কিছু দিন আগে আমার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছে। বন্ধুটি উচ্চশিক্ষিত। বিহারের বেগুসরাইয়ে তার পৈতৃক বাড়ি। বাড়ির কাছে গঙ্গা, সেই গঙ্গার ধারে এক শ্মশান ঘাটে সে তার বাবার মুখাগ্নি করলো, বাবার ছাই ভাসালো গঙ্গা আর যমুনার মিলনস্থলে, ত্রিবেণী সঙ্গমে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন বন্ধুটি নানা রকম কুসংস্কার পালন করছে। সেলাই নেই এমন কাপড় গায়ে পরেছে। এমনই নাকি পরতে হয়। ফল আর দই ছাড়া কিছুই খাচ্ছে না। কিছু দিন আগেই পুরো এক মাস মাছ মাংস খায়নি। শ্রাবণ মাসে নাকি মাছ মাংস খেতে হয় না। এছাড়া প্রতি সপ্তাহেই তিন দিন মাছ মাংস খায় না, শনিবার, মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার। বাবা মারা যাওয়ার পর শুধু খাওয়াই বন্ধ করেনি, বিছানাতেও শুচ্ছে না সে। ধাড়ির ওপর শুচ্ছে। মাথার চুলও বললো ফেলে দেবে।
আমার মনে আছে ছোটবেলায় দেখতাম পাশের বাড়ির হিন্দু ছেলেরা বাবা মারা যাওয়ার পর এক টুকরো সাদা কাপড় গায়ে পরতো আর হাতে একটা মলিন মাদুর নিয়ে হাঁটতো। যেখানেই বসতো, ওই মাদুরখানা পেতে বসতো। ওদের দেখে আমার খুব মায়া হতো। উঠোনে কাকের জন্য খাবার ছড়িয়ে কা কা কা কা বলে সারা দুপুর ডাকতো, কাক এসে খাবার খেয়ে গেলে তবেই নিজে খেতে পারতো। যেদিন কাক খেতো না, সেদিন ওরা নিজেরাও খেতো না। এই নিয়মগুলো আমার ভালো লাগতো না কখনও। শুনতাম ওরা বিশ্বাস করে, ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর কাক হয়ে গেছে, তাই নিজের খাওয়ার আগে বাবাকে খাওয়ায়। ছেলেগুলো কী করে বিশ্বাস করতো ওদের বাবারা এখন কাক হয়ে গেছে, আমি ঠিক বুঝে পেতাম না। শত সহস্র যুক্তিহীন সংস্কার চারদিকে, অধিকাংশরই ব্যাখ্যা আমি জানি না।
ভারতবর্ষ কুসংস্কারে টইটম্বুর। কুসংস্কারই এখানকার সংস্কৃতি। আমার বন্ধুটির সঙ্গে প্রতিদিনই ফোনে কথা হয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এই কষ্টগুলো করছো, সামান্য যুক্তিবুদ্ধি থাকলেই তো বোঝা যায় যা করছো সবই অর্থহীন! বন্ধুটি বললো যা কিছু করছে সে— বাবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে করছে, অথবা বাবা এসব মানতো বলে করছে। আমার কিন্তু মনে হয় বন্ধুটি নিজেই এসব বিশ্বাস করে। নিজে বিশ্বাস না করলে নিজেকে এমন শারীরিক কষ্ট দেওয়া যায় না।
আমার বন্ধুকে কাক খাওয়াতে হয় না। তবে ব্রাহ্মণ খাওয়াতে হয়। গোয়ায় পিন্ডিদান করতে যাবে সে। চালের গুঁড়ো, গমের গুঁড়ো, তিল, আর মধু দিয়ে এক পিন্ড বানিয়ে সেটির ওপরই দুধ ঢেলে, ফুল রেখে পুজো করা হয়, এইভাবেই পিন্ডিদান করে লোকে। তার বাবার আত্মা নাকি পৃথিবীতে থেকে ছটফট করছে, যা করতে চাইছে, পারছে না করতে, কারণ আগের মতো শরীরটি তো তার নেই। আত্মাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই পিন্ডিদান। যতই অর্থহীন হোক, ধর্মীয় প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানই মেনে চলছে বন্ধুটি। সে শ্রাদ্ধ করবে। পিতৃ ঋণ, দেব ঋণ, ঋষি ঋণ সবই সে শোধ করবে।
বন্ধুটি অনেক কিছুতে বিশ্বাস করে, জ্যোতিষি, ভূত প্রেত। আমার এক বাঙালি বন্ধুরও এসবে প্রচণ্ড বিশ্বাস। যখনই প্রমাণ চাই, তখনই একগাদা ভূতের গল্প সে করে, নিজের অভিজ্ঞতার অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প। সবগুলোর যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছি। কিন্তু কিছুই সে মানবে না। বিশ্বাস এমনই ভয়ংকর। বাঙালি বন্ধুও উচ্চশিক্ষিত। সরকারি উচ্চপদে চাকরি করে। আসলে সমাজের সব স্তরের মানুষ, নারী পুরুষ, উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্ত, উঁচুজাত নিচুজাত সবাই বিশ্বাস করে কুসংস্কারে। কেউ কেউ ডাইনি সন্দেহে মানুষ পুড়িয়ে মারে। ভারতবর্ষে খুব কম লোককেই পেয়েছি যাদের কুসংস্কারে বিশ্বাস নেই। উচ্চশিক্ষিত কেউ এসবে বিশ্বাস করলে আঁতকে উঠি। হতাশা গ্রাস করে। যে দেশে স্পেস রিসার্স প্রোগ্রামের বিজ্ঞানী পরিচালক মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশে মহাশূন্যে রকেট পাঠিয়ে মন্দিরের ভিতর রকেটের মূর্তি নিয়ে ঢোকেন ভগবানের আশীর্বাদ নিতে, সেই দেশে সাধারণ মানুষ যে কুসংস্কারে বিশ্বাস করবে, এ তো খুব স্বাভাবিক। এখনও এ দেশে ঠিকুজি কুষ্ঠি বিচার হয়, এখনও কাজ শুরুর শুভ অশুভ দিন, বিয়ে কোন মাসে ভালো কোন মাসে মন্দ- দেখা হয়, এখনও হাতের আঙুলে আঙুলে কুসংস্কারের পাথর। এখনও জাদু-টোনা, ডাব পড়া, সুতো পড়া, পানি পড়া, বাটি চালান, চাল পড়ায় লোকের বিশ্বাস অগাধ।
জন্মের সময় মঙ্গলের কোনও প্রভাব থাকলে তাকে মাঙ্গলিক বলা হয়। মাঙ্গলিক মেয়েদের নাকি বিয়ে করতে নেই। বিয়ে করলে সংসার ভেঙে যায়, স্বামী মারা যায়। অনেকে বলে ঐশ্বর্য রাই মাঙ্গলিক ছিলেন, সে কারণে পরিবারের লোকেরা প্রথমে তাঁকে একটা গাছের সঙ্গে বিয়ে দেয়, দ্বিতীয় বিয়ে অভিষেকের সঙ্গে। কালো বিড়াল দেখলে নাকি যাত্রা অশুভ। ময়ূর দেখলে শুভ। তিনটে টিকটিকি দেখলে বিয়ে হবে, চারটে দেখলে মৃত্যু। যে কোনও টাকার অংকের সঙ্গে এক টাকা জুড়ে দিলে সেটি নাকি মঙ্গলময়। কলকাতার গাড়িগুলোয় দেখেছি লেবু আর কাঁচা লঙ্কা ঝোলানো। এতে নাকি অশুভ দৃষ্টি থেকে বাঁচা যায়। অশুভ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর কপালে টিপ পরানো হয়। কিছু কিছু গাছ আছে ওসবে ভূত থাকে বলে অনেকের বিশ্বাস। শনিবারকে অশুভ দিন ভাবা হয়। ভাঙা আয়নায় মুখ দেখলে অমঙ্গল। সেদিন এক ছেলে আমার বাড়িতে এসেছিল। আম কাটার ছুরিটা চাইলে ছুরিটা বাড়িয়ে দিলাম, সে নিল না, বললো ছুরি হাতে দিতে হয় না। শেষ পর্যন্ত টেবিলের ওপর রাখলাম। তবে সে নিল। এই ছেলেটি কিন্তু সমাজে প্রগতিশীল বলে চিহ্নিত।
ঋতুস্রাবের সময় মেয়েদের অপবিত্র বলে মনে করা হয়। শুভ কাজে তাদের কিছু ধরতে-ছুঁতে দেওয়া হয় না। বিধবা মেয়েদেরও তাড়ানো হয়। মেয়েরা সিঁদুর খেলে স্বামীর দীর্ঘায়ুর জন্য। করভা চৌউথ পালন করে, সারাদিন উপোস থাকে, স্বামীর মঙ্গলের জন্য। ভাইফোঁটা ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য। রাখি, সেও ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য। সিঁথির সিঁদুর, হাতের শাঁখা সবই ওই একই কারণে, পুরুষের মঙ্গল, সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু। একসময় সতীদাহ প্রথা ছিল। স্বামী মরলে স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। দেবতার উদ্দেশে মানুষ বিসর্জন আজকাল দেওয়া না হলেও হঠাৎ হঠাৎ কোথাও কোথাও দেওয়া হয়। উত্তর প্রদেশে দশ বছর আগেও দেখা গেছে দু’শ জন মানুষকে বলি দেওয়া হয়েছে। নানা কারণে এই বলি। বৃষ্টি হওয়ার জন্য, গর্ভবতী হওয়ার জন্য। কুসংস্কারের শেষ নেই। সূর্য গ্রহণের সময় কিছু খেতে হয় না, গর্ভবতীদের ওই সময় বাইরে বেরোতে হয় না। বাস্তু শাস্ত্র বলে আরও এক কুসংস্কার বাঙালিরা বেশ মানছে আজকাল। দিন দিন এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এগুলো তো আছেই, আরও নানারকম কুসংস্কার প্রতিদিন পালন করে শিক্ষিত অশিক্ষিত বিজ্ঞানী অবিজ্ঞানী প্রায় সকলে। হাতেগোনা কিছু বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী লোককেই দেখি কুসংস্কার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, হাতে গোনাই। মানতে ইচ্ছে না করলেও এটা সত্য যে, ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চেয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্র বেশি জনপ্রিয়।
এত কুসংস্কারে পৃথিবীর আর কোনও জাতি বিশ্বাস করে বলে আমার মনে হয় না। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কুসংস্কার নির্মূল হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। ২০০৭ সালে ভারতের ১৩০টি প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ১১০০ জন বিজ্ঞানীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ২৪% বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন ধর্মীয় গুরুরা বা বাবারা অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন, ৩৮% মনে করেন ভগবান অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন। ৫০% হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন, ৪৯% বিশ্বাস করেন প্রার্থনায় উপকার পাওয়া যায়।
আমার বিহারি বন্ধুটি আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমার মা মারা যাওয়ার সময় আমি কী কী ধর্মীয় আচারাদি পালন করেছিলাম? বললাম, কিছুই না। মা’র লাশ নিয়ে বাড়ির পুরুষেরা বেরিয়ে গেছে, কবর দেওয়ার আগে জানাজার নামাজে শামিল হয়েছে। মেয়েরা বাড়িতে ছিল। এক নানীই সম্ভবত সেদিন মা’র জন্য নিজের মতো করে নিভৃতে প্রার্থনা করেছে। আমি নামাজও পড়িনি, প্রার্থনাও করিনি। বোধহয় চল্লিশ দিন পর কিছু গরিব লোককে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু হয়নি। বাবার বেলাতেও এর বেশি কিছু হয়নি। আমি ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর কুসংস্কার পালন করে বাবা মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি না, বা তাঁদের ঋণ শোধ করি না। আমি তাঁদের স্মরণ করি নীরবে সরবে, তাদের ভালোটা থেকে শিক্ষা নিই। মা’কে নিয়ে একটি বই লিখেছি, বইটির নাম ‘নেই কিছু নেই’। বইটি পড়ে, অনেকে বলেছে, তাদের মা’কে অবহেলা, অপমান না করার, বরং শ্রদ্ধা করার, ভালোবাসার, প্রেরণা পেয়েছে।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