মোখা মুখি

মোখা মুখি

চল্লিশ বছর বয়স হতে চলল, এত দেশবিদেশ ঘুরলাম, এত সব আশ্চর্য অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম, তবু মুখোশ জিনিসটাকে এই বয়সেও আমি ভীষণ ভয় পাই।

আসলে এই ভয় পাওয়ার পেছনে আমার একটা যুক্তি আছে। কেন জানি না আমার মনে হয়, শরীরের মাধ্যমে যে অনুভূতির প্রকাশ আদপেই সম্ভব নয়, তা আদিম যুগ থেকে মানুষ মুখোশের মাধ্যমে প্রকাশের চেষ্টা করে। মুখোশের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে উন্মোচন করতে চায় কোন অবদমিত সত্ত্বাকে। সে সুন্দরবনের হিংস্র বাঘকে ঠেকানোর জন্য মাথার পেছনদিকে পরা মুখোশই হোক, কিংবা ফ্রান্সের ত্রোয়া ফেরে-র গুহাচিত্রে বল্গা হরিণের মুখোশ পরে থাকা পৃথিবীর প্রথম মুখোশধারী সেই আদিম মানুষটি, বিরুদ্ধ শক্তিকে লৌকিক-অলৌকিক উপায়ে ভয় দেখিয়ে বশীভূত করাই যেন সমস্ত মুখোশের প্রাথমিক উদ্দেশ্য।

যুদ্ধক্ষেত্র কিংবা বিনোদনমঞ্চ, কাল্পনিক শুভ অশুভ শক্তির সঙ্গে মনের গভীরের কোন ক্লেদ বা পিপাসা মিলিয়ে মিশিয়ে মুখোশের আড়ালে মানুষ যেন নিজেকেই আত্মগোপন করে।

আগে এত কিছু বিশ্লেষণ কখনও করিনি, মুখোশ নিয়ে খুব বেশি কখনও চিন্তাও করিনি। কিন্তু সম্প্রতি মুখোশের প্রতি আমার এই ভীতি জন্ম নিয়েছে এক অদ্ভুত হাড় হিম করে দেওয়া অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়ার পর।

খুলেই বলি তাহলে।

উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্নৌ শহরে গেলে আমি যত ব্যস্তই থাকি না কেন, তহসিনাগঞ্জের খাস বড়রাস্তার মোড়ে লস্যির দোকানের মালিক জনাব আজম খানের সঙ্গে দেখা করে আসতে কখনওই ভুলি না।

দেখা করার পিছনে একটা আকর্ষণ যদি ভদ্রলোকের দোকানের অমৃতসমান মালাই লস্যি হয়, প্রধান এবং মুখ্য কারণ অবশ্যই আজম খান নিজে। ভদ্রলোক জীবনে প্রচুর ঘুরেছেন, দেখেছেন। প্রতিবারই গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে আশ্চর্য সব মণিমুক্তোর সন্ধান পাই। কিন্তু এবারে যে এমন একটা রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হব, তা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। সত্যি বলতে কী, ঘটনাটা যতবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, ততবারই আমার গায়ের প্রতিটা রোম যেন খাড়া হয়ে উঠছে অবিশ্বাসভরা আতঙ্কে।

ভাবছি এমনও হয়? মানে, হতে পারে?

এবারে লক্ষ্নৌ পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। সেদিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরেরদিন সকাল হতেই একটা টাঙ্গা ডেকে চলেছিলাম আজম খানের দোকানের দিকে।

এখানে আমার একমাত্র মাসির বাড়ি। মাসি নিঃসন্তান, মেসোমশাই মারা যাওয়ার পর থেকে মাসি একেবারে একা হয়ে গেছেন। কাজেই, তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে আমাকে কলকাতা থেকে মাস তিন-চার অন্তর এসে খোঁজ নিয়ে যেতেই হয়। এমনিতে মাসি অবশ্য যথেষ্ট শক্তসমর্থ আছেন, সারা দিনরাতের জন্য একজন পরিচারিকাও থাকে সঙ্গে। তবু এই বয়সে একাকীত্বটা একটা সমস্যা, যে কারণে তিন-চারমাস কাটলেই কলকাতায় আমার মা অস্থির হয়ে ওঠেন, ”ওরে ইন্দ্র, অনেকদিন তো হল, দিদিকে তো একবার দেখে আসতে হয়। বেচারি এতবয়সে একা একা থাকে!”

মা নিজে বাতের ব্যথায় বেশিদূর যেতে পারেন না, অগত্যা আমাকেই কর্তব্যপালনে যেতে হয়। তবে তা অবশ্য আমার মন্দ লাগে না। এমনিতেই পৈতৃক ব্যবসার কল্যাণে আমাদের নিউমার্কেটের দোকানটায় খদ্দেরের অভাব হয় না, আর আমার বাবা সুবিবেচকের মত খাস কলকাতা শহরে তিন-চারটে বাড়ি তৈরি করে দিয়ে গিয়ে মাস গেলে মোটা ভাড়া পাওয়ার যে সুব্যবস্থা আমার জন্য করে গিয়েছেন, তাতে আমাকে কখনওই আজকালকার ছেলেদের মত ছোটাছুটি করতে হয়না, দিব্যি আয়েশেই কাটে জীবনটা।

আর তাছাড়া বরাবরই লক্ষ্নৌয়ের মত প্রাচীন ইতিহাস মাখানো শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াতে আমার বড় ভাল লাগে। পুরনো নবাব আমলের সারি সারি বাড়ি, তাদের খাঁজকাটা আলো-আঁধারি ঘুলঘুলি, খানদানী আসবাবপত্র, কিংবা টাঙ্গাগাড়িতে ঘোড়ার টগবগ, এইসবই আমায় নিয়ে চলে যায় কয়েক শতাব্দী আগের দিনগুলোতে। তার সঙ্গে জিভে জল আনা গলৌটি কাবাব কিংবা মালাই মাখনের সরস হাতছানি তো আছেই।

এখানে এলে তাই টাঙ্গা নিয়ে বেশিরভাগ সময়ে একা একাই ঘুরি। ভুলভুলাইয়া, রুমি দরওয়াজা, ইমামবাড়ার মত দ্রষ্টব্য স্থান তো বটেই, চক, শাহ মিনা রোডের মত জমজমাট এলাকার কান ঘেঁষে যে গলিঘুঁজিগুলো ঢুকে গেছে ভেতরে ভেতরে, সেগুলোও চষে বেড়াই। আমাকে একা পেয়ে ওরা সবাই যেন জ্যান্ত হয়ে ওঠে, নীরবে বলতে থাকে ফেলে আসা অতীতের কথা।

আর এভাবেই বছরতিনেক আগে একদিন হঠাৎ আলাপ হয়ে গিয়েছিল আজম খানের সঙ্গে। হুসেইনাবাদ ক্লক টাওয়ারের সামনে যে অনেকটা ফাঁকা জায়গা এখনও রয়েছে, সেইখানে ভদ্রলোককে একটা বড়সড় টাঙ্গার পাশে প্রথম দেখেছিলাম।

পরনে সিল্কের শেরওয়ানি কুর্তা, মাথায় সাদা ফেজ টুপি। থুতনির দাড়ি নেমে এসেছে প্রায় বুক পর্যন্ত। চুল, দাড়ি সব সাদা হলেও শরীরে কোথাও ভাঙ্গনের চিহ্ন নেই। ঋজু দোহারা গড়ন, টানটান ভঙ্গীতে তিনি হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

না, শুধু দাঁড়িয়েছিলেন বলা ভুল, টাঙ্গায় করে নিয়ে আসা মালাইয়ের শরবত বিশাল একটা জার থেকে মাটির ভাঁড়ে ঢেলে ঢেলে বিতরণ করছিলেন গরীব বাচ্চাদের মধ্যে।

আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। বাচ্চাগুলো রীতিমত ওঁকে ঘিরে হুটোপাটি করছিল, কে ক’টা নিতে পারে। হাসতে হাসতে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ঠেলাঠেলি করছিল, হইচই করছিল। কিন্তু আজম খানসাহেবের মুখে কোন বিরক্তি ছিল না, বরং খেলা করছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। তাঁর টাঙ্গার চালকও একনাগাড়ে সাহায্য করে যাচ্ছিল।

প্রায় আধঘন্টা পর সব মালাই ফুরিয়ে যেতে শেষের বাচ্চাদুটোর মাথায় হাত রেখে চোখ বুজে আশীর্বাদের ভঙ্গীতে কিছু বিড়বিড় করলেন আজম খান, তারপর গাড়িতে ওঠার তোড়জোড় করতে লাগলেন।

আর তখনই গিয়ে আমি আলাপ করেছিলাম মানুষটির সঙ্গে। জেনেছিলাম আজম খান আদতেই একজন আশ্চর্য মানুষ। পেশায় তিনি ছিলেন লক্ষ্নৌ কোর্টের উকিল। বিশাল কিছু পসার না থাকলেও রোজগার খুব মন্দও ছিল না। কিন্তু বছরদশেক আগে কি হল, ওকালতিতে হঠাৎই বৈরাগ্য জন্মাল তাঁর। সব ছেড়েছুড়ে বেশ কিছুদিন উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ালেন, তারপর তহসিনাগঞ্জে নিজের সব জমানো পুঁজি দিয়ে দুম করে একটা লস্যির দোকান খুলে বসলেন।

দোকান চালানোর কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় সেই দোকান রমরম করে চলতেও শুরু করল। কিন্তু আজও কর্মচারীরাই সব দেখে, উনি শুধু নিয়মমাফিক একবার করে গিয়ে বসেন রোজ। সংসার করেননি, তাই কোন পিছুটানও নেই। মজা করে বলেন, ”লক্ষ্নৌ নিজেই একটা জীবন্ত ইতিহাস জনাব! এখানে প্রতিটা ইট, পাথর, মাটিও বুকে চেপে বেড়াচ্ছে কত রকমের গল্প। শুধু তা শোনার জন্য কান চাই। হা হা!”

সেই শুরু। তারপর থেকে যতবার এসেছি, দেখা করেছি। আমি স্বভাবের দিক থেকে এমনিই আবেগপ্রবণ, তার ওপর মানুষটার বিচিত্র অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে কখনও অবাক হয়ে গিয়েছি, কখনও স্থবির হয়ে গিয়েছি।

কিন্তু আজ যখন তাঁর দোকানের সামনে টাঙ্গা থেকে নামলাম, দেখলাম তিনি নিজেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসছেন দোকান থেকে।

না, আমাকে দেখতে পাননি, কোন কারণে গভীর চিন্তায় মগ্ন তিনি। একেবারে কাছে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠলেন, ”আরে! লাহিড়ী সাহাব, আপনি! কবে এলেন বঙ্গাল থেকে?”

”এই তো। গতকালই এসেছি।” আমি হাসিমুখে এগিয়ে খাঁ সায়েবের হাত ধরে উষ্ণ করমর্দন করলাম, ”কোথাও বেরোচ্ছেন নাকি? পরে আসব তাহলে?”

খাঁ সাহেবের মুখে আমাকে দেখে যেটুকু হাসি এসেছিল, তা আমার প্রশ্নে উবে গেল।

কী একটা চিন্তা করতে করতে তিনি মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, ”একটা বড় মুশকিলে পড়ে গেছি লাহিড়ী সাহাব! আমাকে এখনই একবার একজায়গায় যেতে হবে। আপনি যদি মেহেরবানি করে সঙ্গে চলেন তো যেতে যেতে কথা বলা যাবে।”

আমি তো এসেইছি আড্ডা মারার জন্য, কাজেই খাঁ সাহেবের সঙ্গে না যাওয়ার কিছু নেই। আমি স্বচ্ছন্দে প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে খাঁ সাহেবের পিছু পিছু তাঁর নিজস্ব টাঙ্গায় উঠে বসলাম। টাঙ্গাচালক মুখে কিছু একটা শব্দ করে হাতের চাবুকটা আলতো করে ঘোড়ার গায়ে ঠেকাতেই ঘোড়াটা চিঁহিঁহিঁ শব্দ করে চলতে শুরু করল ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই টাঙ্গা চলে এল চকে। চক লক্ষ্নৌয়ের বিশাল জমজমাট একটি বাজার এলাকা। সেখানে মনিহারী থেকে জামাকাপড়, আসবাব থেকে প্রসাধন, পাওয়া যায় না এমন কোন জিনিস নেই। চারপাশে অজস্র অটোরিকশা, টাঙ্গা, দু-চাকা আর চারচাকার ক্যাঁচরম্যাচরের মধ্যে দিয়ে আমাদের টাঙ্গাটা মন্থর গতিতে চলছিল।

টাঙ্গায় ওঠা থেকে খাঁ সাহেবের ভ্রূদুটো কুঁচকে রয়েছে, মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

আমি বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম, ”কী হয়েছে খাঁ সাহেব? সব ঠিক আছে তো?”

আজম খাঁ আমার প্রশ্ন শুনে যেন চমকে উঠলেন, তারপর একমুখ দাড়ি দুলিয়ে একটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে বসলেন, ”আচ্ছা সাহাব, আপনার বাড়ি তো কলকাত্তায়। বঙ্গালে দিনাজপুর বলে কোন জায়গা আছে?”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, ”হ্যাঁ, আছে তো। একটা নয়, দুটো জেলা আছে। উত্তরবঙ্গে। উত্তর দিনাজপুর আর দক্ষিণ দিনাজপুর। কেন হঠাৎ?”

আজম খাঁ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ”আর বলবেন না। ওই দিনাজপুর থেকে একটা ছেলে এসেছিল লক্ষ্নৌ ঘুরতে, ছেলেটা দিনাজপুরেরই কোন স্কুলে পড়ায়। দোকানে লস্যি খেতে এসে আমার সঙ্গে আলাপ হয়, তারপর যেমন হয়, বুঝতেই পারছেন, আমি তো মজলিশি মানুষ, আড্ডায় জমে যাই। তো সেই ছেলেটাকে নিয়ে তিনচারদিন আগে আমি একবার নখাশ বাজারে যাই।”

”নখাশ বাজার মানে সেই পুরনো বাজার যেখানে পশুপাখি বেচাকেনা হয়?” আমি বাধা দিয়ে বললাম।

আজম খাঁ মাথা নাড়লেন, ”শুধু পশুপাখি কে বলল লাহিড়ী সাহেব, কাঠের কাজ, গয়না আরও অনেক কিছু বিক্রি হয়। নখাশ বাজার এই শহরের সবচেয়ে পুরনো বাজার, তিন-চারশো বছরের তো হবেই! তো, ওকে নিয়ে এমনিই ঘুরছিলাম, টুকটাক জিনিসপত্র দেখছিল ছেলেটা, কিন্তু কিছুই ওর পছন্দ হচ্ছিল না। হঠাৎ ওখানকারই এক দোকানদারের কাছ থেকে ও জানতে পারে প্রতি শুক্রবার রাত দুটো থেকে চারটে নখাশ বাজারে পুরনো অ্যান্টিক জিনিস লুকিয়ে বেচাকেনা হয়। আর তখনই ছেলেটা আমার কাছে বায়না ধরল আমাকেও ওর সঙ্গে যেতে হবে।”

”রাত দুটো থেকে চারটে? প্রতি শুক্রবার?” আমি অবাক হয়ে বললাম, ”সত্যিই হয় নাকি?”

আজম খাঁ মাথা নেড়ে সায় দিলেন, ”হাঁ জনাব! লক্ষ্নৌতে এখনও হাজার হাজার রইশ ফ্যামিলি আছে যারা ভুখা মরছে আর পূর্বপুরুষের সব অ্যান্টিক জিনিস বেচেবুচে দিন চালাচ্ছে। তারাই গোপনে এসে ওখানে সব পুরনো আইটেম বিক্রি করে। সে আপনি নবাব মহম্মদ আলি শাহ’র নস্যির ডিবে থেকে আরম্ভ করে ওয়াজেদ আলির চশমা, সবরকম জিনিস পাবেন। সঙ্গে আমীর-ওমরাহদের জিনিস তো আকছার। সরকারী অকশন হাউজে অনেক ঝামেলা, অন্য শরিকেরা ঝামেলা করতে পারে, তাই এখানে রাতের অন্ধকারে এইসব কারবার চলে। লাভ কিছু কম হলেও বিক্রি তো করা যায়। পুলিশ সবই জানে, মাঝে মাঝে ঝামেলাও হয়। তারপর আবার যে কে সেই।”

”আচ্ছা। আমাকেও তবে একদিন ঢুঁ মারতে যেতে হয়।” আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম।

”সে যাবেন ‘খন।” খাঁ সাহেব বললেন, ”এখন শুনুন। সুপ্রকাশ, মানে ওই ছেলেটা নখাশে মাঝরাতে ঢুকেই একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল। চারপাশে এত জিনিস, ও কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে ঠিক করতে পারছে না। একদিকে সুলতান আমলের ছড়ি, বোতাম, দাবার বাক্স, অন্যদিকে বেগমসাহেবাদের গয়নার বাক্স থেকে শুরু করে হাতির দাঁতের চিরুনি। আর অকশন হাউজের থেকে দাম অনেকটাই কম। আমি তো আগেও গিয়েছি বারকয়েক, সুপ্রকাশের পাশে পাশে হাঁটছি আর ওর পাগলপান্তি দেখে মিটিমিটি হাসছি। এইভাবে রাত যখন প্রায় ভোর হয় হয়, তখনই চোখে পড়ল সেই মুখোশটা।”

”মুখোশ?”

রাস্তার কোন গর্তে পড়েছে মনে হয় একটা চাকা, জোরে ঝাঁকুনিতে খাঁ সাহেব চেপে ধরলেন টাঙ্গার একদিক, তারপর ফ্যাকাশেভাবে বললেন, ”হ্যাঁ জনাব, একটা মুখোশ। সেটা দেখেই সুপ্রকাশ যেন হামলে পড়ল। মুখোশটা বিক্রি করতে বসেছিল একটা দেহাতী জেনানা। তার সঙ্গে আরও অনেক জিনিস ছিল, বেশিরভাগই স্টাফ করা পশুপাখি, কিন্তু সবার অলক্ষ্যে একপাশে পড়েছিল ওই মুখোশটা। একটাই ছিল। আর সুপ্রকাশের ওটারই ওপরই নজর পড়ল।”

আমি আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু দেখলাম একটা মাঝারি মানের হোটেলের সামনে আমাদের টাঙ্গাটা থেমে গেছে।

আজম খাঁ নেমে বললেন, ”আসুন লাহিড়ী সাহেব, এই হোটেলেই উঠেছে সুপ্রকাশ।”

হোটেলটা আহামরি কিছু নয়, ওই বাজার এলাকায় যেমন ব্যাঙের ছাতার মত হোটেল থাকে, তেমনই একটা। একতলায় রিসেপশনে বসে আছে একটা মাঝবয়সী লোক, সে একঝলক আমাদের দিকে তাকিয়ে আজম খাঁ সাহেবের দিকে চেয়ে অল্প হেসে আবার নিজের কাজে মন দিল।

আমি বুঝলাম খাঁ সাহেব ইদানীং এই হোটেলে মাঝেমাঝেই আসছেন।

খাঁ সাহেব লিফটের দিকে না গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলেন। বাইরে জোরে কোন একটা ধুমধাড়াক্কা গান বাজছে। সেই গানের ফাঁকে ফাঁকে আজম খাঁ ফিসফিস করলেন, ”আসলে ছেলেটা আমার সঙ্গেই কয়েকদিন ঘুরছিল তো, একা মানুষ বিদেশবিভূঁইয়ে এসেছে, আমার একটা দায়িত্ব তো থেকেই যায়!”

আমি বললাম, ”কিন্তু চিন্তার কী আছে?”

আজম খাঁ আমার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, ”সেটা ওই ছেলেটাকে দেখলেই বুঝবেন। আপনারা দুজনেই বাঙালি, দেখুন যদি কিছু হেল্প করতে পারেন। ওইজন্য আরও আপনাকে নিয়ে এলাম।” বলতে বলতে দোতলায় উঠে বাঁ হাতে যে প্রথম ঘরটা পড়ল, তার বেল বাজালেন তিনি।

প্রায় তিন মিনিট অপেক্ষা করার পর যে দরজা খুলল, তাকে দেখে বেশ চমকেই গেলাম। চমকানোর কারণ হচ্ছে ছেলেটার বিপর্যস্ত মুখচোখ। এমনিতে সুশ্রী হলেও তাতে যেন কালির প্রলেপ ফেলেছে কেউ। বয়স পঁচিশের নীচেই হবে, চুল উসকোখুসকো, চোখদুটো রক্তবর্ণ হয়ে রয়েছে। মুখে বেশ কয়েকদিনের না কাটা দাড়ি জঙ্গলের মত এবড়োখেবড়োভাবে বেড়ে উঠেছে।

ছেলেটা দরজা খুলেছিল প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে, কিন্তু আজম খানকে দেখে সেই বিরক্তি লোকানোর চেষ্টা করতে করতে জড়ানো হিন্দিতে বলল, ”ওহ আপনি! আসুন।”

আজম খাঁ আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ”তোমার দেশের লোককে নিয়ে এলাম সুপ্রকাশ।” তারপর আমার দিকে ইশারা করে বললেন, ”ইনি হলেন ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ী। কলকাতার বাঙালি। আমার অনেকদিনের বন্ধু, বলতে গেলে জিগরি দোস্ত। উনি এখানে এলেই আমরা দেখাসাক্ষাৎ করি।”

সুপ্রকাশ বলে ছেলেটা যেন আমাকে দেখেও দেখল না। কেমন একটা উদ্ভ্রান্তের মত এগিয়ে গেল ঘরের ভেতরদিকে, আর আমার গাটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠল। গোটা ঘরটায় একটা কী অসম্ভব দুর্গন্ধ। কোন জৈব পদার্থ বন্ধ ঘরের মধ্যে দিনের পর দিন রেখে দিলে যেমন পচা গন্ধ ছাড়ে, অনেকটা তেমন।

সুপ্রকাশ ঘরের কোণা থেকে দুটো চেয়ার এনে আমাদের সামনে পেতে দিয়ে নিজে খাটে বসতে বসতে বলল, ”বলুন, কী ব্যাপার!”

আজম খান এবার সামান্য গলা চড়িয়ে বললেন, ”সুপ্রকাশ। তোমার তো গতকাল বাড়ি ফেরার ট্রেন ছিল। ফিরলে না কেন?”

”আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম খাঁ সাহেব, এইভাবে এখান থেকে আমার পক্ষে যাওয়া এখন সম্ভব নয়।” সুপ্রকাশ কিছুটা বিরক্ত হয়ে জবাব দিল।

আজম খান এবার আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্তভাবেই বললেন, ”সুপ্রকাশ সেদিন নখাশ বাজার থেকে একটা মুখোশ কিনেছে লাহিড়ী সাহেব। সেই মুখোশ নাকি রাতের বেলা জ্যান্ত হয়ে উঠছে, আর সুপ্রকাশের কাছে অনেকরকমের বক্তব্য পেশ করছে। কী করা যায় বলুন তো?”

আজম খানের কথার মধ্যে যে বেশ কিছুটা উপহাস প্রচ্ছন্ন রয়েছে, তা বুঝতে পেরে সুপ্রকাশ একটু কড়া গলাতেই বলল, ”ওটা মোটেই মুখোশ নয় খাঁ সাহেব। ওটা মোখা।”

”মোখা কী?” খাঁ সাহেব কিছু বলার আগে আমি জানতে চাইলাম।

সুপ্রকাশ এবার আমার দিকে তাকিয়ে তিরিক্ষি গলায় বলল, ”আমাদের দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে এই মোখা বানানো হয়। আমি দেখেই চিনেছি। এমন জিনিস যে লক্ষ্নৌতে এসে দেখতে পাব, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তাই কিনে ফেলেছিলাম। কিন্তু এই মোখাটা শুধুই একটা মোখা নয়।”

”কিছু যদি না মনে করেন।” আমি ছেলেটার মেজাজ বুঝে নরম স্বরে বললাম, ”আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তো বলবেন কী হয়েছে? আপনার তো দিনাজপুরে বাড়ি?”

”জানি না বলে কী লাভ হবে। আমার সমস্যা আমাকেই মেটাতে হবে। তবু আপনি যখন জানতে চাইছেন, বলছি।” সুপ্রকাশ এবার কিছুটা শান্ত হয়ে বলতে শুরু করল, ”দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডিতে আমার বাড়ি। ওখানেই মহকুমাশহর গঙ্গারামপুরের একটা প্রাথমিক স্কুলে আমি পড়াই। বলতে পারেন ঘুরতেই এসেছিলাম এখানে। এখানে এসে আলাপ হয় খাঁ সাহেবের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে নখাশ বাজার ঘুরতে যাই। আর সেখানে গিয়ে খুঁজে পাই ওই মোখাটা।”

কথাটা শেষ করে সুপ্রকাশ এবার উঠে গিয়ে ঘরের এক কোণে রাখা ছোট্ট টেবিলটার ওপর থেকে যেটা নিয়ে এল, সেটা ওর কাছে যাই হোক না কেন, আমার কাছে নেহাতই একটা মুখোশ। সেইরকমের মুখোশ, যেগুলো গ্রামের দিকের লোকগীতির সঙ্গে নৃত্যে মানুষ পরে থাকে।

কাঠের ছাঁচের ওপর ধেবড়ানো রঙ করা, বড় বড় চোখ আর কালো মিশমিশে শনের মত চুল। আকারে সাধারণ মুখোশের তুলনায় অবশ্য বেশ খানিকটা বড়।

সুপ্রকাশ যেন ওর কোলে কোন সদ্যোজাত শিশুকে সন্তর্পণে ধরেছে, এইভাবে পরম মমতায় মুখোশটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ”আপনি জানেন কিনা জানিনা, দিনাজপুরের হেমতাবাদ, ইটাহার, কুশমন্ডির মত এলাকার গ্রামে গ্রামে এই মোখা বানানোর শিল্প অনেক প্রাচীন। প্রাচীন বলতে সেই মধ্যযুগ থেকে চলে আসছে। রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণের নাম শুনেছেন কি?”

আমি মাথা নাড়লাম। এইসব পুরাণ-টুরানের ব্যাপারে আমার আগ্রহ চিরকালই কম। মুখে বললাম, ”না।”

সুপ্রকাশ বলল, ”প্রায় এক হাজার বছর আগের বাংলার কবি ছিলেন রামাই পণ্ডিত। তাঁরই লেখা কাব্য শূন্যপুরাণ। তাতেও আমাদের এই মোখাশিল্পের উল্লেখ রয়েছে। তবেই বুঝুন এগুলো কত পুরনো। রাজবংশীরা বহুকাল ধরে তৈরি করে আসছে। আমিও রাজবংশী, আমার পূর্বপুরুষও এই কাজে যুক্ত ছিলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এত প্রাচীন হলেও মোখা কিন্তু কখনওই দিনাজপুরের বাইরে তেমন বেরোয়নি। সেখানে এতদূরে, এই লক্ষ্নৌতে এর দেখা পাওয়াটা আশ্চর্যের নয় কি?”

”হ্যাঁ তা তো একটু আশ্চর্যের বটেই।” আমি একটু ইতস্তত করলাম, ”এটা কি কাঠের?”

সুপ্রকাশ বলল, ”হ্যাঁ। অনেকরকম গাছের কাঠ দিয়ে মোখা তৈরি করা হয়। কখনও ছাতিম গাছ, কখনও আবার আম, গামারি, পাকুড় বা নিম। এইসব কাঠের ঠুং দিয়ে কাঠামো বানিয়ে কুঁদে কুঁদে চোখমুখ আঁকা হয়।”

”সবই বুঝলাম।” আজম খাঁ এতক্ষণ পরে মুখ খুললেন, ”তুমি নিজের দেশের জিনিস এখানে দেখতে পেয়েছ, সেটা কিনেওছ, খুব ভাল কথা, কিন্তু তাই বলে তুমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছ না কেন? এইভাবে সারাদিন নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী রাখার কী মানে? আমি তো তোমার বাড়ির লোককে চিনিও না, আমি খবরও দিতে পারছি না। তোমার বাবা-মা কি ভাবছেন …।”

সুপ্রকাশ বলল, ”আমার বাবা-মা কেউ নেই।”

”তবুও …!” আজম খাঁ বলে উঠলেন, ”তোমাকে দেখে কেমন একটা লাগছে। চুল-দাড়ি কাটছ না, ঘর থেকে কোথাও বেরচ্ছ না …!”

সুপ্রকাশ এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ”আসলে খাঁ সাহেব, গত পরশু রাতে এই মোখাটা বাড়ি নিয়ে আসার পর থেকে আমি এক মুহূর্ত ঘুমনো তো দূর, স্থির হয়ে বসতে পারিনি। মনে হচ্ছে এই ঘরে আমি ছাড়াও আর একজন জ্যান্ত কেউ রয়েছে। কাল সারাটা দিন এই হোটেলের ঘরেই শুয়ে শুয়ে ছটফট করেছি, নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে বুঁদ হয়ে থেকেছি।”

”কিন্তু কেন?” আজম খান এবার একটু অধৈর্য হয়ে উঠলেন, ”তুমি তো নখাশে মাঝরাতে গিয়েইছিলে অ্যান্টিকের খোঁজে।”

”অ্যান্টিকের খোঁজে ঠিক নয়। আসলে খাঁ সাহেব, আমার এবারের লক্ষ্নৌ আসাটাও খুব অদ্ভুতভাবে হয়েছে। আমার এখন এদিকে আসার কোন পরিকল্পনাই ছিল না।” সুপ্রকাশ বলল, ”এখন তো স্কুলে পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার পর আমাদের গ্রামে উৎসব আছে, তখনই ছুটি নেওয়ার ঠিক ছিল। হঠাৎ কী যে হল, দুম করে লক্ষ্নৌয়ের টিকিট কেটে ফেললাম। নখাশ বাজারের নামটাও যেন কোথায় শুনেছিলাম, এসে থেকেই মনে হতে লাগল একবার ওখানে যেতে হবে। মনের মধ্যে কে যেন বারবার তাড়া দিচ্ছিল নখাশে যাওয়ার জন্য।”

আজম খান বললেন, ”যাই হোক, মনে হয়েছে এসেছ, ঘুরেছ, সেখানে নিজের জায়গার একটা স্মৃতি পেয়েছ ভাল কথা। তা নিয়ে এত বিচলিত হওয়ার কি হল আমার তো মাথায় ঢুকছে না।”

”এটা স্মৃতি নয় খাঁ সাহেব। এটা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।” সুপ্রকাশ বলতে বলতে মাথার দুপাশ যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে এইভাবে টিপে ধরল, তারপর কিছুক্ষণ পর একটু সুস্থির হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ”আপনাদের পুরোটা খুলেই বলছি শুনুন। আমি যখন দশ বছরের, তখন একটা ঘটনা ঘটেছিল। আজ থেকে ঠিক বারো বছর আগে।”

”কী ঘটনা?” আজম খান বেজার মুখে জানতে চাইলেন।

”আমার পূর্বপুরুষদের মত বাবা আর কাকাও ছিলেন মোখাশিল্পী। তখন গ্রামে বাবার নাম মোখা তৈরিতে ছিল সবচেয়ে বেশি। আমরা তখন থাকতাম কুশমুন্ডি থেকে আরও ভেতরে ত্রিমোহিনী বলে প্রত্যন্ত একটা গ্রামে। সেই গ্রামের সবাই ছিল প্রচণ্ড গরীব। এই মোখাগুলো প্রধানত কিনত মোখানাচের দলগুলো, যারা সারা বছর ঘুরে ঘুরে পরবে নাচগান করত। তাতে ক’টাকাই বা আয় হত। মোখাশিল্পীরা তাই অন্যসময় চাষবাস করত, কেউ আবার শহরে গিয়ে দিনমজুরিও করত।”

”কীসের নাচগানের দল?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

”আমাদের ওদিকে সারাবছর ধরেই পরব লেগে থাকে। গম্ভীরার নাচ, জিতুয়া পুজো, চণ্ডীমনসার গান এইসব উৎসব হলেই সেখানে মোখা পরে নাচের অনুষ্ঠান হবেই। অনেকসময় রামায়ণ, মহাভারতের গল্প নিয়েও পালা হয়, তাতেও মোখা পরে নাচে নৃত্যশিল্পীরা।” সুপ্রকাশ এবার একটু থেমে সঙ্কুচিত গলায় বলল, ”আমিও ছোটবেলায় ওই নাচ জানতাম। টুকটাক নাচতামও। উৎসবে পার্বণে বড়রা এক-আধ পয়সা দিলেই খুশি হয়ে যেতাম। এটা আমাদের ওদিককার একটা ট্র্যাডিশন।”

আমি বললাম, ”অনেকটা পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মত বোধ হয়, নাকি?”

”হ্যাঁ, বলতে পারেন। তবে মোখা নাচ অনেক কঠিন, আর তার অনেকরকম নিয়মকানুন আছে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলে ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়ে আসে। আমাদের গ্রামে বাবা, কাকা বা অন্যান্য শিল্পীরা সারাবছর ধরে খেটেখুটে মোখা বানাতেন। আর আমরা ভাইবোনেরা বাবার চারপাশে গোল হয়ে বসে দেখতাম কীভাবে একটা সাধারণ কাঠ আস্তে আস্তে একটা মূর্তির রূপ নিচ্ছে। আমাদের অভাব ছিল প্রচণ্ড, কিন্তু দুঃখ বা অতৃপ্তি খুব একটা ছিল না।” সুপ্রকাশের গলাটা এবার হঠাৎ ধরে এল, ”সেইসময়েই ওই ঘটনাটা ঘটল।”

আজম খান উৎসুক চোখে বললেন, ”কী ঘটনা?”

”দিনাজপুরের ওই এলাকায় একটা মস্ত উৎসব হল গম্ভীরার নাচ। এখন অবশ্য সেটা লোকের মুখে মুখে গমীরার নাচ হয়ে গেছে। গমীরার নাচ শুরু হয় প্রতিবছর চৈত্রমাসের সংক্রান্তিতে, চলে আষাঢ় মাসের অম্বুবাচী পর্যন্ত। এইসময় বাবার মত সব মোখাশিল্পীরাই খুব ব্যস্ত থাকতেন। অনেক মোখা বানানোর বায়না আসত। দিনরাত এক করে হলেও সবকটা বানাতেন বাবা। কাকাও তাই। কারণ এইসময়ের রোজগারেই বলতে গেলে সারাবছর চলত আমাদের। বাবা বা কাকা অন্যদের মত দিনমজুরি করতে বাইরে যেতেন না।” সুপ্রকাশ একটা দম নিল, ”যে বছরের কথা বলছি, সেটা ছিল কালগম্ভীরার বছর।”

”সেটা কী?”

”গম্ভীরা নাচ প্রতিবছর হয়, কিন্তু বারোবছর অন্তর হয় কালগম্ভীরা। অনেকটা মহাকুম্ভের মত। সেইবছর অন্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি ধুমধাম হয়, নিয়ম শৃঙ্খলাও অনেক কঠোর থাকে। সবাই বলে, গম্ভীরা নাচের প্রধান দেবতা উড়ানকালী এই কালগম্ভীরার সময় সটান গ্রামে নেমে আসেন। সামান্য উপাচারের ভুলে দেন কঠোর শাস্তি।

”সেবার বাবা নিজে অনেকগুলো মোখা বানিয়েছিলেন। গমীরার নাচের আসল দেবতা হলেন উড়ানকালী। তাঁর মোখা তো বটেই, এছাড়া বাঘ-ভাল্লুক, জটাপাখি, ভদ্রকালী, চ্যাংকালী, দানো, স্বর্গপেইরী এরকম সব স্থানীয় দেবতা-উপদেবতার অনেক মুখোশ। সব বানানো হয়ে গেলে অম্বুবাচী তিথিতে গমীরা উৎসব যখন শুরু হয়ে যায়, তখন মোখাশিল্পীরা সবাই নিজেদের মধ্যে একটু আনন্দ-ফুর্তি করেন। আনন্দ মানে কিছুই না, একটু মুর্গির মাংস, হইহুল্লোড় এইসব। ওদিকে তখন ফুলঝারি শুরু হয়ে গেছে।”

”ফুলঝারি কী?” আমি বললাম।

সুপ্রকাশ বলল, ”ফুলঝারি দিয়েই কালগমীরা উৎসবের শেষ নাচ শুরু হয়। সেবকরা বাঘ ভাল্লুক, বুড়োবুড়ি এইসব মোখা পরে গোটা গ্রাম ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি সিধা তোলে। সেই সিধা তোলাকে বলে মাঙন। এইভাবে এগারো বারোদিন ধরে সিধা তোলার পর সবাই গমীরাতলায় জড়ো হয়। তখন সমস্ত দেবতা এবং উপদেবতার মোখাগুলোয় মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে প্রাণদান করেন রাজবংশী পুরোহিতরা। শুরু হয় নাচ। মুখোশ পরে নাচতে থাকে মোখাশিল্পীরা, তাদের নেতৃত্ব দেয় দেবাংশীরা। গোটা গ্রামও সেই আনন্দে যোগ দেয়।”

”কিন্তু সেইবছর একটা অঘটন ঘটে গেল। গমীরানাচের প্রধান দেবতা উড়ানকালীর মোখাটায় মন্ত্রপূত জল দেওয়ার আগেই হঠাৎ সেটা এক সেবকের হাত থেকে পড়ে গেল গমীরাতলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তুলাই নদীতে।

”বর্ষাকাল, নদীতে জল থইথই, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেটা নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলে গেল দূরে। সবাই হায় হায় করে উঠল। এ যে ভয়ঙ্কর সর্বনাশ! ঢাক-কাঁসির বাজনা মুহূর্তে থেমে গেল। উড়ানকালী আমাদের ওই তল্লাটের সবচেয়ে উগ্র দেবতা, তাঁর মোখা ছাড়া গমীরা উৎসব হবে কী করে? তায় আবার সেটা কালগমীরার বছর! গ্রামে যে মহামারী নেমে আসবে, দেবতার রোষে ছারখার হয়ে যাবে সব!

”সবাই তখন শলাপরামর্শ করে ছুটে এল মোখাশিল্পীদের পাড়ায়। আমরাও ওখানেই থাকতাম। ওদিকে মোখা বানানোর কারিগরেরা সবাই তখন এতদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হয়ে একটু আনন্দ করছে। সবাই মিলে মাংস রান্না হচ্ছে। খাওয়া হবে মাঝরাতে। কেউ এখন আর মোখা বানাতে বসতে রাজী হল না। তার ওপর যে সে দেবতার মোখা নয়, খাস উড়ানকালীর মোখা।”

”কেন রাজী হল না?” আজম খাঁ যেন শুনতে শুনতে পৌঁছে গিয়েছেন দিনাজপুরের সেই গ্রামে, ”মোখার কারিগরেরাও তো গ্রামেরই লোক। তারা তো এই বিপদে সাহায্য করবে এটাই স্বাভাবিক!”

সুপ্রকাশ এবার একটু থেমে বলল, ”মোখা তৈরি সাধারণ মুখোশের মত কাজ নয় খাঁ সাহেব। আমাদের তল্লাটে সবাই বিশ্বাস করে যে নৃত্যশিল্পী মোখা পরে নাচে, তার ওপর সেই দেবতা বা দেবী ভর করেন। নাচের সময় কোনও কথা বলা যায় না, অসৎ চিন্তাও করা যায় না। আর যে কারিগর মোখা বানায়, তাকেও অনেক নিয়মরীতি পালন করতে হয়। মোখা বানাতে গেলে স্নান সেরে শুদ্ধশুচি হয়ে কাচা কাপড় পরে বসতে হয়। কোন নেশাভাঙ তো ছেড়েই দিলাম, মাছ, মাংস ডিমও খাওয়া যায় না। এই নিয়ম অমান্য করলেই সেই মোখাশিল্পীর মৃত্যু অবধারিত। ওই বিপর্যয়ের দিন ততক্ষণে শিল্পীরা সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে মাংস টাংস খেয়ে ফেলেছে, কেউই সম্মত হল না।

আমার বাবা শুধু নামকরা শিল্পীই ছিলেন না, সৎ স্বভাবের জন্য বাবাকে তখন সবাই বেশ মান্যগণ্য করত। গমীরা উৎসবের প্রধান পুরোহিত তখন এলেন আমাদের বাড়িতে। বাবাকে অনুরোধ করলেন সেদিন রাতের মধ্যেই উড়ানকালী ঠাকুরের মোখাটা বানিয়ে দিতে।”

”অত তাড়াতাড়ি এক একটা মোখা বানানো হয়ে যায়?” আমি সুপ্রকাশের হাতের মোখাটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

মোখাটা যেন আমারই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বড় বড় চোখদুটো একঝলক দেখেই আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।

”এমনিতে ছাঁচ বানিয়ে রঙ করে শুকোতে দেড়দিন মত লাগে, কিন্তু একরাতে করাটা অসম্ভবও নয়। বড়জোর রঙটা একটু কাঁচা থাকবে। কিন্তু কাজ মিটে যাবে।” সুপ্রকাশ বলল, ”কিন্তু আমার বাবাও রাজী হলেন না। বললেন তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা সব ভেতরের ঘর থেকে শুনছি, সকলে অনেক চাপাচাপি করল। কাকার যদিও অত হাতযশ তখন ছিল না, তিনি ছোটখাট মোখা বানাতেন, তবু ঠেকায় পড়ে সবাই কাকাকেও অনুরোধ করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। বাবা-কাকা দুজনেই একেবারে অনড়।

তখন আমাদের গ্রামের সবাই মিলে পরামর্শ করে বাবাকে একটা টোপ দিল। বাবা তো এমনিতেই তখনও পর্যন্ত মাছমাংস খাননি, যদি তিনি কালগমীরা পুজোর প্রধান মোখাটা বানিয়ে দেন, তবে সবাই মিলে চাঁদা তুলে আমার পড়াশুনোর ভার নেবে। আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কাছের শহর গঙ্গারামপুরের ভাল স্কুলে। তারপর থেকে আমার লেখাপড়ার সব ভার হবে গ্রামের লোকদের।

”আমাদের ত্রিমোহিনী গ্রামে তখন একটাই প্রাইমারী স্কুল ছিল। আমার ভাইবোনেরা পড়ায় তেমন মন না দিলেও আমি পড়াশুনোয় ভাল ছিলাম। কিন্তু আমাদের গ্রামের কোন বাড়িতেই লেখাপড়ার তেমন চল ছিল না। সাধ্যও ছিল না। প্রাইমারী পাশ করা মানেই ছিল বিশাল ব্যাপার। সেখানে আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ছি, বাবা সবসময় চিন্তায় থাকতেন আমাকে নিয়ে। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমি অনেকদূর লেখাপড়া করে বড় কিছু করি। কিন্তু আমাকে শহরে পাঠিয়ে পড়ার খরচ চালানোর মত সাধ্য বাবার ছিল না। আর এই আক্ষেপ তিনি সকলের কাছে করে বেড়াতেন। সেই সুযোগটাই নিল গ্রামবাসীরা।”

আমি বললাম, ”তারপর? আপনার বাবা মোখাটা বানালেন?”

”হ্যাঁ।” সুপ্রকাশ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, ”আমাকে পড়াশুনো শেখানোর লোভ বাবা সামলাতে পারেননি। সেদিন প্রায় মাঝরাতে বাবা স্নান সেরে শুদ্ধবস্ত্র পরে বসলেন উড়ানকালীর মোখা বানাতে। সারারাত ধরে ছাঁচ গড়লেন, তারপর বসতবৈর গাছের ছাল ভিজিয়ে তৈরি করলেন লাল রঙ। চুন, সাদা খড়িমাটি, সিঁদুর এসব দিয়ে রাঙাতে লাগলেন মোখাটাকে। আমাদের কাউকে কাছে আসতে দেওয়া না হলেও সেরাতে আমরা কেউ ঘুমোইনি ভেতরে। মা সারারাত জেগে ঠাকুরের নাম জপ করছিলেন।

রাত যখন প্রায় ভোর হয় হয়, তখন বাবার রঙ করা শেষ হল। তেঁতুলের বীজ গুঁড়ো করে রাখা ছিল, তাই দিয়ে পালিশ করলেন মোখাটাকে। তারপর সেটা তুলে দিলেন প্রধান পুরোহিতের হাতে। সবাই একেবারে জয়জয়কার করে উঠল বাবার। বাবার জন্যই যে সেবারের কালগমীরা উৎসবের শেষ নাচ বন্ধ হল না, তা সবাই বলাবলি করতে লাগল।”

”তারপর আমরা সবাই হইহই করে চলে গেলাম গমীরাতলায়। নাচ শুরু হয়ে গেল। বাবা সারারাত জেগে ক্লান্ত ছিলেন, তিনি আর গেলেন না। বাড়িতেই রইলেন।” সুপ্রকাশ একটু দম নিল। কাঁপা গলায় বলল, ”সবাই যখন মোখাটা নিয়ে চলে গিয়েছে গমীরাতলায়, ঠিক তখনই সেই অম্বুবাচীর রাতে একটা ঝড় উঠল। ভীষণ ঝড়। বাজ পড়তে শুরু করল জায়গায় জায়গায়। সবার সঙ্গে আমরাও তখন গমীরাতলার উৎসবে। বাবা একাই ছিলেন বাড়িতে। তার কিছুদিন আগেই ইলেকট্রিকের লাইন পাতা হয়েছিল বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে। একটা তার শর্ট সার্কিট হয়ে ছিঁড়ে পড়েছিল কাঁচা রাস্তার জলে। বাবা কোন কারণে সেখান দিয়ে বোধ হয় যেতে গিয়েছিলেন। ব্যাস! ঝড় থামলে আমরা যখন এলাম, ততক্ষণে বাবা নিথর, নিঃস্পন্দ। বাবাকে সেই শেষ দেখা আমার। রীতি না মেনে মোখা বানানোর মাশুল দিতে হল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।”

”সে কী!” আমি বিস্ময়ে বলে উঠলাম, ”কিন্তু … কিন্তু আপনার বাবা তো কোন মাছ-মাংস খাননি বললেন!”

”হয়ত অল্প হলেও খেয়ে ফেলেছিলেন, কিংবা অন্য কোন নিয়মভঙ্গ করেছিলেন। তাই রাজী হচ্ছিলেন না মোখাটা বানাতে। কিন্তু ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হবে, সেই লোভটা ছাড়তে পারেননি বাবা। তাই নিজের জীবন শেষ হয়ে যাবে জেনেও অতবড় বাজি নিয়েছিলেন।”

সুপ্রকাশ মুখ থেকে হাত সরাল। তার দু’চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। বলল, ”মোখা তৈরির সময়ও অপঘাতে মারা গেলে তাকে পোড়ানো হয় না, তুলাই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাবাকেও তাই করা হল। সেই শোকে মা-ও বেশিদিন বাঁচলেন না তারপর। আমার জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল।”

”তারপর?”

সুপ্রকাশ ধরা গলায় বলল, ”গ্রামের সবাই অবশ্য খুব আঘাত পেয়েছিল। তারা তাদের কথাও রেখেছিল। আমাকে তার পরে পরেই গঙ্গারামপুরে একটা আবাসিক স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আমি শিক্ষিত হলাম, বড় হলাম, নিজের পায়ে দাঁড়ালাম। ত্রিমোহিনী গ্রাম থেকে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হলাম। ততদিন কাকা-ই সংসার চালাতেন। আমি চাকরি পেয়ে বাড়ি করতে শুরু করলাম। কিন্তু বাবা হারিয়ে গেলেন চিরকালের জন্য।”

আমি চুপ করে রইলাম। আজম খাঁও কিছু বলছেন না। তিনি সম্ভবত বুঝতে পারেননি এমন কোন বেদনাদায়ক ঘটনা শুনতে হবে।

সুপ্রকাশ হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠল, ”আপনারা বারবার বলছিলেন না, কেন আমি এই মোখাটাকে নিয়ে এমন পাগলামি করছি?” মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল ও, মোখাটাকে দু’হাতে নিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরল, ”এই সেই বারো বছর আগের কালগমীরা পুজোর উড়ানকালীর মোখা! এটাই বাবা তাঁর জীবনের শেষ রাতে বানিয়েছিলেন আমার ভবিষ্যতের বিনিময়ে!”

এবার আমাদের অবাক হওয়ার পালা। আজম খাঁ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ”তুমি শিওর, এটাই সেই মুখোশ যেটা সেদিন তোমার বাবা বানিয়েছিলেন?”

”একশো পারসেন্ট।” সুপ্রকাশ মোখাটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ”এই দেখুন। চোখদুটো নাকের কতটা কাছাকাছি দেখেছেন? এটা ছিল আমার বাবার একান্ত নিজস্ব স্টাইল। তাছাড়া মুখের ভেতর থেকে অতবড় বেরিয়ে আসা লাল টকটকে জিভ দেখেই আমি চিনেছি। বাবা ছাড়া এমন রঙ আমাদের গ্রামে কেউ বানাতেই পারত না। এখনও পারেনা। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই দেখুন …” মোখাটাকে উল্টে দিল ও, ”এই চিহ্নটা ছিল বাবার ট্রেডমার্ক। বাবা তো নিরক্ষর ছিলেন, এই ছাপটা নিজের হাতের কাজ বোঝানোর জন্য রেখে দিতেন।”

আমি কিন্তু কিন্তু করেও মোখাটা চেয়ে হাতে নিলাম। আয়তনে সাধারণ মুখোশের মতই, তবে ওজনে বেশ ভারী। পেছনদিকে একটা ত্রিভুজের মধ্যে গোল চিহ্ন আঁকা। বললাম, ”এটা কি ছাতিম গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি?”

”না। বাবা গামারি কাঠ দিয়ে উড়ানকালীর মোখা বানাতেন।” সুপ্রকাশ বলল।

আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলাম মোখাটা। খাঁ সাহেবও আমার দিকে ঝুঁকে এসেছিলেন। গোটা মোখাটাই হাঁড়ির কালি দিয়ে কালো রঙ করা। এতদিন কেটে গেছে বলে অবশ্য সেই কালো রঙ মুছে গিয়ে ছাইয়ের মত সাদা রঙ ধারণ করেছে। মুখের হাঁ-গহ্বর দিয়ে অনেকটা বড় লাল টকটকে জিভ বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চোখদুটো সাদা, বড় বড়, চোখের মণিদুটো লাল-কালো মেশানো। সব মিলিয়ে বেশ রাগী একটা দেবীমূর্তি।

এমনি কিছু মনে হয় না, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে মনের মধ্যে অজান্তেই যেন একটা ভয় জেগে ওঠে।

ইনিই তবে দিনাজপুরের ত্রিমোহিনী গ্রামের উড়ানকালী দেবী! সুপ্রকাশের কথা অনুযায়ী এঁর কোপেই মারা গিয়েছেন ওর বাবা। এসব কি সত্যিই হয় আদৌ? নাকি অশিক্ষা আর কুসংস্কার এই সমস্ত গ্রামের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন গেঁথে রয়েছে, যে যুক্তি দিয়ে কোনকিছু ব্যাখ্যা করতে ভুলে গেছে ওরা।

নিজে শিক্ষক হয়ে সুপ্রকাশও সেই চিরাচরিত ধ্যানধারণা থেকে বেরোতে পারছে না।

কিন্তু একটা কথা অস্বীকার করে উপায় নেই, মোখাটার গায়ে একটা বিশ্রী পচা গন্ধ। ঘরের কোণে কোন ইঁদুর মরে পচে গেলে যেমন গন্ধ ছাড়ে, তেমনই। কিন্তু মোখাটা তো ফাঁপা, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কোন পোকামাকড়ও গায়ে লেপ্টে নেই।

খাঁ সাহেব বললেন, ”সবই বুঝলাম। কিন্তু তোমার বাবা তো এটা বানিয়েছিলেন বঙ্গালের সেই গ্রামে। সেটা লক্ষ্নৌয়ের নখাশ বাজারে এল কী করে?”

”এটাই আমারও প্রশ্ন।” সুপ্রকাশের চোখমুখ মুহূর্তে চঞ্চল, ”নিয়ম অনুযায়ী গমীরা পুজোর পর এই মোখাগুলোকে শ্মশানে চিতায় পোড়ানো হয়। গ্রামের সবাই মানে যে, আগে মোখার ভেতরে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা দেবতা-উপদেবতারা চিতায় পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পান। পরেরবছর আবার তাঁদের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় নতুন মোখায়। আমরা ভাইবোনেরা তখন এমনিই ছোট, তার ওপর বাবা ওইভাবে চলে যাওয়ায় সেই কালগমীরার বছরে এই মোখাটাকে কী করা হয়েছিল তা খেয়াল পড়ছে না। তবে কেউ না কেউ যে এটা সুযোগ বুঝে সরিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে।”

”তুমি এখন কী করবে ভাবছ?” খাঁ সাহেব বললেন।

সুপ্রকাশ এবার একটু ইতস্তত করে বলল, ”এই মোখাটা কিনে আনার পর থেকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে।”

আমি বললাম, ”কী অদ্ভুত ব্যাপার?”

সুপ্রকাশ এবার একটু কাশল, তারপর নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে বলল, ”যেদিন প্রথম মোখাটা কিনে হোটেলে আসি, সেদিন কিন্তু আমি তখনও এটাকে চিনতে পারিনি। আমাদের ওদিককার জিনিস ভেবে কিনে এনেছিলাম। কিন্তু সেদিন রাতে একটা কাণ্ড হল। মোখাটাকে টেবিলের ওপর রেখে খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেদিন বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়া ছিল। ঘুমটাও তাড়াতাড়ি এসেছিল। বেশ গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কী একটা অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেল।

 ”চোখ খুলতেই প্রথমে গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল। অন্ধকার ঘরে ম-ম করছে কীসের একটা গন্ধ। গন্ধটা এতটাই তীব্র যে নাক বন্ধ হয়ে আসছে যেন। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলের আলোটা জ্বাললাম, কিন্তু কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। জানলা ভাল করে ভেতর থেকে নিজের হাতে বন্ধ করে শুয়েছি। এমন উগ্র গন্ধ ঘরের মধ্যে কোথা থেকে আসছে?

”আস্তে আস্তে যত গন্ধের মাত্রাটা বাড়তে শুরু করল, ততই আমার মস্তিষ্কের মধ্যে কী একটা হতে লাগল। গন্ধটা যেন খুব চেনা, কোথায় যেন আগে পেয়েছি। গন্ধটা আমাকে যেন অতীতের কোন কিছু মনে করাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। শেষে রাত পেরিয়ে যখন ভোর হয় হয়, তখন হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকের মত মনে পড়ে গেল। আরে! এটা তো একটা বিশেষ ধরণের তামাকের গন্ধ, যেটা কাজের সময় বাবা খেতেন। আমার ছোটবেলায় বাবার কাছে গেলেই এই গন্ধটা পেতাম, তাই ছোটবেলার অনেক স্মৃতির মধ্যে এই গন্ধটাও যেন সোয়েটারে বুনে দেওয়া উলের মত জড়িয়ে রয়েছে। কথাটা মনে পড়তেই আমার কী মনে হল, বিছানা থেকে নেমে ছুটে গেলাম মোখাটার দিকে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, মোখাটা কিছুটা কোণাকুণি বেঁকে আমার খাটের দিকে হেলে রয়েছে। বড় বড় চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে যেন দেখছে আমাকে। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে, শোবার আগে আমি সেটাকে উল্টোদিকে মুখ করে রেখেছিলাম।” সুপ্রকাশ থামল।

ওর চোখদুটো অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে।

কিছুক্ষণ তীক্ষ্নচোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”ত্রিমোহিনী গ্রামে থাকার সময় শুনেছিলাম, মোখা বানিয়ে কেউ অপঘাতে মারা গেলে তার আত্মা ভর করে সেই মোখার ওপর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাবার আত্মা এখনো রয়েছে ওই মোখার ভেতরে। কিছু একটা বলতে চাইছে সে আমাকে।”

”কী বলতে চাইছে?” আজম খান বললেন।

সুপ্রকাশ এবার ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নাড়ল, ”তা এখন বুঝতে পারছি না। কিন্তু যখনই ঘরের মধ্যে একা রয়েছি, আমি যেন অনুভব করছি এই ঘরে আমি একা নেই। ওই মোখা যেন সারাক্ষণ আমায় লক্ষ্য করছে। তার ভেতরের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস যেন আমার গায়েও এসে লাগছে। সময়ে সময়ে যেন তার রূপ বদলে যাচ্ছে! কেমন একটা মাংসপচা গন্ধও পাচ্ছি চারপাশে।”

আমি নীরবে মাথা নাড়লাম। সুপ্রকাশ যেগুলো বলছে সেগুলো সত্যিই হচ্ছে কিনা তা ওই বলতে পারবে, কিন্তু মাংসপচার মত গা গুলনো জৈব গন্ধটা যে আমিও পাচ্ছি, তা তো অস্বীকার করে লাভ নেই।

”সুপ্রকাশ।” আজম খাঁ এবার বললেন, ”আমার মনে হয় একা একা সারাদিন এই ঘরের মধ্যে বন্দী থেকে তোমার এরকম মনে হচ্ছে। এটাকে একধরনের হ্যালুসিনেশন বলে। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে যাও।”

”বাড়ি বলতে তো বাবা-মা কেউ নেই আমার।” সুপ্রকাশ একটা নিঃশ্বাস ফেলল, ”বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই শোকে দুঃখে মা মারা যান। আমি তখন গঙ্গারামপুরের হোস্টেলে। বাড়িতে কাকা, কাকীমা আর ছেলেমেয়েরা। কাকা অবশ্য আমাকে ছেলের মতই ভালবাসেন। বাবা চলে যাওয়ার পর কাকার ধীরে ধীরে মোখা তৈরিতে নাম হতে থাকে। একসময় কাকাই দিনরাত এক করে মোখা বানিয়ে সংসার চালিয়েছেন। এখন সংসারের অবস্থা অনেকটা ভাল, কাকার অধীনে এখন কিছু ছেলেও কাজ করে। আমিও আমার মাইনের বেশিরভাগটাই পাঠিয়ে দিই। কাকার পরিবারই আমার পরিবার এখন।”

”সে যাই হোক।” আজম খান বললেন, ”তুমি বাড়ি ফিরে যাও। তোমার ভাবগতিক আমার ভাল ঠেকছে না।”

”যাব।” সুপ্রকাশ কেমন শূন্য চোখে বিড়বিড় করল, ”বাবা বললেই চলে যাব।”

সেদিন আজম খানের সঙ্গেই সুপ্রকাশের হোটেল থেকে ফিরে এসেছিলাম। ফেরার সময় খাঁ সাহেব মুখে কিছু না বললেও তাঁর কপালের ভাঁজগুলো বলে দিচ্ছিল তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। দোকানের সামনে এসে নামার পর বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ”ব্যাপারটা কী বলুন তো লাহিড়ী সাহেব? সত্যিই কি ওই মুখোশের মধ্যে কিছু লুকিয়ে রয়েছে? নাকি পুরোটাই ছেলেটার মনের ভুল?”

আমি সেই কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিলাম, ”আচ্ছা আমাকে একবার নখাশে সেই রাতের বাজারে নিয়ে যেতে পারবেন?”

”হ্যাঁ, কেন পারব না!” খাঁ সাহেব মাথা নেড়েছিলেন, ”যেদিন বলবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে কী হবে?”

”যার কাছ থেকে সুপ্রকাশ মোখাটা কিনেছিল, তার সঙ্গে একবার কথা বললে মনে হয় কোন আন্দাজ পেলেও পাওয়া যেতে পারে।” আমি বলেছিলাম।

”বহত খুউব। নিয়ে যাব।” আজম খান বলেছিলেন, ”আসলে কী জানেন, ছেলেটা অতদূর থেকে এসে এখানে একা একা রয়েছে তো, কোন বিপদে না পড়ে যায়। তাই একটু চিন্তা হচ্ছে।”

চিন্তা বা কৌতূহল যে আমারও হচ্ছিল না তা নয়, বিশেষত যখনই উড়ানকালীর মোখাটার কথা মনে পড়ছিল।

একটা সাধারণ প্রাকৃতিকভাবে বানানো গ্রাম্য মুখোশ। অমন মুখোশ আমি অজস্র দেখেছি। কিন্তু তবুও, ওই মোখাটার মধ্যে কী একটা অদ্ভুত জিনিস যে আছে সেটা আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছি না।

একটা কাঠের তৈরি মুখোশ, তার মধ্যে কি কোন দেবতা বা উপদেবতার প্রাণ আদৌ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে? কেউ অনিয়ম করলে তার আত্মাই বা কী করে সেই মোখায় প্রবেশ করতে পারে? মাংসপচা গন্ধটাই বা কোথা থেকে আসছিল?

দিনাজপুরের সেই ত্রিমোহিণী গ্রামের লোকেরা আবার উৎসবের পর মোখাগুলোকে মরা মানুষের মত শ্মশানে চিতায় পোড়ায়। অনেকগুলো মুখ একসঙ্গে চিতার লেলিহান শিখায় রাতের অন্ধকারে পুড়ছে, ধীরে ধীরে রঙ গলে যাচ্ছে, আগুন গ্রাস করছে মুখ, চোখ, নাক, ভাবলেই কেমন যেন গা-টা শিরশির করে ওঠে।

মোখার মধ্যে আত্মা থাকার থিয়োরিটাকে যেন আমার অবচেতন মন ধীরে ধীরে সুপ্রকাশের মতই বিশ্বাস করতে শুরু করে।

যাইহোক, পরেরদিন সকালেই ভেবেছলাম আবার খাঁ সাহেবের দোকানে যাব, কিন্তু হঠাৎ একটা বিপর্যয়ে কয়েকদিনের জন্য আমার দৈনন্দিন রুটিনে তুমুল অদলবদল হয়ে গেল। নখাশ বাজারেও যাওয়া হল না, আর সুপ্রকাশের খোঁজও নেওয়া হল না।

আমার মাসি সেদিন রাতেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। গভীর রাতে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বললেন বেশ বড়সড় একটা অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে, কয়েকদিন অবজারভেশনে রাখতে চান।

সেই খবর পেয়ে আমার মা আবার কলকাতায় বসে এমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে একদিকে এখানে হাসপাতালে মাসি আর অন্যদিকে কলকাতায় মায়ের সঙ্গে ঘনঘন ফোনাফুনিতে কয়েকদিন আমি অন্যদিকে তাকাবার ফুরসত পর্যন্ত পেলাম না।

মা খালি বলতে লাগলেন, ”তুই দিদিকে কলকাতা নিয়ে চলে আয়।”

কিন্তু মাসিও কিছুতেই মেসোমশাইয়ের স্মৃতি ছেড়ে কলকাতা ফেরত যেতে রাজী নন।

এইসব মিটিয়ে মাসিকে বাড়িতে সুস্থ করে নিয়ে আসতে আসতে প্রায় দু’সপ্তাহ কেটে গেল। এই কয়েকদিন আমি খাঁ সাহেবের কাছ থেকে কোন খবর পাইনি। অবশ্য পাওয়া সম্ভবও নয়। কারণ খাঁ সাহেব এমনই অদ্ভুত মানুষ, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না।

যাইহোক, ফুরসত পেতেই আমি আবার কিছুদিন পর গেলাম খাঁ সাহেবের লস্যির দোকানে। খাঁ সাহেব দোকানেই ছিলেন, আমাকে দেখে সামান্য হেসে বললেন, ”আসুন জনাব! এই কদিন কোন পাত্তাই নেই কেন? আমি ভাবলাম না বলে কয়ে ঘর চলে গেলেন নাকি?”

আমি সংক্ষেপে গোটা বিষয়টা বলে জিজ্ঞেস করলাম, ”সেই ছেলেটার কী খবর? সুপ্রকাশ?”

”ওই ব্যাপারটা মিটে গেছে জনাব!” আজম খাঁ একটা নিশ্চিন্তের হাসি হেসে বললেন, ”ছেলেটা ওর বাড়ি ফিরে গেছে। হঠাৎই। আমার সঙ্গে অবশ্য দেখা হয়নি আর। আমিও কয়েকদিন নানা ঝঞ্ঝাটে ব্যস্ত ছিলাম, আমার দোকানের এক কর্মচারী ওদিকে থাকে, তিন-চারদিন আগে তাকে খবর নিতে হোটেলে পাঠিয়েছিলাম, সে-ই এসে জানাল। যাক, একা ছেলে বিদেশ বিভুঁইতে মাথা খারাপ করছিল, দেশে ফিরে গেছে ভাল হয়েছে। তাই না বলুন?”

”সে তো বটেই।” আমি এক গ্লাস কেশর বাদাম লস্যি নিয়েছিলাম, তাতে লম্বা চুমুক দিলাম, ”তবে ব্যাপারটা ভারী ইন্টারেস্টিং ছিল কিন্তু! পশ্চিমবঙ্গের কোন এক অখ্যাত গ্রামের একটা মুখোশ কিনা পাওয়া গেল লক্ষ্নৌয়ের নখাশ মার্কেটে, তাও আবার সেটা ছেলেটার বাবারই হাতে বানানো!”

”আমার মনে হয় ওই মুখোশের জ্যান্ত হয়ে ওঠাটা ছেলেটা কল্পনা করছিল।” হাতের আঙুল নাড়ে বললেন আজম খান, ”নাহলে আপনিই বলুন, কাঠের একটা খেলনা, সেটা কখনও নিঃশ্বাস ফেলতে পারে? হা! হা!”

কেন জানিনা, খবরটা শুনে আমি খাঁ সাহেবের মত অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। কেমন যেন খচখচ করছিল মনের ভেতরটা। সুপ্রকাশকে সেদিন যতক্ষণ দেখেছি, বেশ দৃঢ়চেতাই মনে হয়েছে। ওর স্বর্গত বাবার বানানো উড়ানকালীর মোখা নিয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস ছিল ও। যদি কোনও কারণে ওকে দিনাজপুরের সেই গ্রামে ফিরে যেতেই হয়, ও কি মোখাটা নিয়ে যায়নি?

সেদিন আর খাঁ সাহেবের সঙ্গে আড্ডাটা জমল না। লস্যির গ্লাসটা শেষ করে উঠে পড়লাম। খাঁ সাহেব দু’একবার প্রশ্ন করলেন, শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে।

বেরিয়ে কী যে হল, কোন এক মন্ত্রবলে একটা টাঙ্গা ডেকে নিয়ে চললাম চকের সেই হোটেলে, যেখানে সুপ্রকাশ ছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল, আমাদের জানার বাইরেও হয়ত এমন কিছু ঘটতে পারে, যেটা আমরা কল্পনাই করতে পারছি না।

ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে হোটেলটা খুঁজে বের করতে খুব একটা অসুবিধা হল না। রিসেপশনে সেদিনের সেই মাঝবয়সী লোকটাই বসে বসে সামনের ছোট পুরনো দিনের টিভিতে একটা সিনেমা দেখছে। খাঁ সাহেবের সঙ্গে সুপ্রকাশের কাছে এসেছিলাম বলে পরিচয় দিতে মনে হল চিনতে পারল, কিন্তু ভাবলেশহীন মুখে পান চিবিয়ে যেতে লাগল।

আমি বললাম, ”সুপ্রকাশ বলে ছেলেটির সঙ্গে খুব দরকার। একটু ওর ফোন নম্বরটা দেবেন? আপনাদের রেজিস্টারে তো আছে নিশ্চয়ই।”

লোকটার মুখটা নিমেষে আরও গম্ভীর হয়ে গেল। পাশের একটা ময়লা বাটিতে পানের পিক ফেলে মাথা নাড়ল, ”মালিকের হুকুম ছাড়া কাউকে রেজিস্টার দেখানোর নিয়ম নেই।”

”দিন না প্লিজ!” আমি গলায় মাখন মাখিয়ে অনুরোধ করলাম, ”খুব দরকার আসলে ওর সাথে।”

লোকটার কানে কথা গেল বলে মনে হল না, টিভিতে তখন হিরোর সঙ্গে ভিলেনের জোর মারপিট হচ্ছে, একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে পান চিবিয়ে যেতে লাগল।

আমি বাধ্য হয়ে একটা দুশো টাকার হলদে নোট বাড়িয়ে দিলাম, ”দেখুন না একটু প্লিজ!”

 এবার কাজ হল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে সুপ্রকাশের ফোন নম্বর, ঠিকানা আমার হাতে চলে এল। দেখলাম সুপ্রকাশ ফোন নম্বরের সঙ্গে দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের একটা ছেলেদের হোস্টেলের ঠিকানা লিখেছে।

রিসেপশনের লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে এসে আমি আর দেরি করলাম না, ফোন করলাম সুপ্রকাশের নম্বরে। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছিল, ওকে ফোন করলে আমি নিশ্চয়ই কিছু জানতে পারব।

প্রথম বার ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। দ্বিতীয়বার আবার করবো কিনা ভাবছি, তারমধ্যেই ওই নম্বর থেকে আমার ফোনে ফোন ঢুকল। আমি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা রুক্ষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ”হ্যালো কে বলছেন?”

সেদিন ওই কিছুক্ষণ কথা বললেও এখন সুপ্রকাশের গলা আমি ঠিকই চিনতে পারলাম। বললাম, ”সুপ্রকাশ, আমি লক্ষ্নৌ থেকে ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ী বলছি। সেই যে একদিন খাঁ সাহেবের সঙ্গে তোমার হোটেলের ঘরে গিয়েছিলাম। মনে পড়ছে?”

সুপ্রকাশ সামান্য কিছুক্ষণ থমকে গেল, তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ”হ্যাঁ ইন্দ্রজিৎবাবু বলুন, কেমন আছেন?”

”আমি তো ভাল আছি। তোমার কি খবর বলো।” আমি বললাম, ”আজম খান বললেন তুমি বাড়ি ফিরে গেছ। ওই ব্যাপারটার কী হল?”

”কী হল বলতে, আমি মোখাটাকে সঙ্গে নিয়েই এসেছি ইন্দ্রজিৎবাবু।”

”আচ্ছা। তারপর?” আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ”তুমি যে বলছিলে মোখা থেকে একটা অন্যরকম গন্ধ মানে কীরকম একটা অস্বস্তি … সে’সব কিছু আর নেই তো?”

সুপ্রকাশ যেন এবার ইচ্ছে করেই থেমে গেল। বেশ কিছুক্ষণ টেলিফোনের ওপারে বিরাজ করতে লাগল থমথমে নীরবতা। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, সুপ্রকাশ কিছু বলার আগে সময় নিচ্ছে, গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। হয়তো দোলাচলে ভুগছে আমাকে বিশ্বাস করা যায় কিনা তাই ভেবে।

আমিও আর কিছু বললাম না, অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেশ কয়েক মিনিট পর সুপ্রকাশ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ”আপনাকে দাদা বলেই ডাকছি ইন্দ্রজিৎদা। হয়ত খুব শীগগিরই একটা অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হতে চলেছি।”

”কীরকম?” আমি সাগ্রহে ফোনটা কানে চেপে ধরলাম। খাঁ সাহেব যতই যাই বলুন, আমার মন বলছিল মোখার সেই রহস্য এখনও শেষ হয়নি।

সুপ্রকাশ আবার একটু দম নিয়ে বলল, ”আপনি তিনদিনের মধ্যে ত্রিমোহিনী গ্রামে আসতে পারবেন?”

”ত্রিমোহিনী?” আমি অবাক, ”মানে দক্ষিণ দিনাজপুরে তোমাদের গ্রামে যেতে বলছ?”

”হ্যাঁ। সেই যে বারোবছর আগে কালগমীরা হয়েছিল, আবার এইবছর আমাদের কালগমীরা উৎসব।” সুপ্রকাশ বলল, ”যদি আসতে পারেন, একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলেও হতে পারেন। আমি আপনাকে জোর করছি না, কিন্তু আপনি আমাকে ফোন করেছেন দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটায় আপনারও আগ্রহ আছে। তাই বলছিলাম।”

আমি দ্রুত মনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে লাগলাম। এমনিতে না যাওয়ার কিছু নেই। আমি চিরকালই ছাড়া গরু, যখন যেদিকে মন চায়, ছুটে যাই। তাছাড়া লক্ষ্নৌতে মাসিও এখন বেশ সুস্থ।

সুপ্রকাশ ছেলেটাকে একদিন মাত্র দেখলেও রুক্ষতার আড়ালে বেশ বিবেচক বলেই মনে হয়েছে, কোনরকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মত ছেলে বলে মনে হয়নি। সে যখন এইভাবে ডাকছে, নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।

আমি বললাম, ”বেশ। যাব। আমি তোমাকে আজ রাতের মধ্যেই জানাচ্ছি।”

* * *

আজম খান সব শুনে টুনে বলতে গেলে আকাশ থেকে পড়লেন। ”কী বলছেন! আপনি এখন যাবেন বঙ্গালের সেই গ্রামে? এই যে বললেন আপনার বাড়ি থেকে সে জায়গা অনেক দূর?”

”দূর তো বটেই।” আমি বললাম, ”কলকাতায় নেমে সুপ্রকাশদের কাছাকাছি ষ্টেশনে পৌছতেই ট্রেনে রাত কাবার হয়ে যাবে। তারপর ওখান থেকে আরো কতদূর জানি না। তবে ছেলেটা এমনভাবে বলল, না গিয়েও পারছি না। মনের মধ্যে প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছে।”

খাঁ সাহেব তাঁর সাদা দাড়ি নাড়ালেন, ”সে ঠিক আছে। কিন্তু গেলে আপনার কোন বিপদ হবে না তো? বলা যায় না, ওইসব গ্রামে কিন্তু অনেক ধরণের কুসংস্কার থাকে।”

আমি খাঁ সাহেবের কথায় এবার হেসে ফেললাম, ”সুপ্রকাশ ছেলেটাকে দেখে তো সেরকম কিছু মনে হল না। আর একান্তই যদি বিপদ হওয়ার থাকে, বিধির বিধান কে খণ্ডাবে বলুন?”

”তাও ঠিক।” আজম খাঁ মাথা দোলালেন, ”কবে যাবেন ভাবছেন? আজ রাতেই?”

”আজ রাতেই যেতাম, কিন্তু আজ শুক্রবার। এখানে রয়েছি যখন, আপনাকে আজ আমাকে নখাশ বাজারে সেই মাঝরাতের মার্কেটে নিয়ে যেতে হবে।”

”আবার নখাশ? আপনারা বাঙালিরা পারেন বটে!” আজম খান কাঁধ ঝাঁকালেন, ”যো হুকুম!”

আগেই বলেছি, লক্ষ্নৌ শহরে আমি আগে বহুবার এসেছি। বলতে গেলে এখন এই শহর আমার দ্বিতীয় বাড়ি। ঘুরেছি অনেক পুরনো গলি, কেল্লা, ঢুঁ মেরেছি অজস্র প্রাচীন অট্টালিকায়।

তবু আজ নখাশ বাজারে রাত দুটোর সময় না এলে জীবনে বিস্মিত হওয়ার অনেক কিছু বাকি থাকত।

নখাশ বাজার লক্ষ্নৌয়ের পুরনো পট্টীতে। বাদেওয়ান কলোনির পাশ দিয়ে যে কানাগলি এঁকে বেঁকে সোজা গিয়ে শেষ হচ্ছে মুশির আলম সাহেবের ইমাম বড়ায়, তার পাশ দিয়ে আমরা দুজন কিছুক্ষণ আলো আঁধারিতে হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম নখাশে।

এমনিতে সাধারণ বাজারের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। অনেকটা পাহাড়ি উপত্যকার গ্রামগুলোতে যেমন স্থানীয় লোকেরা জামাকাপড়ের পশরা সাজিয়ে বসে থাকে, এও অনেকটা সেরকমই। স্থায়ী দোকান বলতে কিছু নেই, ওই কানাগলির দুপাশে ফুটপাথেই বসে আছে বিক্রেতারা, তার বিক্রিবাটার জিনিসের মধ্যে জ্বলছে নিবু নিবু আলো। আলোর অস্পষ্টতার জন্যই হয়ত গোটা পরিবেশটা কেমন একটা ছমছমে রূপ নিয়েছে।

লক্ষ্য করছিলাম ক্রেতারা এদিক ওদিক সতর্কচোখে তাকাতে তাকাতে হাঁটছে, নিচু হয়ে বসে থাকা বিক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম করছে, বিক্রেতাও গলা নামিয়ে কথা বলছে, হাতে করে জিনিস তুলে দেখাচ্ছে।

আজম খানের দিকে তাকাতে তিনি চাপা গলায় বললেন, ”অ্যান্টিক জিনিস সব, এভাবে তো বিক্রি করা বারণ, তাই লুকিয়ে ছুপিয়ে কারবার চলছে। পুলিশও টাকা খায়, কিছু বলে না।”

আমার জিনিসগুলো দেখার যে লোভ হচ্ছিল না তা নয়, কিন্তু আজ যে কাজে এসেছি সেটা আগে করা উচিত ভেবে নিজেকে সংবরণ করলাম।

ঘড়িতে সাড়ে তিনটে। এই মধ্যরাতে এমন একটা নিষিদ্ধ জায়গায় এসেছি ভেবে কেমন একটা অস্বস্তিও হচ্ছিল।

খাঁ সাহেব মৃদুমন্দ গতিতে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলেন বাজারের একদম শেষ প্রান্তে। সেখানে টিমটিম আলো জ্বালিয়ে একপ্রান্তে বসে আছে এক মহিলা। মাথার ঘোমটা প্রায় নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত, হাতে মোটা মোটা রাজস্থানী ঘরানার বালা।

আজম খান ইঙ্গিতে ফিসফিস করলেন, ”ওর কাছ থেকেই সুপ্রকাশ মুখোশটা কিনেছিল। সাড়ে চারশো রুপেয়া দাম পড়েছিল।”

আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু একদম কাছে না গিয়ে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে মহিলার বিক্রিবাটার জিনিসগুলো দেখতে লাগলাম।

লক্ষ্য করলাম গোটা নখাশ বাজারের থেকে এর বিক্রির জিনিসগুলো যেন একটু আলাদা। বেশিরভাগ বিক্রেতার কাছেই হয় নবাবী আমলের ঝাড়বাতি, পুরনো কয়েন, পেছনদিক থেকে টানা পাখা, নানারকমের পাথর বসানো বাক্স, ঝর্ণা কলম এইসবের ষ্টক। সেগুলোর কোনটা নবাব সুজা-উদ-দৌলার, কি কোনটা বেগম হজরত মহলের, কিংবা কোনটা নবাব বিরজিস কাদেরের নামে বিক্রি হচ্ছে। সত্যি মিথ্যে যাচাই করার অবকাশ নেই। নিলে নাও, না নিলে নিও না।

কিন্তু এই মহিলার কাছে ওইসব কিছু নেই। এই মহিলার সামনে যে গোটাকয়েক জিনিস রয়েছে প্রত্যেকটিই এককালে জীবন্ত প্রাণী ছিল। বড় বড় জমিদারবাড়ি বা নবাবের অট্টালিকায় যেমন শিকার করা বাঘ বা হরিণের মুখ সাজানো থাকে।

আমি সামনের দিকটায় তাকালাম। কাকাতুয়ার মত একটা পাখি, যদিও আয়তনে অনেকটা বড়, জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে। প্রথমে দেখলেই সেই দৃষ্টির তীব্রতা লক্ষ্য করে চমকে উঠতে হয়, পরে ভাল করে দেখলে বোঝা যায় চোখটা পাথরের। গোটা পাখিটাই স্টাফ করা।

শুধু কাকাতুয়া নয়, মহিলাটির সামনে ছোটবড় নানারকমের পাখি থেকে শুরু করে দেড় হাত লম্বা গোসাপ জাতীয় সরীসৃপও রয়েছে। সবই স্টাফ করা। সরীসৃপগুলো দেখলেই কেমন গা গুলিয়ে উঠছে। যদিও মহিলাটি ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে।

এই গভীর রাতে এমন কয়েকটা মৃত প্রাণীকে নিয়ে এভাবে বাজারের একদম শেষ প্রান্তে বসে থাকতে ওর ভয় করছে না?

আমি এগিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে মহিলাটির সামনে বসতেই সে বেশ আগ্রহী চোখে আমার দিকে তাকাল, ”ক্যা চাহিয়ে বাবু?”

আমি ভণিতা না করে বললাম, ”এক ধরণের মুখোশ খুঁজছি। মামুলি কাঠের তৈরি, খড়িমাটি, সিঁদুর দিয়ে রঙ করা, বড় বড় চোখ, ঠাকুরের মুখোশ।” তারপর বেমালুম মিথ্যে বললাম, ”কদিন আগে এখানেই দেখে গিয়েছিলাম। টাকা ছিল না বলে কিনতে পারিনি।”

মহিলার চোখে কোন ভাবান্তর হল না, তার পায়ে বোধ হয় মশা কামড়াচ্ছিল, এক হাত দিয়ে মশা তাড়াতে তাড়াতে বলল, ”এসেছিল একপিস। বিক্রি হয়ে গেছে।”

আমি কৃত্রিম আফসোসে ঠোঁটে আওয়াজ করে উঠলাম, ”যাহ। কী হবে তাহলে? আমার যে ওইরকম মুখোশ ভীষণ দরকার।”

”ওইরকম আর নেই।” মহিলা এবার হাত বাড়িয়ে সামনের জিনিসগুলো দেখাল, ”এখান থেকে লিয়েন। ভাল ভাল জিনিস সব। দুশো বছরের পুরনো।”

আজম খান ততক্ষণে আমার পাশে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসেছেন। আমি খান সাহেবের দিকে একবার তাকিয়ে বললাম, ”না, আমার ওই মুখোশটাই চাই। আরেক পিস আনিয়ে দিতে পারবে না?”

মহিলা এবার হাত উল্টে বলল, ”এইসব জিনিস এক পিস করেই আসে বাবু। আর কোথায় পাব!”

”একটু দ্যাখো না প্লিজ! আমি ভাল দাম দেব।” আমি গলায় আকুতি ফুটিয়ে তুললাম, ”তোমার কাছে এসব জিনিষ যে সাপ্লাই করে, তার সঙ্গে একটু কথা বলে আনাতে পারবে না?”

মহিলা বলল, ”আমার সাপ্লায়ার এটা দিয়ে যায়নি। এখানে এমনিই বসেছিলাম, একটা লোক এসে বেচে গিয়েছিল। আমার এইসব জন্তুজানোয়ার নিয়ে কারবার, ওইসব মুখোশ টুখোশ আমি তো রাখতেও চাইনি। তখন তো বুঝিনি যে বিক্রি হবে।”

”কীরকম লোক বলো তো?” আমি উৎসুক চোখে জিজ্ঞেস করলাম, ”এখানকার? না বাইরের?”

”অত্ত মনে নেই বাবু। রোগা করে কালো মতন।” মহিলা এবার শাড়ির ভেতর থেকে মোবাইল ফোন বের করল, ”আমার নম্বর লিয়ে যান, দশ বারোদিন পর ফোন করবেন। যদি সে আসে, আপনাকে জানাব। নমস্তে।”

নখাশ থেকে যখন টাঙায় চেপে খান সাহেবের দোকানে পৌঁছলাম, তখন পুব আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে, ওদিকটা পুরো লাল হয়ে রয়েছে। আজম খান অনেকক্ষণ কোন কথা বলেননি। দোকান থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি বললাম, ”তাহলে খাঁ সাহেব, এবারের মত বিদায়। পরে যখন আসব, আবার দেখা হবে।”

খাঁ সাহেব বললেন, ”আপনি কি আজই বেরিয়ে যাচ্ছেন নাকি?”

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, ”তাছাড়া আর উপায় কী! সুপ্রকাশ তিনদিনের মধ্যে যেতে বলেছে। আজকের বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছে গেলে কাল ওখান থেকে দিনাজপুরের ট্রেনে চড়তে পারব।”

”প্লেনের টিকিট কি কেটে ফেলেছেন?” খাঁ সাহেব আবার প্রশ্ন করলেন।

আমি বললাম, ”হ্যাঁ, আমার এজেন্টকে বলে দিয়েছি সকালে ফোন করে। দেখি, বিকেলের দিকে একটা টিকিট নিশ্চয়ই পেয়ে যাব।”

খাঁ সাহেব এবার একটু দোনোমনা করলেন, ”ইয়ে, দুটো টিকিট কাটতে বলুন তাহলে আপনার এজেন্টকে।”

”দুটো?” আমি অবাক হয়ে বললাম, ”আপনি যাবেন নাকি আমার সঙ্গে?”

”কিছু করার নেই।” খাঁ সাহেব বললেন, ”আপনার কথা শুনে আমারও কৌতূহল হচ্ছে ছেলেটা আবার নতুন কী বিপদে জড়িয়ে পড়ল। আমি তো এমনিতেও একা মানুষ, আপনি যখন যাচ্ছেনই, চলুন আমিও ঘুরে আসি। আজ রাতটা কলকাতার কোন হোটেলে কাটিয়ে কাল দিনাজপুর যাব না হয়! নতুন একটা দেশ দেখা তো হবে।”

”আমি থাকতে আপনি হোটেলে উঠবেন কেন খাঁ সাহেব?” আমি হাসলাম, ”তা আবার হয় নাকি! আপনি প্যাকিং শুরু করে দিন, আমি হোটেলে ফিরে এজেন্টের সঙ্গে কথা বলছি।”

আজম খান নিজের মনেই মাথা নাড়লেন, ”জানিনা ছেলেটার মনে কী চলছে জনাব!”

* * *

আজম খান যে এর আগে একবারও কলকাতা আসেননি তা নয়, তবু কলকাতা বলে যে আলাদা কোন ষ্টেশন রয়েছে, তা উনি জানতেন না। আমার বাড়ির গাড়ি এসে আমাদের দুজনকে কলকাতা ষ্টেশনে ছেড়ে দিয়ে যেতে তিনি বেশ আশ্চর্য হলেন, ”কলকাত্তা নামেও কোন ষ্টেশন আছে?”

”আছে বৈকি!” আমি মুচকি হাসলাম, ”হাওড়া শিয়ালদার মত অত ট্রেন না ছাড়লেও এখান থেকে এখন বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন ছাড়ে। আসুন।”

কলকাতা ষ্টেশন থেকে রাধিকাপুর এক্সপ্রেসে যখন আমরা উঠলাম, তখন ঘড়িতে সন্ধে সাতটা। আমাদের গন্তব্য কালিয়াগঞ্জ বলে একটি ষ্টেশন, সেখানে পৌঁছব আগামীকাল সকাল সাতটা নাগাদ। কালিয়াগঞ্জ দিনাজপুরেই, রায়গঞ্জের পরের ষ্টেশন। সুপ্রকাশের সঙ্গে ফোনে কথা হয়ে গিয়েছে, সে কালিয়াগঞ্জ ষ্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। ওর সঙ্গেই আমরা পৌঁছব সেই ত্রিমোহিনী গ্রামে।

আজম খান ট্রেনে উঠে বেশ ছড়িয়েছিটিয়ে বসলেন, তারপর বললেন, ”আচ্ছা, সুপ্রকাশ এত তাড়াতাড়ি করছে কেন সেটা বুঝতে পেরেছেন লাহিড়ী সাহেব? তিনদিন পরে কী আছে যে ওর এত জলদিবাজি?”

আমি গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, ”সুপ্রকাশের কথা শুনে আমি ক্যালেন্ডারে দেখেছিলাম আগামীকাল অম্বুবাচী শেষ। কালই তার মানে ওদের গ্রামের সেই গমীরা নাচের শেষ দিন। আমার মনে হয় ওই উৎসবের কোন একটা সম্পর্ক আছে এর সঙ্গে। কারণ সুপ্রকাশ ফোনে বলল যে কালগমীরার নাচের সময় ওর বাবা মারা গিয়েছিলেন, বারো বছর পরেও আবার এখন সেই কালগমীরা চলছে। কালই সেই উৎসবের শেষ দিন।”

কালিয়াগঞ্জ ষ্টেশনটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। ভিড় তো নেই, বরং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এদিক ওদিক যে কয়েকজন কুলি গামছা পেতে অলসভাবে প্ল্যাটফর্মে শুয়েছিল, রাধিকাপুর এক্সপ্রেস বাঁশি বাজাতে বাজাতে ঢোকামাত্র সবাই শশব্যস্ত হয়ে উঠে তৈরি হতে লাগল।

ট্রেন ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি প্ল্যাটফর্মে সুপ্রকাশকে দেখতে পেয়ে গেলাম। কথামত ও টিকিট কাউন্টারের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ও যত আমাদের কাছে এগিয়ে আসতে লাগল, তত চমকে উঠতে লাগলাম।

মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে এ কী আমূল পরিবর্তন ছেলেটার! লক্ষ্নৌয়ের হোটেলেও ওকে বেশ ছন্নছাড়া মনে হয়েছিল, কিন্তু এবার যেন পার্থক্যটা কয়েকগুণ বেশি প্রকট। এই কয়েকদিনে অসম্ভব রোগা হয়ে গেছে সুপ্রকাশ, কণ্ঠার হাড়দুটো যেন বেরিয়ে আসছে বাইরে, মুখের মাংস উধাও, গালের দুপাশের হাড় উঁচু হয়ে রয়েছে। গায়ের রঙও বেশ কালো লাগছে, চুল দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেশ কদিন হল তাতে কোন চিরুনি পড়েনি।

তার ওপর পেটের কাছে কি একটা জিনিস ও চেপে ধরে রেখেছে একটা বস্তার মধ্যে, ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না।

খাঁ সাহেব বলেই ফেললেন, ”এ কী অবস্থা করেছ নিজের চেহারার সুপ্রকাশ? কী হয়েছে তোমার?”

সুপ্রকাশ ম্লান হেসে বলল, ”আর কী হবে খাঁ সাহেব! আমার ওপর দিয়ে যে কী যাচ্ছে, তা আমিই জানি।”

”কেন তুমি যে বললে এখন মোটামুটি সব ঠিক আছে?” আমি হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলাম।

 ”সব ঠিক আছে মানে কালবৈশাখী ঝড় ওঠার আগে যেমন সবদিক শান্ত হয়ে যায়, তেমনই ইন্দ্রজিৎদা।” সুপ্রকাশ ষ্টেশনের বাইরে বেরিয়ে হাতছানি দিয়ে একটা পুরনো দিনের মারুতি ভ্যান ডাকল, ”আপনাদের সবটা বলব বলেই তো আসতে বললাম। আসুন, এই গাড়িতে উঠুন। আপনাদের জন্য গঙ্গারামপুর থেকে ভাড়া করে নিয়ে এসেছি।”

”এখান থেকে তোমাদের গ্রাম কতদূর?” আমি গাড়িতে উঠে প্রশ্ন করলাম।

”তা প্রায় ধরুন দু’ঘন্টার রাস্তা।” সুপ্রকাশ ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে আমার দিকে তাকাল, ”কালিয়াগঞ্জ পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই অবশ্য কুশমন্ডি ঢুকে যাব। তারপর বুনিয়াদপুর, গঙ্গারামপুর পেরিয়ে টাঙন নদীর পাড় বরাবর কিছুদূর গেলেই ত্রিমোহিনী গ্রাম। আসলে গঙ্গারামপুরের পর থেকে রাস্তা বড় খারাপ, নেই বললেই চলে। তাই একটু বেশি সময় লাগবে আর কী।”

”নদীর নাম টাঙন!” আমি বললাম, ”এই প্রথম নাম শুনলাম।”

সুপ্রকাশ চোখের তলায় কালি নিয়ে হাসল, ”আপনারা কী করে শুনবেন, টাঙন জংলী ছোট একটা নদী, বাংলাদেশের পদ্মার উপনদী, এদিকে কিছুটা চলে এসেছে।”

”তোমার পেটের ওখানে ওটা কী ধরে রেখেছ?” আজম খান জিজ্ঞাসা করলেন।

সত্যি কথা। সুপ্রকাশের সঙ্গে ব্যাগ বা কোন মালপত্র কিছুই নেই। চটের বস্তাসমেত ওই উঁচু জিনিসটা কেমন যেন বিসদৃশ লাগছে।

সুপ্রকাশ আবার হাসল, ”আপনি যা ভাবছেন, সেটাই খাঁ সাহেব। নখাশ বাজার থেকে কেনা সেই মোখা।”

”এখানে সেটা টেনে নিয়ে এসেছ কেন?” আমি অবাক হলাম, ”বাড়িতে রেখে আসা গেল না?”

”না। আমি তো এই কয়েকদিন হোস্টেলে ছিলাম, আজ আপনাদের সঙ্গেই গ্রামে ফিরছি। গাড়ির পেছনের ডিকিতে আমার মালপত্র আছে।” সুপ্রকাশ এবার দ্রুত মাথা নাড়ল, চাপা গলায় বলল, ”তাছাড়া পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, বাবাকে এক মুহূর্ত একা রাখা যাচ্ছে না।”

আজম খান আর আমি এবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। সুপ্রকাশের মনের মধ্যে যে কোন একটা চিত্তবৈকল্য হয়েছে তা লক্ষ্নৌতেই টের পেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা যে এমন আকার ধারণ করেছে, আন্দাজ করতে পারিনি।

সুপ্রকাশ আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই বোধ হয় তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ”আমি জানি আপনারা ভাবছেন আমার মাথা খারাপ হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই কয়েকটা দিন এই মোখাটার দিকে তাকালেই আমি বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি। কত কথা যে বাবার সঙ্গে বলেছি!”

”আমি ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে এসেছ যখন, তোমার পাগলামিটা কমেছে। কিন্তু এখন দেখছি তা নয়।” আজম খান রীতিমত উষ্মা প্রকাশ করলেন, ”তা কী বলছেন তোমার বাবা?”

 সুপ্রকাশ এবার কাতর গলায় বলল, ”আমি জানি আপনারা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এখানেও তো কাউকে বলতে পারছি না, ব্যাপারটা এতটাই স্পর্শকাতর। যেদিন আপনারা লক্ষ্নৌতে আমার হোটেল থেকে চলে গেলেন, সেদিন রাতেই আমার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতে সেদিনও দেখি, উল্টোদিকে ঘুরিয়ে রেখে শোয়া সত্ত্বেও উড়ানকালী ঠাকুরের মোখাটা আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। শুধু যে তাকিয়ে রয়েছে তাই নয়, চোখে চোখ পড়তেই আমি মনে মনে যেন বাবার গলা শুনতে পেলাম।” সুপ্রকাশের ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছে, ”বিশ্বাস করুন, হুবহু সেই এক গলা, এক বলার ভঙ্গী!”

”কী বললেন আপনার বাবা?” আজম খান জিজ্ঞেস করলেন আবার।

”আমি … আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম বাবা আমাদের গ্রাম্য ভাষায় বললেন, বুধন, তুই আমাকে ত্রিমোহিনী নিয়ে চ’। কালগমীরা নাচের যে আবার সময় হয়ে এল! সেবার আমি নাচ দেখতে পাইনি, তারপর থেকে বড্ড ছটফট করছি!” বলতে বলতে সুপ্রকাশের মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে।

”বুধন কে?”

”বুধন আমার ডাকনাম। বাবা মা ওই নামে আমায় ছোটবেলায় ডাকতেন। এখন আর ওই নামে কেউ কেউ ডাকে না।” সুপ্রকাশ অধীর হয়ে ঝুঁকে পড়ে আমার হাত চেপে ধরল, ”আপনি বিশ্বাস করুন ইন্দ্রজিৎদা, তারপর থেকে যতক্ষণ না হোটেল থেকে বেরিয়ে ষ্টেশনে গিয়ে কলকাতার ট্রেন ধরেছি, মাথার মধ্যে কেউ যেন একই কথা রেকর্ড বাজানোর মত করে অনবরত বলে গিয়েছে। প্রথমে ভাবছিলাম মনের ভুল, এখানে ফিরে এসেও সেইজন্য ত্রিমোহিনী যাইনি। গঙ্গারামপুরে আমার হোস্টেলের ঘরেই ছিলাম। কিন্তু … এই প্রতিটা রাতে বাবার সেই কাতর অনুরোধ শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। একই কথা, ত্রিমোহিনী নিয়ে চল আমায়, কালগমীরা নাচ দেখবো!”

আমি ভাল করে সুপ্রকাশকে দেখছিলাম। দেখে মনে হচ্ছিল না ছেলেটা মিথ্যে বলছে। আর মিথ্যে বলবেই বা কেন, কিন্তু ওর মুখ দেখে অসুস্থ লাগলেও অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছে না।

কিন্তু ওর কথাগুলো যদি সত্যি ধরে নিই, এ কি সম্ভব? বারো বছর আগে মারা যাওয়া একজন মানুষ কীভাবে একটা কাঠের মুখোশের মধ্যে আটকে থাকতে পারে?

”তুমি তো এখন গঙ্গারামপুরে থাকো, ত্রিমোহিনীতে এখন তোমাদের কেউ থাকে?” আজম খান জিজ্ঞেস করলেন।

”হ্যাঁ, কাকা, কাকিমা থাকেন। সেদিন বললাম না, চাকরি পাওয়ার পর আমি আমাদের কাঁচা বাড়িটাকে পাকা করেছি। তাছাড়া কাকার এখন মোখা তৈরিতে খুব নাম। মোখা বিক্রি করে মোটামুটি ভালই আয় হয়। দুজন কর্মচারীও রাখা হয়েছে। কাকার দুই মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর ছেলে পরেশ গ্রামেই থাকে, বছর বারো তেরো বয়স।”

আমি বললাম, ”বুঝলাম। তা তুমি এখন কী করবে ভাবছ?”

সুপ্রকাশ একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, ”বাবা চান, আমি বাবার বানানো এই মোখা পরে গমীরা নাচ করি। তারপর কালগমীরা উৎসব শেষ হলে অন্য মোখাগুলোর মত এটাকেও শ্মশানের চিতায় দাহ করলে বাবার আত্মা চিরতরে মুক্তি পাবে।”

”তুমি নাচ করবে?” আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ”তুমি ওই মোখা নাচ পারো নাকি?”

”আপনাকে লক্ষ্নৌতেই বলেছিলাম দাদা, ভুলে গেছেন।” সুপ্রকাশ ম্লান হাসল, ”আমরা তো রাজবংশী, ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের প্রত্যেককেই বাধ্যতামূলক গমীরা নাচ শিখতে হয়। আমার বেশ মনে আছে, যখন ছোট ছিলাম, তিন-চারবার মাশান কালী, দুয়ার-দুয়ারী, জিতুয়া পুজো এইসবেতে নেচেছিলাম। আসলে প্রাচীনকালে এদিক থেকে কামরূপ সাম্রাজ্য তো একেবারেই কাছে ছিল, কামরূপের তান্ত্রিক পুজোর নাচের সঙ্গে আমাদের গমীরা নাচের বেশ মিল আছে।”

কথা বলতে বলতে ত্রিমোহিনী গ্রামে গিয়ে যখন পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় দশটা। ত্রিমোহিনী গ্রামটা একেবারেই ছোট, একপাশ দিয়ে ছোট্ট একটা নদী বয়ে গেছে কুলকুল করে।

সুপ্রকাশ আগেই বলেছিল নদীটার নাম তুলাই। তুলাই নদীর পাশ দিয়ে লম্বাটে ধরণের গ্রামটায় তেমন কোন পাকা বাড়িই নেই। দেখেই বোঝা যায়, গোটা গ্রামটাই চরম গরীব।

সুপ্রকাশ গাড়ি যেখানে থামাতে বলল, সেখানে একটা ছোট একতলা পাকা বাড়ি। দেখেই বোঝা যায় নতুন তৈরি করা হয়েছে। ও বলল, ”এই আমাদের বাড়ি। আসুন। কাকা ভেতরেই আছেন।”

”তোমাদের বাড়িটাই কি এই গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়ি?”

”হ্যাঁ।” সুপ্রকাশ বলল, ”ওই যে বললাম, কাকা এখন মোখাশিল্পী হিসাবে বেশ নাম করেছেন, আর আমিও চাকরি পাওয়ার পর সাহায্য করছি। আমার তো আর নিজের বলতে কেউ নেই, কাকা কাকিমাই সব।” বলতে বলতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকে ও এগোল ভেতরের দিকে।

গ্রামের বাড়িগুলোর মত এই বাড়িটাও বেশ ছড়ানো, দরজা দিয়ে ঢুকেই চওড়া উঠোন, একপাশে ধানের মড়াই, অন্যদিকে দুটো ছাগল একমনে পাতা চিবুচ্ছে। উঠোন পেরিয়ে একচালা পাকা একটা বাড়ি, তার খোলা বারান্দায় বসে আছেন এক প্রৌঢ়। তাঁর হাতে তুলি, সেই তুলি আঁকিবুঁকি খেলছে একটা কাঠের ছাঁচের ওপর। তার আশেপাশে একই কাজ করছে আরও কয়েকজন লোক। সবার গভীর মনোযোগ কাজের দিকে, আমাদের দিকে তাদের নজর পড়লই না বলতে গেলে।

প্রৌঢ়র চোখে ঢাউস চশমা, গায়ের রঙ বেশ কালো, মাথার চুলে সাদা পাক ধরেছে। সাদা এক খানা ধুতি হাঁটু পর্যন্ত পড়ে কাজ করে চলেছেন। ভাল করে দেখলে সুপ্রকাশের সঙ্গে মুখের মিল বোঝা যায়। ইনিই নিশ্চয়ই সুপ্রকাশের কাকা।

পেছনের দেওয়ালে একটা ছবি আটকানো, একজন লোকের আবক্ষ ছবি। সুপ্রকাশ ইঙ্গিতে ছবির দিকে দেখাল, ”আমার বাবা।”

আমার কী মনে হল, মোবাইলে একটা ছবি তুলে নিলাম সুপ্রকাশের বাবার। দালানে সবাই কাজ করছে বলে বেশি কাছে যাওয়ার উপায় নেই, তাই ছবিটা একটু দূর থেকে নিতে হল। তাতে অবশ্য সুপ্রকাশের কাকা ও অন্যান্যরাও চলে এল ফ্রেমে।

আজম খান চাপা গলায় বললেন, ”ইনিই তার মানে সুপ্রকাশের কানে সারাদিন ফুসফাস করে যাচ্ছেন? হায় আল্লা!”

”আসুন, আমার কাকা।” সুপ্রকাশ প্রৌঢ়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর অবোধ্য ভাষায় কিছু কথা বলতে লাগল।

প্রৌঢ়ও শুনতে শুনতে আমাদের দিকে একঝলক তাকালেন, তারপর আবার সুপ্রকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুনে যেতে লাগলেন।

আজম খান এবার আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন, ”কিছু বুঝছেন? আমি তো একবর্ণ বুঝতে পারছি না। এদের মতলব ঠিক আছে তো?”

আমি স্মিত হেসে কিছু বললাম না। খাঁ সাহেবের জানার কথা নয় এটা এখানকার রাজবংশীদের একেবারে গ্রাম্য ভাষা। বাংলার সঙ্গে সামান্য মিল থাকলেও এত জড়ানো উচ্চারণের জন্য আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, ”সুপ্রকাশ ওর কাকার কাছে আমাদের পরিচয় দিচ্ছে মনে হচ্ছে খাঁ সাহেব!”

”খুদা হাফিস!” আজম খান চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করলেন, ”আপনার পাল্লায় পড়ে কোথায় যে এসে পড়লাম! ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরতে পারলে হয়!”

মিনিট পাঁচেক পর সুপ্রকাশ আমাদের দিকে তাকাল, ”কাকা আপনাদের পরিচয় পেয়ে খুশী হয়েছেন। আজ রাতেই কালগমীরা পুজো, এখনও সব মোখা শেষ হয়নি, তাই কথা বলতে পারছেন না। চলুন আপনাদের থাকার ঘরে নিয়ে যাই।”

”উনি কী বললেন তোমার বাবার ঘটনাটা শুনে?” আমি না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।

উঠোনের একপাশ কয়েকটা ছোট ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করে নিজেদের মধ্যে খেলছে। সুপ্রকাশের কথা অনুযায়ী এখন গ্রামে উৎসব চলছে। কিন্তু কোন গান বাজনা শোনা যাচ্ছে না। সেটা হয়ত এই গ্রামের আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য।

সুপ্রকাশ আমাদের উঠোন পেরিয়ে অন্য একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। এটা একই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আরেকটা একতলা বাড়ি। সেখানকার একটা ঘরে ঢুকে আমাদের ব্যাগগুলো রেখে নিচু গলায় বলল, ”আসলে আমি কাকাকে কিছু জানাইনি। একে এই বছর সেবারের মতই কালগমীরা। নিয়মকানুন অনেক কড়া। এমনিতে গমীরা নাচের প্রতিটা মোখাকেই লোকে প্রচণ্ড ভয় করে। তার মধ্যে উড়ানকালীর মোখা তো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিবছর ওটা কাকাই বানাচ্ছেন। এবারেও বানিয়েছেন। আমি যে আসল সময়ে সেই নতুন মোখাটা পাল্টে এটা করে দেব, সেটা কেউই জানে না।”

”সেকী!” আমি বিস্মিত ভাবে বললাম, ”কিন্তু তুমি তো আজ হঠাৎ করে এসেছ এই গ্রামে। তোমার নিশ্চয়ই আগে থেকে ওই মোখা পরে নাচার কথা ছিল না। সবাই যখন দেখবে তুমি নাচছ, বাধা দেবে না?”

”সেই ব্যবস্থাও হয়েছে ইন্দ্রজিৎদা।” সুপ্রকাশ বলল, ”গমীরা নাচের সময় নাচের দল দুই ভাগে নাচে, বুঝলেন। একদল মুখোশ ছাড়া নাচে, অন্যদল মুখোশ পরে নাচে। দুটো দলের মধ্যে নাচের প্রতিযোগিতা চলে বলতে পারেন।”

আজম খান বললেন, ”মানে সেই গান গেয়ে নেচে নেচে যে পালাগুলো হয় সেইরকম?”

সুপ্রকাশ দুপাশে মাথা নাড়ল, ”না, আমাদের গমীরায় কোন গান নেই। নদীর ওপারে বাংলাদেশের রাজশাহীতে একধরণের গম্ভীরা নাচ হয়, সেখানে নাচ গান হয়। আমাদের শুধুই বাজনা আর নাচ। নাচের ওই দুটো দলের জন্য একজন করে সর্দার গোছের লোক থাকে। সে নাচে না, তাকে বলে দেবাংশী। দেবাংশীরা আমাদের রাজবংশীদের মধ্যে তান্ত্রিক গোছের বলতে পারেন। দেবাংশীর তত্ত্বাবধানে ওই নাচ হয়। গোটা গ্রাম দেবাংশীকে তখন ভগবানের মত মানে। একটু অন্যথা হলেই যে নাহলে বিপদ নেমে আসবে।

”এবার হয়েছে কী, আমার ছোটবেলার বন্ধু তারক হল নাচিয়েদের দলের দেবাংশী।” সুপ্রকাশ গলা একেবারে খাদে নামিয়ে নিয়ে এল, ”ওদের পরিবার বংশপরম্পরায় এই কাজ করে। ওকে আমি পুরো ব্যাপারটা ফোনে বলেছি, অনেককষ্টে রাজিও করিয়েছি। তার জন্য অবশ্য আমার বেশ কিছু টাকা খসবে। আমাদের প্ল্যানটা হল, ওর দলের যে ছেলেটার উড়ানকালীর মোখা পরে নাচতে নামার কথা ছিল, তাকে তারক নামাবে না। বদলে এই মোখা পরে নামব আমি।”

আমি বলে ফেললাম, ”তাতে আবার কিছু ক্ষতি হবে না তো?”

কথাটা মুখ ফস্কে বলে ফেলে নিজেরই কেমন যেন লাগল। মনে হল এইসব অলৌকিক কাণ্ডকারখানা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই আমিও কেমন যেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে উঠছি। এরা নাহয় এইসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করে যে, সাত্ত্বিকভাবে মোখা না বানালে বিপদ হবে, অমুক আচারবিচার না মানলে অনর্থ হবে, কিন্তু আমিও কি তাই মানতে শুরু করলাম নাকি!

সুপ্রকাশ আমার দিকে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে বলল, ”বাবা নিজেই যখন সেটা চাইছেন, ক্ষতি হবে কেন ইন্দ্রজিৎদা?”

কাহিনীর প্রথমেই যে কথাটা বলেছিলাম, ঘুরেফিরে আবার তাতেই এলাম। জীবনে এত কিছু দেখেছি, এত বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, কিন্তু দক্ষিণ দিনাজপুরের অখ্যাত গ্রাম ত্রিমোহিনীতে কাটানো আষাঢ় মাসের অম্বুবাচীর সেই রাতের মত হাড় হিম করা অভিজ্ঞতা আমার খুব কমই হয়েছে।

সত্যি বলতে কী, রাতের বিছানায় একা যখন শুয়ে থাকি, জানলা দিয়ে বাইরের নিকষ কালো আকাশে তারা দেখতে দেখতে ঘুম আসতে চায় না, হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা। আর মনে পড়লে আজও বুকের ভেতরটা কেমন ধড়াস ধড়াস করতে থাকে, গলার কাছটা শুকিয়ে আসে। মনে হয় আমার মাথার ওপাশেই যেন নিঃশ্বাস ফেলছে কেউ। বিকট একটা চিৎকার শুনতে পাই দূর থেকে।

ত্রিমোহিনী গ্রামে তুলাই নদীর পাশের শ্মশান ঘেঁষা ফাঁকা জায়গাটায় যখন আমি আর আজম খান পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সুপ্রকাশ বিকেল থাকতেই আমাদের সঙ্গে দেখা করে চলে গিয়েছিল ওর নিজের কাজে, আমাদের সাহায্যের জন্য দিয়ে গিয়েছিল ওর কাকার ছেলেকে। ছেলেটার নাম পরেশ। বারো-তেরো বছর বয়স। বাংলায় প্রচণ্ড টান থাকলেও স্কুলে পড়ছে বলে তবু ভাল করে শুনলে কী বলছে বোঝা যায়।

দুপুরে ছিমছাম নিরামিষ তরকারি-ভাত খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিতে না নিতেই পরেশ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল তুলাই নদীর ধারে। সেখানে তখনও মোখা নৃত্যশিল্পীরা আসেনি, বরং কয়েকজন পালোয়ান জাতীয় লোক হাত পা নাড়িয়ে দৈহিক কসরত দেখাচ্ছে।

আজম খাঁ সকালে এসে থেকেই কেমন চুপ করে গিয়েছিলেন। হয়ত চারপাশের পরিবেশটাকে একেবারেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না বলে। এখন পালোয়ানদের দেখে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করলেন, ”ও বাবা, এখানে দেখি বডি বিল্ডাররাও এসে জুটেছে লাহিড়ী সাহেব!”

আমি ট্রেনে আসার সময় গমীরা নাচ সম্পর্কে ইন্টারনেটে একটা বই পড়তে পড়তে এসেছিলাম। সেই সুবাদে একটু হলেও ধ্যানধারণা হয়েছে আমার। বললাম, ”না খাঁ সাহেব। এই দৈহিক কসরত গমীরা নাচে চলে আসছে সেই সম্রাট অশোকের আমল থেকে।”

”সম্রাট অশোক?” আজম খাঁ বেশ অবাকই হয়েছিলেন।

”হ্যাঁ। মৌর্য আমলে বছরে একটা সময় রাজারা বিহার যাত্রার মাধ্যমে রাজ্য দর্শন করতেন। সঙ্গে থাকত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর মুখোশ পরা নৃত্যশিল্পীরা। সম্রাট অশোকের সময় থেকে সেই বিহার যাত্রা পরিণত হয় ধর্ম যাত্রায়।

সেই ধর্মযাত্রায় ঢাক আর কাঁসার ঘন্টা বাজিয়ে মুখোশ পরে নাচ হত। পালোয়ানরা এইরকম কসরতও দেখাত। আসলে সম্রাট অশোক মুখোশনাচের মাধ্যমে ধর্মপ্রচার করতে চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। সেইসব প্রথাই এই গমীরা নাচের মত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসছে।”

 ”বুঝলাম। আপনি অনেক স্টাডি করেছেন!” খাঁ সাহেব দূরে আঙুল দেখিয়ে ইশারা করলেন, ”এবার ওদিকে দেখুন।”

আমি আজম খানের আঙুল অনুযায়ী তাকিয়ে দেখলাম আমাদের কথার ফাঁকে কখন যেন শ্মশানের পাশের সমতল জায়গাটা সাজিয়ে ফেলা হয়েছে। বেশ অনেকটা চওড়া বাঁধানো চাতাল, তার ওপর দিয়ে ঝলমল করছে নানা রঙিন ফিতে। চারপাশে জ্বালানো হয়েছে হ্যাজাক। আস্তে আস্তে ভিড় জমছে চারপাশে।

”এখুনিই তার মানে নাচ শুরু হবে।” আমি বিড়বিড় করলাম।

পরেশ বলে সুপ্রকাশের কাকার ছেলেটা এতক্ষণ আমাদের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন আমার কথাটা শুনতে পেয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, ”না বাবু। আগে দেবাংশী দুজন আসবে, মন্তর পড়বে, তারপর গমীরা শুরু হবে।”

সুপ্রকাশ কাকে কী বলে গেছে জানিনা, তবে কয়েকজন আমাদের বেশ খাতির করছিল। সুপ্রকাশের কাকা আসার পর আমাদের সকলের জন্য কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে দেওয়া হল, আমরা তাতে বসলাম। এখানকার নারীপুরুষ সবাই উবু হয়ে বসে রয়েছে চারপাশে গোল করে, মেয়েদের কারুর কারুর কোলে ছোট বাচ্চা। একপাশে ঢাক বাজছে।

মোখা নাচ সম্পর্কে আগে থেকে নিষেধাজ্ঞার জন্যই হোক বা এতদিন ধরে সুপ্রকাশের কাছ থেকে নানা প্রবাদ শোনার জন্য, হ্যাজাকের আলোয় চারপাশটা বেশ রহস্যময়ই লাগছিল। কেন জানিনা মনে হচ্ছিল, এমন কিছুর সাক্ষী হতে যাচ্ছি যা চিরকাল মনের মধ্যে গাঁথা থাকবে।

সুপ্রকাশের কাকা চুপচাপ বসেছিলেন, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে বিজাতীয় ভাষায় কিছু বললেন।

আমি কিছুই বুঝতে না পেরে অপ্রস্তুতভাবে হাসলাম।

পরেশ পাশ থেকে সেই টান দেওয়া বাংলায় বলল, ”বাবা বলছে আপনাদের কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? নাচ এখুনি শুরু হবে। তখন কোন কথা বলবেন না।”

এখানে এসে ইস্তক দেখছি অনেকেই এসে সুপ্রকাশের কাকার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে যাচ্ছে। সুপ্রকাশ তাহলে ঠিকই বলেছিল, ওর কাকার এখন বেশ খাতির গ্রামে।

আমি সৌজন্যের হাসি হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আচমকা প্রচণ্ড জোরে কাঁসরঘণ্টা বেজে উঠল। আর দুপাশ থেকে নাটকীয় ভঙ্গীতে মঞ্চে আবির্ভূত হল দুটো নাচের দল। সুপ্রকাশের কথা সঠিক, এক দল লাল টকটকে ধুতি মালকোঁচা মেরে হাঁটু অবধি পরে রয়েছে, ঊর্ধ্বাঙ্গে সাদা ফতুয়া, গলায় নানারকমের ছোটবড় হার। অন্য দলের পরনেও একই পোশাক, কিন্তু তাদের মুখে রয়েছে বিশাল বিশাল মোখা।

প্রতিটিই ভয়ঙ্করদর্শন। শিল্পীদের অনাবৃত হাতে আলতা জাতীয় কিছু লেপে আরো ভয়ঙ্কর করা হয়েছে চেহারাগুলো।

প্রতিটি দলে নাচিয়ে রয়েছে চারজন করে, তার পাশে পাশে কপালে লাল তিলক এঁকে পা ফেলছে একটা করে লোক। আমি অনুমানে বুঝলাম, এই দুজনই সেই দেবাংশী। মঞ্চের একেবারে মধ্যিখানে এসে জোরে জোরে মন্ত্রোচ্চারণের ঢঙে দেবাংশী দুজন কিছু উচ্চারণ করতে লাগল।

আড়চোখে আজম খানের দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর মুখচোখ বদলে গেছে, খোলা আকাশের নীচে বসে ওপরে তাকিয়ে কী সব বিড়বিড় করছেন।

আমি মৃদু ঠেলা মেরে বললাম, ”খাঁ সাহেব, সুপ্রকাশকে চিনতে পারছেন?”

”হায় আল্লা!” খাঁ সাহেব সাদাচোখে নাচের দলটার দিকে তাকালেন, ”এঁদের মধ্যে কী করে চিনব জনাব! আচ্ছা, বলি টলি হবে না তো?”

আমি ভাল করে দলটার দিকে তাকালাম। ওই তো, ওই তো সেই উড়ানকালী ঠাকুরের মোখা, যেটা প্রথম দেখেছিলাম লক্ষ্নৌয়ের সেই হোটেলে। সেই করালদর্শন মোখার আড়ালে যে মানুষটা ঢাকের তালে দ্রিমিদ্রিমি ভঙ্গীতে নেচে চলেছে, তাকে চিনতে আমার অসুবিধা হচ্ছিল না। তার কারণ, অন্য নাচিয়েদের তুলনায় তার লাফের গতি বা উচ্চতা বেশ শ্লথ, অনভ্যাস হেতু।

সুপ্রকাশের মুখ আর মাথায় কাপড় এমনভাবে পেঁচিয়ে জড়ানো, যে তাকে চেনার সাধ্য কারুর নেই। পাটের দড়ি দিয়ে মোখাটা চেপে আটকে দেওয়া হয়েছে মুখের সাথে।

দেখতে দেখতে আমি অনুভব করলাম, এই নাচ জানা না জানা এমন কিছু ব্যাপার নয়। নাচের কলাকৌশল বলতে কিছুই নেই, খালি বড় বড় লাফ দিয়ে দিয়ে ঢাক আর কাঁসির তালে তালে নেচে যাও।

পাশে একটা খুট করে শব্দ পেয়ে দেখি সুপ্রকাশের কাকা নিবিষ্টমনে চেয়ে আছেন নাচের দিকে। তাঁর হাতের আঙুলগুলো বোধ হয় উত্তেজনায় ঈষৎ কাঁপছে। ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেছে, বিড়বিড় করছেন কিছু।

নাচের লয় ক্রমেই দ্রুত হচ্ছিল। মোখা পরিহিত শিল্পীরা ক্রমেই তাদের হাতের লাঠির মত জিনিসগুলো নিয়ে তেড়ে যাচ্ছিল মুখোশহীন শিল্পীদের দিকে। আমি চাপা গলায় পরেশকে জিজ্ঞেস করলাম, ”কোন দল জিতবে?”

পরেশ একটুর জন্যও না চোখ সরিয়ে উত্তর দিল, ”মোখার দল। ওদেরই তো জিততে হবে। নাহলে দেবতা শান্ত হবে কী করে আর মোখাগুলো চিতায় পুড়বে কী করে!”

আমি মাঝেমাঝেই তাকাচ্ছিলাম উড়ানকালীর মোখাটার দিকে। সত্যিই কি সেই মোখার মধ্যে এখন বাস করছে সুপ্রকাশের বাবার আত্মা? যাকে চিরতরে তৃপ্তি দিতে আজ আসরে নেমেছে সুপ্রকাশ?

কিন্তু কেন?

বারোবছর আগের সেই দুর্ঘটনার পর আবার এই কালগমীরা নাচের আসরে ওই মোখা পরে নাচলে কেন তৃপ্তি পাবে সুপ্রকাশের বাবার আত্মা?

আমি একটু ঝুঁকে আজম খানকে সেই কথাটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, ওদিকে বাজনা তখন চরম জোরে বাজছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছি এবছরের মত গমীরা নাচ শেষ পর্বে এসে পৌঁছেছে, এমন সময় যেটা ঘটল, সেটা ভাবলে এখনও আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে।

উড়ানকালীর মোখা পরিহিত সুপ্রকাশ লাফাতে লাফাতে এদিক ওদিক চক্রাকারে পাক খেতে শুরু করল। ও যেন আর ওর মধ্যে নেই, কেউ যেন অমোঘ এক ঘূর্ণিপাকে ঘোরাচ্ছে ওকে পুতুলের মত, একটু আগের সেই অনভ্যস্ত শ্লথ গতি তো নেই, বরং রুদ্ধশ্বাস জোরে পাক খেয়ে চলেছে ও। এতটাই দ্রুত যে সবাইকে বাদ দিয়ে চারপাশে গোল করে বসে থাকা মানুষ ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে।

সুপ্রকাশ এত জোরে ঘুরছে যে ওর ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে ফ্যানা বেরিয়ে আসছে, কিন্তু তবু ও গতি কমাচ্ছে না। প্রতিটি পাকে প্রায় এক মানুষ সমান লাফিয়ে আবার পড়ছে মঞ্চে, তারপর আবার পাক খাচ্ছে। হাতের লাঠিখানা কখন খসে পড়েছে হাত থেকে।

আমি বিস্ফারিত চোখে দেখছিলাম। সুপ্রকাশের গতি ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না আমার। শুধু আমার নয়, কারুরই।

কী ভেবে আমি উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই চরকি পাক খেতে খেতে ও এসে পড়ল আমাদের একদম সামনে, তারপর হঠাৎ … হঠাৎ সব ঢাক কাঁসির আওয়াজ ছাপিয়ে একটা জান্তব আওয়াজ করে আমাদের ঠিক পাশ থেকে তুলে নিল ওর কাকাকে, প্রবল আস্ফালনে ঘোরাতে শুরু করল শূন্যে।

দুই দলের দুই দেবাংশী হকচকিয়ে গেল এই ঘটনায়, নাচের দলের দেবাংশী মন্ত্র ভুলে চেঁচিয়ে উঠল কিছু, কিন্তু সুপ্রকাশ পরোয়া করল না, কলের পুতুলের মতই সেই প্রচণ্ড গতিতে তার কাকার শরীরটাকে বনবন করে ঘোরাতে লাগল। ওর পা দুটো মঞ্চের এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে অক্ষের কাজ করছিল, আর গোটা শরীরটা দেহকাণ্ডের ওপর ভর করে ঘুরছিল লাট্টুর মত, আর ঠিক লাট্টুর মুণ্ডুর মতই দুহাত দিয়ে ওপরে তুলে ধরা ওর কাকার শরীরটা ঘুরছিল প্রায় উল্কার গতিতে।

এমন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সবাই ভয়ার্তমুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, আমরাও ভীতসন্ত্রস্তভাবে উঠে দাড়িয়েছি, এমন সময় শূন্যে ঘোরাতে ঘোরাতে কাকার শরীরটাকে কোলে নিয়ে ও ধপ করে বসে পড়ল মঞ্চের মাঝখানটায়, বিকৃত একটা উল্লাস করে নিজের হাতের বড় বড় কৃত্রিমভাবে আটকানো নখগুলো সটান ঢুকিয়ে দিল ওর কাকার পেটে। মুহূর্তের মত গলগলিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল সেখান থেকে।

আমরা এতটাই আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম যে নড়তেও পারছিলাম না। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু দম্ভভরে পুত্র প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্তিকে তাচ্ছিল্য করে পদাঘাত করেছিলেন স্ফটিকস্তম্ভে, তখন বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার নৃসিংহ আবির্ভূত হয়ে হিরণ্যকশিপুকে নিজের দুই উরুর মধ্যে ফেলে নখ দিয়ে রক্তাক্ত করে হত্যা করেন। সুপ্রকাশের এই পাশবিক কাণ্ড আমাকে যেন সেই বিখ্যাত হিরণ্যকশিপু বধের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল।

আমার মনে হচ্ছিল উড়ানকালীর মোখার আড়ালে এখন আর সুপ্রকাশ নেই, প্রতিশোধের তীব্র দহনে সেখানে আক্রোশের নিঃশ্বাস ফেলছে ওর বাবা।

ওর বাবাই যেন আজ সেই নৃসিংহ অবতার। আর কাকা? হিরণ্যকশিপু! সুপ্রকাশ নেহাতই এক অজুহাত, ঠিক প্রহ্লাদের মতই!

বিকট বিকৃত মরণ চিৎকার, তারপরই দেখলাম ফেনার মত তাজা রক্ত ছড়িয়ে পড়ল গোটা জায়গাটায়।

সুপ্রকাশের কাকার নাড়িভুঁড়ি বেরনো ক্ষতবিক্ষত নিষ্প্রাণ দেহটা একলহমায় আছড়ে পড়ল মঞ্চের মাঝখানে।

* * *

আজম খান আজ ফোন করেছিলেন লক্ষ্নৌ থেকে। কলকাতা থেকে ফেরত যাওয়ার পর অনেক অনুরোধ উপরোধে ভদ্রলোক এখন একটা ফোন কিনেছেন। আমি রিসিভ করতেই কোন ভণিতা না করে বললেন, ”সুপ্রকাশ ফোন করেছিল?”

”না তো!” আমি চমকে উঠেছিলাম। দক্ষিণ দিনাজপুরের ত্রিমোহিনী গ্রামের সেই অভিশপ্ত রাতের স্মৃতি এখনও এই একমাস পরেও মনে সমান ভাবে স্পষ্ট। কীভাবে যে সেদিনের পর টলতে টলতে কালিয়াগঞ্জ ফিরে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরেছিলাম, ভাবলে এখনো হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।

আমি একটা দম নিয়ে বললাম, ”কী বলল সে? কেমন আছে?”

আজম খান একটু থেমে বললেন, ”ভাল। আপনাকে শীগগিরই ফোন করবে। কাল জামিনে ছাড়া পেয়েছে। সেদিনের ঘটনার তেমন কোন সাক্ষী পুলিশ পায়নি। তাই কেস ঢিমেতালে এগোচ্ছে। ক্লোজ হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই।”

”সে কী!” আমি অবাক হয়ে বললাম, ”সারা গ্রাম তো উপস্থিত ছিল কালগমীরা নাচের সময়।”

”তো কী!” খাঁ সাহেব একটু থেমে বললেন, ”বারো বছর আগে কালগমীরার রাতে সুপ্রকাশের কাকা ওর বাবাকে গলা টিপে খুন করেছিল, তারপর সেই ডেডবডি ফেলে দিয়েছিল কারেন্ট হয়ে থাকা জলে। যাতে সবাই ভাবে সুপ্রকাশের বাবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন। সেই প্রতিশোধ পরের কালগমীরায় নিয়েছে ওর বাবা। এতে তো কোন দোষ নেই। সবই তো উড়ানকালীর আদেশ! অন্তত গ্রামের লোকেরা তাই মনে করছে। সবাই সুপ্রকাশের পক্ষে।”

আমার মনে পড়ল, সুপ্রকাশ পুলিশের সঙ্গে চলে যাওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়ে সেদিন ম্লানমুখে হেসেছিল, ”বাবার মনে যে এই ছিল বুঝিনি ইন্দ্রজিৎদা!” পরক্ষণেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল ও, ”অবশ্য বুঝিনি তো অনেক কিছুই। বারো বছর আগে বাবার ক্রমাগত নামডাকে হিংসায় কাতর কাকাই যে বাবাকে খুন করেছিলেন, সেটাও কি বুঝেছিলাম?”

আমি অধীরভাবে বলেছিলাম, ”তোমার বাবার অতৃপ্ত আত্মা তাহলে বারোবছর অপেক্ষা করে এই বছরের কালগমীরাতে প্রতিশোধ নিল সুপ্রকাশ?”

সুপ্রকাশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে ততক্ষণে উঠে পড়েছিল পুলিশভ্যানে। চলতে শুরু করেছিল গাড়ি। আমি আর আজম খান আরও প্রচুর গ্রামবাসীর সঙ্গেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেছিলাম সেই যাত্রা।

টেলিফোনের ওপার থেকে আজম খানের স্বরে আবার বর্তমানে ফিরে এলাম, ”লাহিড়ী সাহেব, সুপ্রকাশ ওর খুড়তুতো ভাইটাকে কলকাতা পাঠাতে চায় পড়াশুনোর জন্য। সেই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে ফোন করে কথা বলবে।”

”ওর কাকার ছেলে পরেশকে?”

”হ্যাঁ।” খাঁ সাহেব বললেন, ”ও বলল, পরেশের তো কোন দোষ নেই! সে ওর ভাই, এটুকুই সুপ্রকাশ মনে রাখতে চায়।”

আমি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম, ”সুপ্রকাশের কাকার বারো বছর আগে কোন পসার ছিল না। অথচ দাদার নামডাক ক্রমেই বাড়ছিল। ঈর্ষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি! উনি সম্ভবত কল্পনাও করতে পারেননি পরের কালগমীরায় এইভাবে মাশুল দিতে হবে।”

আজম খান বললেন, ”সত্যিই মোখা ভয়ঙ্কর এক জিনিস লাহিড়ী সাহেব! আমি জীবনেও ভুলব না এই অভিজ্ঞতা।”

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ”আর নখাশ বাজারের কোন খবর আছে?”

সুপ্রকাশের কাকার একটাই ছবি আমার মোবাইলে ছিল, যেটা সেদিন ওঁদের বাড়ির দালানে তুলেছিলাম। সেটা আজম খানকে পাঠিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে। ওই ছবিতে ওর কাকা ছাড়াও দু-চারজন সহকারী ছিল। আমি দেখতে চাইছিলাম ওদেরই কেউ গিয়ে নখাশে সেটা বিক্রি করে এসেছিল কিনা।

”হ্যাঁ, আছে।” আজম খান বললেন, ”আপনি যে ছবি পাঠিয়েছিলেন, সেটা দেখে ওই জেনানা চিনতে পেরেছে।”

আমি উত্তেজিতভাবে বললাম, ”সে কী! ওর কাকাকে?”

”না।” আজম খান একটু থেমে বললেন, ”দেওয়ালে যার ছবি ঝুলছিল তাকে। যে লোকটা এসে মোখাটা বেচে দিয়ে গিয়েছিল, তার সঙ্গে দেওয়ালের ওই ছবিটার নাকি হুবহু মিল।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *