মোগলমারির আবিষ্কৃত বৌদ্ধমহাবিহার : প্রত্নকথা
উৎখননের ইতিবৃত্ত ও সংবাদ শিরোনামে মোগলমারি
ইতিহাস ও পর্যটন
বৌদ্ধ প্রভাব

মোগলমারি উৎখনন : একটি প্রতিবেদন

মোগলমারি উৎখনন : একটি প্রতিবেদন – ড. অশোক দত্ত, ড. রজত সান্যাল

সখিসোনার ঢিবি : আবিষ্কারের গোড়ার কথা

আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন বঙ্গে নদী-বাণিজ্য সংক্রান্ত পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের খোঁজে সুবর্ণরেখার গতিপথ ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের সময় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন শহরে এসে এই প্রতিবেদনের প্রথম লেখকের সাথে পরিচয় হয় দাঁতন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও দাঁতন হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষাব্রতী-ইতিহাসপ্রেমী শ্রদ্ধেয় নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস মহাশয়ের। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনার সূত্রে শ্রীবিশ্বাস জানান যে, দাঁতন শহরের ৫কিমি উত্তরে মোগলমারি (২১০৫৭ উত্তর অক্ষাংশ/৮৭০১৬ পূর্বদ্রাঘিমাংশ) নামে একটি ছোট্ট গ্রাম আছে এবং সেই গ্রামে ‘সখিসেনার ঢিবি’/‘সখিসোনার ঢিবি’ নামে একটি প্রাচীন ইটের ঢিবি রয়েছে। শ্রীবিশ্বাসের সাথে মোগলমারি গ্রামে এসে দেখা গেল সেই সুবিশাল ঢিবি, যেটি গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এবং বর্তমানে ‘মোঘলমারী তরুণ সেবা সঙ্ঘ ও পাঠাগার’-এর নিয়ন্ত্রণাধীন। মূলত ঢিবিটি প্রায় ৫০০০ বর্গমিটার ব্যাপী বিস্তৃত একটি ইটের স্তূপ। জনশ্রুতি, উড়িষ্যার মধ্যযুগীয় রাজা বিক্রম কেশরীর বিদুষী কন্যা সখিসোনা (মতান্তরে সখিসোনা) এই ঢিবির উপর একটি পাঠশালা স্থাপন করেন এবং এখানেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় অহিমানিক নামক জনৈক সেনাধ্যক্ষের পুত্রের। সখিসোনা-অহিমানিকের ব্যর্থ প্রণয়ের সাক্ষী নাকি এই ঢিবি। খালি চোখে দেখেই বোঝা গেল যে, এই ঢিবির তলায় লুকিয়ে আছে কোনো এক প্রাচীন কাঠামোর নিদর্শন। এই কারণেই এই জাতীয় ঢিবিকে পুরাতত্ত্বের পরিভাষায় বলা হয় ‘কাঠামোগত/সাংস্থানিক ঢিবি’ (প্রত্নতত্ত্বের পরিভাষায় Structural mound)। ঢিবির উপর ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ইটগুলির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বেধ দেখেই অনুমান করা যায় যে, মাটির নীচের কাঠামোটি প্রাক-ইসলামীয় যুগের।

এরপর শুরু হয় গ্রাম জুড়ে প্রত্নসমীক্ষার কাজ। ঘুরে দেখে বোঝা গেল যে, শুধু গ্রামে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ ঢিবিটিই নয়, প্রায় সমগ্র গ্রামটিই দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্রের (পরিভাষায় archaeological site) উপর। গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মাটির নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে ইটের কাঠামোর নিদর্শন। এইগুলির মধ্যে, গ্রামের কেন্দ্রে কালিপদ মিশ্র মহাশয়ের বাস্তুজমি সামনে রাস্তার উপর মাথা তুলে থাকা তিনটি গোলাকার স্তূপ-এর আকৃতির কাঠামো দেখেই প্রথম সন্দেহ হয় যে, এই গ্রামের মাটির নীচে হয়তো বা লুকিয়ে আছে কোনো এক সুপ্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্য ও জনপদের নিদর্শন। বৌদ্ধ নিদর্শন সংক্রান্ত ধারণা আরও সুদৃঢ় হল গ্রামের অপর এক বাসিন্দা স্থানীয় স্কুলশিক্ষিকা শ্রীমতী প্রণতি জানার বাড়িতে এসে। শ্রীমতী জানার কাছে সযত্নে রক্ষিত আছে তাঁর পিতা কতৃক সখিসোনার ঢিবির উপর থেকে সংগৃহীত এমন কিছু পুরাবস্তু, যেগুলি মোগলমারির প্রাচীন ইতিহাসের উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করছে। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল পোড়ামাটির তৈরি একটি গোলাকার উৎসর্গ ফলক (পরিভাষায় Votive tablet) যেটির উপর খোদিত ছিল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের ব্রাহ্মী লিপিতে এবং মিশ্র সংস্কৃত-প্রাকৃত ভাষায় লেখা অভিলেখে (পরিভাষায় epigraph) বৌদ্ধধর্মের অতি পরিচিত এক বাণী। এছাড়াও ছিল ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট মুন্ডহীন বুদ্ধ মূর্তি, যেটির পিছনেও আনুমানিক খ্রিস্টীয় নবম শতকের সিদ্ধমাতৃকা নামক লিপিতে খোদিত একটি লেখ-এর জীর্ণ অবশিষ্টাংশ।

উপরে বর্ণিত পুরানিদর্শনগুলির সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করেই ২০০৩-০৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অর্থানুকূল্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ প্রথম মোগলমারির এই ঢিবিতে উৎখনন শুরু করে। পরবর্তীকালে দাঁতন ১নং পঞ্চায়েত সমিতি ও দাঁতন ভট্টর কলেজের পক্ষ থেকে পাওয়া আংশিক আর্থিক সাহায্য খননের কাজকে সহজ ও গতিময় করে। প্রসঙ্গত, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে বিংশ শতকের ষাট-এর দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রশাসনিক দলিল-প্রতিবেদন থেকে শুরু করে নগেন্দ্রনাথ বসু ও পরবর্তীকালে তারাপদ সাঁতরা প্রমুখের ন্যায় পেশাদার ঐতিহাসিক-পুরাতাত্ত্বিকদের লেখায় এবং সাম্প্রতিকতম সরকারি জনগণনা-প্রতিবেদনে মোগলমারির এই ঢিবির কথা আঞ্চলিক ইতিহাসের সাক্ষ্যরূপে উল্লিখিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানটিকে উড়িষ্যার মধ্যযুগীয় ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত করে এর পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব নিরূপণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিপূর্বে কখনো এই অঞ্চলের আদি ঐতিহাসিক ও আদি মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক সাক্ষ্য ও অঞ্চলটির ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে মোগলমারির পুরানিদর্শনগুলিকে ব্যাখ্যা করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি।

মোগলমারি তথা দাঁতন : ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার বর্তমান মেদিনীপুর ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল সংক্রান্ত প্রাচীনতম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় আচারাঙ্গসুত্ত নামক প্রাচীন জৈন গ্রন্থে, যেখানে এই অঞ্চলটিকে সুহ্ম জনপদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সমসাময়িক এবং অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালীন কিছু সাহিত্যিক সাক্ষ্যে আবার বাংলার এই অংশ ‘রাঢ়’ অথবা ‘দক্ষিণ রাঢ়’-এর অন্তর্ভুক্ত। আনুমানিক খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে কালিদাস বিরচিত রঘুবংশ কাব্যগ্রন্থে আবার ‘বঙ্গ’ অঞ্চলকে সুহ্মের দক্ষিণে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং সেই সূত্রে গঙ্গার পশ্চিমে প্রবহমান ‘কপিশা’ (আধুনিক কাসাই/কাঁসাই) নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত ‘উৎকলদেশ’ সংলগ্ন ‘কলিঙ্গ’ রাজ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে রচিত দশকুমারচরিত গ্রন্থে ‘দামলিপ্ত’ (অর্থাৎ তাম্রলিপ্ত) নামক নগরীকে সুহ্ম দেশের রাজধানীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

দক্ষিণ বাংলার এই অঞ্চলের প্রশাসনিক গুরুত্ব সংক্রান্ত প্রাচীনতম পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে শশাঙ্কের সমকালীন। মেদিনীপুর জেলার এগরা ও মোহনপুর থানার দু-টি গ্রাম থেকে আবিষ্কৃত শশাঙ্কের রাজত্বকালীন তিনখানি তাম্রশাসনে ‘উৎকলদেশ-সম্বন্ধ’ যে প্রদেশের নাম উল্লিখিত হয়েছে সেটি হল দন্ডভুক্তি বা ‘দন্ড’ নামক প্রদেশ। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, আধুনিক ‘দাঁতন’ নামটি দন্ডভুক্তি শব্দের অপভ্রংশ (যদিও কোনো কোনো অভিলেখবিদ ভাষাতত্ত্বের বিচারে এই মত খন্ডন করারও চেষ্টা করেছেন)। এই দন্ডভুক্তির নাম আবার অভিলেখ সাহিত্যে স্থান পায় আনুমানিক খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে উড়িষ্যার কম্বোজবংশীয় রাজা নয়পালের ইর্দা ও কালান্দা (বালেশ্বর জেলা) থেকে পাওয়া দু-টি তাম্রশাসনে, যেখানে ‘দন্ডভুক্তি মন্ডল’ নামক প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন অবশ্য এই প্রশাসনিক বিভাগ অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও ‘বর্দ্ধমান ভুক্তি’ নামক প্রদেশের অন্তর্গত হয়েছিল। সাম্প্রতিকতমকালে বেলদা থানার অন্তর্গত সাবড়া নামক গ্রাম থেকে উড়িষ্যার পরাক্রমশালী গজপতি রাজা কপিলেশ্বরদেবের রাজত্বকালীন ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দের একখানি লেখ সম্বলিত তাম্রপট্ট আবিষ্কারের ফলে বোঝা যায় যে, এই অঞ্চল মধ্যযুগে উড়িষ্যার রাজনৈতিক অধিকারভুক্ত হয়েছিল।

এ তো গেল ঐতিহাসিক পটভূমির কথা। ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট থেকেও দাঁতন ও সন্নিহিত অঞ্চলের গুরুত্ব ও প্রাচীনত্ব বিলক্ষণ বিশেষত্বের দাবি রাখে। সাম্প্রতিক ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে জানা গেছে যে, দাঁতন অঞ্চলের ভূস্তরসমূহ মূলত সমকালীন (পরিভাষায় Holocene) ও প্রাক-সমকালীন (পরিভাষায় Pleistocene) ভূতাত্ত্বিক যুগের পলিবিধৌত অঞ্চলের সম্প্রসারণের ফলে গঠিত হয়েছে। তাই ভূতত্ত্বের পরিভাষায় অঞ্চলটিকে ‘সিজুয়া’ ভূস্তরীয় গঠনের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এই প্রাচীন ভূস্তরে লোহাযুক্ত শক্ত বাদামিমাটি ও বালির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এই জাতীয় নদীবিধৌত ভূস্তরীয় গঠন বৃহত্তর অর্থে ‘আদি পলিবিধৌত গঠন’ (পরিভাষায় Alluvial formation) নামেও পরিচিত।

আদি ঐতিহাসিক ভূগোলের রূপরেখায় তাম্রলিপ্ত অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক পথের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল মেদিনীপুরের এই অঞ্চল। উড়িষ্যা সন্নিহিত হওয়ায় একদিকে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল সুবর্ণরেখার অক্ষ ধরে উত্তর ও পশ্চিম উড়িষ্যার সাথে। অন্যদিকে, এই অঞ্চল স্থলপথে নিম্ন ও মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। সুতরাং মোগলমারির পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্য কোনো বিক্ষিপ্ত বা বিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে না। সার্বিকভাবে পূর্ব ভারতের আদি মধ্যযুগীয় বৌদ্ধধর্মীয় সংগঠন ও সংস্কৃতির অঙ্গরূপেই মোগলমারির বৌদ্ধ সংগঠনের বিকাশ ঘটেছিল।

মোগলমারির উৎখনন : বৌদ্ধবিহার ও অপরাপর পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন

আগেই বলা হয়েছে যে, শুধুমাত্র সখিসোনার ঢিবিই নয়, সমগ্র মোগলমারি গ্রামটিই একটি অবিচ্ছিন্ন প্রত্নক্ষেত্রের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই কারণে গ্রামটির মধ্যে উৎখননযোগ্য এলাকাগুলি বেছে নিয়ে প্রথমে ২০০৩-০৪ খ্রিস্টাব্দে দু-টি উৎখনন অঞ্চলকে শনাক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে ২০০৭-০৮ খ্রিস্টাব্দে আরও একটিঅঞ্চল নির্বাচন করা হয়। পুরাতত্ত্ব চর্চার সর্বভারতীয় সুপারিশ অনুযায়ী এই উৎখনন স্থলগুলির নাম দেওয়া হয় এমজিএম ১, এমজিএম ২ ও এমজিএম ৩, যেখানে ‘এমজিএম’ মোগলমারির সংক্ষিপ্ত নাম। প্রথম বছরে এমজিএম ১ ও এমজিএম ২ অর্থাৎ যথাক্রমে সখিসোনার ঢিবি ও কালিপদ মিশ্র মহাশয়ের বাড়ির সামনের অংশে খনন শুরু করা হয়। মূলত যে উদ্দেশ্যগুলি নিয়ে মোগলমারিতে খননকার্য চালানো হয়, সেগুলি হল :

 ক. এমজিএম ১-এর অর্থাৎ ঢিবির মধ্যে নিহিত ইটের কাঠামো উন্মোচন এবং ওই কাঠামোর চরিত্র উদঘাটন।

 খ. মোগলমারির পুরাতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষগুলিকে আদি মধ্যযুগীয় দন্ডভুক্তি নামক প্রশাসনিক অঞ্চলের ঐতিহাসিক উপাদানগুলির সাথে শনাক্ত করা এবং

 গ. প্রত্নক্ষেত্রটির সাংস্কৃতিক অনুক্রম (পরিভাষায় systematic succession) নির্ধারণ ও এর বিভিন্ন অংশের উপাদানগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে মোগলমারির প্রাচীন জনবসতির স্বরূপ অনুধাবন করা।

প্রথম বছরে ঢিবির উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে ৬মি : ৬মি মাপের মোট ১৯টি খাত (পরিভাষায় ditch) কেটে প্রায় ৫০৪ বর্গমি এলাকা খননের ফলে বেরিয়ে এল বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ইটের কাঠামো। প্রসঙ্গত, এইভাবে বড়ো এলাকায় খাত কেটে বিস্তৃত ক্ষণনকে ‘অনুভূমি ক্ষণন’ (পরিভাষায় horizontal excavation) বলা হয় এবং এই জাতীয় খননে খাতগুলিকে ইংরাজি বর্ণমালার বিভিন্ন বর্ণের মাধ্যমে নামাঙ্কিত করা হয়। পশ্চিম-উত্তরের পশ্চিমদিকে প্রাপ্ত কাঠামোগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক ছিল মাটি থেকে ১১৩সেমি উচ্চতাবিশিষ্ট তিনটি উদগত প্রক্ষেপযুক্ত (পরিভাষায় projection/recess) একটি প্রশস্ত দেওয়াল। প্রাচীন ভারতীয় শিল্পশাস্ত্রে এই জাতীয় গঠনকেই ত্রিরথ কাঠামো বলা হয়েছে। এই ত্রিরথ কাঠামোর ঠিক কেন্দ্রে একটি আয়তক্ষেত্রাকার বেদী পাওয়া যায়। সাধারণত দেওয়ালটির তিনটি প্রক্ষেপণেরই বাইরের দিকগুলি ছিল সুন্দরভাবে বানানো চৌকোণা ইটে তৈরি। কিন্তু দেওয়ালের যে অংশটি সাধারণের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকে সেই ভিতরের অংশগুলির ইট কিঞ্চিৎ অবিন্যস্তভাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের গঠনবিন্যাসের কারণ সহজেই অনুমেয়। কাঠামোগুলির যে অংশ বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হয় সেই অংশগুলিকেই ভালো ইটে গেঁথে কাঠামোটিকে দৃষ্টিনন্দন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভিতরের অংশগুলির ক্ষেত্রে সেপ্রয়োজন ছিল না। এখানে উল্লেখ্য যে, ঢিবির প্রতিটি অংশেই কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে এই কৌশলই অনুসরণ করা হয়েছিল। ত্রিরথ কাঠামোর অনেক নীচের স্তরে আরও একটি অসমঞ্জস ইটের দেওয়ালের ভিতরের অংশ উন্মোচিত হয়েছিল, কিন্তু এর সঠিক চরিত্র এখনই জানা সম্ভব নয়, কারণ এটিকে সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত করতে গেলে উপরের অংশের কাঠামোগুলিকে ভেঙে ফেলতে হয়, যা পুরাতত্ত্বের মূলগত নীতির বিরোধী। ঢিবির দক্ষিণাংশে খননের ফলে বাইরের দিকে একটি ২.৭৫মি চওড়া দেওয়াল পাওয়া যায় এবং এই দেওয়ালের ভিতরের অংশে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত চারখানি ছোটো বর্গক্ষেত্রাকার বা আয়তক্ষেত্রাকার ঘর আবিষ্কৃত হয়। এই ঘরগুলির মাপ ৩.২০মি ও ২.৮০মি থেকে ২.৩৫মি ও ১.৪৫মি-এর মধ্যে। সাধারণত এই জাতীয় ছোটো ছোটো ঘর বৌদ্ধ বিহারের মধ্যে সন্ন্যাসীদের বসবাস ও পূজার্চনার জন্য নির্মিত হত।

অন্যদিকে এমজিএম ২ নামক ক্ষেত্রটিতে খননের ফলে মোগলমারির অপর কিছু বৌদ্ধ নিদর্শন ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার পুরাতত্ত্বে আরও একটি নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়। মূলত এই ক্ষেত্রটিতে খননের উদ্দেশ্য ছিল স্তূপের মতো কাঠামোগুলিকে উন্মোচিত করা। খননের ফলে দেখা গেল, এখানে পাওয়া তিনটি গোলাকার কাঠামো আসলে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মাপের বৌদ্ধ স্তূপ। তিনটির পরিধি ২.৮০মি, ২মি এবং ১.২৫মি। এরা একটি ইটের তৈরি একটি বড়ো বেদীর উপর অবস্থিত এবং ছোটো দু-টি স্তূপ একটি ইট বিছানো সরু সংযোগ রেখা দ্বারা সংযুক্ত। এখানে বলা প্রয়োজন যে, এই তিনটি ছাড়াও অনতিদূরে আরও দু-টি এই ধরনের স্তূপ আছে, যাদের চিহ্ন মাটির উপর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়। এদের একটি গোল ও একটি বর্গাকার।

এমজিএম ২-এর স্তূপগুলির সামনের অংশের খাতটিতে গভীর খননের ফলে বাংলার এই অংশের প্রাচীন জনবসতি সম্পর্কিত এক নতুন তথ্যভান্ডার আবিষ্কৃত হয়। স্তূপ বহনকারী মৃত্তিকাস্তরের বহু নীচে খননের ফলে এক বিশেষ শ্রেণির মৃৎপাত্র উঠে আসে যেগুলির বাইরের দিক লাল ও ভিতরের দিক কালো রঙের। এই ধরনের মৃৎপাত্রকে কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র (পরিভাষায় Black-and-Red ware) বলা হয়ে থাকে। পূর্ব ভারতের বিভিন্ন পুরাক্ষেত্র থেকে এই ধরনের মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এগুলিই এই অঞ্চলের তাম্রাশ্মীয়/প্রাগৈতিহাসিক (পরিভাষায় Chalcolithic/Protohistoric) সাংস্কৃতিক পর্বের গ্রামীণ জনবসতির মুখ্য নিদর্শন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ থেকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরু পর্যন্ত এই সংস্কৃতির বিকাশের মূল সময়কাল। এমজিএম ২-এর তাম্রাশ্মীয় নিদর্শনগুলি প্রায় ১.৪৮মি গভীর মৃত্তিকাস্তর জুড়ে পাওয়া গেছে। কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র ছাড়াও এখানে পাওয়া গেছে লাল, কালো ও ধূসর বর্ণের মৃৎপাত্র। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার এই অংশ থেকে প্রাপ্ত এই পর্বের সাংস্কৃতিক নিদর্শনের এটি প্রথম উদাহরণ।

মোগলমারির তৃতীয় প্রত্নস্থল অর্থাৎ এমজিএম ৩-এ শুধুমাত্র ২০০৬-০৭ বছরটিতেই খনন হয়। এখানেও আদি মধ্যযুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন পুরাবস্তু যেমন বহু ধরনের মৃৎপাত্র, কিছু লোহার সামগ্রী, পোড়ামাটির লেখযুক্ত ‘নামমুদ্রা’ (পরিভাষায় seal) ইত্যাদি জনবসতির অস্তিত্ব সংক্রান্ত নিদর্শন পাওয়া গেছে।

এমজিএম ১ : মূল বৌদ্ধবিহার

এমজিএম ১ বা সখিসোনার ঢিবিটিই ছিল মোগলমারির মূল প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ এবং ২০০৩-০৪ থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত মোট ৯ বছর সময় ধরে এই ঢিবিটিতে খনন সংগঠিত হয়েছে। ২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮, ২০০৯-১০, ২০১০-১১ এবং ২০১১-১২ খ্রিস্টাব্দগুলিতে মূলত খননকার্য এই অংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ পর্যন্ত ঢিবিটির প্রায় ৪০-৪৫% শতাংশ খনন করা গেছে এবং তার ফলস্বরূপ বাংলায় আদি মধ্যযুগে বৌদ্ধধর্মের বিকাশের ইতিহাস চর্চায় পুরাতত্ত্বের অবদান সংক্রান্ত এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এমজিএম ১ খননের ফলে যেসকল ইটের স্থাপত্য নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে সেগুলিকে তাদের অবস্থান অনুযায়ী মোটামুটিভাবে নিম্নলিখিত ভাগে বিভক্ত করা যায় :

 ১. ঢিবির পূর্বদিকে উত্তর-দক্ষিণে ৬০মি বিস্তৃত একটি ৩.৭৫মি উচ্চতাবিশিষ্ট বিশাল দেওয়াল যেটির নীচের অংশ চুনের পলেস্তারা দিয়ে ঢাকা এবং উপরের অংশে অনবদ্য কারুকার্যমন্ডিত ইটের উপর ‘স্টাকো’ (ল্যাটিন ওপাস আলবেরিয়াম থেকে উদ্ভূত শব্দ) নামক এক বিশেষ ধরনের যৌগ দ্বারা গঠিত বিভিন্ন রকমের কারুকাজ ও মূর্তিসমূহ। ‘স্টাকো’ এবং আলঙ্কারিক ইট সংক্রান্ত বিশদে আলোচনায় আমরা আবার ফিরব সুতরাং এখানে সেআলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। পূর্বদিকের এই দেওয়ালটি নিরবচ্ছিন্নভাবে উত্তর ও দক্ষিণে বিস্তৃত হয়ে আবার পূর্ব-পশ্চিমে সমধিক দূরত্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ৬০মি অগ্রসর হয়েছে। দক্ষিণের দেওয়ালটিতেও ‘স্টাকো’ অলঙ্করণের কিছু অস্পষ্ট নিদর্শন থেকে গেছে, যদিও কালের নিয়মে অধিকাংশ উপাদানই প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। দেওয়ালের পূর্ব ও দক্ষিণদিকের অংশে ‘স্টাকো’ নির্মিত নকশাগুলির ঠিক উপরের স্তরে প্রতি ৭০সেমি দূরত্ব বরাবর একটি করে ইটে তৈরি ছোটো ছোটো স্তম্ভ পাওয়া গেছে এবং প্রত্যেক দু-টি স্তম্ভের মাঝে একটি করে প্রশস্ত কুলুঙ্গি (পরিভাষায় niche) দেখতে পাওয়া যায়। পূর্ব ও দক্ষিণাংশের একটি করে কুলুঙ্গি ‘স্টাকো’-র মূর্তি দ্বারা সজ্জিত। ঢিবির মাঝ-বরাবর পূর্ব দেওয়ালের সাথে সমান্তরালে অপর একটি দেওয়াল আবিষ্কৃত হয়েছে যেটিতে ‘স্টাকো’-র অনবদ্য নকশা ও ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। ঢিবির চতুর্দিক দিয়ে চলা এই দেওয়ালটি আসলে একটি বৌদ্ধ- বিহারের বাইরে প্রাচীরের পাদপীঠ (বা foot stool)।

 ২. ঢিবির উত্তরদিকে উপরে উল্লিখিত দেওয়ালটি এসে বিহারেও মূল প্রবেশপথের সাথে মিশেছে। এই প্রবেশপথের দু-পাশে দু-টি বৃহদাকার (৮০সেমি × ৭৭সেমি × ৩২সেমি কারুকার্যমন্ডিত ইটে সজ্জিত কুলুঙ্গি পাওয়া গেছে, যদিও এই অংশের পলেস্তরা অবিকৃত আছে, কিন্তু স্টাকো মূর্তিগুলির কোনো চিহ্নই এই অংশটিতে নেই। প্রবেশপথটির যে সামান্য অবশেষ টিকে আছে তা হল সিঁড়ির নীচের অংশের ইট বিছানো পথের কিছু চিহ্ন।

 ২০১১-১২ খ্রিস্টাব্দের খননের ফলে ঢিবির কেন্দ্রীয় অংশে উত্তর-দক্ষিণে ই৮-ই৬-ই৭ ইত্যাদি নামাঙ্কিত খাতগুলিতে খননের সময় ৮০সেমি চওড়া একটি চুন-পলেস্তারা সমৃদ্ধ দেওয়াল বেরিয়ে আসে, যেটির গায়ে ৮০সেমি গভীরতায় পূর্বদিকের দেওয়ালের মতো স্টাকো নকশা দেখা যায়। এই নকশাগুলির ঠিক নীচের অংশ থেকে আবার ৭০সেমি সমদূরত্বে ১৪০০ বর্গসেমি মাপের ১৫টি কুলুঙ্গি আবিষ্কৃত হয় এবং এই দেওয়ালের প্রতিটি কুলুঙ্গিতেই অপূর্ব শিল্পসুষমায় স্টাকো দ্বারা নির্মিত বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি ও অন্যান্য মানবাবয়ব উন্মোচিত হয়।

 ৩. ঢিবির পূর্ব ও দক্ষিণদিকে বহি:প্রাকারের বাইরের দিকে ৩.৭৫মি গভীরে অর্থাৎ প্রাকারটির ভিতের ঠিক উপরের স্তরে একটি সযত্নে নির্মিত ইট বিছানো পথ যেটির উপর দিয়ে সমগ্র বিহারটিকে প্রদক্ষিণ করা যেত। এই পথ দিয়েই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, ভক্ত ও দর্শনার্থীগণ বিহার প্রদক্ষিণ করে বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের উদ্দেশ্যে তাঁদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। প্রাচীন ভারতের বহু বৌদ্ধ বিহারেই এই ধরনের প্রদক্ষিণপথের (পরিভাষায় circumambulatory path) পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। মোগলমারির বিহারটির দক্ষিণদিকের প্রদক্ষিণপথের উপর একটি সুন্দর গোলাকার স্তূপের ভিত্তিও উন্মোচিত হয়েছে। যেহেতু এই স্তূপগুলিকে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষ দেবজ্ঞানে পূজা করতেন, তাই বিহারের বাইরের অংশেও স্তূপ নির্মাণের প্রচলন ছিল। এই জাতীয় স্তূপের নিদর্শন বিহার, উড়িষ্যা ও অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত বহু প্রত্নক্ষেত্রে ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছে।

 ৪. বিহারের বহি:প্রাকারের ঠিক ভিতরে ঢিবির মাঝের অংশে উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিম অক্ষ ধরে বেশ কয়েকটি ছোটো ঘরের ভিত্তি উন্মোচিত হয়েছে, যেগুলির কথা আগেও বলা হয়েছে। বৌদ্ধবিহারগুলি যেহেতু বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন চর্চার পীঠস্থান ছিল, বহু আবাসিক এই বিহারগুলিতে বসবাস করতেন। চীনা পরিব্রাজক সুয়ান জাং (হিউয়েন সাঙ) খ্রিস্টাব্দে সপ্তম শতকে তাম্রলিপ্তে এসে দশটি বৌদ্ধবিহার দেখেছিলেন এবং তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী সেগুলিতে মোট ১০০০ জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বসবাস করতেন। এই ঘরগুলি বৌদ্ধ আবাসিকদের অধ্যয়ন ও সাধনাকক্ষ ছিল। প্রসঙ্গত, এমজিএম ১-এ মাটির দু-টি ভিন্ন স্তরে এই ঘরগুলির অবশেষ পাওয়া গেছে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এই বিহার অন্তত দু-টি পর্বে নির্মিত ও পুনর্নির্মিত হয়েছিল। এই পুনর্নির্মাণের আরও বহু প্রমাণ কাঠামোটির অপরাপর অংশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

 ৫. ২০০৭-০৮ খ্রিস্টাব্দের উৎখননের ফলে ঢিবির মধ্যভাগে প্রায় ৩মি গভীর একটি বিশাল আকারের তিনদিক ঘেরা সংস্থান পাওয়া গেছে যেটির মধ্যে ব্যবহৃত ইটের মাপের অদ্ভুত তারতম্য থেকে মনে হয় যে, এটির বেশ কয়েকটি পর্বে সংস্কার করা হয়েছে। সম্ভবত এই অংশটিই বৌদ্ধবিহারটির মূল মন্দিরের অংশ ছিল, যদিও এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া কঠিন।

 ৬. প্রাচীন বৌদ্ধবিহার শ্রেণি স্থাপত্যে বিহারের বাইরের দেওয়াল ও ভিতরের সাধনাকক্ষ ও সম্মুখস্থ বারান্দা পেরিয়ে একটি বর্গাকার বা আয়তাকার উঠোন থাকত। এই উঠোনের এক প্রান্তে অথবা কেন্দ্রেই থাকত বুদ্ধের মন্দির। মোগলমারির বিহারটিতে এফ৫ নামক খাতটির প্রায় ১মি গভীরতায় চুনের পলেস্তারা যুক্ত যে মেঝেটির সন্ধান পাওয়া গেছে সেটি নি:সন্দেহে এই বিহারের উঠোন বা কেন্দ্রীয় অঙ্গনের অংশ। এই খাতের ঠিক পাশের খাতটিতেও (জি৫ নামাঙ্কিত) ভূপৃষ্ঠের ২৬সেমি গভীরে অপর একটি ইট বিছানো অঙ্গনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যদিও এটিতে চুনের পলেস্তারা ব্যবহৃত হয়নি। এ থেকে আবার প্রমাণ হয় যে, বিহারটি পরবর্তীকালে পুনর্গঠিত হয়েছিল।

মোগলমারির মৌলিকত্ব স্টাকো ও ইটের অলংকরণ

মোগলমারির উৎখননের ফলে বিবিধ ধরনের পুরাবস্তু প্রচুর পরিমাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে দু-টি শ্রেণির প্রত্ননিদর্শন এই প্রত্নক্ষেত্রটিকে বিশেষ মৌলিকত্ব দান করেছে। এদের মধ্যে প্রথমটি হল ‘স্টাকো’ নামক এক বিশেষ যৌগ। বিহারটির বিভিন্ন স্থাপত্যাংশে স্টাকো অলংকরণগুলির সাংস্থানিক বৈচিত্র্যের কথা আগেই বলা হয়েছে। এও বলা হয়েছে যে, স্টাকো শব্দটি লাতিন ‘ওপাস’ শব্দগুচ্ছ থেকে এসেছে। বস্তুত, এই বিচিত্র যৌগটি চুনের সাথে মার্বেলের গুঁড়ো (কোনো কোনো ক্ষেত্রে জিপসাম), বালি ও আঠা মিশিয়ে মন্ড আকারে তৈরি করা হত। তারপর অর্ধকঠিন অবস্থায় এই মন্ডকে প্রয়োজনীয় আকার ও আকৃতির ছাঁচে ঢেলে অথবা হস্তনৈপুণ্যে বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণে অথবা অলংকরণে ব্যবহার করা হত। মোগলমারির বিহারের পূর্ব ও দক্ষিণের বহি:প্রাচীরে অত্যন্ত ভগ্ন অবস্থায় যথাক্রমে এক পদ্মোপবিষ্ট মানবমূর্তি ও একটি পশুমূর্তি (সম্ভবত সিংহের অবয়ব) উদ্ধার করা গেছে। পূর্বের দেওয়ালের ইষ্টকস্তম্ভের ঠিক নীচের অংশে যে অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত স্টাকো অলংকরণের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তার সাথে তুলনীয় বৈচিত্র্য পূর্বভারতের পুরাতত্ত্বে বিদ্যমান। দেওয়ালের এই অংশটিতে ভূস্তর থেকে ৩৪সেমি ও ৯৫সেমি পরিধির মধ্যে এই অলংকরণগুলির অবস্থান। পদ্মস্তবকের সারি, পিরামিডের আকারের কারুকার্য, ঝুলন্ত পর্দার ন্যায় অলংকরণ, এবং আরও বহু ধরনের জ্যামিতিক নকশা দ্বারা এই কারুকার্যমন্ডিত সারিগুলি (পরিভাষায় panel/frieze) গঠিত। কে৬ নামক খাতে এরূপ একটি জ্যামিতিক নকশার অপূর্ব নিদর্শন এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে।

মোগলমারির স্টাকো অলংকরণের উৎকৃষ্টতম নিদর্শন হল ঢিবির কেন্দ্রের পশ্চিমমুখী দেওয়ালে গ্রন্থিত বৃহদাকার দেবদেবী ও গণমূর্তিগুলি। এগুলির মধ্যে, ব্রাহ্মণ্য দেবতা কুবেরের (যিনি আদি মধ্যযুগীয় বৌদ্ধধর্মেও অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিলেন) মূর্তি, একটি সর্পদেবীর মূর্তি, নৃত্যরত মানব-মানবী ইত্যাদির শৈল্পিক রূপ ও বিন্যাস মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকায় গুপ্তযুগের ভাস্কর্যশিল্পের সুষমার কথা মনে করিয়ে দেয়।

এই বৌদ্ধ বিহারের স্টাকো অলংকরণের পাশাপাশি এখান থেকে পাওয়া কারুকার্যমন্ডিত ইটের বৈচিত্র্যও অবিশ্বাস্য শিল্পসুষমামন্ডিত। এই বিহারের আলংকারিক কারিগরির সবচেয়ে অদ্ভুত দিক হল এখানে বিভিন্ন ধরনের আলংকারিক ইটের সম্মুখভাগের কারুকার্যের হুবহু অনুকরণে ইটের উপরের স্টাকো অলংকরণগুলি করা হয়েছে। কেবলমাত্র স্টাকো নিদর্শনগুলি খসে পড়লেই সেগুলিকে দৃষ্টিগোচর করা সম্ভব। ৬০টিরও বেশি আলংকারিক ইটের নমুনা অধ্যয়ন করে এখানে অন্তত ৪০ থেকে ৪২ রকমের বিভিন্ন আলংকারিক ইটের ব্যবহারের কথা জানা যায়। এর মধ্যে যেমন রয়েছে পদ্মস্তবকের অলংকরণ বা উলটানো পিরামিডের কারুকাজ, তেমনই রয়েছে বিভিন্ন ধরণের জ্যামিতিক নকশার অপূর্ব নমুনা। এই বিশালায়তন স্থাপত্যটির বিভিন্ন অংশকে অলঙ্কৃত করতে কী বিপুলসংখ্যক কর্মী ও কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন হয়েছিল সেকথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। নিশ্চিতরূপেই এই ইটগুলি ছাঁচে নির্মিত হত।

স্টাকো এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ইট ছাড়াও মোগলমারি বৌদ্ধবিহার থেকে যেসকল উল্লেখযোগ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে আছে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট শিস্ট পাথরের তৈরি বুদ্ধের মূর্তি, গুপ্ত আমলের কারুকাজ করা মৃৎপাত্র, একটি লেখযুক্ত পাথরের মূর্তির ভাঙা অংশ, বৌদ্ধবিহারে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের কিছু মৃৎপাত্রের নমুনা, লেখ-সম্বলিত নামমুদ্রা এবং সর্বোপরি বেশ কিছু পোড়ামাটির গোলাকৃতি উৎসর্গ ফলক যেগুলিতে, পদ্মাসন অথবা ভদ্রাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধের দু-পাশে বোধিসত্ত্বদের মূর্তি অভূতপূর্ব শিল্পসুষমায় চিত্রায়িত। আবার কোনোটিতে অজস্র বৌদ্ধ স্তূপের ভাস্কর্য উৎকীর্ণ। এই ফলকগুলির প্রতিটিই খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের পরিণত ব্রাহ্মী ও অপরিণত সিদ্ধমাতৃকার মিশ্রিত লিপিতে ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা লেখ-সম্বলিত। লেখগুলিতে বুদ্ধের বাণীর ধর্মপর্যায় নামক মন্ত্র খোদিত।

স্থাপত্যের সাংস্থানিক বৈশিষ্ট্য, ইটের মাপ, স্টাকো মূর্তিগুলির নান্দনিক চরিত্র ও প্রাচীন লিপির বৈশিষ্ট্য অধ্যয়নের মাধ্যমে মোগলমারির বৌদ্ধবিহারটিকে নি:সন্দেহে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সময়সীমার মধ্যে স্থান দেওয়া যায়। পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের আলোয় এই প্রাচীন পুরাক্ষেত্রের সার্বিক সাংস্কৃতিক কালানুক্রমকে (পরিভাষায় Cultural chronology) তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :

১. তাম্রাশ্মীয়, ২. আদি মধ্যযুগীয় ও ৩. মধ্যযুগীয়। যদিও এই শেষের পর্বের সাংস্কৃতিক নিদর্শনের মধ্যে এমজিএম ৩ অঞ্চলের কিছু মৃৎপাত্র ছাড়া আর প্রায় কোনো নিদর্শনই পাওয়া যায়নি।

যদিও মোগলমারির বহু প্রত্ন নিদর্শন কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে, তথাপি উৎখননের ফলে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত পুরাসাক্ষ্য দক্ষিণ বাংলার এই প্রত্যন্ত গ্রামটিকে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের পুরাতাত্ত্বিক মানচিত্রে স্থায়ী ও মৌলিক অবস্থান দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *