মোরেল্লা
মোরেল্লা!
আমার বান্ধবী মোরেল্লা।
আমি যথেষ্ট অথচ বিশেষ অনুরাগের দৃষ্টিতেই আমার বান্ধবী মোরেল্লাকে দেখতাম।
বান্ধবী মোরেল্লার সঙ্গে আমার পরিচয় আজকের নয়, দীর্ঘ কয়েক বছর আগেই তার সঙ্গে আমার হঠাৎ-ই পরিচয় হয়েছিল। গড়ে উঠেছি যোগসূত্র।
কিন্তু তাকে প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই অজানা এক আগুনে আমার অন্তরাত্মা জ্বলতে আরম্ভ করল। কীসের আগুন, কেমনতর আগুন, তাই না? সে আগুন কিন্তু মোটেই প্রেম ভালোবাসার আগুন নয়। যা-ই হোক, সেটাই একটু-একটু করে বেড়ে গিয়ে এমন যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠল যে, আমার পক্ষে সে আগুনের প্রকৃতরূপ বুঝতে তো পারলামই না, আবার তাকে সামলে রাখাও সম্ভব হলো না।
এতকিছু সত্ত্বেও আমাদের দুজনের দেখা সাক্ষাৎ হত। আর ভাগ্যদেবী আমাদের দুজনকে একই ডুরিতে বেঁধে দিল।
সত্যি বলছি, ভালোবাসার কথা কিন্তু আমি ভুলেও কোনোদিন মনে ঠাই দেইনি। আর মুখে প্রকাশ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে এটা সত্য যে, মোরেল্লা সমাজ সংসারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে কেবলমাত্র আমার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত হয়ে থেকে গেল। সে আমাকে সুখি করল। কীসের সুখ? কেমন সুখ? সে সুখ বাস্তবিকই বিস্ময়ের স্বপ্ন দেখার সুখের সঙ্গেই তুলনীয়।
গভীর পাণ্ডিত্য ছিল মোরেল্লার। আর তার প্রতিভা সাধারণ ছিল না। আর তার। মানসিক দৃঢ়তার তুলনা কেবলমাত্র অসুরের সঙ্গেই চলতে পারে।
তার গুণাবলী সম্বন্ধে আমার মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছিল বলেই তো বহু ব্যাপারেই আমি তার ছাত্র বনে গেলাম। তার সান্নিধ্যে আমার দিন কাটতে লাগল। তবে যা-ই হোক, অল্প দিনের মধ্যেই আমি উপলব্ধি করতে পারলাম যে, সে আমার কাছে এমন সব রহস্যসঞ্চারকারী লেখা নিয়ে আসত যেগুলোকে মোটামুটি জার্মান সাহিত্যের জঞ্জাল বলেই জ্ঞান করা হয়। তা হয়তো বা প্রেসবুর্গের শিক্ষালাভ করার জন্যই সম্ভব। হতো। সঠিক কারণ আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, তবে এগুলো ছিল তার প্রিয় আর। সর্বদা পাঠও করত। আর একটু একটু করে এগুলো আমার কাছেও প্রিয় হয়ে উঠল। কেন? কারণ কি? কারণ খুবই সহজ, দৃষ্টান্ত আর অভ্যাসের জন্যই এমনটা ঘটল। যা ই হোক, আমিও তার ভালোলাগা সাহিত্যের প্রতি আমার মনও মজে গেল।
যদি আমার নিতান্তই ভুল না হয়ে থাকে তবে বলছি, এসব ব্যাপার স্যাপারে। আমার বিচার-বিবেচনা বোধের তেমন কিছু করার ছিল না।
বিশেষ কোনো আদর্শের দ্বারা আমার চিন্তা-ভাবনাগুলো প্রভাবিত হয়েছে এমন। কথা অবশ্যই বলা যাবে না। অর্থাৎ আমি যে সব কাজ, যা-কিছু পড়াশুনা করতাম তার রহস্যময়তার তিলমাত্রও আমার মনকে আকর্ষণ করতে পারত না, মনে দাগ কাটার
তো প্রশ্নই ওঠে না। পড়তাম তবু পড়তাম, পড়তে হত।
সত্যি বলছি, আমার পাঠ-সঙ্গি, আমার পড়াশুনার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়েই আমি সম্পূর্ণরূপে নিজে উৎসাহি হয়ে, নিশ্চিন্তেই আমার স্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।
ব্যস, আমি শান্ত-সুস্থির মন নিয়ে আমার সহধর্মিণীর পাঠবিষয়ের ভেতরে রীতিমত ডুবে গেলাম।
আর তখন?নিষিদ্ধ পাঠ্য বিষয়গুলো যখন একান্তভাবে মন-প্রাণে সঁপে পড়াশুনায় মেতে যেতাম আর তখনই আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করতাম যে, একটা নিষিদ্ধ ভাব আমার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ঠিক সে মুহূর্তেই আমার সহধর্মিণী মোরেল্লা তার বরফ-শীতল হাতটা আলতোভাবে আমার হাতের ওপর রেখে তৃপ্ত হতো। আর মৃত দর্শনকে নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতো–তা জ্বলন্ত অক্ষরে আমার স্মৃতিতে লেখা হয়ে যেত।
আর তখন আমি একের পর এক ঘণ্টা তার কাছে, তার মুখোমুখি বসে কাটিয়ে দিতাম। অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে, উৎকর্ণ হয়ে তার মিষ্টিমধুর আর সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতাম। তারপর এক সময় তার সুরে ত্রাস প্রকাশ পেত, আমার মুখ ফ্যাকাশে বিবর্ণ। হয়ে যেত। তখন তার অভাবীয় স্বর আমার বুকের ভেতরে কম্পনের সৃষ্টি করত।
তারপর? তারপর ত্রাসে আনন্দ ফুর্তি মন থেকে ক্রমে মিলিয়ে যেতে যেতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। আর তখন অতিসুন্দর কুৎসিৎ হয়ে পড়ত। হিল্লোস যেমন জি হেন্না হয়ে ওঠে ঠিক এমনটার কথাই বলতে চাইছি।
উপরোক্ত বইপত্রগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা যে সব প্রবন্ধ বহুদিন যাবৎ মোরেল্লা আর আমার আলাপ আলোচনার একমাত্র বিষয়বস্তু ছিল, তার যথাযথনির্ণয়, ও বিশ্লেষণ করার কোনো দরকার আছে বলে মনে করছি না। যাদের ধর্মীয় নীতিবাদ সম্বন্ধে ধারণা আছে, তারা সহজেই সেটা অনুধাবন করতে পারতেন।
আর ধর্মীয় নীতিবাদ সম্বন্ধে যাদের ধ্যান ধারণা নেই তারা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারবেন না।
আমাদের আলোচনার অধিকাংশ বিষয়বস্তু কি ছিল বলছি, শেলিং-এর আইডেন্টিটি বাদ আর ফিটকের সর্বেশ্বর বাদ। আর অন্য যা-কিছু আলোচনা চলত তা নিতান্তই গৌণ।
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কোনো মানুষের আলোচনা আমি সব সময়ই অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে শুনতাম। অবিচল চিত্তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার সামনে বসে আমার এ ভালো-লাগা বিষয়টার আলোচনা শুনে যেতাম।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, মোরেল্লা যে উত্তেজিত ভঙ্গিতে তার বক্তব্যকে প্রকাশ করত তা আমার মনকে যারপরনাই আকর্ষণ করত। আর সে আকর্ষণেই আমি তার মুখোমুখি বসে ঘণ্টর পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম।
তবে এতদিনে সে লগ্নটা এসে গেল, যখন আমার সহধর্মিণীর আচার আচরণ যাদুমন্ত্রের মতো আমার মন প্রাণের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করল।
তার সরু সুন্দর আঙুলের স্পর্শ, তার মিষ্টি-মধুর ক্ষীণ ও সুরেলা কণ্ঠস্বর, তার বিষণ্ণ চোখের মণি দুটোর চাকচিক্য এসবের কোনোকিছুই আমার তিলমাত্রও ভালো লাগত না, অর্থাৎ মোটেই বরদাস্ত করতে পারতাম না।
সে কিন্তু সবকিছুই আমার অনীহার ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারত। তবে কোনো অনুযোগই করত না। ব্যাপারটা এমন মনে হতো যে, সে যেন সবকিছু বুঝেও না-বোঝার ভান করে থাকত।
আর এও মনে হতো আমার মুখতা অথবা আমার মানসিক দুর্বলতা সম্বন্ধে সে অচেতন তো নয়ই, বরং সম্পূর্ণ সচেতন, তা সত্ত্বেও সে ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তাকেই নিয়তি বলত।
আর একটা ব্যাপারের এখানে উল্লেখ করার দরকার মনে করছি, আমার কিন্তু পরিষ্কার মনে হতো তার ওপর আমার আস্থা আর শ্রদ্ধা উভয়ই যে হ্রাস পাচ্ছে তার কারণটা আমার ঠিক জানা না থাকলেও সে ভালোই জানত। কোনো ব্যাপারে ভালো মন্দ কোনো কথাই সে বলত না। তবুও সেও তো এক নারী; দিন দিনই সে কেমন শুকিয়ে যেতে লাগল। ঠোঁট দুটো ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে পড়তে লাগল, দুগালে লালচে ছোপ পড়ল। কপালের নীল শিরা-উপশিরাগুলো ক্রমেই ফুলে ভেসে উঠতে লাগল।
আর মুহূর্তেই জন্য আমার অন্তরাত্মাটায় দয়া-মায়ার উদ্রেক ঘটতে-না-ঘটতেই পরমুহূর্তেই তার অর্থবহ চোখ দুটোর দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আমার মনটা পীড়িত হয়ে পড়ত। আর মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করত, ঘুরে যেত মাথাটা। ঘুরে যেত বলতে আমি কী বলতে চাইছি, তাই না? কোনো মানুষ যখন খুবই গভীর কোন খাদ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করে তখন হঠাৎ তার মাথাটা যেমন ঝিম ঝিম করতে থাকে, হঠাৎ-ই ঘুরে যায়, ঠিক তেমন ব্যাপারের কথা বলতে চাইছি।
তবে কি আমি এ-কথাই বলব যে, আমার সহধর্মিণী মোরেল্লা-র মৃত্যুই আমি মনে-প্রাণে কামনা করতাম? হ্যাঁ, করতামও তা-ই বটে। কিন্তু তার বিদেহী আত্মা আরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার পার্থিব জগতের আস্তানাটাকে আঁকড়েই থাকল।
বহু সপ্তাহ, বহু বিতৃষ্ণাসঞ্চারকারী মাস, আমার যন্ত্রণাকাতর স্নায়ুগুলো যতদিন না আমার মনকে বাগে আনতে সক্ষম হলো, যতই সময় পেরিয়ে যেতে লাগল ততই আমি হিংস্র জানোয়ারের মতো হয়ে পড়তে লাগলাম। শয়তান আমার মনকে বশ করে ফেলল। আমি প্রতিটা দিন, প্রতিটা ঘণ্টা, প্রতিটা বিরক্তিকর মুহূর্তকে অভিসম্পাতে ঝাঁঝরা করে দিতে আরম্ভ করলাম। হায় এ কী হলো!
এক সময় হেমন্তকাল এলো। হেমন্তের এক সন্ধ্যায় বাতাস যখন একেবারেই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, তখন আমার সহধর্মিণী মোরেল্লা আমাকে কাছে ডাকল। ডেকে তার বিছানার কাছে নিয়ে এলো। তখন পৃথিবীর ওপর হালকা একটা কুয়াশার চাদর আলতোভাবে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, তপ্ত একটা আভা পানির উপরিতলের ওপর বিরাজ করছে।
আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম। আমি এগিয়ে গিয়ে তার কাছে, মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ানো-মাত্র সে বলে উঠল–আজকের দিনটা বড় ভালো! কী চমৎকার, তাই না?
আমি প্রায় অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলাম–হুম!
সে পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চলল–সত্যি করে বলতে গেলে, অনেক দিনের মধ্যে বেঁচে থাকার, বা মৃত্যুবরণ করার উপযুক্ত একটা দিন, তাই না?
হুম!
লক্ষ্য করে দেখ, পৃথিবীর পুত্র সন্তানদের, জীবনের পক্ষে আজকের দিনটা খুবই প্রকৃষ্ট আঃ! স্বর্গের কন্যাদের মৃত্যুবরণের পক্ষে খুবই প্রকৃষ্ট দিন।
আমি এগিয়ে তার বিছানার একেবারে গা-ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তার শায়িত দেহপল্লবের ওপরে ঝুঁকে আলতো করে একটা চুমু খেলাম। তারপর আর একবার, তারপর আরও একবার।
সে বলে চলল–মৃত্যু আমার শিয়রে। আমি মরতে চলেছি, তবুও আমি বেঁচে থাকব।
আমি আঁতকে উঠে বললাম–মোরেল্লা মোরেল্লা!
আজ একটা কথা বলার খুবই দরকার মনে করছি।
মোরেল্লা। এত ইতস্ততের কি–
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সে আবার বলতে শুরু করল–আমাকে অন্তর থেকে ভালোবাসতে পারতে, এমন কোনোদিন কখনই আসেনি।
আমি একেবারে মিইয়ে গিয়ে বলে উঠলাম–মোরেল্লা!
সে পূর্ব প্রসঙ্গে জের টেনে বলে চলল–আমার কথা মনে রেখো, জীবনে যাকে তুমি অন্তর থেকে ঘৃণা করেছ, তাচ্ছিল্য করেছ, মৃত্যুর পর তুমি তাকেই পূজা করবে, বলে রাখছি।
মোরেল্লা! এ তুমি বলছ কি।
হ্যাঁ, আমি মরতে চলেছি; আবারও বলছি, আমি মরতে চলেছি। আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে কিন্তু সে প্রেমের শপথ রয়েছে। উফ্! তুমি আমার জন্য আর কতটুকু ভালোবাসাই বা অন্তরে পোষণ করতে?
আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম–মোরেল্লা!
আরও আছে, আমার আত্মা যখন দেহ-খাঁচা ছেড়ে চলে যাবে সন্তানটার মধ্যে তখনও প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে।
মোরেল্লা! মোরেল্লা!
হ্যাঁ, সত্যি বলছি, সন্তনাটা তখনই জীবিতই থাকবে। সে সন্তান তোমার আর আমার মোরেল্লার সন্তান।
মুহূর্তের জন্য থেমে, একটু দম নিয়ে মোরেল্লা আবার বলতে আরম্ভ করল– শোন–মনে রেখো, সামনের দিনগুলো থাকবে দুঃখে ভরপুর। অফুরন্ত দুঃখ-যন্ত্রণা। কেমন দুঃখ? যে দুঃখ অন্যসব অনুভূতির চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, সাইপ্রাস গাছ যেমন যাবতীয় গাছগাছালির মধ্যে দীর্ঘ।
আমি করুণ দৃষ্টিতে তার ফ্যাকাশে মুখটার দিকে দৃষ্টি অব্যাহতই রাখলাম।
সে আগের মতোই বিষণ্ণমুখে বলে চলল–হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, দুঃখ, তোমার সামনে অন্তহীন দুঃখ অবস্থান করছে। কারণ, তোমার সুখের দিন যে ফুরিয়ে গেছে। পিস্তামের গোলাপ বছরে দুবার করে ফোটে, খুবই সত্য বটে। কিন্তু একই জীবনে দুবার সুখ আসে না। শুনে রাখ, সময়ের সঙ্গে তোমার আর লুকোচুরি খেলা সম্ভব নয়। খেরতে তুমি পারবে না। কিন্তু দ্রাক্ষালতা আর মেহীদির কথা মন থেকে মুছে ফেলে দিয়ে এ মর্তভূমিতে অবস্থান করেই তোমার কবরের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার সহ্য করতে হবে, মুসলমানরা ঠিক যেমনটা মক্কায করে।
আমার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল। আমি দু কানে হাত চেপে ধরে উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠলাম–মোরেল্লা!
হ্যাঁ, যা বললাম, সবই সত্য, মিলিয়ে নিও।
মোরেল্লা! এমন ভয়ঙ্কর কথা তুমি কি করে জানলে?
মোরেল্লা আমার কথার জবাব দিল না। জবাব দেবার মতো অবকাশ পেল না। সুযোগ পেলে কি জবাব দিত, কে জানে?
যাক, আমার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই মোরেল্লা বালিশের ওপরেই তার মুখটা ঘুরিয়ে নিল। তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো মৃদু মৃদু, তিরতির করে কেঁপে উঠল। হ্যাঁ, এভাবেই সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করল।
মোরেল্লার মুখ থেকে কোনো কথা আর শুনতে পাইনি। মোরেল্লা আমাকে ও আমাদের পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো চলে গেল।
তবে তার গর্ভের সন্তান–মৃত্যুশয্যায়, মৃত্যুর প্রায় পূর্ব মুহূর্তে সে যাকে প্রসব জন্মদান করেছিল, আর গর্ভধারিণীর ফুসফুস নিঙড়ে শেষ নিকাস ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত সে নিশ্বাসই ত্যাগ করেনি। সেই সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তান, একটা কন্যা সন্তান, প্রাণে বেঁচে গেল।
দেহের দিক থেকে আর বুদ্ধি বিবেচনার বিচারে সে মেয়েটা অদ্ভুত রকমের বড় হয়ে উঠল। সত্যি বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার! মেয়েটা যেন একেবারে তার পরলোকগতা মায়েরই কার্বনকপি। হুবহু প্রতিবিম্ব।
স্বীকার না করে উপায় নেই, আমি তাকে কেবল ভালোবাসতামই না, অন্তর থেকে ভালোবাসতাম। আমার মতো এমন গভীর ভালোবাসা পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষের মনে, পৃথিবীর অন্য কেউ, অন্য কোনো মানুষকে ভালোবাসতে পারে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করতে পারতাম না।
হায়! কিছুদিন যেতে না যেতেই সে ভালোবাসার স্বর্গ ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল, ভালোবাসার স্বর্গ অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল।
জমাট বাঁধা আতঙ্ক, বিষাদ, আর দুঃখ-দুর্দশা চরম রূপ নিয়ে তার ওপর আছড়ে পড়ল। আমি তো এই একটু আগেই বলেছি, মেয়েটা দেহ আর মনে তর তর করে অদ্ভুত রকমের বড় হয়ে উঠল।
সত্যি সম্পূর্ণ সত্যি কথা, তার দৈহিক বৃদ্ধি এত দ্রুত ও এত বেশি ছিল যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তবে এও সত্য যে, তার মানসিক বৃদ্ধির এত দ্রুত প্রসারণ– সে চিন্তা ভাবনাগুলো আমার মনে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল, তা ছিল ভয়ঙ্করতায় পরিপূর্ণ। ভয়ঙ্কর বড়ই ভয়ঙ্কর।
আমি যখন শিশুর চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এক প্রাপ্তবয়স্কা নারীর মনোবৃত্তি আর শক্তির প্রকাশ আবিষ্কার করতে আরম্ভ করলাম, একটা শিশুর মুখে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর অভিজ্ঞতার কথা যখন শুনতাম, আর তার আয়ত ও চঞ্চল চোখের মণি দুটোতে প্রাপ্তবয়সের আবেগ-উচ্ছ্বাস-জ্ঞানের ছাপ ফুটে উঠত, তখন আমার মনের প্রতিক্রিয়া কি অন্যদিকে, মোড় নিতে পারত? আমি কি অন্য কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তাকে দেখতে পারতাম?
আমার ভীত-সন্ত্রস্ত মনের আয়নায় এসব খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠল–তাকে যখন নিজের কাছে লুকিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ তখন যদি ভয়ঙ্কর অথবা উত্তেজক কোনো সন্দেহ আমার অন্তরের গভীরে দানা বেঁধে থাকে।
তা যদি না-ও হয়, যদি আমার চিন্তা-ভাবনা যদি পরলোকগতা, কবরস্থ মোরেল্লার অদ্ভুত সব কাহিনী আর মতবাদের মধ্যে যদি ফিরে যায় তবে কী সেটা খুবই অবাক হবার মতো ব্যাপার হবে?
একমাত্র সে কারণেই তো সে প্রাণীটাকে পৃথিবীর সন্ধানী চোখগুলোর আড়ালে আমি নিয়ে চলে গেলাম। ভাগ্যদেবী যাকে ভালোবাসা দান করতে আমাকে বাধ্য করেছে। সত্যি এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়ই আমার ছিল না।
আর এবার থেকে আমি আমার বাড়ির নির্জন-নিরালায় বসে বেদনাদায়ক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সঙ্গে আমার সে নিজের মানুষটার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলতে লাগলাম।
এদিকে বছর যত পেরোতে লাগল আমি ততই দিনের পর দিন সে মুখটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে রেখে আর তার বাড়-বাড়ন্ত দেহপল্লবটার কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় সেদিনের সে শুটার সঙ্গে তার বিষাদক্লিষ্ট পরলোকগতা গর্ভধারিণীর সঙ্গেনিত্য নতুন মিল স্পষ্ট লক্ষ্য করতে লাগলাম।
তার মুখের হাসিটা যে অবিকল তার মায়েরই হাসির মতো তা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হতো, কিন্তু সে-মিল যখন পূর্ণ একাত্মতা হয়ে আমার চোখের সামনে ফুটে উঠত তখনই আমার ভেতরটা আতঙ্কে কেঁপে উঠত, আমি দারুণভাবে কুঁকড়ে যেতাম। মোরেল্লার চোখ দুটোর সঙ্গে যে তার চোখ দুটোর হুবহু সাদৃশ্য থাকত তাহলে মেনে নিতাম, বরদাস্ত করতে পারতাম। কিন্তু সে চোখ দুটোতে, চোখের মণি দুটোতেও যে তার মায়ের, মোরেল্লার নিজের দৃষ্টি আর বিভ্রান্তিকর অর্থবাহী হয়ে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেত।
আরও আছে, রেশমের সুতোর মতো কোঁকড়ানো সোনালি চুলের গোছা, সমুন্নত কপাল, সেই বিবর্ণ আঙুলগুলো, সেই একই মর্মভেদী বিষণ্ণসুরে কথা বলা আর সবার ওপওে উফ্, সবার ওপরে প্রাণবন্ত মনের মানুষটার মুখে পরলোকগতা মানুষটার কথা বলার কায়দা কৌশল আর ভাবাবেগের চিহ্ন–এসব চিন্তা-ভাবনা আর ভয়-ভীতি আমার ভেতরটাকে ঘুণ পোকার মতো কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে একেবারে ঝাঁঝরা করে দিত। হায়! সে মর্মান্তিক চিন্তাকীটের মৃত্যু নেই, বিনাশ নেই। উফ কী দুর্বিষহ যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত আমাকে অস্থির করে রাখত।
তার জীবনের দুটো পঞ্চাব্দ এমন অবর্ণনীয় দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। কিন্তু তবু আমার মেয়েটা তখন নামহীনই থেকে গেল। বুকের সবটুকু পিতৃস্নেহ নিঙড়ে একটা কথাই বার বার বিভিন্নভাবে বেরিয়ে আসত, আমার সন্তান, আমার মেয়ে আর আমার প্রিয়। এভাবেই তাকে সম্ভাষণ করা হতো, অর্থাৎ সম্ভাষিত হতো।
তার বরাতে এমন সম্ভাষণ কেন জুটত, তাই না? আসল কারণটা হচ্ছে, সে সব সময়, প্রতিটা মুহূর্ত কঠোর নির্জনতার মধ্যে থাকার ফলে অন্য কোনো সম্ভাষণ থেকেনিদারুণভাবে বঞ্চিত হয়েছে।
মোরেল্লা মাটির পৃথিবী, আমাকে, আমাদের ছেড়ে অন্যলোকে পাড়ি জমানোর সঙ্গেই তার নামটাও চিরদিনের মতো মুছে গেছে। আমিও কোনোদিন তার কথা মেয়ের কাছে কিছুই বলিনি। আমার পক্ষে বলা সম্ভবও ছিল না।
এতদিন তো নির্বিঘ্নেই পেরিয়ে গেল। কিন্তু এবারই তার নামকরণের একান্ত প্রয়োজন দেখা দিল। তার দীক্ষান্ত অনুষ্ঠানে কোনো-না-কোনো একটা নাম অবশ্যই দরকার হয়ে উঠল।
হ্যাঁ, আমার মেয়েটার নামকরণ অবশ্যই দরকার আর তা আমাকে করতেই হবে।
আমি প্রয়োজনের তাগিদে পুরনো ও নতুন, স্বদেশি ও বিদেশি বহু নামই মনে মনে আওড়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু হায়! তবে একটা পরলোকগতা, কবরে শায়িত মানুষের স্মৃতিকে বিঘ্নিত করার চিন্তা আমার মনের গভীরে বার বার ভেসে উঠতে লাগল কেন? কেন এমন একটা অভাবনীয় ব্যাপার আমার মাথায় ভিড় জমাল? কোন দত্যি-দানোর এ-কাজ? কোন দৈত্য এ নামটা উচ্চারণ করতে আমাকে প্রেরণা জোগাল? সে নামটা মনের কোণে ভেসে ওঠামাত্র আমার শরীরের সব কটা স্নায়ু একই সঙ্গে সচেতন হয়ে উঠল? আর আমার মাথা থেকে বুক অবধি লাল রক্তের স্রোত বইতে লাগল? কেন? কোন দৈত্য, কোন শয়তানের কারসাজিতে এমনটা হলো?
আমার বুকের গভীর প্রান্তে অবস্থানরত কোন শয়তানের প্রেরণায় আমি পবিত্র লোকটার কানে কানে প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেছিলাম–মোরেল্লা?
কেবলমাত্র শয়তান বললে যথার্থ বলা হবে না, শয়তানের চেয়েও বড় কিছু যেন আমার সন্তানকেনিদারুণভাবে সঙ্কুচিত করেছিল, মৃত্যুর বিবর্ণতা তার আপাদমস্তক ছেয়ে ফেলল। সেই প্রায় না শোনা শব্দটা তার কানে যাওয়ামাত্র সে দারুণভাবে চমকে উঠল। অবর্ণনীয় একটা অস্বাভাবিকতা যেন হঠাৎ-ই তার মধ্যে ভর করল। আর কাঁচের মতো স্বচ্ছ চোখের মণি দুটোকে মর্ত্যলোক থেকে স্বর্গলোকের দিকে মেলে ধরেই আমাদের বংশের গর্ভগৃহের কালো মসৃণ পাথরের বেদীটার ওপর টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপরই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, এখানে, আমি এখানে!
খুবই স্পষ্ট আমি এখানে ওই সহজ-সরল কথা বাতাসবাহিত হয়ে আমার কানে এসে বাজল। তারপর কান থেকে গলিত সিসার মতো দ্রুত ধেয়ে গিয়ে আমার মস্তিষ্কে পৌঁছে গেল। বছরের পর বছর পেরিয়ে যাবে, কিন্তু সেদিনের স্মৃতি কোনোদিন, মুহূর্তের জন্যও আমার মন থেকে মিলিয়ে যাবে না।
আর ফুল এবং দ্রাক্ষালতার কথাও তো আমার অজ্ঞাত ছিল না। তবুও আমার দিন-রাত, আমার প্রতিটা মুহূর্তকে সাইপ্রেস আর হেমলক ছায়ায় ঢেকে রাখল।
আর স্থান এবং কালের কোনো হিসেবের অস্তিত্ব আমার মনে থাকল না। অদৃষ্টের নক্ষত্রগুলো আমার আকাশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল চিরদিনের মতো বিদায় নিল। সুতরাং আমার পৃথিবী অন্ধকারের কালো ঘোমটার আড়ালে আত্মগোপন করল। পৃথিবীর যতসব মূর্তি চলন্ত ছায়ামূতির মতো অদ্ভুতভাবে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তাদের ভিড়ের মধ্যে আমি মোরেল্লাকে কেবলমাত্র মোরেল্লাকেই দেখি।
উফ! মোরেল্লা! মোরেল্লা! একটামাত্র কথা, একটামাত্র নামই বাতাসবাহিত হয়ে। আমার কানে এসে বাজতে লাগল। কিন্তু কোথায় মোরেল্লা! তার অস্তিত্ব কি করেই বা সম্ভব? মোরেল্লা যে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছে। এ মাটির পৃথিবী ছেড়ে দূরে, বহু দূরে চলে গেছে।
মোরেল্লার নিসাড় দেহটাকে নিজের হাতে কবরস্থানে নিয়ে গেলাম। আর সেখানকার জমিতে দ্বিতীয় মোরেল্লাকে শুইয়ে দিলাম। সে সমাধিতে প্রথম মোরেল্লা নিশ্চিহ্ন। প্রথম মোরেল্লাকে সেখানে দেখতে না পেয়ে বিষণ্ণ, দীর্ঘ অট্টহাসিতে আকাশ-বাতাস ছড়িয়ে দিলাম।