মোটর দুর্ঘটনা
পান্নালালকে শ্রীরামপুরের ভীষ্ম বলা হইত। তাহার প্রতিজ্ঞা ছিল, প্রাণ দিবে, তবু বিবাহ করিবে না।
সে-যুগের এক-একটা দিনের কথা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। সন্ধ্যার মুখে গঙ্গার ঘাটে সব বসিয়া আছি, তৰ্ক চলিতেছে। তখন কলেজে নূতন জীবন, লজিকের ঝাঁজ খুব বেশি, সবারই পান্নালালকে কোণঠাসা করিবার চেষ্টা। কে একজন বলিলাম, বেশ, প্রাণ দেবে, তবু বিয়ে করবে না; কিন্তু যদি জবরদস্তি কিংবা পাক-চক্রে বিয়ে দিয়ে দেয়?
প্ৰাণ দোব।
গোঁয়ারের বেয়াড়া লজিকের ধাঁধায় পড়িয়া সবাই মনে মনে দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টাইতেছি, ততক্ষণ পান্না বলিয়া চলিয়াছে, কেন বিয়ে করতে যাব বল দিকি? এই যে আমাদের পরমকাম্য স্বাধীনতা, কিসের লোভে এটা একজনের পায়ে জন্মের মত জলাঞ্জলি দোব?
রমণী বলিল, বাঃ, তা হ’লে ইউরোপে, আমেরিকা, জাপানের সবাই পরাধীন বলতে চাও?
পৃথিবী প্রভৃতি গ্রহের মত পান্নালাল-জাতীয় লোকেদের বেষ্টন করিয়া এক-আধটি উপগ্রহ থাকে; পান্নালালের ছিল সতে। সতে রমণীর কথায় ফোঁস করিয়া উঠিল, যা বুঝিস না, তাতে তর্ক করতে যাস নি, ভাল লাগে না। বিয়ে ক’রে পৃথিবী জাহান্নমে যেতে বসেছে, আর তোরা সব—তোমার সে প্যারডিটা শুনিয়ে দাও না পান্নাদা, কে কাটে দেখি।
পান্নালাল বলিল, হ্যাঁ, লংফেলোর সেই কবিতাটা একটুখানি বদলে বেশ বলা চলে—”
Lives of married men all remind us
We make our life a hell and slime,
And departing leave behind us
Progeny to curse us till end of time.
সতে বাংলাও বেশ করেছে—
বিবাহিত ভ্রান্তজন যে পথে ক’রে গমন
এনেছেন ধ্বংস ডেকে স্বীয়;
সেই পথই লক্ষ্য ক’রে—একি মতিচ্ছন্ন ওরে।
—মৃত্যুকে করিলি বরণীয়!
তা, এই সর্ববিধ মৃত্যুকে ডেকে আনবার যার শখ আছে, সে বিয়ে করুক না ভাই; আমার নেই।
সতে বলিল, আমারও নেই।
কোন বুদ্ধিমান লোকেরই থাকা উচিত নয়। যে সময়টা বিয়ে ক’রে নষ্ট করব, আমার মতে ঢের ভাল হয় সেই সময়টা—সেই সময়টা—
সামনে সন্তরণ-প্রতিযোগিতা আসিতেছে। সতে বলিল, সেই সময়টা যদি গঙ্গা সাঁতরে ব্যারাকপুরে ওঠা যায়—
রমণী মুখটা কুঞ্চিত করিয়া বলিল, তার চেয়ে আরও ভাল হয়, যদি সাঁতরে আর না উঠতে পারিস।
পান্নালাল বলিল, আমি সেই ত্রেতাযুগ থেকে আরম্ভ করছি, মিলিয়ে নাও।—রামচন্দ্র বিয়ে না করলে চোদ্দ বছর পরেই নিরিবিলিতে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসতে পারতেন; পঞ্চপাণ্ডব বিয়ে না করলে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হ’ত না, তাতে কুরুপাণ্ডবের মধ্যে সহজে একটা এমিকেল সেট্লমেন্ট হয়ে যেতে পারত; পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে বিয়ে ক’রে যা কাণ্ডটি বাধালেন, তাতে শেষ পর্যন্ত পৈতৃক প্রাণটি তো গেলই, দেশটিও মুসলমানদের হাতে তুলে দিয়ে বসলেন; আর—আর—একবারে আধুনিকতম উদাহরণ চাও তো চোখের সামনেই দেখতে পাবে—”
সতে তাড়াতড়ি জুড়িয়া দিল, রমণী বিয়ে ক’রে দু’বছর থেকে আই এ-তে ঘ্যাষটাচ্ছে।
রমণী রাগে নির্বাক হইয়া গটগট করিয়া সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া গেল এবং গঙ্গায় কোঁচার খুঁটটা ভিজাইয়া আনিয়া বলিল, নে, পান্না আর সতে হাত পাত; গঙ্গাজল স্পর্শ ক’র বল্—কখনও বিয়ে করবি নি, দেখি কত মুরোদ
পান্নালাল তেজোগর্ভ নিস্পৃহতার সহিত হাতটা বাড়াইয়া বলিল, আমার নিজের প্রিন্সিপ্ল-ই গঙ্গাজলের চেয়ে পবিত্র, তবুও যখন বলছিস, দে।
আমরা দুই-একজন বাধা দিতে উঠিলাম। পান্নালাল সৌম্য মৃদু হাস্যের সহিত দৃঢ়ভাবে বলিল, তোমরা পান্নাকে তা হ’লে চেন নি ভাই।
***
সেই পান্নালালকে দেখিলাম, অখিল বোসের মনোহারী দোকানে গভীর অনুধাবনের সহিত কচি ছেলেকে দুধ খাওয়াইবার একটা ফিডিং-বটল পরীক্ষা করিতেছে।
পাস করিয়াই চাকরি লইয়া নাগপুরে চলিয়া যাই; ছয় বৎসর পরে আজ দেশে ফিরিয়াছি। খবর-টবর এখনও বিশেষ কিছু সংগ্রহ করা হয় নাই; তাহা হইলেও এ দৃশ্য একেবারেই প্রত্যাশা করিতে পারি নাই। যাই হোক, হঠাৎ বিস্ময়ে পান্নাকে অভিভূত করিয়া দিবার জন্য আস্তে আস্তে দোকানের মধ্যে প্রবেশ করিয়া পাশে দাঁড়াইলাম, কাঁধে হাত দিয়া প্রশ্ন করিলাম, কি রে, চিনতে পারিস?
খু-ব। তারপর? আচ্ছা, দেখ দিকিন, ঐ জিনিসটা কেমন হবে? পাঁচ-ছটা ব্র্যান্ড দেখলাম বাজার ঘুরে—আমেরিকান আছে, জার্মান আছে, জাপানী আছে; জাপানী ফিডিং- বটল ভাল নয়—খোঁজ নিলাম, আমাদের পাড়াতেই সাত-আটটা গিয়েছিল, কারুরই টেকে নি। অখিল এই দু’রকম দেশী আমদানি করেছে, মোটা নয় তেমন কাঁচটা—ছেলেটা যা দামাল, টেকতে দেবে কি? আমি তো বলি, বেলজিয়ান—”
বিস্ময়ের মাত্রা আমার বাড়িয়াই চলিয়াছিল,—ছয় বছর পরে এই সম্ভাষণ। কাঁধে চাপ দিয়া বলিলাম, কার ছেলে রে পান্না?
পান্নালাল যেন অন্য কোন লোক হইতে ফিরিয়া আসিল। আস্তে আস্তে বোতলটা টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া, ফ্যালফ্যাল করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া নিতান্ত অপ্রতিভভাবে বলিল, আমাদের শৈলেন না? তারপর অনেকদিন পরে যে! দেশ মনে পড়ল? নাগপুর—নাগপুর—নাগপুরে—কি যে বলে—নাগপুর থেকে আমাদের জন্য গুপোসন্দেশ—
লজ্জার বশে তাহার অবস্থা দেখিয়া বেজায় হাসি পাইল, চাপিয়া লইয়া বলিলাম, নাগপুরে গুপোসন্দেশ হয় না—কমলালেবু। যাক, সে থাক পরে হবে’খন; বলি, কার দামাল ছেলে সামলাবার বন্দোবস্তে বাজারে বেরিয়েছিস তাই বল্। তোর যে এ রকম দুর্ভোগ হবে—
সেই রকমই জড়িতকণ্ঠে পান্নালাল বলিল, আর কার? থাক্, সে দুঃখের কথা আর তুলে কাজ নেই ভাই।
বলিলাম, শুনিই না।
আরে ভাই, এই এক সেরামপুর-হাওড়া বাস সার্ভিস হয়েছে ঢঙের, ধড়ফড়ানির মধ্যে তাড়াহুড়ো ক’রে চলতে গিয়ে বিয়ে হয়ে গেল। সাতটায় ফিডিং-বল কিনতে বেরিয়েছি, এই সাড়ে নটা বাজে। রোদে ধুলোয় আর মাথার ঠিক নেই।
বলিলাম, আমারও মাথা গুলিয়ে আসছে, একটু ভেঙে বল্। বাসে চড়তে গিয়ে ঠ্যাং খোঁড়া করে বসলে সেটা বুঝতে পারতাম; কিন্তু—
ঠ্যাং খোঁড়া হওয়ার চেয়ে কি এ কম দুর্ঘটনা রে ভাই? চল্, বলছি, এইটেই তা হ’লে কিনে নিই। দাও হে অখিল।
বাড়ি আসিতে আসিতে পান্নালাল নিম্নলিখিত কাহিনীটিকে বিবৃত করিল—
এম. এ.-তে ফার্স্ট ক্লাসটা আর পাওয়া গেল না, সে তো জানিসই; প্রফেসারির চান্সটা গেল। বি. এল.-এ জয়েন করলাম। আচার্য রায় তখন ল-কলেজটাকে ডাক ছেড়ে গালাগাল দিচ্ছেন; দুচ্ছাই ব’লে ব্যবসায় ঢুকে পড়লাম।
তিন মাস পরে বেরিয়ে আসতে হল। জেঠামশাই দু-হাজার পর্যন্ত লোকসান বরদাস্ত ক’রে বললেন, নাও, ঢের হয়েছে; গণেশের মুখটি ফিরিয়ে দাও।
দুদিন পরে বাড়িতে বললেন, আর অনেক তো হ’ল, এইবার বিয়ে-থা করুক। জেঠাইমাকে বললাম, প্রাণ দোব তবুও—সে আমার প্রিন্সিপ্ল তো তুই জানিসই। জেঠামশাই বললেন, তবে আমি চললাম; ও নিজের বাড়ি ঘরদোর দেখুক নিজে। দোসরা অঘ্রাণ কাশী যাবেন, পয়লা হাঁচতে গিয়ে মাথার শির ছিঁড়ে মারা গেলেন। তারপর চাকরির চেষ্টায় বেরুলাম আর কি। খেয়েদেয়ে একটি ছোট্ট নিদ্রা দিয়ে বেরুই, আবার খাবার সময়টিতে বাড়ি ঢুকি। যত না হয়, যেন একটা রোখ চেপে যায়। গভর্মেন্ট আপিস, পোর্ট কমিশনার, কর্পোরেশন, ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট—কিছু আর বাকি রাখলাম না। শেষে একটা সওদাগরী আপিসে একটু আশা পাওয়া গেল। বললে, কাল সাড়ে এগারোটার সময় দেখা ক’রো, ঠিক সাড়ে এগারোটার সময়।
তার মানে নটা বিয়াল্লিশের গাড়িটা ধরতে হয়, তার মানে বাড়ি থেকে বেরুতে হয় অন্তত সাড়ে নটার সময়। শীতকাল, তায় আবার কয়েক দিন থেকে ভোরের দিকে চাকরি হওয়ার স্বপ্ন দেখছি ব’লে আশায় আশায় আটটা সাড়ে আটটার পূর্বে আর ঘুম ভাঙে না। যা হোক, সেদিন তাড়াহুড়ো ক’রে ভোর সাড়ে সাতটার সময়েই উঠে পড়লাম। মুখ- হাত ধুয়ে-টুয়ে তেল মেখে নাইতে যাব, জেঠাইমা বললেন, চাকরিটা হচ্ছে, যা, বরং গঙ্গা থেকে একটা ডুব দিয়ে আয়।
বললাম, কোথায় চাকরি তার ঠিক নেই—তা ছাড়া সময় কোথায় জেঠাইমা? নটা বিয়াল্লিশের গাড়িটা যে ধরতে হবে।
জেঠাইমা বললেন, থাক্, অপরাধ হয়েছে। আমায় আজ কাশী পাঠিয়ে দে।
কাজ কি ঘাঁটিয়ে? হি-হি করতে করতে ছুটলাম গঙ্গায়। নেয়ে আসতে দেরি হয়ে গেল; সাড়ে নটার সময় খেতে বসলাম। তাড়াতাড়ি নাকে-মুখে গুঁজে উঠতে যাব, জেঠাইমা বললেন, ওরে পান্না, থাম্। দেখেছ মরণ! এক্কেবারেই মনে ছিল না, দই না খেয়ে আজ বেরুতে আছে? ব’স একটু, রতু গিয়ে দু পয়সার নিয়ে আসুক চট্ করে।
বললাম, এই ঠাণ্ডা; ফোঁটা দিয়ে দিলে হয় না জেঠাইমা? ততক্ষণ কাপড়-চোপড় পরি।
বললেন, হবে না কেন? সবই হয় বাবা; হয় না শুধু এই রকম অপদার্থ ভুলো মন নিয়ে আর সংসার করা, তাই বলছিলাম যে, দে আমায় কাশী পাঠিয়ে।
কত আর বলব ভাই? যাত্রা করতে গাড়ি তো গেল বেরিয়ে। দশটা প’নেরোর একটা বাস রান করে, বুঝি সেটাও ছেড়ে যায়। পিঁড়েয় ব’সে ঘড়ির দিকে চেয়ে ছট্ফট করতে লাগলাম।
দই আসতে, খাওয়া শেষ হতে অনেক দেরি হয়ে গেল; ‘অমৃতবাজার টা একবার উল্টেও দেখা হয় নি। জুতো জামা পরতে পরতে রতনকে বললাম, তুই ততক্ষণ এই বিজ্ঞাপনের কলমগুলো পড় দিকিন, শুনি।
রতন তখন ফিফথ ক্লাসে পড়ছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পড়ে যেতে লাগল। কেবল লেডি আর লেডি। লেডি স্টেনোগ্রাফার চাই, একজন লেডি প্রাইভেট সেক্রেটারি চাই, স্কুলের হেড-মিস্ট্রেস; একটা ইন্সিওরেনস কোম্পানির ক্যাভাসার চাই, তাও লেডি। বেটাছেলের যদি নামগন্ধ আছে! ওইদিকে জুতোর ফিতেটা গেল ছিঁড়ে; একটা গেরো দিলাম, এমন বড় হয়ে গেল, ফিতেটা টানলে না ভেতরে যায়, না বাইরে আসে, মেজাজটা গেল খিঁচড়ে। এই রিডিং পড়া শিখেছ রাস্কেল?—বলে দিলাম রতনার রগে এক চড় কষিয়ে। তাই বোধ হয় তার চোখ দুটো অন্য কলমে ঠিকরে গিয়ে পড়ল; রতনা পড়লে, ওয়ান্টেড এ হাইলি কোয়ালিফাইড ইউথ অফ—”
ঠিক এই সময়টিতে মোড়ে বাসের ভোঁ-শব্দ শোনা গেল, একেবারে ছ-সাতটা, ওগুলো ওই রকমই করে কিনা, যেন দিলে এই ছেড়ে। একটা জুতো প’রে, একটা হাতে নিয়ে ছুটলাম।
মিনিট দশেক কেটে গেল, ছাড়েই না। আমার মন প’ড়ে সেই বিজ্ঞাপনটির ওপর। কেবলই মনে হচ্ছে, আহা, ঠিকানাটা নিয়ে এলে হ’ত! অনেকবার হ্যাঁ-না হ্যাঁ-না ক’রে পড়লাম একবার নেমে। বাড়ির সিঁড়িতে পা দোব আর কি, স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ হল। ফিরে এক রকম দৌড়তে দৌড়ুতে বললাম, রতন, কাগজটা নিয়ে আয় শিগগির; না দিতে পারিস, আপিসের নম্বরটা চেঁচিয়ে ব’লে দে, গাড়িটা দিলে বুঝি ছেড়ে।
রতনা আসতে আসতে গাড়িটা মোশান দিয়েছে! চেঁচিয়ে বললে, পঁচাত্তর নম্বর ক্লাইভ রেঞ্জ—ক্লাইভ রেঞ্জ—পলাশীর রবার্ট ক্লাইভ মামা। এই হিসেবে ঠিক রেখে গুনে যাও।
তারপর হাত উঁচু ক’রে দু’হাতের আঙুলগুলো হরদম খুলতে লাগল আর মুড়তে লাগল, বুদ্ধিমান ভাগনে আমার! যখন এই ভাবে আন্দাজ বোধ হয় দেড়শো হয়েছে, তখন বাসটা মোড় ফেরায় আর দেখতে পেলাম না। আপিসে তার পরদিন দেড়টার সময় ডাকলে—ঠিক দেড়টার সময়। ওরা বোধ হয় ক্যান্ডিডেটদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাস গেলে বাস কোম্পানি, ট্রাম কোম্পানি, এদের কাছ থেকে মোটা কমিশন মারে। ভাবলাম—মরুক গিয়ে, ক্লাইভ রেঞ্জ কি বলেন একবার দেখি।
.
জায়গাটা খুঁজে বের করতে যা বেগটা পেতে হয়েছিল, সে আর ব’লে কাজ নেই। নাম শুনে প্রথমে ক্লাইভ স্ট্রীট, ক্লাইভ রো তো চ’ষে ফেললাম, সারা ড্যালহৌসি স্কোয়ারের কোথাও আর বাদ দিলাম না। শেষে এক ভদ্দরলোক বললেন, সে তো এখানে নয়; কালীঘাটে গিয়ে খোঁজ করুন।
মনটা একটু দ’মে গেল। ভেবেছিলাম, হাইলি কোয়ালিফাইড ইউথ চাইছে, নিশ্চয় বড় কোন সাহেবী সওদাগরী আপিস হবে; তা হ’লে নয় দেখছি। কালীঘাটের বাস থেকে নেমে একটা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম। বললে, বেলেঘাটায় যেতে হবে।
বললাম, একজন বললেন যে কালীঘাটে?
সে একটা ঢেকুর তুলে মুখটা কুঁচকে শুধু বললে, খুঁজে দেখুনগে তা হ’লে।
তার সঙ্গে আর একটি ছোকরা ছিল; আমার পানে বিরক্তভাবে আড়ে চেয়ে বললে, ক্লাইভ রেঞ্জে ওর শ্বশুরবাড়ি মশাই; কালই শালীর বিয়েতে নেমন্তন্ন খেয়ে এল, এখনও চোয়া ঢেকুর তুলছে আর কোরের সীতাকুণ্ডের জলের সোডাওয়াটার খুঁজে বেড়াচ্ছে, ও জানবে কেন? তার র্যাপারে একটা টান দিয়ে বললে, চল্, যত সব বোগাস।
তাদের কাছে পাকাপাকি ঠিকানাটা জেনে ফিরতি বাসে চ’ড়ে বসলাম।
.
মাঝারি গোছের একটা দোতলা বাড়ি, বেশ ফিটফাট, সামনে একটু বাগানের মতন ও আছে। সওদাগরী আপিস নয় ব’লে বিশেষ নিরাশ হলাম না; ভাবলাম, বাড়ির মালিক কোন ছোটখাটো কোম্পানির ডিরেক্টর-গোছের কেউ একটা হওয়া বিশেষ আশ্চর্য নয়।
খবর পেয়ে একটি ভদ্দরলোক বেরিয়ে এলেন।
আগ্রহ চাপিতে না পারিয়া প্রশ্ন করিলাম, তোর হবু শ্বশুর বুঝি?
পান্নালাল বলিল, শোনই না সবটা আগে।
জিজ্ঞাসা করিলেন, কি চাই?
বললাম, ‘অমৃতবাজারে’ একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে—
ভদ্দরলোকের কপালটা হঠাৎ কুঁচকে উঠল, আর দৃষ্টিও হয়ে উঠল যেন বড় তীক্ষ্ণ। আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কথাটা না বাড়িয়ে বাড়ির নম্বরের দিকে চেয়ে বললাম, এইটেই তো পঁচাত্তর নম্বরের বাড়ি?
বললেন, হ্যাঁ, পঁচাত্তর নম্বরের বাড়ি।
বললাম, বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে যে, একজন বিশেষরকম শিক্ষিত যুবক দরকার, তাই ভাবলাম, বেলেঘাটার দিকে যখন যাচ্ছিই, একবার না হয় দেখাটা করেই যাই।
ভদ্দরলোক সেই রকম ভাবেই ভুরু কুঁচকে বললেন, যুবকটি আপনার কে হয়? খটকাটা বেড়েই চলল; বললাম, আজ্ঞে আমি নিজের জন্যেই এসেছি, ভাবলাম, সব কাজে নিজে গিয়েই—”
এক্কেবারে যাকে বলে অগ্নিশর্মা! বললেন, কে হ্যা তুমি? ইয়ারকির আর জায়গা পাও নি? দারোয়ান!
আমি তো এতটুকু হয়ে গেলাম রে ভাই।—বলে কি? সেই সেরামপুর থেকে ক্লাইভ স্ট্রীট, কালীঘাট হয়ে তেতে-পুড়ে এককাঁড়ি পয়সা খরচ ক’রে এলাম ইয়ারকি দিতে! ভ্যাবাগঙ্গারাম মেরে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় ওপর থেকে একজন বললেন, কি হ্যা দ্বিজেন?
ভদ্দরলোক রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, তোমায় বলেছিলাম দাদা, ও রকম অ্যাডভারটাইজমেন্ট করা ঠিক হবে না, এ সে দেশ নয়। দেখ না, কোথাকার একটা ভ্যাগাবন্ড, বলে কিনা, নিজের জন্যে—
ওপরের লোকটি নেমে এলেন। বলতে কি ভাই, আমার তো তখন শেষ হয়ে এসেছে। তাঁর লাশটি দেখে বোধ হ’ল, তাঁর দ্বারবান ডাকবার দরকার হবে না। যা হোক, নেমে একটু ঠাণ্ডাভাবেই বললেন, ব্যাপার কি? থাম দ্বিজেন, চট ক’রে রাগে না। আপনি কোথা থেকে আসছেন মশায়? কি কাজ?
বললাম, আজ্ঞে, আসছি সেরামপুর থেকে। ভ্যাগাবন্ড নয়। সেখানে এক বিশিষ্ট ভদ্রঘরেরই ছেলে আমি। আজ পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে—
এ ক্ষেত্রেও ওই পর্যন্ত ব’লেই একটু দাঁড়ালাম; দেখি এঁর মুখের ভাবটা আবার কেমন হয়; তা বুঝে সাবধানে এগুব।
ভদ্দরলোক বেশ ভাল ক’রে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললেন, আপনি বড্ড ঘুরেছেন, না? আসুন, ওপরে আসুন।
তাঁদের দু ভায়ের তত্ত্বাবধানে একেবারে রাস্তা ছেড়ে অত ভেতরে যাবার সাহস হচ্ছিল না; কিন্তু ‘না’ বলবার সাহসও সঞ্চয় করতে না পেরে আস্তে আস্তে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। বললেন, হ্যাঁ বেরিয়েছে, আপনি কি করেন?
বললাম, কিছুই করি না, সেই জন্যেই তো আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছি।
প্রথম লোকটি মুখ লাল ক’রে কি বলতে যাচ্ছিলেন, দাদার চোখ টিপুনিতে থেমে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
আমি ভাই বেজায় নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম ব্যাপার দেখে,–ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ঘাগী ক্যান্ডিডেটদের ভঙ্গীতে হাত কচলে বললাম, তা আপনাদের যদি দয়া নাই হয় তো উঠি না হয়।
ছোট রাগে গসগস করতে করতে উঠে গেলেন, ফিরে ফিরে আমার ওপর অগ্নিদৃষ্টি হানতে হানতে। দাদা বললেন, আচ্ছা, এসে পড়েছেন যখন ব’সেই যান একটু, বড্ড মেহনত হয়েছে। দারোয়ানকে ওপর থেকে এক গ্লাস জল আর পান আনতে হুকুম ক’রে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার বাপ-মা জীবিত আছেন?
দুদিক থেকে এ রকম প্রবল অনুরাগ আর বিরাগের ধাক্কায় আমার মাথা গুলিয়ে আসছিল। প্রশ্নটা অনধিকার-চর্চা ঠাউরে একটু বিরক্তির আঁচ দিয়েই বললাম, আজ্ঞে না, তাঁদের অনেক দিন খেয়েছি, জেঠামশাই ছিলেন, সম্প্রতি তাঁকেও সাবড়েছি; কিন্তু এসব কথা বলতে তো মশায়ের কাছে আসি নি।
ঠিক এই সময় জল আর পান এল। এক চুমুকে জলটুকু খেয়ে দুটো পান মুখে দিয়ে উঠে পড়লাম। বললাম, কেন তা বলতে পারি না কিন্তু আমাকে দেখছি আপনারা উপযুক্ত ক্যানডিডেট ব’লে মনে করেন না—যদিও আমার শিক্ষাদীক্ষা বংশপরিচয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ ক’রে সেটা পরখও করলেন না। তা হ’লে উঠি।
গেট পর্যন্ত এসেছি, তিনি বারান্দায় সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে ডাকলেন, শুনুন। কাছে যেতে জিজ্ঞাসা করেন, পড়াশুনো কতদূর হয়েছে আপনার?
বললাম, ইংরেজিতে এম. এ. সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হই গত বৎসর। চার মার্কের জন্যে ফার্স্ট ক্লাসটা মিস করি। ওদিকে ম্যাট্রিকুলেশন, আই.এ.-তে স্কলারশিপ নিয়ে এসেছি। দিন কতক বি.কম.-এও জয়েন করেছিলাম, আর ব্যবসা সম্বন্ধেও একটু অভিজ্ঞতা আছে।
ভদ্রলোক ‘পুয়োর চ্যাপ’ ব’লে মুখটা নীচু ক’রে মাথা চুলকোতে লাগলেন, যেন কি একটা মহা সমস্যায় পড়েছেন। একটু পরে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, পুয়োর চ্যাপ, ইয়োর আঙ্কল্স ডেথ হ্যাজ বিন টু মাচ ফর ইউ—জেঠামশাই মারা পড়েছেন ব’লে কি অতটা মুষড়ে পড়তে আছে? আচ্ছা, এখন যান, কাল বরং সার্টিফিকেটগুলো একবার নিয়ে আসবেন। সকালে ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় নিয়ে আসবেন বরং।
এ ধরনের সহানুভূতির জন্যে কড়া কড়া দু কথা শুনিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু আর হাঙ্গামা বাড়ালাম না। মনে মনে বললাম, ঢের হয়েছে বাবা, ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার; আবার এ-মুখো?
রাস্তায় আসতে আসতে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে দেখবার চেষ্টা করলাম। শেষের দিকে অত সহানুভূতি-সান্ত্বনার মানেটাই বা কি? জেঠামশাই মারা যাওয়ার জন্য এমন কোন প্রবল শোকের পরিচয় তো দিই নি ওদের কাছে! তবে কি পাগল ঠাওরালে? চাকরির উমেদারি করেছি, যেমন আরও পাঁচজনে ক’রে থাকে, তবে? আমি উল্টে পাগলদের পাল্লায় পড়ি নি তো?
বাড়িতে এসে ‘অমৃতবাজার টার খোঁজ করলাম, বিজ্ঞাপনটা ভাল ক’রে দেখতে হবে। টের পাওয়া গেল, রতনা ঢাউস ঘুড়ি করে সেটাকে উড়িয়ে দিয়েছে। আমি আর অতটা চড়াও করলাম না; কাল তো টের পাওয়াই যাবে। পরের দিন যা কাগজ এল তাতে বিজ্ঞাপনটা ছিলই না।
হ্যাঁ-না হ্যাঁ-না ক’রে সেদিন সাড়ে আটটার বাসে সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সর্দি করেছিল, দইয়ের ভয়ে আর জেঠাইমাকে কিছু বললাম না।
ভদ্রলোক বাইরের বারান্দাতেই ব’সে একটা কাগজ পড়ছিলেন; বললেন; এই যে এসেছেন। বসুন।
একটি ছোট ছেলেকে আদেশ করলেন, যা, তোর কাকাকে ডেকে দে।
বললাম, থাক্, থাক্; তাঁকে আর কষ্ট দেওয়া কেন?
ছেলেটা কিন্তু চ’লে গেল। কাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম। পাশের ঘরটিতে একপাল মেয়েরও আমদানি হ’ল। ব্যাপারটা যতই তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করি, চাপা হাসি, ফিস-ফিসানি আর চুড়ির আওয়াজে ততই যেন থই পাই না। একবার ভাবলাম, বোধ হয় টুইশনির চাকরি হবে; কিন্তু তার মধ্যে এত হেঁয়ালি আসে কোথা থেকে?
হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছি—রাতারাতি গিয়ে কলেজের প্রিন্সিপ্যালের কাছ থেকে আর গুণময়ের বাবার কাছ থেকে ভাল ক্যারেক্টার-সার্টিফিকেট নিয়ে আসি। গুণময়ের বাবা তখন সেরামপুরের সাবডিভিশনার অফিসার।
দুই ভাইয়ে মিলে সার্টিফিকেটগুলো দেখে গেলেন। শেষ হ’লে বড় শুধু ‘হুঁ’ করে একটা টানা শব্দ করলেন। ছোট জিজ্ঞাসা করলেন, এখন আপনার গার্জেন কে?
বললাম, নিজেই; অর্থাৎ বাড়ির বেটাছেলের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বড়। আর একটা অপোগণ্ড ভাগনে আছে।
দুই ভাইয়ে মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। ছোট বললেন, তবুও একজন মুরুব্বি আছেন তো এসব কথায় মধ্যস্থতা করবার জন্যে?
বললাম, দরকার কি? আমায় উপযুক্ত মনে করেন গ্রহণ করবেন, না করেন বিদায় হব। এর মধ্যে মধ্যস্থতার দরকার দেখি না তো।
ঘরের ভেতর চাপা হাসি হঠাৎ একটু স্পষ্ট হয়ে উঠল। বড় উঠে গিয়ে একটু দাবড়ানি দিয়ে এসে বসলেন।
সার্টিফিকেটগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, বড় অল্পের জন্যে ফার্স্ট ক্লাসটা পান নি তা হ’লে। আচ্ছা, পরীক্ষার আগে কোন শক্ত ব্যারাম-ট্যারাম হয়েছিল কি? এই যেমন টাইফয়েড, কি–
যে কারণেই হোক, আমায় যে পাগল ঠাউরেছে তাতে আর সন্দেহ রইল না। আমি কথাটা খোলসা ক’রেই উত্তর দিলাম; বললাম, আজ্ঞে না, যাতে ব্রেন অ্যাফেক্ট করে এমন অসুখই হয় নি।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না না, ব্রেন অ্যাফেক্ট করার কথা বলছি না, ব্রেন অ্যাফেক্ট কেন করতে যাবে।
আরও এই রকম গোটাকতক কথাবার্তার পর বড় ভাই ছোটকে ডেকে নিয়ে পাশের একটা ঘরে চ’লে গেলেন। খানিকক্ষণ কি পরামর্শ হল, তারপর বেরিয়ে এসে বললেন, আচ্ছা, আপনি তা হলে যান এখন; ঠিকানাটা রেখে যান, আমাদের মতামত জানাব।
চাকরির উমেদারিতে মাসখানেক নাগাড়ে ঘুরে ঘুরে একেবারে নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলাম। এই আশাটুকুকে একেবারে আঁকড়ে ধরলাম। হাত দুটো একত্র ক’রে খুব মিনতির সঙ্গে বললাম, আমার চেয়ে খুব বেশি উপযুক্ত ইয়ংম্যান পান তো আলাদা কথা; তা না হলে নিরাশ হব না, এ রকম আশা করতে পারি কি?
ঘরের মধ্যে হাসি, ফিসফিসানি, ঠুংঠুং আবার একচোট বেড়ে উঠল। এঁদের মুখে যেন হঠাৎ কালি ছেয়ে গেল, বড়রও। কেমন এক রকম হয়ে গিয়ে বললেন, আচ্ছা, এখন আসুন।
বাড়িতে এসে দেখলাম, বহরমপুর থেকে একটা টেলিগ্রাম এসেছে—দিদিমা এখন- তখন, একবার দেখতে চান। বিকেলের ট্রেনে চ’লে গেলাম। তিন দিন পরে ফিরে এলাম। স্টেশনে গাড়ি থেকে নামতেই ফেলুর সঙ্গে দেখা; পিঠ চাপড়ে বললে, বেশ, দিব্যি! মোদ্দা, মিষ্টান্ন ইতরে জনা—যেন বাদ না পড়ি।
তাকে যতই স্পষ্ট ক’রে বলতে বলি, সে ততই হেঁয়ালিটা ঘোরালো ক’রে তোলে; উল্টে বলে, যাও না ভাই, আর ভাঁওতা দেওয়া কেন?
বাড়িতে এসে জেঠাইমাকে প্রণাম করতে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ওগো, কোথায় গেলে গো, তোমার সেই পান্না আজ স্বয়ংবরা হয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে, একবার দেখে যাও গো।
একেবারে কাঠ মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম, শোকে শেষ পর্যন্ত কি জেঠাইমার মাথা বিগড়ে গেল!
শৈলীকে ডাকলাম; সে বাড়ি ছিল না। রতন লেই-মাখা হাতে বেরিয়ে এল। একগাল হেসে, চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললে, মামা, দিদিমা সব ঠিক করে ফেললে, চল্লিশ ভরি সোনা, আর এই নগদ—। ব’লে লেইয়ের মধ্যে থেকে বুড়ো-আঙুল দুটোকে উদ্ধার ক’রে দাঁড় করিয়ে ধরলে,—অর্থাৎ দু হাজার টাকা।
জিজ্ঞাসা করলাম, কার চল্লিশ ভরি সোনা রে? খুলে বল্ দিকিন।
শৈলী কোথায়? রতন হাত দুটো পরিষ্কার করতে করতে বললে, যাও, যেন জানেন না; নিজে ঠিক ক’রে এসে—। মামীমার! আর কার! আমি নিতবর; সিল্কের জামা চাই, হ্যাঁ।
জেঠাইমা ওদিকে কেঁদে যাচ্ছেন। রতনার কাছ থেকে যতটা জানতে পারা গেল, তাতে বোঝা গেল—আমি যাওয়ার পরদিন কলকাতা থেকে দুটি ভদ্রলোক এসে হাজির হন। রতনা হাত দুটো মুঠো ক’রে আর কনুই দুটো পাঁজরা থেকে হাতখানেক ক’রে সরিয়ে বললে, ইয়া কেঁদো কেঁদো দুটো ভদ্দরলোক মামা। জেঠাইমা বাড়ি ছিলেন না; প্ৰথমে রতনার সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় হয়। এদিক সেদিক অনেক কথা আলোচনা ক’রে রতনাকে নানাপ্রকারে আপ্যায়িত করে তাঁরা প্রশ্ন করেন, তোমার মামার কি মাথা খারাপ আছে?
রতন বলে, হ্যাঁ, একটু একটু।
তাঁরা বলেন, বিয়ে-পাগল, না?
রতন বলে, হ্যাঁ, এক্কেবারে বিয়ে করতে চায় না। দিদিমা বেচারী সবাইকে ব’লে বেড়ায়, এ কি পাগলামি ছেলের, দেখ তো! মামা কিন্তু টসকায় না একটুও।
তারপর জেঠাইমা এসে পৌঁছন! তাঁদের কথা শুনে লাহিড়ী মশায়কে ডেনে আনান। মুখুজ্জেদের বাগানে ঘুড়ি কেটে এসে পড়ায় রতনা আর এর পরের খবর রাখে না।
বললাম, তোর মাকে ডেকে আন্ শিগগির।
শৈলী এসে পৌঁছবার আগেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সোমবার ‘অমৃতবাজার’ বন্ধ থাকায় কাগজওয়ালা ‘বঙ্গবাণী’ দিয়ে যায়। রতনা সেটাকে ঢাউস ঘুড়িতে পরিণত করবার জন্যে সব যোগাড়যন্ত্র ক’রে রেখেছিল। বিজ্ঞাপনের কলমে চোখ বোলাতে বোলাতে এক জায়গায় হঠাৎ দৃষ্টি আটকে গেল; লেখা রয়েছে,
একটি সুন্দরী সুশিক্ষিতা পাত্রীর জন্য বিশেষ উচ্চশিক্ষিত শাণ্ডিল্য গোত্রের পাত্র আবশ্যক। কন্যার বয়স পনের বৎসর। কন্যার পিতা উপযুক্ত পণদানে সমর্থ। পাত্রটি সুশ্রী এবং স্বাস্থ্যবান হওয়া বাঞ্ছনীয়। অভিভাবক পাত্রের ফোটো সমেত পত্রাচার করুন, অথবা সম্ভবপর হইলে স্বয়ং আসিয়া সাক্ষাৎ করুন।
ডাক্তার সত্যপ্রিয় ব্যানার্জি
৭৫/১ নং ক্লাইভ রেঞ্জ, বেলিয়াঘাটা, কলিকাতা
আমি তো এক রকম টলতে টলতেই চেয়ারে এলিয়ে ব’সে পড়লাম।—করেছি কি! সাততাড়াতাড়ি একেবারে সশরীরে গিয়ে হাজির! বিজ্ঞাপনটা আবার পড়বার চেষ্টা করলাম, বোধ হয় ভুল দেখেছি, কিন্তু কালো ঝাপসা রেখার ওপর চোখ বুলিয়ে গেলাম মাত্র, একটা কথারও যেন মানে ধরতে পারলাম না। মাথার মধ্যে ক্রমাগতই কতকগুলো কথা এলোমেলোভাবে এসে সব গুলিয়ে দিতে লাগল।—বলছি, ‘আজ্ঞে আমি নিজের জন্যেই এসেছি’, কতই কাকুতি ক’রে বলছি, ‘সেইজন্যেই তো আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছি’, শেষে হাত দুটো একত্র ক’রে বলছি, ‘নিরাশ হব না, এ রকম আশা করতে পারি কি?’—পাশের ঘরের চাপা হাসি, ছোট ভাইয়ের উগ্র ভাব, আর বড়র সেই হতভম্ব ভাব—সবই তাদের প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। ভাবলাম, মা ধরণী, তোমায় দ্বিধা হতে অনেকেই অনেকবার বলেছে; কিন্তু আমার মত বিপন্ন হয়ে কেউ কখনও বলে নি। তুমি অন্তত তিনটি জায়গায় ফাঁক হয়ে আমাকে, সত্যপ্রিয়গুষ্টিকে, আর সেই বেটা বাস ড্রাইভারকে গ্রাস ক’রে ফেল। ওঃ, এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি, বেটা নিশ্চিন্দি হয়ে বিড়ি টানছে, আর নামতে গেলেই বলছে, ‘এই ইস্টার্ট দিলাম ব’লে বাবু।’
তাড়াতাড়ি সাইকেলটা নিয়ে ক্লাবে গিয়ে সেদিনকার পুরনো ‘অমৃতবাজার টাও খুঁজে বের করলাম। যদি কোনখানে, কোন রকমে, কোন একটু ভুল থাকে, নেহাত যদি।— কোথায় ভুল? স্পষ্ট লেখা রয়েছে—
Wanted a highly qualifed youth of other than Sandilya Gotra for a fair, accomplished girl aged fifteen. Handsome dowry. Kindly correspond with or see personally-in either case with the groom’s photo.
Dr. Satyapriya Banerjee,
75\1, Clive Range, Beliaghata, Calcutta.
অনেক চেষ্টাচরিত্র করলাম। বোঝানো, রাগ, অভিমান,—কিছুতেই কিছু হল না। অনশন ব্রত ধরলাম, ভাবলাম, গভর্মেন্ট ট’লে যাচ্ছে; ওদিকে ওরাও কাউন্টার অনশন ব্রত ধরলে—জেঠাইমা, শৈলী, এমনকি রতনা পর্যন্ত। পরে টের পেলাম, রতনা তিন বেলায় ছিদাম ময়রার দোকানে আমার নামে ধার করে তিন টাকা আড়াই আনার খাবার সাঁটিয়েছে, বলছে, বাড়িতে সবার ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাঁড়ি চড়ে না।
বেলেঘাটাতেও লজ্জার মাথা খেয়ে এক লম্বা চিঠি দিলাম, এই এই ব্যাপারে- অবস্থাগতিকে আমি ঘুণাক্ষরেও আসল কথাটা সন্দেহ করতে পারি নি—বড়ই লজ্জিত— আর বিবাহ করতে নিতান্তই অক্ষম—আমায় রেহাই দিন।
তারা তাড়াতাড়ি সেই দিন সন্ধ্যের সময় এসে আশীর্বাদ ক’রে গেল।
আমি সতেদের বাড়ি ছিলাম; টের পেলে কি আসি? শৈলী চালাকি ক’রে রতনাকে বলে, তোর মামাকে ডেকে আন, বলবি মাকে বিছে কামড়েছে, ছটফট করছে, শিগগির এস। শৈলীর সুপুত্র হঠাৎ এসে চোখ মুখ পাকিয়ে বললে, মামা, দিদিমাকে সাপে কামড়েছে, শিগগির ওঠ। বেটা হারামজাদাকে সেদিনে আর পেলাম না যে—
তবুও জেঠাইমাকে বললাম, আমি গঙ্গাজল স্পর্শ ক’রে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, বিয়ে করব না।
জেঠাইমা বললেন, মা দোষ নেবেন না, প্রাশ্চিত্তির ক’রে নিস।
বললাম, বিয়ের প্রাশ্চিত্তির কি আছে? কিন্তু কে শোনে সে সব কথা!
এই তো কাণ্ড রে ভাই; তাড়াতাড়ি বাসে চাপতে গিয়ে ঘটনাটি ঘটিয়ে ব’সে আছি।
তারপর? কবে এলি নাগপুর থেকে? আছিস কদ্দিন?
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আর সতে? সে কি করলে?
প্রথমটা দিন কতক কথা বন্ধ করলে; তারপর আমার ওপর আক্রোশ ক’রে পর পর দু-দুটো বিয়ে করলে। এখন বউ একটিই আছে, দুটি যমজ ছেলে, একটি মেয়ে।