মোল্লা নাসীরুদ্দীনের গল্প – ৫০

৫০

নাসীরুদ্দীন বাজার গিয়ে দেখে সারি সারি খাঁচায় ময়না বিক্রি হচ্ছে, সেগুলির দাম একেকটা পঞ্চাশ টাকা।

পরদিন সে তার ধাড়ি মুরগীটাকে নিয়ে বাজারে হাজির, ভাবছে সেটাকে বিক্রি করে মোটা টাকা পাবে।

যখন দেখল যে পাঁচ টাকার বেশি দাম দিতে চায় না কেউ, তখন সে তম্বি শুরু করলে। তাই দেখে একজন লোক এসে তাকে বললে, ‘মোল্লাসাহেব, কালকের পাখিগুলো যে কথা বলতে পারে, তাই এত দাম। তোমার মুরগী কথা বলে কি?’

নাসীরুদ্দীন চোখ রাঙিয়ে বললে, ‘পুঁচকে পাখি বক্‌বক্‌ করে কানের পোকা নড়িয়ে দিলে তার হয়ে গেল পঞ্চাশ টাকা দাম, আর আমার এত বড় মুরগী নিজের ভাবনা নিয়ে চুপচাপ থাকে বলে তার কদর নেই? যত সব ইয়ে!’

 ৫১

নাসীরুদ্দীন বাজার থেকে খাবার আনে, আর তার গিন্নী সেগুলো লুকিয়ে এক বন্ধুকে দিয়ে দেয়।

‘ব্যাপার কি বল ত?’ একদিন মোল্লা বললে—‘খাবারগুলো যায় কোথায়?’

‘বেড়ালে চুরি করে’, বললেন গিন্নী।

কথাটা শুনেই নাসীরুদ্দীন তার সাধের কুড়ুলটা এনে আলমারির ভিতর লুকিয়ে ফেললে।

‘ওটা কী হল?’ জিগ্যেস করলেন গিন্নী।

‘বেড়াল যদি দশ পয়সার খাবার চুরি করতে পারে’ বললে নাসীরুদ্দীন, ‘তাহলে দশ টাকার কুড়ুলটা বাইরে ফেলে রাখি কোন ভরসায়?’

 ৫২

এক চোর নাসীরুদ্দীনের বাড়িতে ঢুকে তার প্রায় সর্বস্ব চুরি করে রওনা দিল নিজের বাড়ির দিকে।

নাসীরুদ্দীন রাস্তা থেকে সব দেখে একটি কম্বল কাঁধে নিয়ে চোরের পিছু ধাওয়া করে তার বাড়িতে ঢুকে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।

‘কে হে তুমি?’ চোর জিগ্যেস করলে, ‘আমার বাড়িতে কেন?’

‘আমার জিনিস যখন সবই এখানে’, বললে নাসীরুদ্দীন এখন থেকে এটাই আমার বাড়ি নয় কি?’

 ৫৩

সুসংবাদ দিলে বকশিস পায় জেনে একজন লোক নাসীরুদ্দীনকে গিয়ে বললে, ‘তোমার জন্য খুব ভালো খবর আছে, মোল্লাসাহেব।’

‘কী খবর?’

‘তোমার পাশের বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।’

‘তাতে আমার কী?’

‘তোমাকে সে পোলাওয়ের ভাগ দেবে বলছে।’

‘তাতে তোমার কী?’

 ৫৪

নাসীরুদ্দীন একটি সরাইখানার তত্ত্বাবধায়কের কাজে বহাল হয়েছে। একদিন সেখানে স্বয়ং সম্রাট সদলবলে এসে বললেন তিনি ডিমভাজা খাবেন।

খাওয়া শেষ করে শাহেন শা নাসীরুদ্দীনকে বললেন, ‘এবার আমরা শিকারে যাব। বল কত দিতে হবে তোমাদের?’

‘জাঁহাপনা’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘ডিমভাজার জন্য লাগবে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা।’

সম্রাটের চোখ কপালে উঠল। ‘ডিম কি এখানে এতই দুষ্প্রাপ্য?’ তিনি প্রশ্ন করলেন।

‘আজ্ঞে না জাঁহাপনা’, বললে নাসীরুদ্দীন। ‘ডিম দুষ্প্রাপ্য নয়। দুষ্প্রাপ্য হল সম্রাটের মত খদ্দের।’

 ৫৫

নাসীরুদ্দীনের গানবাজনা শেখার শখ হয়েছে। এক জবরদস্ত ওস্তাদের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলে, ‘আপনি বাদ্যযন্ত্র শেখাতে কত নেন?’

‘প্রথম মাসে তিন রৌপ্যমুদ্রা, তারপর থেকে প্রতিমাসে এক রৌপ্যমুদ্রা।’

‘বেশ, তাহলে দ্বিতীয় মাস থেকেই শুরু করব আমি’, বললে নাসীরুদ্দীন।

 ৫৬

নাসীরুদ্দীন নদীর ধারে বসে আছে, এমন সময় দেখে ন’জন অন্ধ নদী পেরোবার তোড়জোড় করছে।

নাসীরুদ্দীন তাদের কাছে প্রস্তাব করলে যে জনপিছু এক পয়সা করে নিয়ে সে ন’জনকে পরপর কাঁধে করে পার করে দেবে। অন্ধরা রাজি হয়ে গেল।

নাসীরুদ্দীন আটজনকে পার করে ন’ নম্বরের বেলায় মাঝনদীতে হোঁচট খেতে পিঠের অন্ধ জলে তলিয়ে গেল।

বাকি আটজন দেরি দেখে ওপার থেকে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলে, ‘কী হল মোল্লাসাহেব?’

‘এক পয়সা বাঁচল তোমাদের’, বললে নাসীরুদ্দীন।

 ৫৭

এক সন্ধ্যায় নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নাসীরুদ্দীন কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রমাদ গুনলে। নির্ঘাৎ এরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে শাহেন শা-র ফৌজে ভর্তি করে দেবে।

রাস্তার পাশেই গোরস্থান; নাসীরুদ্দীন এক দৌড়ে তাতে ঢুকে ঘাপটি মেরে রইল।

ঘোড়সওয়াররা কৌতূহলী হয়ে গোরস্থানে ঢুকে দেখে নাসীরুদ্দীন একটা কবরের ধারে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। ‘এখানে কী হচ্ছে মোল্লাসাহেব?’ তারা অবাক হয়ে জিগ্যেস করলে।

নাসীরুদ্দীন বুঝলে তার আঁচে গলতি হয়েছে। সে বললে, ‘সব প্রশ্নের ত আর সহজ উত্তর হয় না। যদি বলি যে তোমাদের জন্যেই আমার এখানে আসা, আর আমার জন্যেই তোমাদের এখানে আসা, তাহলে কিছু বুঝবে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *