াশুনো করবে!’
‘এ তো ভালো কথা। খাটাই-এর ছেলে পড়াই করবে—এর চাইতে ভালো জিনিস হয় না!’
‘না স্যার। এটা খুব খারাপ জিনিস। লেখাপড়া শেখার বিস্তার হ্যাপা। না-পারবে আমার পেশা ধরতে, না পাবে চাকরি। মাঝখান দিয়ে গুচ্ছের টাকা নষ্ট, না-ঘরকা না-ঘাটকা।’
‘তা আমাকে কী করতে হবে খাটাইদা?’
‘আপনি ও-ব্যাটাকে ধরে এনে একটা হালকা কেস দিয়ে চালান করে দিন। কত কেস তো আপনাদের খাতায় ফাঁকা পড়ে থাকে। একবার দাগি হয়ে গেলে ওর লেখাপড়ার বারোটা বেজে যাবে, কোনো ইস্কুল আর ভর্তি নেবে না। এটুকু উবগার আপনাকে করতেই হবে, স্যার।
শুনেছি, আপনি ঘরের খেয়ে বনের শিয়াল তাড়াতে ভালোবাসেন।’
‘ঠিক আছে, কাল সকালে মার্কশিট নিয়ে পেল্লাদকে দেখা করতে বলো। দেখব, কী কী চার্জ খালি আছে। তা খাটাইদা, একথা বলার জন্য দিনের বেলা না-এসে এতরাতে এলে কেন?’
‘আজ্ঞে আমার নামে যে হুলিয়া আছে।’
‘হুলিয়া! কে হুলিয়া জারি করেছে?’
‘আজ্ঞে, আপনার আগের বড়োবাবু। আমার সঙ্গে দশ-আনা ছ-আনার চুক্তিতে আসতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। চোদ্দোআনা-দু আনা পর্যন্ত ঠিক ছিল। আপনার মেজোবাবুও ওঁর দলে ছিল। তা সেই বড়োবাবু মেজোবাবুকে হুকুম দিয়ে গেছেন, আমাকে দেখতে পেলেই যেন ধরা হয়। স্যার, দিনকাল খুব খারাপ, লোকে টাকাপয়সা সোনাদানা আজকাল আর বাড়িতে রাখে না। ক-পয়সাই বা পাই—তার থেকে ছ-আনা চলে গেলে—।
‘ঠিক আছে, সকালে ছেলেকে পাঠিয়ে দিও।’
খাটাই প্রণাম করে চলে গেল।
4
পরদিন আটটার সময় পেল্লাদ এসে মোহনকে প্রণাম করে মুখ নীচু করে সামনে দাঁড়াল। মোহন তাকিয়ে দেখলেন, রংকালো হলেও সুন্দর সুশ্রী মুখখানা পেল্লাদের। চোখের দৃষ্টিও শান্ত। পেল্লাদের বগলে কাগজে মোড়া একটা জিনিস দেখে মোহন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওটা কী তোমার বগলে?’
পেল্লাদ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ‘আপনার চটিজোড়া।’
‘আমার চটি! তোমার বগলে গেল কী করে?’
‘কালরাতে বাবা নিয়ে গিয়েছিল।’
‘কেন? চটি নিয়ে গিয়েছিল কেন! তাই সকালে উঠে খুঁজে পাইনি!’
‘আজ্ঞে, বাবার গুরুদেবের নির্দেশ আছে, রাত্তিরে বাড়ির বাইরে পা দিলে খালি হাতে ফেরা যাবে না—কিছু হাতে করে ফিরতেই হবে! ‘বাবা খুব গুরুর কথা মানে কি না!’
মোহন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলেন না, বললেন, ‘কই তোমার মার্কশিটটা দেখি।’
মার্কশিট দেখে মোহন মোহিত হয়ে গেলেন! মোট আটশো মার্কসের মধ্যে প্রহ্লাদ পেয়েছে ছশো সাতানব্বই! তিনি তক্ষুনি প্রহ্লাদকে নিয়ে সোজা বসন্তপুর উচ্চমাধ্যমিক ইস্কুলের দিকে রওনা দিলেন!
খবর শুনে খাটাই হায় হায় করে উঠল ‘স্যার, কী বললাম আর কী করলেন! পেল্লাদকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এলেন!’ মোহন খুব কড়াগলায় বলল, ‘হ্যাঁ। দিয়ে এলাম। তুমি যদি ওর পড়াশোনায় বাধা দাও, তোমাকেও জেলখানায় ভর্তি করে দিয়ে আসব। ও যতদূর পড়তে চায় পড়বে—খরচের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না।’ দাবড়ানি খেয়ে খাটাই চুপ করে গেল।
সেদিন ইস্কুল থেকে ফেরার পথে মোহনের মনটা খুব ফুরফুরে লাগছিল। অনেকদিন পরে সাইকেল চেপেছিলেন মোহন। পাশ কাটিয়ে একটা বাইক উলটোদিকে চলে গেল। একটু পরেই সেই বাইকটা ঘুরে এসে মোহনের পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ল! ফুল ইউনিফর্ম পরা লোকাল থানার দারোগার পথ আটকায়, এতবড়ো আস্পর্ধা কার? একটু দেখতে হচ্ছে! মোহন সাইকেল থেকে নেমে পড়লেন।
একজন যুবকও বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। সুন্দর সুঠাম চেহারা, ব্যাক-ব্রাশ করা চুল, জিনসের প্যান্টের উপর খয়েরি টি-শার্ট পরা। যুবকটি এগিয়ে এসে মোহনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। থতোমতো খেয়ে মোহন বললেন, ‘তুমি কে? ঠিক চিনতে পারলাম না তো!’ যুবকটি বলল, ‘স্যার, আমি কালু! সেই যে ব্রহ্মপুর স্কুলে—।’
‘ওহ কালু! অর্জুন কৃষ্ণসখা! কত পালটে গেছ—কী করে চিনব? এ দিকে কোথায় যাচ্ছ?’
‘এই তো কেদারপুর বিডিও অফিসে ক্লার্ক-এর চাকরি করছি—স্পোর্টস কোটায় পেয়েছিলাম! মোহন কালুকে জড়িয়ে ধরলেন।
বাকি পথটুকু সাইকেল চালাতে চালাতে মোহন ভাবছিলেন, আজ খুব আনন্দের দিন। ঘোর অন্ধকারের মধ্যে একই দিনে দুটো আলো দেখতে পেলাম। একটা আলো জ্বলছে, অন্যটাও জ্বলব জ্বলব করে হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করছে, নিভবে না মনে হয়। জোরে প্যাডেলে চাপ দিয়ে মোহন মনেমনে বললেন, ‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া! সব রত্নাকর বাল্মীকি হয় না ঠিকই, কিন্তু একজনও না-হলে রামায়ণ লিখবে কে?’