২০
এক ধনীর বাড়িতে ভোজ হবে খবর পেয়ে নাসীরুদ্দীন সেখানে গিয়ে হাজির।
ঘরের মাঝখানে বিশাল টেবিলের উপর লোভনীয় সব খাবার সাজানো রয়েছে রুপোর পাত্রে। টেবিল ঘিরে কুরসি পাতা, তাতে বসেছেন হোমরা-চোমরা সব খাইয়েরা। নাসীরুদ্দীন সেদিকে এগোতেই কর্মকর্তা তার মামুলি পোশাক দেখে তাকে ঘরের এক কোনায় ঠেলে দিলেন। নাসীরুদ্দীন বুঝলে সেখানে খাবার পৌঁছতে হয়ে যাবে রাত কাবার। সে আর সময় নষ্ট না করে সোজা বাড়ি ফিরে গিয়ে তোরঙ্গ থেকে তার ঠাকুরদাদার আমলের একটা ঝলমলে আলখাল্লা আর একটা মণিমুক্তো বসানো আলিশান পাগড়ি বার করে পরে আবার নেমন্তন্ন বাড়িতে ফিরে গেল।
এবার কর্মকর্তা তাকে একেবারে খাস টেবিলে বসিয়ে দিলেন, আর বসামাত্র নাসীরুদ্দীনের সামনে এসে হাজির হল ভুরভুরে খুশবুওয়ালা পোলাওয়ের পাত্র। নাসীরুদ্দীন প্রথমেই পাত্র থেকে খানিকটা পোলাও তুলে নিয়ে তার আলখাল্লায় আর পাগড়িতে মাখিয়ে দিলে। পাশে বসেছিলেন এক আমীর। তিনি ভারী অবাক হয়ে বললেন, ‘জনাব, আপনি খাদ্যদ্রব্য যেভাবে ব্যবহার করছেন তা দেখে আমার কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অর্থ জানতে পারলে আমি বিশেষ বাধিত হব।’
‘অর্থ খুবই সোজা’, বললে নাসীরুদ্দীন। ‘এই আলখাল্লা আর এই পাগড়ির দৌলতেই আমার সামনে এই ভোজের পাত্র। এদের ভাগ না দিয়ে আমি একা খাব সে কি হয়?’
২১
মোল্লাগিন্নী একটা শব্দ পেয়ে ছুটে গেছে তার স্বামীর ঘরে।
‘কী হল? কিসের শব্দ?’
‘আমার জোব্বাটা মাটিতে পড়ে গেস্ল’, বললে মোল্লাসাহেব।
‘তাতেই এত শব্দ?’
‘আমি ছিলাম জোব্বার ভেতর।’
২২
বোগদাদের খালিফের প্রাসাদে ভোজ হবে, তিন হাজার হোমরা-চোমরার নেমন্তন্ন হয়েছে। ঘটনাচক্রে নাসীরুদ্দীনও সেই দলে পড়ে গেছে।
খালিফের বাড়িতে ভোজ, চাট্টিখানি কথা নয়। অতিথি সৎকারে খালিফের জুড়ী দুনিয়ায় নেই। তেমনি তাঁর বাবুর্চিটিও একটি প্রবাদপুরুষ। তার রান্নার যেমনি স্বাদ, তেমনি গন্ধ, তেমনি চেহারা।
সব খাদ্যের শেষে বিরাট বিরাট পাত্রে এল একেকটি আস্ত ময়ূর। দেখে মনে হবে ময়ূর বুঝি জ্যান্ত, যদিও আসলে সেগুলো রোস্ট করা। ডানা, ঠোঁট, পুচ্ছ সবই আছে, আর সবকিছুই তৈরি রঙবেরঙের উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য দিয়ে।
নিমন্ত্রিতেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে আছে রন্ধনশিল্পের এই অপূর্ব নিদর্শনের দিকে, কেউই যেন আর খাবার কথা ভাবছেনা।
নাসীরুদ্দীনের খিদে এখনো মেটেনি। সে কিছুক্ষণ ব্যাপার-স্যাপার দেখে আর থাকতে না পেরে বলে উঠল, ‘এই বিচিত্র প্রাণীটি আমাদের ভক্ষণ করার আগে আমাদেরই এটিকে ভক্ষণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না কি?’
২৩
নাসীরুদ্দীন একবার ভারতবর্ষে এসে এক সাধুর দেখা পেয়ে ভাবলে, ‘আমার মতো জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তির পক্ষে সাধুর সাক্ষাৎ পাওয়া পরম সৌভাগ্য। এঁর সঙ্গে আলাপ না করলেই নয়।’
তাঁকে জিজ্ঞেস করতে সাধু বললেন তিনি একজন যোগী; ঈশ্বরের সৃষ্ট যত প্রাণী আছে সকলের সেবাই তাঁর ধর্ম।
নাসীরুদ্দীন বললে, ঈশ্বরের সৃষ্ট একটি মৎস্য একবার আমাকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করেছিল।’
একথা শুনে যোগী আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, ‘আমি এত দীর্ঘকাল প্রাণীর সেবা করেও তাদের এত অন্তরঙ্গ হতে পারিনি। একটি মৎস্য আপনার প্রাণরক্ষা করেছে শুনে এই দেখুন আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন না ত কে থাকবে?’
নাসীরুদ্দীন যোগীর সঙ্গে থেকে তার কাছ থেকে যোগের নানান কসরৎ শিক্ষা করলে। শেষে একদিন যোগী বললেন, ‘আর ধৈর্য রাখা সম্ভব নয়। অনুগ্রহ করে যদি সেই মৎস্যের উপাখ্যানটি শোনান।’
‘একান্তই শুনবেন?’
‘হে গুরু!’ বললেন যোগী, ‘শোনার জন্য আমি উদ্গ্রীব হয়ে আছি।’
‘তবে শুনুন’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘একবার খাদ্যাভাবে প্রাণ যায় যায় অবস্থায় আমার বঁড়শীতে একটি মাছ ওঠে। আমি সেটা ভেজে খাই।’
২৪
একদিন এক জ্ঞাতি এসে নাসীরুদ্দীনকে একটা হাঁস উপহার দিলে। নাসীরুদ্দীন ভারী খুশি হয়ে সেটার মাংস রান্না করে জ্ঞাতিকে খাওয়ালে।
কয়েকদিন পরে মোল্লাসাহেবের কাছে একজন লোক এসে বললে, ‘আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তাঁর বন্ধু।’
নাসীরুদ্দীন তাকেও মাংস খাওয়ালে।
এরপর আরেকদিন আরেকজন এসে বলে, ‘আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধু।’ নাসীরুদ্দীন তাকেও খাওয়ালে।
তারপর এল বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। মোল্লাসাহেব তাকেও খাওয়ালে।
এর কিছুদিন পরে আবার দরজায় টোকা পড়ল। ‘আপনি কে?’ দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলে নাসীরুদ্দীন।
‘আজ্ঞে মোল্লাসাহেব, যিনি আপনাকে হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু।
‘ভেতরে আসুন’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘খাবার তৈরিই আছে।’
অতিথি মাংসের ঝোল দিয়ে পোলাও মেখে একগ্রাস খেয়ে ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন, ‘এটা কিসের মাংস মোল্লাসাহেব?’
‘হাঁসের বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর’, বললে নাসীরুদ্দীন।
২৫
নাসীরুদ্দীন একদিন রাজসভায় হাজির হল মাথায় এক বিশাল বাহারের পাগড়ি পরে। তার মতলব সে রাজাকে পাগড়িটা বিক্রি করবে।
‘তোমার ওই আশ্চর্য পাগড়িটা কত মূল্যে খরিদ করলে মোল্লাসাহেব?’ রাজা প্রশ্ন করলেন।
‘সহস্র স্বর্ণমুদ্রা, শাহেন শা!’
এক উজীর মোল্লার মতলব আঁচ করে রাজার কানে ফিসফিস্ করে বললে, ‘মূর্খ না হলে কেউ ওই পাগড়ির জন্য অত দাম দিতে পারে না, জাঁহাপনা।’
রাজা মোল্লাকে বললেন, ‘অত দাম কেন? একটা পাগড়ির জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা যে অবিশ্বাস্য।’
‘মূল্যের কারণ আর কিছুই না, জাঁহাপনা’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘আমি জানি দুনিয়ায় কেবল একজন বাদশাই আছেন যিনি এই পাগড়ি খরিদ করতে পারেন।’
তোষামোদে খুশি হয়ে রাজা তৎক্ষণাৎ মোল্লাকে দুহাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবার ব্যবস্থা করে নিজে পাগড়িটা কিনে নিলেন।
মোল্লা পরে সেই উজীরকে বললে, ‘আপনি পাগড়ির মূল্য জানতে পারেন, কিন্তু আমি জানি রাজাদের দুর্বলতা কোথায়।’
২৬
নাসীরুদ্দীন এক বাড়িতে চাকরের কাজ করছে। মনিব তাকে একদিন ডেকে বললেন, ‘তুমি অযথা সময় নষ্ট কর কেন হে ঝপু? তিনটে ডিম আনতে কেউ তিনবার বাজার যায়? এবার থেকে একবারে সব কাজ সেরে আসবে।’
একদিন মনিবের অসুখ করেছে, তিনি নাসীরুদ্দীনকে ডেকে বললেন, ‘হাকিম ডাক।’
নাসীরুদ্দীন গেল, কিন্তু ফিরল অনেক দেরিতে, আর সঙ্গে একগুষ্টি লোক নিয়ে।
মনিব বললেন, ‘হাকিম কই?’
‘তিনি আছেন, আর সঙ্গে আরো আছেন,’ বললে নাসীরুদ্দীন।
‘আরো কেন?’
‘আজ্ঞে হাকিম যদি বলেন পুলটিশ দিতে, তার জন্য লোক চাই। জল গরম করতে কয়লা লাগবে, কয়লাওয়ালা চাই। আপনার শ্বাস উঠলে পর কোরান পড়ার লোক চাই, আর আপনি মরলে পরে লাশ বইবার লোক চাই।’
২৭
থলেতে একঝুড়ি ডিম লুকিয়ে নিয়ে নাসীরুদ্দীন চলেছে ভিন্দেশে। সীমানায় পৌঁছতে শুল্ক বিভাগের লোক তাকে ধরলে। নাসীরুদ্দীন জানে ডিম চালান নিষিদ্ধ।
‘মিথ্যে বললে মত্যুদণ্ড’, বললে শুল্ক বিভাগের লোক। ‘তোমার থলেতে কী আছে বল।’
‘প্রথম অবস্থার কিছু মুরগী’, বললে মোল্লাসাহেব।
‘হুম—সমস্যার কথা। মুরগী চালান নিষিদ্ধ কিনা খোঁজ নিতে হবে, তারপর ব্যাপারটার মীমাংসা হবে। ততদিন এ থলি রইল আমাদের জিম্মায়। ভয় নেই, তোমার মুরগীকে উপোস রাখবনা আমরা।’
‘কিন্তু আমার মুরগীর জাত যে একটু আলাদা’, বললে নাসীরুদ্দীন।
কিরকম?’
‘আপনার ত শুনেছেন অবহেলার দরুন মুরগীর অকাল বার্ধক্য আসে।’
‘তা শুনেছি বটে।’
‘আমার মুরগীকে ফেলে রাখলে সেগুলো অকালে শিশু হয়ে যায়!’
‘শিশু মানে?’
‘একেবারে শিশু,’ বললে নাসীরুদ্দীন, ‘যাকে বলে ডিম।’
২৮
মোল্লা মসজিদে গিয়ে বসেছে, তার জোব্বাটা কিঞ্চিৎ খাটো দেখে তার পিছনের লোক সেটাকে টেনে খানিকটা নামিয়ে দিলে। মোল্লাও তৎক্ষণাৎ তার সামনের লোকের জোব্বাটা ধরে নিচের দিকে দিলে এক টান। তাতে লোকটি পিছন ফিরে চোখ রাঙিয়ে বললে, ‘এটা কী হচ্ছে?’
মোল্লা বললে, ‘এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে আমার পিছনের লোক।’
২৯
নাসীরুদ্দীন মওকা বুঝে একজনের সবজির বাগানে গিয়ে হাতের সামনে যা পায় থলেতে ভরতে শুরু করেছে।
এদিকে মালিক এসে পড়েছেন। কাণ্ড দেখে তিনি হন্তদন্ত নাসীরুদ্দীনের দিকে ছুটে এসে বললেন, ব্যাপারটা কী?’
নাসীরুদ্দীন বললে, ‘ঝড়ে উড়িয়ে এনে ফেলেছে আমায় এখানে।’
‘আর ক্ষেতের সবজিগুলোকে উপড়ে ফেলল কে?
‘ওড়ার পথে ওগুলিকে খামচে ধরে তবে ত রক্ষা পেলাম।’
‘আর সবজিগুলো থলের মধ্যে গেল কী করে?’
‘সেই প্রশ্নই ত আমাকেও চিন্তায় ফেলেছিল, এমন সময় আপনি এসে পড়লেন।’