১
রাস্তার কয়েকটি ছোকরা ফন্দি করেছে তারা মোল্লাসাহেবের জুতোজোড়া হাত করবে। একটা লম্বা গাছের দিকে দেখিয়ে তারা মোল্লাসাহেবকে বললে, ‘ওই যে গাছ দেখছেন, ওটা চড়ার সাধ্যি কারুর নেই।’
‘আমার আছে’, বলে মোল্লাসাহেব জুতোজোড়া পা থেকে না খুলেই গাছটায় চড়তে শুরু করলেন।
বেগতিক দেখে ছেলেরা চেঁচিয়ে বলল, ‘ও মোল্লাসাহেব, ওই গাছে আপনার জুতো কোনো কাজে লাগবে কি?’
মোল্লাসাহেব গাছের উপর থেকে জবাব দিলেন, ‘গাছের মাথায় যে রাস্তা নেই তা কে বলতে পারে?’
২
নাসীরুদ্দীনের বন্ধুরা একদিন তাকে বললে, ‘চলো আজ রাত্রে আমরা তোমার বাড়িতে খাব।’
‘বেশ, এস আমার সঙ্গে,’ বললে নাসীরুদ্দীন।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে বললে, ‘তোমরা একটু সবুর কর, আমি আগে গিন্নীকে বলে আসি ব্যবস্থা করতে।’
গিন্নী ত ব্যাপার শুনে এই মারে ত সেই মারে। বললেন, ‘চালাকি পেয়েছ? এত লোকের রান্না কি চাট্টিখানি কথা? যাও, বলে এস ওসব হবেটবে না।’
নাসীরুদ্দীন মাথায় হাত দিয়ে বললে, ‘দোহাই গিন্নী, ও আমি বলতে পারব না। ওতে আমার ইজ্জত থাকবে না।’
‘তবে তুমি ওপরে গিয়ে ঘরে বসে থাক। ওরা এলে যা বলার আমি বলব।’
এদিকে নাসীরুদ্দীনের বন্ধুরা প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে শেষটায় তার বাড়ির সামনে এসে হাঁক দিল, ‘ওহে নাসীরুদ্দীন, আমরা এসেছি, দরজা খোল।’
দরজা ফাঁক হল, আর ভিতর থেকে শোনা গেল গিন্নীর গলা।
‘ও বেরিয়ে গেছে।’
বন্ধুরা অবাক। কিন্তু আমরা ত ওকে ভিতরে ঢুকতে দেখলাম। আর সেই থেকে ত আমরা দরজার দিকেই চেয়ে আছি। ওকে ত বেরোতে দেখিনি।’
গিন্নী চুপ। বন্ধুরা উত্তরের অপেক্ষা করছে। নাসীরুদ্দীন দোতলার ঘর থেকে সব শুনে আর থাকতে না পেরে বললে, ‘তোমরা ত সদর দরজায় চোখ রেখেছ; সে বুঝি খিড়কি দিয়ে বেরোতে পারে না?’
৩
নাসীরুদ্দীনের পোষা পাঁঠাটার উপর পড়শীদের ভারী লোভ, কিন্তু নানান ফিকির করেও তারা সেটাকে হাত করতে পারে না। শেষটায় একদিন তারা নাসীরুদ্দীনকে বললে, ‘ও মোল্লাসাহেব, বড় দুঃসংবাদ। কাল নাকি প্রলয় হবে। এই দুনিয়ার সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।’
‘তাহলে পাঁঠাটাকেও ধংস করা হোক,’ বললে নাসীরুদ্দীন।
সন্ধেবেলা পড়শীরা দলেবলে এসে দিব্যি ফুর্তিতে পাঁঠার ঝোল খেয়ে গায়ের জামা খুলে নাসীরুদ্দীনের বৈঠকখানায় নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা দেখে তাদের জামা উধাও।
‘প্রলয়ই যদি হবে,’ বললে নাসীরুদ্দীন, ‘তাহলে জামাগুলো আর কোন্ কাজে লাগবে ভাই? তাই আমি সেগুলোকে আগুনে ধ্বংস করে ফেলেছি।’
৪
নাসীরুদ্দীন তার বাড়ির বাইরে বাগানে কী যেন খুঁজছে। তাই দেখে এক পড়শী জিগ্যেস করলে, ‘ও মোল্লাসাহেব, কী হারালে গো?’
‘আমার চাবিটা’, বললে নাসীরুদ্দীন।
তাই শুনে লোকটিও বাগানে এসে চাবি খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ খোঁজার পর সে জিগ্যেস করলে, ঠিক কোনখানটায় ফেলেছিলে চাবিটা মনে পড়ছে?’
‘আমার ঘরে।’
‘সে কি! তাহলে এখানে খুঁজছ কেন?’
‘ঘরটা অন্ধকার’, বললে নাসীরুদ্দীন। যেখানে খোঁজার সুবিধে সেইখানেই ত খুঁজব!’
৫
নাসীরুদ্দীনের যখন বয়স খুব কম তখন একদিন তার বাপ তাকে বললেন, ‘ওরে নসু, এবার থেকে খুব ভোরে উঠিস।’
‘কেন বাবা?’
‘অভ্যেসটা ভালো,’ বললেন নসুর বাপ। ‘আমি সেদিন ভোরে উঠে বেড়াতে গিয়ে রাস্তার মধ্যিখানে পড়ে থাকা এক থলে মোহর পেয়েছি।’
‘সে থলে ত আগের দিন রাত্রেও পড়ে থাকতে পারে, বাবা।’
‘সেটা কথা নয়। আর তাছাড়া আগের দিন রাত্রেও ওই পথ দিয়ে হাঁটছিলুম আমি; তখন কোনো মোহরের থলে ছিল না।’
‘তাহলে ভোরে উঠে লাভ কি বাবা?’ বললে নাসীরুদ্দীন। ‘যে লোক মোহরের থলি হারিয়েছিল সে নিশ্চয় তোমার চেয়েও বেশি ভোরে উঠেছিল।’
৬
নাসীরুদ্দীন বাজার থেকে মাংস কিনে এনে তার গিন্নীকে দিয়ে বললে, ‘আজ কাবাব খাব; বেশ ভালো করে রাঁধ দিকি।’
গিন্নী রান্নাটান্না করে লোভে পড়ে নিজেই সব মাংস খেয়ে ফেললে। কর্তাকে ত আর সে কথা বলা যায় না, বললে, ‘বেড়ালে খেয়ে ফেলেছে।’
‘এক সের মাংস সবটা খেয়ে ফেলল?’
‘সবটা।’
বেড়ালটা কাছেই ছিল, নাসীরুদ্দীন সেটাকে দাঁড়িপাল্লায় চড়িয়ে দেখলে ওজন ঠিক এক সের।
‘এটাই যদি সেই বেড়াল হয়’, বললে নাসীরুদ্দীন, ‘তাহলে মাংস কোথায়? আর এটাই যদি সেই মাংস হয়, তাহলে বেড়াল কোথায়?’
৭
শিকারে বেরিয়ে পথে প্রথমেই নাসীরুদ্দীনের সামনে পড়ে রাজামশাই ক্ষেপে উঠলেন। ‘লোকটা অপয়া। আজ আমার শিকার পণ্ড। ওকে চাবকে হটিয়ে দাও।’
রাজার হকুম তামিল হল।
কিন্তু শিকার হল জবরদস্ত।
রাজা নাসীরুদ্দীনকে ডেকে পাঠালেন।
‘কসুর হয়ে গেছে নাসীরুদ্দীন। আমি ভেবেছিলাম তুমি অপয়া। এখন দেখছি তা নয়।’
নাসীরুদ্দীন তিন হাত লাফিয়ে উঠল।
‘আপনি ভেবেছিলেন আমি অপয়া? আমায় দেখে আপনি ছাব্বিশটা হরিণ মারলেন, আর আপনাকে দেখে আমি বিশ ঘা চাবুক খেলাম। অপয়া যে কে সেটা বুঝতে পারলেন না?’
৮
গাঁয়ের লোকে একদিন ঠিক করল নাসীরুদ্দীনকে নিয়ে একটু মশকরা করবে। তারা তার কাছে গিয়ে সেলাম ঠুকে বললে, ‘মোল্লাসাহেব, আপনার এত জ্ঞান, একদিন মসজিদে এসে আমাদের তত্ত্বকথা শোনান না।’ নাসীরুদ্দীন এক কথায় রাজি।’
দিন ঠিক করে ঘড়ি ধরে মসজিদে হাজির হয়ে নাসীরুদ্দীন উপস্থিত সবাইকে সেলাম জানিয়ে বললে, ‘ভাই সকল, বল ত দেখি আমি এখন তোমাদের কী বিষয় বলতে যাচ্ছি?’
সবাই বলে উঠল, ‘আজ্ঞে সে ত আমরা জানি না।’
মোল্লা বলল, ‘এটাও যদি না জান তাহলে আর আমি কী বলব। যাদের বলব তারা এত অজ্ঞ হলে চলে কি করে?’
এই বলে নাসীরুদ্দীন রাগে গজগজ করতে করতে মসজিদ ছেড়ে সোজা বাড়ি চলে এল।
গাঁয়ের লোক নাছোড়বান্দা। তারা আবার তার বাড়িতে গিয়ে হাজির।
‘আজ্ঞে, আসছে শুক্রবার আপনাকে আর একটিবার আসতেই হবে মসজিদে।’
নাসীরুদ্দীন গেলেন, আর আবার সেই প্রথম দিনের প্রশ্ন দিয়েই শুরু করলেন। এবার সব লোকে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি।’
‘সবাই জেনে ফেলেছ? তাহলে ত আর আমার কিছু বলার নেই’—এই বলে নাসীরুদ্দীন আবার বাড়ি ফিরে গেলেন। গাঁয়ের লোক তবুও ছাড়ে না। পরের শুক্রবার নাসীরুদ্দীন আবার মসজিদে হাজির হয়ে তাঁর সেই বাঁধা প্রশ্ন করলেন। এবার আর মোল্লাকে রেহাই দেবে না গাঁয়ের লোক, তাই অর্ধেক বলল ‘জানি’, অর্ধেক বলল ‘জানি না’।
‘বেশ, তাহলে যারা জান তারা বলো, আর যারা জান না তারা শোন’—এই বলে নাসীরুদ্দীন আবার ঘরমুখো হলেন।
৯
তর্কবাগীশ মশাই নাসীরুদ্দীনের সঙ্গে তর্ক করবেন বলে দিনক্ষণ ঠিক করে তার বাড়িতে এসে দেখেন মোল্লাসাহেব বেরিয়ে গেছেন। মহা বিরক্ত হয়ে তিনি মোল্লার সদর দরজায় খড়ি দিয়ে লিখে গেলেন ‘মূর্খ’।
নাসীরুদ্দীন বাড়ি ফিরে এসে কাণ্ড দেখে এক হাত জিভ কেটে এক দৌড়ে তর্কবাগীশ মশাইয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে বললে, ‘ঘাট হয়েছে পণ্ডিতমশাই, আমি বেমালুম ভুলে গেসলুম আপনি আসবেন। শেষটায় বাড়ি ফিরে দরজায় আপনার নামটা লিখে গেছেন দেখে মনে পড়ল।’