মোগলমারির আবিষ্কৃত বৌদ্ধমহাবিহার : প্রত্নকথা
উৎখননের ইতিবৃত্ত ও সংবাদ শিরোনামে মোগলমারি
ইতিহাস ও পর্যটন
বৌদ্ধ প্রভাব

মোগলমারি প্রত্নক্ষেত্র : সংস্কৃতির সন্ধানে

মোগলমারি প্রত্নক্ষেত্র : সংস্কৃতির সন্ধানে – ড. বঙ্কিমচন্দ্র মাইতি

দাঁতন পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত, মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণান্তে অবস্থিত, সুবর্ণরেখা নদীর পূর্বতট-চত্বর। মন্দির, ভাস্কর্যপ্রতিমা, বৃহৎ দীর্ঘিকা, বহু প্রাচীন ইটের স্তূপ—তার পুরাতনী ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে।

৬ষ্ঠ থেকে ১১শ শতক দক্ষিণ-পশ্চিমের সমৃদ্ধ রাজ্য ‘দন্ডভুক্তি’। রাজকীয় অনুশাসনের সাক্ষ্য—৬ষ্ঠ শতকের জয়রামপুরের গোপচন্দ্রের তাম্রলিপি, ৭ম শতকের শশাঙ্কের ২টি মেদিনীপুর তাম্রলিপি, ১০ম শতকের নয়পালদেবের বালেশ্বর জেলার ইরদা তাম্রলিপি, তামিলনাড়ুর তিরুমইল পাহাড়ে উৎকীর্ণ ১১শ শতকের ১ম রাজেন্দ্র চোলের তিরুমইল প্রস্তরলিপি এবং ১১শ শতকে রচিত সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্যে ১১শ শতকের বিষয় অবলম্বনে রচিত দন্ডভুক্তি রাজ্যের উল্লেখ ও বিবরণ। রাজধানীর উল্লেখ নেই। রাজধানী নগরীর নাম নিয়ে ঐতিহাসিক বিতন্ডা আছে। প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিকরা ‘দাঁতন’কেই স্বীকার করেছেন। জনশ্রুতি—লোককথায় বর্তমানের মোগলমারি, পুরোনো নামে ‘অমরাবতী’—রাজপুরীর অধিষ্ঠানক্ষেত্র বলে মেনে নিয়েছে।

মোগলমারি দাঁতনের উত্তরে সুবর্ণরেখার ৪কিমি পূর্বে। গ্রামটির দক্ষিণে একটি বৃহৎ ও উঁচু ইট-মাটির পরিত্যক্ত ঢিবি। কিংবদন্তিখ্যাত ‘শশীসেনার পাঠশালা’। উত্তরে ইটের গাঁথনির উপর গড়া—একালের গ্রাম বসতি। সম্প্রতি (২০০৪ সাল) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপকমন্ডলী, বিভাগীয় প্রধান অশোক দত্তের অধিনায়কত্বে ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দের সযত্ন খননে—মোগলমারির প্রত্নক্ষেত্রের সামান্য কিছু অংশ অবারিত হয়েছে, গভীর খাত তৈরি করে শীর্ষ থেকে প্রায় আদি স্তর পর্যন্ত মনুষ্যবসতির সন্ধান মিলেছে।

দক্ষিণের ঢিবির ইটের গাঁথনির ভগ্নস্তূপ। নগরবাসীর প্রশাসনিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র। খননের ফলে উপরের ৪টি স্তর উন্মোচিত হয়েছে। সুপরিকল্পিত সৌধের কাঠামো, পূজার বেদী, মাটির প্রদীপ প্রভৃতি। সমৃদ্ধ, সম্পূর্ণ নগরজীবনের আভাস। উত্তরে গ্রাম বসতি—রাজা-রাজপুরুষের ইষ্টক গৃহের প্রোথিত ভগ্নাবশেষ। কয়েকটি খাত খননের ফলে ৭টি স্তর উন্মোচিত হয়েছে। সামগ্রিক বিচারে লোকজীবনের দু-টি পৃথক ধারা ফুটে উঠেছে। একটি প্রাক-ঐতিহাসিক লোকবসতির ধারা। অন্যটি নগরবাসীর জীবন পর্যায়। কালে কালে গড়ে ওঠা, অধিবাসীজনের সামগ্রিক ছবি। নদীচরের বসতি।

ভূমির নিরিখে, ২টি সংস্কৃতির পৃথক বিভাজিকা—প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক পর্যায়ের। মধ্যবর্তী—নদীগর্ভের মজ্জমান পলিমাটির স্তর ৫.৫সেমি উঁচু ধূসর বালি। স্বাভাবিক কারণে, সেই সময় মনুষ্যবসতির অবকাশ ছিল না। তারই নীচে নদীচরের ডাঙা ছিল। খননের ফলে তার ৩টি স্তর উন্মোচিত হয়েছে।

সর্বনিম্ন স্তর, ব্যাবহারিক প্রয়োজনে ১নং স্তর। জমাটবঁাধা হলুদ মাটির স্তর। তার উপর প্রত্নপলি। সম্ভবত বসতিহীন। ছোটোনাগপুরের পাহাড়ি মানুষেরা—শবর-মুন্ডা-কোল আদিজনগোষ্ঠীর পিতৃপুরুষেরা প্রস্তরায়ুধ ব্যবহারকারী মানুষেরা—উঁচু ভূমি জঙ্গলভূমি পশুশিকারী দল নদী পেরিয়ে সমভূমিতে আগ্রহী হয়নি। পরবর্তী ২টি ঊর্ধ্বস্তর, ক্রমি সংখ্যায় ২নং, ৩নং। মাটির রং ধূসর বাদামি।

কাঠ পোড়ানো কয়লা, পোড়া মাটির বিবিধ পাত্র, গৃহপালিত পশুর অস্থি নব্য প্রস্তর ও নদীচরের তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার নিদর্শন বহন করছে।

মাটির পাত্র তৈরিতে বৈচিত্র্য এসেছে। কর্কশ ও কাঁকুরে থেকে মসৃণতা এসেছে। কালো, ধূসর, রক্তিমোজ্জ্বল এবং চিত্রিত পাত্র তৈরি হয়েছে। পশুপালন শিখেছে। নদীচরের তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার পূর্ণতম রূপ বিকশিত হয়েছে। সুবর্ণরেখা নদীর তীরভূমি মানব সভ্যতার বিশদ রূপটি ফুটিয়ে তুলতে, ছোটোনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল, রাঢ় বাংলার নদী উপত্যকার আদি সংস্কৃতির রূপরেখাটি পশ্চাৎপটে আঁকা প্রয়োজন।

১. প্রস্তরায়ুধ সংস্কৃতি

ময়ূরভঞ্জের বুড়িবালাম, সুবর্ণরেখা-কাঁসাই-শিলাই-তারাফেনী-দামোদরের উচ্চ অববাহিকা প্রত্নজীবক শিলাভূমি পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি খ্রিস্টপূর্ব ১০ সহস্রাব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২ সহস্রাব্দ পর্যন্ত—প্রস্তরাশ্মীয় সভ্যতার মানববসতি গড়ে উঠেছিল। আদি প্রস্তর যুগের মুষল সংস্কৃতির সন্ধান মিলেছে—ময়ূরভঞ্জের বুড়িবালাম অববাহিকায়, বাঙরিপোষীর পাহাড়ি গুম্ফায়, সুবর্ণরেখার উপত্যকায়, তপোবনে, পাতিনার টিলাগুহায়, কংসাবতীর তটে—বেলপাহাড়ির টিলার সানুদেশে, লালগড়ের গুহায়, বঁাকুড়া-পুরুলিয়ায় আদি প্রস্তর যুগের নিদর্শন মিলেছে। মুখ্যত গুহাবাসী। কঙ্করস্তর, মাকড়া পাথরের স্তর থেকে প্রত্ন-প্রহরণগুলির সন্ধান মিলেছে। আয়ুধগুলি —পাথরের একধার, দ্বিধার হাতকুঠার—ছেদক। স্থূল আকারের।

মধ্যপ্রস্তর যুগের আয়ুধগুলি গড়ে উঠেছিল, পুরা প্রস্তর যুগের শল্কায়ুধের উপর ভিত্তি করে। স্থূলতা হ্রাস পেয়ে—পাতলা হাতকুঠার, ছেদক প্রভৃতি।

নব্যপ্রস্তর যুগে এল মসৃণতা। হ্রস্বাকার আয়ুধ, হাতল দেওয়া কুঠার, ছিদ্রল কুঠার, ফসল কাটার দা প্রভৃতি। মেদিনীপুরের তমলুক, গড়বেতার গনগনি ডাঙায় এই ধরনের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। পাওয়া গেল বঁাকুড়ার শুশুনিয়ায়, পুরুলিয়ার বনগাড়ায়, বর্ধমানে পান্ডুরাজার ঢিবিতে।

প্রত্নপ্রস্তর যুগে মৃৎপাত্র পাওয়া যায়নি। নব্যপ্রস্তর যুগে মৃৎপাত্র পাওয়া গেলেও, তা স্থূল পর্যায়ের। প্রাচীন মৃৎভান্ডের সন্ধান মিলেছে—সুবর্ণরেখার নদী উপত্যকায় গোপীবল্লভপুরের ঘোড়াপিঞ্চায়, পাতিনায়। সুবর্ণরেখার শাখানদী খরতী উপত্যকায় লালরঙের মোটা ধরনের মৃৎপাত্র, দাঁতনের সুবর্ণরেখার নদীচরের লাল ও চিত্রিত মৃৎপাত্র।

দ্বিপদী মেরুদন্ডী প্রাণীরূপে মানুষের আবির্ভাব—প্রায় ১ লক্ষ বছর আগে। দক্ষিণ ভারতের পূর্ব উপকূলে, প্রথম হিমযুগের শেষে ভারতে আদি মানবের আবির্ভাব। উত্তরকালে পূর্বভারতে খাদ্য সংগ্রহের অভিযানে অভিবাসিত হয়েছিল। আদি প্রত্নাশ্ম পর্বের স্থূল প্রস্তর, লগুড় নিয়ে—ময়ূরভঞ্জ-সুবর্ণরেখা-তারাফেনী উপত্যকায় উপস্থিত হয়েছিল। পশুশিকারী নিষাদ, কন্দ-মূল-সংগ্রাহক আহরণজীবী। স্থায়ী বসতি গড়ার প্রয়োজন হয়নি। নতুন নতুন অন্বেষণ ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার ও সংলগ্ন ঝাড়খন্ডের মালভূমি দীর্ঘস্থায়ী গভীর অরণ্য, বন্যপশুর প্রাচুর্য এদের বসবাসের উপযোগী। বিনপুরের সিজুয়ায়, কংসাবতী-তারাফেনীর সঙ্গমস্থলে নীচের চোয়ালের একটি জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীনতম জীবাশ্ম। প্রত্নবিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত—প্রায় ১০ হাজার বছর আগে সেই মানুষটির অস্তিত্ব ছিল।

প্রস্তরায়ুধ সংস্কৃতির সব স্তরের নিদর্শন পশ্চিম বাংলার পশ্চিম খন্ডের মালভূমিতে। আয়ুধ নির্মাণের কাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিসহস্রাব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ পর্যন্ত। স্থূল মুষলায়ুধ থেকে পাতলা, মসৃণ, তীক্ষ্ণায়ুধ। প্রস্তরভূমি থেকে, নদী-চত্বরের পলিভূমি দিকে বিশেষ অগ্রসর হয়নি। পশুশিকারী নিষাদ, সংগ্রহকারী কন্দ-মূল-ফল আহরণজীবী। নতুন নতুন অন্বেষণে যাযাবর, স্থায়ী আবাস নির্মাণের প্রয়োজন নেই। পশুমাংস আগুনে পোড়ানো হত। তাই মাটির পাত্র তৈরি হয়নি।

পরবর্তীকালে, তাম্রায়ুধ সৃষ্টির ঠিক আগের স্তরে, নব্যপ্রস্তর যুগে মাটির পাত্র তৈরি হল, পশুপালন শিখল, প্রাথমিক ধরনের কৃষিকাজ শিখল। প্রত্নতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় তা নব্যপ্রস্তর যুগ ও তাম্রপ্রস্তর যুগের সন্ধিকাল।

ঝাড়গ্রাম-সিংভূম-ময়ূরভঞ্জের পার্বত্য ও জঙ্গলভূমিতে আদি অস্ট্রাল গোষ্ঠীর সাঁওতাল, মুন্ডা, শবর, নিষাদ—এরাই প্রস্তরায়ুধ সংস্কৃতির স্রষ্টা। সুবর্ণরেখা নদীর পূর্বতট ভূমিতে, নিম্ন অববাহিকায় এদের বসতি গড়ে উঠেনি।

২. তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতি

প্রত্ন সংস্কৃতির ২টি মোটা ধাপ—ধাতু-পূর্ব প্রস্তর সংস্কৃতি, ধাতব সংস্কৃতি। ধাতব সংস্কৃতির ২টি উপস্তর—তাম্র সংস্কৃতি ও লৌহ সংস্কৃতি। তাম্র সভ্যতার কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৪শ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতক। লৌহ যুগের লোহার অস্ত্র ব্যবহারকারীরা তাম্র সংস্কৃতির পতন ঘটায়।

পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চল প্রস্তরায়ুধ সৃজন ক্ষেত্র। প্রস্তরায়ুধের শেষ স্তরে, নব্যপ্রস্তর প্রকরণের অবসানে তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতির আবির্ভাব। উত্তর ভারতের প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ে তখন প্রাক-মৌর্য যুগ। সিন্ধুনদের উপত্যকায়—হরপ্পা মহেঞ্জোদরোয় খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার অব্দের দিকে তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল, লোহার ব্যবহার প্রচলিত হয়নি।

তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার আর-এক ধারা, ভাগীরথীর পশ্চিমে নদীকেন্দ্রিক অঞ্চলে, সুবর্ণরেখার নদীর চরে, কংসাবতী পূর্বধারে, শিলাবতী-তারাফেনী নদী-উপত্যকায়, রূপনারায়ণ নদীর পশ্চিম তটে, বর্ধমানে অজয় নদীর তীরে—মেদিনীপুরের বঙ্গোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত—তাম্র নিষ্কাশন ও তাম্রবস্তু নির্মাণের কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। বিনয় ঘোষের অনুমান ধলভূম গড়, ঝাড়গ্রাম, শিলদা, বেলপাহাড়ি, মৌবনি তাম্রভান্ডার অঞ্চল। তাম্রাশ্ম উত্তোলন, তাপে গলন ও তাম্রবস্তু নির্মাণের প্রথম আবির্ভাব এই অঞ্চলে ঘটে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে—উত্তরে বর্ধমান—বীরভূম—বঁাকুড়া, পূর্ব-দক্ষিণে তমলুক, পশ্চিমে পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি অঞ্চলে।

এই অঞ্চলে দ্রাবিড়ীয় কোলীয় মিশ্রণগোষ্ঠী অসুর, হো, ওরাওঁ, তামার প্রভৃতি উপজাতি এই সংস্কৃতির স্রষ্টা। ‘অসুরগড়’ ঘাটশিলার প্রাচীন নাম। সিংভূমের তাম্রখনি অঞ্চলে এরা রাজধানী রাজ্য গড়ে তুলেছিল। ঘাটশিলার রাখা মাইনস অঞ্চলের অরণ্যভূমি ‘অসুরবনি’ তামা অর্থে ‘টাট’ বা ‘তাট’ এদের ভাষার দান। ধাতুনগরী ‘টাটা’ এই ভাষা সূত্রে প্রাপ্ত অভিধা। অমরকোষে—তাম্র ‘ম্লেচ্ছমুখ’ ঐতরেয় আরণ্যক-এ —অভক্ষ্যহারী মগধজন ‘অসুর’। কোল বা শূকরমাংস অভক্ষ্যবিধি। মগধজনের মতো স্ত্রী-পুরুষ নৃত্য-গীতপ্রিয়। পৌষ সংক্রান্তিতে ‘বাণপূজা’ ব্রতাচার। পূজাবেদী ‘মার্ড়ুক’ বা ‘মাড়ো’-য় লিঙ্গসদৃশ ভৈরব পূজা। দগ্ধাস্থি ডিম্বাকৃতি মৃৎপাত্রে শ্মশানে প্রোথিত করে। শ্মশান স্তূপ ‘মাড়ো’ পরে লিঙ্গদেবের অধিষ্ঠান-মন্দির ‘মাড়ো’।

অসুরগণ যেমন তাম্র নিষ্কাশনে পটু, মুন্ডারা তেমনি লৌহপিন্ড তৈরি ও লৌহবস্তু নির্মাণে দক্ষ। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে বিহারের লৌহখনিগুলি মৌর্য শাসনের অধিকারে আসে। মৌর্য-গুপ্ত শাসনের মধ্যবর্তী পর্যায়ে—শক, হুণ শাসনে লৌহ নির্মাণের কৃৎ-কৌশল গড়ে উঠল।

তাম্র গলানো ও নির্মাণের সঙ্গে লৌহ নির্মাণের পদ্ধতি ভিন্ন। খনি থেকে আহরিত তাম্র-প্রস্তরপিন্ড প্রথমে কাঠের আগুনে গলানো হত। পরের ধাপ—গলানো ধাতু ছাঁচে ঢেলে উদ্দিষ্ট বস্তু নির্মাণ করা। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে মৌর্যশাসনে তামার ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

লোহার ক্ষেত্রে লম্বা চুল্লিতে, হাপরের বাতাসে লোহা পাথরকে স্পঞ্জ জাতীয় ফাঁপা নলে পরিণত করা হত। পরে তামার মতো তরল ঢালাই না করে, তাকে বারবার পেটাই করে, উদ্দিষ্ট লোহার বস্তু নির্মাণ করা হত। বিনপুর থানার খস্বতী নদী অববাহিকায় গভীর অরণ্যে লোহা গলানোর ক্রিয়াকলাপ এখনও বর্তমান। অগভীর মাটির ট্রেঞ্চে—লোহা পাথর কুল ও তেঁতুল কাঠের গুঁড়ি সাজিয়ে লোহা গলানো হত। গলানোর কাজ করত মুন্ডা, ভূমিজরা। লৌহ পদার্থ নির্মাণ করত, ‘শান’ দিত রানক রাণারা। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে তামার এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে লোহার ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করেছিল।

তাম্রাশ্মীয় সভ্যতার বসতি গড়ে উঠেছিল—বর্ধমানের পান্ডুরাজার ঢিবিতে, বানেশ্বর ডাঙায়, পুরুলিয়ায় অযোধ্যা পাহাড়ের তলদেশে, রূপনারায়ণ নদীর তটভূমি প্রাচীন তাম্রলিপ্তে। বহির্ভারতে তাম্র আকরিক, তাম্র বস্তু সমুদ্রপথে রপ্তানি হত। যেমন— তামার ছিদ্রযুক্ত মুদ্রা, ছাঁচে ঢালা তামার মুদ্রা, তামার প্রসাধনী কাঠি।

ময়ূরভঞ্জের বুড়িবালাম নদীর তীরে পাওয়া গেছে তামার দীর্ঘাকৃতি কুঠার। বিনপুরে তামাজুড়িতে পাওয়া গেছে একটি কুঠার ফলক। শিলাবতী নদীর তটে পাওয়া গেছে একটি তামার কুঠার, তামার বালা, কিছু তৈজস। পুরাবিদদের বক্তব্য, তাম্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল—নদীচরের কোমল মাটিতে, জলধারার অকৃপণ দাক্ষিণ্যে। কৃষি উৎপাদন, গৃহপালিত পশুপালন, কুটিরশিল্প—জনবৃদ্ধি ও সম্পদপ্রাচুর্য উন্নত জীবনযাপনে আগ্রহী করে তুলল। সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠার পশ্চাৎপট তৈরি করল। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শ্রী ও পুষ্টির ছোঁওয়া লাগল।

নদীর মধ্য ও অন্ত্য প্রবাহভূমিতে মানুষ খাদ্য সংগ্রাহকের অচিরস্থায়ী ভূমিকা ত্যাগ করে, স্থায়ী উৎপাদকের ভূমিকা গ্রহণ করল। নদীচরের বালি মাটি, ধূসর হলুদ মাটি, বর্ষে বর্ষে প্লাবিত পলিমাটি ভূমিকে করেছিল উর্বর। নদীর অফুরন্ত জলধারা, মৌসুমি বর্ষণ ভূমিকে করে তুলল কোমল, সরস। তামার হাতিয়ার ভূমিকে কর্ষণ করল। বারিবহুল ধান মুখ্য ও বর্ষভোগ্য শস্য। তৃণাচ্ছাদিত ভূমি গরু মোষ ছাগ প্রভৃতি গৃহপালিত প্রাণীর খাদ্যের জোগান দিল। স্থায়ী বসতির প্রয়োজন দেখা দিল।

উৎখনিত প্রত্ন সাক্ষ্য থেকে, মোগলমারিকে কেন্দ্র করে নিম্ন সুবর্ণরেখার মাটি, কৃষি, পশুপালন, গ্রাম-গৃহবিন্যাস, মৃৎপাত্র ও পূজাচারের চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক তথ্য এসেছে, রাঢ় বাংলার জীবনদর্পণ থেকে।

ক. মাটি : সুবর্ণরেখার নিম্নতট চত্বরে অভগ্ন শিলাস্তর নেই। নদীর প্লাবন ভূমি হলুদ বান মাটি, গ্রাবেল মিশ্রিত বালিমাটি, ধূসর মাটি।

খ. কৃষি : মানব বসতির আদি স্তর থেকেই কৃষি প্রচলিত। বর্ষায় সিক্তভূমিতে ধানচাষ করা হত। ‘মাদা’ দিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ধান বপন ও রোপণ করা হত। পুঁড় জাতীয় আখ, দানা শস্য অড়হর জাতীয় টুঙুর ডাল ইত্যাদিও ছিল।

গ. পশুপালন : প্রস্তরায়ুধ উচ্চভূমিতে পশুপালন হয়নি। বঁাকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগের হাতি, বাঘ, হায়না, মহিষ, শূকর প্রভৃতি বন্য প্রাণীর অশ্মীকৃত কঙ্কাল পাওয়া গেছে। চরের পলিভূমিতে ভারবাহী ও মাংস সরবরাহকারী গৃহপালিত প্রাণীরূপে গুরুত্ব পেয়েছে—গোরু, মহিষ, শূকর।

ঘ. গ্রাম ও গৃহ : তাম্রাশ্মীয় যুগে ঘরবাড়ি তৈরি করে, স্থায়ী বসতি গড়ে উঠেছে। ছোটো ছোটো গ্রাম গড়ে উঠেছে। কৃষক, পশুচারক, মাছশিকারী জেলে, কুম্ভকার, তামার, লোহারদের আলাদা আলাদা সীমানা ছিল।

 বঁাশ, ডালপালা দিয়ে বাড়ির দেওয়াল তৈরি হত, কাদামাটির প্রলেপে ‘ছিটে বেড়া’। ছাউনি—খড়, তালপাতার। এক চালার একটি ঘর। ছাউনি দাঁড়িয়ে থাকত বঁাশ-কাঠের খুঁটির ওপর। মেঝে শক্ত হত—শুকনো মাটি, বালি, কাঁকর পিটিয়ে। গোবর-মাটি দিয়ে জাব দেওয়া হত। গোলাকার বা চতুষ্কোণাকার কুঁড়ে।

 ঘরের মধ্যে এক কোণে থাকত রান্নার চুল্লি, মাটির পাত্র, গৃহপালিত প্রাণীর খোয়াড়।

 বাস্তুভূমিতে পূর্ণবয়স্ক মানুষের দাহ হত। কখনো কখনো শবভস্ম মাটির পাত্রে রেখে সমাহিত হত।

ঙ. মাটির পাত্র : নব্যপ্রস্তর ও তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতির প্রধান দান—মাটির পাত্র তৈরি। প্রত্নপ্রস্তর সংস্কৃতিতে পাত্রের ব্যবহার ছিল না। আগুনে পোড়ানো ছাড়া অন্য রন্ধনপ্রণালী তাদের অজ্ঞাত। তাম্রাশ্মীয় সভ্যতায় ধানের মতো শস্যকে খোসা ছাড়িয়ে সেদ্ধ করার রীতি দেখা গেল।

রন্ধনপাত্র, পানপাত্র, শস্য সংরক্ষণ ক্ষেত্রে পাত্ররূপে দেখা গেল হাঁড়ি, কলসি, জালা প্রভৃতি। পুরোনো পলি মাটি, ক্ষার মাটি, বালি মিশিয়ে—পাত্রের উপযোগী মাটি তৈরি হল। প্রথম স্তরে হলুদ বানমাটি, গিরিমাটির মিশাল দিয়ে মোটা ধরনের হালকা রঙের হাঁড়ি। বাইরে ও ভেতরে তুষের আগুনে পোড়ানো হত। হাতে-গড়া পাত্র প্রাথমিক স্তরের।

দ্বিতীয় স্তরে পাত্রের আকারে বৈচিত্র্য এল। চাকা ঘুরিয়ে পাত্র তৈরি হল—জালা, হাঁড়া, ঘট, ঘড়া, সরা, থালা, রেকাব প্রভৃতি।

পরবর্তী স্তরে বর্ণিল সৌন্দর্যময়তা এল। মোগলমারির ঢিবিতে পাওয়া গেছে গাঢ় লাল রঙের, ফিকে লাল রঙের, কালো ও ধূসর ছাঁচেঢালা পাত্র। ছিদ্রহীন ও ছিদ্রযুক্ত গামলা, কানা-উঁচু কলসি। বৃত্তাকার ও অর্ধবৃত্তাকার থালা-সরা-বাটি এবং প্রচুর প্রদীপ। অর্ঘ্য সাজানো বাটি। শিল্পদ্রব্যগুলি ছিল—খাড়া দাঁড়ে পাখি, ছাঁচে-ঢালা মনুষ্য মস্তক। কড়ির আকারের মৃৎগুটিকা—সম্ভবত ক্রয়-বিক্রয়ের প্রয়োজনে, সুতো কাটার মাটির তকলি—বয়নের স্বার্থে।

মাটি সংগ্রহ হত নদীচরের হলুদ বানমাটি, দুধেল খড়িমাটি থেকে। উজ্জ্বলতা আনতে লাল রাঙা মাটির উপর খয়ের, তেঁতুলবিচি, আমের ছালের ভিজানো মন্ড ব্যবহৃত হত। গাঢ়তা আনতেন কাপড়ের পাতলা আবরণ দিয়ে। ভাটিতে পোড়ানোর জন্য পাত্রগুলিকে সাজানো হত। তুষ, শুকনো পাতা, ছোটো ছোটো ডালপালা দিয়ে পোড়ানো হত। ভাটিতে রাখা হত একদিন একরাত্রি ধরে।

মোগলমারির প্রাচীনতম সংস্কৃতি—গ্রামীণ সংস্কৃতি, জনপদ সংস্কৃতির অভিমুখ। প্রাক-মৌর্য ও মৌর্যযুগের লোকজীবনের সৃষ্টি। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে ২য় শতক পর্যন্ত তার জীবৎকাল।

পরবর্তীকালে দীর্ঘ সুষুপ্তির পর মজ্জমান ভূমি পেরিয়ে অন্ত্য-গুপ্ত যুগে তার নগরজীবনে আবির্ভাব।

দুই

ইট, পাথরে তৈরি স্থায়ী আবাস—স্থাপত্য। রাজার প্রাসাদ, দেবতার মন্দির—সৌষ্ঠবে -সৌষম্যে স্থাপত্যশিল্প। পাহাড়ি ভূমিতে পাথর যেখানে প্রকৃতির দান, সহজলভ্য— সেখানে মন্দির চৈত্য-বিহার বহু শতাব্দীর স্থায়ী স্থাপত্য কীর্তি।

নদীমাতৃক ভূমিতে—সিন্ধু-গাঙ্গেয় উপত্যকায় পোড়া মাটির ইট ব্যবহৃত হত। খ্রিস্টোত্তর ৪র্থ শতক থেকে গুপ্তশাসনে ইটের ব্যবহারের ব্যাপকতা এসেছে।

গুপ্তান্তিক পর্বে সুবর্ণরেখা নদীর মোহানা সংলগ্ন ভূমিতে, ৬ষ্ঠ শতক থেকেই উত্তর ভারতীয় নগর সংস্কৃতির সুস্পষ্ট প্রভাব প্রসারিত হয়েছে। ইটের গাঁথনি দিয়ে তৈরি রাজার প্রাসাদ, দেবতার মন্দির, শ্রমণ-ভিক্ষুদের সংঘ-আবাস, উপাসনালয়, চৈত্য-বিহার নির্মিত হয়েছে। প্রাচীর, পরিখাবেষ্টিত পৌর-নগরী গড়া হয়েছে।

মোগলমারি—ইসলাম-স্পৃষ্ট শিরোনাম অর্বাচীন কালের, মাত্র চার-শো বছরের পুরোনো স্মারক। ষোড়শ শতকের শেষপাদে সুবর্ণরেখার তটচত্বরে কয়েক বছরব্যাপী (১৫৭৫—১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) মোগল-পাঠানের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মৃতি।

পূর্ব নামের লিখিত সাক্ষ্য নেই। জনমুখরতায় ‘দন্তবন বিহার’ (দন্তবন > দাঁতন) এবং আরও পরবর্তীকালে ‘অমরাবতী’ দেবনগরী। জনশ্রুতি ‘নাহ্য মূলা:’ হলেও বহু পল্লবিত হয়েও ইতিহাসের ছিটেফোঁটা টিকে থাকে। গ্রামের মধ্যে ৮০মি × ৮০মি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ইট-মাটির একটি ঢিবি। এতবড়ো ভগ্নস্তূপের দাঁতন অঞ্চলে আর সন্ধান মেলেনি। বর্তমানে বসতি নেই ওই ঢিবিতে।

ঢিবির উত্তরে নাতি-উচ্চ ভিত্তির ওপর একালের গ্রাম জনপরিচয়ে শশিসেনার গড়। গল্পকথা : রাজকন্যা শশিসেনার গুরুগৃহে ছদ্মবেশী এক রাজপুত্রের রোমান্টিক বাল্যপ্রণয়। গান্ধর্ব বিবাহ, ছদ্মবেশে গৃহত্যাগ, স্বৈরিণী মালিনীর সঙ্গে রাজপুত্রের অবৈধ প্রণয়, পূর্বকথা বিস্মৃত। পুরুষবেশে রাজপুত্রকে উদ্ধার করে নানা দুঃসাহসিক রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা কাহিনির চুম্বক। ইতিহাসের তথ্য হারিয়ে যায়। কিন্তু লোকমানস রসের কারবারী। তাই মানবিক রাগ-অনুরাগ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, জয়-পরাজয়ে—সেই রসের ভিয়ানে গড়ে ওঠে—জনশ্রুতি কিংবদন্তি।

খনন চালিয়ে, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য দৃষ্টিগোচরে এসেছে। খ্রিস্টপূর্বকালে যে গ্রামীণ সংস্কৃতির এখানে উদ্ভব, মধ্যযুগে সেখানে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি-অনুগ এক নাগরিক সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল।

মূলত তাঁদের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, উড়িষ্যা-বাংলার সীমান্ত অঞ্চলে মধ্যযুগীয় বাংলার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা বর্তমানের আলোচনার বিষয়।

উৎখনিত গড় : প্রায় ১ মাইল (১.৬কিমি স্থান জুড়ে, বর্তমান গড়টির বিস্তার। মাটির চরিত্র থেকে বোঝা যায় নদীতটের পলিমাটিতেই বসতি গড়ে উঠেছিল। সুবর্ণরেখার পূর্বে চাতালভূমিতে তার অবস্থান। বর্তমানে নদী আরও পশ্চিমে প্রায় ৪কিমি সরে গিয়েছে।

ক. পরিখা : পশ্চিমে নদী, বাকি তিনদিকে পরিখা। পরিখার সামান্য কিছু কিছু এখনও বর্তমান। গভীর খাতে ছেড়ে দেওয়া হত নক্র কুমির—হিংস্র জলজ প্রাণী।

খ. প্রাকার : পরিখা পেরিয়ে গড়কে ঘিরে মাটির প্রাচীর। বহু কালের বহুক্ষয়ের পরও, দক্ষিণের সামান্য অংশে ১০ ফুট উঁচু, ৩৫ ফুট চওড়া প্রাচীরের অংশ এখনও কালের সাক্ষী। চারদিক ঘিরে কাঁটা, বঁাশ ও বেতের ঘন সন্নিবেশ। প্রাচীন বাস্তুবিজ্ঞান শাস্ত্রে, একদিকে নদী, বাকি তিনদিক ঘেরা প্রাচীর, পরিখা—রাজ অবরোধ, মাগধী রীতিতে গড়া এক বর্ত্ম—জলদুর্গ। এই রীতিতে গড়া ভুবনেশ্বরের শিশুপাল গড়, মগধের রাজগৃহ।

গ. গড়ের বিন্যাস (ঢিবি) : গড়ের ২টি অংশ। দক্ষিণেরটি মাটি-ইটের উঁচু ঢিবি। আয়তন ৩০০ বর্গমি। নীচের শস্যক্ষেত্র থেকে বর্তমানে উচ্চতা ২৫ ফুট। সামান্য উৎখননের ফলে (ক বি ২০০৪) বহু কক্ষ সমন্বিত একটি ভগ্নসৌধের ভিত। ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কেন্দ্ররূপে সৌধটি ব্যবহার করা হত।

 তার উত্তরে নীচের অংশটি—বসতি গ্রাম। আয়তাকার। সমতল অপেক্ষাকৃত নীচু জমি উৎখননের ফলে ইটে গাঁথা বসতবাড়ি, গম্বুজের পাদমূলের আভাস ফুটে ওঠে। প্রশাসক, সম্পন্ন কর্মচারীর বসতগৃহ।

ঘ. ইট: গড় নির্মাণে ইটেরই ব্যবহার হয়েছে। পুরোনো কালের ইট—পাতলা, আয়তাকার। দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে বড়ো, উচ্চতায় হ্রস্ব। গুপ্ত পর্বের ও আদিপাল পর্বের। সাধারণভাবে ২৮ × ২৪ × ৬সেমি এবং ২১ × ১৯ × ৫সেমি। বড়ো ইটগুলি আগের কালের, ছোটো ইটগুলি পরবর্তীকালের। দুই ভিন্ন কালের দুই গাঁথনির স্মৃতি বহন করছে। গাঁথনিতে মাটি ও চুনের ব্যবহার।

ঙ. স্তর নির্দেশ : উৎখননের ফলে গড়টির সামগ্রিক ভূস্তরের কিছু কিছু অংশ উদঘাটিত হয়েছে। প্রধান ঢিবিটির উপর থেকে নীচের ৪টি স্তর।

নিম্নের বসতিগ্রামে কয়েকটি বিবর (hole) খুঁড়ে, ৭টি ভূস্তরের সন্ধান মিলেছে।

সর্বনিম্ন স্তর (১ম)—আদি মৃত্তিকার স্তর। ৩০সেমি উঁচু হলুদ মাটির জমাট বঁাধা স্তর। সম্ভবত এই স্তরে এই অঞ্চলে মনুষ্যবসতি গড়ে ওঠেনি। ২য় ও ৩য় স্তর উচ্চতায় ৯০সেমি এবং ৫০সেমি। মাটির রং ধূসর বাদামি। মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। ২য় স্তর মনুষ্য বসতির প্রথম স্তর। মুষল মুদগর আয়ুধধারী মানুষ। ৩য় স্তরে মানুষ তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতির অধিকারী। কাঠপোড়ানো কয়লা, পোড়ামাটির বিবিধ পাত্র, গৃহপালিত পশুর অস্থি, রন্ধন, পশুপালন, শস্য উৎপাদন মানুষের আয়ত্তে। মোগলমারির প্রাচীনতম সংস্কৃতি, গ্রামীণ সংস্কৃতি, জনপদ সংস্কৃতির দিকে অভিমুখ। প্রাক-মৌর্য যুগ ও মৌর্যযুগের লোকসাধারণের সৃষ্টি। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক পর্যন্ত প্রায় ৩শ বছর ধরে সুবর্ণরেখার পূর্বতটে এই সংস্কৃতির আবির্ভাব, সেই সংস্কৃতি প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি।

৪র্থ স্তর নদীগর্ভের মজ্জমান পলি-বালিস্তর। প্রায় ৫৫সেমি উঁচু ধূসর বালি -মাটির স্তর। স্বাভাবিক কারণে, এই মজ্জমান স্তরে মনুষ্যবসতির অবকাশ ছিল না। প্রত্নবিদদের বক্তব্য : আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২ শতক থেকে আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৫ম শতক পর্যন্ত এই অঞ্চল নদীতে ডুবে ছিল।

এই সুউচ্চ বালুকাস্তূপের ওপর ৬ষ্ঠ-৭ম শতকে এখানে গড়ে উঠল এক নতুন সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতি গ্রামানুগ সংস্কৃতি নয়, হর্ম্য-সৌধবহুল নগর সংস্কৃতি।

উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তখন গুপ্তশাসনের অবক্ষয়ের কাল। প্রাদেশিক শাসকরা তখন প্রায় স্বাধীন। বিস্তীর্ণ বালুকাভূমির উপর দন্ডভুক্তি রাজ্যের প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, ধর্মীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্র গড়ে উঠল। সুবর্ণরেখার উর্বর পূর্বতটে, উত্তর ও দক্ষিণে প্রসারিত ‘দন্ডপথ’-এ, ‘দন্তবন বিহার’-এ। তার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে—কেন্দ্রীয় মৃৎস্তূপের ৫ম স্তরে।

প্রাচীন দন্ডপথ—উত্তরাপথ—দক্ষিণাপথ, পাটলিপুত্র থেকে বিশাখাপত্তনম পর্যন্ত তার স্থল সরণি। তাম্রলিপ্ত থেকে দন্ডভুক্তি পর্যন্ত একটি শাখা সরণি এসে মিশেছে। স্থলপথ ও জলপথের বাণিজ্যকেন্দ্র—তাম্রলিপ্ত, দন্তপুর, পিপ্পলী। সুবর্ণরেখাকে পাশে রেখে কিছুদূরে গড়ে তোলা হয়েছে—প্রতিরক্ষাব্যূহ বনদুর্গ, জলদুর্গ; শ্রেষ্ঠী-বণিক-সদাগরের পণ্য পরিবহণের নিরাপদ আশ্রয় পান্থশালা; শ্রমণ-ভিক্ষু-যোগী-যতিদের মঠ, বিহার-সংঘারাম, মন্দির-দেবদেউল। বহু সার্থসাধক পৌরনগর।

৫ম স্তর : মাটির ঢিবির ৫ম স্তরে ইটের তৈরি একটি সৌধের অস্তিত্ব ছিল। কালো বাদামিস্তরে ছিটিয়ে ছড়িয়ে আছে ভগ্নসৌধের ইট, ইটের টুকরো। স্তরটির ঘনত্ব ৪৩সেমি। ইটের পরিমাপ ২৮ × ২৬ × ৬সেমি।

সৌধ অঙ্গনটি প্রায় বর্গাকার। ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে বর্গাকার নকশা বিহার নির্মাণের সাধারণ রীতি। অঙ্গনটি ঘিরে মাটির প্রাচীর ছিল, স্নান-আচমনের জন্য গভীর কূপ ছিল।

আঞ্চলিক শক্তির সীমিত ঐশ্বর্যে গড়ে উঠেছিল এই কর্মকান্ড। ভিত্তিভূমি ছিল পোড়া ইটের। সম্ভবত দেওয়াল ছিল কাঠ-বঁাশের মাটির পলেস্তারার, ছাউনি খড়-তৃণের। ভগ্নস্তূপে প্রাচুর্যের লক্ষণ কোথাও নেই। ভঙ্গুর বলেই স্তূপ-বিহারটি শতবৎসরের মধ্যেই ভূমিসাৎ হয়েছিল। সেই কালের ইট, পরবর্তী কালের সৌধ নির্মাণে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছিল। জনশ্রুতিতে তা ছিল—‘দন্তবনবিহার’, শারীর ধাতুস্তূপ। বুদ্ধের বাম শ্বদন্তের উপর প্রতিষ্ঠিত স্তূপ।

বৌদ্ধ ঐতিহ্যে স্তূপ তিন প্রকারের : ১. শারীর ধাতুস্তূপ। এই শ্রেণির স্তূপে বুদ্ধদেবের এবং তাঁর শিষ্য-অনুচরের শরীরাবশেষ রক্ষিত ও পূজিত হত। ২. পারিভোগিক ধাতু স্তূপ—এই ধরনের স্তূপে বুদ্ধের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি রক্ষিত ও পূজিত হত। ৩. নির্দেশিকা বা নিবেদন স্তূপ—বুদ্ধ বা বৌদ্ধধর্মের জীবনেতিহাসের সঙ্গে জড়িত কোনো স্থান বা ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত, বৌদ্ধতীর্থস্থানে ভক্তগণ ছোটো-বড়ো স্তূপ নিবেদন করে অর্ঘ্য ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করতেন।

আদিতে শারীর স্তূপের গঠনগত বৈশিষ্ট্য : একটি গোলাকার বা অর্ধচন্দ্রাকার বেদীর ওপর একটি অন্ড গড়া হত। অন্ডের ঠিক উপরে থাকত একটি হমিকা। হমিকা বেষ্টনীর মধ্যে একটি ভান্ডে রাখা হত পবিত্র শারীর ধাতু।

পরবর্তীকালে: পারিভোগিক ও নিবেদন স্তূপে—হমিকার ওপর রাখা হত ছত্রাবরণ।

জনশ্রুতি, বিধ্বস্ত সৌধ ছাড়া—‘দন্তবনবিহার’ অনুমান-নির্ভর। সেটি ছিল বুদ্ধদন্তের ওপর স্থাপিত শারীর ধাতুস্তূপ।

উত্তর কলিঙ্গ—উৎকলের সঙ্গে বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের সম্পর্ক নিবিড় এবং সম্পর্ক গড়ে তোলার মূলে ছিল উৎকলীয় বণিকদের বিশিষ্ট ভূমিকা। উরুবিল্ব গ্রামে গোপকন্যা সুজাতা মহাবোধি মহাজ্ঞানীকে পায়সান্ন নিবেদন করেছিলেন। দুই উৎকলীয় বণিক ত্রপুসা ও ভল্লিক তাঁদের পণ্যসম্ভার নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরমান্ন ও মধু দিয়ে তাঁরা পরম সুগতকে অর্ঘ্য দান করেছিলেন। তাঁরাই বুদ্ধবাণী উৎকল ওড্র-কলিঙ্গে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। অজন্তার ১১নং গুহার একটি প্যানেলে এই বণিকদ্বয়ের চিত্র অঙ্কিত আছে। শ্রদ্ধাবনত, নতজানু, উৎকলীয় কেশবিন্যাস মাথার পেছনে ঝুঁটিবঁাধা খোঁপা।

সিংহলী ‘দাঠ্যবংশ’-এর বিবরণ : বুদ্ধের দেহাবশেষের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ অব্দ) পর, বুদ্ধশিষ্য ক্ষেম বুদ্ধদন্ত সংগ্রহ করে কলিঙ্গ-উৎকলের কোনো এক স্থানে স্থাপন করে শারীর ধাতুস্তূপ নির্মাণ করেন। পন্ডিতমহলে স্থানটির অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে। খ্রিস্টপূর্ব শতকগুলিতে সুবর্ণরেখার তটভূমি জলগর্ভে মজ্জমান ছিল। মানব-সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটলেও, সেই সংস্কৃতি প্রাথমিক গ্রামীণ সংস্কৃতি। ইটে তৈরি নগর-সংস্কৃতি সেখানে গড়ে ওঠার অবকাশ ছিল না।

গুপ্তান্তিক ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে বাণিজ্যের বিস্তৃতি, উত্তর ভারতীয় রাজন্যবর্গের শ্যেন দৃষ্টি, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রবল আগ্রহ — দন্ডভুক্তি রাজ্য এবং সেই পশ্চাৎপটে কিংবদন্তি-কথিত ‘দন্তবনবিহার’ গড়ে ওঠার সম্ভাব্য কারণ বলে মনে হয়।

খ্রিস্টীয় ৮ম শতকে বজ্রযানী দার্শনিক নাগার্জুন কটকের ললিতগিরি বিহারে প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রজ্ঞাপারমিতা পান্ডুলিপির পৃষ্ঠপটে স্তূপশীর্ষ ভদ্র, দন্ডভুক্তির সৌধ বিহারের চিত্র অঙ্কিত আছে।

ঐতিহাসিক, প্রত্নবিদদের সিদ্ধান্ত : অন্ত্য-গুপ্ত সামন্ত শাসকগণই দন্ডভুক্তির নগর-সংস্কৃতির স্রষ্টা। ৬ষ্ঠ শতকের গুপ্ত সম্রাট বৈন্যগুপ্তের রাজপ্রতিনিধি ছিলেন মহারাজ গোপচন্দ্র (খ্রিস্টীয় ৫২৫—৫৮৫ অব্দ)। তাঁর সামন্ত শাসক দন্ডভুক্তিরাজ ‘মহারাজা-মহাসামন্ত’ অচ্যুত। অচ্যুতের রাজাদেশ যে তাম্রপটে ঘোষিত হয়েছিল, তা পাওয়া গেছে বালেশ্বর জেলার জয়রামপুরে। শাসনটিতে বিজ্ঞাপিত হয়েছিল—সমুদ্র উপকূলে সুবর্ণরেখার উত্তর-পূর্বে ‘বোধি-পড্রক’ গ্রামে। বর্তমানে ‘বোধড়া’ কাঁথি রামনগর থানার সমুদ্র উপকূলে। অচ্যুত প্রায়-স্বাধীন রাজা, রাজোপাধি—‘মহারাজা মহাসামন্ত’—দন্ডভুক্তির রাজা। দন্ডভুক্তির উল্লেখ থেকে বোঝা যায়, খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের আগেও, দন্ডভুক্তি রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। বৈন্যগুপ্ত শিব-অনুধ্যাত। অচ্যুত সম্ভবত বৌদ্ধ।

বৌদ্ধ শ্রমণ-ভিক্ষু, বণিক-শ্রেষ্ঠীর উদ্যোগে, সামন্তরাজের পৃষ্ঠপোষকতায়, অর্থানুকুল্যে শারীর চৈত্য ‘দন্তবনবিহার’ ৬ষ্ঠ শতকে এখানে নির্মিত হয়েছিল। স্তূপ, সংলগ্ন শ্রমণাবাস, উপাসনাগৃহ। কাকরাজিতে প্রাপ্ত মাকড়া পাথরের ধর্মচক্র, ত্রিরত্ন ত্রিশরণ—এই কালের সৃষ্টি। মাত্র ১ শত বৎসরের মধ্যেই তা ভূমিসাৎ হয়েছিল। শশাঙ্কের রাজত্বকালে আরও বিপুল, আরও সমৃদ্ধ বিহার এখানে নির্মিত হল।

৬ষ্ঠ স্তর : ৫ম এবং শেষ মধ্যবর্তী ভূমি ভরাট করা ভাঙা ইট, ধূসর মাটির স্তর। তার উচ্চতা মাত্র ৪৯সেমি।

৭ম স্তর : ঢিবিটির সর্বোচ্চ ও শেষ স্তর। ওপরে ছড়িয়ে আছে ভাঙা ইট, মাটির পাত্রের ভাঙা টুকরো। স্তরটির ঘনত্ব ৪৩সেমি।

ওপরের ধুলো ও মাটির আস্তরণ সরিয়ে ফেলতেই বেরিয়ে আসে, এক বিপুলায়তন, গুরুভার—পোড়া ইটের সৌধের কাঠামো। মূল প্রাসাদটি বর্গাকার। পশ্চিম থেকে পূর্বে আড়াআড়ি ভাবে চলে এসেছে কয়েকটি উদগত অংশ। ফলে সমগ্র সৌধ ভবনটি আয়তাকার এবং ক্রুশের আকারের।

মূল ভবনটির দেওয়াল ২মি থেকে ১.৮৯মি চওড়া। দেওয়ালের বাইরের দিক গোটা ইটে গাঁথা। ভেতরের অংশ ভাঙা ও টুকরো ইটের প্রলেপ দিয়ে দেওয়ালের ভেতরের দিক মসৃণ করা হয়েছে। ভিতের তিনটি ধাপ দেখা যাচ্ছে। নীচের ধাপটি ১২ইঞ্চি উচ্চতায় ৫টি ইট। উপরের দু-টি ধাপ ১৬ইঞ্চি করে ৭টি করে ইট আছে। উপরের অংশ সমতল ভূমিতে মিশে আছে। হলঘরের পশ্চিম, উত্তর ঘেঁষে আয়তাকার একটি গভীর বেদী মঞ্চ। ওপরের মেঝে থেকে ৫৩সেমি গভীর। পশ্চিমে বিস্তার ৫.১৫মি, উত্তরে-দক্ষিণে বিস্তার ৪.৩৫মি। পুবের দিকের অংশটি একালের তৈরি একটি বাড়ি ঢেকে রয়েছে। প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী—বড়ো-ছোটো গামলা, ছোটো হাঁড়ি, উঁচু-গলা তৈল পাত্র। ঢিবিটির দক্ষিণে বাইরের প্রাচীরের গা ঘেঁষে কয়েকটি বর্গাকার ও আয়তাকার ভিতের কক্ষ।

গাঁথনিতে ইটগুলি বিভিন্ন আকারের। সেকালের ইটের সঙ্গে, আরও আগের কালের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ঢিবিটিকে ঘিরে পরিখা। চওড়া ও উচ্চতায় বৃহৎ একটি মাটির প্রাচীর।

প্রত্নবস্তু : (ক) মূর্তি: ঢিবিটির পৃষ্ঠতল থেকে একটি বুদ্ধমূর্তি, একটি গণেশমূর্তি, একটি বিষ্ণুমূর্তি সংগৃহীত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তিটি গুরুত্বপূর্ণ।

সিংহাসনে আসীন, পদ্মাসনে উপবিষ্ট কষ্টিপাথরের ধ্যানীবুদ্ধের আসল মূর্তি। চালচিত্রসহ সিংহাসনের আয়তন লম্বায় ২২সেমি, প্রস্থে ১০সেমি। প্রস্তর ফলকের বেধ ৮.৭সেমি। মূর্তিটি লম্বায় ২.৫সেমি, বক্ষে প্রস্থ ৪সেমি বেধ ২.৫সেমি।

মূর্তিটি স্বল্পায়তনের, আকারে হ্রস্ব। মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত হয়েছিল বলে মূর্তিটি সিংহাসনাসীন। নিরলংকার দেহসজ্জা, ডৌলের কমনীয়তা সূক্ষ্ম সংবেদনশীল বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব মূর্তি। পৃষ্ঠপটে উৎসর্গ লিপি। সংস্কৃত ভাষায়, ব্রাহ্মী অক্ষরে, সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে খোদিত। প্রতিমার পরিচয়, প্রতিমার দাতা, রানক ভাস্করের নাম খোদিত। মূর্তি-বিশেষজ্ঞের সিদ্ধান্ত—মূর্তিটি ৮ম শতকের। গণেশ ও লক্ষ্মী মূর্তিও এই কালের।

ঢিবিটির ওপরের অংশে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর মাটির প্রদীপ, অর্ঘ্যপাত্র, বড়ো- ছোটো মাটির গামলা, কালো পালিশ দেওয়া ছোটো ছোটো মাটির পাত্র, লাল রঙের ছোটো ছোটো পাত্র। পূজার উদ্দেশ্যেই সেগুলি ব্যবহার করা হত।

(খ) ব্রতোদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত পদক লিপি : গ্রামবাসীর সংগ্রহে আছে পোড়ামাটির একটি লিপি ফলক। আয়তন ৬.৫সেমি/৭.৫সেমি। ফলকে উৎকীর্ণ লিপির ভাষা প্রাকৃত মিশ্রসংস্কৃত। অন্ত্য-গুপ্তকালীন ব্রাহ্মী লিপির ছাঁচ। লিপি বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্তে লিপিটি ৬ষ্ঠ-৭ম শতকের। ৩টি পঙক্তি :

১ম পঙক্তি : ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সিদ্ধি কামনায়,

২য় পঙক্তি : গোড়া থেকে গণনীকৃত (জপমন্ত্র),

৩য় পঙক্তি : বহু দ্রব্য উৎসর্গীত হল।

দু-টি কারণে পদক লিপিটির গুরুত্ব খুব বেশি। এক, ভাষা ও লিপির বিচারে এটি অন্ত্য-গুপ্তকালীন রচনা, ৬ষ্ঠ-৭ম শতক। দুই, লিপিটি উদ্দেশিক বা নিবেদন লিপি। স্তূপপদমূলে ভক্তজন তা নিবেদন করতেন। পূজা ও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হত। জপমালা হাতে নিয়ে মন্ত্র জপ হত।

ফলকটি আবিষ্কৃত হওয়ায়, এটি যে স্তূপবিহার এবং এটি যে শারীর স্তূপ নয়, পারিভোগিক নয়, একান্তভাবে উদ্দেশক স্তূপ সেবিষয়ে নি:সংশয় হওয়া গেল। স্তূপবিহারের ইতিহাসে এটি শেষ পর্যায়ের।

স্তূপ নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু-টি অঙ্গ। প্রথমে বেদী—বর্গাকার বা আয়তাকার ভিত্তি বেদী। দ্বিতীয়, তার ওপর স্থাপিত গোলাকার ‘অন্ড’—শারীর বা উপভোগিক নিদর্শন তার মধ্যে স্থাপিত হত।

পরবর্তীকালে তাকে ঘিরে একটি হমিকা তৈরি হল। হমিকার ওপর স্থাপিত হল ছত্রাবরণ। স্তূপটিকে উঁচু করে গড়ে তুলতে প্রতিটি অঙ্গকে লম্বিত করা হল। ৭ম-৮ম শতকে বেদীর নীচে আর-একটি সমচতুষ্কোণ ভিতও তৈরি হল। মোগলমারির ৭ম স্তরের বেদীগর্ভ, ৫৩সেমি গভীর। পশ্চিমে বিস্তার ৫.১৫মি, উত্তর-দক্ষিণে ৪.৩৫মি। বেদিটিকে একটি লম্বিত মেধিতে পরিণত করা হল।

মেধির ওপর অন্ডটি স্থাপিত হল। তাকে ঘিরে একটি হমিকা তৈরি হল। হমিকার ওপর ক্রমহ্রাসমান ছত্রসংখ্যা বৃদ্ধি করে, সমগ্রতায় একটি সূচ্যগ্র শিখরের আকৃতি লাভ করল। বৌদ্ধবিহার স্থাপত্যে এটি উদ্দেশক বা নিবেদন স্তূপ।

নিবেদন স্তূপের ভূমিনকশা চতুষ্কোণ। চতুষ্কোণ ভিতের চারদিকে, মোগলমারি বিহারের দক্ষিণ, পশ্চিমে একাধিক কক্ষ তৈরি হয়েছিল। ফলে ভূমিনকশাটি ক্রুশের আকার ধারণ করেছে। স্তূপগর্ভে বৌদ্ধ সূত্রোৎকীর্ণ মাটির শিলমোহর রক্ষিত হত। মোগলমারিতে ব্রতোদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত একটি পদকলিপির পাঠোদ্ধার করা হয়েছে।

বিহার নির্মাণের ক্ষেত্রে বিন্যাসগত একটি কাঠামো ছিল। স্তূপের সম্মুখে ছিল বিস্তৃত একটি অঙ্গন। অঙ্গনকে ঘিরে রাখত কক্ষ শ্রেণি। কেন্দ্রীয় কক্ষটি বৃহত্তম। অঙ্গনের এককোণে স্নান ও আচমন স্থান। অঙ্গন ঘিরে থাকত পরিখা, প্রাচীর।

কালের নিয়মে সব সৌধই ভেঙে পড়ে। ১১শ শতকের আগের কোনো সৌধের অস্তিত্বই বাংলায় টিকে নেই। তা সত্ত্বেও, মোগলমারির বিহারের কর্মকান্ড ১৫ শতকের শেষ অর্ধেও বজায় ছিল। ঢিবি থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি রুপোর মুদ্রা। মুদ্রাটিতে বাহমনীর সুলতান ৩য় মোহম্মদশাহ সামস আলাদিনের মুদ্রাচিহ্ন অঙ্কিত। শাসনকাল ১৪৬৩-১৪৮২ খ্রিস্টাব্দ। মুদ্রাটি মোহম্মদাবাদ টাঁকশাল থেকে ১৪৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল।

ঐতিহাসিক পশ্চাদপট : সমসাময়িক ঐতিহাসিক পশ্চাৎপটে স্থাপন করলে, মোগলমারির সর্বোচ্চ স্তরের বৌদ্ধবিহারের একটি হদিশ মিলতে পারে।

সপ্তম শতকের প্রথম অর্ধে, গৌড়রাজ শশাঙ্ক দন্ডভুক্তি জয় করেন। জয় করেই এই রাজ্যকে স্বশাসনের অন্তর্ভুক্ত করেননি। পূর্বতন রাজশক্তিকে সামন্তরাজ রূপে নিযুক্ত করে, শাসনদায়িত্ব অর্পণ করেন।

উৎকল-বঙ্গের সীমান্তখন্ডে ২টি তাম্রপট লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। একটি, শশাঙ্কের অধীনস্থ ‘মহাপ্রতিহার’, ‘উপরিক’—শুভকীর্তির নিজস্ব লিপি, মেদিনীপুর লিপি। শশাঙ্কের রাজত্বের ৮ম বর্ষে লিপিটি বিজ্ঞাপিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় লিপি, শশাঙ্কের অধীনস্থ ‘সামন্ত মহারাজ’, ‘উপরিক’ সোমদত্ত। ‘উপরিক’ গুপ্তশাসনের শাসনকর্তার পদোপাধি। শশাঙ্কের রাজত্বের ১৯ বর্ষে সুবর্ণরেখার পশ্চিম বনরাজ্য ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলে তাঁর শাসনটি ঘোষিত হয়েছিল। ১৮টি বনরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ‘দন্ডভুক্তি’ রাজ্য। সোমদত্ত এইসব রাজ্যচক্রের মহারাজ শশাঙ্কের অধীন ‘সামন্ত মহারাজ’। দত্তবংশীয়রা খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ-৭ম শতকে ময়ূরভঞ্জ-বালেশ্বর-কটক-দাঁতন অঞ্চলে রাজত্ব করে গেছেন। এঁরা ভৌমকর—স্থানীয় ভূমি—ভূঞ্যা-ভঞ্জ। প্রায় স্বাধীন। প্রথমে বৌদ্ধ, পরে শৈব।

সম্ভবত এই ভৌমকরবংশীয়রা মোগলমারির মহাবিহার নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। উত্তর ভারতীয় স্তূপ-বিহার সংস্কৃতি তখন এই অঞ্চলে সুস্পষ্ট আকার ধারণ করেছিল।

মোগলমারির প্রত্ন ঢিবি—স্তূপবিহার। ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে তার প্রাথমিক সূচনা হয়েছিল। ৭ম-৮ম শতকে তার পূর্ণতা এসেছিল। গ্রামীণ সংস্কৃতির বদ্ধজলা থেকে মুক্তি পেয়ে নগরায়ণের পরিশীলিত জীবনে প্রবেশ করেছিল।

তিন

ঢিবিটির পশ্চিম অংশ খনিত হয়েছিল ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে। উন্মোচিত হয়েছিল একটি বৃহৎ ও বিপুল সৌধের পশ্চিম ও উত্তরভাগ। শেষ পর্যায়ে ঢিবিটির পূর্ব ও দক্ষিণ ভাগ উদঘাটিত হওয়ার ফলে, সৌধের সামগ্রিক রূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আয়তন ৭৫০ বর্গমি। বর্গাকার ভূমিক্ষেত্র।

পূর্ব, উত্তর, দক্ষিণ—তিনদিক ঘিরে গৃহের সারি। ভিক্ষুদের আবাসস্থল। পূজা উপকরণের ভান্ডার অঙ্গনটি গৃহ। বৃহত্তর কক্ষটি পূজাস্থল। সমতল সুবিস্তৃত সভাস্থল, সম্মেলন-কক্ষ। দক্ষিণ-পূর্বে একটি কূপ, স্নান, আচমন কক্ষ। কক্ষশ্রেণির সামনে লম্বমান সুপ্রশস্ত বারান্দা। কেন্দ্রের সিঁড়ি বেয়ে বারান্দা থেকে নামলেই সুপ্রশস্ত অঙ্গন।

সৌধমন্দিরে প্রবেশের প্রধান তোরণ ছিল উত্তরদিকে। সুপ্রশস্ত, সুউচ্চ ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশ করতে হয়। সম্ভবত পশ্চিম, দক্ষিণে ছিল দু-টি খিড়কি দ্বার। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম ছিল প্রাচীরের বহির্গত উদগত অংশ। পূর্বে তোরণের পাশে ছিল মন্দিরের নিয়মবিধি পরিচালনার জন্য হিসাব রক্ষার কক্ষ খাজাঞ্চিখানা।

অঙ্গনের একেবারে কেন্দ্রে ছিল সুউচ্চ, সুবৃহৎ মন্দির। মন্দিরের ভূমিনকশা চতুষ্কোণ। তিনদিকে (পূর্ব, উত্তর, দক্ষিণ) গর্ভগৃহের দেওয়ালগুলি সম্মুখের দিকে বর্ধিত করে, ত্রি-রথের আকৃতি দেওয়া হয়েছিল। তাই কেন্দ্রীয় মন্দিরটি ছিল ত্রি-রথ দেউল। মন্দিরের বহির্গাত্রে সংস্থাপিত ছিল স্লেট পাথরে গড়া বুদ্ধজীবনের নানা ফ্রেসকো রূপ। খননের ফলে অঙ্গনের একপাশে ভগ্ন অবস্থায় পড়ে ছিল ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় খোদিত বুদ্ধায়নের একটি ফ্রেসকো রূপ। মহাযান-বজ্রযান তন্ত্রের বৌদ্ধ প্রতিমা। প্রতিমার কেন্দ্রে আছেন শাক্যসিংহ গৌতম বুদ্ধ। বজ্রাসনে দক্ষিণহস্ত ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট। বামহস্ত বরাভয়। পার্শ্বে সাক্ষীরূপে পৃথিবীমাতাকে আহ্বান। দক্ষিণহস্ত ভূমি স্পর্শ করে, বুদ্ধের ঊর্ধ্বায়ন, বোধিলাভের দ্যোতক। মূর্তিটির কন্ঠে জানু পর্যন্ত লম্বিত বৈজয়ন্তী বা বনমালা। সর্বালংকার ভূষিত। শিরোদেশে রত্নখচিত উষ্ণীষ। মূর্তি-বিশেষজ্ঞদের মতে ৮ম-৯ম শতকের এটি পাল যুগের মূর্তি।

ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধ : নালন্দা মহাবিহারে ধ্যানাসনোপবিষ্ট, ভূমিস্পর্শমুদ্রা লাঞ্ছিত অনুরূপ একটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপিত আছে।

সামগ্রিক বিচারে মোগলমারির প্রত্নখনিত ঢিবি একটি বৌদ্ধস্তূপ বিহার। স্তূপ বেদী, প্রত্ন সৌধের ভূমিনকশা, বুদ্ধ প্রতিমা—এইসব তথ্যে সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। নিবেদিত অর্ঘ্যস্তূপে প্রাপ্ত ফলক লিপির ভাষা—প্রাকৃত মিশ্র সংস্কৃত, ব্রাহ্মীলিপি, সিদ্ধমাতৃকা লিপির ছাঁচ, অন্ত্য-গুপ্ত যুগ (শশাঙ্ক, ৭ম শতক) বা পাল শাসনের আদিপর্ব (৮ম শতক) এই বিহারটির সমৃদ্ধির কাল। ৭ম শতকের পরিব্রাজক সুয়ান জাং-এর (হিউয়েন সাঙ) বিবরণে তাম্রলিপ্ত ও তার সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি বৌদ্ধবিহারের কথা বললেও, সেগুলির অবস্থান ও নাম অভিধার কথা উল্লেখ করেননি। প্রখ্যাত গবেষক দেবল মিত্র তাঁর বিখ্যাত Buddhist Monuments গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— ‘It is a great regret that the vestiges of not a single establishment have so far been identified at modern Tamluk.’ এই বক্তব্যের সাপেক্ষে মোগলমারির প্রত্নখনক অধ্যাপকমন্ডলী অশোককুমার দত্ত ও তাঁর সহযোগীবৃন্দের একটি বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছে—

 It is in this context that the present discovery of monastic complex at Moghalmari is a significant landmark in the history of Bengal in the sense that at least one such Buddhist establishment as referred by Huen Tsang has come to light in this region and this discovery will definitely rich the history of Bengal in the near future.

(Excavation at Moghalmari Dantan, district – West Midnapur, 2006-2007. A Preliminary Report, The Department of Archaeology, University of Calcutta. P 3)

৬ষ্ঠ থেকে ১১শ শতকের গৌড়-রাঢ় এবং সংলগ্ন উৎকল সীমান্তে সমৃদ্ধ দন্ডভুক্তি রাজ্য। কান্যকুব্জ থেকে কর্ণাটক-তামিলনাড়ু পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একটি দন্ডপথ সমুদ্র উপকূল ধরে এই রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত হয়েছে। বণিক-ব্যাপারী-শ্রেষ্ঠী-চেট্টীর দল তাঁদের বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে এই পথেই যাতায়াত করতেন। তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে একটি শাখাপথ দন্ডভুক্তিতে এসে মিলিত হয়েছে। সন্ন্যাসী-যতি-শ্রমণ-ভিক্ষুর দল পথপার্শ্বের বিহার-সংঘারামে আশ্রয় গ্রহণ করতেন। পূজা-অর্চনা সমাধা করতেন। প্রসারণশীল আর্যাবর্ত ও দক্ষিণাপথের রাজশক্তিও এই পথদন্ড ধরেই তাঁদের সামরিক অভিযান চালনা করতেন। সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী, ভূস্বামী ও বণিককুলের দাক্ষিণ্যে, বিত্ত-সম্পদদানে ৬ষ্ঠ-৭ম শতকে এই সুরম্য ও বৃহদাকার স্তূপবিহারটি গড়ে উঠেছিল। ৯ম-১০ম শতকের পালশাসনেও ধর্ম ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্ররূপে তার প্রসিদ্ধি অক্ষুণ্ণ ছিল।

চার

স্থাপত্য, ভাস্কর্য—নগরশিল্প। নরপতি, ধনপতির অর্থানুকূল্যে হর্ম্য-হম্যিকাবহুল পুরনগরী গড়ে ওঠে। রাজৈশ্বর্যে দেবগৃহ মন্দির নির্মিত হয়। নভোস্পর্শী শিখর নির্মাণে, আয়তনের বিপুলতায়, ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে তা ময়দানবীয় স্থাপত্য কীর্তি। ভাস্কর্য—দেবমূর্তি নির্মাণ, শিল্পীর ধ্যানলব্ধ রূপমূর্তির তক্ষণ—দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার বিস্মিত মনের রূপকর্ম। রাজার ধন সেখানে নতজানু হয়, ভক্তজন কালে কালে শ্রদ্ধা-ভক্তির ধূপ-দীপ জ্বালে।

ভারতীয় ঐতিহ্যে মূর্তিশিল্প—দেবশিল্প। চিন্তনে-মননে, ধ্যানে-অনুধ্যানে, রূপে-অরূপে, সৌন্দর্যে-লাবণ্যে দেবতার প্রতীকী রূপের প্রকাশ। স্থানক রূপে, ভঙ্গ-বিভঙ্গে, উপবেশন ভঙ্গিতে, পদ্মাসনে, সুখাসনে, অঙ্গুলিমুদ্রায়, বাহক-বাহন লাঞ্ছনে, আয়ুধ ধারণে, দ্বিভুজা থেকে বহুভুজায়, অঙ্গবর্ণে, উষ্ণীষ ধারণে—বহু সহস্রাব্দ ধরে বহু তাপসের ধ্যানরূপকে রূপদক্ষ ভাস্করের দল মাটিতে, পাথরে, ধাতুতে গড়ে চলেছেন। বহুকালের বহু ভাবনা, বহুকালের বহু নির্মিতির স্বাক্ষর খোদিত রয়েছে এইসব দেবশিল্পে। তার চলমান পদচিহ্নে লুপ্ত ইতিহাস প্রাণবন্ত রয়েছে, শিল্পবিকাশের শতদল ফুটেছে, চিন্তন-দর্শনের ধারাবাহিক পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে।

বর্তমান প্রবন্ধ কেবলমাত্র আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার আগ্রহে রচিত নয়। ক্ষুদ্র একটি অঞ্চলের কয়েকটি ভাস্কর্যমূর্তিকে আশ্রয় করে—বিশেষ এক ঐতিহাসিক কালের, একটি বিশেষ অঞ্চলের ধর্মভাবনা, শিল্পকর্ম এবং পূর্বভারতের বৃহত্তর সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে তার সংযোগ খুঁজে পাওয়া প্রাবন্ধিকের উদ্দেশ্য। স্পষ্টত, দাঁতন অঞ্চলে প্রাপ্ত বৌদ্ধ দেবমন্ডলী, তাঁদের শাখাগত কুল পরিচয়, মূর্তি নির্মাণকর্ম এবং পূর্ব ভারতের রাষ্ট্রিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের পটভূমিকায় স্থাপন করা তাঁর লক্ষ্য।

কাকরাজিত-এর প্রস্তর ফলক, ত্রিরত্ন, ধর্মচক্র দাঁতনের উত্তর-পূর্বে ৩কিমি দূরে কাকরাজিত গ্রাম। কাকরাজিতের ২কিমি পশ্চিমে মোগলমারির প্রত্নস্তূপ। গ্রামের মধ্যস্থলে বর্গাকার প্রশস্ত উচ্চভূমি তার উত্তরে বিশাল কুন্ডপুকুর, রানাপুকুর, রাজগেড়িয়া। গ্রামের এক অধিবাসী কুন্ডের পাঁক থেকে উদ্ধার করেছেন দু-টি বৃহদাকার মাকড়া পাথরের প্রস্তরফলক। পড়ে আছে আকাশের তলায়, অশ্বত্থ গাছের নীচে।

একটির আয়তন (ত্রিরত্ন) লম্বায় ৯৬সেমি, চওড়ায় ৮৬সেমি। মধ্যে ৩টি ফলক কেটে তোলা হয়েছে। কর্তিত মধ্যবর্তী ফলক ৩৯সেমি, দক্ষিণে ও বামের ফলক একই আয়তনের ৩১সেমি লম্বা। এক শিলা, পাদভূমি বেদী।

দ্বিতীয়টি ভগ্ন, একটি বৃহৎ চক্রের অর্ধাংশ। অবশিষ্ট অংশটির সন্ধান মেলেনি। প্রাপ্ত অর্ধবৃত্তাকার চক্রের পরিধি ১৪১সেমি × ১৪১সেমি। মধ্যবর্তী ভূমিতে একটি মেধিচক্র। খোদিত অরদন্ডের আভাস।

অনুরূপ একটি ক্ষুদ্রাকার ত্রিরত্নের সন্ধান মিলেছে দাঁতনের উত্তর রায়বাড় মৌজার নর্মদেশ্বর শিবমন্দির প্রাঙ্গণে। লম্বায় ২০সেমি চওড়ায় ১৮সেমি। মাকড়া পাথরে তৈরি।

অন্য একটি ধর্মচক্র রয়েছে দাঁতন হাইস্কুলের নিকটবর্তী চন্দনেশ্বর শিবমন্দিরের বারান্দায়। বেলেপাথরে তৈরি, ১৮সেমি পরিমিত।

ত্রিরত্ন, ধর্মচক্র, বৌদ্ধস্তূপ বিহারের শীর্ষে শোভিত হত। বৌদ্ধধর্মীয় শিল্প-ভাবনায় আদিস্তর মৌর্য শিল্পস্তর (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০-১৫০)। অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল স্তূপ পূজা। সারনাথ, সাঁচি, বরহূতে নির্মিত হয়েছিল অন্ডাকার স্তূপ। বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ ও বুদ্ধপ্রতিমা পূজা তখনও প্রচলিত হয়নি। তক্ষশিলার তক্ষণ শিল্পীরা গড়ে তুলেছেন বুদ্ধ প্রতীকী ‘ত্রিরত্ন’ (বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ), ধর্মচক্র, বুদ্ধবৃক্ষ, পদচিহ্ন, শূন্য সিংহাসন, পাদুকা, শিরোভূষণ। সারনাথে নির্মিত হয়েছিল বুদ্ধ প্রতীকী একশিলার সিংহ, বুদ্ধ দ্রুম, বুদ্ধ ধর্মচক্র। ধৌলীতে নির্মিত হয়েছিল হস্তীমূর্তি। উড়িষ্যার উদয়গিরির রানি গুম্ফার (খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬) খিলানের উপরে আছে অর্ধখোদিত নাগমূর্তি, মকরমূর্তি, গজলক্ষ্মী এবং ত্রিরত্ন। বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ মন্ত্রের প্রতীক, ত্রিশূলাকার ফলক—ত্রিশরণ। মধ্যে বুদ্ধ, দক্ষিণে ধর্ম এবং বামে সংঘ ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি এই মন্ত্রের প্রতীক।

খ্রিস্টীয় ২য় শতকে কণিষ্কের শাসনে ৪র্থ বৌদ্ধ মহাসম্মেলনে, বৌদ্ধধর্ম হীনযান ও মহাযান —এই দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানীরা বুদ্ধমূর্তি পূজা গ্রহণ করেননি। স্তূপে বৌদ্ধ প্রতীকই ব্যবহার করতেন। মহাযানীরা এই সময় গ্রিক ও ভারতীয় শিল্পের মিশ্রণে গান্ধার রীতির মূর্তি গড়ে তোলেন। অনুমান করা যায়, আরও কিছুকাল ধরে হীনযান পন্থীরা (এবং মহাযান পন্থীরা) বৌদ্ধ প্রতীক ব্যবহার করেছিলেন। গুপ্ত শাসনেও হীনযানপন্থীরা সাম্রাজ্যের উপান্তিক অঞ্চলে সক্রিয় ছিলেন। ৪র্থ-৫ম শতকে হীনযানীরা ভারতবর্ষে লুপ্ত হয়ে যান।

দাঁতনের কাকরাজিতের বৌদ্ধ প্রতীক ‘ত্রিরত্ন ও ধর্মচক্র’ খ্রিস্টীয় ৪র্থ-৫ম শতকের বা পূর্ববর্তী কালের সৃষ্টি। গুপ্তান্তিক বৌদ্ধ শিল্পের নিদর্শন।

অন্য একটি বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। কাকরাজিতের ত্রিরত্ন ও ধর্মচক্র গুপ্ত বা পাল যুগের কৃষ্ণশিলায় গড়া নয়। গড়া হয়েছে স্থানীয় সুলভ পাথরের ল্যাটারাইট শিলা এবং স্থানীয় শিল্পীর স্থূল ও অদক্ষ হাতে। কৃষ্ণশিলা সিংভূম, মানভূম, ওড্রভূমি দক্ষিণ রাঢ়ের প্রকৃতির দান নয়। স্থানীয় শিল্পীর স্থানীয় উপাদানে তৈরি।

কাকরাজিতের অনির্ণীত বৌদ্ধ দেবমন্ডলী : কাকরাজিত প্রত্নক্ষেত্র। ১১শ শতকে পাল সামন্ত জয়সিংহ, উৎকলরাজ কর্ণকেশরীকে এখানেই প্রবল যুদ্ধে নিহত করেন।

প্রাগুক্ত কুন্ডপুকুর ভাস্কর্য মূর্তির আকর। পঙ্কোদ্ধার করতে গিয়ে প্রচুর ভাস্কর্য মূর্তি উত্তোলিত হয়েছে। অথচ গ্রাম জুড়ে কোথাও পুরোনো ঢিবি বা পুরোনো ইটের সন্ধান মেলেনি। সম্ভবত মোগলমারির পাঠান যুদ্ধের কালে, সেখানকার দেবমূর্তিগুলি কাকরাজিতের কুন্ডপুকুরে নিমজ্জিত হয়েছিল।

প্রাপ্ত ভাস্কর্য মূর্তিগুলির মধ্যে আকর্ষণীয় একই রূপের একই আকারে ৪টি প্রতিমা। উপবিষ্ট পুরুষমূর্তি। পুতুলাকার, হস্ত-পদ আবৃত। অলংকৃত বসনে দেহের ঊর্ধ্বভাগ আবৃত। ধ্যানসমাহিত নিমীলিত চক্ষু। প্রশস্ত বক্ষ, ক্ষীণ কটি। সম্ভবত মুন্ডিত মস্তক, শিরোভূষণ নেই। শিরচক্র জ্যোর্তিমন্ডলী নেই। মুখাবয়বে গাম্ভীর্য। পশ্চাৎপট নেই। পার্শ্বদেশে পার্শ্বদেবতা নেই। একক মূর্তিগুলি মন্দিরের দেহ গাত্রে সজ্জিত হত।

মূর্তিগুলি মাকড়া পাথরের। গোলাকার পাদপীঠসহ মূর্তিগুলি লম্বায় ৬৫সেমি। বক্ষভাগের প্রস্থ ৬৩সেমি।

বিশেষজ্ঞের তীক্ষ্ণদৃষ্টি ছাড়া প্রতিমাগুলিকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। সম্ভবত মহাযানী সম্প্রদায়ভুক্ত বজ্রযানী সাধকমন্ডলী। পাল শাসনে বজ্রযানী কৌলমার্গীরা সিদ্ধাচার্য গুরুকুলের পূজা করতেন।

উত্তর রায়বাড়ের সিদ্ধ গুরুর ভাস্কর্যমূর্তি : দাঁতনে ২টি কৃষ্ণ শিলামূর্তি পাওয়া গেছে। ক. উত্তর রায়বাড়ের মূর্তি, খ. দাঁতনের লাইব্রেরীর প্রত্নশালায় রক্ষিত মূর্তি। সবগুলিই কৃষ্ণশিলার।

উত্তর রায়বাড়ের মূর্তিটি বৃহদাকার। জানুর নিম্নভাগ ও দু-টি বাহু ভাঙা। পাদপীঠ ও মূর্তি একই শিলায় গঠিত। পাদপীঠে ভগ্ন পদতল অক্ষত।

মস্তক থেকে জানু পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১৫১সেমি বুকের বেড় ১১৭সেমি। সুঠাম বলিষ্ঠ দেহ, বৃষস্কন্ধ। মাথায় জটাবদ্ধ কুন্ডলীকৃত উষ্ণীষ। মুখমন্ডলে শ্মশ্রু-গুম্ফের প্রাচুর্য। কৌপীন পরিহিত, কর্ণে কুন্ডল, গলায় কবচ, বাজুবন্ধে বলয়, কটি-লম্বিত ত্রিসূত্রক উপবীত। পাদপীঠে দুই ক্ষুদ্রাকার পার্শ্বমূর্তি—উপাসক। পৃষ্ঠপট নেই, মাথায় উষ্ণীষ নেই, চালচক্র জ্যোতির্মন্ডলী নেই। পদতলে বজ্র। দেহ পৃথলু, উদর স্ফীত। বাদনভঙ্গিতে বামে হেলে পড়ার ভঙ্গি। মুখমন্ডলে সংগীত উপভোগের মাধুর্য।

প্রত্নশালার মূর্তিটি একই অবয়বের, ক্ষুদ্রাকার। আয়তন ৫৪.৫সেমি × ২৬.৫সেমি। দুই করাঙ্গুলি দিয়ে বীণাবাদনরত। ক্ষুদ্র ভাস্কর্যমূর্তি গুপ্ত ও পাল যুগের শিল্পাদর্শ। কৃষ্ণশিলাও এই যুগের আদর্শ। শুঙ্গ-কুষাণ শাসনে মূর্তি বৃহৎ অবয়বের। সেই ধারা ফিরে এল সেন শাসনে।

শিলাপটে খোদাই মূর্তি গুপ্ত যুগের। গর্ভগৃহে পূজার উদ্দেশ্যে স্থাপিত হত। পাল শাসনের শেষ পর্বে মূর্তি ত্রিমাত্রিক। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, পৃষ্ঠ কর্তিত সম্পূর্ণ স্থানক মূর্তি।

দাঁতন অঞ্চলের বৌদ্ধ শিল্পাদর্শের সূচনা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব কোনো এক শতকে, তার সমাপ্তি দ্বাদশ শতকে সেন পর্বে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *