মোহনা
ময়না এসে হাসিমুখে বলল, “আমায় একটা ছেলে যোগাড় করে দে; বিয়ে করব।”
দাড়ি কামানো শেষ হয়ে গিয়েছিল, মুখ মুছে ময়নার দিকে সহাস্য চোখে তাকালাম। “কি ব্যাপার তোর? হঠাৎ?”
ময়না ততক্ষণে আমার বিছানায় বসে পড়েছে। বলল, “কিসের হঠাৎ? বিয়ের?”
“আরে না না, তুই আর আসিস না বড়, তাই বলছি…।”
“বলিস না, সেদিনও এসেছি।”
“কবে?”
“তুই ছিলিস না; মাসি বলল কলকাতার বাইরে কোথায় গিয়েছিস।”
কলকাতার বাইরে আমায় মাঝে মধ্যেই যেতে হয়, শেষবার গিয়েছি শীতের গোড়ায়, এখন শীত চলছে। ময়না এসেছিল আমি জানতাম না, আমায় কেউ বলে নি। বলার মতন খবরও কিছু ছিল না বোধ হয়। আজও যে ময়না এসেছে আমি জানতে পারতাম না যদি-না বাড়ির মধ্যে একটা অট্টরোল উঠত। আগে ময়না এলে বাড়িতে নানারকম রোল উঠত, আজকাল তেমন বড় শুনি না। দাড়ি কামানোর সরঞ্জামগুলো তুলে রাখতে রাখতে বললাম, “তোকে অনেকদিন পরে দেখছি।”
ময়না আমার চোখের ওপর তার সকৌতুক, সামান্য ধারালো, চঞ্চল দৃষ্টি ফেলে বলল, “কেমন দেখছিস, ফুলদা? বিয়ের কনে হতে পারব কি না দেখছিস?” বলে হাসিমুখে ময়না পিঠ নুইয়ে দোল খাওয়ার ভঙ্গি করল, করেই মাথার খোঁপায় হাত দিয়ে ঘাড় বেঁকাল, “আমার চুল এখনও পাকে নি…, ভাবিস না নকল কিনে খোঁপা ফুলিয়েছি… হাত দিয়ে দেখতে পারিস।” ময়না ঘাড় সোজা করল। “দাঁত দেখবি? দেখ…। একটাও পড়েনি। কষ দাঁতে একটা গর্ত আছে-ভরিয়ে রেখেছি। আর কি দেখবি? এই দেখ হাত, এখনও নরমটরম। পা দেখবি—?” বলে ময়না তার শাড়ির খানিকটা পায়ের উপর তুলে ধরল, ডিম পর্যন্ত। তার পায়ের গোছ ভারী, মোলায়েম, সুন্দর।
ময়নার ভাল নাম মোহনা; আমরা ডাকি ময়না বলে। এক সময়ে আমি ওকে ‘মোহ’ বলে ডেকেছি। ময়না আমার আত্মীয়া, মেজমাসির মেয়ে; মার সঙ্গে মেজমাসির রক্তের সম্পর্কটা খুব নিকট নয়, যথেষ্ট দূরেরও নয়। ছেলেবেলা থেকেই ময়নাদের সঙ্গে আমাদের মেশামিশি করে কেটেছে, তখন ওরা কাছাকাছি থাকত, এখন এখান থেকে দূরে চলে গেছে, ভবানীপুরের দিকে। মেজমাসির বড় মেয়ের নাম অঞ্জনা, ছোট মোহনা, মোহনার পরে এক ছেলে—জ্যোতি। মোহনা নামটা মাসি বা মেসোমশাই কে যে দিয়েছিলেন আমরা জানি না, কেন দিয়েছিলেন তাও নয়; বোধ হয় কিছু মনে করেই।
মোহনার সঙ্গে আমি বাল্যাবধি মানুষ হয়েছি। ও কিন্তু আমার ঠিক সমবয়সী নয়। আমাদের মধ্যে বয়সের সামান্য তফাত আছে। মোটামুটি আমরা বছর চারেকের ছোট বড়। তবু একটা বয়স থেকে আমরা সমবয়সীর মতন অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলাম। সে বরাবর আমাকে তুই বলত, পরে কখনও-সখনও তুমি বলেছে। এখন কথনও তুই, কখনও তুমি।
মোহনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আগাগোড়া সাদামাটা ছিল না। আমাদের মধ্যে বাঁধাধরা আত্মীয়তা ছাড়াও নানা সময়ে নানা রকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আপাতত আমরা বন্ধুত্ব ও প্রীতির পিঠটাই দেখি, উলটো পিঠ দেখি না, দেখতে চাই না হয়ত।
মোহনা বরাবরই নিজের একটা ধাত বজায় রেখে কাটিয়ে যাচ্ছে। সে খানিকটা বেশি রকম স্পষ্ট, মেয়েদের পক্ষে যথেষ্ট অনাবৃতই বলা চলে। তার আচরণ প্রায়ই এত মুক্ত হয়ে ওঠে যে তাকে বাস্তবিক ভাবতে অনেকের বাধবে। আত্মীয়-স্বজন তাকে নির্লজ্জ, নির্বোধ বলেছে; তার কুখ্যাতি অনেক, নিন্দা অপবাদ অজস্র। তবু মোহনা নিজের ধাতের জোরেই যেন আত্মীয়-স্বজনের মুখের সামনে সোজা পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বরাবরই ময়নাকে পছন্দ করে এসেছি। যখন সে ফ্রক পরে কাঁধ পর্যন্ত চুল ছড়িয়ে ঘুরত তখন তাকে প্রায়ই বলতাম, বড় হলে তুই ডেঞ্জারাস হয়ে যাবি; শাড়ি পরতে শুরু করলে বলেছি, ময়না তুই বোরখা পর—আর পারা যাচ্ছে না। তারপর মোহনার তরুণী ও যুবতী অবস্থায় আমার গরম নিশ্বাসে তার গাল পুড়িয়ে বলেছি, তুই মোহ তুই ভীষণ মোহ।
আর আমার চোখে মোহনা কতটা মোহ তা গুছিয়ে ভাবি না আর। ওর ওপর আমার অবশিষ্ট মোহ হয়ত কিছু আছে, মমতা বোধ হয় তারও বেশি। মোহনার বয়েস এখন বছর তিরিশ। সচরাচর তার মতন মাথায় উঁচু মেয়ে দেখা যায় না; পাশাপাশি দাঁড়ালে আমার মতন লম্বা মানুষেরও সে প্রায় গাল ছুঁয়ে ফেলে। তার গায়ের রঙ নতুন শ্লেট-পাথরের মতন অনেকটা, ঠিক কালচে নয়, কালো মিশেল দেওয়া ধূসর এক রঙ—যা কখনও কখনও শেষ বিকেলের আকাশে দেখা যায়। ওই রঙের ওপর এমন এক মসৃণতা যা দেখলে মনে হয় আভা ফুটে আছে। ছিপছিপে গড়ন বললে যা বোঝায় মোহনা তা নয়। তার গড়ন মাপজোপা, খুঁত তেমন কিছু চোখে পড়ে না। গলা ঈষৎ লম্বা হয়ত, কিন্তু কাঁধের দু’ পাশ পুরু ডানার মতন নোয়ানো, ওপর বুকের আদল অল্প উঁচু—প্রতিমার আদলের মতন, নিচের বুক সুঠাম, দৃঢ়। তার স্তনে বাহুল্য নেই, ভীরুতাও নয়। ওর কোমর হালকা, যেন অনায়াসেই অসাধ্য-সাধন করে সামনে পেছনে বা পাশে হেলে পড়তে পারে। ভরা সোজা পিঠ। পেছন থেকে মোহনাকে দেখে মতিভ্রম ঘটা স্বাভাবিক। তার পা, পায়ের গোছ ভারী, ভরন্ত সুন্দর। মোহনার মুখ বুঝি তার চরিত্র। টানা লম্বা ধাঁচের মুখ, কাঠবাদামের মতন পুরু ও মসৃণ, গালের তলা ক্রমে ক্রমে গড়িয়ে নেমেছে; নেমে থুতনির কাছে ন্যাসপাতির মতন নধর হয়ে গেছে। অথচ তার থুতনির ডৌলটি শক্ত এক রকম কাঠিন্য লক্ষ করা যায়। ওর ঠোঁট যতটা পাতলা হলে মানানসই হত, ততটা নয়, সামান্য মোটা, নিচের ঠোঁট বেশ পুরু; দাঁতের পাটি গোছানো। নাক হিসেবে মোহনার নাক আমার ভালই লাগে, বিসদৃশ লম্বা নয়, ডগা অল্পরকম ফোলা। ওর চোখ যে কেমন তা বুঝিয়ে বলা মুশকিল; কালো নয়নতারা, পালক খুব ঘন দীর্ঘ; পাতলা টানা টানা ভুরু। মোহনার দৃষ্টি খুব সজীব, চঞ্চল; বিদ্ধ করার মতন ধারালো। ওর চোখে একটা সকৌতুক ভাব আছে, কিন্তু এই ভাব যখন থাকে না—তখন তার চোখের তারা এবং দৃষ্টি কি রকম রহস্যময় হয়ে থাকে; মনে হয় ওর সবই অনিশ্চয়তায় ভরা। আমার বরাবরই মনে হয়েছে, মোহনার চোখ তার চরিত্রের অনেকটা প্রকাশ করেছে।
মোহনাকে আমি চুপচাপ লক্ষ করছি দেখে এবার অধৈর্যের ভান করে সে বলল, “কিরে, বলছিস না যে কিছু?”
“বলব। বলার আগে তোকে দেখছি।” হেসে বললাম।
মোহনা বলল, “আর কত দেখবি? তুই তো আর পাত্র নয়।”
মোহনার মুখখামুখি চেয়ার টেনে নিয়ে বললাম, “পাত্রী হিসেবে তুই এখনও সচল।” বলে হাসলাম। “তোর একটু বয়স হয়ে গেছে ময়না, তা হোক, অনেকে আজকাল খানিকটা বয়েস পছন্দ করে।”
ময়না তার গায়ের গরম উড়নিটা গলার কাছে পাক খাইয়ে নেবার মতন করল, বলল, “আহা রে, কি কথাই বললি…বয়স হয়ে গেছে। বয়স না হয়ে গেলে কি তোর কাছে ধরনা দিয়ে বলতে আসতাম, একটা ওগো-টোগো খুঁজে দে।” ময়না মেয়েলী ভরাট গলায় হাসতে লাগল।
সিগারেট ধরিয়ে মুহূর্ত কয়েক মোহনার দিকে তাকিয়ে তার এই রঙ্গময় হাসি দেখলাম। পরে বললাম, “তোর পাত্রের অভাব কি?”
ময়না কৃত্রিম বিস্ময় দেখিয়ে বলল, “অভাব না হলে তোর কাছে আসব? থাকলে কেউ চায়?”
“তোর অনেক ছিল।”
ময়না এবার হাসল না। তার গলার স্বর যদিও গম্ভীর হল না, তবু আগের মতন অতটা লঘুও থাকল না। বলল, “যাদের কথা বলছিস তারা আমার পাত্র নয়; হলে বিয়ে করে ফেলতাম।”
পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশায় ময়না বড় একটা কৃপণতা করেনি। তার সঙ্গে যারা মেলামেশা করত তাদের কাউকে কাউকে আমার মনে আছে।
আমার সংশয়ের ভাবটা মোহনা বুঝতে পারল। বুঝে জানলার দিকে সামান্য হেলে বিছানায় তার বাঁ হাতের ভর রাখল, অলস গলায় বলল, “দেখ ফুলদা, আমার বরাবরই একটু স্বয়ংবর সভা করার ইচ্ছে ছিল। আদ্যিকালের ব্যাপার হলে কি হবে, জিনিসটা বেশ। কত রাজাগজা, বীরটীর, দেবতা-দানব সভায় আসবে—আমি বেছে-টেছে নিজের মতন একটা বর খুঁজে তার গলায় মালা দিয়ে দেব, ব্যাস্—ঝামেলা চুকবে।” হাসিতে মোহনার কণ্ঠনালী কাঁপতে লাগল।
হেসে উঠে বললাম, “তুই তাহলে এতোদিন স্বয়ংবর করছিলি?”
“ঠিক বুঝেছিস—” মোহনা মস্ত করে ঘাড় হেলাল। “স্বয়ংবর করছিলাম। আজকাল তো আর সভা ডাকা যায় না, যারা আসে তাদের নিয়ে রাস্তায়, মাঠে, গঙ্গার ধারে, সিনেমায় কিংবা ধর বাড়িতে বসার ঘরে বসতে হয়। তা, আমার বেলায়, বুঝলি ফুলদা, রাজাটাজা আসে নি; কোথা থেকে আসবে বল, পৃথিবী থেকে রাজাগুজাগুলো মরে যাচ্ছে। তার বদলে ভাল মাইনের চাকরে-টাকরে এসেছিল, ব্যবসা করা গণেশ, স্কুল-কলেজে পড়ানো হাঁদাটাদা, পাড়ার এক-আধটা কার্তিক। …দুর এরা আবার পাত্র নাকি? এদের সঙ্গে ঘোরাফেরা, হসাবসা করেছি এরা বন্ধুটন্ধু, সঙ্গী; ইয়ার ক্লাসের লোক সব। এদের আবার কেউ নিজের থেকে বিয়ে করে!”
মোহনা যেন তার উচ্চশির ঝাপটা দিয়ে সব ধুয়ে মুছে দিল।
হাসির দমক কাটতে আমারও কিছুটা সময় লাগল। সিগারেটের ধোঁয়া নিলাম গাল-গলা ভরতি করে। পরে বললাম, “তাহলে আর তুই স্বয়ংবরে নেই?”
“না, আর নয়।”
আমি চুপচাপ করেই থাকলাম। মোহনাও নীরব। জানলা দিয়ে শীতের রোদ এসে তার পিঠের আধখানা রৌদ্রময় করে রেখেছে তার বাঁ হাতে রোদ পড়েছে, সোনার বালা ঝকঝক করছিল। তার কানের মুক্তোটাও রোদ পেয়ে ঠিকরে উঠছিল।
মোহনা এবার তার মুখের ভাব, গলার স্বর একেবারে পালটে ফেলে বলল, “ফুলদা তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। অনেক কথা… আমার মন যে কি রকম হয়ে আছে তুই জানিস না।”
মোহনাকে আমি বুঝি, তার মুখ এবং কথার ভাবে বুঝলাম, সে কোনো ব্যাপারে অশান্তি নিয়ে আছে। বললাম, “বেশ তো, তোর মনের কথা বল।”
“না এখন নয়; এখানে নয়।”
“তবে?”
“দুদিনের জন্যে কোথাও থেকে ঘুরে আসি চল। আমার ভাল লাগছে না আর।”
“কোথায় যাবি,” বলেই আমার কিছু মনে পড়ল। বললাম, “আমার এক জায়গায় যাবার কথা আছে। কাজ আছে একটা। ইচ্ছে হলে আমার সঙ্গে যেতে পারিস।”
“যেখানে খুশি চল। শুধু নিরিবিলি আর চুপচাপ চাই। …তুই কবে যাবি আমায় জানাস। আমি পা উঠিয়ে আছি। বললেই যাব।”
২
দিন আট দশ পরে ময়নাকে নিয়ে আমি যেখানে এলাম সেখানে বড় কেউ বেড়াতে আসে না। কলকাতা থেকে ট্রেনে পুরো এক বেলার পথ। নিরিবিলি ফাঁকা জায়গা। স্টেশনের কাছাকাছি পাহাড়ী টিলার তলায় এক সময় মিলিটারী ছাউনি পড়েছিল এখন ওখানে ফায়ার ব্রিক্স্-এর কারখানা। কিছু দূরে কয়েকটা কয়লা কুঠি। অজস্র পলাশ ঝোপ আর বন তুলসীর জঙ্গল এখানে। কাছাকাছি এক ফালি নদী অজয় থেকে গড়িয়ে এসেছে।
কাজকর্মে আমায় এখানে বার কয়েক আসতে হয়েছে: এবারেও কিছু কাজ নিয়ে এসেছি। ভাবনা ছিল আমার পুরনো আশ্ৰয়টা পাব কি না। সৌভাগ্যবশে পেয়ে গেলাম। স্টেশনের কাছাকাছি একটা ছোট বাড়ি, মাথার ওপর শ্যাওলা ধরা টালির আচ্ছাদন, জানলা দরজা বোধ হয় জাম কাঠের। বাইরে সিমেন্টে বাঁধানো কুয়াতলা।
স্টেশনে নেমেই ময়নার জায়গাটা ভাল লেগে গিয়েছিল। এসে পৌঁছেছিলাম প্রায় দুপুরে। দেখাশোনা করার লোকটাকেও পাওয়া গেল। নাম তার দাশরথি। আমার সঙ্গে তার মুখ চেনাচিনি আগেই ঘটেছিল।
দাশরথি যাচ্ছিল কোলিয়ারীর দিকে তার ঘরের ডিম বেচতে, আমাদের দেখে খুশি হয়ে অভ্যর্থনা করল; বলল “অনেকদিন বাদে এলেন বাবু, কাজে এলেন কি? বউদিদিকেও নিয়ে এলেন? ভালই করলেন।”
পৌষের মাঝ দুপুরের রোদ ময়নার ঠিক মাথায় পড়ছিল বলে সেই তপ্ত রোদ বাঁচাতে ময়না মাথায় খানিকটা কাপড় তুলে দিয়েছিল। দাশরথি অত বোঝে নি। বোঝার দরকারই বা কি! আমি এবং ময়না দুজনেই পরস্পরের চোখে চোখে তাকিয়ে হাসলাম মৃদু।
দুটি মাত্র ঘর। দাশরথি ঘর খুলে ঝেড়ে ঝড়ে পরিষ্কার করে দিল। তক্তপোশ আর একটা পায়া-ভাঙা টেবিল ছাড়া আসবাবের কোনো বাহুল্য নেই। দেওয়ালে কিছু পেরেক পোঁতা, একটা রাধাকৃষ্ণের ছবিঅলা পুরনো ছেঁড়া ক্যালেণ্ডারও ঝুলছিল।
দাশরথি গেল কিছু শুকনো খাবার আর চায়ের ব্যবস্থা করতে। ময়না গেল কুয়ার জলে অর্ধস্নান সারতে।
শাড়ি জামা ভিজিয়ে পরিষ্কার হয়ে ফিরে এসে ময়না বলল, “খুব আরাম লাগল, ফুলদা; কুয়ার জল যে এত মিষ্টি কে জানত!” বলে ময়না কাপড় ছাড়তে পাশের ঘরে গেল।
পাশাপাশি ঘর, মাঝখানে পলকা দরজা। দাশরথি একটা ঘরই খুলে দিয়েছিল, পাশের ঘরের ছিটকিনিটা আমি খুলেছি, ময়না দাশরথির রেখে-যাওয়া ঝ্যাঁটা দিয়ে ঘরটা আগেই একটু পরিষ্কার করে নিয়েছে।
দাশরথি ফিরে আসতে আসতে আমারও হাতমুখ ধোওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর চা জলখাবার খেতে বললাম। ততক্ষণে প্রায় বিকেল।
আমি ভেবেছিলাম ময়না ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আজ আর বাইরে যেতে চাইবে না। বিকেল পড়ে যাচ্ছে দেখে ময়না বলল, “চল ফুলদা, একটু ঘুরে আসি বাইরে থেকে।”
দরজায় তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, দাশরথি বলল, যান ঘুরে আসুন, আমি আছি। এই বাড়ির লাগোয়া একটা খাপরা-ছাওয়া বাড়িতে সে থাকে।
শীতের বিকেল, এই ছিল দাঁড়িয়ে, হঠাৎ পালাল কোথাও, আর তার দেখা নেই; আর প্রায় দেখতে দেখতে আঁধার হয়ে এল। শীতের বাতাস এখানে উদ্দাম, কোথা দিয়ে ছুটে আসছে বোঝাও যায় না, কখনও মনে হয় জঙ্গলের দিক থেকে, কখনও মনে হয় নদীর ধার ঘেঁষে। বন-তুলসীর গন্ধ আরও ঘন হয়ে নাকে লাগে। ফায়ার ব্রিক্স্-এর ধোঁয়া পাহাড়ী টিলার মাথায় মেঘের মতন জমতে থাকল। ততক্ষণে তারা উঠে গেছে আকাশে, চারপাশ কালো, হিম পড়ছে। স্টেশনের দিকে কয়েকটা দোকানপত্রের আলো জ্বলছে টিমটিম করে। শীত ধরে গিয়েছিল ময়নার, বলল, “চল, বড্ড হাওয়া বাপু, গা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।”
ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধে ঘন হল।
দাশরথির দেওয়া লণ্ঠন নিয়ে আমি বসলাম। ময়না তোলা জলে হাত পা ধুয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে সটান তক্তপোশের ওপর তার পাতা বিছানায় বসে পড়ল। আমার বিছানাটা ও-ঘরে। বিছানায় বসে ময়না তার গায়ের র্যাগ কোলের ওপর টেনে নিল। “এই রকম শীত পড়লে মরেই যাব রে ফুলদা, বাব্বা!”
“মরবি না; বোস চাপাচুপি দিয়ে গরম হয়ে যাবি।”
“তুই না তোর ফ্লাস্ক ভরতি করে চা আনলি স্টেশন থেকে। দে, গরম চা খেয়ে গলার ব্যথা সামলাই।”
কুয়ার জল বোধ হয় একটু বেশিই ঘেঁটেছিল ময়না, তারপর বাইরের বাতাসে সামান্য ঠাণ্ডাই লেগেছে; গলা ব্যথা ব্যথা করছিল। ফ্লাস্ক ভরতি করে চা এনেছিলাম স্টেশন থেকে, দাশরথি এ জিনিসটা যখন তখন দিতে পারে না।
ময়নাকে চা দিয়ে নিজের গ্লাসটাও ভরতি করে নিলাম। আরও থাকল ফ্লাস্কে। আমাদের নিজস্ব বাসনপত্র বলতে ওই দুটো কাচের গ্লাস, জলটল খাওয়ার জন্যে বয়ে এনেছি। দুজনের দুটো ছোট বিছানা, দুটো সুটকেস আর ছোট মতন একটা বেতের টুকরিতে একটা টিফিন কেরিয়ার, কয়েকটা কমলালেবু, একটা প্যাকেট মোমবাতি, কিছু টুকিটাকি।
দাশরথি এর মধ্যে একবার দরজার কাছ থেকে ঘুরে গেল। ন’টার গাড়ি আসতে আসতে তার খাবার তৈরি হয়ে যাবে। বললাম, তার পরে হলেও আমাদের অসুবিধে হবে না, খাবার সময় হলে তাকে ডাকব।
লণ্ঠনটা ভাঙা টেবিলের ওপর জ্বলছে, ময়লা, মেটে রঙের আলো। চায়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সিগারেট ধরালাম, ধরিয়ে ময়নার মুখোমুখি বসলাম। পা ঝুলিয়ে বসা যাচ্ছিল না, ঠাণ্ডা লাগছে; বিছানায় পা উঠিয়ে নিলাম। জানলা দরজা বন্ধ, তবু ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে কনকনে বাতাস আসছিল।
ময়না আরাম করে ধীরেসুস্থে চা খাচ্ছিল। আমি কখনও ময়নাকে দেখছিলাম, কখনও ঘরের ধুলো-জমা দেওয়ালের গায়ে ঝাপসা আলো, কখনও বা পাশের ঘরের অন্ধকার দরজাটা দেখছিলাম।
ময়না এবার ঢোঁক গিলে আরামের শব্দ করল একটু, বলল, “গরম লাগিয়ে ব্যথাটা যেন কমল খানিক।”
“অবেলায় তুই অত জল ঘাঁটলি কেন, কলকাতার মানুষ কুয়া দেখে নেচে উঠলি।”
কথাটা শুনল ময়না। তারপর কি মনে করে হেসে ফেলল । বলল, “অবেলায় বুঝি কিছু ঘাঁটতে নেই রে?”
ময়নার চোখের দিকে তাকালাম। কথাটা সে অন্যভাবে বলেছে। কি ভেবে বলেছে আমি তার খানিকটা অনুমান করতে পারি। ওর চোখে অন্যমনস্কতা ফুটে উঠেছে। আমায় সে দেখছিল না, আমার পাশ দিয়ে মলিন আলোর দিকে তাকিয়েছিল।
কিছুক্ষণ কোনো কথা বলা গেল না। অথচ এই কিছুক্ষণের মধ্যে এমন একটা নীরবতা সৃষ্টি হয়ে উঠল বা আমাদের বোধ ও অনুভূতির মধ্যে কোনো গভীর উম্মনার ভাব সঞ্চার করছিল। ময়নার চোখের পাতা স্থির, দৃষ্টি এলোমেলো, যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। বিগত কোনো কোনো ঘটনা আমায় উদাস করছিল।
শেষে অনেকটা হালকা গলায় আমি বললাম, “তুই তো অবেলাই পছন্দ করলি!”
ময়না তাকাল না, একই ভাবে বসে থাকল।
অপেক্ষা করে আবার বললাম, “তোর এখনও একেবারে অবেলা হয় নি, খানিকটা বেলা আছে…”
এবার ময়না আমার দিকে তাকাল। আমার পরিহাস সে মন দিয়ে শুনেছে কি শোনে নি বোঝা গেল না; চোখের পলক ফেলল। বলল, “আর কতটুকু আছে তুই জানিস? জানিস না।” ময়না মাথা নাড়ল ধীরে ধীরে।
না জানার মতন আমি কিছু পাচ্ছিলাম না। ময়নার হয়ত সামান্য বয়স হয়ে গেছে; কিন্তু সে কিছু না। চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সিগারেটের এক মুখ ধোঁয়া গলায় নিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থাকলাম। পরে ঠাট্টা করে বললাম, “তোর তো সবটাই আছে। সেদিন বাড়িতে এসে চুল দেখালি, দাঁত দেখালি নিজেই। বললি হাত পা এখনও নরম।”
ময়না এবার ঠোঁটের ডগায় হাসির ভাব আনল একটু, বলল “মিথ্যে বলেছি?”
“না, কে বলল মিথ্যে বলেছিস?”
“ওগুলো মিথ্যে নয় বুঝলি ফুলদা—” ময়না কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে হঠাৎ কি রকম অন্যমনস্ক হল, তার চোখের দৃষ্টি আমার দৃষ্টিতে মিশে গিয়েছিল, তবু সে আমাকে দেখছিল না। মুহূর্ত কয়, তারপর আবার ময়না স্বাভাবিক ভাবে আমায় দেখতে দেখতে নিশ্বাস ফেলল। বলল, “বাইরে সব ঠিক আছে, কিন্তু ভেতরে কি যেন একটা হয়ে গেছে রে, ফুলদা।”
ওর দিকে সপ্রশ্ন সকৌতুক চোখ করেই বললাম, “কি হয়ে গেছে? বল শুনি।”
ময়না তার কালো গরম শাল আরও ঘন করে নিয়ে বলল, “তুই কিছু বুঝিস না? একটা আন্দাজ কর না।”
মনের আন্দাজ যাই হোক মুখে হেসে বললাম, “আমি কি বুঝব! আমি শুধু দেখছি তুই আমায় একটা বিয়ের পাত্র খুঁজে দিতে বলছিস।”
ময়নাও হাসল। “তা বলেছি—।”
আমার চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, গ্লাসটা জানলার দিকে হাত বাড়িয়ে রেখে দিলাম। সিগারেটও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
ময়না তার দু পা উঁচু করে হাঁটু ভেঙে বসল, তার কোমর পর্যন্ত কম্বল চাপা; যদিও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না তবু বুঝতে পারছিলাম ময়না তার দু হাত পায়ের দু দিক দিয়ে বেড় দিয়ে হাঁটু বুকের সামনে টেনে নিয়ে তার চিবুক রাখল।
ময়নার মাথার চুল রেলের ধুলো ময়লায় সামান্য রুক্ষ হয়ে আছে। কপাল আর কানের পাশের আলগা চুলগুলো কিছু এলোমেলো, নিচের পুরু ঠোঁটে সকালের পানের বাসি খয়েরী দাগ।
“পাত্র খোঁজার আগে পাত্রীর কথা কিছু শুনি—”আমি সাধারণভাবেই বললাম, কৌতুক করেই, “তুই না বলেছিলি তোর অনেক কথা আছে—!”
ময়না হাঁটুর ওপর চিবুক রেখেই চোখ তুলে কয়েক পলক আমায় দেখল। বলল, “হ্যাঁ, কথা আছে।”
সিগারেটের টুকরোটা এবার নিবিয়ে ফেলে দিলাম। “বল, শুনি।”
আমি এবার খানিকটা আলসামির ভাব করে বসলাম। ময়নার কম্বলের অনেকটা বাড়তি পড়ে আছে, পায়ের খানিকটা ঢেকে নিলাম।
ময়না চুপচাপ। হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে চোখ নিচু করেই বসে আছে।
খানিকটা সময় অপেক্ষায় কাটল। তারপর আবার বললাম, “কি রে, বল।”
ময়না প্রথমে বিড়বিড় করে কি বলল, মনে হল যেন বলছে, “বলছি—বলছি, অত তাড়া দিস না।” তারপর মুখ তুলে নিশ্বাস টেনে বলল বলার আগে একটা কথা তোকে বলি ফুলদা, আমার কথা তুই নিজেই বুঝিস, আমি অতশত বুঝিয়ে বলতে পারব না।”
মজার গলায় বললাম, “গৌরচন্দ্রিকা ভালই হচ্ছে, তুই চালিয়ে যা।”
“দূর, এটা গৌরচন্দ্রিকা কেন হবে” ময়না বলল, “আমার কোনো চন্দ্রিকাটন্দ্রিকা নেই। তবে একটা জিনিস আছে; দাঁড়া বের করে আনি।” বলে কম্বলের তলা থেকে পা টেনে বাইরে আনল ময়না। তার পায়ের কাপড় সায়া অগোছালো করেই তক্তপোশ থেকে নামল। তারপর দেখলাম মেঝেতে বসে অন্ধকারে কি যেন খুঁজছে। একটু পরেই ময়না তার সুটকেস বের করে নিয়ে চাবি খুলে ডালা তুলল। সামান্য হাতড়াল ময়না, আবার সুটকেস বন্ধ করে তক্তপোশের আড়ালে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
বিছানায় বসবার আগে গায়ের শাল মাথার দিকে সামান্য তুলে আবার কম্বলের মধ্যে তার পা কোমর ডুবিয়ে দিল। ডান হাতে কি একটা জিনিস । কৌতুহল বোধ করলেও বুঝতে পারলাম না জিনিসটা কি! মনে হল, পাতলা খয়েরী রঙের এক টুকরো চামড়া, ঠিক যে খয়েরী রঙ তা নয়, অনেক পুরনো হয়ে যাওয়ায় এবং হাতে হাতে ময়লা ধরায় ওই রকম একটা রঙ মনে হল। বিঘতটাক লম্বা হয়ত, অথচ গোল রুলের মতন। মনে হল, গোল করে গুটিয়ে রাখা হয়েছে।
“ওটা কি রে!” অবাক হয়ে শুধোলাম।
ময়না জিনিসটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল না দেখতেও বলল না; তার ডান পাশে পেছনে পিঠের দিকে সরিয়ে রাখল। ময়নার আড়াল পড়ায় ওখানটায় লণ্ঠনের আলো নেই, ছায়া গাঢ় হয়ে আছে।
আবার শুধোলাম, “ওটা কি?”
ময়না বলল, “ওই থেকেই আমার শুরু। ধরে নে ওটা আমার জীবন।”
তার এই হেঁয়ালিভাব আমি বুঝলাম না। ময়নার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তার সুশ্রী মুখে পাতলা হাসি ছিল, সেই হাসি ক্রমেই যেন মুছে গিয়ে গম্ভীর হয়ে আসছিল। কপালের চুল হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সরিয়ে কপাল পরিষ্কার করল ময়না, আঙুলের ডগা দিয়ে চোখ রগড়াল। চোখ রগড়াবার পর তার চোখ সামান্য ছলছলে হল। অনেকটা বাতাস টানল শব্দ করে, মুখ বুজে; বুক ফুলে উঠল, তারপর মুখ হাঁ করে নিশ্বাস ফেললে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল।
“ওই কিসের একটা টুকরো—চামড়ার না কাগজের—তোর জীবন হল কি করে?” হাসির গলায় বললাম।
“হল। কেমন করে হল, তোর জেনে লাভ কি!” ময়না বলল, “হাসির কথা নয়। আমিও ভেবেছিলাম এটা আবার আমার জীবন কিসের! আমিও হেসেছি ঠোঁট উলটেছি, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। কিন্তু সত্যি ফুলদা, একদিন দেখলাম, ওটা আমার জীবন।” ময়নার মুখ গম্ভীর, গলায় অল্প আবেগ।
মানুষের কোন কথা কি যে ব্যক্ত করে জানি না। ময়নার এবারের কথায় আমার মধ্যে হাসি লঘুতার ভাব কমে গেল। আমি ওর মুখ দেখে অনুভব করতে পারছিলাম, নিছক হেঁয়ালি নয় মোহনার কোথাও যেন একটা সত্য আছে; সে কোনো কিছুর ইঙ্গিত দিতে চাইছে। আমার অবিশ্বাস বা প্রশ্ন তাকে হয়ত বিরক্তই করবে। নীরবই থাকলাম, কৌতূহল হচ্ছিল—মোহনা কি বলে?
মোহনা বলল, “দেখ ফুলদা মানুষ নাকি কতরকমের ভাবনা চিন্তা করে। আমার অত ভাবনাটাবনা আসে না। পারি না। তবু তুই না চাইলেও কখনো কখনো ভাবতে তো হয়ই। আমি ভেবে দেখেছি, আমাদের মধ্যে অনেক জিনিস থাকে কিছু ওপরে ভাসে কিছু থিতিয়ে থাকে। জোরে নাড়া পড়লেই থিতোনো জিনিসগুলো আবার ওপরে ভেসে ওঠে। …ঠিক কি না বল?”
“ওই রকমই—।” আমি মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম।
অল্প চুপ করে থেকে মোহনা বলল, “আমার মধ্যে খুব যে কিছু থিতিয়ে ছিল আমি বুঝতে পারতাম না। যেগুলো ভাসত সেগুলোই আমি বুঝতাম । তুই দেখেছিস, ছেলেবেলা থেকেই আমি আমার মতন। লোক বলত, বেয়াড়া, জেদী, ধিঙ্গি; বলত, আমি নিজেকে নিয়েই থাকি স্বার্থপর, আত্মসুখী। ছেলেবেলা থেকেই দিদির সঙ্গে আমার ঝগড়া, দিদিকে আমি আমার ওপর মোড়লি করতে দিতাম না, তার সঙ্গে সব ব্যাপারেই সমান ভাগ বাটরা করে নিতাম। কিন্তু সেটা পাবার বেলায়, দেবার বেলায় নয়, কাজের সময় নয়। মা আমাকে অবাধ্য বলত; বলত আমার যত বয়েস বাড়বে আমি ততই বেয়াড়া হয়ে উঠব, আমার স্বভাব মন্দ হবে, আমি যেখানে যাব সেখানেই ঘর জ্বালাব। বাবা এত কথা বলত না প্রথমে, পরে বলত যে আমায় একটু বেশি রকম আসকারা দেওয়া হয়ে গেছে, এখন বাঁধতে গেলে দড়ি ছিঁড়ে পালাব। এসব হল ঘরের কথা; তুই সব জানিস। আমি যা শুনেছি কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। আমি আমার মতন হয়েই থাকলাম। তেরো চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই পাড়ার মেয়েদের চোখ টাটাতে লাগল, ছেলের দল তখন থেকেই আমার জন্যে গলিতে জটলা পাকাতে লাগল। আমার তাতে কোনো লজ্জাটজ্জা হত না। একবার সেই সরস্বতী পুজোর দিন পাড়ার মধ্যে দু দল ছেলের মধ্যে মারপিট হল তোর মনে আছে? আমায় নিয়ে কেচ্ছা। আমি তখন বলেছিলাম, আমি কিছু জানি না। মিথ্যে কথা। আমি জানতাম। লাহাদের বাড়ির ছেলে—কি যেন নাম ছিল রে তার—মনেও নেই, সেই ছেলেটা আমায় পটাচ্ছিল, অন্য দলের ছেলেরা জানতে পেরে মারধোর লাগিয়ে দিল। আমার তাতে বয়েই গেল। সোজা কথা, ওই বয়স থেকেই আমি বুঝলাম, আমার একটা দাম আছে। আমার দাম যে ছিল, তুইও জানিস। …আমার যখন বয়স ষোলো সতেরো—তখন তুই আমায় কি বলতিস, ফুলদা?”
“বোরখা পরতে…”
“নাঃ, সে আরও আগে; সবে যখন শাড়ি ধরেছি।”
“শাড়ি ধরারও বেশ পরে তোকে আমি ‘মোহ’ বলে ডেকেছি।”
“হ্যাঁ। শুধু ডাকিস নি, তুই আমার প্রেমিক হয়েছিলি।”
“হয়েছিলাম।”
“তোর সঙ্গে আমার খুব একটা লুকোচুরি খেলা কখনও হয় নি। আমি পারতাম না; আমার স্বভাবও তেমন ছিল না। তুই আমার কাছে হাত বাড়ালেই পেয়েছিস। তোকে আমার বরাবরই ভাল লেগেছে ফুলদা; তুই আমার ধাত বুঝিস, স্বভাবও বুঝিস। তুই বুঝতে পেরেছিলি আমার বাঁধাবাঁধি বলে কিছু নেই। আমি একটা কিছু খুঁটি পেলেই তার গা জড়িয়ে বাড়ব এমন লতাগাছ নই। তেমন হলে আমার হাতের কাছে তুই ছিলি, আহা কত ভালই না বাসতিস, তোতে-আমাতে দুম করে গিয়ে বিয়ে করে আসতুম। কেউ আটকাতে পারত না। সেই তোকেও আমি পাশ কাটিয়ে দিলাম। অবশ্য, তোর রাগ, হিংসে, আফসোস শেষের দিকে কমেই এসেছিল। তুই খুব চালাক, ধরতে পেরে গিয়েছিলি—আমার প্রেম-ভালবাসায় মতি নেই।” মোহনা স্নিগ্ধ করে হাসল একটু, যেন সে একটু দুঃখই পাচ্ছে আমার জন্যে, পেয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আমি বললাম, “আমার কথা থাক, তোর কথাই বল!”
“বলছি, বলছি—” মোহনা তার কানের লতিতে হাত দিয়ে মুক্তো পাথরটা ঠিক করে নিল, হয়ত আলগা করল। বলল, “আমায় অত তাড়া দিস না, এক বলতে আরেক বলে বসব। আমি ছাই গুছিয়ে কি কিছু বলতে পারি! যাক্, শোন—যা বলছিলাম। আমি বলছিলাম যে, আমার স্বভাবটাই ছিল অন্যরকম। কোনো কিছুই আমি শেষ বলে নিই নি, নিতে পারতাম না। তুই বিশ্বাস কর, আমি সত্যি সত্যি কোনোদিন কোনো ছেলেকে বাছি নি। তোকে সেদিন ঠাট্টা করে বলেছিলাম বটে যে, আমি স্বয়ংবর সভা করছিলাম, কথাটা কিন্তু ঠাট্টাই। না রে ফুলদা, আমি বাছবিচার করি নি। কেন করব বল? আমার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, কাউকে শুইয়ে-বসিয়ে হাত করব এমন কথাই আমি ভাবতাম না। আর তা যদি হবে তবে আমি অমিয়বাবুকেই আমার হাতের মুঠো খুলে সম্মতিটা ধরিয়ে দিতে পারতাম। তুই অমিয়বাবুকে চিনিস। কি রকম কাজেকর্মে তৎপর ছেলে বল। ছিল এখানকার মিউজিয়মে, চলে গেল দিল্লির খাস অফিসে। গভর্নমেন্ট তাকে দু’দুবার বিদেশ পাঠাল। বা ধর, আমাদের দীপক-কে, টেক্সটাইলের পাশ করা ছেলে, আমাদের অফিসে এসে বসতে না বসতেই ছ’মাসের জন্যে আমেরিকা। ফিরে এসে বলল, বেল্ট না আঁটলে ট্রাউজার্সস পরতে পারি না, ফ্যাট হয়ে গেছে। দু লাফে বড় চাকরি বগলে পুরে আবার যেন কোথায় চলে গেল। পয়মন্ত ছেলে। আমায় বলেছিল, লেট্ আস্ সেটেল্ সামথিং। আমি বলেছিলাম, নাথিং। ঘা খেয়ে দীপক আমায় ঘেন্নাই করে বসল। তা করুক। তারপর আরও কত এল: বিজন, কমলেশ, সানু সোম—এর বিয়ের বাজারে কলকাতার ট্যাক্সির মতন, হুট করে পাওয়া যায় না। সজ্জন মানুষ, বিদ্যেবুদ্ধির বহরে মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, কলেজের এক প্রফেসারও এসেছিল; স্কুলের মাস্টার—ডানপিটে একটা ঘোকরাও জুটেছিল। কত বলব তোকে। এদের কাউকেই আমি আমার খুঁটি করতে চাই নি। ইচ্ছেও হয় নি।” ময়না থামল। তার বোধ হয় একটু জিরিয়ে নেবার দরকার হয়েছিল কিংবা যেদিকে তার কথা গড়িয়ে চলেছে সেদিক থেকে থামিয়ে নেবার।
ময়নার চোখমুখ সামান্য চকচক করছিল। বলার ঝোঁকে কিছুটা আবেগ ও অস্থিরতা তার এসেছে; সেই উত্তেজনা বোধ হয় চোখে মুখে ভাসছিল।
আমি বললাম, “তোর ইচ্ছেটা কি ছিল?”
ময়না সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। বার কয়েক সে ছোট বড় নিশ্বাস নিল। তারপর বলল, “আমার ইচ্ছে আমার মধ্যেই ছিল বোধ হয় জন্মকাল থেকেই। আমি নিজের ইচ্ছেকেই কতবার শুধিয়েছি—হ্যাঁ রে তোর মতলব কি? হসিস না ফুলদা সত্যি বলছি, এক একদিন, যখন আর কিছু মাথায় থাকত না, একেবারে ফাঁকা হয়ে থাকতাম তখন, বা যখন আমার সঙ্গে কারও বন্ধুত্ব মেলামেশা শেষ হয়ে যেত আমার ওপর আক্রোশ আর ঘৃণা নিয়ে কমলেশ মলেশরা চলে যেত—তখন রাত্রে বিছানায় শুয়ে নিজের ইচ্ছেকেই নিজে শুধোতাম, তোর ইচ্ছে কি? আমরা সবাই একটা মানুষ, কিন্তু তুই দেখিস মাঝে মাঝে আমরা দুটো হয়ে যাই, বাইরে যে থাকে সে ভেতরের মানুষটাকে চুপি চুপি এ-সব কথা জিজ্ঞেস করে। আমি ভাই মনটাকেই একটা মানুষ বলি—ভেতরের মানুষ। তুই কোনো-দিন তার গোটা চেহারা দেখতে পাবি না, তাকে ভাল বুঝবি না, অথচ সে তোকে আড়াল থেকে কোথায় যে চালিয়ে নিয়ে যাবে তুই জানিস না। আমি অনেকদিন রাত্রে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করেছি, কি তোর ইচ্ছে? কখনও স্পষ্ট কোনো জবাব পাই নি। …তবু আমার মনে হত, আমার ইচ্ছে আমাদের মতন নয়। দেখে শুনে, সাত পাঁচ ভেবে, লাভলোভ খতিয়ে দেখে একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলব—সে-রকম ইচ্ছে আমার হত না। আমি, জানিস ফুলদা, একবার স্বপ্ন দেখেছিলাম যে আমি একটা গয়নার বাক্সের মতন হয়ে বিজনের আলমারির লকারে ঢুকে গিয়েছি, বিজন লকার বন্ধ করে দিচ্ছে। উরে বাব্বা, সে কী ভয় আমার, গলা শুকিয়ে কাঠ ঘামতে ঘামতে মরি, ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর সারারাত ঘুম নেই। পরের দিন সারাক্ষণ সেই একই স্বপ্ন আমায় খোঁচাতে লাগল। সহজে আর সেটা ভুলতে পারি না। শেষে বিজনকে এড়িয়ে গিয়ে তবে বাঁচি। তাই বলছি তোকে, আমার ইচ্ছেটা কি—আমি কোনোদিন জানতে পারি নি, কিন্তু বুঝেছিলাম—আমি কোনো অবলম্বন চাই না, কারও অধিকারের মধ্যেও থাকতে পারব না। আমার সঙ্গে যাদের অনেক দিনের মেলামেশা হয়েছিল—আমি তাদের কারও জন্যে ছটফট করতে পারি নি, মনেই হয় নি ও বা অমুক না থাকলে আমার সব অন্ধকার হয়ে যাবে, আমি আর বাঁচব না! যখন কেউ চলে যেত মামুলি একটু-আধটু মন খারাপ ছাড়া কারও জন্যে আমার দুঃখ হত না। অল্পস্বল্প মায়া ছাড়া সত্যিই আমার ওদের জন্যে কোনো ব্যাকুলতা ছিল না। ওই তো, সেবার প্রমথ রাত না পেরোতে মারা গেল। সবাই কাঁদল, হা-হুতাশ করল, দুঃখ পেল; আমারও মনটা খারাপ লাগছিল, কিন্তু প্রমথ নেই—আমার কি করে জীবন কাটবে এ-সব আমি ভাবতেও পারলাম না। দুঃখশোকে আমি অধীর হলাম না। আমার কাছে কিছুই ফাঁকা ঠেকল না।” মোহনা চুপ করে গেল।
কিছু সময় আমি একইভাবে বসে থাকলাম। মোহনার চোখ-মুখ এখন আর আলাদা করে আমার নজরে আসছিল না, কেন ওর সমস্ত মুখ আমার দৃষ্টিপটে ছবির মতন স্থির হয়ে গেছে। মোহনা সামান্য নড়াচড়া করল। আমার তন্ময় ভাবটা তখন কাটল। নিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে আবার একটা সিগারেট ধরালাম।
মোহনা মাথা নামিয়ে শালের গায়ে তার নাকের ডগা ঘষল একবার, ছোট করে হাই তুলল। এবার লক্ষ করে দেখলাম, মোহনার চোখ-মুখ গম্ভীর হলেও তার মধ্যে কেমন এক ব্যাকুলতা এসেছে। আবেগে তার চোখ উদ্দীপ্ত হয়ে এসেছে।
কি যেন একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম, মোহনা বাধা দিল। বলল, “তুই বলবি, আমি নিষ্ঠুর, স্বার্থপর, আত্মসুখী। বলতে পারিস আমি হৃদয়হীন। এ সব নতুন কথা নয়; মা বলেছে কোটি বার, বাবা বেচারা মারা যাবার আগেও আমায় বলেছে—আমি আমাদের পরিবারের মানসম্মান বলে কিছু আর রাখি নি। দিদি আমায় তার শ্বশুরবাড়িতে কোনোদিন ডাকে না, ঘেন্না পায়, বলে আমায় তার বোন ভাবতে গা গুলিয়ে ওঠে। আমার ছোট জ্যোতি সেদিন সবে কলেজ থেকে বেরিয়ে চাকরি শুরু করেছে, সেও সেদিন চোটপাট করে বলল, আমার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে তার ঘেন্না হয়!… শোন ফুলদা, আমি সব স্বীকার করে নিচ্ছি, যে যা বলেছে; এমন কি আমার জামাইবাবু যে বলেছিল—আমার মধ্যে বিকার ও রোগ আছে—আমি তাও মেনে নিলাম। কিন্তু তুই বল, আমার দোষ কোথায়? পাঁচজনের শেখানো কথায় আমার যদি রুচি না থাকে আমি কি করতে পারি। এই সংসারে, তুই দেখবি, পাঁচজন তোকে শুধু শেখাচ্ছে—এটা করো না, এটা মন্দ, ওটা ভাল এরকম করলে লজ্জায় মাথা নিচু হবে, ওটা করো—করলে ভবিষ্যতে ভাল হবে। দূর ছাই, ও শিক্ষা যদি আমার ভাল না লাগে কি করব আমি। জীবনটা আমার। আমার নয়? এই শরীর বল মন বল সবই তো আমার। আমার নিজের যদি শরীর নিয়ে মনে না হয় যে, আমি চোর তবে আমি কেন তাকে নিয়ে কোথায় রাখি, কোথায় ধরি করে ভয়ে মরব। আমি কি চুরি করে আমার দেহটা এনেছি? এ আমার জন্ম থেকেই। কেন আমি নিজের জিনিস নিয়ে পথ হাঁটতে ভয় পাব? না না, আমার ভয়টয় ছিল না। বরং আমি দেখতাম ওই জিনিসটা আমার সম্পদ। তই দেখিস ফুলদা, আমাদের সংসারে সব সম্পদেরই কদর আছে তাকে ফলাও করে বেড়ালেই লোকে খুশি হয়। তোর যদি গাড়ি-বাড়ি থাকে তুই কি লজ্জায় মরবি, তোর যদি বংশ-মর্যাদা থাকে তুই কি ইঁদুরের গর্তে ঢুকিস? লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট হলে তার কদর, গানের গলা থাকলে তারও কদর মস্ত চাকরি করলে তারও কদর। শুধু তোর যদি এমন একটা শরীর থার্কে যা ভাল যার জন্যে—কি বলব, সেই পদ্যটা—পরিমল লোভে অলি সকলি জুটল—তবেই শুধু ছিছি।…আমি ভাই, এ-সব বুঝতে পারতাম না। আমার মনে হত, যা পেয়েছি সে আমার নিজের ধন, আমার সম্পদ, আমার জিনিস নিয়ে আমি মাথা উঁচু করে চলব, যা খুশি করব, তাতে অন্যের কি! তা বলে আমি কি অত বোকা যে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে খইমুড়ি ছিটোনোর মতন করে যত রাজ্যের কাকপাখি জুটিয়ে এনে নিজেকে খাওয়াব। অত বোকা আমি নই। আমার সুখ যতটুকুতে ততটুকু আমি নিয়েছি। আমার কোনোদিন আফসোস হয় নি, বুক ধকধক করে নি।” ময়না থেমে গেল, যেন সে কোনো উঁচু জায়গা থেকে তরতর করে নামতে নামতে এসে হঠাৎ দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে থমকে গিয়ে আরও নিচের দিকে তাকাল। দেখল—এবার তার পা ফেলতে হবে সাবধানে। রীতিমত সতর্ক ও বিচক্ষণ হয়ে যেন পরের পা ফেলছে এইভাবে ময়না বলল, “তারপর—একদিন…”
হাতের সিগারেটটায় ছাই জমেছিল, আঙুল সরাতে গিয়ে ছাই কম্বলে পড়ল, পড়ে তার বাঁকা চেহারাটা ভেঙে দুদিকে ছড়িয়ে গেল।
মোহনা বলল, “তারপর একদিন হঠাৎ কেমন সব হয়ে গেল। বলতে পারিস উলটে-পালটে গেল।” মোহনা শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার চোখের তারা বিষণ্ণ ও কাতর হল, কিছুটা উদাস। “একদিন কি যে হল বুঝলাম না। দিনটাই ছিল খারাপ। সকালে কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম কে জানে, ঘুম ভেঙে উঠতে না উঠতেই মার সঙ্গে খিটিমিটি বাধল। আমার ওপর মার মনের ভাবটা তুই জানিস। কথা কাটাকাটি, মন কষাকষি আমাদের নতুন নয়, প্রায়ই হয়। কিন্তু সেদিন মার মন একেবারে তেঁতো হয়ে ছিল। কি যে বলল আর না বলল তার কোনো ঠিক নেই। বুঝলাম, জ্যোতিই মাকে উসকে দিয়েছে। জ্যোতির সঙ্গেও আমার ঝগড়া হল, আমারও মুখের ঠিক থাকল না, যা তা বললাম। ঝিয়ের বাচ্চা ছেলেটা বাঁদরামি করছিল, ঠাস করে এক চড় মারলুম, ছেলেটা ককিয়ে মরে আর কি। তিতিবিরক্ত হয়ে স্নান নেই, খাওয়া নেই, চলে গেলাম অফিস। অফিসে কোথায় একটু স্বস্তিতে থাকব তা নয়, মেঘলা দুপুরে এক মূর্তিমান এসে হাজির। আমার এই নতুন মূর্তিমানটিকে তুই চিনিস না, এর নাম ললিত। নামে ললিত হলেও ওর কোথাও তেমন লালিত্য নেই, চেহারাটা লম্বাচওড়া, পুরুষের মতন, স্বভাবটা রুক্ষ, অহমিকা বেশি। অফিসে এসে আমায় জোর জবরদস্তি করে টেনে নিয়ে রাস্তায় বেরোলো। তারপর নিয়ে গেল পার্ক স্ট্রীটের এক চীনে দোকানে। ভেবেছিলাম, খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু নেশার মধ্যে আমায় ছেড়ে দেবে। ওমা, ছেড়ে দেবে কি, পকেট থেকে কাগজ বের করে এগিয়ে দিল, বলল, নোটিশ। ওর উদ্দেশ্য বুঝলাম। কাগজ ফিরিয়ে দিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, না—না, এ-সব হয় না। ও বলল, কেন? আমি কেন-টেনোর পথ মাড়ালাম না। কিন্তু ও একেবারে নাছোড়বান্দা। আমার না ও শুনবে না। বিকেল হয়ে গেল, বৃষ্টি নামল ঝিপঝিপ করে, সেই বৃষ্টির মধ্যে ট্যাক্সি নিয়ে চলল ডায়মন্ডহারবার। আমায় সারাক্ষণ শুধু বোঝাতে চাইল, আমায় না হলে ওর চলবে না। কী মুশকিলেই পড়লাম। মদের গন্ধ আমার অজানা নয়, মাতলামি আমি বুঝি; কিন্তু লোকটা ক্রমেই জবরদস্তি শুরু করেছে। আমার বিরক্তি লাগছিল। এমনভাবে কেউ আমার পথ আটকাতে আসে নি, অথচ ওর চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা আমার অন্য অনেকের সঙ্গেই হয়েছিল। ললিতকে আমার ভীষণ খারাপ লাগল। ওর জবরদস্তি দেখে এবং ভাবসাব বুঝে আমার মনে হল, লোকটা আমায় উপার্জন করতে চায়, করে তার নিজের অ্যাকাউন্টে আমায় জমা করে ফেলতে চায়। তাতে তার তহবিল যেন মোটা হবে। কিন্তু আমার কি হবে? আমি তো তার গচ্ছিতের মধ্যে গিয়ে পড়ব। ও আমায় আয়ত্ত করবে, অধিকার করবে, সেই অহমিকায় খুশি থাকবে। আর আমি? আমার কি থাকবে?…আমি ওকে হাজারবার না না করলুম, কতবার পাঁচ কথায় বোঝাবার চেষ্টা করলুম। ভবি ভুলল না। শেষে ওর নোঙরা চেহারাটা বের করতে লাগল। আমায় ও শাসাতে লাগল। ওর শাসানি আমার খারাপ লাগল। তখন বুঝি নি, গ্রাহ্যও করি নি। আকাশে মেঘ গুড় গুড় করলেই কি ভয়ে কাঁটা হয় মানুষ!…শেষে সন্ধেবেলায় আমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে এল। কেন এল তা কি বুঝতে পেরেছিলাম তখন! একটু পরেই ওর আসল উদ্দেশ্যটা বুঝলাম। আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে শয়তানটা গলা বড় করে বলে গেল, আমার পেটে তার বাচ্চা রয়েছে।”
কথাটা বুঝেও না বোঝার মতন বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে থাকলাম।
মোহনা বলল, “বাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে কথাটা বলে সে চলে গেল। মা ছিল সামনে, শুনল। মাকে শোনানোর জন্যেই বলা। অথচ কথাটা মিথ্যে একেবারে মিথ্যে। বিশ্বাস কর ফুলদা; আমি তোর গা ছুঁয়ে বলছি, ওর একবর্ণও সত্যি নয়। ও আমায় ভীষণভাবে জব্দ করার জন্যে, মার কাছে আমার মুখখানা একেবারে হেঁট করে দেবার জন্যে কথাটা বলেছিল। খেপে গিয়ে, আমার ওপর আক্রোশ নিয়ে। বুঝলাম, ও কেন এত শাসাচ্ছিল। একেবারে শয়তান একটা। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। মা ধোঁকা খেয়ে গেছে; বিশ্বাসও করে ফেলেছে প্রায়। আমি যত বলি না না, মা ততই পাগল হয়ে যেতে লাগল। আমায় কিসের বিশ্বাস। আমার আবার সম্ভ্রম কোথায়! মা, দিদি, ভাইয়ের কাছে আমার মাথা কোনোদিনই উঁচু হয়ে ছিল না। ওরা জানত, আমার সম্ভ্রম বলে কিছু নেই। তবু, যা হয়ে গেল তার ধাক্কাটা ভীষণ। মা অনায়াসেই ধোঁকা খেয়ে আমায় কী না করল। সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল সেদিন, রাত্রে আরও সব নোঙরা, কদর্য কুচ্ছিত কাণ্ড হল। শেষে মা বলল, ‘আমি জানতাম এইরকমই হবে, তোর কপালে ঠিক এইটেই লেখা ছিল, তুই জাতধর্ম রাখবি না, বংশের নাম ডোবাবি, তুই নষ্ট হবি, নষ্ট মেয়েছেলে হয়ে ঘর ছাড়বি, তারপর মরবি।’ এই বলে মা নিজের ঘরের আলমারি থেকে আমার ঠিকুজি-কোষ্ঠিটা বের করে এনে মুখের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল।”
কথা বলার কোনো অর্থ হয় না, অপলক হয়ে নীরবে বসে থাকলাম।
মোহনা অল্প সময় চুপ করে থাকল, বড় বড় শ্বাস নিল, গলা পরিষ্কার করল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “মানুষের কখন যে কি হয় বলা যায় না। মা আমার ঠিকুজি-করা কাগজটা ফেলে দিয়ে যাবার পর আমি ওটা ছুঁয়েও দেখলাম না। কেন যে মা ওটা বের করতে গেল তাও জানি না। হয়ত মা আগাগোড়া আমায় দেখে দেখে আমার ভবিতব্য বিশ্বাস করে নিয়েছিল। দেখল সেটা মিলে যাচ্ছে। আমি প্রথমে ওই হলদে রঙের গোল করে পাকানো কাগজটা ছুঁই নি। ওটা আমার অদেখা নয়, ছেলেবেলা থেকেই দেখছি, বাবা করিয়ে রেখেছিল, বাবার এ-সবে বিশ্বাস ছিল। হিন্দুর বাড়িতে, বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে ওটা আর ক’জন না তৈরী করে রাখে। আমরা কখনোসখনো কাগজটা দেখেছি; বুঝি না বুঝি, কত মজা করেছি, ঠাট্টাতামাশা করেছি, আবার একএক সময় যেন বিশ্বাসও করেছি।…রাত্রে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছিল না। রাগ, ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা, জ্বালা—আমি যেন পুড়ে যাচ্ছিলাম। কি মনে করে সেই হলুদ কাগজটা একবার দেখলাম। তারপর ফেলে দিলাম। ভোর রাতে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম, আমার ভবিতব্যের কাগজটা সাপের মতন আমার মাথার পাশে ছোবল দেবার জন্যে এগিয়ে এসেছে; পরের দিন আর অফিস গেলাম না, সকাল থেকেই বাড়ি থমথম করছে, মা একদিকে জ্যোতি একদিকে, আমি অন্যদিকে। কেউ কারুর ছায়া মাড়াচ্ছি না। কাল যে বাদলা শুরু হয়েছিল, আজ সেটা ঘন হয়ে এসেছে, পুজোর মুখ, এই এক পশলা জল নামল তোড়ে, তারপর আবার একটু নরম হয়ে গেল, কিন্তু থামল না। বাড়ির মধ্যে দমবন্ধের ভাব, সাড়াশব্দ নেই, যে যার ঘরে বসে নিজেকে একেবারে আড়াল করে রেখেছি। জ্যোতি কখন অফিস চলে গিয়েছিল; আমার স্নান হল না, ইচ্ছে হল না স্নানে, খেতেও রুচি হল না। দুপুরের দিকে কলঘরে যাচ্ছিলাম, মনে হল—নিজের ঘরে বসে মা কাঁদছে। আমার ভাল লাগল না। ঘরে ফিরে এসে আবার বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম। মার মতন বোকা আহাম্মুক আর দেখি নি। আমি বলছি, না—না, তবু মার বিশ্বাস হচ্ছে না? মা কি সত্যি সত্যিই ওই হলুদ গোল করে পাকানো কাগজটাই বিশ্বাস করবে। …তারপরই আমার স্বপ্নের কথা মনে পড়ল, সাপের মতনই না কাগজটা আমার মাথার পাশে ছোবল মারার জন্যে বসে ছিল! কি আছে ওতে? কিসের ভাগ্য? কিরকম যে ঘেন্না হল, সেই পাকানো কাগজটা টেনে নিয়ে আবার দেখলাম। এই আমার ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমান নাকি? কিম্ভুত ছক, এখানে গোল, ওখানে চৌকোনো, রেখার কাটাকুটি, কুচকুচে কালির অঙ্ক, অজস্র কথা লেখা, কি বা তার অর্থ কে জানে। দেখলাম খানিক, কিছু বা বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না। ফেলে দিলাম।… আমার কাছে সবটাই বাজে, বিচ্ছিরি মনে হচ্ছিল। … এইভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যে। সন্ধেবেলায় বৃষ্টিটা উদাম হয়ে এল। কী জোরে যে জল এল, কি বলব। … দেখ ফুলদা, ওইরকম ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে, চুপচাপ অসাড় ঘরে বসে থাকতে থাকঙ্গে আমার কি যে হল কে জানে, আমি সেই দেড় দু’হাত লম্বা গোল করে গোটানো কাগজটা আলোর মধ্যে মেলে ধরে আবার দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে আমার কেমন নেশা হয়ে গেল, আক্রোশ হল, হাসি পেল ! এই নাকি আমার কপাল? কবেকার পুরোনো, বিবর্ণ একটা কাগজ, মাথামুণ্ডু নেই, যত হাবিজাবি লেখা—এর আবার সত্যি মিথ্যে কি! শেষে আমার ঘেন্না ধরল, একটা কাঁচি এনে কাটতে শুরু করলাম। আমার জীবনের যেটা গোড়া—কাঁচি দিয়ে সেটুকু কুচ করে কেটে ফেললাম। তারপর দেখি বালিকা অবস্থাটা কোন একটা গ্রহ তাকে বছর দশ টেনে নিয়ে গেছে, সেটাও কাঁচি দিয়ে কেটে ফেললাম। তখন আমি কিশোরী রে, ফুলদা! দেখে দেখে সেটাও কাটলাম। আমি এবার যুবতী হয়ে চলেছি, মাথার ওপর একটা গ্রহ বসে। সেটাও কখন কাঁচি দিয়ে কেটে উড়িয়ে দিলাম। গুটোনো কাগজটা অনেকখানি ছোট হয়ে গেল। কাটা টুকরোগুলো আমার মুখের সামনে বিছানায় ছিটোনো। একে একে সবটুকু কেটে কাগজের টুকরোগুলো মার মুখের সামনে গিয়ে উড়িয়ে দিয়ে আসব, বলব: এই নাও—উনুনে দিয়ে এস।… তারপরও কাঁচি দিয়ে কাটতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি কি একটা লেখা। মানেটানে আমি বুঝলাম না। কিন্তু কোথ্ থেকে একটা ভয় যেন লাফিয়ে আমার বুকে এসে পড়ল। এ কেমন ভয়, কিসের ভয় তোকে আমি বোঝাতে পারব না। মনে হল, এরপর আর আমার কিছু নেই, আমার জন্যে আর কিছু বাকি থাকল না, সব ফাঁকা শূন্য হয়ে গেল। যেন এরপরই আমার মারক। …কী রকম যে হয়ে গেল, ভয় আমার গলা টিপে ধরল। আমার আর সাধ্য হল না কাঁচি দিয়ে কাগজটা কেটে উড়িয়ে দি। ভয়ে ভয়ে ওটা সরিয়ে রেখে দিলাম। “ মোহনা থামল সামান্য, কোলের ওপর কম্বলটা আরও ঘন করে টানল, যেন সেই য় এসে তাকে আবার কাঁপাতে শুরু করেছে।
“কাগজটা সরিয়ে রেখে দিলাম অবশ্য– মোহনা বলল, “কিন্তু ওই চিন্তা আর আমার গেল না। আমায় ওটা পেয়ে বসল, ভর করল ভূতের মতন। রাত যত বাড়ে ততই যেন গ্রাস করে বসছে। আবার সেই কাগজটা ভয়ে ভয়ে বের করে নিয়ে দেখলাম। ইস—কাগজটা কত ছোট হয়ে গেছে। কতটাই না ছেঁটেকেটে বাদ দিয়ে দিয়েছি। ছাঁটাকাটা, ছোট-হয়ে-আসা কাগজটা দেখতে দেখতে একেবারেই আচমকা অদ্ভুত এক চিন্তা এল। মনে হল, সর্বনাশ, এ আমি কি করেছি। কে যেন আমার মনের ঝুটি ধরে নেড়ে দিয়ে বলল, কি করেছিস দেখ। …ফুলদা, বিশ্বাস কর, আমার গা ছমছম করে উঠল, চক্ষ আমার এমন জিনিস দেখল যা আগে কখনও দেখেনি। মনে হল, জন্মকাল থেকেই কেউ আমার হাতে এই সম্পদ তুলে দিয়েছিল, বলেছিল—এর কাছ থেকে যা চাইবি পাবি। যা তোর কামনা চাইতে পারিস কিন্তু যত দেবে ততই ওটা ছোট হয়ে আসবে, দিতে দিতে ক্ষয়ে যাবে। কথাটা মনে রেখো।
ফুলদা, আমার বুক, সমস্ত সত্ত্বা কেঁপে উঠল, ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, গলা দিয়ে আর শ্বাসপ্রশ্বাস যেন বইছিল না। আগে কখনও আমার মনে হয়নি আহা রে—সব যে ফুরিয়ে এল, ক্ষয়ে এল।এবার? এবার আমি কি করব? কার কাছে চাইব? আমার সম্পদের আর কতটুকুই বা থাকল?”
মোহনার গলার কাছটায় ফুলে উঠেছিল, ঠোঁট কাঁপছিল, নাকের ডগা মোটা হয়ে গিয়েছিল। ওর চোখের তারার সব জ্যোতি নিবে এসেছিল।
মোহনা ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকার থেকে তার সেই আড়াল করে রাখা জিনিসটা তুলে নিয়ে আলোয় ধরল। আমি বুঝতে পারলাম, ওটা মোহনার সেই ছোট করে ফেলা কাগজ। বিবর্ণ রঙ, ময়লা জমে জমে বুঝি খয়েরী মতন হয়েছে।
মোহনা এবার বলল, “এই আমার অবশিষ্ট। কিন্তু এর কাছে বড় করে চাওয়ার আর আমার উপায় নেই, আজ বুঝতে পারি। অথচ আমি এতদিন আমার সম্পদ খোলামকুচির মতন ছড়িয়েছি। কোনো গা করিনি। এখন মনে হচ্ছে, হায় হায়, আমার হাতের ধন এ জীবন, কত্ কমে এল, এখন আমি কি করি ! শোন ফুলদা, আমার যেটুকু আছে সেটুকু আমি বোকার মতন ফুরিয়ে দিতে চাই না। বল তো, আমি কি চাই এখন? এই আমার শেষ চাওয়া, তারপর ও ফুরিয়ে যাবে। বল আমি কি চাইব।”
মোহনার জীবনের প্রার্থনা এখন কি হতে পারে আমি দ্রুত ভাববার চেষ্টা করছিলাম। কিছু মনে পড়ছিল না। বিশ্রী এক ধাঁধার মতন আমার কাছে কয়েকটি প্রার্থনা আলোর লেখার মতন ফুটে উঠছিল, নিবছিল, আবার ফুটে উঠছিল। মোহনা কি প্রেম চাইবে? মোহনা কি সত্যিই কোনো সঙ্গী প্রার্থনা করবে? মোহনা কি সুখ শান্তি কামনা করবে? কি যে চাইতে পারে মোহনা আমি স্থির করতে পারছিলাম না। এই শেষ সময়ে মোহনা আমায় বিপদে ফেলেছে।
আমার কিছু মনে এল না। মোহনার নির্বাক, স্তব্ধ, করুণ অথচ বিহুল চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার মনে হল, জীবনের কোনো গোপন নিভৃত স্থান থেকে মোহনা আচমকা এক প্রার্থনার বোধ পেয়েছে। সে ছোট কিছু চায় না, আপাত কিছু চায় না। তার প্রার্থনা হয়ত এত বেশি যে তার অবশিষ্ট নামমাত্র সম্পদে সে অভাব পূর্ণ হবার নয়।
মোহনা আবার বলল, “বল ফুলদা, এখন আমি কি চাই?”
মাথা নেড়ে বললাম, “জানি না।”
মোহনা আর কিছু বলল না, আমার চোখে চোখ রেখে নিঃস্বের মতন বসে থাকল।