মোগলমারির আবিষ্কৃত বৌদ্ধমহাবিহার : প্রত্নকথা
উৎখননের ইতিবৃত্ত ও সংবাদ শিরোনামে মোগলমারি
ইতিহাস ও পর্যটন
বৌদ্ধ প্রভাব

মোগলমারির উৎখনন ও সংরক্ষণ

মোগলমারির উৎখনন ও সংরক্ষণ – প্রকাশচন্দ্র মাইতি

মোগলমারি প্রত্নস্থলটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় বিভাগ কতৃক সংরক্ষিত। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একদা এক অজানা অখ্যাত গ্রাম আজ ইতিহাসের পাতায় অতিপরিচিত নাম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তদানীন্তন বিভাগীয় প্রধান স্বর্গীয় ড. অশোক দত্ত মহাশয়ের প্রচেষ্টায় পরপর ৭ বার উৎখনিত হয় (২০০৪-২০১২)। মোগলমারি উৎখনন শুরু হওয়ার পূর্বে ড. দত্ত যখন সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকায় প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা ও নিদর্শনের আবিষ্কারে ব্যস্ত ছিলেন সেই সময় হঠাৎই এক প্রবীণ ইতিহাসপ্রেমী শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। কথায় কথায় মোগলমারির প্রসঙ্গও আসে, কালবিলম্ব না করে তিনি এই প্রত্নস্থল পরিদর্শন করেন। প্রথম দর্শনেই তিনি এই প্রত্নস্থলের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে পারেন। উৎখননের পরের ঘটনাপ্রবাহ তো আমাদের সকলের জানা।

প্রথমবার উৎখননেই আবিষ্কৃত হয় বহু অজানা তথ্য, বিভিন্ন পুরাবস্তু, লিপি, সিলমোহর আরও অনেক কিছু। তাঁর অকাল প্রয়াণের পরে প্রত্নস্থলটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে আসে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ৭ মার্চ এটি West Bengal Preservation of Historical Monuments and Objects of Archaeological Site Act 1957 and Rules 1964-এর বলে রাজ্য সরকার সংরক্ষিত স্মারক-এর মর্যাদা লাভ করে। এই কাজে তদানীন্তন প্রত্নতত্ত্ব অধিকর্তা ও সহ-অধিকর্তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। রাজ্য সরকার ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ড. অমল রায়ের নেতৃত্বে উৎখনন শুরু করে, কিন্তু ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎই ড. রায়ের জীবনাবসান হয়। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই প্রবন্ধের লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে উৎখনন শুরু করেছে।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতামত ও তথ্য থেকে জানা যায়, ৭ম শতাব্দীতে মেদিনীপুর জেলার এগরা থেকে শশাঙ্কের তাম্রপত্র ও বেলদা থেকে উড়িষ্যার এক শাসকের তাম্রপত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। মোগলমারি উৎখননে এই অঞ্চলের ইতিহাস ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি নির্ধারিত হয়েছে। রাজ্য প্রত্নতত্ত্বের প্রথমবার উৎখননে (২০১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে) বৌদ্ধবিহার, ইটের স্থাপত্য, লিপি সংবলিত সিল ও সিলমোহর, মিশ্র ধাতুর মুদ্রা, সোনার লকেট, স্টাকোর অলংকৃত দেওয়াল, পোড়ামাটির পুঁতি ও প্রচুর মৃৎপাত্রের টুকরো পাওয়া গেছে। এরপর ২০১৫ ও ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ২য় ও ৩য় বার উৎখনন হয় এবং উৎখননে বিরাট ইটের স্থাপত্যের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ড. অশোক দত্তের অনুমান ছিল এখান থেকে বিরাট আকৃতির বাংলার সবচেয়ে বড়ো বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হবে। রাজ্য সরকার পরিচালিত পরপর তিনবার উৎখননে দেখা গেছে প্রত্নস্থলটির পশ্চিমদিকে একটি ছোটো আকৃতির বৌদ্ধবিহারের অংশ আবিষ্কৃত হলেও পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকে একাধিক স্থাপত্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, যদিও স্থাপত্য শৈলীর সম্পূর্ণ রূপটি আবিষ্কৃত হয়নি এখনও। উৎখননে আবিষ্কৃত স্থাপত্যগুলির বিচারে বোঝা যায়, এখানে শুধুমাত্র একটি নয় একাধিক বৌদ্ধ স্থাপত্যকীর্তি নির্মিত হয়েছিল। ২০১৫-র উৎখননে আবিষ্কৃত স্থাপত্যগুলির মধ্যে দু-টি প্রথম পর্যায়ের স্থাপত্য হল পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত দু-টি লম্বা সমান্তরাল দেওয়াল সারি যা প্রত্নস্থলের মাঝ বরাবর এসে দক্ষিণমুখী হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের স্থাপত্যগুলি হল স্তূপ, ১২টি চতুষ্কোণাকৃতি ও আয়তাকার ইটের বেদী, স্টাকোর অলংকরণসমৃদ্ধ বহির্দেয়াল, পোড়ামাটি ও হাতির দাঁতের পুঁতি, প্রচুর মাটির প্রদীপ, তামার আংটি, লোহার পেরেক, খাদ্যশস্য, জীবজন্তুর হাড় এবং প্রচুর মাটির পাত্র।

আপাতদৃষ্টিতে সাধারণের চোখে এই প্রত্নস্থল ও প্রত্নবস্তুগুলি কতটা আগ্রহ সৃষ্টি করে তা জানা নেই, তবে প্রত্নস্থলে ও বিভিন্ন মিউজিয়ামে বহু সাধারণ দর্শকের আগ্রহ, উপস্থিতি ও মতামত প্রত্যক্ষ করা যায়। বিভিন্ন সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও বেতারের মাধ্যমে প্রচারিত মোগলমারির ইতিহাস সম্বন্ধে নানা খবর সম্প্রচার হওয়ায় মানুষের উপস্থিতির সংখ্যাটা অধিক হয়েছে। পরিদর্শনকারীর মধ্যে যেমন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা আছেন, তেমনি অগণিত সাধারণ মানুষ, প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের গবেষক, ছাত্রছাত্রী, আমলা ও দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও আছেন।

পরিদর্শনকারীদের মধ্যে এক স্কুলছাত্রের অভিব্যক্তি না প্রকাশ করলেই নয়—(২০১৫) উৎখনন যখন পুরোদমে চলছে হঠাৎই এক ১২-১৩ বছরের স্কুলছাত্র তার বাবা মা-এর সঙ্গে মোগলমারিতে এসেছিল। ছেলেটির চোখে ছিল একরাশ বিস্ময় ও মুখে অজস্র প্রশ্ন। ছাত্রটির প্রথম প্রশ্ন ছিল এটা কি কোনো রাজপ্রাসাদ? তাহলে রাজার সিংহাসনটা কোথায় ছিল? রাজার অস্ত্রভান্ডারের তীরধনুক? তলোয়ার কোথায়? সাধারণ মানুষের সর্বদাই কৌতূহল থাকে খোঁড়াখুঁড়িতে কত কিলো সোনা পাওয়া গেল। তাঁদের কাছে একটা মাটির পুতুল, মৃৎপাত্র বা পাথরের কোনো মূল্য নেই যতক্ষণ-না বুঝতে পারে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে একটুকরো মৃৎপাত্র ও সোনার তৈরি বস্তুটির মূল্য এক। ছাত্রটির শেষ প্রশ্ন ছিল প্রত্নতাত্ত্বিকরা কীভাবে বুঝতে পারেন যে, এইখানে এই ধরনের নিদর্শন পাওয়া যাবে। সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা আমরা করেছি, ওর শিশুমনে ভীষণভাবে প্রত্নতত্ত্বের সব বিষয়গুলি রেখাপাত করেছিল, বুঝেছিলাম যখন দ্বিতীয়বার হাজির হয়েছিল ছোটো বাক্সে-ভরতি বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রা নিয়ে ও কতকগুলি প্রত্নবস্তু নিয়ে। ওর বাবা-মার থেকে জানা গেল মোগলমারি পরিদর্শনের পর ওর প্রত্নতাত্ত্বিক হওয়ার অদম্য ইচ্ছার কথা। এই ১২-১৩ বছরের ছাত্রটির মতো সাধারণ মানুষের কাছেও এভাবে প্রত্নতত্ত্বের সব কিছু আস্তে আস্তে আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে ওঠে প্রত্নস্থল পরিদর্শনের পর।

প্রত্নস্থলে এসে সাধারণ চোখে উৎখনন ও প্রত্নস্থল একঝলক দেখলে হয়তো মনে হবে—এ আর এমনকী, যার জন্য এত আয়োজন? কিন্তু কয়েকটি ইটের দেওয়ালের সারির মাঝে উপস্থিত হলে অতীতের মর্মকথার অনুভূতি হয়, অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে। দেওয়ালের গায়ে সাদা স্টাকোর অলংকরণে বেরিয়ে আসে সাধারণ মানুষের আংশিক জীবনযাত্রার নানা অজানা কাহিনি, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভালো লাগা না-লাগা ও নানা ধর্মীয় জীবনের কাহিনি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মৃৎপাত্রগুলি যেন অতীতের কথা বলে বর্তমানের সাক্ষী হয়ে। স্টেশন বা রাস্তার ধারের ছোট্ট চায়ের দোকানদার বন্ধু যখন মাটির ভাঁড়ভরতি গরম চা এগিয়ে দেয় তখন খেয়াল থাকে না সেই মাটির ভাঁড়ের কথা। মন ভরে যায় গরম চায়ে। মাটির হাঁড়ি-কলসির ইতিকথা বোঝা যায় কোনো এক প্রত্নক্ষেত্রে এলে। নানা রঙের, নানা ধরনের, নানা অলংকরণের মৃৎপাত্রগুলি ভীষণ সুন্দর দেখায় যখন ক্রমান্বয়ে সাজানো থাকে। ধাতুর ব্যবহারের পূর্ব থেকে এই মাটির পাত্রগুলির ব্যবহার হয়ে এসেছে। এখানেই এর মাধুর্য। বাসনকোসন বলতে অন্য কিছু যখন ছিল না তখন গাছের পাতা ও মাটির পাত্রই ছিল একমাত্র অবলম্বন। শুধুমাত্র মৃৎপাত্র দিয়ে যে সংস্কৃতির নামকরণ হয় তাতেও বোঝা যায় মৃৎপাত্রের গুরুত্ব কত ছিল। উদাহরণস্বরূপ BRW, NBPW, PGW, OCP সংস্কৃতির কথা বলা যায়।

উৎখননের সময় নানা ধরনের প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হতে থাকে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর। সরকারিভাবে প্রথমবার এই প্রত্নস্থলে খনন চলার দু-সপ্তাহ পরে হঠাৎই একদিন একটি মিশ্র ধাতুর মুদ্রা পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে খবর ছড়িয়ে পড়ল বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং গ্রামের অসংখ্য মানুষ উপস্থিত হলেন মুদ্রাটি দেখতে। উপস্থিত হলেন বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাংবাদিক, আলোকচিত্রীরা, বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা। যখন সারা প্রত্নস্থলে মানুষে মানুষে ছয়লাপ সেই সময়ে আবার একটি গোলাকার বস্তু আবিষ্কৃত হল একইভাবে। পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা গেল এটি একটি সোনার লকেট যার মাঝখানে দু-টি ছিদ্র। ঠিক যে জায়গা থেকে মুদ্রাটি পাওয়া গেছে সেই একই জায়গায় লকেটটিও পাওয়া গেল। সাংবাদিকরা নিমেষে সমস্ত তথ্য নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে এই আবিষ্কারের সংবাদ তাঁদের সংবাদমাধ্যমে শিরোনামে নিয়ে এলেন। মোগলমারির এই আবিষ্কার স্থাপত্য এবং অন্যান্য প্রত্নবস্তুর সময়কাল নির্ধারণ করে দিল। মুদ্রাবিশেষজ্ঞরা মুদ্রাটি পর্যবেক্ষণ করে জানালেন এটি একটি গুপ্ত-পরবর্তী যুগের রাজার মুদ্রা। সেদিন সত্যি আনন্দ পেয়েছিলাম দু-টি কারণে; একটি হল—মোগলমারির সংস্কৃতির সময়কাল নিয়ে যে সন্দেহ ছিল এটি আবিষ্কারের ফলে সঠিক সময়কাল নিরূপণ করা গেল। জানা গেল, খ্রিস্টীয় ৫৫০-এর পরবর্তীকালে রাজা সমাচারদেবের সময়কালে এই মুদ্রা প্রচলিত হয়েছিল এবং বোঝা গেল স্থাপত্যগুলির নির্মাণকাল। দ্বিতীয় আর-একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল—বাংলার অন্ধকারময় যুগের ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে আবিষ্কৃত এই পুরাবস্তুর সঙ্গে সমসাময়িক সাংস্কৃতিক পর্যায় নিরূপণে।

প্রত্নতত্ত্বে এই মুদ্রা নামক উপাদানটি ইতিহাস রচনায় বিশেষ ভূমিকা নেয়। আমরা জানি গুপ্ত সাম্রাজ্য ধ্বংসের পর দক্ষিণবঙ্গের কিছু আঞ্চলিক স্তরের প্রশাসক নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষের দিকে রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হুণ আক্রমণ হয়। কেন্দ্রীয় প্রশাসন তখন ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। সেই সময়ে বাংলার এই দক্ষিণ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সমাচারদেব স্বাধীন রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন যিনি গুপ্তরাজাদের অনুরূপ স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন ও নিজেকে তাঁর মুদ্রায় নরেন্দ্রাদিত্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। শুধু সমাচারদেব নন ওই সময়ে আরও দুজন রাজার নাম জানা যায়—তাঁরা হলেন গোপচন্দ্র ও ধর্মাদিত্য। এঁদের প্রচলিত মুদ্রাও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেছে, যারা খ্রিস্টীয় ৫২৫-৫৭৫ অব্দে রাজত্ব করতেন। এই আবিষ্কারে মোগলমারি প্রাচীনত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে ও বাংলার ইতিহাসের অন্ধকারময় যুগের ইতিহাস রচনায় মোগলমারির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

উৎখননে একাধিক পোড়ামাটির সিল ও সিলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। সিলমোহরে খোদিত গুপ্ত-পরবর্তী ব্রাহ্মীলিপিও আর-একটি মূল্যবান তথ্য যার মাধ্যমে এই বৌদ্ধবিহারের নাম জানা গেছে। আবিষ্কৃত সিলগুলির মধ্যে একটি এই মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের বলে পূর্ববর্তী উৎখনক ড. অমল রায় মনে করেছেন এবং আবিষ্কৃত সিলটি পাঠোদ্ধারের জন্য তিনি পন্ডিত বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়েছিলেন। একটি সিলে ‘শ্রীবন্দক মহাবিহারীয় আর্য ভিক্ষু সংঘ’ লিপি পাওয়া যায়। এ থেকে এই মহাবিহারটি ‘শ্রীবন্দক মহাবিহার’ বলে চিহ্নিত হয়েছে, যদিও একটি সিলই যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রচেষ্টা সমানে চলেছে দ্বিতীয় একই রকম একটি সিলের সন্ধানে। গুপ্ত-পরবর্তী ব্রাহ্মী লিপিতে খোদিত অন্য আর-একটি পুরাবস্তু হল পাথরের ছোটো একটি বুদ্ধমূর্তি যাতে ‘মাতৃচন্দ্রায়ঃ’ কথাটি লেখা। অন্যান্য নিবেদিত সিলগুলিতে ‘ye dhamma hetu pravaba … sramana’ কথাটি লেখা আছে। এইসব সিলমোহর ও তার লেখগুলি দেখে পন্ডিতরা মোগলমারি যে একটি সময়ে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল ও একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল সে-বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। কতিপয় ঐতিহাসিক মোগলমারিকে জৈনধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্থান বলে মনে করেন কিন্তু উৎখননে এখনও পর্যন্ত জৈনধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়নি। মোগলমারি উৎখননে উন্মোচিত স্থাপত্যগুলি স্টাকোর ভাস্কর্য শুধু বাংলা নয় পূর্বভারতে আবিষ্কৃত অন্যান্য প্রত্নস্থলের মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৬-০৭ খ্রিস্টাব্দে ড. অশোক দত্ত যখন উৎখনন পরিচালনা করেন সেই সময় প্রত্নস্থলের মাঝ-বরাবর প্রায় ২০মিটার লম্বা যে দেওয়াল আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে শুধু স্টাকোর প্লাস্টার নয় বিভিন্ন স্টাকোর মূর্তিও দেওয়াল গাত্রে অলংকৃত অবস্থায় ছিল।

এই সকল স্টাকোর মূর্তিগুলি বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যুক্ত সাধারণ উপাসক, নৃত্যরত যুগলমূর্তি, কিন্নর ও গন্ধর্বমূর্তি হতে পারে। ভগ্নপ্রায় ঝুরঝুরে উৎখনিত জায়গাটি জল, বৃষ্টি, রোদ থেকে বঁাচাতে অর্ধগোলাকৃতি ফাইবারের কাঠামোর ছাউনি দেওয়া হয়েছে। স্টাকোর কারুকার্য খুব সাবধানতার সঙ্গে বঁাচানোর চেষ্টা চলেছে। বর্তমানে সংরক্ষণের কাজ শুরু করা গেছে এবং যথাযথভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। স্টাকোর কাজগুলি বালি, চুন ও মার্বেলের গুঁড়ো (জিপসাম) এবং আঠার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে। শুধু বাংলা নয় পূর্বভারতের বিভিন্ন জায়গাতে এই স্টাকোর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে বিহারের নালন্দা ও বাংলায় কর্ণসুবর্ণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন রাসায়নিক ও প্রতিরোধক দিয়ে এগুলির সংরক্ষণ করা হচ্ছে। গতবারের উৎখননেও স্টাকোর তৈরি মনুষ্যমূর্তির মাথার অংশ, দেওয়াল গাত্রে বিভিন্ন স্টাকোর কারুকার্য ও অলংকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে। যথাযথ সংরক্ষণ না করে দেওয়ালগুলির উন্মোচন সমস্যাবহুল। তাই স্টাকোর কাজ করা দেওয়ালগুলি মাটি দিয়ে ঢাকা দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি প্রত্যেকটি উৎখনন হল একটি ধ্বংসাত্মক কাজ, তাই উৎখননে আবিষ্কৃত নিদর্শন ও স্থাপত্য-ভাস্কর্যকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা উৎখনকের প্রথম ও প্রধান কাজ। মাটির নীচে যে কোনো প্রত্নবস্তুই সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু বাইরের জল, হাওয়া, আলোর সংস্পর্শে এলে প্রত্নবস্তুগুলি আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। তাই বহুক্ষেত্রে উৎখননে উঠে আসা স্থাপত্য ও প্রত্নবস্তুকে পুনরায় মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। এ বছর কয়েকটি উৎখনিত খাদ পুনরায় মাটি চাপা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

উৎখননে নানা আকৃতির লোহার পেরেক ও লোহার তৈরি পুরাবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। ইটের স্থাপত্যের বিরাটাকার ছাউনি বা কাঠের কাজে এই লোহার পেরেকগুলি ব্যবহৃত হয়েছিল। পোড়ামাটির, পাথরের ও হাতির দাঁতের পুঁতি আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ ভালো সংখ্যায়। এই পুঁতিগুলি বিভিন্ন মাপের ও আয়তনের। বেশির ভাগই গলার হার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হয়। হাতির দাঁতের পুঁতিগুলি একসঙ্গে পাওয়া গেছে। অন্যান্য প্রত্নবস্তুগুলির মধ্যে ৪০-৪২ রকমের বিভিন্ন নকশা-অলংকৃত ইট, এগুলি দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে যেমন দেওয়ালের কোণে, অর্ধগোলাকৃতি স্তম্ভে বা অফসেটে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলি বিভিন্ন মাপের এবং আকৃতির। এগুলির মধ্যে অর্ধগোলাকৃতি, চৌকোণা, একদিকে ঢালু পদ্মের পাপড়ির আকৃতির। অন্যান্য প্রত্নবস্তু হিসেবে মাটির প্রদীপ, লৌহমল, পাথরের মূর্তি, খেলনা গুটি, মাটির ঘণ্টা, জীবজন্তুর দাঁত, কড়ি, শিলনোড়া, শাঁখের টুকরো, ব্রাহ্মীলিপিযুক্ত বুদ্ধমূর্তি, পাথরের থালা, নালীযুক্ত পাত্র, ধাতু গলানোর মাটির বস্তু, বল, খেলনাগাড়ির চাকা, পোড়ামাটির জন্তু, বুদ্ধমূর্তি, লিপি সংবলিত নিবেদিত ফলক, ওজন মাপার বাটখারা, চুড়ি, তামার আংটি প্রভৃতি।

২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত খননের কাজ হয়। খুবইগুরুত্বপূর্ণ এবারের উৎখনন পর্ব। প্রতিবারের মতো এবারও নানান প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে খননকালে। সেইসঙ্গে পাওয়া গেছে খেলনাগাড়ির চাকা, গুলতির বল, পাশার ঘুঁটি, পুঁতি, চাকতি প্রভৃতি। সব থেকে আশ্চর্য ও অভিনব ব্যাপার ঘটেছে ২৪ জানুয়ারি। মোগলমারি প্রত্নক্ষেত্রের সংলগ্ন মাঠে বুদ্ধিষ্ট হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল হচ্ছিল ৩ দিন ব্যাপী। ২৪ তারিখ শুরুর দিন সেদিন পূর্ণিমা তিথি—সকালে উদবোধনী মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে—‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।’ আর ঠিক সেই সময় প্রত্নক্ষেত্রের একটি ট্রেঞ্চ থেকে প্রায় ১.৬০মি গভীর থেকে উত্তোলিত হচ্ছে একটার পর একটা মূর্তি। বিকেল পর্যন্ত মোট ৯৫টি (অক্ষত ও কয়েকটি ভগ্ন) সবগুলি ব্রোঞ্জ বা মিশ্র ধাতুর তৈরি বুদ্ধ, বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি এবং ভোটিভ স্তূপ। সব থেকে বড়ো বুদ্ধদেবের দন্ডায়মান মূর্তিটি দৈর্ঘ্যে ৪৩সেমি ও প্রস্থে ১৪সেমি। এক জায়গায় এত সংখ্যক মূর্তি সম্ভবত লুকোনো ছিল। এর থেকে প্রমাণিত উত্তর-পূর্ব ভারতের বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল এই বৌদ্ধমহাবিহার। সেদিন সারাদিন ধরে উৎসবে বৌদ্ধভিক্ষু, সন্ন্যাসী, গবেষক, বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক, অসংখ্য মানুষ ভিড় করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন। এমন অভূতপূর্ব ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই।

আর-একটি ঘটনা ঘটল ৭ মার্চ। অন্য একটি ট্রেঞ্চে পাওয়া গিয়েছিল মাটির আস্তরণে থাকা একটি প্রত্নবস্তু। ১মিটার ২৩সেমি গভীর থেকে প্রাপ্ত। ধীরে ধীরে পরিষ্কার করতে বোঝা গেল—ব্রোঞ্জের উপর সোনার প্রলেপ দেওয়া একটি মুকুটের অংশ। দৈর্ঘ্যে ৭সেমি, প্রস্থে ৪সেমি হয়তো এটি ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতে পারে। এই মূল্যবান প্রত্নবস্তু দেখতেও সেদিন অসংখ্য মানুষের ঢল নেমেছিল।

সাধারণের কাছে প্রত্নবস্তুর বহু টুকিটাকি বিষয় অজানা। ১০০ বছরের প্রাচীন যেকোনো বস্তুই প্রত্নতত্ত্বে আলোচনার বিষয়। হঠাৎ করে কুড়িয়ে পাওয়া কোনো ধাতুর মুদ্রা থেকে পোড়ামাটির মূর্তি, পাথর বা কাঠের তৈরি জিনিস সব কিছুরই সাধারণের কাছে বিশেষ গুরুত্ব নেই। মুদ্রার ক্ষেত্রে সাধারণের বিবেচনায় আসে এটা মূল্যবান ধাতু কিনা বা পোড়ামাটির পুতুলটা খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা। কিন্তু প্রত্নতত্ত্বে দু-টি বস্তু ভীষণভাবে মূল্যবান। ইতিহাসে বহু শাসকের নাম পাওয়া গেছে শুধুমাত্র মুদ্রার লিপি থেকে। অন্যদিকে মুদ্রাগুলির ধাতুমান, ওজন, খোদিত রাজার প্রতিকৃতি, খোদিত লিপি ইতিহাসে মূল্যবান উপাদান জোগায়। ভারত সরকার প্রচলিত The Indian Treasures Trove Act 1878 অনুযায়ী ১০ টাকার বেশি মূল্যের যেকোনো পুরাবস্তু মাটির নীচ থেকে পাওয়া গেলে তখনই জেলার জেলাশাসককে অবহিত করার নির্দেশ আছে। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থার নির্দেশও আছে। তেমনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের জন্য The Ancient Monuments and Archaeological Sites & Remains Act 1958 & Rules 1959 প্রচলিত আছে। দেশের যেকোনো জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের জন্য এই আইন প্রযোজ্য।

২০১৩ খ্রিস্টাব্দে রাজ্য সরকার এই প্রত্নস্থল অধিগ্রহণ করার পর সরকারিভাবে উৎখনন শুরু হয়েছে। এই তিন বছরে উৎখননে প্রায় ৬,৪০০ বর্গমিটারের মধ্যে প্রায় ১,৮০০ বর্গমিটার উৎখনন সম্ভব হয়েছে। অনুমান করা যায়, বাকি অংশ উৎখনন দ্রুততার সঙ্গে করা হবে। উৎখননে আবিষ্কৃত স্থাপত্য ও স্টাকো ভাস্কর্য সংরক্ষণ যথাযথভাবে করা হচ্ছে। এর জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মীরা সর্বদাই সজাগ রয়েছেন। ২০১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে উন্মোচিত ইটের স্থাপত্যে যথাযথ সংরক্ষণ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই সংরক্ষণে ব্যবহৃত চুন, সুরকি এবং ব্যবহৃত ইট সবই স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত হয়েছিল।

২০১৫-র উৎখননে আবিষ্কৃত বিশালাকার স্থাপত্য অনুরূপ সংরক্ষণের কাজ করা হয়েছে। প্রাচীন স্থাপত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চুন, সুরকি, বালি ও সামান্য চিটে গুড়ের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং এ বছরে জুন-জুলাই মাসে প্রবল বর্ষা উন্মোচিত স্থাপত্যের কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। দীর্ঘদিন মাটির নীচে থাকা স্থাপত্যকীর্তি ভেজা মাটি থেকে সোডিয়াম ক্লোরাইড বা লবণ সংগ্রহ করে। উৎখননের ফলে স্থাপত্যকীর্তি বাইরে এলে সোডিয়াম ক্লোরাইড বা লবণ স্ফটিকের আকার ধারণ করে যা স্থাপত্যের ক্ষতিসাধন করে এবং জলীয় বাষ্পের পরিমাণের তারতম্যের জন্য (আদ্রতা কমার জন্য) ভারসাম্য নষ্ট হয়। তার ফলে ইটের দেওয়ালে বহু সূক্ষ্ম ফাটলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় ও দেওয়ালগুলি আস্তে আস্তে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। উৎখনকের প্রথম কাজ হল এর যথাযথ সংরক্ষণ করা এবং এই স্থাপত্যকীর্তি থেকে লবণ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা। Paper pulp প্রযুক্তির সাহায্যে কাগজের মন্ড দেওয়ালের গায়ে প্রয়োগ করে ইটের দেওয়াল লবণমুক্ত করা হয় ও স্থাপত্যটি ক্ষতির হাত থেকে বঁাচানো হয়। ভেজা কাগজের মন্ডের আস্তরণ দেওয়ালে প্রয়োগ করার পর ৫ শতাংশ নাইট্রোসেলুলোজ বা ২ শতাংশ পলিভিনাইল অ্যাসিটেড-এর দ্রবণ প্রয়োগ করে স্থাপত্যটি বঁাচানোর চেষ্টা চলছে। স্টাকোর মূর্তিগুলি ও বিভিন্ন স্টাকো নকশাগুলিকে সংরক্ষিত করা হয়েছে। স্টাকোগুলি এতই ঝুরঝুরে ও ভঙ্গুর যে তাপমাত্রা ও আদ্রতার তারতম্যে আরও ক্ষতিসাধন হতে পারে। তাই আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে যে ফাইবারের ছাউনি দেওয়া হয়েছে তাকেও আধুনিক করার চেষ্টা চলছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার মোগলমারি সংরক্ষণে ২০১৫-তে ২ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। খুব শীঘ্রই জেলা প্রশাসনের সহায়তায় এ কাজ শুরু হবে এবং এই প্রত্নস্থলের নিকটে একটি মিউজিয়াম তৈরি হবে যার পরিকল্পনা চলছে, বাস্তব রূপ শীঘ্রই দেওয়া হবে। মোগলমারির এই সখিসোনা ঢিবি প্রত্নস্থলের ওপর তরুণ সেবা সংঘের যে ক্লাবঘরটি আছে এর স্থানান্তরকরণও জরুরি হয়ে পড়বে প্রত্নস্থলের প্রকৃত রূপ দিতে। আশা করা যায়, ক্লাব কতৃপক্ষ ও প্রশাসন যথাসময়ে এর উদ্যোগ নেবে ও সহযোগিতা করবে।

যেকোনো উৎখনন পরিচালনা করতে গেলে স্থানীয় প্রশাসন, জনসাধারণ, প্রত্নতত্ত্ব অনুরাগী, সহযোগী কর্মীবৃন্দ ও দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। মোগলমারি উৎখনন পরিচালনা করতে গিয়ে বহু মানুষের সাহায্য দরকার হয়েছে। কীভাবে ক্যাম্প স্থাপিত হবে, ক্যাম্প থেকে প্রত্নস্থলে যেতে প্রতিদিন যে গাড়িটি লাগবে তার ব্যবস্থা কীভাবে হবে, খননকাজ শুরু করতে গেলে যে সরঞ্জাম দরকার তার ব্যবস্থা করতে সর্বদাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় BDO অফিস। উৎখননে যে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আছে তা যথাযথভাবে পালন করেছেন খননকার্যে অংশগ্রহণকারী শ্রমিক, খননে যুক্ত গবেষক ও সহকর্মীরা। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন শিবির স্থাপনে পরপর দু-বছর জলসেচ দপ্তরের পরিদর্শন বাংলোর ব্যবস্থা হয়েছিল। এই বাংলো শিবির স্থাপনে বিশেষ উপযুক্ত।

স্থানীয় তরুণ সেবা সংঘের সম্পাদক মাস্টারমশাই গৌরীশঙ্করবাবু, অতনুবাবু এবং ক্লাবের অন্যান্য সদস্যরা এই খননকাজে ভীষণভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং আমাদের পাশে সর্বক্ষণ আছেন। গ্রামের প্রতিটি মানুষ এই খননকাজের ব্যাপারে আগ্রহী, সহযোগী ও দরদি। উৎখনন চলার সময় সবাই শৃঙ্খলা বজায় রেখেছেন এবং আমাদের অনুপস্থিতিতে প্রত্যেকে প্রত্নস্থলকে আগলে রাখেন। বিগত বছরগুলিতে উৎখনন কাজ করতে করতে বহু দক্ষ শ্রমিক তৈরি হয়েছে তাঁরা প্রত্নবস্তু ও প্রত্ন নিদর্শন আবিষ্কারে বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেছেন।

মোগলমারি উৎখননে যুক্ত দুই প্রত্নতাত্ত্বিককে এখানকার মানুষ সর্বদাই মনে রাখবেন। একজন অধ্যাপক ড. অশোক দত্ত ও দ্বিতীয়জন ড. অমল রায়। দু-জনেরই অল্প সময়ের ব্যবধানে জীবনাবসান হয়েছে। দুজনের মধ্যে মোগলমারি নিয়ে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছিল প্রত্নস্থলটি কেন্দ্রীয় সরকার না রাজ্য সরকারের অধীনে থাকবে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকার এটি অধিগ্রহণ করেছে এবং মোগলমারি আজ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস বইতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মোগলমারির প্রতি যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা পূর্ববর্তী দুই উৎখনকের ছিল বর্তমান উৎখনকেরও আছে এবং থাকবে। এই প্রত্নক্ষেত্রটির সম্পূর্ণ ইতিহাস, তথা এই অঞ্চলের সম্পূর্ণ ইতিহাস উন্মোচিত করতে হবে এই দায়িত্ব ও কর্তব্য আমাদের সকলের।

তথ্যসূত্র:

 • প্রত্নসমীক্ষা—পশ্চিমবঙ্গ সরকার, প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় অধিকার, I-VIII

 • IAR—ASI—1955-1956, 1956-1957, 1957-1958, 1958-1959, 1959-1960, 1960-1961, 1961-1962, 1963-1964, 1964-1965, 1971-1972।

 • পুরাবৃত্ত-১, প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় অধিকার

 • News Letter—CAST

 • Rajbaridanga—সুধীররঞ্জন দাস

 • Excavation of Pandurajar Dhibi—শ্যামচাঁদ মুখার্জি

 • 1963 Archaeological Discovery in West Bengal—পরেশচন্দ্র দাসগুপ্ত

 • Lithic Industry of Bankura, Puratattva, No-II

 • An Encyclopaedia of Indian Archaeology—A Ghosh

 • সম্প্রতি আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহার : জগজ্জীবনপুর — অমল রায়

 • ব্যক্তিগত যোগাযোগ

 • Excavation at Moghalmari, First Interim Report (2003-2004— 2007-2008) by Ashok Datta

 • এবং সায়ক—৩৮ বর্ষ, শারদ-২০১২; সম্পাদক : সূর্য নন্দী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *