মোগলমারিতে উৎখননের পর্যায়ক্রম (২০০৪-২০১২) – ফিরোজ খান
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন-১ ব্লকের অধীন মোগলমারি গ্রামটি দাঁতন শহরের ৬কিমি উত্তরে অবস্থিত। বেলদা থেকে মোগলমারির দূরত্ব ১০কিমি। খড়গপুর স্টেশন থেকে মোগলমারির দূরত্ব ৪৫কিমি। এই গ্রামের ৪কিমি পশ্চিম অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুবর্ণরেখা নদী। মোগলমারি আজ পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানরূপে চিহ্নিত হয়েছে। ড. অশোক দত্তের নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি বিভাগের খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ একটি বৌদ্ধবিহারের নিদর্শন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সাতবার খননকার্য সম্পন্ন হয়েছে, তারই প্রাপ্ত তথ্য নিম্নরূপ :
খননকার্য প্রথম পর্ব (২০০৩-২০০৪)
প্রথম পর্যায়ে (১০/৩/২০০৪ থেকে ১২/৪/২০০৪) খননকার্য শুরু করার জন্য মোগলমারির এই প্রত্নক্ষেত্রটিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। প্রথম ভাগটি ছিল ৮০মি × ৮০মি ঢিবির উপরের একটি অংশ। স্থানীয়ভাবে এই ঢিবিটিকে সেখানকার জনসাধারণ ‘সখিসোনার পাঠশালা’ বলে চিহ্নিত করে আসছেন। খননকার্যের এটি সবচেয়ে বড়ো একটি অংশ ছিল। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি ছিল বসবাসের এলাকার মধ্যে ৩০০মি স্থান। এটি মূল ঢিবির উত্তর-পশ্চিমদিকে অবস্থিত। তৃতীয় যে ভূখন্ডটি চিহ্নিত করা হয়েছিল সেটিও ছিল জনবসতির মধ্যে রাস্তার পাশের অংশ।
এই খননকার্যের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মাটির তলায় যুগ যুগ ধরে ঢেকে থাকা প্রত্ননিদর্শনের আবিষ্কার। খাড়াভাবে অত্যন্ত সন্তর্পণে খননকার্য শুরু হয়। মোট ১৪টি পৃথক পৃথক (৬মি×৬মি) গর্ত খোঁড়া হয়। পশ্চিম পাশে ৯টি গর্ত এবং দক্ষিণ পাশে ৫টি গর্ত। পশ্চিম পাশের গর্তগুলি খোঁড়া শুরু হতেই মাটির নীচে বিশালাকার ইটের স্থাপত্য আবিষ্কার হল। মোগলমারিতে ১৪টি পৃথক পৃথক গর্ত খোঁড়া সমাপ্ত হতেই পাওয়া গেল ইটের নানা কারুকার্যময় স্থাপত্য। দেওয়ালগুলির উচ্চতা ছিল প্রায় ১১৩সেমি এবং প্রস্থ ১.৮৯মি থেকে ২মি-এর মধ্যে। সবমিলিয়ে ২৬.৫৩মি লম্বা দেওয়াল মাটির তলা থেকে আবিষ্কার করা হল। এই দেওয়ালগুলির বাইরের অংশ সমান্তরাল ইট দিয়ে সাজানো ছিল কিন্তু ভিতরের দেওয়ালের মধ্যবর্তী চওড়া অংশ ভাঙা ইট দিয়ে পূরণ করা ছিল। উত্তরদিকের পাঁচটি গর্ত খননে যে দেওয়ালগুলি আবিষ্কার হল তা পশ্চিম পাশে প্রাপ্ত দেওয়ালের থেকেও চওড়া ছিল। দেওয়ালগুলি ছিল প্রায় ১০.৮৫মি লম্বা এবং চওড়া যথাক্রমে ২.৬৫মি এবং ২.৭৫মি। দেওয়াল লাগোয়া দু-টি চারকোণা চেম্বারও আবিষ্কার করা হয়েছিল, যার মাপগুলি ছিল যথাক্রমে ৩.২০মি × ২.৮০মি এবং ২.৮০মি × ২.৪৫মি। এগুলি বৌদ্ধমঠের অংশবিশেষ বলেই অনুমান করা হয়েছিল। এই খননকালে পাঁচটি গোলাকার ইটের স্তূপও আবিষ্কৃত হয়েছে। এই পিলারগুলির লক্ষণীয় দিক হল এখানে সুদৃশ্য গোল ইটের ব্যবহার করা হয়েছে।
খননকার্য দ্বিতীয় পর্ব (২০০৬-২০০৭)
১৫/২/০৭ থেকে ২৫/৩/০৭ দ্বিতীয় পর্বে খোঁড়া হয়েছিল ঢিবিটির পূর্ব ও দক্ষিণ ভাগ। পাওয়া গেছে দু-টি ল্যাটেরাইট স্টোন পিলার। ঢিবিটির উপরের অংশে পাওয়া গেছে বহু সংখ্যক মাটির প্রদীপ, অর্ঘ্যপাত্র। মাটির গামলা, কালো ও লাল রঙের পালিশ করা মৃৎপাত্র। এই পর্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আবিষ্কার ছিলভূমিস্পর্শ মুদ্রায় একটি বুদ্ধমূর্তি। ঢিবির পশ্চিম পাশের একটি গর্ত থেকে এই মূর্তির অংশগুলি পাওয়া যায়। ওই স্থানের দেওয়ালে চুনের প্লাস্টার ছিল। সৌভাগ্যের বিষয় মূর্তিটি ভগ্ন দশায় পাওয়া গেলেও মূর্তির প্রায় সমস্ত অংশ ওই স্থানে ছিল। ফলে ওগুলিকে জুড়ে মূর্তির একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়া গেল। এই বুদ্ধমূর্তিটির উচ্চতা ছিল ৯.৫ইঞ্চি এবং চওড়া ছিল ৫.৫ইঞ্চি। তবে বামপাশের কিছুটা অংশ পাওয়া যায়নি। সেই সময় অধ্যাপক ড. অশোক দত্ত জানিয়েছিলেন, ষষ্ঠ থেকে একাদশ শতকের গৌড়-রাঢ় এবং সংলগ্ন উৎকল সীমান্তে সমৃদ্ধ ছিল দন্ডভুক্তি রাজ্য। কান্যকুব্জ থেকে কর্ণাটক তামিলনাড়ু পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একটি দন্ডপথ সমুদ্র উপকূল ধরে এই রাজ্যের ভিতর দিয়ে প্রসারিত হয়েছে। বণিক, ব্যাপারী, শ্রেষ্ঠীর দল তাঁদের বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে এই পথেই যাতায়াত করতেন। তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে একটি শাখাপথ দন্ডভুক্তিতে এসে মিলেছে। সন্ন্যাসী-যতি-শ্রমণ-ভিক্ষুর দল পথের ধারেই বিহার-সংঘারামে আশ্রয় নিতেন। পূজার্চনাও করতেন। এই পথদন্ড দিয়েই চলত সামরিক অভিযান। সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী, ভূস্বামী ও বণিককুল তাঁদের দাক্ষিণ্যে, বিত্ত-সম্পদ দানে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে এই সুরম্য ও বিশাল স্তূপ বিহারটি গড়ে তুলেছিলেন। নবম-দশম শতকের পালশাসনেও ধর্ম ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্ররূপে এর প্রসিদ্ধি অক্ষুণ্ণ ছিল। দ্বিতীয় পর্বের খননকার্যের সময়েও পাওয়া গেল বৌদ্ধ স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ-এর আরও সন্ধান। এখানে ঢিবির তলাতেই বৌদ্ধমঠ থাকার প্রমাণ মিলেছিল। বিভিন্ন মাপের ইটগুলির আয়তন সর্বোচ্চ ৩৯সেমি এবং সর্বনিম্ন ২০সেমি। মঠের ভিতর রয়েছে ছোটো ছোটো সেল। যা থেকে স্পষ্ট ওইসব সেলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা থাকতেন। তাঁদের ঘোরার জন্যও রয়েছে বারান্দা, এমনকী দেওয়ালে প্লাস্টারের কারুকার্য করা রয়েছে। ব্রাহ্মীলিপিতে লেখা একটি সিল পাওয়া গিয়েছে। তাতে ‘শ্রীবর্ম’ নামে এক ব্যক্তির নাম পুরাতাত্ত্বিকরা পেয়েছেন। তাঁদের ধারণা, ওই ব্যক্তি হয়তো কোনোভাবে নির্মাণ কাজে যুক্ত থাকতে পারেন। তবে কোন রাজার আমলে তা তৈরি হয়েছিল, তা উদ্ধার করা যায়নি। সমস্ত কিছু দেখে পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা, এটি সপ্তম এবং অষ্টম শতাব্দীর কোনো এক সময় তৈরি হয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই জনপদ যে মুখরিত ছিল, তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এর সঙ্গে বিহারের নালন্দা, মুর্শিদাবাদের রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের মিল আছে। পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদ-সহ মালদহের নন্দদীর্ঘীকা নিয়ে মোট দু-টি এ ধরনের বৌদ্ধবিহার রয়েছে, তবে সেগুলির থেকেও মোগলমারি আকারে অনেক বড়ো।
খননকার্য তৃতীয় পর্ব (২০০৭-২০০৮)
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের খননকার্যে যে বৌদ্ধমঠ স্থাপত্যের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছিল, তৃতীয় পর্বের খননে ওই স্থাপত্য যে বৌদ্ধমঠেরই প্রাচীন স্থাপত্য সেটিই পুনরায় প্রমাণিত হল। এই বৃহৎ স্থাপত্যশৈলী নির্মাণে ৪২ রকমের ডেকোরেটিভ ইট ব্যবহার করা হয়েছিল। এতরকম সুসজ্জিত ইটের সুনিপুণ ব্যবহারের নিদর্শন থেকে সিদ্ধান্তে আসা গেল যে, ওই সময়ে স্থাপত্যবিদ্যা এবং প্রয়োগিক বিদ্যার খুব উন্নতমানের বিকাশসাধন হয়েছিল। প্লাস্টারে নানা রকমের কারুকার্যের আবিষ্কারও উপস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিকদের উৎসাহিত করেছিল।
খননকার্য চতুর্থ পর্ব (২০১০)
ড. অশোক দত্তের নেতৃত্বে চতুর্থ পর্বের খননকার্য শুরু হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ এবং সমাপ্ত হয় ২২ মার্চ ২০১০। মোগলমারিতে চতুর্থ দফার খননকার্যে একটি বৌদ্ধবিহারের অন্যতম প্রবেশদ্বার পাওয়া গিয়েছে। ড. অশোক দত্তের মতে, বিহারের মধ্যে একটি স্তূপ ছিল। স্তূপটির উত্তর দিকে ১১.৬মিটার চওড়া প্রবেশদ্বারটি পাওয়া গিয়েছে। দ্বারের ভিতরের দিকের দেওয়াল লাগোয়া কয়েকটি কক্ষও পাওয়া গিয়েছে। গঠনশৈলী দেখে মনে হচ্ছে, অন্তত তিনটি পৃথক পর্যায়ে বহু সময়ের ব্যবধানে এই বৌদ্ধবিহারটি গড়ে তোলা হয়েছিল। সুয়ান জাং ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে এসেছিলেন। তিনি এই এলাকায় যে বৌদ্ধবিহারগুলির কথা বলেছিলেন, এই বিহারটি তারই অন্যতম বলে আমরা মনে করছি।
ঐতিহাসিকদের অনুমান এই বিহারের নির্মাণকাল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যে। তারপরে এই বিহারটি অন্তত দু-বার সংস্কার হয়েছে। গঠনশৈলীর বৈচিত্র্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, দ্বাদশ শতাব্দীতেও এই বিহারের ভবনের সংস্কার হয়েছিল। পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন সময়ের মৃৎপাত্রও। ইতিহাসবিদদের তাই ধারণা, দীর্ঘদিন ধরে এই বৌদ্ধবিহারটি অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার একটি উৎকৃষ্ট কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। যে কারণে তারা ভবন সংস্কারের কাজে ভালো আর্থিক সহায়তাও পেত। এই দফার খননে পাওয়া গেছে বৌদ্ধভিক্ষুদের ব্যবহৃত বেশ কিছু মৃৎপাত্র, ইট ও শ্লেট পাথরে তৈরি বিভিন্ন আকারের পাত্র এবং পোড়ামাটির কাজ করা কিছু পাত্র। আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারের দেওয়ালে স্ট্যাকোর নানা অলংকরণও পাওয়া গিয়েছে। মোগলমারি গ্রামের প্রত্নক্ষেত্রটিকে ইতিমধ্যে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ।
চতুর্থ পর্বের খননকার্য শেষ হওয়ার পরদিন ২৩ মার্চ ২০১০, এই পর্বের উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। স্থানীয় মানুষের প্রবল উৎসাহ দেখা গিয়েছিল এই প্রদর্শনীটিকে ঘিরে। ভগ্নপ্রায় বৌদ্ধবিহারের পাশে দু-টি মন্ডপে আয়োজন করা হয়েছিল এই প্রদর্শনীর। একটি মন্ডপে ছিল আগের তিন দফার উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর ছবি। অন্য মন্ডপটিতে ছিল এ বারের খননে প্রাপ্ত সামগ্রী। প্রদর্শনীকে ঘিরে সকাল থেকে গোটা এলাকা মেলার চেহারা নেয়। দাঁতনের দু-টি ব্লক ছাড়াও কেশিয়াড়ি, নারায়ণগড়, মোহনপুর ব্লক এলাকা থেকেও অসংখ্য উৎসাহী মানুষ এসেছিলেন। পঞ্চায়েত সমিতির সভাকক্ষে সন্ধ্যে থেকে ছিল আলোচনা সভা। শিরোনাম ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মোগলমারি। আলোচক ছিলেন এই খননকার্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. অশোক দত্ত, ড. দুর্গা বসু এবং অধ্যাপক রজত সান্যাল প্রমুখ।
খননকার্য পঞ্চম পর্ব (২০১১)
পঞ্চম দফার খননকার্য ২৪/৩/১১ তারিখে শুরু হওয়ার ঠিক পূর্বেই মোগলমারিতে পাওয়া গেল একটি বুদ্ধমূর্তি। ২১/২ইঞ্চি লম্বা ও ৪ইঞ্চি চওড়া কালোপাথরেখোদিত ছোট্ট মূর্তিটি বড়ো কোনো বুদ্ধমূর্তির অংশবিশেষ বলেই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেছেন। মোগলমারি গ্রামের বাসিন্দা রবিশঙ্কর হাঁসদা একদিন সকালে ভগ্নস্তূপের পশ্চিমদিকের একটি অংশ থেকে বুদ্ধমূর্তিটি উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে স্থানীয় তরুণ সেবাসংঘ ও পাঠাগারের সদস্যদের নজরে বিষয়টি এলে তাঁরা মূর্তিটিকে সংঘের সংগ্রহশালায় নিয়ে আসেন। সাধারণত বুদ্ধমূর্তির পশ্চাৎপটে তাঁরই বিভিন্ন ভঙ্গিতে ধ্যান করার মূর্তি খোদাই থাকে। এখানে উদ্ধার হওয়া বুদ্ধের মূর্তিটিও সেই রকম ধ্যানরত। মূর্তির ডান হাত ডান পায়ের হাঁটুর উপরে রয়েছে। আর বঁা হাত রয়েছে কোলে। মূর্তিটির চারদিকে নানা কারুকাজ। বঁা দিকে বেদিতে পদ্মকলি খোদিত রয়েছে। যেটির কিছুটা অংশ ভাঙা।
পঞ্চমবার উৎখননে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হল মোগলমারির ধ্বংস স্তূপ থেকে। বোঝা গেল বৌদ্ধবিহারটির সামগ্রিক নকশা, উপর্যুপরি নির্মাণের সুস্পষ্ট তিনটি স্তর। উদ্ধার হওয়া স্ট্যাকোর তৈরি মস্তক (যেটি বুদ্ধমূর্তির অংশবিশেষ বলে অনুমান), টেরাকোটার ‘সিল’ ও উৎসর্গিত স্তূপের সাহায্যে সুপ্রাচীন ওই বৌদ্ধবিহার সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যাবে বলে আশা প্রত্নতাত্ত্বিকদের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান তথা মোগলমারি খননকার্যের অধিকর্তা অশোক দত্ত বলেন, ‘এবারের খননকার্যে প্রাপ্ত শিলালিপিটির পাঠোদ্ধার সম্ভব হলে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য জানা সম্ভব হবে।’ প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে, সংস্কৃত ভাষায় পূর্ব ভারতীয় সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে ওই শিলায় পাঁচ লাইনের বৌদ্ধ ধর্মপর্যায় রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও লিপিবিশারদ রজত সান্যাল বলেন, ‘বৌদ্ধধর্মের প্রসারকালে যে বাণীগুলি বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, এটি তারঅন্যতম।’ টেরাকোটায় ‘সিল’-টি পাওয়া গিয়েছে ভগ্নস্তূপের ভূমিতল থেকে ৭৪ সেন্টিমিটার গভীরে। এই প্রথম এই ধরনের ‘সিল’ মিলল মোগলমারিতে। ‘সিল’-টি অষ্টম-নবম শতকের বলে অনুমান রজতবাবুর। এবারের খননে স্ট্যাকোর তৈরি মস্তকের খন্ডটি মিলেছে ভগ্নস্তূপের ভূমিতল থেকে ১৭৫সেন্টিমিটার গভীরে,অনুমান সেটি বৌদ্ধবিহারের প্রথম নির্মাণকাল, অর্থাৎ ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর। অশোকবাবু