মোল্লা নাসীরুদ্দীনের গল্প – ৪০

 ৪০

নাসীরুদ্দীন একটা মনিহারী দোকানে গিয়ে জিগ্যেস করলে, ‘এখানে পেরেক পাওয়া যায়?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ’, বললে দোকানদার।

‘আর চামড়া?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, যায়।’

‘আর সুতো?’

‘যায়, আজ্ঞে।’

‘আর রঙ?’

‘তাও যায়।’

‘তাহলে তুমি বসে না থেকে একটা জুতো তৈরি করে ফেলনা বাপু!’

 ৪১

সরাইখানায় ক’জন সৈনিকের আগমন হয়েছে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বীরত্বের বড়াই করছে। একজন বললে, ‘খোলা তলোয়ার হাতে এমন তেজের সঙ্গে ছুটলাম আমি দুষমনদের দিকে যে তারা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমায় রোখে কার সাধ্য!’

সবাই একথা শুনে সমস্বরে বাহবা দিলে। নাসীরুদ্দীনও এককালে যুদ্ধ করেছে। সে বললে, ‘তোমার কথা শুনে আমার নিজের একটা যুদ্ধের ঘটনা মনে পড়ছে। এক শত্রুর পা কেটে ফেলেছিলাম তলোয়ারের এক কোপে।’

তাই শুনে এক প্রবীণ যোদ্ধা বললে, ‘ওইখানেই ত ভুল। কাটা উচিত ছিল মুণ্ডুটা।’

‘মুণ্ডু না থাকলে আর মণ্ডু কাটব কোত্থেকে?’ বললে নাসীরুদ্দীন।

 ৪২

এক পড়শী মোল্লাসাহেবের কাছে একগাছ দড়ি ধার চাইতে এসেছে।

‘পাবে না’ বললে নাসীরুদ্দীন।

‘কেন মোল্লাসাহেব?’

‘দড়ি কাজে লাগছে।’

‘ওটা ত মাটিতে পড়ে আছে আজ কদিন থেকে মোল্লাসাহেব।’

‘ওটাই কাজ।’

পড়শী তবু আশা ছাড়ে না। বললে, ‘কদিন চলবে কাজ মোল্লাসাহেব?’

‘যদ্দিন না ওটা ধার দেওয়া দরকার বলে মনে করি’ বললে নাসীরুদ্দীন।

 ৪৩

নাসীরুদ্দীন তার পুরোন বন্ধু জামাল সাহেবের দেখা পেয়ে ভারী খুশি। বললে, ‘বন্ধু, চল পাড়া বেড়িয়ে আসি।’

‘লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার এই মামুলি পোশাক চলবে না’, বললে জামাল সাহেব। নাসীরুদ্দীন তাকে একটি বাহারের পোশাক ধার দিলে।

প্রথম বাড়িতে গিয়ে নাসীরুদ্দীন গৃহকর্তাকে বললে, ‘ইনি হলেন আমার বিশিষ্ট বন্ধু জামাল সাহেব। এঁর পোশাকটা আসলে আমার।’

দেখা সেরে বাইরে বেরিয়ে এসে জামাল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার কেমনতরো আক্কেল হে! পোশাকটা যে তোমার সেটা কি না বললেই চলত না?’

পরের বাড়িতে গিয়ে নাসীরুদ্দীন বললে, ‘জামাল সাহেব আমার পুরোন বন্ধু। ইনি যে পোশাকটা পরেছেন সেটা কিন্তু ওঁর নিজেরই।’

জামাল সাহেব আবার খাপ্পা। বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘মিথ্যে কথাটা কে বলতে বলেছিল তোমায়?’

‘কেন?’ বললে নাসীরুদ্দীন, ‘তুমি যেমন চাইলে তেমনই ত বললাম।’

‘না’, বললেন জামাল সাহেব, ‘পোশাকের কথাটা না বললেই ভালো।’

তিন নম্বর বাড়িতে গিয়ে নাসীরুদ্দীন বললে, ‘আমার পুরোন বন্ধু জামাল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি যে পোশাকটা পরেছেন সেটার কথা অবিশ্যি না বলাই ভালো।’

 ৪৪

নাসীরুদ্দীনের ভারী শখ একটা নতুন জোব্বা বানাবে, তাই পয়সা জমিয়ে দরজির দোকানে গেল ফরমাস দিতে। দরজি মাপ নিয়ে বললে, ‘আল্লা করেন ত এক সপ্তাহ পরে আপনি জোব্বা পেয়ে যাবেন।’

নাসীরুদ্দীন এক সপ্তাহ কোনরকমে ধৈর্য ধরে তারপর আবার গেল দরজির দোকানে।

‘একটু অসুবিধা ছিল মোল্লাসাহেব’, বললে দরজি, ‘আল্লা করেন ত কাল আপনি অবশ্যই জোব্বা পেয়ে যাবেন।’

পরদিন গিয়েও হতাশ। ‘মাপ করবেন মোল্লাসাহেব’ বললে দরজি, ‘আর একটি দিন আমাকে সময় দিন। আল্লা করেন ত কাল সকালে নিশ্চয় রেডি পাবেন আপনার জোব্বা।’

নাসীরুদ্দীন এবার বললে, ‘আল্লা না করে তুমি করলে জোব্বাটা কবে পাব সেটা জানতে পারি কি?’

 ৪৫

মোল্লা এক ছোকরাকে মাটির কলসী দিয়ে পাঠালে কুয়ো থেকে জল তুলে আনতে। ‘দেখিস, কলসীটা ভাঙিসনি যেন’, বলে একটা থাপ্পড় মারলে ছোকরার গালে।

এক পথচারী ব্যাপারটা দেখে বললে, ‘কলসী না ভাঙতেই চড়টা মারলেন কেন মোল্লাসাহেব?’

‘তোমার যা বুদ্ধি’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘ভাঙার পরে চড় মারলে কি আর কলসী জোড়া লেগে যাবে?’

 ৪৬

এক প্রবীণ দার্শনিক সরাইখানায় বসে বিলাপ করছেন, ‘বিচিত্র জীব এই মানুষ। কোনো কিছুতেই তৃপ্তি নেই। শীতকালে বলে ঠাণ্ডায় মলাম, গ্রীষ্মে বলে গরমে প্রাণ আইঢাই।’

সবাই তার কথায় সায় দিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।

‘বসন্তের বিরুদ্ধে যার নালিশ আছে সে হাত তোল’, বললে নাসীরুদ্দীন।

 ৪৭

নাসীরুদ্দীন আর তার গিন্নী একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখে চোর এসে বাড়ি তছনছ করে দিয়ে গেছে। গিন্নী ত রেগে আগুন। বললে, ‘এ তোমার দোষ। সদর দরজায় তালা দাওনি তাই এই দশা।’

পড়শীরাও সেই একই সুর ধরলে। একজন বললে, ‘জানালাগুলোও ত ভালো করে বন্ধ করনি দেখছি।’

আরেকজন বললে, ‘চোর আসতে পারে সেটা আগেই বোঝা উচিত ছিল।’

আরেকজন বললে, ‘দরজার তালাগুলোও পরীক্ষা করে দেখা উচিত।’

‘কী আপদ!’ বললে নাসীরীন, ‘তোমরা দেখছি শুধু আমার পেছনেই লাগতে শুরু করলে।’

‘দোষ ত তোমারই মোল্লাসাহেব’, পড়শীরা বললে।

‘বটে?’ বললে নাসীরুদ্দীন, ‘আর চোরের বুঝি দোষ নেই?’

 ৪৮

নাসীরুদ্দীন এক আমীরের বাড়ি গেছে দুর্ভিক্ষের চাঁদা তুলতে। দারোয়ানকে বললে, ‘তোমার মনিবকে গিয়ে বল মোল্লাসাহেব চাঁদা নিতে এসেছেন।’

দারোয়ান ভিতরে গিয়ে মিনিট খানেক পরে ফিরে এসে বলল, ‘আজ্ঞে, মনিব একটু বাইরে গেছেন।’

‘তাহলে তোমায় একটা কথা বলে যাই’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘তোমার মনিব এলে তাঁকে বোল যে বেরোবার সময় তাঁর মুণ্ডুটা যেন জানালার ধারে রেখে না যান। কখন চোর আসে বলা কি যায়!’

 ৪৯

নাসীরুদ্দীন হামামে গেছে গোসল করতে। পরিচারক তার ছেঁড়া পোশাক দেখে আধখানা সাবান আর একটা ময়লা তোয়ালে ছুঁড়ে দিলে তার দিকে।

নাসীরুদ্দীন কিন্তু যাবার সময় তাকে ভালোরকম বকশিস দিয়ে গেল। পরিচারক ভাবলে, ‘এ কেমন হল? খাতির না করেই যদি এত পাওয়া যায় তাহলে খাতির করলে না জানি কত মিলবে!’

পরের সপ্তাহে নাসীরুদ্দীন আবার গেছে হামামে। এবার তাকে দেখেই পরিচারক একেবারে বাদশার হালে তার তোষামোদ করেছে। আচ্ছা রকম দলাই-মালাই করে, গায়ে আতর ছিটিয়ে দিয়ে, কাজের শেষে হাত পাততেই নাসীরুদ্দীন তাকে একটি তামার পয়সা দিয়ে বললে, ‘গতবারের জন্য এই বকশিস। এবারেরটা ত আগেই দেওয়া আছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *