মোগলমারির আবিষ্কৃত বৌদ্ধমহাবিহার : প্রত্নকথা
উৎখননের ইতিবৃত্ত ও সংবাদ শিরোনামে মোগলমারি
ইতিহাস ও পর্যটন
বৌদ্ধ প্রভাব

মোগলমারির মধ্যযুগের ইতিহাস

মোগলমারির মধ্যযুগের ইতিহাস – ড. বিমলকুমার শীট

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন থানার অন্তর্গত মোগলমারি একটি ছোট্ট গ্রাম। দাঁতন থানা থেকে ৬কিমি উত্তরে এবং খড়গপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৪৫কিমি দক্ষিণে, ৬০নং জাতীয় সড়কের কাছে এই গ্রামের অবস্থান। বেলদা থেকে মোগলমারির দূরত্ব ১০কিমি। মোগলমারি গ্রামে প্রবেশের মুখেই একটি উঁচু ঢিবি দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামবাসীদের কাছে এটি ‘সখিসোনার পাঠশালা’ নামে খ্যাত। এই গ্রামের যত্রতত্র ইটের দেওয়াল, ইটের ধ্বংসস্তূপ দেখতে পাওয়া যায়। হ্যারিসন সাহেবের মেদিনীপুর জেলার আর্কিওলজি সংক্রান্ত রিপোর্ট (নং-২০৭, তাং-২০/৮/১৮৭৩) থেকে জানা যায়, পূর্বে বালেশ্বরের অনতিদূরে রাজঘাট রোড নির্মাণ করার জন্য মোগলমারি এবং সাতদৌলা নামক গ্রাম দু-টির প্রাচীন ভগ্নস্তূপ থেকে প্রায় ২৬ লক্ষ প্রস্তর ও ইট খনন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেসময় অনেক প্রাচীন মূর্তি, মুদ্রা ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছিল। স্থানীয় গ্রামবাসীগণ অনেকেই ওই সকল মুদ্রা সংগ্রহ করে রেখেছেন। এই সমস্ত ধ্বংসস্তূপগুলি বিগত দিনের প্রবল পরাক্রমশালী হিন্দু স্থপতিদের অমর কীর্তি বলে অনুমান করা যায়। স্তূপগুলি খনন করলে আরও অনেক প্রাচীন কীর্তি প্রকাশ পেতে পারে। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার ওই রিপোর্টের প্রায় ১৩০ বছর পর আমাদের দৃষ্টি মোগলমারির ঢিবির উপর পড়ল। যদি আগে আমরা তৎপর হতাম তাহলে মোগলমারির সংরক্ষণ অন্যরকম হতে পারত।

মোগলমারি আলোচনা প্রসঙ্গে দন্ডভুক্তির কথা অনিবার্যভাবে আসে। প্রাচীনকালে ভুক্তি বলতে সাধারণত কয়েকটি গ্রামকে বোঝাত। কয়েকটি ভুক্তি নিয়ে গঠিত হত বিষয় বা জেলা। প্রদেশগুলি ‘মন্ডল’ নামে পরিচিত ছিল। প্রদেশগুলি শাসিত হত স্বাধীন অথবা সামন্ত নৃপতি কতৃক। তবে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, সর্বাপেক্ষা বড়ো বিভাগের নাম ছিল ভুক্তি। প্রত্যেক ভুক্তি কতকগুলি বিষয়, মন্ডল, বীথি ও গ্রামে বিভক্ত ছিল। তাই দন্ড নামক একটি জায়গা ভুক্তিতে রূপান্তরিত এবং পরে সেটিই মন্ডল বা প্রদেশে রূপান্তরিত হয়েছিল কিনা বলা কঠিন। তবে ষষ্ঠ শতাব্দীতেই যে একটি অঞ্চল দন্ডভুক্তি মন্ডল নামে সুপরিচিত ছিল তা অনুমান করা যায় এবং ওই সময় থেকেই অঞ্চলটি বিভিন্ন বিবদমান রাজশক্তির দ্বন্দ্বক্ষেত্র ছিল সেবিষয়ে সন্দেহ নেই। দীনেশচন্দ্র সরকার (পাল-পূর্বযুগের বংশানুচরিত) স্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করেছেন যে, দন্ডভুক্তির ক্ষেত্রে একটি স্থানের নাম দন্ড এবং তা ভুক্তির প্রধান কেন্দ্র। শশাঙ্কের লিপি থেকে জানা যায়, দন্ডভুক্তি আঞ্চলিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। সুয়ান জাং-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে এবং কিছু গবেষকের সিদ্ধান্ত থেকে জানা যায় যে, সপ্তম শতাব্দীতে দন্ডভুক্তি তাম্রলিপ্তের অংশ ছিল। এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কম ছিল না। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার প্রাচীন দু-টি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রের মধ্যে একটি দন্ডভুক্তি, অন্যটি হল তাম্রলিপ্ত। দন্ডভুক্তি বাণিজ্যিক খ্যাতি লাভ করে মূলত স্থলপথের বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে। উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের সাথে দন্ডভুক্তির বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। যে পথ দিয়ে মহাবীর দক্ষিণ রাঢ়ে এসেছিলেন ওই পথ দিয়েই পণ্যসম্ভার উত্তরে মগধ, রাজগৃহ ইত্যাদি অঞ্চলে যেত। সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময় দন্ডভুক্তি প্রাদেশিক প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায়, একাদশ শতাব্দীতে এই দন্ডভুক্তি অঞ্চলের অংশ ছিল কম্বোজরাজ নয়পালের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মোগলমারির বহু প্রত্নসামগ্রী প্রারম্ভিক মধ্যযুগের এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক নিদর্শন।

