ভারতের পর্যটনমন্ত্রী বলেছেন, বিদেশি মেয়েরা যেন ছোট স্কার্ট পরে ঘোরাঘুরি না করে, তাদের নিরাপত্তার জন্যই এটি দরকারি। এ কথা বলে তিনি ভারতের পুরুষদের চরিত্র সম্পর্কে একরকম বুঝিয়ে দিলেন যে ভারতের পুরুষদের চরিত্র খারাপ, মেয়েরা ছোট পোশাক পরলে পুরুষরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যৌন নির্যাতন করে।
সৌদি আরবে ঢুকলেও বিদেশি মেয়েদের মাথায় কাপড় দিতে হয়। ওখানেও এরকম বিশ্বাস যে মেয়েরা চুল ঢেকে না রাখলে পুরুষরা এত উত্তেজিত হবে যে নিজেদের ধর্ষণেচ্ছাকে বাগে আনা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ভারত কি সৌদি আরব হতে যাচ্ছে? ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ, সৌদি আরব মূলত মুসলিম দেশ। ধর্মে মিল না থাকলেও মেয়েদের দাবিয়ে রাখার বেলায় দু’পক্ষে বেশ মিল। আসলে নারী-বিরোধ সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে। অন্য কোনও বিষয়ে মতের মিল না থাকলেও নারী-বিরোধিতায় সব ধর্মের মানুষের মত প্রায় এক। নারীর শরীর নিয়ে, পোশাক নিয়ে, আচার ব্যবহার নিয়ে, চরিত্র নিয়ে তারা প্রায় একই মত প্রকাশ করে। মতটি পুরুষতান্ত্রিক। কোনও ধর্মই পুরুষতন্ত্রের বিপরীত কোনও কথা বলে না। পুরুষতন্ত্র আছে বলেই সর্ব ধর্মের সমন্বয় হওয়া সম্ভব। ধর্মের চেয়ে পুরুষতন্ত্র ঢের শক্তিশালী। পুরুষতন্ত্রই পারে সব ধর্মের মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করতে।
মেয়েদের ওপর পুরুষের যৌন নির্যাতন নতুন কিছু নয়। পুরোনো কালে পুরুষরা যৌন নির্যাতন করতো না, একালেই হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করেছে পুরুষ— আমার মনে হয় না এই তথ্যটি সঠিক। পুরোনো কালে যৌন নির্যাতনকে যৌন নির্যাতন বলে মনে হয়নি মানুষের। যৌন নির্যাতনকে পুরুষের স্বাভাবিক আচরণ বলে ধরে নেওয়া হতো। স্বামী পেটালে, মারলে, ধর্ষণ করলে ভাবা হতো এসবে স্বামীর অধিকার আছে। দীর্ঘ বছরব্যাপী নারীবাদী আন্দোলনের ফলে মানুষ এখন জানে কোনও নারীকেই কোনও রকম নির্যাতন করার কোনও রকম অধিকার কোনও পুরুষেরই নেই, সে পিতা হোক কী স্বামী হোক কী ভাই হোক কী পুত্র হোক। না, কোনও নারীরও সে অধিকার নেই। একসময় নারীরা সব নির্যাতন চুপচাপ সইতো, চুপচাপ সওয়াটাকেই নারীর গুণ বলে মনে করা হতো। এখনও যে হয় না তা নয়। রাস্তাঘাটে যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও ‘পুরুষরা একটু ওরকমই হয়’, ‘পুরুষদের সেক্সটা একটু বেশি’- এসব ভেবে পুরুষের সব অন্যায়কে, সব অপকর্মকে, সব অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হতো। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সব অপরাধীকে দেখাটাকেও নারীর গুণ বলে ভাবা হতো, এখনও হয়। নারীবাদী আন্দোলনের ফলে নারীরা নিজের অধিকারের ব্যাপারে এখন খানিকটা সচেতন। তাই পুলিশে রিপোর্ট করে অনেকেই। সব নির্যাতিতাই রিপোর্ট করে না। এই যে কিছু রিপোর্ট করা হয়, এই যে মিডিয়া লেখালেখি করে বা বলাবলি করে এ নিয়ে, এতেই অনেকে মনে করে নারী নির্যাতনের হার বুঝি আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। সত্য কথা হলো, নারীবিরোধীরা আগেও ছিল, এখনও আছে। আগেও নারীকে যৌন বস্তু হিসেবে দেখা হতো, এখনও দেখা হয়।
বিদেশি মেয়েরা ছোট স্কার্ট না পরলে কি তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হবেন না? এ কথা কি হলফ করে বলতে পারবেন পর্যটনমন্ত্রী? ষাট বছর বয়সী যে বিদেশি মহিলাকে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছিল, সেই মহিলা কি মিনি স্কার্ট পরেছিলেন? না, তিনি মিনি স্কার্ট পরেননি। বিদেশি নারী- যারা যৌন নির্যাতনের এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে এ যাবৎ, তাদের অধিকাংশই ছোট স্কার্ট পরা ছিলেন না। দোষটা স্কার্টের নয়, দোষটা পুরুষের নারীবিদ্বেষের, নারীকে যৌন বস্তু ভাবার মানসিকতার, নারীকে যা ইচ্ছে তাই করা যায়, পাশ্চাত্যের মেয়েরা ‘যার তার সঙ্গে সেক্সে আপত্তি করে না’- এই বিশ্বাসের।
ভারতে গত বছর নারী নির্যাতনের রিপোর্ট হয়েছে তিন লাখ সাতাশ হাজার। আমরা অনুমান করতে পারি, রিপোর্ট না হওয়ার সংখ্যাটা আরো বেশি। যে হারে ভারতীয় নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, সে হারে বিদেশি নারী পর্যটক যৌন নির্যাতনের শিকার হয় না। জরিপে দেখা যায়, গত বছরে বিদেশি মহিলাদের ধর্ষণ করার হারটা আগের বছরের চেয়ে বরং কিছু কমেছে। কিন্তু এ তথ্য প্রমাণ করে না যে ভারত ধীরে ধীরে বিদেশি মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ হয়ে উঠছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটবেই, দেশি মেয়েরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে বিদেশি মেয়েরাও শিকার হবে। দেশ নিরাপদ হলে দেশি বিদেশি সব মেয়ের জন্য নিরাপদ হবে, নিরাপদ না হলে কারও জন্যই হবে না।
দেশ যদি মেয়েদের জন্য নিরাপদ হয় মেয়েরা শরীরে কিছু না পরলেও নিরাপদ। উলঙ্গ মেয়ে রাস্তায় হেঁটে গেলেও কেউ কটু কথা বলবে না, কেউ যৌন হেনস্থা করবে না। যে দেশ স্কার্ট পরা মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়, সে দেশ বোরখা পরা মেয়েদের জন্যও নিরাপদ নয়। মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ- মেয়েরা যা কিছুই পরুক, অথবা কিছু না পরুক- নিরাপদ। আর যে দেশ মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়- সে দেশে কোনও কাপড় চোপড় পরে নিরাপত্তা আনা যায় না। স্কার্ট বা লুঙ্গি তো পুরুষও পরে। উত্তর ভারতের গ্রামে গঞ্জে পুরুষরা স্কার্ট বা লুঙ্গি পরে। ভারতের তামিলনাড়ু আর কেরালার পুরুষরা ঘরে বাইরে তাদের জাতীয় পোশাক মুন্ডু পরেই থাকে। মুন্ডু আর লুঙ্গিতে পার্থক্য নেই। মুন্ডুটাকে ফোল্ড করে ছোট করেও পরে ওরা। ছোট করা মুন্ডু দেখতে অনেকটা ছোট স্কার্টের মতো। কই ছোট স্কার্ট পরে বলে তাদের নিরাপত্তার কোনও অভাব হয়নি তো! কোনও নারী তো ধর্ষণ করার জন্য তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে শুনিনি। দোষটা তাহলে স্কার্টের নয়। দোষটা নারীর নয়, কারণ নারীরা স্কার্ট পরা পুরুষকে যৌন নির্যাতন করে না। দোষটা নিশ্চিতই পুরুষের, কারণ স্কার্ট পরা এবং না-পরা মেয়েদের যৌন নির্যাতন করে পুরুষরাই। এই পুরুষদের মানুষ করার উপায়টা কি? কী করে মেয়েদের জন্য নিরাপদ দেশ বানানো যায় একটি দেশকে?
যত নারীবিদ্বেষ পুরুষ জন্মের পর থেকে শিখেছে- তা সবার আগে তাদের মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিতে হবে। ওসব আবর্জনা মস্তিষ্কে রেখে নতুন বপন করে সুস্থ কিছু ফলানো সম্ভব নয়। নারীকে শ্রদ্ধা করো- এই শিক্ষা কোনও কাজে আসবে না, কারণ নারীকে ঘৃণা করো—এই শিক্ষা পেয়েই বেড়ে উঠেছে অধিকাংশ পুরুষ। আসলে ‘নারীকে শ্রদ্ধা করো, নারীও মানুষ’ ইত্যাদি যত না মাথায় প্রবেশ করানো দরকার, তার চেয়ে মাথা থেকে ‘নারী যৌন বস্তু, নারীকে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার পুরুষের আছে’— এই ধরনের বিশ্বাস মাথা থেকে বের করে দেওয়া বেশি দরকার।
মেয়েদের কাপড় চোপড় নিয়ে পুরুষের মাথা ঘামানো কিছু নতুন নয়। মেয়েদের কাপড় চোপড়ের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দোষ ঢাকতে চায় ধর্ষক পুরুষ। অচেনা কারও সঙ্গে কোনও অনুমতি ছাড়াই যৌন সঙ্গমের ইচ্ছে হতেই পারে পুরুষের, কারও ওপর পেশির জোর দেখানোর ইচ্ছে হতেই পারে তাদের, কাউকে খুন করার ইচ্ছে হতেই পারে- কিন্তু এসব বদ ইচ্ছেগুলোকে সংবরণ করতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। সভ্য মানুষ হতে হলে এর বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি মানুষ সভ্য না হলে দেশটিরও সভ্য হয়ে ওঠা হয় না। আমি অপেক্ষা করে আছি সেই দিনের, যে দিন একটিও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতে।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