বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। ছাত্রদের পাসের হার ৭৩.৯৩, ছাত্রীদের পাসের হার ৭৫.৬০। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছেলেরা একটু দুষ্টু, তাই রেজাল্ট খারাপ করেছে’।
মেয়েদের পাসের হার কম হলে লোকে কী বলতো? বলতো, ‘মেয়েরা একটু ডাল, তাই রেজাল্ট খারাপ করেছে’।
ছেলেরা ‘দুষ্টু’ মানে পড়াশোনায় মন নেই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করে, খেলাধুলো নিয়ে পড়ে থাকে। মেয়েরা ‘দুষ্টু’ মানে সেক্সি পোশাক পরে ছেলেদের সিডিউস করার চেষ্টা করে, ছেলেদের সঙ্গে শুয়ে বেড়ায়।
মেয়েরা বার বার প্রমাণ দিচ্ছে মেয়েরা পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু তারপরও মেয়ে-বিরোধী সমাজ কিন্তু যেমন ছিল, তেমনই আছে। কারওরই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি।
খুব বেশিদিন হয়নি মেয়েরা ইস্কুলে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে। ঘরের বাইরে বেরোনোরও অধিকার ছিল না মেয়েদের। থাকতে হতো পর্দার আড়ালে। ইস্কুলে যাওয়ার, বইপত্র পড়ার, ডিগ্রি নেওয়ার, উপার্জন করার অধিকার রীতিমত দীর্ঘ আন্দোলন করে অর্জন করতে হয়েছে। কত কুসংস্কারই যে রচনা করা হয়েছে মেয়েদের বিরুদ্ধে, মেয়েরা ইস্কুলে গেলে নাকি স্বামী মারা যাবে, মেয়েরা আপিসে গেলে সংসার ভেঙে যাবে। এত প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে মেয়েরা পড়াশোনা করলো আর দেখিয়ে দিল ছেলেদের চেয়ে তারা ভালো। এখন কি সব মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে শুরু করবে! চাকরির উঁচু পদগুলো মেয়েরা পাবে! আমার বিস্তর সংশয়।
মেয়েদের উচ্চশিক্ষার চেয়ে, স্বনির্ভরতার চেয়ে, মেয়েদের বিয়ে হওয়া, পরনির্ভর হওয়া, বাচ্চা কাচ্চার মা হওয়াকেই প্রাধান্য দেয় পরিবার আর সমাজ। অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা না থাকলেও সামাজিক পরনির্ভরতা যেন যে করেই হোক মেয়েদের থাকে। এই সমাজ নিয়ে প্রায়ই আমি হতাশ হই। তাই সমাজ বদলের আশায় থাকি।
আজকালকার পুরুষরা মেধাবী মেয়েদের বিয়ে করতে ইচ্ছুক। সম্ভবত বাইরে বলে বেড়ানোর জন্য, ‘বউ তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট’, ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’! বিয়ের পরও বলা যায়, ‘ওকে একটা বাচ্চাদের ইস্কুলে ঢুকিয়ে দিয়েছি বা মেয়েদের জন্য ভালো এমন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছি’, বা ‘অবসর সময়টায় কিছু একটা করতে চাইছে তাই একটা চ্যারিটি অরগানাইজেশনে জয়েন করতে বলেছি’। সন্তান হওয়ার পর বলে বেড়ানো যায়, ‘বাচ্চাদের সুবিধে, ঘরে মায়ের কাছেই পড়ছে। ’ মেধাবী মেয়ে বিয়ে করতে চাওয়ার আরও কারণ আছে, কারণ ওরা চাকরি করলে বেতনের টাকাটা স্বামীর হাতে দেবে অথবা না দিলেও সংসার খাতেই খরচ করবে। রোজগেরে মেয়ে বিয়ে করার চল শুরু হয়েছে বাংলায়। পরনির্ভর মেয়েদের শাসিয়ে যতটা সুখ পাওয়া যায়, স্বনির্ভর স্বাবলম্বী সচেতন মেয়েদের শাসিয়ে তার চেয়েও বেশি সুখ পাওয়া যায়। আত্মবিশ্বাসও ভীষণ বেড়ে যায়।
আমরা জানি কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে মেয়েদের চেয়ে বেশি ছেলেরাই। কারণ অনেক মেয়ে এর মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হবে। অনেক মেয়েই স্বামী এবং শ্বশুর শাশুড়ির উপদেশ বা আদেশ মানতে বাধ্য হবে, পড়াশোনা বন্ধ করে দেবে বা চাকরি ছেড়ে দেবে। অনেক মেয়েই গর্ভবতী হবে, অথবা সন্তান প্রসব করবে। তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না মেধার মূল্য দেওয়া।
সংসার এবং চাকরি কী করে একসঙ্গে সামলাবে এই প্রশ্নের সামনে মেয়েদেরই পড়তে হয়। পুরুষদের পড়তে হয় না। কেউ কোনও পুরুষকে জিজ্ঞেস করে না, এই যে চাকরিতে ঢুকেছেন, সংসার কী করে সামলাবেন, দুটো একসঙ্গে অসুবিধে হবে না? সংসার সন্তানের জন্য মেয়েরা নিজের স্বনির্ভরতা ত্যাগ করলে লোকে খুশি হয়। সংসার সন্তানের জন্য পুরুষরা নিজের স্বনির্ভরতা ত্যাগ করলে লোকে ছি ছি করে।
মেয়েদের খেলাধুলো করাও তো একরকম বারণ ছিল। ছোটবেলায় দেখেছি, বাবা মায়েরা মেয়েদের বড়জোর পুতুল খেলতে দিত, দৌড়ঝাঁপের মধ্যে উঠোনে ওই দড়ি লাফানো, এক্কা দোক্কা, অথবা গোল্লাছুট। খেলা মূলত ছেলেদের জন্য। হৈ হল্লা ছেলেদের জন্য। আনন্দ উল্লাস ছেলেদের জন্য। সতীচ্ছদ ছিঁড়ে যাবে এই ভয়ে মেয়েদের সাইকেল চালাতে দিতেও অনেক লোক আপত্তি করতো। সত্তর দশকে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছি। মেয়েদের জন্য তখনও রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বের হওয়া বা লেকে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ। আমি আজও সাইকেল চালাতে জানি না। সাঁতার শিখেছি যখন বার্লিনে ছিলাম।
ভারত এত বড় দেশ। অথচ অলিম্পিকে সোনা রুপো তেমন জোটে না। এবার বিজয়ী বলতে কিছু মেয়ে। কুস্তিতে সাক্ষী, ব্যাডমিন্টনে সিন্ধু। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে দীপা কর্মকার। প্রথম দুজন ব্রোঞ্জ আর সিলভার জিতলেও তৃতীয়জন কিছু জেতেনি, কিন্তু চতুর্থ হয়েছে। হয়েছে তো চতুর্থ। প্রোদুনোভার মতো কঠিন ঘটনা তো অনেকটাই ঘটিয়ে দেখিয়েছে। প্রশিক্ষণে অঢেল টাকা ঢেলে ছেলেদের খেলোয়াড় বানানো হয়। মেয়েদের খেলোয়াড় বানাতে ঠিক কত যায়? খুব বেশি যায় কি? দীপাকে তো দেশের বাইরে পাঠানো হয়নি প্রশিক্ষণ নিতে। দেশি কোচ দিয়েই কাজ সারতে হয়েছে মেয়েকে।
কী আশ্চর্য তাই না? মেয়েদের দক্ষ খেলোয়াড় বানাতে যে দেশের, সমাজের, সংস্কৃতির অবহেলা, সেই দেশের মেয়েরাই অলিম্পিকের পদক জিতে দেশকে গর্বিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। মেয়েরা পারে না, পারবে না, মেয়েদের ঘটে বুদ্ধি নেই, পেশিতে জোর নেই— সেই কতকাল থেকে শুনে আসছি। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত, অপমানিত মেয়েরাই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করে।
মানুষের তবু শিক্ষা হয় না। কন্যায় আপত্তি বলে অনেকে কন্যার ভ্রূণ নষ্ট করে ফেলে, কন্যাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলে অথবা অনাদরে বড় করে। পুত্র জন্ম দিয়ে ধন্য হয় লোক। অথচ অনেক সময় দেখা যায় হেলাফেলা করে বড় করলেও বাবা মা’কে দেখভাল অধিকাংশ সময় কন্যাই করে, ননীটা ছানাটা খেয়ে বড় হওয়া পুত্র বরং দায়িত্ব এড়ায়।
মেয়েদের হাজারো কিছু করার স্বাধীনতা নেই। যদি থাকতো, তবে দক্ষতা দেখাতে পারতো আরও। পৃথিবীর অর্ধেকই নারী। এই অর্ধেককে আবৃত করে, অনাবৃত করে, অশিক্ষায় মুড়িয়ে, অত্যাচারে ভুগিয়ে মারছে পুরুষ আর তার তৈরি সমাজ ব্যবস্থা। যদি একবার সমান সুযোগ পেত মেয়েরা, একবার যদি সমান সুযোগ পেতাম আমরা, পৃথিবী বদলে দিতে পারতাম। ছেলেরা যে সুযোগ পায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে, যেখানে খুশি সেখানে যেতে, জগৎ জানতে, জ্ঞানার্জন করতে— একই সুযোগ মেয়েদের দেওয়া হোক। একই অধিকার, একই স্বাধীনতা মেয়েদের একবার দিয়ে দেখুক সমাজ। সোনার মেডেল কারা নিয়ে আসে দেখুক। বিজয় নিশান কারা ওড়ায় দেখুক।
কেউ যেন ভাববেন না আমি ছেলে-মেয়েদের আলাদা করে দেখছি। আসলে, আমি নই, আলাদা করে সমাজ দেখছে। আমি এক করতে চাইছি। এই বলে এক করতে চাইছি যে ছেলেরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে দক্ষ, মেয়েরাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ। যে খেলাগুলো ছেলেরা খেলে, সেসব মেয়েরাও খেলে। মেয়েরা ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ম্যারাথন, বাস্কেটবলও খেলে। মেয়েরাও পারে। উড়োজাহাজ কেন, মহাকাশযানও চালাতে পারে। হাতিয়ার হাতে নিয়ে যুদ্ধ করতেও পারে। ছেলেরা যা পারে, মেয়েরা প্রমাণ করেছে মেয়েরাও তা পারে। কিন্তু মেয়েরা আরও যা পারে, ছেলেরা এখনও প্রমাণ করতে পারেনি, ছেলেরাও সেসব পারে। একটি যেমন শিশু পালন।
মেয়েরা কম বোঝে, কম জানে, কম পারে— এসব তো নতুন নিন্দে নয়। এসব শুনে শুনে বড় হয়েছে প্রায় প্রতিটি মেয়ে। ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’ বলে মেয়েদের পেছনে মেয়েদের লেলিয়ে দিয়ে মজা দেখে পুরুষ। মেয়েদের বোকা বানিয়ে, দাসী বানিয়ে, ঠকিয়ে, নিঃস্ব করে পুরুষ আনন্দ পায়। এ তো হাজার বছরের ইতিহাস।
মেয়েরা পুরুষকে যে সম্মান দেয়, একই সম্মান যদি পুরুষরাও মেয়েদের দিত, তা হলে সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য বলে কিছু থাকতো না। পুরুষ তৈরি পিতৃতন্ত্র বহাল না থেকে যদি মানবতন্ত্র বহাল থাকতো, তবে ধর্ষণ, বধূহত্যা, পণ প্রথা, নারী নির্যাতনও বন্ধ হতো।
নারীবিরোধী আইন যতদিন সমাজে আছে, যতদিন নারীবিরোধী ওয়াজ চলবে, যতদিন পিতৃতন্ত্র ছড়ি ঘোরাবে, যতদিন ধর্মান্ধতা বিরাজ করবে সমাজে— ততদিন নারী সেই সম্মান পাবে না যে সম্মান তার পাওয়া উচিত।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ আগস্ট, ২০১৬