মোদের গরব মোদের আশা

মোদের গরব মোদের আশা

‘বাংলাদেশের ইতিহাস খন্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ়, বারেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়, অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজেরও মিল ছিল না। তবু এর মধ্যে যে ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সেভাষার ঐক্য নিয়ে। এতকাল আমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি।’—রবীন্দ্রনাথ

বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য—এই কথা যেমন ভারত-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও সত্য। বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায় বাংলা ভাষার নানা কথ্য ও লেখ্য উপভাষার মধ্যে, কিন্তু ঐক্যের দিকগুলি যে-কোথায় ও কেমন তা নিয়ে খুব প্রণালীবদ্ধ অনুসন্ধানের কাজ তেমন হয়নি। অথচ প্রায় একশো বছর আগে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের প্রতি এক সম্ভাষণে এই কাজটা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! রবীন্দ্রনাথের এই সম্ভাষণের পর সুনীতিবাবুর বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত বিখ্যাত বইটি প্রকাশিত হয়েছে, সুনীতিবাবুর প্রেরণায় বাংলা ভাষার আঞ্চলিক কথ্যভাষার পরিচয় সম্পর্কেও কিছু কিছু গবেষণার কাজ ইতস্তত শুরু হয়েছে। কিন্তু কবি যা চেয়েছিলেন তা হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার কথ্য উপভাষাগুলির একটি তুলনামূলক বিচার করে বাংলা ভাষার বৈচিত্র্য ও ঐক্যের সূত্রগুলি তুলে ধরা। কবির ভাবনা অনুসরণ করে এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়নি। আসলে কবিমূর্তির সামনে বক্তৃতা করা যত সহজ, তাঁর মূর্তি থেকে দূরে গিয়ে তাঁর কথামতো কাজ করায় অনেক ঝামেলা। একমাত্র বোকা ও পাগল ছাড়া আর কেউই কবির কথায় নাচতে প্রস্তুত নয়। এইজন্যই বোধহয় প্রাচীন গ্রিসের একজন গ্রিক দার্শনিক রাষ্ট্র থেকে কবিদের নির্বাসন চেয়েছিলেন। যাই হোক, আমাদের কবিকে কেউ নির্বাসন দেয়নি এটা যেমন ঠিক, তাঁর কথামতো কাজ কেউ করেনি বা করে না এটাও তেমনি ঠিক। এর ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে এবং হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ওই সম্ভাষণের প্রায় সমসাময়িক কালে গ্রিয়ার্সনের ভারতীয় ভাষা সর্বেক্ষণের কাজ হয়েছিল, ওই সময়ে তাঁর বইয়ের বাংলা ভাষাবিষয়ক খন্ডটিও প্রকাশিত হয়েছে। এ কাজ আগে কখনো হয়নি, তাই এর ঐতিহাসিক মূল্য অস্বীকার করা চলে না, তবু এই কাজের অনন্যতা স্বীকার করেও বলতে হয় এই কাজের মূলে ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিভেদপন্থী পরিকল্পনা—শাসিত জনগোষ্ঠীর ঐক্যের চেয়ে অনৈক্যের ওপরই যার প্রধান নির্ভর। আর এই কারণেই একশো বছর আগে যখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন হয়েছিল তখন বঙ্গভাষী সমাজের ঐক্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত করার জন্য লাটসাহেব কার্জন চেয়েছিলেন, অতঃপর বঙ্গদেশের প্রাথমিক শিক্ষার ভাষামাধ্যম হবে বাংলার নানা আঞ্চলিক উপভাষা। বাঙালি সমাজের সেই সর্বনাশা ‘ভাষাবিচ্ছেদে’র বিরুদ্ধে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এই একজন কবিই, রাজনীতি যাঁর পেশা নয়, কিন্তু যিনি সেদিন চেয়েছিলেন ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন, সব এক হোক, এক হোক।’ তবে সেদিন সেই ভাষাবিচ্ছেদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও সেই বিচ্ছেদের বীজ একেবারে উন্মূলিত হয়নি। কারণ, দেশ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা পেলেও স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও আমরা এখনও ঔপনিবেশিক বশ্যতার উত্তরাধিকার মর্মে মর্মে বহন করে চলেছি। তাই আজও দেখি গ্রিয়ার্সন ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বাংলার ভাষার উপভাষা-সমীক্ষায় সেদিন যেসব ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন আমরা আজও নির্বিচারে তা সত্য বলে মেনে চলেছি। আর তার সুযোগ নিয়ে চলেছে আমাদের দেশের ওপর নজররাখা নানা নয়া উপনিবেশবাদী শক্তি যারা স্থানীয় দালালদের সাহায্যে বাংলাভাষী সমাজের মধ্যে নানা ধরনের ভাষাকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তথা ঐক্যবিনাশী তৎপরতা সংগঠিত করে চলেছে। তারই উদাহরণ আজ উত্তরবঙ্গে বেশ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। উত্তরবঙ্গের স্থানীয় মানুষ কয়েক শো বছর ধরে বাংলা ভাষাকেই তার মাতৃভাষা বলে জেনে এসেছেন এবং তার আঞ্চলিক রূপভেদকে সম্প্রদায়বিশেষের নামে অভিহিত না করে ‘দেশী ভাষা’ বলে অভিহিত করে এসেছেন। অথচ আজ তাঁদের কেউ কেউ নয়া উপনিবেশবাদীদের সুচতুর প্ররোচনায় তাকে বাংলা থেকে ভিন্ন একটি ভাষা বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন এবং আরও পরিতাপের বিষয় এই যে, দক্ষিণ বঙ্গাশ্রয়ী বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রভাবশালী অংশ এই অপচেষ্টার মর্ম অনুধাবন না করে এই আঞ্চলিক কথ্য ভাষারূপকে গ্রিয়ার্সনের অনুকরণে সম্প্রদায়-বিশেষের নামে অভিহিত করছেন এবং নিজেদের লেখালেখিতে তা অসংকোচে উল্লেখ করছেন। অথচ তাঁরা ভেবে দেখছেন না সত্যিই এই নামে কোনো ভাষা আদৌ আছে কিনা বা এই ধরনের নামকরণে কোনো যুক্তির ফাঁক আছে কিনা। মোটের ওপর তাঁদের এই অর্ধমনস্ক উচ্চারণ বিচ্ছিন্নতাকেই সাহায্য করছে প্রকারান্তরে। উত্তরবঙ্গে যেসব সংগঠন এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তাদের কিছু কিছু সদস্য এখন প্রতিবেশী ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রে আত্মগোপন করে আছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের এই আঞ্চলিক কথ্য ভাষা যদি সত্যিই বাংলা ভাষা থেকে পৃথক ভাষা হত তবে ওই সব আত্মগোপনকারী নেতা বা কর্মী রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া এলাকায় ভারতীয় উত্তরবঙ্গের অনুরূপ স্বাতন্ত্র্যকামী ভাষা-আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ হাতছাড়া করত। তা যে সম্ভব হয়নি তার কারণ ‘বাংলাদেশে’র ওইসব এলাকায় ওই আন্দোলন গড়ে তোলার উপযোগী কোনো বাস্তব পরিস্থিতি নেই। আমাদের দক্ষিণবঙ্গাশ্রয়ী ওইসব বুদ্ধিজীবী এসব কথা ভেবে দেখছেন না, কারণ তাঁরা উত্তরবঙ্গ নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখে খুব ভালোই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। উত্তরবঙ্গের প্রকৃত সমস্যা নিয়ে ভাবতে গেলে আরও সময় দিতে হয়, আরও গভীরে যেতে হয়। কিন্তু তাঁদের ‘বাজার’ তাঁদের অত সময় দিতে প্রস্তুত নয়। বলা বাহুল্য এই ‘বাজার’ নিছক বিকিকিনির বাজার নয়, এর সঙ্গে তাঁদের নামডাকের প্রশ্নও জড়িত আছে। এই নামডাকের বাজারে তাঁরা পেশাদার ‘হিতৈষী’ বা বুদ্ধিদাতা বলে পরিচিত, নানান মূল্যের বিনিময়ে তাঁরা তাঁদের বুদ্ধি দিয়ে এই এলাকার সামাজিক হিতসাধনের পরামর্শ দেন। এই সব ‘হিতৈষী’ শুধু উত্তরবঙ্গের জন্যই বুদ্ধি বিক্রি করেন না, পশ্চিমবঙ্গের পুবে-পশ্চিমেও তাঁদের বুদ্ধির বাজার অবাধ ও অব্যাহত। কিন্তু এদের নিয়ে একটা বাস্তব সমস্যা আছে, আর সেটা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ চিহ্নিত করে গিয়েছেন : ‘প্রীতির দানে কোনো অপমান নাই, কিন্তু হিতৈষিতার দানে মানুষ অপমানিত হয়। মানুষকে সকলের চেয়ে নত করিবার উপায়—তাহার হিত করা অথচ তাহাকে প্রীতি না করা।’ মানুষের প্রতি প্রীতিহীন বদান্যতায় এঁরা বেশ সুখেই আছেন। তাই প্রশ্ন জাগে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের তৎপরতায় উত্তরবঙ্গের ভাষাকেন্দ্রিক সমস্যার কিছু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মীমাংসা হলেও তার মানবিক নিষ্পত্তি কি পুরোপুরি সম্ভব হবে? কারণ মানবিক নিষ্পত্তির জন্য চাই প্রীতিপূর্ণ সহমর্মিতা, পেশাদারি বদান্যতা নয়।

যাই হোক, বাঙালিকে আত্মবিস্মৃত জাতি বলা ঠিক নয়, কারণ সব যুগেই অল্প কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ ছাড়া আর সব বাঙালিই তার স্বার্থের কেন্দ্রগুলি সম্পর্কে সর্বদা সচেতন। স্বার্থসিদ্ধির উপায়গুলিও সেকখনো বিস্মৃত হয় না, কাজেই বাঙালিকে আত্মবিস্মৃত বলা যাবে কীভাবে? আসলে বাঙালি মূলত আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থসিদ্ধির ধান্দায় সেস্বার্থের কেন্দ্রগুলিতে নিরন্তর ঘুরপাক খায়। শুধু ব্যতিক্রম ঘটে যখন সেকোনো দিক থেকে কোনো বড়ো ধাক্কা খায়। তখন সেআত্মরক্ষার তাগিদে নিজের কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে অন্যের দিকে হাত বাড়ায় সাহায্য নেওয়া ও সাহায্য দেওয়ার জন্য। দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার বিকাশ হবার পর বাঙালি জাতি এই রকম একটি বড়ো ধাক্কা খায় দ্বাদশ শতকের গোড়ায় যখন বিদেশ থেকে তুর্কিরা এদেশে ঢুকে পড়ে। তার আগে বাঙালি সমাজের উচ্চবর্ণীয় অংশ টোল-চতুষ্পাঠী, বর্ণাশ্রম প্রথা, কৌলীন্য প্রথা ইত্যাদি নিয়ে, সংস্কৃত বা অপভ্রংশ ভাষায় কাব্যকবিতা লিখে এবং রাজা ও রাজসভাকে তোয়াজ করে বহাল তবিয়তে ছিল, সমাজের নিম্নবর্ণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা ছিল প্রভু আর সেবাদাসের। শতাব্দীর পর শতাব্দী এইভাবে চলেছে। শুধু মাঝে একবার কৈবর্ত বিদ্রোহ হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত পাল রাজাদের অভ্যুদয়ে সেসমস্যাও মিটে গিয়েছিল। তাছাড়া পালরাজারা নিজেরা বৌদ্ধ হলেও তাঁদের ধর্মীয় উদারতার জন্য অন্যান্য ভারতীয় ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের কোনো অসুবিধা হত না। তাঁদের পর ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরাজাদের আমলে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হলেও সমাজের বুকে খুব একটা ঘা লাগেনি। কিন্তু বড়ো আঘাত এল তুর্কি আগমনের পর। একে তো তারা বহিরাগত, তারপর তাদের সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় আদর্শ ভারতে প্রচলিত সমস্ত রকম বৈদিক ও অবৈদিক ধর্মাদর্শ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নানা কারণে দেশের নিম্নবর্ণের মানুষেরা ওই বিদেশি ধর্মাদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়তে লাগল। হিন্দু সমাজপতিরা এবার প্রমাদ গুনলেন। নীচের তলায় যদি ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরণ হয় তবে তো সমাজকাঠামোর ভাঙণ ধরবে, তা ছাড়া গায়ে-গতরে খাটার লোকও তো পাওয়া যাবে। ধর্মান্তরিত বির্ধমীকে তো আর সেবার কাজে লাগানো যাবে না। সেজন্য বুদ্ধিমান সমাজপতিরা ঠিক করলেন সমাজের উচ্চবর্ণের সঙ্গে নিম্নবর্ণের একটি সহজ সমন্বয়ের রাস্তা তৈরি করতে হবে। এই রাস্তার জন্য হিন্দু ধর্মের আদর্শের কথা যা এতদিন সংস্কৃতে লেখা পূরাণ আর মহাকাব্যে লেখা থাকত তার মর্মকথা সাধারণ মানুষের ভাষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে হবে। অন্যদিকে শুধু ওপর থেকে চাপিয়ে দিলেই হবে না। নীচের তলার দেবদেবীদেরও কিছুটা শাস্ত্রীয় মর্যাদা দিয়ে তাদের পূজায় ব্যবহৃত মৌখিক মন্ত্র-ব্রতকথাগুলিকেও পুরাণের ঢঙে সাজিয়ে নতুন করে লিখতে হবে। তাই কৃত্তিবাস ওঝা-মালাধর বসুর মতো উচ্চবর্ণের লোকেরা সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজে এগিয়ে এলেন আর বিজয় গুপ্ত বা মুকুন্দ চক্রবর্তীর মতো শিক্ষিত উচ্চবর্ণীয় লোকেরা বাংলায় মঙ্গলকাব্য লিখতে শুরু করলেন। কাজেই ঠেলায় পড়ে এবার বাঙালি সমাজের শিক্ষিত অংশে বাংলা ভাষার কিছুটা গুরুত্ব বাড়ল। তার আগে বৌদ্ধ ও নাথেরা বাংলায় গান লিখেছেন নিরক্ষর জনগণের মধ্যে নিজেদের ধর্মীয় সংগঠন মজবুত করার জন্য, কিন্তু তার প্রভাব সমাজে বহু ব্যাপক হয়নি। তাছাড়া রাজনৈতিক স্তরে বিরুদ্ধ শাসকশক্তির পীড়নে-পেষণে এইসব অব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রচার ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। এই অবস্থায় তুর্কিরা এসে পড়ায় উচ্চবর্ণীয় সমাজপতিরাই জনসংযোগের প্রয়োজনে বাংলা ভাষার চর্চায় এগিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। বাংলা ভাষার সামাজিক প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এটা নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠা অবাধে বা অনায়াসে ঘটেনি। কৃত্তিবাস বা মালাধরেরা সংস্কৃত ছেড়ে বাংলায় লিখতে শুরু করলেও তাঁদের মধ্যে দ্বিধাও ছিল। তাই তাঁরা নানা অজুহাতে সংস্কৃত ছেড়ে বাংলা লেখার জন্য কৈফিয়ত দিয়েছেন। আর বাংলায় লেখা বলে কেউ যাতে সেই লেখাকে অবজ্ঞা না করে সেজন্য তাঁরা রচনার পেছনে দেব-দেবীর স্বপ্নাদেশের গল্প ফেঁদেছেন। শিক্ষিত বাঙালির এই আড়ষ্টতা কেটে গিয়েছে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর। চৈতন্যদেব নিজে যদিও বাংলায় কিছু লেখেননি, তবু তিনি ধর্মপ্রচার করেছেন বাংলা ভাষায়, গান শুনেছেন বাংলা ভাষায়, গান করেছেন বাংলা ভাষায়। অত বড়ো সংস্কৃতজ্ঞ হয়েও চৈতন্যদেব বাংলাকে এত গুরুত্ব দেওয়ায় সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষেরা ক্রমে বুঝতে পারলেন যে, বাংলা লেখায় অগৌরবের কিছু নেই। এবার দলে দলে তাঁরা বাংলা ভাষায় পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, জীবনীকাব্য, অনুবাদ কাব্য ইত্যাদি লিখতে আত্মনিয়োগ করলেন। তাঁদের পদবি থেকেই বোঝা যায় তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন সমাজের তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষ। চৈতন্যদেব এই কারণে শুধু গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মেরই প্রচারক নন তিনি বাংলা ভাষারও প্রধান প্রচারক। কিন্তু তাঁর পরে আবার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মোগল সাম্রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। আগেকার মুসলিম শাসকদের শাসনকেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের মাটিতে। ফলে বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের একটি সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেত, কিন্তু মোগল আমলে সম্রাট থাকতেন দিল্লিতে এবং তাঁর প্রতিনিধিরা বাংলায় এসে অস্থায়ী শাসনকেন্দ্র থেকে শাসনকার্য চালাতেন। ফলে বাংলা ও বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের কোনো আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফারসি ছিল শাসক শক্তির সরকারি ভাষা, তাই যার শাসক শক্তির অনুগ্রহ বা দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন ছিল তার পক্ষে অনিবার্য ছিল ফারসি ভাষার চর্চা। ফলে বাংলাভাষায় এবার আরবি-ফারসির প্রভাবও অনিবার্য হয়ে পড়ল। ফলে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বিকাশ আবার সংকুচিত হয়ে পড়ল।

অবস্থার আবার পরিবর্তন হল কলকাতায় ভারতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপনের পর। ব্রিটিশরা অবশ্য সরাসরি বাংলা ভাষা প্রসারে আগ্রহ দেখায়নি, তবে তারা বুঝতে পেরেছিল ভারতের এই অংশে সাম্রাজ্য চালাতে গেলে বাংলা ভাষা শেখা দরকার। এজন্য তারা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের মতো ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে, বাংলা ছাপাখানা চালু করতেও উদ্যোগী হয়। ক্রমে রামমোহন, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে দেশীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষা শিক্ষারও প্রসার ঘটতে লাগল। বাঙালিরা এবার বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজিও শিখে নিতে নতুন সমাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্ঠিত হতে লাগল। এই শিক্ষিত বাঙালিদের একটি উদীয়মান অংশ ভারতে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবিস্তারের সূত্র ধরে ভারতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তখন ইংরেজ-শাসিত সমস্ত ছোটো-বড়ো শহরে ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, কেরানি, বড়োবাবু, ইঞ্জিনিয়ার—সবই বাঙালি। এঁরা যেখানেই গেছেন সেখানেই সম্মানিত হয়েছেন এঁদের হৃদ্য ব্যবহারের জন্য, এঁদেরই উৎসাহে বাংলার বাইরে স্থাপিত হয়েছে একাধিক বাংলা বিদ্যালয় বা বাংলা ভাষার চর্চাকেন্দ্র। কাজেই গোটা উনিশ শতক জুড়েই চলেছে বাংলা ভাষার সসম্মান ভারত-পরিক্রমা। কিন্তু বাংলা ভাষার বিপর্যয়ের সূত্রপাত হল বিশ শতকের গোড়ায় যখন ব্রিটিশ রাজধানী স্থানান্তরিত হল কলকাতা থেকে দিল্লিতে। বিপর্যয় চূড়ান্ত রূপ নিল ঊনিশশো সাতচল্লিশের দেশভাগের পর। বাংলাদেশের বাংলাভাষী এলাকার বড়ো অংশটাই চলে গেল বিদেশি রাষ্ট্রের অধীনে, আর ছোটো অংশটা ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামে ভারতের অন্যতম অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত হল, বাংলা ভাষাও হল ভারতের অন্যতম পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যভাষা। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ভাষা বাংলা হলেও দেখা গেল পশ্চিমবঙ্গের সীমার বাইরে ভারতের অর্ন্তভুক্ত অন্যান্য কয়েকটি সংলগ্ন রাজ্যেও কিছু এলাকার প্রধান ভাষা বাংলা। স্বাধীনতার পর বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুর্নগঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে-কাজ যে বাস্তবসম্মতভাবে করা হয়েছিল তা বলা যায় না। কারণ, এই পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক রূপায়ণের পরও দেখা গেল অসমের কিছু বাংলাভাষী এলাকা সেই অসম রাজ্যেই রয়ে গেল, আর সাবেক মানভূমের বিস্তীর্ণ বাংলাভাষী এলাকাও রয়ে গেল বিহারের মধ্যেই। অন্য রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ক্ষতি ছিল না, যদি বাংলাভাষী মানুষদের মাতৃভাষাচর্চায় সরকারি বিধিনিষেধ আরোপিত না হত। ফলে অসম ও মানভূমে বাঙালিদের মাতৃভাষার স্বাধিকার রক্ষার প্রশ্নে অনেক রক্তপাত হল। কিন্তু এত রক্তপাত সত্ত্বেও ওইসব এলাকার বাংলা ভাষা নিতান্ত ঘরোয়া ভাষা, এবং সরকারি কাজে বাংলা নিতান্ত দুয়োরানির ভূমিকায় অবস্থিত। রাজ্যগুলির বৈষম্যমূলক ভাষানীতির জন্য ওইসব এলাকায় বাংলাভাষী মানুষ অস্তিত্বরক্ষার বাস্তব প্রয়োজনে শিক্ষা ও অন্যান্য কাজের জগতে মাতৃভাষাকে সরিয়ে দিতে অন্যভাষাকে বরণ করতে বাধ্য হয়েছে ও হচ্ছে। বিহার রাজ্যের অংশ নিয়ে নবগঠিত ঝাড়খন্ড রাজ্যে বাংলা ভাষাকে একটা প্রাধান্যের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবি এখন উঠলেও শেষ পর্যন্ত তা কতদূর কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। শুধু ওই দুটি রাজ্যেই নয়, ভারতের অন্যান্য এলাকাতেও যেসব বাঙালি একসঙ্গে অনেক দিন বাস করছেন তাঁরাও কি মাতৃভাষার প্রশ্নে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে আছেন? দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক, বেনারস-লখনউ-এলাহাবাদ-মুম্বই-গুজরাত-নাগপুরের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। একেবারে পাশের রাজ্য ওড়িশার অবস্থাটা কেমন? ওখানেও তো একশো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে কোনো কোনো এলাকায় বাঙালিরা বাস করছেন, কিন্তু তাদের মাতৃভাষাচর্চায় তাঁরা কতটা স্বাধিকার ভোগ করেন? গত ৩/৪ বছর আগে একটি সরকারি কাজে আমন্ত্রিত হয়ে ওড়িশার খুর্দা জেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ওখানকার চিলকা হ্রদের আশপাশের এলাকায় হাজার তিরিশেক বাঙালির বাস, এঁদের বেশির ভাগই মৎস্যজীবী এবং দিনমজুর। এলাকায় আট-দশটি বাংলা-মাধ্যম স্কুল আছে, কিন্তু তা শুধু নামেই মাত্র বাংলা-মাধ্যম, কারণ ওইসব স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলায় পড়াশোনা হয়, তারপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে পঠন-পাঠনের মাধ্যম ওড়িয়া ভাষা। ওইসব স্কুলের বাংলাভাষী শিক্ষকেরা জানালেন, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলায় লেখা উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তকের দুষ্প্রাপ্যতা। পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষায় যেসব বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়, সেইসব বই তাঁদের কলকাতার খোলা বাজার থেকে বই-পিছু ২০/২৫ টাকা খরচ করে সংগ্রহ করতে হয়। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই, যদিও এ ব্যাপারে তাঁরা সম্পূর্ণ আগ্রহী। কিন্তু ঘণ্টা বাঁধার কাজটা করবে কে? সরকার না বেসরকারি সংস্থা? সরকার হলে কোন সরকার—পশ্চিমবঙ্গ না ওড়িশার সরকার? না কি কেন্দ্রীয় সরকার? পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একই রকম বিচ্ছিন্নতা আন্দামান ও দন্ডকারণ্যের বাঙালিদের। দেশভাগের পর তখনকার সরকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা অগণিত বাংলাভাষী পরিবারকে ওইসব জায়গায় পাঠিয়েছিল। কিন্তু সরকার তাদের অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়ের পুনর্বাসন করলেও তাদের সাংস্কৃতিক পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থাই করেনি, করলে তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-নিয়ামক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে ওখানকার স্কুল-কলেজের আইনি সম্পর্ক স্থাপিত হত। কিন্তু তার বদলে ওইসব জায়গার স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহুদূরে অবস্থিত ভিন্ন রাজ্যের নানা পর্ষদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। আন্দামানের বাঙালিরা এখন আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেও এ ব্যাপারে তাঁদের কারও কারও মনে একটি বিষণ্ণতা বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে। খবরে প্রকাশ, দন্ডকারণ্যের অবস্থা আরও খারাপ। কিন্তু বাংলা ভাষার মূলকেন্দ্র থেকে এই বিচ্ছিন্নতার কারণ কি শুধুই ভৌগোলিক? আর কোনো কারণ নেই? বছর চারেক আগে একবার দার্জিলিং জেলার মিরিক এলাকায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দেখা গেল, শিলিগুড়ির পর পাহাড়ি এলাকার সমস্ত জনবহুল এলাকায় যত সাইন বোর্ড আছে তাতে ব্যবহৃত হয়েছে নেপালি ভাষায় ব্যবহৃত নাগরী লিপি ও ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত রোমক লিপি, কোথাও কোথাও অল্পসংখ্যক সাইনবোর্ডে গুরুমুখী লিপি। এই সব লিপির ব্যবহারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু অন্তত দু-দশখানা বাংলা সাইনবোর্ডও তো থাকতে পারত, কারণ জায়গাটা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে, আর বাংলাভাষী মানুষেরা তো এই এলাকার নিকটতম প্রতিবেশী। তবু এ অবস্থা কেন? শুধু পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি এলাকাতেই নয়, সাম্প্রতিক জনগণনার পরিসংখ্যানে দেখা যায় ডুয়ার্সের চা-বাগানের কোনো কোনো বিস্তীর্ণ এলাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলা এখন চতুর্থ স্থানে। কেন এমন অবস্থা? ভাবতে হবে। তবে ভাবতে গিয়ে একথাটাও মনে রাখতে হবে যে, আগে অবস্থাটা এমন ছিল না। এখন আমরা দু-চারদিনের জন্য মিরিক বা জলদাপাড়ায় বেড়াতে যেতে পারি, কিন্তু কর্মসংস্থানের এমন তীব্র সংকটের দিনেও চাকরির ‘পোস্টিং’ যদি হয় মিরিক বা জলদাপাড়ায়, তবে কাজে যোগদানের পরের দিন থেকেই আমরা দক্ষিণবঙ্গে বদলির জন্য তদবির করতে থাকি। কিন্তু আগে এ অবস্থা ছিল না। আগে বাংলার অন্য এলাকার বহু মানুষ এইসব এলাকার চাকরি ও ব্যাবসা উপলক্ষ্যে এসেছেন, ফিরে যাননি। জমি কিনে বসবাস করেছেন, স্থানীয় লোকদের সঙ্গে দৈনন্দিন মেলামেশা ও বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করেছেন। অথচ তখন এইসব এলাকায় যোগাযোগ-ব্যবস্থা ও সামাজিক পরিকাঠামো এখনকার তুলনায় কত অনুন্নত ছিল। কিন্তু এখন আমরা এইসব এলাকার সঙ্গে আর কোনো দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক রাখতে চাই না। কারণ এইসব এলাকার সঙ্গে বঙ্গসংস্কৃতি ও বঙ্গভাষার প্রাণকেন্দ্র দক্ষিণবঙ্গের দূরত্ব অনেক বেশি এবং সেই দূরত্ব শুধু ভৌগোলিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকও বটে। এই ভাষাবিচ্ছেদের নিশ্চয়ই আরও অনেক পারিপার্শ্বিক ও বস্তুগত কারণ আছে; কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক কারণটাই প্রধান, এবং সেটা হল আমাদের আত্মকেন্দ্রিক অহম্মন্যতাবোধ। এই আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হতে না পারলে এই অবস্থা চলতেই থাকবে।

শুধু বাঙালি এলাকার বাইরেই নয়, এই অবস্থা চলতে চলতে এখানকার বাঙালি সমাজের সংখ্যালঘু অথচ প্রভাবশালী অংশের ভিতরেই মাতৃভাষার উপযোগিতা সম্পর্কে ধ্যানধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, যা আমাদের দুশো বছরের ইংরেজি শিক্ষার ঐতিহ্যের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন দেশের শাসক-কতৃপক্ষের কাছে দেশীয় শিক্ষার সমসাময়িক অবস্থার পরিচয় দেওয়ার জন্য উইলিয়ম অ্যাডাম পরপর কয়েকটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। অ্যাডামের প্রথম প্রতিবেদনে (জুলাই, ১৮৩৫) প্রকাশ, তখন দেশীয় স্কুলে ইংরেজি ভাষা শেখার চাহিদা থাকলেও মাতৃভাষা বাংলা শেখানোর ওপর বেশ জোর দেওয়া হত। তখনকার আরপুলি বিদ্যালয় ছিল কলকাতার বিখ্যাত স্কুলগুলির অন্যতম। অ্যাডামের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই স্কুলে ইংরেজি বিভাগ থাকলেও বাংলা শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। সেগুরুত্ব এতটাই ছিল যে, মাতৃভাষায় যথেষ্ট অধিকার না জন্মালে কোনো ছাত্রকেই ইংরেজি শেখানো হত না। এছাড়া যেসব ছাত্র বাংলা শিক্ষায় বিশেষ পারদর্শিতার পরিচয় দিত তারা ‘were promoted to the (School Book) society’s English school or to the Hindu College as a reward for their proficiency in Bengalee’ (Adam’s Report, 1835, p. 13)। আর এখন অবস্থাটা সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন অনেক অভিভাবকেরই চিন্তার বহর এইরকম : ‘স্কুলে বাংলা শেখার কী দরকার? বাড়ির কাজের লোকও তো স্কুলে না গিয়ে বাংলায় বেশ কথাবার্তা বলে। আসল দরকার হচ্ছে ইংরেজি শেখা, কারণ ইংরেজি শিখলেই কানাডা বা নিউইয়র্কে যাবার রাস্তা একদম পরিষ্কার।’ এই জন্য একেবারে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই ইংরেজি শেখা/শেখানোর এত কৌশলী তৎপরতা। যে-স্কুলে যত বেশি তৎপরতা সেই স্কুলে তত বেশি ভিড়। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতীয় বাঙালিদেরই অবস্থা নয়, প্রতিবেশী ‘বাংলাদেশে’র মধ্যবিত্ত বাঙালিদেরও প্রায় একই অবস্থা। বাংলাদেশের সদ্য প্রয়াত লেখক ও গবেষক হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘বাংলা ভাষার শত্রুমিত্র’ বইটিতে আনুষঙ্গিক তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বছর দশেক দেশের সরকারি বা বেসরকারি কাজকর্মে ও ব্যাবসা-বাণিজ্যে বাংলা ভাষার যে-মর্যাদা ছিল আশির দশক থেকে তাতে ভাটা পড়তে থাকে। দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজির দিকেই টান ক্রমশ বাড়ছে। কারণ হিসেবে দুদেশেই একটা কথা বলা হয়—বিশ্বায়ন। এই বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষায় ইংরেজিতে গুরুত্ব না দিলে তো বাঙালির কাছে বিশ্বের দরজা বন্ধই থাকবে। কিন্তু যাঁরা বিশ্বায়ন নিয়ে এত চিন্তিত তাঁরা বোধহয় জানেন না বিশ্বায়ন ব্যাপারটা আমাদের কাছে নতুন নয়। এখনকার বিশ্বায়নপন্থীদের অভ্যুদয়ের অনেক আগে রামমোহন-রবীন্দ্রনাথও বিশ্বায়নের কথা বলেছিলেন। তাঁদের কাছে বিশ্বায়নের অর্থ ছিল শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে বিশ্বের কাছে এবং বিশ্বকে নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করার প্রয়াস অর্থাৎ বিশ্বায়ন হচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তির মানবিক সম্পর্কের সম্প্রসারণ। কিন্তু এখনকার বিশ্বায়ন নিতান্তই বাণিজ্যিক ব্যাপার, যার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বৃহৎ পুঁজির বিশ্ববিহার এবং বিশ্বের বাজারে বিপণনের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার। বিশ্বায়নের এই পরিস্থিতিতে ভেবে দেখতে হবে বাঙালি শিশুকে তার দুগ্ধপোষ্য অবস্থা থেকেই মাতৃভাষার বদলে ইংরেজি ভাষা শেখানোর অত্যাচার কতটা জরুরি। কারণ, প্রথমত, বিশ্বে যত চাহিদাই থাক প্রত্যেকটি বাঙালি কখনই বিশ্বের বাজারে দাম পাবে না। দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়নের এখনকার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা। সব গোষ্ঠীই চাইবে খরচ কমিয়ে মুনাফা বেশি করতে। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে কাঁচামালের জোগান তুলনামূলকভাবে বেশি ও দামেও সস্তা, শ্রমশক্তিও এসব দেশে নিজেদের দেশের চেয়ে দরে সুলভ, তাই উৎপাদনকেন্দ্রগুলি উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে সরিয়ে দিলে উৎপাদনের খরচ কম হবে। তাছাড়া নিজের দেশের দূষণঘটিত ঝুঁকি ও বিধিনিষেধও তাতে থাকবে না। এই কারণেই অন্য দেশ থেকে প্রযুক্তিবিদদের সশরীরে ডেকে আনার বদলে ‘আউটসোর্সি’-এর মাধ্যমে প্রযুক্তিবিদকে তার নিজের দেশে রেখেই কাজ করানোর রীতি বিশ্বের বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এই অবস্থায় আগামী দিনে কয়জন ভারতীয় তথা বাঙালি ছেলেমেয়ে বিদেশে যাবার সুযোগ পাবে তা বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে। এদেশের কলসেন্টারগুলিতে বিদেশিদের উচ্চারণ বোঝার জন্য তো বিদেশে যাবার দরকার নেই, ভাষা শেখার উন্নততর প্রযুক্তির সাহায্যে এদেশেই কাজটা সুসম্পন্ন করা যায়। তৃতীয়ত, বিশ্বায়নের মাধ্যমে তো শুধু বিশ্বের ইংরেজিভাষী দেশগুলির সঙ্গেই সম্পর্ক তৈরি হবে না। ইউরোপের ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানির মতো অ-ইংরেজিভাষী দেশে এবং এশিয়ার চিন, জাপানের সঙ্গেও ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্য সম্পর্ক প্রসরিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। ইংরেজির বদলে ওই সব দেশের ভাষা শেখাই তো ব্যাবসা চালানোর পক্ষে সুবিধাজনক এবং ভাষা শেখার আধুনিক প্রযুক্তি এক্ষেত্রেও সাহায্য করবে। এর জন্য বাঙালি শিশুর মুখ থেকে তার মাতৃভাষাটা কেড়ে নিয়ে সেখানে ইংরেজি ভাষা প্রতিস্থাপনের মতো নিষ্ঠুর বর্বরতার দরকার কী? তবে বাঙালি ছেলেমেয়েকে ইংরেজি শিখতেই হবে। কিন্তু সেটা বাণিজ্যের ভাষা হিসেবে নয়, আন্তর্জাতিক চিন্তাচেতনার অন্যতম প্রধান ধারক-বাহক হিসেবে। তবে তার জন্য একেবারে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে নয়, উচ্চ প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করাই যথেষ্ট। তার আগে শুধুই মাতৃভাষা এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের প্রধান প্রধান বিষয়গুলির সার কথা জেনে নেওয়া দরকার। চতুর্থত, এখনকার বাণিজ্যনির্ভর বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আরও একটা কথা ভাবার আছে। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুসারে সারা পৃথিবীতে এখন প্রায় ২২ কোটি লোকের মাতৃভাষা বাংলা, বিশ্বে যার স্থান ষষ্ঠ, অর্থাৎ বাণিজ্যের দৃষ্টিতে বাংলা ভাষার এলাকা মানে ২২ কোটি মানুষের বাজার, বাণিজ্যের নিরিখে যার স্থান ছয় নম্বরে। সুতরাং বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠীগুলির তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে যে-গোষ্ঠী এই ২২ কোটি মানুষের ঘরোয়া বাজার (যেখানে বাংলা ভাষার চলই বেশি) দখল করতে পারবে লাভ তো তারই বেশি। তাই আগামী দিনে বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠীগুলি তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন ও বিপণনে ইংরেজির চেয়ে বাংলাই বেশি ব্যবহার করবে। বিপণনব্যবস্থায় ‘অন-লাইন’ বিপণন যত জনপ্রিয় হবে জনসংযোগের সহজ নিবিড় উপায় হিসেবে বাংলা-বাজারে বাংলা ভাষার ব্যবহার ততই বাড়বে। সুতরাং ইংরেজির চেয়ে বাংলার দিকে বেশি নজর দেওয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ। বস্তুত এখন দেখা যাচ্ছে বহু অনাবাসী বাঙালি শিল্পপতি পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর টাকা লগ্নি করছেন। আবার দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিজেদের বাংলা অনুষ্ঠানগুলির বাংলা বিজ্ঞাপনসুদ্ধ বিদেশের বাঙালি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছে। এ সবের মধ্যেই সাম্প্রতিক পুঁজিপতিদের এই বাংলাকেন্দ্রিক দূরদর্শিতা ফুটে উঠছে। এর মধ্যে যখন অন্য ভাষার দরকার হবে তখন সেই ভাষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাহায্য নিলেই চলবে। কিন্তু কবে বিদেশের বাজারে ডাক পড়বে তার জন্য নিজের ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজির জন্য আয়ুক্ষয় করা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়।

সুতরাং, এখন দরকার বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে একটা যোগাযোগের স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যাপকভাবে সাহায্য করতে পারবে। বাংলা ভাষার প্রসারের জন্য কিছু কিছু সংগঠন ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাদের কার্যকারিতা সর্বতোমুখী ও সর্বত্রগামী নয় বলেই মনে হয়। ইদানীং যে-বিদেশে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের চল হয়েছে তাও গোষ্ঠীবদ্ধ। কয়েক বছর আগে অনাবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে কলকাতায় বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল, সেখানেও সেই গোষ্ঠীর বেড়াজাল। বাংলাভাষী বৃহত্তর গ্রামবাংলার সঙ্গে এদের সংযোগ কোথায়? কাজেই এখন একটা সংগঠন দরকার, যার চরিত্র হবে আন্তর্জাতিক আর কাঠামো হবে যুক্তরাষ্ট্রীয়, কিন্তু কিছুতেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক নয়। এমন সংগঠন গড়ে তোলা খুব সহজ নয়। তবু যেসব সংগঠন এখন চালু আছে তার কর্তাব্যক্তিরা ইচ্ছা করলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পারেন। প্রথম প্রথম ভুলভ্রান্তি ও বাধাবিপত্তি ঘটবেই। তবু সেসব থেকে শিক্ষা নিয়েই পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করতে হবে। এই সংগঠনের মূল কাজটা হবে সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে সহজ যোগাযোগের ব্যবস্থা করা এবং সেই সঙ্গে যেসব রাষ্ট্রে বা রাজ্যে বাংলা প্রধান ভাষা সেই সব রাষ্ট্রে বা রাজ্যে প্রতিবেশী ভাষাগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে বাংলাভাষাগোষ্ঠীর একটা সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। এছাড়া, আর যা যা করতে হবে তা কাজ করতে করতেই ঠিক করতে হবে। উদ্দেশ্য যদি স্থির থাকে এবং অভিপ্রায় যদি সৎ হয় তবে কোনো কিছুতেই অসুবিধা হবে না। দেখুন না, কিছু করা যায় কিনা। শুরুটা না হয় একটু ছোটো করেই হল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *