৩০
কারো মত্যু হলে শোক জানানোর জন্য কালো পোশাক পরে মোল্লার দেশের লোকেরা। মোল্লাকে সেই পোশাকে হাঁটতে দেখে একজন জিগ্যেস করলে, ‘কেউ মরল নাকি, মোল্লাসাহেব?’
‘সাবধানের মার নেই’, বললে মোল্লাসাহেব, ‘কোথায় কখন কে মরছে তা কি কেউ বলতে পারে?’
৩১
নাসীরুদ্দীন বাজারে গিয়ে এক নিলামদারের হাতে তার গাধাটিকে তুলে দিলে। সেটাকে দিয়ে আর কাজ চলে না, তাই একটা নতুন গাধা কেনা দরকার।
আর পাঁচরকম জিনিস পাচার হয়ে যাবার পর গাধা যখন নিলামে উঠল, নাসীরুদ্দীন তখন কাছাকাছির মধ্যেই রয়েছে। নিলামদার হাঁক দিলে, ‘এবার দেখুন এই অসামান্য, অতুলনীয় গাধা। পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা কে দেবেন এর জন্য? মাত্র পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা!’
এক চাষা হাত তুললে। দর এত কম দেখে মোল্লাসাহেব নিজেই হেঁকে বসলেন, ‘ছয় স্বর্ণমুদ্রা।’
ওদিকে অন্য লোকেও ডাকতে শুর করেছে, আর নিলামদারও গাধার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দর যত বাড়ে ততই বাড়ে গুণের ফিরিস্তি।
চাষা ও মোল্লাসাহেবের মধ্যে ডাকাডাকিতে গাধার দাম চড়ে চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রায় পৌঁছে শেষটায় মোল্লাসাহেবেরই জিত হল। গাধার আসল দাম ছিল বিশ স্বর্ণমুদ্রা, অর্থাৎ লোকসান হল দ্বিগুণ।
কিন্তু তাতে কী এসে গেল? ‘যে গাধার এত গুণ’, বললে মোল্লাসাহেব, ‘তার জন্য চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রা ত জলের দর!’
৩২
নাসীরুদ্দীন নাকি বলে বেড়াচ্ছে যারা নিজেদের বিজ্ঞ বলে তারা আসলে কিচ্ছু জানে না। এই খবর শুনে দেশের সাতজন সেরা বিজ্ঞ নাসীরুদ্দীনকে রাজার কাছে ধরে এনে বললে, ‘শাহেন শা, এই ব্যক্তি অতি দুর্জন। ইনি আমাদের বদনাম করে বেড়াচ্ছেন। এর শাস্তির ব্যবস্থা হোক।’
রাজা নাসীরুদ্দীনকে জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার কিছু বলার আছে?’
‘আগে কাগজ-কলম আনা হোক, জাঁহাপনা,’ বললে নাসীরুদ্দীন।
কাগজ-কলম এল।
‘এদের সাতজনকে একটি করে দেওয়া হোক।’
তাও হল।
‘এবার সাতজনে আলাদা করে আমার প্রশ্নের জবাব লিখুন। প্রশ্ন হল—রুটির অর্থ কী?’
সাত পণ্ডিত উত্তর লিখে রাজার হাতে কাগজ দিয়ে দিলেন, রাজা পর পর উত্তরগুলো পড়ে গেলেন।
পয়লা নম্বর লিখেছেন—রুটি একপ্রকার খাদ্য।
দুই নম্বর—ময়দা ও জলের সংমিশ্রণে তৈয়ারি পদার্থকে বলে রুটি।
তিন নম্বর—রুটি ঈশ্বরের দান।
চার নম্বর—একপ্রকার পুষ্টিকর আহার্যকে বলে রুটি।
পাঁচ নম্বর—রুটির অর্থ করতে গেলে আগে জানা দরকার, কোনপ্রকার রুটির কথা বলা হচ্ছে।
ছয় নম্বর—রুটির অর্থ এক মূর্খ ব্যক্তি ছাড়া সকলেই জানে।
সাত নম্বর—রুটির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার।
উত্তর শুনে নাসীরুদ্দীন বললে, ‘জাঁহাপনা, যে জিনিস এঁরা প্রতিদিন খাচ্ছেন, তার মানে এঁরা সাতজন সাতরকম করলেন, অথচ যে লোককে এঁরা কখনো চোখেই দেখেন নি তাকে সকলে একবাক্যে নিন্দে করছেন। এক্ষেত্রে কে বিজ্ঞ কে মূর্খ সেটা আপনিই বিচার করুন।’
রাজা নাসীরুদ্দীনকে বেকসুর খালাস দিলেন।
৩৩
মোল্লাগিন্নী মাঝরাত্তিরে নাসীরুদ্দীনের ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, ‘ব্যাপার কী? চশমা পরে ঘুমোচ্ছ কেন?’
মোল্লা নতুন চশমা নিয়েছে। খাপ্পা হয়ে বললে, ‘চোখে চাল্শে পড়েছে, চশমা ছাড়া স্বপ্ন দেখব কী করে?’
৩৪
নাসীরুদ্দীন রাজাকে একটা সুখবর দেবে, তাই অনেক কসরৎ করে রাজসভায় গিয়ে হাজির হয়েছে। রাজা খবর শুনে খুশি হয়ে বললেন, ‘কী বকশিস চাও বল।’
‘পঞ্চাশ ঘা চাবুক’, বললে নাসীরুদ্দীন।
রাজা অবাক, তবে নাসীরুদ্দীন যে মসকরা করছে না সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যায়। হকুম হল পঞ্চাশ ঘা চাবুকের।
পঁচিশ ঘায়ের পর নাসীরুদ্দীন বললে, ‘থামো!’
চাবুক থামল। ‘বাকি পঁচিশ ঘা পাবে আমার অংশীদার’, বললে নাসীরুদ্দীন। রাজপেয়াদা আমার সঙ্গে কড়ার করেছিল সুখবর পেয়ে রাজা বকশিস দিলে তার অর্ধেক তাকে দিতে হবে।’
৩৫
রাজদরবারে নাসীরুদ্দীনের খুব খাতির।
একদিন খুব খিদের মুখে বেগুন ভাজা খেয়ে ভারী খুশি হয়ে রাজা নাসীরুদ্দীনকে বললেন, ‘বেগুনের মতো এমন সুস্বাদু খাদ্য আর আছে কি?’
‘বেগুনের জবাব নেই’, বললে নাসীরুদ্দীন।
রাজা হুকুম দিলেন, ‘এবার থেকে রোজ বেগুন খাব।’
তারপর পাঁচদিন দুবেলা বেগুন খেয়ে ছ’দিনের দিন রাজা হঠাৎ বেঁকে বসলেন। খানসামাকে ডেকে বললেন, ‘দূর করে দে আমার সামনে থেকে এই বেগুন ভাজা।’
‘বেগুন অখাদ্য’, সায় দিয়ে বললে নাসীরুদ্দীন।
রাজা একথা শুনে ভারী অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কী মোল্লাসাহেব, তুমি যে এই সেদিনই বললে বেগুনের জবাব নেই!’
‘আমি ত আপনার মোসাহেব, জাঁহাপনা’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘বেগুনের ত নই।’
৩৬
নাসীরুদ্দীনের দজ্জাল গিন্নী ফুটন্ত সুরুয়া এনে কর্তার সামনে রাখল তার জিভ পুড়িয়ে তাকে জব্দ করবে বলে, কিন্তু ভুলে সে নিজেই দিয়ে ফেলেছে তাতে চুমুক। ফলে তার চোখে জল এসে গেছে।
নাসীরুদ্দীন তাই দেখে বলে, ‘হল কী? কাঁদছ নাকি?’
গিন্নী বললেন, ‘মা মারা যাবার ঠিক আগে সুরুয়া খেয়েছিলেন, আহা! সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।’
এবার নাসীরুদ্দীনও সুরুয়ায় চুমুক দিয়েছে, আর তার ফলে তারও চোখ ফেটে জল।
‘সে কি, তুমিও কাঁদছ নাকি?’ শুধোলেন গিন্নী।
নাসীরুদ্দীন বললে, ‘তোমায় জ্যান্ত রেখে তোমার মা মারা গেলেন, এটা কি খুব সুখের কথা?’
৩৭
নাসীরুদ্দীন সরাইখানায় ঢুকে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করলে, ‘সূর্যের চেয়ে চাঁদের উপকারিতা অনেক বেশি।’
‘কেন মোল্লাসাহেব?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে সবাই।
‘চাঁদ আলো দেয় রাত্তিরে’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘দিনে আলোর দরকারটা কি শুনি?’
৩৮
নাসীরুদ্দীন এক পড়শীর কাছে গিয়ে হাত পাতলে। ‘এক গরীব তার দেনা শোধ করতে পারছে না। তার সাহায্যে যদি কিছু দ্যান।’
পড়শীর মনটা দরাজ, সে খুশি হয়ে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললে, ‘আহা বেচারী! এই ঋণগ্রস্ত অভাগাটি কে, মোল্লাসাহেব?’
‘আমি’, বলে নাসীরুদ্দীন হাওয়া।
কিছুদিন পরে নাসীরুদ্দীন আবার সেই পড়শীর কাছে এসে হাত পেতেছে। পড়শী একবার ঠকে সেয়ানা হয়ে গেছে। বললে, ‘বুঝেছি। দেনাদারটি এবারও তুমিই ত?’
‘আজ্ঞে না। বিশ্বাস করুন। এবার সত্যিই আমি না।’
পড়শীর আবার মন ভিজল। নাসীরুদ্দীনের হাতে টাকা দিয়ে বললে, ‘এবার কার দুঃখ দুর করতে যাচ্ছ মোল্লাসাহেব?’
‘আজ্ঞে, আমার।’
‘কিরকম?’
‘আজ্ঞে এই অধম এবার পাওনাদার।’
৩৯
নাসীরুদ্দীন তার এক বন্ধুকে নিয়ে সরাইখানায় ঢুকেছে দুধ খাবে বলে। পয়সার অভাব, তাই এক গেলাস দুধ দুজন আধাআধি করে খাবে।
বন্ধু বললে, ‘তুমি আগে খেয়ে নাও তোমার অর্ধেক। বাকিটা আমি পরে চিনি দিয়ে খাব।’
‘চিনিটা আগেই দাও না ভাই’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘তাহলে দুজনেরই দুধ মিষ্টি হবে।’
বন্ধু মাথা নাড়লে। ‘আধ গেলাসের মতো চিনি আছে আমার সঙ্গে, আর নেই।’
নাসীরুদ্দীন সরাইখানার মালিকের সঙ্গে দেখা করে খানিকটা নুন নিয়ে এল। ‘ঠিক আছে,’ সে বললে বন্ধুকে, ‘এই নুন ঢাললাম দুধে। আমি অর্ধেক নোনতা খাব, বাকি অর্ধেক মিষ্টি খেও তুমি।’