জানান, বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা, লৌকিক-অলৌকিক কাহিনি, উপদেশ-ইতিকথা বৌদ্ধবিহারের বাইরের দেওয়ালে খোদাই করা থাকত। প্রাপ্ত ‘স্ট্যাকো হেডটি’ ভাঙা দেওয়ালের অংশবিশেষ বলেই অনুমান। উৎসর্গিত স্তূপটি রয়েছে ভূমিতল থেকে ৪২০সেন্টিমিটার গভীরে। বৌদ্ধবিহারের প্রদক্ষিণপথে বিভিন্ন আকারের ইট দিয়ে বঁাধানো গোলাকার। স্তূপটির নির্মাণ ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে। অশোকবাবু জানান, নালন্দায় এই ধরনের অসংখ্য স্তূপ পাওয়া গিয়েছে। বৌদ্ধবিহারে যাঁরা অর্থসাহায্য করতেন, সেইসব রাজা, বণিক বা শ্রেষ্ঠীদের পরিচয়বাহী স্তূপগুলি। স্তূপের কাছেই মিলেছে টেরাকোটার প্রদীপ।
এবার খননকার্যের ফলেই ৪৬.৮মি বাহুবিশিষ্ট বর্গাকার এই বৌদ্ধবিহারটির সামগ্রিক নকশা বোঝা সম্ভব হয়েছে। বৌদ্ধবিহারটি দু-বার ধ্বংস হয়েছে এবং প্রতি বারই ধ্বংসের পরে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান। নবম শতাব্দীতে প্রথমবার ধ্বংসের পরে দশম শতাব্দীতে পুনর্নির্মাণ করা হয়। ফের ধ্বংস হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব চলে যাওয়ার পরে ২১মি বাহুবিশিষ্ট বৌদ্ধবিহারটি শেষবারের মতো নির্মাণ করা হয়।
খননকার্য ষষ্ঠ পর্ব (২০১২)
২০১২-তে দু-টি পর্যায়ে মোগলমারিতে খননকাজ হয়। প্রথম পর্যায়ের উৎখনন হয় ১০/৩/১২ থেকে ২৫/৩/১২ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের খনন হয় ৬/৫/১২ থেকে ২৩/৫/১২ পর্যন্ত। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের খননে আর্থিক সহায়তা করেছেন দাঁতন ভট্টর কলেজের বৌদ্ধ বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র। দুই পর্যায়ের খননে যে সামগ্রিক বৌদ্ধবিহার স্থাপত্য আবিষ্কৃত হল, তাতে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান নালন্দার স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত এটিই পশ্চিমবঙ্গে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বৃহৎ বৌদ্ধবিহার। এই প্রথম ড. দত্ত বললেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই পশ্চিমবঙ্গের মৃত্তিকার আবরণে ঢেকে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে এটি অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন। এত বড়ো বৌদ্ধবিহার পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয়টি আর নেই। মূল বৌদ্ধ মন্দিরটির প্রস্থ ও দৈর্ঘ্য ৬০মি করে। সমসাময়িক দেওয়ালের স্টাকোর অপরূপ অলংকরণ এবারেও আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ধরনের অলংকরণ খুব কম জায়গাতেই পাওয়া গিয়েছে। এবারেও ২৬/৩/১২ তারিখে মোগলমারিতে সেমিনার হয়। বক্তা ছিলেন ড. অশোক দত্ত, ড. অমিত ভট্টাচার্য, ড. মণিকুন্তলা হালদার প্রমুখ। এবারেও প্রত্নপ্রদর্শনী হয়েছিল মোগলমারি তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগারের উদ্যোগে। অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীসহ উৎসাহী মানুষ প্রত্নক্ষেত্র পরিদর্শন করেছেন ও প্রদর্শনী দেখেছেন।*
* এই পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খননকার্য সম্পন্ন করেছেন। পরবর্তীকালে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব অধিকার সংযুক্ত হয়েছেন। —সম্পাদক