সেইসঙ্গে চৈনিক পরিব্রাজক সুয়ান জাং-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত এ-প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সুয়ান জাং ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন, সেই সময় পুন্ডবর্ধনে ২০টি মঠ ও ৩ হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে সমতটে ৩০টি মঠ ও ২ হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, তাম্রলিপ্ত ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে ১০টি মঠ ও ১ হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং কর্ণসুবর্ণে (মুর্শিদাবাদ) ১০টি মঠ ও ২ হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেবলা মিত্র তাঁর বুদ্ধিষ্ট মনুমেন্ট গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আধুনিক তমলুকে একটিও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়নি।’ এই প্রসঙ্গে পাল-পূর্বযুগে মোগলমারিতে বৌদ্ধবিহার আবিষ্কার বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন স্বরূপ। সুয়ান জাং-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত এর গুরুত্বকে শক্তিশালী করবে। দাঁতনের কাছে মোগলমারিতে স্থাপিত বৌদ্ধবিহারটি ছিল প্রাচীন তাম্রলিপ্তের বাণিজ্যিক পথের অন্তর্ভুক্ত। সুবর্ণরেখা নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত মোগলমারি। বর্তমান মোগলমারি থেকে ৪কিমি পশ্চিমে সুবর্ণরেখা নদী প্রবাহিত। এই আবিষ্কার প্রারম্ভিক মধ্যযুগের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে সেবিষয়ে সন্দেহ নেই। দাঁতনের মোগলমারি বিহার স্বতন্ত্র কিছু ছিল না। প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায়, প্রাচীন বাণিজ্যিক পথ তমলুকের সঙ্গে উড়িষ্যার অপরাপর বৌদ্ধ কেন্দ্র যা সুবর্ণরেখা নদীর তীরবর্তী জয়রামপুর, বস্তা, খিচিং, বালেশ্বর, পুষ্পগিরি এবং নালন্দা। প্রাচীন মগধ নালন্দা ও বৌদ্ধগয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাণিজ্যিক পথের ধারে অবস্থানের কারণে উপরোক্ত স্থানসমূহের উন্নতি সম্ভব হয়েছিল। মধ্যযুগের শেষদিক পর্যন্ত দাঁতন এবং সন্নিহিত অঞ্চল উড়িষ্যার অধীন ছিল।

অধুনা মোগলমারি বৌদ্ধবিহার হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছে। কিন্তু মধ্যযুগের মোগলমারি একটি যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে জনমানসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। বর্তমানে এর ঐতিহাসিক সত্যতা বিচার করা দরকার। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝির আগে পর্যন্ত মেদিনীপুর মুসলমান শাসকদের আক্রমণের বাইরে ছিল বলা যায়। এই জেলার দক্ষিণভাগ ও হিজলি (দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত) উড়িষ্যার গঙ্গবংশীয় হিন্দু রাজাদের নিরাপদ অধিকারে ছিল। ১২০১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশের তৎকালীন রাজধানী নদিয়া, ইকতিয়ার-উদ্দিন-মোহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজি জয়লাভ করলেও পশ্চিমবঙ্গ বা রাঢ় দেশ জয় করেননি। এই সাফল্য অর্জন করতে তাঁদের দীর্ঘকাল কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর এই সংগ্রামের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মুখ্যত উড়িষ্যার স্বাধীন রাজারা। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু অংশ নিয়ে প্রায় দামোদর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাঁদের রাজ্যসীমা। ফলে মুসলমান শাসকদের ঠেকানোর দায়িত্বের সিংহভাগ উড়িষ্যার রাজাদের বহন করতে হয়েছিল। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত উড়িষ্যার হিন্দু রাজাদের সঙ্গে মুসলমান রাজাদের যে লড়াই চলে তার তীব্রতা মেদিনীপুরের দক্ষিণ অংশে খুবই অনুভূত হয়। এ সময় দেশের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার ছবি চৈতন্যচরিতামৃত থেকে পাওয়া যায়। এর পরই শুরু হয়েছিল আফগান-মোগল সংঘর্ষের ইতিহাস।

কররাণী বংশের দ্বিতীয় আফগান সুলতান সুলেমান কররাণীর (১৫৬৫-১৫৭২) আমলে মেদিনীপুর সরাসরি মুসলমান আক্রমণের সম্মুখীন হয়। শেরশাহের আমলের সামরিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেক ব্যক্তি সুলেমানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলাসহ সম্পূর্ণ উড়িষ্যা সুলেমান কররাণীর সক্রিয় প্রভাবে আসে। এ ব্যাপারে তাঁর সুযোগ্য সেনাপতি কালাপাহাড় ওরফে রাজু যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখান। উড়িষ্যার সিংহাসনে এ সময়ে গজপতিবংশের অবসান ঘটে এবং সিংহাসন দখল করেন ওই বংশের রাজত্বকালীন এক মন্ত্রী হরিচন্দন মুকুন্দদেব। তিনি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে শীতকালে সুলেমান তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়াজিদের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র সৈন্য মুকুন্দদেবের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই সৈন্যবাহিনী ছোটোনাগপুর এবং ময়ূরভঞ্জের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়। ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ অন্তর্দ্বন্দ্বে মুকুন্দদেবের মৃত্যু ঘটে। সিংহাসন দখল করেন তাঁরই সেনাপতি রামচন্দ্র ভঞ্জ। কারোর মতে দুর্গাভঞ্জ। তিনিও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অল্পকালের মধ্যে নিহত হন। এইভাবে ছোটোখাটো স্থানীয় বিদ্রোহ চলতে থাকলেও উড়িষ্যা শেষ পর্যন্ত বাংলার মুসলমান সুলতানের হাতে চলে যায়।

কিন্তু আফগানদের বিজয়গৌরব দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি। সুলেমানের কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ কররাণীর (১৫৭২-১৫৭৬) আমলে মোগল-আফগান যুদ্ধ সংঘটিত হয় বঙ্গদেশে। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী টোডরমল ও মুনিম খাঁর নেতৃত্বে এক বিশাল মোগল বাহিনী বাংলা অভিমুখে প্রেরিত হল। এই সংকটময় মুহূর্তে দাউদ কররাণী অন্যান্য আফগান সেনাপতিদের সংগঠিত করে উপযুক্ত নেতৃত্ব দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেন। দাউদ হুগলির সাতগাঁর মধ্যে দিয়ে উড়িষ্যায় পলায়ন করলেন এবং অন্যান্য আফগান সেনাপতিরা উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার এখানে-ওখানে আশ্রয় নিলেন। মুনিম খাঁ বর্তমান মালদা জেলার গৌড়ের কাছাকাছি টান্ডাকে বা তান্ডাকে প্রধান ঘাঁটি করে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হলেন। অল্পকালের ভেতর মোগলরা পশ্চিম, উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণে আফগানদের দমন করতে সক্ষম হল। যদিও ওইসব স্থানে তখনই তারা কোনো সামরিক চৌকি বা স্থায়ী কর আদায়ের ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। মেদিনীপুর, বঁাকুড়া ও বীরভূমের ঘন জঙ্গলের উপর কোনো স্থায়ী আধিপত্যের প্রসঙ্গই ওঠে না।

মুনিম খাঁ তাঁর সামরিক সাফল্যের আনন্দে উদবেলিত হলেও টোডরমল তাঁকে উদবুদ্ধ করলেন দাউদের পশ্চাদ্ধাবন করতে। টোডরমল স্বয়ং একদল সৈন্য নিয়ে বর্ধমান থেকে গড় মান্দারণে গিয়ে হাজির হলেন। এখানে গুপ্তচররা খবর দিলেন যে, দাউদ কররাণীকে ডেবরা কেশাড়িতে দেখা গেছে (বর্তমান কেশিয়াড়ি থানা নয়)। আসন্ন যুদ্ধের সম্ভাবনায় টোডরমল মুনিম খাঁর কাছে সৈন্য চেয়ে পাঠালেন। পর্যাপ্ত সৈন্য এসে পৌঁছালে তিনি মান্দারণ থেকে মেদিনীপুরের উত্তর-পূর্ব দিকে তেইশ মাইল দূরে কোলিয়া অভিমুখে অগ্রসর হলেন। দাউদ কররাণী তখন বর্তমান দাঁতন রেল স্টেশন থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে এগারো মাইল দূরে গড় হরিপুরে আশ্রয় নিয়েছেন। টোডরমল এবার কোলিয়া থেকে মেদিনীপুরে এসে ঘাঁটি গাড়লেন। সেনাশিবিরে অসন্তোষ দেখা দেওয়ায় টোডরমল পুনরায় মান্দারণে ফিরে যান। এই সংবাদ পেয়ে মুনিম খাঁ আরও সৈন্য বর্ধমান থেকে টোডরমলকে প্রেরণ করেন। এরপর টোডরমল আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করেন। মান্দারণ থেকে সমগ্র মোগল বাহিনী চেতুয়ায় এসে পৌঁছোলে সেখানে যোগদান করেন মুনিম খাঁ নিজে।

ইতিমধ্যে খবর পাওয়া গেল যে, দাউদ কররাণী হরিপুরে পরিখা খনন করে তাঁর ঘাঁটিকে আরও সুরক্ষিত করে ফেলেছেন। এর উপর মেদিনীপুর থেকে দক্ষিণমুখী সমগ্র রাস্তাটির গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে ব্যরিকেড স্থাপন করে আক্রমণকারী সৈন্যবাহিনীর অবাধ চলাচলেও বাধা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তাটি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়ায় আচমকা আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল, সামগ্রিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করে মোগল সৈন্যবাহিনী হতাশায় ভেঙে পড়ল এবং যুদ্ধের জন্য অসম্মতি প্রকাশ করল। আশু শান্তির জন্যও তারা দাবি জানাল। পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনার জন্য টোডরমল ও মুনিম খাঁ সৈন্যদের ধমক দিলেন। সরাসরি দাউদ কররাণীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর না হয়ে নতুন পথ দিয়ে আক্রমণের কথা ভাবা হল। সেজন্য একজন স্থানীয় লোককে সংগ্রহ করা হল যে সমস্ত রাস্তা ও অঞ্চলটি সম্পর্কে খুবই পরিচিত। তার সাহায্যে একটি আঁকাবঁাকা ঘোরা পথ আবিষ্কার করা হল। মেরামতকারীদের দিয়ে রাস্তাটিকে চলার মতো করার পর অভিযান শুরু হল। বঁা দিক দিয়ে ঘুরে অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব হয়ে বর্তমান দাঁতন রেলস্টেশন থেকে এগারো মাইল পূর্বে কাঁথি-মেদিনীপুর রাস্তায় অবস্থিত নানজুরা (নহঞ্জরা) গ্রামে গিয়ে মোগলবাহিনী পৌঁছোল এবং দাউদ কররাণীর বাহিনীর পিছনের অংশকে আচমকা হামলা করে বিচ্ছিন্ন করার কথা ভাবল।

এই সময় দাউদ বিপদের আশঙ্কায় নিজের পরিবারবর্গকে উড়িষ্যার কটকে নিরাপদ আশ্রয়ে প্রেরণ করলেন। এবার শত্রুবাহিনীকে তার ঘাঁটিতে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে এলেন। তাৎপর্যপূর্ণ এই ঐতিহাসিক লড়াই ঘটল তুকোরায়ের (তুরকা) প্রান্তরে যার অবস্থান দাঁতনের ন-মাইল দক্ষিণ-পূর্বে এবং নহঞ্জরার তিন মাইল পশ্চিমে। এই যুদ্ধকেই অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও লেখক ‘মোগলমারির যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার প্রমাণ করেছেন তুকোরায়ের যুদ্ধকে মোগলমারি বলার হেতু নেই, কারণ মোগলমারি একটি স্বতন্ত্র স্থান, দাঁতনের ৬কিমি উত্তরে, তুকোরায় থেকে ব্যবধান অন্যূন বারো-চোদ্দো মাইল। এই ‘তুকোরোই’ আইন-ই-আকবরি-তে ‘টাকারুই’ -এর অপভ্রংশ। যুদ্ধ তুকোরাই, নহঞ্জরা প্রভৃতি স্থান জুড়ে হয়েছিল। মোগলমারিতে যুদ্ধ না হওয়া অসম্ভব নয়। বর্তমানে মোগলমারিতে প্রাচীন বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। আরও খননকার্য চললে যদি মোগল-পাঠান যোদ্ধাদের যুদ্ধাস্ত্র বা তৎ-সম্পর্কিত নিদর্শন স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় তবে মোগলমারিতে যে মোগল-পাঠান যুদ্ধ হয়েছিল তা স্পষ্ট প্রমাণিত হবে। তবে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানা গেছে পুকুর খুঁড়তে গিয়ে তাঁরা বর্শা গুলতি পেয়েছেন।

ইতিহাসে অনুমানের স্থান স্বল্প। প্রকৃতপক্ষে ‘মোগলমারি’ নয়, ‘মোগলমাড়ী’। ‘মাড়ী’ কথার অর্থ রাস্তা, ‘মোগলমাড়ী’ মানে মোগলদের চলাচলের পথ। মোগলরা এই পথ মাড়িয়ে গিয়েছিল। এই পথ বর্তমানে জাতীয় সড়ক নং-৬০ এবং এর পূর্ব নাম ও টি রোড যা পুরী যাওয়ার অন্যতম রাস্তা। মোগল সৈনিকেরা সম্ভবত এই পথ ধরেই অগ্রসর হয়েছিল। কোনো জনপথ হঠাৎ গড়ে ওঠে না, অতীতের সূত্র ধরে তার বিস্তার ঘটে।

যাই হোক তুকোরায়ের যুদ্ধ হয়েছিল ৩ মার্চ ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে, আর তার পরের বছর ঘটে হলদিঘাটের যুদ্ধ। মোগল সেনাপতিরা ওইদিন লড়াই না করা স্থির করেছিলেন। কারণ তাঁদের মতে গ্রহের অবস্থান অনুকূলে ছিল না। শত্রুদের উপর লক্ষ্য রাখার জন্য কেবলমাত্র শিবিরের সামনে কয়েকজন ঘোড়সওয়ার পাহারা দিচ্ছিল। হঠাৎ তারা লক্ষ করল যে, শত্রুসৈন্য তীব্রবেগে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মুনিম খাঁ শীঘ্র তাঁর সৈন্যদের ব্যূহ রচনা করে দাঁড়িয়ে পড়তে আদেশ দিলেন। গুজর খাঁর নেতৃত্বে দাউদের হাতিগুলি ততক্ষণে মোগলদের অগ্রগামী অংশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাতিগুলোর শুঁড় আর ঘাড় কালো চমরী-গাইয়ের লেজ ও অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকার ফলে একটা বীভৎসজনক আতঙ্কের আবহাওয়া সৃষ্টি করেছিল। অগ্রগামী ঘোড়সওয়ারদের ঘোড়াগুলি হাতিগুলিকে ভয়ংকর জন্তু মনে করে আর শত্রুবাহিনীর প্রবল চিৎকার শুনে খেপে গিয়ে পিছু দৌড় লাগাল, মোগল ঘোড়সওয়াররা ঘোড়াগুলিকে লাগাম টেনে আটকাবার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। ফলে সৈন্যব্যূহ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেল। যুদ্ধে খান-ই-আলম মারা গেলেন। বিজয়ী আফগান বাহিনী মোগল বাহিনীর মধ্যভাগকে তছনছ করে দিল। মুনিম খাঁ ও অন্যান্য সেনাপতিরা প্রাণপণ যুদ্ধ চালালেও অনুচররা ক্রমশ যুদ্ধের গতি দেখে হতাশ হয়ে পড়ল। নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলে, শিবিরের লড়াই না করা লোকজন যারা খাবার-দাবার নিয়ে নিরাপদে পালাবার চেষ্টা করেছিল, তাদের উপর বিশৃঙ্খল আফগানরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর এটিই হল তাদের বিপদ। মোগল রণব্যূহের কেন্দ্রস্থল যেটি গুজর খাঁ-এর আক্রমণে ভেঙে গিয়েছিল, দাউদ খাঁ সেই ভেঙে পড়ার সুযোগ নিয়ে বঁাদিকে লক্ষ করে আক্রমণ চালাতে ব্যর্থ হলেন। আফগান বাহিনীর দক্ষিণভাগে সিকান্দারের নেতৃত্বে মোগল বাহিনীর বঁাদিকে কিছুটা আক্রমণের চেষ্টা করে বিফল হন। দাউদ কররাণী নিজে দক্ষিণভাগের সাহায্যে এগিয়ে এলেও অবস্থার বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি।

ইতিমধ্যে বিপর্যস্ত মোগল বাহিনী ছোটো ছোটো গ্রন্থি তৈরি করে রণব্যূহ সাজিয়ে আফগানদের সঙ্গে মুখোমুখি ঘোড়ায় চড়ে নবোদ্যমে লড়াই শুরু করে দিল। ঘোরতর যুদ্ধের মধ্যে হঠাৎ শত্রুনিক্ষিপ্ত একটি তির গুজর খাঁকে সরাসরি নিহত করে ফেলল আর সেইসঙ্গে যুদ্ধের গতিও একেবারে বদলে গেল। ক্ষণিকের মধ্যে আফগানদের অগ্রগামী অংশ রণক্ষেত্র থেকে প্রাণভয়ে একেবারে উধাও হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মুনিম খাঁ যুদ্ধক্ষেত্রে আবার ফিরে এসেছেন এবং মোগলদের ঐক্যকে সুসংহত করে ফেলেছেন। মোগলবাহিনী দৃঢ়তার সঙ্গে আফগানদের যুঝতে লাগল এবং ক্রমশ তাদের হঠিয়ে আফগানদেরই রণব্যূহের মধ্যভাগে আঘাত হানতে লাগল। সামনে ও বঁাদিকে আশু আক্রমণের সম্ভাবনা এবং অগ্রগামী বাহিনী সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে কে, কোথায় পালিয়ে গেছে—এই রকম এক অসহায় অবস্থায় দাউদ কররাণীর পক্ষে আর লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল যখন খবর এল গুজর খাঁ মারা গেছেন আর তাঁর সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে আফগানরা পলায়নে তৎপর হল। বিজয়ী মোগলরা পরাজিত পক্ষের পশ্চাদ্ধাবন করে ইচ্ছেমতো আফগানদের নিহত করতে লাগল। তুকোরায়ের প্রান্তর মৃতদের রক্তে এক ভয়ংকর আকার ধারণ করল। অসংখ্য আফগান মোগলদের হাতে বন্দি হল। পরের দিন বিরাশি বৎসর বয়স্ক মোগল সেনাপতি মুনিম খাঁ অভূতপূর্ব নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সমস্ত আফগান বন্দিকে হত্যা করে তাদের ছিন্নমুন্ড সাজিয়ে আটটি সুউচ্চ মিনার প্রস্তুত করলেন। টোডরমল দাউদকে পশ্চাদ্ধাবন করলেন। দাউদ কররাণী কটকে গিয়ে দুর্গে আশ্রয় নিলেন এবং ১২ এপ্রিল মুনিম খাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। ২১ এপ্রিল তারিখে মুনিম খাঁ দাউদ কররাণীকে মার্জনা করে টান্ডায় ফিরে এলেন। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার তুকারোয়ের যুদ্ধের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে আকবরের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হল। যদিও মোগলদের পক্ষে সেখানে সঙ্গে সঙ্গেই শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করা সম্ভবপর হয়নি। যদুনাথ সরকারের উপরোক্ত মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়, মেদিনীপুর বাংলাদেশে মোগল-আফগান সংঘর্ষের এক চরম সন্ধিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আফগানরা যুদ্ধে জিতলেও ইতিহাসের গতি বদলাত না। তুকারোয়ের যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই আকবর নিজেকে সাম্রাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। মুনিম খাঁর দ্বারা বিদ্রোহ দমন সম্রাটের কাছে ছিল কেবলমাত্র সময়ের প্রশ্ন। এক বছরের মধ্যে দাউদ কররাণী বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে আফগানরা পরাজিত এবং দাউদ কররাণী বন্দি হলেন ও সন্ধি ভঙ্গের অপরাধে তাঁর প্রাণদন্ড হল। সঙ্গে সঙ্গে মেদিনীপুর পাকাপাকিভাবে মোগল শাসনের অন্তর্ভুক্ত হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *