মোল্লা নাসীরুদ্দীনের গল্প – ১০

১০

নাসীরুদ্দীন বাড়ির ছাতে কাজ করছে, এমন সময় এক ভিখিরি রাস্তা থেকে হাঁক দিল, ‘মোল্লাসাহেব, একবারটি নিচে আসবেন?’

নাসীরুদ্দীন ছাত থেকে রাস্তায় নেমে এল। ভিখিরি বলল, ‘দুটি ভিক্ষে দেবেন মোল্লাসাহেব?’

‘তুমি এই কথাটা বলার জন্য আমায় ছাত থেকে নামালে?’

ভিখিরি কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘মাপ করবেন মোল্লাসাহেব, -গলা ছেড়ে ভিক্ষে চাইতে শরম লাগে।’

‘হুঁ…তা তুমি ছাতে এসো আমার সঙ্গে।’

ভিখিরি তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে ছাতে ওঠার পর নাসীরুদ্দীন বললে, ‘তুমি এসো হে: ভিক্ষেটিক্ষে হবে না।’

 ১১

নাসীরুদ্দীন একজন লোককে মুখ ব্যাজার করে রাস্তার ধারে বসে থাকতে দেখে জিগ্যেস করলে তার কী হয়েছে। লোকটা বললে, ‘আমার জীবন বিষময় হয়ে গেছে মোল্লাসাহেব। হাতে কিছু পয়সা ছিল, তাই নিয়ে দেশ ঘুরতে বেরিয়েছি, যদি কোনো সুখের সন্ধান পাই।’

লোকটির পাশে তার বোঁচকায় কতগুলো জিনিসপত্র রাখা ছিল। তার কথা শেষ হওয়ামাত্র নাসীরুদ্দীন সেই বোঁচকাটা নিয়ে বেদম বেগে দিলে চম্পট। লোকটাও হাঁ হাঁ করে তার পিছু নিয়েছে, কিন্তু নাসীরুদ্দীনকে ধরে কার সাধ্য! দেখতে দেখতে সে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে হাওয়া। এই ভাবে লোকটিকে মিনিটখানেক ধোঁকা দিয়ে সে আবার সদর রাস্তায় ফিরে বোঁচকাটাকে রাস্তার মাঝখানে রেখে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। এদিকে সেই লোকটিও কিছুক্ষণ পরে এসে হাজির। তাকে এখন আগের চেয়েও দশগুণ বেশি বেজার দেখাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় তার বোঁচকাটা পড়ে আছে দেখেই সে মহাফুর্তিতে একটা চিৎকার দিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

গাছের আড়াল থেকে নাসীরুদ্দীন বললে, ‘দুঃখীকে সুখের সন্ধান দেবার এও একটা উপায়।’

 ১২

নাসীরুদ্দীন লেখাপড়া বেশি জানে না ঠিকই, কিন্তু তার গাঁয়ে এমন অনেক লোক আছে যাদের বিদ্যে তার চেয়েও অনেক কম। তাদেরই একজন নাসীরুদ্দীনকে দিয়ে নিজের ভাইকে একটা চিঠি লেখালে। লেখা শেষ হলে পর সে বললে, ‘মোল্লাসাহেব কী লিখলেন একবারটি পড়ে দেন, যদি কিছু বাদটাদ গিয়ে থাকে।’

নাসীরুদ্দীন ‘প্রিয় ভাই আমার’ পর্যন্ত পড়ে ঠেকে গিয়ে বললে, ‘পরের কথাটা ‘বাক্স’ না ‘গরম’ না ‘ছাগল’ সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’

‘সেকি মোল্লাসাহেব, আপনার লেখা চিঠি আপনিই পড়তে পারেন না ত অপরে পড়বে কী করে?’

‘সেটা আমি কী জানি?’ বললে নাসীরুদ্দীন। ‘আমায় লিখতে বললে আমি লিখলাম। পড়াটাও কি আমার কাজ নাকি?’

লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে বলল, ‘তা ঠিকই বললেন বটে। আর এ চিঠি ত আপনাকে লেখা নয়, কাজেই আপনি পড়তে না পারলে আর ক্ষতি কী?’

‘হক্ কথা,’ বললে নাসীরুদ্দীন।

 ১৩

একদিন রাত্রে দুজনের পায়ের শব্দ পেয়ে নাসীরুদ্দীন ভয়ে একটা আলমারিতে ঢুকে লুকিয়ে রইল।

লোকদুটো ছিল চোর। তারা বাক্সপ্যাঁটরা সবই খুলছে, সেই সঙ্গে আলমারিটাও খুলে দেখে তাতে মোল্লাসাহেব ঘাপটি মেরে আছেন।

‘কী হল মোল্লাসাহেব, লুকিয়ে কেন?’

‘লজ্জায়’, বললে নাসীরুদ্দীন। ‘আমার বাড়িতে তোমাদের নেবার মতো কিছুই নেই তাই লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না ভাই।’

 ১৪

নাসীরুদ্দীন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, পাশে ফুলে ফলে ভরা বাগিচা দেখে তার মধ্যে গিয়ে ঢুকল। প্রকৃতির শোভাও উপভোগ করা হবে, শর্টকাটও হবে।

কিছুদুর যেতে না যেতেই নাসীরুদ্দীন এক গর্তের মধ্যে পড়ল, আর পড়তেই তার মনে এক চিন্তার উদয় হল।

‘ভাগ্যে পথ ছেড়ে বনে ঢুকেছিলাম’, ভাবলে নাসীরুদ্দীন। ‘এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশেই যদি এমন বিপদ লুকিয়ে থাকে, তাহলে না-জানি ধুলো-কাদায় ভরা রাস্তায় কত নাজেহাল হতে হত!’

 ১৫

রাজামশাই একদিন নাসীরুদ্দীনকে ডেকে বললেন, ‘বনে গিয়ে ভাল্লুক মেরে আনো।’

নাসীরুদ্দীন রাজার আদেশ অমান্য করে কী করে? অগত্যা তাকে যেতেই হল।

বন থেকে ফেরার পর একজন তাকে জিগ্যেস করলে, ‘কেমন হল শিকার, মোল্লাসাহেব?’

‘চমৎকার’, বললে নাসীরুদ্দীন।

‘কটা ভাল্লুক মারলেন?’

‘একটিও না।’

‘বটে? কটাকে ধাওয়া করলেন?’

‘একটিও না।’

‘সে কী! কটা দেখলেন?’

‘একটিও না।’

‘তাহলে চমৎকারটা হল কী করে?’

‘ভাল্লুক শিকার করতে গিয়ে সে-জানোয়ারের দেখা না পাওয়ার চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে?’

 ১৬

এক চাষা নাসীরুদ্দীনের কাছে এসে বলল, ‘বাড়িতে চিঠি দিতে হবে মোল্লাসাহেব। মেহেরবানি করে আপনি যদি লিখে দেন।’

নাসীরুদ্দীন মাথা নাড়লে। ‘সে হবে না।’

‘কেন মোল্লাসাহেব?’

‘আমার পায়ে জখম।’

‘তাতে কী হল মোল্লাসাহেব?’ চাষা অবাক হয়ে বললে, ‘পায়ের সঙ্গে চিঠির কী?’

নাসীরুদ্দীন বললে, ‘আমার হাতের লেখা কেউ পড়তে পারে না। তাই চিঠির সঙ্গে আমাকেও যেতে হবে সে চিঠি পড়ে দিতে। জখম পায়ে সেটা হবে কি করে শুনি?’

 ১৭

এক বেকুবের শখ হয়েছে সে পণ্ডিত হবে। সে মনে মনে ভাবলে মোল্লার ত নামডাক আছে পণ্ডিত হিসেবে, তার কাছেই যাওয়া যাক, যদি কিছু শেখা যায়।

অনেকখানি পথ পাহাড় ভেঙে উঠে সে খুঁজে পেলে নাসীরুদ্দীনের বাসস্থান। ঢোকবার আগে জানালা দিয়ে দেখলে মোল্লাসাহেব ঘরের এককোণে ধুনুচির সামনে বসে নিজের দু হাতের তেলো মুখের সামনে ধরে তাতে ফুঁ দিচ্ছে।

ঘরে ঢুকে বেকুব প্রথমেই হাতে ফুঁ দেওয়ার কারণ জিগ্যেস করলে। ‘ফুঁ দিয়ে হাত গরম করছিলাম’, বলে নাসীরুদ্দীন চুপ করলে। বেকুব ভাবলে, একটা জিনিস ত জানা গেল। আর কিছু জানা যাবে কি?

কিছুক্ষণ পরে নাসীরুদ্দীনের গিন্নী দুবাটি গরম দুধ এনে কর্তা আর অতিথির সামনে রাখলেন। নাসীরুদ্দীন তক্ষুনি দুধে ফুঁ দিতে শুরু করলে।

এবার বেকুব সম্ভ্রমের সঙ্গে শুধোলে, ‘হে গুরু, এবারে ফুঁ দেবার কারণটা কী?’

‘দুধ ঠাণ্ডা করা’, বললে নাসীরুদ্দীন।

বেকুব বিদায় নিলেন। যে লোক বলে ফুঁ দিয়ে জিনিস গরমও হয়, আবার ঠাণ্ডাও হয়, তার কাছ থেকে জ্ঞানলাভের কোনো আশা আছে কি?

 ১৮

এক পড়শী এসেছে নাসীরুদ্দীনের কাছে এক আর্জি নিয়ে।

‘মোল্লাসাহেব, আপনার গাধাটা যদি কিছুদিনের জন্য ধার দেন ত বড় উপকার হয়।’

‘মাপ করবেন’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘ওটা আরেকজনকে ধার দিয়েছি।’

কথাটা বলামাত্র বাড়ির পিছন থেকে গাধা ডেকে উঠে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে দিল।

‘সে কি মোল্লাসাহেব, ওটা আপনারই গাধার ডাক শুনলাম না?’

নাসীরুদ্দীন মহারাগে লোকটার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার সময় বললে, ‘আমার কথার’ চেয়ে আমার গাধার ডাককে যে বেশি বিশ্বাস করে, তাকে কোনোমতেই গাধা ধার দেওয়া চলে না।’

 ১৯

মোল্লা এখন কাজী, সে আদালতে বসে। একদিন এক বুড়ী তার কাছে এসে বললে, ‘আমি বড়ই গরীব। আমার ছেলেকে নিয়ে বড় ফ্যাসাদে পড়েছি কাজীসাহেব। সে মুঠো মুঠো চিনি খায়, তাকে আর চিনি জুগিয়ে কূল পাচ্ছি না। আপনি হকুম দিয়ে তার চিনি খাওয়া বন্ধ করুন। সে আমার কথা শোনে না।’

মোল্লা একটু ভেবে বললে, ‘ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এক হপ্তা পরে এসো, আমি একটু বিবেচনা করে তারপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবো।’

বুড়ী হুকুমমতো এক হপ্তা পরে আবার এসে হাজির! মোল্লা তাকে দেখে মাথা নাড়লে।—‘এ বড় জটিল মামলা। আরো এক হপ্তা সময় দিতে হবে আমাকে।’

আরো সাত দিন পরেও সেই একই কথা। অবশেষে ঠিক এক মাস পরে মোল্লা বুড়ীকে বললে, ‘কই, ডাকো তোমার ছেলেকে।’

ছেলেটি আসতেই মোল্লা তাকে হুঙ্কার দিয়ে বললে, ‘দিনে আধ ছটাকের বেশি চিনি খাওয়া চলবে না। যাও।’

বুড়ী মোল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললে, ‘একটা কথা জিগ্যেস করার ছিল, কাজীসাহেব।’

‘বলো।’

‘এই নিয়ে চারবার ডাকলেন কেন আমাকে? এর অনেক আগেই ত আপনি এ হুকুম দিতে পারতেন।’

‘তোমার ছেলেকে হকুম দেবার আগে আমার নিজের চিনি খাওয়ার অভ্যেসটা কমাতে হবে ত!’ বললে নাসীরুদ্দীন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *