মোদের বাড়ি এসো
বেলা একটা নাগাদ পানবিড়ির দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল ইনোভা গাড়িটা৷ ঘন কাচের জানলাটা নেমে এল ধীরে ধীরে৷ মুখ বাড়িয়ে শৈলেন জিজ্ঞেস করল, ‘দাদা, পুষ্পরানি লাহিড়ীর বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?’
দোকানের লোকটা কেটলি থেকে চা ঢালছিল৷ সে কোনও উত্তর দিল না৷ তার বদলে সামনের বেঞ্চে বসে থাকা একটা বয়স্ক-গোছের একটা লোক মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ওই তো, এই গলির শেষে ডানহাতের লালবাড়ি৷ কার কাছে যাবেন? পুষ্পরানি তো…’
‘মারা গেছেন, জানি৷ ওনার ভাড়াটের সঙ্গে একটু দরকার ছিল…’ শৈলেন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফোনটা দেখতে দেখতে বলে৷
লোকটা একটু অবাকই হয়৷ এত বছর কেটে গেল, পুষ্পরানির ভাড়াটের সঙ্গে দেখা করতে প্রায় কেউই আসেনি৷ এক ডাক্তার বদ্যি ছাড়া৷
‘আপনি পুষ্পরানিকে চিনতেন নাকি?’
গাড়ির কাচ নিজে থেকেই উঠে আসে৷ মানুষটার মুখ ঢেকে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে গাড়ির ভেতর থেকে শোনা যায়, ‘আমার মা…’
* * *
ডানদিকে চোখ রেখে আরও কিছুটা গাড়ি এগিয়ে নিয়ে আসে শৈলেন৷ এ রাস্তাটায় ও আগে কখনও আসেনি৷ আসার কথাও নয়৷ দেশ ছেড়েছে বছরকুড়ি হতে চলল৷ তার আগে পড়াশোনা ব্যাঙ্গালোরে৷ কলকাতার আশপাশে ঘোরাঘুরি ওর জীবনে তেমন হয়নি৷
খানিক এগোতে চোখে পড়ে বাড়িটা৷ সামনে গিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়িটা পার্ক করাতেই মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে ওর৷ ওয়াটসঅ্যাপে কল আসছে৷ বিদেশ থেকে৷ সেটা কানে ধরে শৈলেন, ‘পৌঁছে গেছিস?’
‘দরজার সামনে…’
‘তুই পরশু ফিরছিস তো? শিওর?’
‘ইচ্ছা তো তাই আছে… নাও ফিরতে পারি…’
‘ওয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট? দেখ, তোর পাগলামি করার ইচ্ছা হয়েছে, কর৷ বাট একটা লিমিট রেখে, এসব কী বালখিল্য?’
উত্তর দেয় না শৈলেন৷ চুপ করে থাকে৷ ওপাশ থেকে আবার প্রশ্ন ভেসে আসে, ‘ওখানে লোকাল কাউকে চিনিস?’
‘অলমোস্ট চিনি না৷ পঁচিশ বছর হয়ে গেল এদের সঙ্গে কোনও কন্ট্যাক্ট নেই৷ ওয়াট ডু ইউ এক্সপেক্ট?’
‘অ্যাড্রেসটা ঠিকঠিক আছে তো?’
‘আই হোপ সো৷ বছরখানেক আগে একটা মেইল এসেছিল৷ সেখান থেকে উদ্ধার করেছি৷ সেখানে যদি আর কেউ না থেকেও থাকে, অন্তত কিছু তো ট্রেস করা যাবে…’
‘আর বুড়িরা যদি এতদিনে মরে গিয়ে থাকে?’
এতক্ষণে বিরক্ত হয় শৈলেন, ‘তুই চাসটা কী শুভ?’
‘নাথিং, ইটস ইয়োর মানি টু লুজ৷ শুধু যা পাগলামো করার করে তুই পরশু ফিরে আয়৷ ফারদার মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট দরকার তোর শৈলেন…’
ফোনটা রাখতেই সামনের আয়নায় নিজের মুখের দিকে চোখ পড়ে যায় শৈলেনের৷ চোখের তলায় পুরু কালির ছাপ৷ কোটরে ঢুকে গেছে৷ গাড়ি চালাতে চালাতে বেশ কয়েকবার ঝিমিয়ে পড়েছিল৷ সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গেছে ঘুমটা৷ এরকমটা হবে তা আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল শুভময়৷ সেইজন্যই প্রতি দশমিনিট অন্তর ফোন করেছে ওয়াটসঅ্যাপে৷ এখানে এসে ড্রাইভারও নিতে বলেছিল৷ কিন্তু শৈলেন রাজি হয়নি৷ ওর এখানের এক বন্ধুর গাড়ি এয়ারপোর্টে ছিল৷ নিজেই সেখান থেকে ড্রাইভ করে এসেছে এতদুর৷
দোতলা লালচে রঙের বাড়ি৷ পুরনো কলকাতার রাস্তাঘাটে এমন জরাজীর্ণ বাড়ি হামেশাই দেখা যায়৷ দোতলায় ভাড়াটে রাখা হয়েছে৷ সে টাকাতেই একতলার মালিকদের সংসার চলে৷ বাড়িটার দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায় অন্তত বছর কুড়ি এ বাড়ির কোনও সংস্কার হয়নি৷ উপরের বারান্দা ঘেঁষে কয়েকটা পুরনো শাড়ি ঝুলছে৷ একদিকে দেয়াল খেয়ে ফেলেছে গাছের এগিয়ে আসা গুঁড়ি৷ ভাঙা জানলার গ্রিলে মরচে ধরেছে৷ রাস্তা থেকে কয়েকধাপ সিঁড়ি উঠলে একটা ঘুণে খাওয়া সবুজ কাঠের দরজা৷ তাতে একটা আংটা ঝুলছে৷
উপরে উঠে তাতেই কড়া নাড়ে শৈলেন৷ সজোরে বারদুয়েক কড়া ঝাঁকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সে৷
প্রায় আধমিনিট পরে ঝনাৎ শব্দ করে খুলে যায় দরজাটা৷ বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা বেরিয়ে এসে ওর দিকে মুখ তুলে তাকায়৷ তারপর বাইরে পার্ক করা ইনোভা গাড়িটার দিকে এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়৷ জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘কী ব্যাপার?’
‘এটা পুষ্পরানি লাহিড়ীর বাড়ি তো?’
‘হ্যাঁ৷ কিন্তু আপনি…’
‘আমি ওনার ছেলে হই৷ আমার নাম শৈলেন লাহিড়ী…’
মহিলার মুখে আচমকাই একটা আশঙ্কার ছায়া নামল, যেন এরকম একটা সকাল আসবে সে আগে থেকেই জানত৷ সরু গলার মাঝখানে গলকণ্ঠটা একবার ওঠানামা করল, ‘আপনি বিদেশে থাকেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ সকালেই এসে পৌঁছেছি৷ পরশু আবার রিটার্ন ফ্লাইট…’ মানিব্যাগ থেকে পাসপোর্ট বের করে মহিলার সামনে মেলে ধরে শৈলেন, ‘এই যে, নাম… মায়ের নাম… আর…’
‘লাগবে না…’ হাত নাড়ে মহিলা, ‘আপনার ছেলেবেলার ছবি দেখেছি আমি৷ কিন্তু আইনের ব্যাপার-স্যাপার হলে… আপনার মা তো…’
‘জানি, আমি একটা কাজে এসেছি৷ একটা দরকারে…’
‘কী দরকার?’ মহিলার গলার স্বরে সন্দেহ ঘনীভূত হয়৷
এবার ঘাড় সোজা করে হাসে শৈলেন, ‘সব বলছি, একটু ভেতরে আসতে দেবেন?’
এতক্ষণে যেন মহিলার সৌজন্যবোধ ফিরে আসে, লজ্জিত মুখে দরজা থেকে সরতে সরতে বলে, ‘হ্যাঁ, আসুন না৷ আপনারই তো বাড়ি…’
ভেতরে ঢুকে আসেন শৈলেন৷ বাড়ির ভেতরটা বাইরের থেকে আরও বেশি রংচটা৷ আলো ভীষণ রকম কম৷ সেটা সম্ভবত ইলেকট্রিসিটি বিল কমানোর জন্য৷ রাস্তার দিকের একটা খোলা জানলা দিয়ে পাতলা সূর্যের আলো আসছে৷
তবে একতলার ডাইনিংটা বেশ বড়৷ তার বেশিটাই হাবিজাবি আবর্জনা আর ভাঙা আসবাবে ঢাকা পড়ে গেছে৷ সিমেন্টের মেঝে৷ দড়ি থেকে গামছা আর নাইটি ঝুলছে৷ একদিকে কিছু বাসনকোসন জমা করে রাখা৷ বাসন মাজা সাবানের ঘ্যানঘ্যানে গন্ধ আসছে সেখান থেকে৷ সম্ভবত এতক্ষণ দুপুরের বাসন মাজছিলেন মহিলা৷ তার দিকে একবার আড়চোখে দেখে নেয় শৈলেন৷ ছিপছিপে চেহারা৷ পরনে একটা রংচটা নাইটি৷ মাথার চুল উসকোখুসকো৷ গলার কাছে কণ্ঠার হাড় দৃশ্যমান৷
তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঘরের ভিতরে তাকায় শৈলেন৷ একদিকে দুটো পাশাপাশি ঘরের দরজা৷ তার মধ্যে একটা বন্ধ, অন্যটা খোলা৷ খোলা ঘরের মধ্যে একটা মশারি টাঙানো বিছানা দেখা যাচ্ছে৷ তার ভেতর কে শুয়ে আছে বোঝার উপায় নেই৷
বাইরে একটা কাঠের চেয়ারের উপর জামাকাপড় ডাঁই করে রাখা ছিল৷ সেগুলো সরাতে সরাতে চেয়ারটা দেখিয়ে মহিলা বলল, ‘আপনি চা খাবেন?’
দু-দিকে মাথা নাড়ে শৈলেন৷ চেয়ারের উপরে বসতে বসতে বলে, ‘বুঝতে পারছি আপনি আমাকে দেখে ভয় পেয়েছেন৷ চিন্তা করবেন না৷ আমি এ বাড়ির দখল নিতে আসিনি৷ আমার দরকারটা আসলে…’
মহিলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে৷ এই প্রথম মুখে হাসি ফোটে তার, উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলে, ‘হ্যাঁ, বলুন কী দরকার?’
ইতস্তত করে শৈলেন, ‘দরকারটা এতটাই পিকিউলিয়ার যে ঠিক কীভাবে বলব…’ উত্তরটা দেওয়ার হাত থেকে যেন আপাতত পালাতে চায় শৈলেন, খোলা দরজাটার দিকে আঙুল তুলে দেখায়, তারপর বলে, ‘রুনিমাসি আর টুনিমাসি কি ওই ঘরে?’
নামগুলো শুনে একটু চমকায় মহিলা৷ ভুরুটা ভাঁজ খায় তার৷ জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যাঁ৷ আমি ওদের দেখাশোনা করি…’
‘ওদের শরীর কেমন আছে?’
‘ছোট মাসি, মানে রুনিমাসির শরীর একেবারেই ভালো নয়৷ ক্যানসার হয়েছে৷ ফাইনাল স্টেজ৷ টুনিমাসিরও অবস্থা ভালো নয়৷ স্মৃতিটা পুরোই নষ্ট হয়ে গেছে৷ আমাকেই মাঝে মাঝে চিনতে পারে না৷ মাসখানেক হল উঠতে পারে না বিছানা থেকে৷ আর রাতের দিকটায়…’
ঘরের দিকে আরেকবার মুখ ফিরিয়ে তাকায় শৈলেন৷ মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার৷ মহিলা বলে, ‘বিছানা থেকে উঠতে পারে না দু-জনেই৷ আমি কোলে করে বাথরুম অবধি নিয়ে যাই৷ না নিয়ে যেতে পারলে…’
‘আপনি বয়ে নিয়ে যেতে পারেন? মানে একটা আস্ত মানুষকে কোলে করে…’
মহিলা বাঁকা হাসি হাসে, ঝকঝকে দাঁতের শাড়ি দেখা যায় তার, ‘চেহারা দেখে মনে হয় না, তাইতো? আপনি ওদের যখন দেখেছিলেন সেরকম চেহারা তো নেই, অসুবিধা হয় না৷ ভালো কথা, আপনার দরকারটা…’
শৈলেন বুঝতে পারে মহিলার কথাবার্তায় শিক্ষার ছাপ আছে৷ মা সম্ভবত লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন তাকে৷ তবে পেটে শিক্ষা আছে বলেই বোধহয় কথাবার্তা কেমন ঝাঁঝালো৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শৈলেনকে বিদায় করে দিতে পারলেই সে খুশি৷
একবার গলা খাঁকারি দেয় শৈলেন৷ তারপর চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলে, ‘আসলে কিছুদিন আগে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে৷ একটা বছর চারেকের ছেলে ছিল, তারও কাস্টডি পাইনি৷ মাসখানেক আগে ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে গেছিলাম৷ আমার হাতটা ধরেই ছিল৷ এমন সময়…’
শৈলেনের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে মহিলা আর প্রশ্ন করতে ভরসা পায় না, মুখ নামিয়ে নেয়৷ শৈলেন নিজেই বলে, ‘গাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরোচ্ছিল ও৷ উল্টোদিক থেকে একটা ট্রাক এসে… স্পট ডেথ৷ আমার চোখের সামনেই৷’
ঘরের বাতাস ভারীই ছিল৷ এখন একটা বিষণ্ণতার গন্ধ এসে মেশে তাতে৷ সেটা লঘু করতেই একটা নরম হাসি হাসে শৈলেন, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন এসব কথা আপনাকে কেন বলছি আমি, আসলে… আমার প্রয়োজনটা না বুঝলে…’
‘বলুন…’ এককথায় উত্তর দেয় মহিলা৷
একটা হাতের উপর অন্য হাত দিয়ে আঁচড় কাটে শৈলেন, ‘আসলে নিজের চোখে সমস্ত ব্যাপারটা দেখেছি তো, চোখ বন্ধ করলেই বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে৷ ফলে মাসখানেক হল একটা রোগ হয়েছে— ইন্সোমনিয়া…’
‘সেটা কী?’ মহিলা উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে৷
‘না ঘুমানোর রোগ৷ আজ এক মাস হয়ে গেল আমি ঘুমাইনি৷ মেন্টাল ট্রমা তো আছেই, সেই সঙ্গে দীর্ঘদিনের ডিপ্রেশন, একাকীত্ব৷ এ বাড়িতে ঢোকার আগেই আমার সাইকায়াট্রিস্ট ফোন করেছিল, সে বলছে…’
মহিলা এতক্ষণে সমস্যাটা বুঝতে পারে৷ এ ঘরে আলো কম বলে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বাইরে লোকটাকে দেখেই ঝটকা লেগেছিল ওর৷ যেন চামচ দিয়ে চোখের কাছটা আইসক্রিমের মতো তুলে নিয়ে সেখানে কয়লার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে কেউ৷ দেখেই বোঝা যায় অনেকদিন ঘুমায়নি৷ এই তাহলে রোগ?
‘রোগ হয়েছে, ডাক্তারের কাছে যান..’ কথাগুলো একটু বেশিই ঝাঁজের সঙ্গে বলে ফেলেছে মহিলা৷ বলেই বুঝতে পারে উত্তেজনার বশে দুর্ব্যাবহার করে ফেলেছে৷ গলাটা খাদে নামিয়ে বলে, ‘বুঝতে পারছি খারাপ সময় চলছে আপনার৷ কিন্তু তার জন্য এ বাড়িতে এসে…’
চেয়ার থেকে উঠে পড়ে শৈলেন৷ তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় খোলা দরজাটার দিকে৷ দরজার উপর হাত দিয়ে ভিতরে তাকায়৷ অল্প আলোয় মশারির ভেতর দলা পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে দুটো শীর্ণ শরীর৷
গোটা ঘরময় একটা অসুস্থতার গন্ধ৷ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে গন্ধটা কেমন মন খারাপ করিয়ে দেয়৷ তাও সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে মশারির ভিতরে আবছা রহস্যময় প্রাণীদুটোর অবয়ব বোঝার চেষ্টা করে শৈলেন৷
হঠাৎ পেছন ফিরে বুঝতে পারে মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে ওর পেছনে৷ শৈলেন আর একপা এগিয়ে যায় মশারির দিকে৷ নিচু গলাতেই বলে, ‘আপনার শুনতে হয়তো অবাক লাগবে, কিন্তু… রোগটা সারাতে ওদের দু-জনকেই দরকার আমার৷’
‘মাসিদের? কেন?’ হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মেয়েটা৷
শৈলেন সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই বলে, ‘ছোটবেলায় দু-জনকে আমি একটা নামে ডাকতাম, জানেন? মা শিখিয়েছিল…’
‘কী নাম?’
‘ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি…’ কথাটা বলতে বলতে মশারির গা ঘেঁষে দাঁড়ায় শৈলেন, ‘মা আমাকে কিছুতেই ঘুম পাড়াতে পারত না৷ দস্যি ছিলাম তো৷ আর মায়ের ধৈর্যটা বরাবরই কম৷ প্রথম প্রথম নিজে চেষ্টা করত বটে, শেষে বিফল হয়ে ওদের হাতে দিয়ে বলত ‘নে, তোরাই ঘুম পারা’৷ আশ্চর্যের ব্যাপার মায়ের অত দস্যি ছেলে ওদের কাছে চট করে ঘুমিয়ে পড়ত৷ সে জন্যেই মা ওই নামে ডাকতে শিখিয়েছিল…’
মহিলাও এতক্ষণে মশারির দিকে চেয়েছে৷ ঠোঁটের কোণে বিড়বিড় করে বলল, ‘ওদের মুখেই শুনেছি, বড় জেঠিমা রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল ওদের দু-বোনকে৷ বাপ বেচে দিয়েছিল মাড়োয়ারি শেঠের হাতে৷ মাসখানেক ছিলও সেখানে৷ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দু-জনে পালিয়ে আসে৷ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিল, এমন সময় জেঠিমা দেখতে পেয়ে নিয়ে আসে ওদের… ভেবেছিল পুলিশের কাছে দিয়ে আসবে, কিন্তু ওরা আর বড় জেঠিমার আঁচল ছাড়েনি৷ কিন্তু…’ মহিলা এবার মুখ তুলে তাকায় শৈলেনের দিকে, ‘আপনি কী চাইছেন বলুন তো?’
‘আমাকে একটা রাত ওদের মাঝখানে ঘুমাতে দেবেন?’ শৈলেনের গলাটা শিশুর মতো শোনায়৷
এ কথাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না মহিলা৷ কয়েক সেকেন্ডের জন্যও সে থমকে যায়, হুট করেই একটা বিশ্রী হাসির তোড় শরীর কাঁপিয়ে দিতে চায় তার৷ সেটা সামলে নিয়ে কোনওরকমে ঠোঁট চেপে বলে, ‘আপনি বিদেশ থেকে এতদূর এই কারণে এসেছেন! দুটো অসুস্থ মানুষের মাঝে ঘুমাবেন বলে? আপনি পাগল, তাই না?’
‘কেন পাগলের কী দেখছেন এতে?’
‘মিস্টার লাহিড়ী, ওরা দু-জনেই মৃত্যুশয্যায়৷ দু-জনের কেউ চিনতেই পারবে না আপনাকে৷ ঘুমপাড়ানো দূরের কথা, একটা হাত ভালো করে উপরে তুলতে পারে না ওরা…’
হাত দিয়ে কপালের ঘাম মোছে মহিলা, ‘পয়সা থাকলে মানুষের মাথায় কত না শখ চাপে, বাপ রে বাপ…’
শৈলেন কিছু বলে না৷ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মশারির দিকে চেয়ে৷ মহিলা তেমন হাসি চাপতে চাপতেই বলে, ‘দেখুন, আইন অনুযায়ী এটা আপনারই বাড়ি৷ আপনি চাইলে একদিন কেন, যতদিন খুশি থাকতে পারেন৷ যেখানে ইচ্ছা শুতে পারেন… খাবার-দাবার যা লাগবে বলবেন, আমি করে দেব…’
কথাটা বলে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে৷ বিড়বিড় করে একবার যেন, ‘কোথাকার পাগল যতসব…’ কথাটাও বেরিয়ে এল মুখ থেকে৷
কয়েক সেকেন্ড সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শৈলেন৷ ঘরের ভিতর সিলিং থেকে পুরনো পাখাটা ক্যাচকোচ করে ঘুরছে৷ বাইরে থেকে বিকেলের কাকের চিৎকার ভেসে আসছে মাঝে মাঝে৷ সেই সঙ্গে অল্প সুরে মিশে যাচ্ছে দুটো অসুস্থ মানুষের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ, যন্ত্রণাময় নিঃশ্বাস…
মশারিটা তুলে ধরে শৈলেন৷ সামনেই একটা মানুষ পাশ ফিরে শুয়ে আছে৷ মুখটা দেখা যাচ্ছে না৷ হাড় বের করা হাতের কুঁচকানো চামড়ার উপর আঙুল স্পর্শ করে শৈলেন, ‘মাসি, মাসি শুনতে পাচ্ছ…’
***
‘বেশ তো ঘুমিয়ে পড়েছিলি, আবার উঠে পড়লি কেন?’ অতু চোখ মেলে তাকাতেই হালকা ধমকের সঙ্গে বলল রুনিমাসি৷
‘ঘুম আসছে না৷ সেই গল্পটা বলো না মাসি..’
‘কোনটা?’ টুনিমাসি ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে৷
‘সেই যে ভুলো ভূতের গল্প৷ যে সব কিছু ভুলে যেত..’
‘উঁহু, আজ নয়৷ অনেক রাত হয়েছে৷ ওই গল্পটা অনেক বড়৷’
অতু অনুযোগের সুরে বলে, ‘আমি কি গোটা গল্প শুনি? একটু বলতে বলতেই তো ঘুমিয়ে পড়ি…’
অতুর দুই মাসিই হেসে ওঠে৷ বাচ্চা ছেলেটার পেটের উপর ওদের দু-জনের হাত হালকা ভাবে পড়ে আছে৷ সেই হাতটাও যেন কেঁপে যায় একবার৷
‘ওই গল্পটাই এত ভালো লাগে কেন তোর?’
‘ভালো লাগে না, ভয় লাগে…’ অতু টুনিমাসির মুখের দিকে চেয়ে বলে৷
‘ভয় লাগে কেন?’
অতুর গলা উদাস হয়ে যায়, ‘আচ্ছা, কখনও তোমরা যদি আমাকে ভুলে যাও?’
‘সে তো যাবই৷ বুড়ো হলে কি মানুষ সবকিছু মনে রাখতে পারে?’
‘তখন কী হবে তাহলে?’
‘কী আবার হবে? ততদিনে তুইও অনেক বড় হয়ে যাবি৷ নিজে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তে পারবি তখন৷ বরং তখন তোকে তোর ছেলেমেয়েকে ঘুম পাড়াতে হবে…’ চটুল হাসি হেসে ওঠে ওর দুই মাসি৷
‘তখন আমিও কাঁদব?’
ওর দুই মাসিই অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে, ‘কাঁদবি কেন?’
‘তোমরা যে আমাকে ঘুম পাড়ানোর সময়ে কাঁদো?’
ওর দু-পাশে আধশোয়া হয়ে থাকা দুটো মানুষ নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচায়ি করল একবার৷ মুখে একটা অচেনা ছায়া নামল তাদের৷ সেটা লক্ষ করেই অতু হাসল, বড়দের মতো ভাব করে বলল, ‘আমি দেখেছি, আমাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে পাড়াতে তোমরা কাঁদো৷ কেন কাদো মাসি?’
অতু কয়েক সেকেন্ড কোনও উত্তর পেল না৷ ওর পেটের উপর দুটো হাত এখনও শক্ত পাথরের মতো পড়ে আছে৷ ক্রমশ তার মধ্যে একটা হাত ওর গালে উঠে আসে, ‘যেদিন কাঁদবি সেদিন বুঝতে পারবি…’
একদিকে পাশ ফিরে শোয় অতু, ‘তোমরা আমাকে ভুলে গেলেও আমি কাঁদব৷ সে আমার যতই বয়স হোক না কেন…’
রুনিমাসি ওর গালে হাত রাখে, ‘ওমা! কাঁদবি কেন? মনে করিয়ে দিবি আমাদের…’
‘কেমন করে?’
কথা বলতে বলতে এতক্ষণে ঘুম পেয়ে যায় অতুর৷ মাসিদের মুখের বাকি উত্তরটা আর শোনা হয় না তার৷
* * *
দুপুর নাগাদ পাশের ঘরটা খুলে দিয়েছে মহিলা৷ নিজের হাতের ছোট সুটকেসটা সেখানেই রেখেছে শৈলেন৷ দুপুরে সামান্য কিছু খাওয়া দাওয়া করে নিয়েছে৷ মহিলার হাতের রান্না মন্দ নয়৷ ওকে খুব একটা পছন্দ না করলেও খুব একটা অশ্রদ্ধা নিয়ে রান্নাবান্না করেনি৷ সেসব খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতেই দিনটা বিকেলের দিকে গড়িয়েছে৷
এর মাঝে কয়েকবার পাশের ঘরে গিয়ে মাসিদের দেখে এসেছে শৈলেন৷ কখনও পাশের চেয়ারে চুপ করে বসে থেকেছে৷ মড়ার মতো বিছানার দু-ধারে পড়ে আছে দুটো মানুষ৷ নড়াচড়া নেই৷ নিরবচ্ছিন্ন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ আর মাঝে মাঝে কাশির আওয়াজ৷ সে আওয়াজ একটু বেশিক্ষণ ধরে চললেই পাশের ঘর থেকে এসে কী একটা ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গেছে মহিলা৷ মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে শৈলেন দুই মাসিকেই ঠেলা দিয়েছে, ‘মাসি, শুনছ? চিনতে পারছ আমাকে? আমি অতু…’
কোনও সাড়া আসেনি৷ সম্ভবত আসবেও না৷
গোটা দিনের জেট ল্যাগে শরীরটা একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল শৈলেনের৷ দুপুরবেলা সে ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে ফিরে এসে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসেছিল৷
ঘুম আসে না… ঘুম আসে না৷ চোখ বন্ধ করেই একরাশ স্মৃতি ভিড় করে মাথার ভিতর৷ একটা জনশূন্য পৃথিবী৷ ওর সমস্ত শরীর ঘা আর ক্ষততে ভরে উঠেছে, ও প্রাণপণে ছুটে যাচ্ছে একটা ডাক্তারের চেম্বার থেকে অন্য ডাক্তারের কাছে৷ কিন্তু অবাক কাণ্ড — ওষুধপত্র, ইঞ্জেকশন, স্টেথোস্কোপ, সব আছে —কেবল কোথাও কোনও ডাক্তার নেই৷
চেয়ারে চোখ বুজে বসে থাকতে থাকতেই বিকেল হয়ে গেছিল৷ চোখটা খুলল মহিলার ডাকে৷ চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে সে বলল, ‘আপনার ফেরার টিকিট আছে তো?’
শৈলেন হাসল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না৷ যাই হয়ে যাক, আমি পরশুর পর মোটেই এখানে থাকব না…’
মহিলা বিছানার ধারে বসতে বসতে বলল, ‘বললাম তো, আপনার বাড়ি৷ যতদিন খুশি থাকুন৷ কিন্তু আমার খালি নিজের মতোই বাজার করা আছে৷ যদি তার বেশি থাকেন তাহলে…’
‘পরশু সকাল সাড়ে দশটার ফ্লাইট৷ একেবারে ভোর ভোর বেরিয়ে যেতে হবে৷ তার মধ্যে আমার জন্য যা অতিরিক্ত খরচ হয় সেটা আমি কম্পেন্সেট করে যাব…’
মহিলা আর কিছু বলল না৷ নিজের চায়ে একটা বড়সড় চুমুক দিয়ে বিছানার উপর বাবু হয়ে বসল৷ শৈলেন এতক্ষণে খেয়াল করেছে আজ দুপুর থেকে সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে একটা ব্যঙ্গ মিশ্রিত কৌতূহল বারবার মহিলার মনের মধ্যে আসছে, কিন্তু কিছুতেই সেটা প্রকাশ হতে দিতে চাইছে না সে৷
চায়ের কাপে চামচ ঘোরাতে ঘোরাতে শৈলেন জিজ্ঞেস করল, ‘ভালো কথা, আপনার নামটাই জানা হয়নি…’
‘সুকন্যা পাল, বড় জেঠিমা সুকু বলে ডাকত…’
‘কতদিন হল আছেন এখানে?’
‘ওই বছরতিনেক৷ বড় জেঠিমাই নিয়ে এসেছিলেন আমাকে৷ আপনার কথা ওঁর মুখে মাঝে মাঝে শুনেছি৷ তবে এতদিন পড়ে হুট করে এসে পড়বেন সেটা ভাবতে পারিনি, তাই…’
চায়ের কাপে একটা চুমুক দেয় শৈলেন৷ নাঃ, খুব একটা বেশি মিষ্টি দেয়নি৷ চা’টা পাশের টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বলে, ‘কী বলতেন আমার ব্যাপারে? আমি স্বার্থপর, দেশে ফিরতে চাই না, এইসব?’
‘না, ছোটবেলার কথা বেশি বলতেন৷ সত্যি কথা বলতে আপনার ছেলেবেলার কথা আমি এত শুনেছি যে মনে মনে একটা ছবি ফুটেছিল আপনার৷ তার সঙ্গে একেবারেই মিল নেই এখন…’
‘আর মাসিরা? ওঁরা কিছু বলতেন না?’
সুকন্যা পাল ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবে, তারপর কেটে কেটে বলে, ‘আমি যখন এখানে আসি তখনও ওরা এতটা অসুস্থ হয়নি৷ তবে আপনার কথা বলতে শুনিনি কখনও৷’
‘অথচ মায়ের থেকে বেশি ওদের কাছেই মানুষ হয়েছি আমি৷ কোলেপিঠে করে মানুষ করা যাকে বলে৷ ছোট থেকেই দেখছি মা এনজিও করে৷ আরও হাবিজাবি কত কিছু৷ আমাকে দেওয়ার মতো সময় একদম থাকত না…’
‘ছোট থেকেই দেখেছেন ওদের?’
পকেট থেকে প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল শৈলেন৷ ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলল, ‘একেবারে জন্ম থেকে নয়৷ আমার যখন বছরপাঁচেক বয়স তখন মা ওদের একরকম রাস্তা থেকেই বাড়ি নিয়ে আসে৷ পাড়ার লোকে ওদের আড়ালে ‘মাসি-মাসি’ বলে টোন টিটকিরি করত৷ একদিন আমার সামনেই করে ফেলেছিল৷ আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম — মা, মাসি মানে কী? মা বলেছিল ওরা আমাকে ঘুম পাড়ায় তো, তাই ওরা ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি…’ কথাগুলো একদমে বলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় শৈলেন, ‘মা বলল আমার কথা, অথচ ওরা বলল না… অদ্ভুত, না?’
‘অভিমান হয়েছিল হয়তো…’
হেসে মাথা নাড়ায় শৈলেন, সিগারেটের মুখে ছাইয়ের পরত জমেছিল, সেটা অ্যাশট্রেতে ফেলে বলল, ‘আমার উপর অভিমান কেন বলুন তো? সে তো মায়ের উপর হওয়ার কথা৷ মা-ই আমাকে কখনও কাছে রাখতে চায়নি৷ একরকম জোর করেই অত কম বয়সে ব্যাঙ্গালোরে পড়াশোনা করতে পাঠাল৷ আমার না তো ওসব কালচার ভালো লাগত, না ওই পড়াশোনা৷’
‘তারপর কী করলেন?’
‘আর পাঁচটা লোক যা করে৷ মানিয়ে নিলাম৷ ভেবেছিলাম ক-টা বছরের তো ব্যাপার৷ পড়াশোনা শেষ করে কলকাতার কাছে চাকরিও পেয়েছিলাম৷ মা নিতে দিল না৷ বলল এদেশে পড়াশোনা করে কোনও লাভ নেই৷ বিদেশে চলে যা…’ করুণ হাসি হাসল শৈলেন, ‘আমার মা আর পাঁচটা বাঙালি মায়ের থেকে একটু আলাদা ছিল…’
‘সেই অভিমান থেকেই আর দেশে ফিরলেন না?’
সিগারেট আঙুলের ফাঁকে ধরে চায়ের কাপে আর একটা চুমক দিয়ে ওর দিকে মুখ তুলে তাকায় শৈলেন, ‘আপনাকে কে বলল আমার মায়ের উপর অভিমান আছে?’
‘তাহলে এতদিন ফিরলেন না কেন?’
শৈলেনের গলার স্বর দূর থেকে ভেসে আসে, ‘সুকন্যাদেবী, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, অভিমান — এসব থাকলে মানুষ ফিরে আসে৷ যে আর কখনও ফেরেনি, জানবেন তার আর ওসব কিছুই ছিল না৷ তাই ফেরেনি…’ নাক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে শৈলেন, ‘আমি একটা সময় বুঝে গিয়েছিলাম আমার এখানে আর কিছুই নেই৷ মা, বাবা, মাসি-পিসি, চেনা মুখ, চেনা ঘর, চেনা আঁচল, কী করব ফিরে?’
‘যদি কিছু না থাকে তাহলে আজ তাহলে ফিরলেন কেন?’
খোলা জানালাটা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় শৈলেন৷ বিকেলের রোদ নামছে বাইরে৷ দু-একটা পাড়ার বাচ্চা ছেলে ব্যাট হাতে চলে গেল দূরের দিকে৷ কিছুক্ষণ স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে শৈলেন বলল, ‘কারণ আজ আর আমার ওখানেও কিছু নেই৷ আমার বউ, ছেলে, বন্ধুবান্ধব, টাকাপয়সা সব কিছু মিনিংলেস হয়ে গেল৷ এখন শুধু একটু ঘুম দরকার…’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে, ‘নইলে ভাবার ক্ষমতাটাও চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে৷’
সুকন্যা চায়ের বাকিটুকু এক ঢোঁকে শেষ করে ফেলে৷ তারপর সেটা খাটের একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলে, ‘তবে আমার মনে হয় না এখানে এসে আপনার কিছু লাভ হবে বলে৷ ওরা আজ মাসখানেক হল কিছুই করতে পারে না৷ আগের কিছুই আর নেই…’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শৈলেন, ‘আচ্ছা আমার কাছে তো ছবি-টবিও নেই৷ ওদের আগের কোনও ছবি আছে আপনার কাছে?’
সুকন্যা একটুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবে৷ তারপর ভুরু কুঁচকে বলে, ‘থাকার কথা তো ছিল৷ কিন্তু বাড়ি বদলের সময় সেসব… বেশ, খুঁজে দেখব নাহয়…’
কথাটা বলতে বলতেই উঠে পড়ে সে৷ ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলে, ‘দশটা নাগাদ ওদের খাওয়াতে হয়৷ তারপর থেকে ওরকম পড়েই থাকে ওরা৷ একটা বালিশ রেখে দেব৷ যখন খুশি গিয়ে শুয়ে পড়বেন, কেমন?’
সুকন্যা চলে যেতে শৈলেন উঠে দাঁড়িয়ে জানলার কাছে সরে আসে৷ একটু আগে ব্যাট হাতে যে ছেলেপুলের দল হেঁটে গেছে তাদের ছোট হয়ে আসা শরীর এখনও দেখা যায়৷ মাঠের দিকে হেঁটে যাচ্ছে ওরা৷ শৈলেনের মনে হয় ওদের মুখগুলো ও চেনে৷ কিছুক্ষণ আগেই জানলার বাইরে থেকে ওকে ডেকে ডেকে ফিরে যাচ্ছে ওরা৷ ওকে ছাড়াই খেলতে চলে যাচ্ছে৷
শৈলেন ক্ষীণ স্বরে খুব মৃদু গলায় ডাকে ওদের, ‘আমি আসছি, তোরা দাঁড়া একটু, গুলে, শ্যামল, অনু… শুনতে পাচ্ছিস তোরা? আমি বেরোচ্ছি এক্ষুনি…’
ওরা শুনতে পায় না৷ অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ বিকেলের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে যায় ওরা৷
* * *
‘আমার একদম ভালো লাগছে না মাসি…’
‘কেন?’
‘মা বলেছে আমি বড় হলে আমাকে পড়াশোনা করতে বাইরে পাঠিয়ে দেবে…’
‘না দিয়ে উপায় আছে? তোর মায়ের কত কাজ বল তো?’
‘আমাকে তোমাদের কাছে রাখতে পারবে না?’
‘আমরা কি পড়াশোনা জানি? সেই কবে ইস্কুল পাঠশালের পাট চুকিয়ে দিয়েছি…’
বড় বড় চোখ তুলে দুই মাসির দিকে তাকায় অতু, ‘আচ্ছা মাসি, তোমাদের খুউব কষ্ট, তাই না?’
‘সে এককালে ছিল৷ এখন তোরা আছিস, কষ্ট থাকবে কেন?’
‘আমরা থাকলে তোমাদের কোনওদিন কষ্ট হবে না? আর যদি না থাকি? যদি অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয় মা? তোমাদের কষ্ট হবে?’
রুনিমাসি ওর থুতনিতে একটা হাত রাখে, ‘তুই মাঝে মাঝে আমাদের দেখতে আসবি না?’
‘আমি তোমাদের না দেখে থাকতেই পারব না৷’
‘ব্যস, তাহলেই আর কষ্ট হবে না…’
অতু ওর পাশের ফাঁকা বালিশটার দিকে চায়৷ ও কি ভুলে যাবে মাসিদের? সেদিন মাসিরা কি খুব রেগে যাবে? রেগে গিয়ে আর ওকে দেখতে চাইবে না? আর ঘুম পাড়াতে চাইবে না?
* * *
এ ঘরের বিছানাটা বেশ বড়সড়৷ দুটো মানুষের শরীর এতটাই শীর্ণ হয়েছে গেছে যে তাদের মাঝে একটা মানুষ আরামসে শুয়ে পড়তে পারে৷ সেখানেই একটা নতুন ওয়ার পরানো বালিশ রাখতে রাখতে সুকন্যা বলে, ‘মাঝরাতে ওদের ব্যথা বাড়ে বেশিরভাগ দিন৷ তখন গোঙাবে৷ তেমন হলে আমাকে ডাকবেন, কেমন? আমি পাশের ঘরেই আছি…’
‘রোজই ব্যথা হয়?’
‘প্রায়দিনই৷ যেদিন যেদিন গোঙানির আওয়াজ আসে না ভাবি কেউ একটা মরল…’ সুকন্যা পাল হালকা হেসে বলে৷
শৈলেন নিজের মনেই বিড়বিড় করে, ‘ভালো করে চিকিৎসা করা দরকার ছিল৷ এরকম টার্মিনাল স্টেজে এসে…’
‘দরজাটা ভিতর থেকে দেবেন না৷ রাতে ব্যথা উঠলে…’
‘আজকাল তো বিদেশে নানারকমের থেরাপি হচ্ছে, এখানে সেসবের একটা ব্যবস্থা করে…’
‘মাঝরাতে আপনার গরম লাগলে…’
বিরক্ত হয় শৈলেন, বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে, ‘এতক্ষণ ধরে আপনাকে বলছি ওদের চিকিৎসার কথা আর… অদ্ভুত মানুষ তো আপনি…’
সুকন্যা হাতের বালিশটার উপরে সজোরে একটা চাপড় মারে, তারও কানের পাশ গরম হয়ে ওঠে, ‘হঠাৎ আজ চিকিৎসার কথা বলছেন যে? এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার মায়ের কী রোগ হয়েছিল জানেন? ওদের শরীর কবে থেকে খারাপ হতে শুরু করেছে জানেন? কতবার এসেছেন দেশে? ক-টা টাকা পাঠিয়েছেন?’
‘আমাকে কেউ কিছু জানায়নি৷ জানালে অন্তত টাকাটুকুনি পাঠাতে পারতাম…’
‘এসব ছেঁদো কথা রাখুন মিস্টার লাহিড়ী…’ ওর দিকে দু’পা এগিয়ে আসে সুকন্যা পাল, ‘সত্যিটা স্বীকার করতে শিখুন, আপনি খবর নেননি কারণ এতদিন আপনার কিছু যায়-আসেনি৷ কোথায় আপনার মা-মাসিরা ধুঁকে ধুঁকে মরছে, তারা কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে, কোন শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খায় তার খোঁজ রাখেননি, কারণ আপনার যায়-আসেনি৷ আজ আর কোথাও কিছু নেই বলে এখানে এসেছেন স্রেফ নিজের দরকারে৷ আপনি নিজের দরকার ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝেন না…’
‘বাঃ! একদিনে এত চিনে ফেলেছেন আপনি আমাকে?’
‘বললাম না, আপনার গল্প ছোট থেকে শুনে আসছি আমি, আমার কী মনে হয় জানেন? আপনি একটা স্বার্থপর…’
‘তাই নাকি?’
‘তাই না? আপনি নিজের দরকার মতো মনে রাখেন, তারপর ভুলে যান৷ যতটুকু ভুলে গেলে সব ঠিক থাকবে, মন ভালো থাকবে ততটুকু ভুলে যান আপনি৷ যাদের ভুলে গেলেন তাদের কেমন করে কাটে সেটা নিয়ে আপনি দু-সেকেন্ডও ভাবেন না…’
ভুরু কুঁচকে যায় শৈলেনের, একটু চুপ করে থেকে সে বলে, ‘এগুলো মা বলেছে আপনাকে, নাকি মাসিরা?’
সুকন্যা পালের চোখের আগুন হুট করেই নিভে যায়৷ এতক্ষণের উত্তেজনায় বলা কথাগুলো একরকম ঝোঁকের বশেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে তার৷
‘কোনও দরকার পড়লে ডাকবেন… কিছু মনে করবেন না…’ একরকম মুখ লুকিয়েই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে৷
পকেট থেকে ফোনটা বের করে শৈলেন৷ এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বেজেছে ফোনটা৷ শুভময়ের কল৷ ছেলেটা ওকে নিয়ে একটু বেশিই দুশ্চিন্তা করছে৷ রিং ব্যাক করে ফোনটা কানে চেপে ধরে শৈলেন, ‘বল…’
‘ইউ আর অলরাইট?’
‘জানি না৷ তবে মা আমাকে নিয়ে এত কথা ভেবে রেখেছে আমি জানতাম না…’
‘কী কথা?’
‘তোর মনে আছে একবার বলেছিলি ছোটবেলায় কোনও মেন্টাল ট্রমা আমি সহজে ভুলে যেতে পারতাম?’
‘হ্যাঁ, তবে সেটা আমি বলিনি৷ তোর জীবনে এমন কিছু একটা ঘটেছিল যেটা তুই মেনে নিতে পারিসনি৷ আই ডোন্ট নো সেটা কী৷ তখন তোর একটা ট্রিটমেন্ট চলে, সেই ট্রিটমেন্টের ফলেই ছেলেবেলার কিছু কিছু স্মৃতি তোর কাছে ঝাপসা হয়ে যায়৷ এসব তোর তখনকার রিপোর্টেই লেখা আছে…’
‘কী ঘটে থাকতে পারে বল তো?’
‘প্রিয়জনের মৃত্যু, চোখের সামনে কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা৷ এনিথিং, আমি ঠিক বলতে পারব না…’
‘আমার তো মনে পড়ে না এমন কিছু…’
‘বললাম যে ভুলে গেছিস…’
‘ওয়েল, আমার মা জানত৷ যাই হোক, বাদ দে৷ এখানে এখন রাত হয়েছে৷ শুতে যাচ্ছি…’
ফোনটা কেটে দেয় শৈলেন৷ সুকন্যা পাল যাওয়ার আগে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে গেছে৷ সবজে টুনি বাল্বের আলোয় ঘরটা হালকা আলোকিত হয়ে আছে৷ খাট, একটা ছোট আলমারি, দেওয়ালে দুলন্ত আয়না, ক্যালেন্ডার আর একদিকের দেওয়াল লাগোয়া একটা বড় আলনার আউটলাইন দেখা যাচ্ছে কেবল৷ কেমন যেন মৃত্যুর গন্ধ লেগে আছে ঘরটায়৷ বেশিক্ষণ থাকলে গা ছমছম করে৷
মশারিটা আপাতত খোলা৷ বিছানার উপরে ঘুমন্ত মানুষদুটোর দিকে এগিয়ে যায় শৈলেন৷ হাঁটু ভাঁজ করে বিছানার উপরে উঠে ওদের ঠিক মাঝখানে শুয়ে পড়ে৷
ওর মাথার উপরে সবজে সিলিং৷ ঘুরন্ত আদ্যিকালের পাখা৷ দু-পাশে দুটো ক্ষীণ হয়ে আসা মানুষের অস্তিত্ব৷
বহুদিনের ঘুম না আসা চোখে ও চেয়ে থাকে সিলিংয়ের দিকে৷ নিজের শরীরের ভিতর রক্তের আনাগোনা শুনতে পায়৷ অনুভূতিগুলো জট ছাড়িয়ে এক-এক করে ফুটে ওঠে চোখের সামনে৷ আবার মিলিয়ে যায়৷ আবার সেই পরিচিত দৃশ্য৷ নিঃসঙ্গ পৃথিবী, পরিচিত কেউ নেই, কোথাও কোন চেনা মুখ নেই, চেনা গলার স্বর নেই, স্পর্শ নেই…
পাশ ফিরে হাত দিয়ে একটা মানুষের শরীর স্পর্শ করে৷ খুব মৃদু স্বরে ডাকে, ‘মাসি, অনেক দেরি হয়ে গেছে না?’
অন্যদিকে ফেরে শৈলেন, ‘বলো না, অনেক দেরি হয়ে গেছে?’
শব্দ আসে না৷ কেবল যান্ত্রিক নিঃশ্বাস শোনা যায়৷ নিঃশ্বাসে যন্ত্রণা এসে মেশে৷ মানুষগুলোর মাথার চুল নেই প্রায়৷ চামড়ায় সময় কাটাকুটি খেলে৷ তিরিশবছর আগের হাসিখুশি মানুষকে চামড়া জড়ানো পাথর করে দিয়ে চলে গেছে সময়…
‘আমার খুব দরকার তোমাদের… তোমরা চিনবে না আমাকে?’ শৈলেনের গলা কাতর শোনায়, ‘আমার ঘুম আসে না মাসি, ভয় করে আমার, সারাক্ষণ খুব ভয় করে… চোখ বুজলে ভয় করে… এরকম করে আমি বাঁচব কী করে বল? তোমরা তাও রাগ করে থাকবে?’
এবার দু-হাতে ঠেলা দেয় ও৷ মাথার ভিতরে একটা শিরা ছিঁড়ে যায় যেন৷ শেষ আশা ছিল ওর৷ জানত কোনও লাভ হবে না, তাও ছেলেবেলার টান৷ অন্তত একটা হারানো শিকড়, হারানো মানুষ, যতই অবহেলা করে থাকুক, এতকিছুর পরেও মুখ ফিরিয়ে থাকবে?
অসুস্থ মানুষগুলোর দুটো হাত নিয়ে নিজের পেটের উপরে রাখে শৈলেন, ‘আমার ভয় করলে এইভাবে দু-জনে জড়িয়ে ধরতে তোমরা৷ মনে আছে? আজও খুব ভয় করছে…’
হাতে সেই স্পর্শ নেই আর৷ ঠান্ডা, শীতল, উদাসীন স্পর্শ ওর বুকের ভিতরের মেঘ এতটুকু কমাতে পারে না৷ সেই অসুস্থ নিঃশ্বাসের শব্দ৷ কেউ নেই, কেউ জেগে নেই ওর দু-পাশে…
‘পাথর হয়ে গেছ, না?’
শৈলেনের মুখে হাসি ফোটে৷ বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি ফিরে যাব না মাসি, আমি এখানেই ঘুমাব, তোমাদের মাঝে… দেখো তোমরা…’
ও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে৷ তারপর এগিয়ে যায় আলনার দিকে৷ কিছু পুরনো শতচ্ছিন্ন শাড়ি রাখা আছে সেখানে৷ তার সবেতেই রক্ত কিংবা সময়ের গন্ধ৷
তার মধ্যে থেকে একটা রংচটা শাড়ি তুলে নেয় শৈলেন৷ আলাদিনের মাদুরের মতো নরম স্পর্শ লাগে ওর হাতে৷ বহু পুরনো শাড়ির আঁচলের গন্ধ৷ এমন একটা গন্ধ ছোটবেলা মনে করিয়ে দেয়৷ কতরাত এমন নরম শাড়ির আরামে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়েছে ও৷ বুক দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চায় সে গন্ধটুকুকে৷ নাক ডুবিয়ে দেয় শাড়ির ভাঁজে৷
তবে শাড়িগুলো তেমন মজবুত নয়৷ একটায় হবে না৷ আর একটা শাড়ি আলনা থেকে তুলে নিয়ে পাশাপাশি নিয়ে আসে শৈলেন৷ জড়ো করে দড়ির মতো পাকাতে থাকে৷ এবার যেন একটু একটু ঘুমের ঘর আসছে ওর৷ শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে৷ চোখটা জ্বালা করছে ভীষণ…
হঠাৎ ওর ঘুমের ঘোরে ব্যাঘাত ঘটে৷ ফোনটা পকেটে ভাইব্রেট করছে৷ মনেই ছিল না ওটা বন্ধ করার কথা৷ পকেট থেকে বের করে সরিয়ে রাখতে গিয়েও কী ভেবে সেটা রিসিভ করে শৈলেন৷ ওপাশ থেকে শুভময়ের গলা শোনা যায়, ‘হোয়াট আর ইউ আপ টু শৈলেন?’
‘ফোন রাখ, রাত হয়েছে অনেক…’
‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তুই তোর সমস্ত প্রপার্টি চ্যারিটিতে দিয়েছিস৷ দেশে ফেরার কোনও টিকিট তুই কাটিসনি… তুই…’ ওপাশের গলাটা হুট করেই যেন ঠান্ডায় কেঁপে ওঠে, ‘তুই ওখানে ঘুমাতে যাসনি শৈলেন…’
‘ঘুমাতেই এসেছি, একটা লম্বা ঘুম৷ যেমন বহুকাল ঘুমাইনি…’
‘তুই পাগল হয়ে গেছিস শৈলেন৷ কোথায় আছিস তুই? এক্ষুনি ডাক কাউকে…’
‘আমার ডাকার মতো কেউ নেই৷ শুধু ওখানে না, এখানেও৷ যারা আমায় চিনত, হয় মারা গেছে না হয় ভুলে গেছে আমাকে৷ আমার কোনও শেকড় নেই শুভ…
‘তুই এখানে ফিরে আয় প্লিজ৷ ইউ আর জাস্ট অ্যানাদার ভিক্টিম অফ সিভিয়ার ডিপ্রেশন…’
বিরক্ত হয়ে শৈলেন, তাও গলা নিচে নামিয়েই বলে, ‘কী করব ফিরে? শুভ, আমি বিদেশে কিছু অপরিচিত মুখের মাঝে, অপরিচিত গন্ধ, অপরিচিত শব্দ, অপরিচিত দেওয়ালের মধ্যে কুকুরের মতো ধুঁকতে ধুঁকতে মরতে চাই না৷ আমি ঠিক সেভাবে ঘুমাতে চাই যেভাবে ছোটবেলায় নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতাম৷ রাজার মতো, রাজপুত্রের মতো৷ আমার দুই রূপকথার মাঝে…’
‘শাট আপ, তুই এক্ষুনি কাউকে ডাকবি৷ নইলে আমি…’
শৈলেনের গলায় ব্যঙ্গ এসে মেশে, ‘নইলে কী? তুই এখানে কাউকে চিনিস না৷ কারও নাম্বার নেই তোর কাছে…’
‘পুলিশের আছে…’
‘পুলিশকে কী বলবি? আমি কোথায় এসেছি? তুই ফোন রাখ৷ আমার ঘুম পাচ্ছে…’
ওপাশের কথা শোনার আগেই ফোনটা কেটে দেয় শৈলেন৷ তারপর শাড়িদুটোকে দড়ির মতো পাকিয়ে নেয়৷ শক্ত করে ফাঁস দেয়৷ ওর মতো একটা বিয়াল্লিশ বছরের মানুষকে অন্তত কয়েক মিনিট ধরে রাখতে পারবে ফাঁসটা৷
বিছানার কাছে এগিয়ে এসে দুটো মানুষের পা স্পর্শ করে শৈলেন৷ ওর ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিদের পা৷ তারপর উঠে দাঁড়ায় বিছানার উপর৷ দড়ির একটা দিক বাঁধে পুরনো লোহার সিলিংয়ে৷ নিচ থেকে দুই বৃদ্ধার ঘুমন্ত নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে৷ তারা আর জাগবে না৷ উঠে বসবে না৷ ওকে বাধা দেবে না৷ বহুবছর হল ওকে ভুলে গেছে তারা…
বিছনার উপর দাঁড়িয়ে ফাঁসটা গলায় পরে শৈলেন৷ মনটা ভরে যায় ওর৷ ওর দু-পাশে শুয়ে দুই ঘুমের জাদুকর৷ ঠিক এই জায়গাটায় শুয়েই কতবার ঘুমিয়েছে ও৷ ওই নিঃশ্বাসের শব্দ কী ভীষণ পরিচিত ওর৷ অসহায় চোখে একবার মানুষদুটোর দিকে তাকায়৷ না, ওদের আর কিছু দেওয়ার নেই৷ ওদের হারিয়ে ফেলেছে অনেকদিন আগে৷
ভালো করে গলার সঙ্গে শাড়িটা পেঁচিয়ে নেয় শৈলেন৷ পা দুটো একটু একটু করে তুলে নেয় বিছানা থেকে৷ নিঃশ্বাসের বেগ দ্রুত হয়৷ তারপর কমে আসতে থাকে৷
ঠক – ঠক – ঠক…
দরজায় টোকা পড়ছে৷ শৈলেন ছটফট করতে করতেও শুনতে পায় সুকন্যা বাইরে থেকে ডাকছে ওকে, ‘মিস্টার লাহিড়ী, আপনাকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল… মিস্টার লাহিড়ী…’
এখনই কেন এল মেয়েটা? আর কী পাওয়ার আছে ওর? যন্ত্রণার স্রোত বেড়ে উঠতেই শৈলেনের পা নেমে আসে বিছানার উপরে৷ একটানে সিলিং থেকে দড়িটাকে খুলে বিছানার নিচে লুকিয়ে ফেলে ও৷ ছোট লাফ দিয়ে নেমে আসে মেঝেতে৷ ঘরটা একবার দেখে নিয়ে গলায় হাত বুলিয়ে খুলে ফেলে দরজাটা৷
‘হ্যাঁ বলুন…’ কাশতে কাশতেই জিজ্ঞেস করে৷
মহিলার গায়ে এখনও সারাদিনের পোশাক৷ বোঝা যায় এতক্ষণ পরিশ্রমসাধ্য কিছু একটা কাজ করছিল সে৷ মুখে একই সঙ্গে ক্লান্তি আর উত্তেজনার ছাপ খেলা করছে৷ ওকে দরজা খুলতে দেখে একটা খাতাজাতীয় কিছু এগিয়ে দেয় সুকন্যা, ‘অনেক কষ্ট করে খুঁজে পেলাম৷ ভেবেছিলাম সকালেই দেব, কিন্তু ভাবলাম আপনি তো এমনিতেই ঘুমান না…’
শৈলেন দেখে ওর দিকে একটা ফটো অ্যালবাম এগিয়ে দিয়েছে মহিলা৷ আজ থেকে বছরতিরিশেক আগে এমন ফটো অ্যালবামের চল ছিল৷ অন্তত গোট-পঞ্চাশেক ছবি ধরে রাখা যায় তাতে৷ ধুলো ঢাকা কভারের উপরে একটা পাখির ছবি৷ এই ছবিটা চেনা লাগে শৈলেনের৷ অ্যালবামটা ও আগেও দেখেছে৷ সম্ভবত ছোটবেলায়৷
‘আপনি পুরনো ছবি দেখতে চাইছিলেন না? তবে এটা ওদের কাছে না৷ আমার কাছে ছিল…’
ধীরে ধীরে অ্যালবামটা হাতে নেয় শৈলেন৷ একটা একটা করে পাতা উল্টাতে থাকে৷ ঘরের বাইরের আলোটা জ্বলছে৷ তেরচা করে এসে পড়া আলোতে রং বোঝা না গেলেও ছবির মানুষগুলোকে চেনা যায়৷ ওর স্মৃতি হাঁটতে থাকে পেছন দিকে৷ অসুস্থ মানুষগুলো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ কোথাও ওকে কোলে নিয়ে৷ কোথাও…
শৈলেনের হাত কেঁপে যায়৷ প্রায় সব ছবিতেই ওরা তিনজন আছে৷ তবে শুধু তিনজন নয়…
স্তম্ভিত হয়ে শৈলেন দেখে ছবিতে ওর দুই মাসি আর ওর সঙ্গে রয়েছে আরও একটা মানুষ৷ একটা ওরই বয়সের বাচ্চা মেয়ে৷ তার মুখে হাসি, পরনে কখনও নীলচে রঙের ফ্রক, কখনও ওরই শার্ট৷ কখনও ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে, কখনও শৈলেনের গলা জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে ওর গালে…
এই মুখটা শৈলেনের অপরিচিত নয়৷ এই মুহূর্তে এ মুখটাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে দুটো উজ্জ্বল চোখে৷ ও অবাক হয়ে তাকায় সেদিকে৷ দুটো মুখের মধ্যে মিল খোঁজার চেষ্টা করে৷ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে, ‘এটা… এটা…’
‘আমি…’ সুকন্যা ওর দিকে চেয়ে একটা অদ্ভুত হাসি হাসে৷
‘আপনাকে ছোটবেলায় দেখেছি আমি? কিন্তু…’
‘মনে পড়ছে না, তাইতো? আসলে মানুষ শুধু বয়স হলেই ভুলে যায় না৷ যন্ত্রণার হাত থেকে পালাতে আমাদের মন অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয় আমাদের… ভুলতে না পারলে ঘুম আসে না…’
‘আপনি কী বলছেন আমি কিছুই…’
সুকন্যা ওর দিক থেকে সরে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়৷ রাতের ফিকে হাওয়ায় ওর চুল উড়তে থাকে, ‘আপনার মা রাস্তা থেকে দুটো মেয়েকে তুলে আনেনি৷ এনেছিলেন তিনজনকে৷ যে মারোয়াড়ি শেঠের কাছে ওদের দু-জনকে বিক্রি করা হয়েছিল সেখানে একটা বাচ্চা মেয়েও ছিল৷ সেও পালিয়ে আসে ওদের সঙ্গে৷ আপনার বোনের মতো ছিল সে…’
ধীরে ধীরে ঝাপসা কিছু ছবি ভেসে ওঠে শৈলেনের মাথার ভেতরে৷ ওর দুই মাসির মধ্যে একজনের কোলে ওর মাথা৷ আর একজনের কোলে একটা বাচ্চা মেয়ে শুয়ে আছে৷ দু-জনের হাসির আওয়াজে ভরে যাচ্ছে ঘরটা, যন্ত্রণাময় রাতগুলো বদলে যাচ্ছে রূপকথার গল্পে৷ ঝিমঝিমে হাওয়া দিচ্ছে কোথায় যেন৷ টুকরো টুকরো ছবিগুলোকে ধুলো করে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূরে৷ আবার নতুন ছবি তৈরি হচ্ছে৷ ছাদময় লুকোচুরি খেলছে দুটো ছেলেমেয়ে৷ ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠের নরম ঘাসের উপরে৷ তাদের খিলখিল হাসির শব্দ এত বছর পরেও শৈলেনের কানে বাজতে থাকে৷
সুকন্যা বলেই চলেছে এখনও, ‘ওইটুকু বয়সে সেও কম যন্ত্রণা সহ্য করেনি৷ আপনি একা গল্প শোনেননি মিস্টার লাহিড়ী, একা ঘুমাননি৷ আপনার পাশে শুয়ে থাকত একটা বাচ্চা মেয়ে৷ আপনার সব থেকে পুরনো বন্ধু, সব থেকে পুরনো শিকড়!’
‘কিন্তু আমি তাহলে আপনাকে…’
‘ওই যে বললাম, মানুষ তার জীবনের সবথেকে বড় যন্ত্রণাকে ভুলে যেতে চায়৷ আপনি আমাকে ভুলে গেছিলেন কারণ মনে থাকলে আপনি ঘুমোতে পারতেন না৷’
‘কীসের যন্ত্রণা?’
সুকন্যা জানলা থেকে ভিতরের দিকে সরে আসে, বুক ভরে একটা দম নেয়, ‘এখানে আসার পর কয়েকবছর আমি এই বাড়িতে ছিলাম৷ তারপর যে দল আমাদের পাচার করেছিল তারা রাস্তা থেকে আমাকে আবার তুলে নিয়ে যায়৷ অনেকদিন ধরেই টার্গেট করেছিল ওরা আমাকে৷ আবার বিক্রি করে দেয় এক ধনী ব্যবসায়ীর কাছে৷ তারপর অনেক হাত ঘুরে অনেক ঘাটের জল খেয়ে আমি বড় হই৷ সে বড় হওয়ার কথা আপনি যত কম জানতে পারেন ততই ভালো…’
সুকন্যার চোখে মুখে কোনও বিশেষ কোনও অভিব্যক্তি নেই৷ যেন ভারি আরাম করে মনের সুখে কথাগুলো বলছে সে, ‘এত বছর পরে সমস্ত কিছু ছেড়ে আবার ফিরে আসি এখানে৷ বড় জেঠিমাই আমাকে এখানে নিয়ে আসে৷ তারপর থেকে আমি এখানে৷ আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন আপনি মিস্টার লাহিড়ী৷ কতগুলো নোংরা লোক আমাকে তুলে নিয়ে গেছে, আমাকে আর আপনি দেখতে পাবেন না, কিংবা আমি মরে গেছি, এই যন্ত্রণাটা আপনি মানিয়ে নিতে পারেননি৷ তাই ধীরে ধীরে মুছে ফেলেছিলেন আমাকে…’
সত্যি কথা বলছে মেয়েটা? ছবিগুলো মিথ্যে না৷ আজ শুভময়ের বলা কথাগুলোর সঙ্গেও মিলে যাচ্ছে সমস্তটা৷ ছেঁড়া ছেড়া ছবিগুলোও মনের ভিতরে ভেসে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে৷ মিথ্যে বলে লাভই বা কী সুকন্যার?
শৈলেনের মাথার ভিতরে ভারী হয়ে আসে৷ দু’হাতে মাথা চেপে ওর দিক থেকে সরে আসে শৈলেন, ‘কিন্তু আ… আমার কিছু মনে নেই৷ আপনাকে মনে নেই, কাউকে মনে নেই… আমার শুধু ঘুম দরকার, আমাকে আর ঘুম পাড়ানোর কেউ নেই… আমার ঘুম আসে না…’
সুকন্যা এগিয়ে এসে ওর দিকে, ‘আসবেও না৷ আপনি বড় হয়েছেন মিস্টার লাহিড়ী৷ আপনাকে কেউ আদর করে, গান গেয়ে ঘুম পাড়াবে না…’
শৈলেন ছিটকে সরে যেতে যাচ্ছিল৷ ওর একটা হাত ধরে টান দেয় মেয়েটা, ‘আসুন আমার সঙ্গে…’
‘কোথায়?’
উত্তর দেয় না সুকন্যা৷ বিছানার উপরে ঘুমন্ত মানুষদুটো এখনও মরার মতোই পড়ে আছে৷ শৈলেন এখানে আসার পর থেকে তারা একবারও চোখ মেলে চায়নি৷ একবারও উঠে বসেনি৷ শৈলেন একঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়, ‘ছাড়ুন আমাকে৷ ওরা সব ভুলে গেছে৷ ওদের কাছে আর ঘুম আসবে না আমার৷ কিছুতেই আসবে না…’
‘জানি…’
ওর হাতটা ধরে রুনিমাসির মাথার কাছে ওকে বসিয়ে দেয় সুকন্যা৷ দুটো মানুষ একটু নড়ে ওঠে৷ অর্ধমৃত শরীরে উসখুস শুরু হয়েছে৷ সুকন্যা একজনের কাঁধের উপরে হাত রেখে বলে, ‘রাতের দিকে ওদের ব্যথাটা বাড়ে৷ গোঁগোঁ আওয়াজ করে সারারাত৷ মাঝে মাঝে মনে হয় এবার বুড়ি মরে গেলেই ভালো…’
গোটা ঘরময় রক্তের গন্ধটা আরও বেড়ে উঠেছে৷ শৈলেনের সমস্ত শরীর জুড়ে অস্বস্তি৷ সত্যি অসুস্থ মানুষগুলোর গলা থেকে থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ বের হতে শুরু করেছে৷ ক্রমশ বাড়ছে সেটা৷ তীব্র মৃত্যুচিৎকার ধ্বনিত হচ্ছে ঘরময়৷ শৈলেনের ইচ্ছা করে দু-হাতে নিজের কান চেপে ধরতে…
সুকন্যা যন্ত্রণাক্লিষ্ট দু-জনের মধ্যে একজনের মাথাটা তুলে নেয় কোলের উপর৷ ঠোঁটে একটা শিসের মতো শব্দ করে৷ বাচ্চারা যন্ত্রণা পেলে এভাবেই শব্দ করে বোঝাতে হয় তাদের৷ কপালে হাত রাখে৷ গোঙানির শব্দের জোর কমে আসে৷
মুখ ফিরিয়ে সে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে শৈলেনের দিকে৷ ধীরে ধীরে বলে, ‘আমাদের বয়স হয়েছে মিস্টার লাহিড়ী৷ রূপকথার কাছে ঘুমিয়ে পড়ার বয়স আর আমাদের নেই৷ এখন আমাদের রূপকথা তৈরি করতে হবে দাদা৷ না হলে ঘুম আসবে না…’
শৈলেন কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ তারপর কখন যেন আর একজনের মাথাটা তুলে নেয় নিজের কোলে৷ বিড়বিড় করে অজান্তেই কী যেন একটা গল্প বলতে থাকে৷ ভুলো ভূতের গল্প, যে সব কিছু ভুলে গিয়েছিল, তেপান্তরের গল্প, বোকা রাজার গল্প…
গুনগুন করে একটা গান গাইতে থাকে মেয়েটা৷ এতক্ষণে দুটো মানুষের ছটফটানি কমতে শুরু করেছে৷ চিৎকারের তীব্রতা কমে আসছে৷ তাদের ব্যথায় যেন মলম লাগে ধীরে ধীরে৷ ঘুমের রেশ নামে চোখে৷
শৈলেনের চোখে জলের ধারা নামে৷ মেয়েটা সেদিকে তাকিয়ে হাসে, বলে, ‘আপনার মনে আছে? ছোটবেলায় আপনি প্রশ্ন করতেন দুই মাসি আপনাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে কাঁদে কেন?’
শৈলেন কিছু বলে না৷ দু-চোখ ছাপিয়ে জল নেমেছে৷ গলা অবরুদ্ধ৷
‘আপনার কাছে কিছু নেই, আপনার ছেলে, বউ, বন্ধুবান্ধব, এই পৃথিবীর কেউ আপনাকে চেনে না৷ কিন্তু এই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষটাও কাউকে ঘুম পাড়াতে পারে… কারও ব্যথায় মলম লাগাতে পারে… আজ আপনি যে জন্য কাঁদছেন ওরা সেদিন সে জন্যই কাঁদত মিস্টার লাহিড়ী…’
যন্ত্রণা কমে আসতে আবার কখন যেন গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে পাথর হয়ে যাওয়া মানুষদুটো৷ শৈলেনের কোলে তাদের একজনের মাথা৷ অন্যজনের মাথা সুকন্যার পায়ের উপর৷ ঠিক ছোটবেলার মতো৷ কেবল এই তিরিশ বছরে জায়গাগুলো বদলে গেছে৷
সুকন্যার একটু আগে বলা কথাটা ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজেই চলেছে ওর কানের কাছে, ‘এখন আমাদের রূপকথা তৈরি করতে হবে দাদা৷ না হলে ঘুম আসবে না… ঘুম আসবে না…’
ঘুমের নেশায় কোলের উপর পড়ে থাকা মাথায় হাত বুলাতে থাকে শৈলেন৷ চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে সেই মাথার উপরে৷
হাত বুলাতে বুলাতে ক্লান্ত লাগে ওর৷ ক্লান্তি, এমন ক্লান্তি বহুদিন হল লাগেনি কোথায়৷ চোখের জলের নোনতা স্বাদ পায় মুখে৷ হাঁপিয়ে ওঠে…
আর ঠিক সেই সময় এতদিনের ঘুম যেন একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে আসে ওর চোখে৷ ঘুম পায় শৈলেনের৷ অনেকদিন পরে সত্যিকারের ঘুম নেমে আসতে থাকে চোখে…
ওর ঠিক পাশে বসে গুনগুন করে একটা গান গাইছে সুকন্যা৷ ভারি পরিচিত দূর, তাও শৈলেনের মনে হয় সে সুরের মোহেই ঘুমে জড়িয়ে আসছে ওর রাতের পর রাত জেগে থাকা ক্লান্ত চোখদুটো… আরামে ঝিমিয়ে পড়তে পড়তে ও শুনতে পায় মেয়েটা চেনা সুরে গেয়ে চলেছে—
ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি, মোদের বাড়ি এসো,
মোদের বাড়ি এসো… মোদের বাড়ি এসো…