1 of 2

মেসমেরিক রেভেল্যেশন

মেসমেরিক রেভেল্যেশন

মেসমেরিজম!

মেসমেরিজম, আমরা যাকে মৈস্মরবিদ্যা বলে জানি, তার যুক্তিটুক্তি সম্বন্ধে আমাদের মনে যত সন্দেহই জেগে থাকুক না কেন, সে বিষয়ের অদ্ভুত ঘটনাগুলো সম্বন্ধে কিন্তু প্রায় সবারই ভালো ধ্যান-ধারণা রয়েছে। তা সত্ত্বেও যাদের সন্দেহ বাতিক রয়েছে, সহজে অত্যাশ্চর্য কোনো ঘটনাকে বাস্তব বলে হাসিমুখে মেনে নিতে উৎসাহি নয়, সন্দেহ করাটাই তাদের কাজ। সবকিছুতেই সন্দেহ করে তারা গন্ধ শুঁকতে মেতে যায়।

সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত লোকগুলোনিষ্কর্মা আর বিশ্বনিন্দুক ছাড়া আর কোনো আখ্যায় আখ্যায়িত করা যেতে পারে, আমার মাথায় আসছে না।

কেবলমাত্র ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই কোনো একজন, অন্য একজনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে আর এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে তাদের হাসিমুখে ঠেলে দিতে পারে, যাকে প্রায় মৃত্যুর সামিলই মনে করতে দ্বিধা থার কথা নয়। অর্থাৎ সে যেন মৃত্যুর শিকার হয়ে পড়েছে, এমন মনে করতে বাধা নেই।

আর সে মর্মান্তিক অবস্থায় পড়লে লোকটা বহু চেষ্টা চালালেও খুবই দুর্বলভাবে তার বাইরের ইন্দ্রিয়গুলোকে কার্যকর করতে সক্ষম হয়। অথচ কোনো সূক্ষ বিশ্বাসের মাধ্যমে আর আমাদের নিতান্ত অজানা, একেবারেই অভাবনীয়ভাবে কোনো বস্তুকে। চাক্ষুষ করতে পারে, যা দৈহিক ইন্দ্রিয়গুলোর আয়ত্তের বাইরে। তাছাড়া তার বুদ্ধিমত্তাও একান্তই অভাবনীয়ভাবে সক্রিয়, সজীব ও উন্নত হয়ে পড়ে।

তার মনে যে লোকটা, এভাবে প্রভাব বিস্তার কওে, তার প্রতি সঙ্গতকারণেই। সহানুভূতি প্রগাঢ় হয়ে পড়ে। আর মোদ্দা কথা হচ্ছে, এরকম ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সঙ্গে লোকটার প্রভাবিত হবার ইচ্ছাটাও বৃদ্ধি পায়। আর এজন্যই লোকটার কাজকর্ম অধিকতর ব্যাপক ও স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এটাই নিয়ম, এটাই স্বাভাবিক।

এটাই আমি বোঝাতে চাইছি যে, মেসমেরিজম বিদ্যার এসব বিশেষত্বকে প্রমাণ করে দেখানোর প্রয়াস অপ্রয়োজনীয় ছাড়া কিছু নয়। তাই তো সে রকম অ-দরকারি কোনো কাজ আজ আমি এখানে উল্লেখ করে বিরক্তির কারণ হতে আদৌ উৎসাহি নই। বরং পাঠক-পাঠিকারা মনে করতে পারেন, আজ আমি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা উৎসাহ নিয়ে কলম ধরেছি। হরেক রকম প্রতিকূল ধারণা থাকা সত্ত্বেও আজ আমি কোনো বয়স, মন্তব্যের অবতারণা না করেই, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ বিষদভাবে তুলে ধলতে উৎসাহি হয়েছি, যেটা কোনো এক স্বপ্নের ঘোরে ভ্রমণকারী ব্যক্তি আর আমার মধ্যে হয়েছিল। আর সে সংলাপ পাঠ করলে পাঠক-পাঠিকাদের উল্লেখযোগ্য ভাবান্তর ঘটবে–ঘটতে বাধ্য হবে বলেই আমার নিশ্চিত ধারণা।

বহুদিন যাবই আমি মি. ভ্যাজকার্ক স্বপ্নের ঘোরে ভ্রমণকারী লোকটাকে স্বপ্নবস্থায় অভিভূত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার কর্মতৎপরতা আর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে তার অভিভূত হয়ে পড়ার ইচ্ছা আর উন্নতিও উত্তরোত্তর বেড়েই যাচ্ছিল।

বহুদিন যাবৎ লোকটা খয়-রোগে ও ঠন্ডায় ভুগছিল। আমার একনিষ্ঠ প্রয়াসের ফলে তার রোগটা অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক লক্ষণগুলো ক্রমেই হাস পাচ্ছিল। রোগ নিরাময় না হলেও যন্ত্রণার উপশম যে কিছু না কিছু হচ্ছিল এতে কোনোই দ্বিমত নেই।

বর্তমান মাসের পনেরো তারিখে তার রোগশয্যার পাশে আমাকে তলব করে পাঠানো হলো। সে ডাক অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না।

এই বিকেলে আমি ঝোলা-কাঁধে রোগীর ঘরে হাজির হলাম। আমি ঘরে পা দিয়েই ব্যাধিগ্রস্ত লোকটার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়েই বুঝে নিলাম। সে ব্যাধির যন্ত্রণায় খুবই কষ্ট পাচ্ছে। শ্বাসকষ্টও হচ্ছে খুবই না। তবে যক্ষা রোগের অন্য সব লক্ষণ খুবই স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। এরকম খিচুনি শুরু হলে স্নায়ুকেন্দ্রগুলোতে সামান্য পরিমাণে সরষের তেল মালিশ করলে রোগী কিছুটা স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! আজ রাতে এরকম চিকিৎসায় কিছুমাত্রও উপকার হলো না।

আমি চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরের ভেতরে পা দিতেই সে মুখে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে আমাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাল। আমাকে কাছে পাওয়ায় সে বড়ই আনন্দিত হয়েছে, আমার বুঝতে ভুল হলো না।

তার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, সে ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় দগ্ধ হলেও মনের দিক থেকে শান্ত স্বস্তিতেই সময় কাটাচ্ছে।

একটা চেয়ারে শান্ত হয়ে বসতে বসতে আমি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকালাম।

আমার মনের কথা বুঝতে পেরে, জিজ্ঞাসা দূর করতে গিয়ে সে ম্লান হেসে বলল–আমার অসুখ-মানে দৈহিক যন্ত্রণা দূর করার জন্য আমি তোমাকে কষ্ট দিয়ে এখানে তলব করিনি।

আমি স্লান হেসে বললাম–ভালো কথা, কিন্তু এরকম জরুরি তলবের কারণটা কি–জানতে পারি কী?

অবশ্যই জানবে। সবই তোমাকে বলব।

কেন? বলো, কী তোমার কারণ?

অতিকষ্টে পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল–শোনো, বর্তমানে কয়েকটা মানসিক চিন্তা আমার কাছে খুবই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কম বিস্ময় উৎপাদনও করেনি।

হুম!

তোমাকে ডাকার কারণ হচ্ছে, সেগুলো সম্বন্ধে জ্ঞান-বুদ্ধি আর উপদেশ দিয়ে আমার স্বস্তি ফিরিয়ে দেবেন।

ঠিক মাথায় গেল না।

মন দিয়ে শোনো, আরও খোলাখুলি বলছি–আমি আত্মার অমরত্বের ব্যাপারে মনে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করি, আশাকরি সে-কথা আমাকে বলার দরকার নেই।

হুম!।

একটা কথা মনে রেখো, এ ব্যাপারটা নিয়ে আমি কিন্তু তেমন ভাবনা চিন্তা করি না। আসল কারণ কী জানো? ব্যাপারটা নিয়ে যুক্তিবিচারের পথে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়েই আমি অধিকতর সন্দিগ্ধচিত্ত হয়ে পড়েছি।

আমি তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নীরবে তাকিয়েই রইলাম। তার কথার জবাবে বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে মুখ বুজে সবকিছু মন দিয়ে শোনা ছাড়া গতিও তো কিছু নেই।

তারপর কি বলছি ধৈর্য ধরে শেনো, আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কুজিন পড়াশুনা করার জন্য।

আমি এবার মুখ না খুলে আর নিজেকে সামলেসুমলে রাখতে না পেরে বললাম কুজিনের লেখা বইপত্র পড়েছ কী?

পড়েছি। তার লেখা এক-এক করে বেশ কয়েকটা বই পড়েছি। কেবল তাঁর লেখার কথাই বা বলি কেন? তার মার্কিন আর উত্তরোপীয় অনুরাগীদের বইপত্র পড়েছি।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।

উদাহরণস্বরূপ চার্লস এলউড বইটা ভাগ্যগুণে আমি হাতে পেয়েছিলাম।

চার্লস এলউড মি. ব্রাউলসন-এর লেখা আশা করি আপনার জানাই আছে, তাই না?

হুম!

তিনি বইটার উপসংহারে অতি সংক্ষেপে যে বক্তব্য পেশ করেছেন, তা বারবার পড়ে আমি বাধ্য হয়ে এ-সিদ্ধান্তই নিতে বাধ্য হয়েছি, তিনি যা-কিছু বলতে চেয়েছেন, তা যেন তিনি নিজেই বোঝেননি। ব্যাপারটা যদি নিজেকেই ভালোভাবে বোঝাতে না পেরে থাকেন, তবে অন্যের মধ্যে ধারণা সঞ্চার কি করে সম্ভব, বলো?

আর কিছু? তোমার মধ্যে আর কোনো ধারণা–

ধৈর্য ধরো, আরও বলছি।

আমি চেয়ারটায় একটু নড়েচড়ে বসে তার বক্তব্য শোনার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় রইলাম। সে একটু দম নিয়ে আবার মুখ খুলল–হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, আমি কিন্তু অচিরেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম, এরকম যুক্তির জাল ছড়িয়ে মানুষকে তার অমরত্বের বিশ্বাসের জালে আটকে ফেলা সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়।

আমি তোমার সঙ্গে সহমত পোষণ করছি।

সে আমার কথায় কান দিল কি না বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য যে, আমার ইচ্ছা সেটাকে সমর্থন করতে পারে সত্য বটে, কিন্তু মন কিছুতেই মেনে নিতে উৎসাহি হবে না–এমনকি বুদ্ধি-বিবেচনাও না।

বেশ কয়েকটা ব্যাপারে আমার মধ্যে ধারণা জন্মেছে, মেসমেরিক অবস্থায় আমাকে কিছু সংখ্যক নির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয় তবে হয়তো ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হতে পারে। তবে ফল সম্বন্ধে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়।

তার প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে গেলাম।

আমার দিক থেকে সবুজ সঙ্কেত পেয়ে তার মধ্যে স্বস্তির লক্ষণ প্রকাশ পেল।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্ৰ সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে গেলাম।

বেশি ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হলো। প্রথমবার চেষ্টা করতেই মি. ভ্যানকার্ক মেসমেরিক ঘুমের শিকার হয়ে বিছানায় একেবারে এলিয়ে পড়লেন।

সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ামাত্র তার শ্বাসক্রিয়া সহজভাবেই চলতে লাগল। আমি অনুসন্ধিৎসু নজরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম, সত্যি তার শ্বাসকার্যে এতটুকুও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি। আরও একটা ব্যাপার আমার নজরে ধরা পড়ল, এ অবস্থায় তার মধ্যে কোনোরকম শারীরিক অস্বস্তি দেখতে পেলাম না। মোদ্দাকথা, তার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে আমার মনে হলো যেন একটা লোক আমার সামনে গভীর ঘুমে ডুবে রয়েছে।

এবার সংলাপ শুরু করার পালা। এক্ষেত্রে রোগীর নামকরণ হলো ভি, আর আমি পি।

এবার উভয়ের কথোপকথন শুরু করা যাক—

মি. পি বলল–মি. ভি, আপনি কি ঘুমোচ্ছেন?

মি. ভি ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিল–হা-না, এখন গভীর ঘুমে ডুবে যেতে পারিনি।

তবে কি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছেন, এটাই বলতে চাইছেন?

তা অবশ্য মনে করতে পারেন।

এ-মুহূর্তে আপনার সবচেয়ে তীব্র আকাঙ্ক্ষা কি, দয়া করে বলুন?

গভীর ঘুমে ডুবে যেতে চাই।

কয়েকমুহূর্ত নীরবে থেকে মি. পি এবার বলল–এখন কি আপনি ঘুমিয়েছেন?

হুম।

তবে আপনি এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন, তা-ই কী?

হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।

এবার নিজের সম্বন্ধে আপনার ধারণা কি, বলবেন কী?

ধারণা? কি জানতে চাইছেন খোলাসা করে বলুন।

আপনার বর্তমান ব্যামোর কোন পরিণতি হতে পারে বলে আপনি নিজে ভাবছেন?

দীর্ঘ ইতস্ততের পর, ব্যাপার বলার চেষ্টা করে মি. ভি এবার আগের মতোই ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিলেন মারা যাব–আমি মারা যাব।

মৃত্যু-ভাবনা কী আপনার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে?

হুম।

এবার বলুন তো, আপনার মধ্যে মৃত্যু-ভাবনা প্রকট হয়ে পড়ায় আপনি কী কষ্ট পাচ্ছেন?

মি. ভি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন–। না না, কোনো কষ্টই না।

মি. পি যারপরনাই সবিস্ময়ে বলে উঠলেন–না! কোনো কষ্টই পাচ্ছেন না! মৃত্যুকে তবে আপনি সহজভাবেই গ্রহণ

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মি. পি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন– অবশ্যই। মৃত্যুকে আমি খুবই সহজভাবে, মানে হাসিমুখেই গ্রহণ করতে পারব।

তবে এ আমি নিঃসন্দেহ হতে পারি, এ-সম্ভাবনায় আপনি খুবই খুশি। ঠিক কিনা?

ঠিক। একটা কথা কি জানেন? জাগ্রত অবস্থায় আমি মরতে চাই। কিন্তু এ অবস্থায় মৃত্যু আমার মধ্যে কিছুমাত্রও আতঙ্ক সঞ্চার করছে তো না-ই, বরং এ-মুহূর্তে মৃত্যুই সবচেয়ে বড় কাম্য।

এর কারণ কি, মানে আপনার এরকম ধারণার কারণ সম্বন্ধে আপনার নিজের কী মনে হচ্ছে?

মেসমেরিক দশাটা মৃত্যুর এতই কাছাকাছি, যার জন্য এখন মৃত্যুই আমার একমাত্র কাম্য জ্ঞান করছি।

এটাই কী আপনার দৃঢ়প্রত্যয়?

হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।

মি. ভি, আমি আপনার মুখ আপনার নিজের বর্তমান পরিস্থিতির কথা আরও পরিষ্কার–আরও ভালোভাবে আমাকে বলুন।

তবে সমস্যাটা কোথায়?

দেখুন, নিজের বর্তমান পরিস্থিতির কথা পরিষ্কারভাবে বলার জন্য যে শক্তি সামর্থ্য, যতটা চেষ্টা থাকা দরকার, তার অভাব খুব বেশি করে আমি বোধ করছি।

তবে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনার ভেতরে শক্তি সামর্থ্যের অভাব হেতু আপনি উপযুক্ত চেষ্টা চালাতে পারছেন না, এই তো?

তা তো বললামই।

আর কিছু?

আরও আছে।

আরও? সেটা কী, বলুন তো?

বার কয়েক আমতা আমতা করে মি. ভি এবার একই রকম ক্ষীণকণ্ঠে বললেন দেখুন, আপনার প্রশ্নেও যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে।

মানে, প্রশ্নে ত্রুটি?

হ্যাঁ, আপনার প্রশ্নগুলো জুতসই হচ্ছে না।

তবে আপনিই বলে দিন, আমি কী ধরণের প্রশ্ন করব?

গোড়া থেকে—

গোড়া থেকে? মি. পি তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলেন।

হ্যাঁ। গোড়া থেকে আবার শুরু করতে হবে।

ভালো কথা, তা না হয় করলাম। কিন্তু সে গোড়া, মানে শুরুটা যে কোথায়, তা তো বুঝতে পারছি না।

আপনার তো আর অজানা নয়, শুরুতেই অবস্থান করছেন স্বয়ং ঈশ্বর।

খুবই ক্ষীণ ও দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে মি. পি কথাটা উচ্চারণ করলেন। তবে এও সত্য যে, তাতে খুবই শ্রদ্ধার ভাব অবশ্যই রয়েছে। মি. পি এবার জিজ্ঞেস করলেন– ঈশ্বর? তবে ঈশ্বর কি, মানে ঈশ্বর সম্বন্ধে আপনার ধারণাটা জানতে পারি কী?

মিনিট কয়েক নীরবে ইতস্ততার পর মি. ভি মুখ খুললেন–আমি, আমি ঠিক বলতে পারব না।

ঈশ্বর আর আত্মার মধ্যে কোনো ফারাক আছে বলে আপনি মনে করেন কী? মি. পি নীরব রইলেন।

মি. ভি আবার এক প্রসঙ্গ পারলেন–ঈশ্বর আর আত্মা কী এক নয়? স্বয়ং ঈশ্বরই কী আত্মা নন?

আপনি আত্মা বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছেন? এ-কথা আমি যখন জেগে ছিলাম, তখন তা জানতাম, বুঝতাম।

কিন্তু এখন? আপনার এ পরিস্থিতিতে আপনার মধ্যে কোন ধারণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে?

কিন্তু বর্তমানে আত্মা আমার কাছে ঠিক একটা শব্দমাত্র। যেমন ধরুন–সত্য, সুন্দর বলতে একটা গুণকেই বোঝায়।

মি. ভি, এবার বলুন তো, ঈশ্বর কী অজড় নন–আপনার বক্তব্য কী?

না। অবশ্যই না।

তার উত্তরটা, বিশেষ করে এমন দৃঢ়ভাবে দেওয়া উত্তরটা কানে যেতেই মি. পি সচকিত হয়ে তড়াক করে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আকস্মিক বিস্ময়ের ঘোরটুকু কাটাতে মি. পি-কে খুবই বেগ পেতে হলো। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি আবার পরবর্তী প্রশ্ন করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিলেন।

মি, পি-র এবারের প্রশ্ন–তা-ই যদি বলেন, তবে তিনি আসলে কি?

মি. ভি এবার সত্যি খুব ফাঁপড়ে পড়লেন। এ প্রশ্নের কি জবাব দেবেন, সহসা গুছিয়ে উঠতে পারলেন না। তাই অনন্যোপায় হয়েই কয়েক মুহূর্ত নীরবতার মধ্য দিয়েই কাটিয়ে দিলেন। তারপর এক সময় আমতা-আমতা করে বললেন–হ্যাঁ, তা ও তো সত্য বটে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা কী জানেন?

কি? সমস্যাটা কি বলে আপনি মনে করছেন?

ঈশ্বর আত্মা নন।

এ-কথা তো আগেই বললেন। কিন্তু কেন নন? আর এমন কোন সমস্যা রয়েছে, যার জন্য আপনি ঈশ্বরকে আত্মা বলে স্বীকার করতে কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না?

কারণস্বরূপ আমি প্রথমেই বলব, তার অস্তিত্ব বর্তমান, ঠিক কিনা?

হ্যাঁ, তা-তো খুবই সত্য।

আরও আছে।

যেমন–?

যেমন, তিনি বস্তু নন। অন্তত বস্তু বলতে আপনি যা বোঝেন, সে কথাই আমি বলছি।

আর কিছু?

হ্যাঁ। বস্তুর বিভিন্ন স্তর বর্তমান। স্বীকার করছেন তো?

হুম।

বস্তুর যে বিভিন্ন স্তর রয়েছে তা আমরা স্বীকার করলেও সে-বিষয়ে আমাদের তিলমাত্র ধারণাও নেই, ঠিক কিনা?

মি. পি আমতা-আমতা করে বললেন–যা বলেছেন কোনো ধারণাই নেই।

মি. ভি মুহূর্তের জন্য থেমে আবার মুখ খুললেন–এবার যা বলছি, ধৈর্য ধরে শুনুন–সূক্ষ স্থূলদ্বারা চালিত হয়। আর স্কুলের মধ্যে সূক্ষ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না।

হুম।

উদাহরণস্বরূপ বলছি–ধরুন, বৈদ্যুতিক নীতি আবহাওয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়। আবার আবহাওয়া জড়িয়ে-পেঁচিয়ে অবস্থা করে বৈদ্যুতিক নীতি।

বস্তুর এ-স্তরগত পার্থক্য ক্রমেই সূক্ষতার দিকে অগ্রসর হতে হতে এমন এক সময় আসে, যখন আমরা কণাবিহীন বস্তুতে পৌঁছে যাই। এই কণাবিহীন বস্তুর গঠনগত বৈশিষ্ট্য কি, তা-ই তো ভাবছেন?

মি. পি নীরব রইলেন।

মি. ভি-ই প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে প্রসঙ্গটাকে বোধগম্য করে দিতে গিয়ে বললেন আমি কণাবিহীন বস্তুর এ বৈশিষ্ট্যেরই ইঙ্গিত দিচ্ছি। কণাবিহীন বস্তু মূলত অবিভাজ্য–এক, না একক না। একে কেউ কেউ পরমৎ বলেও সম্বোধন করে থাকেন। তাই বলছি কি, যাবতীয় বস্তুকে নিজের মধ্যে নিয়েই তো সে একক। আমরা যাকে ঈশ্বর বলে থাকি, এ-বস্তুই তো তিনি।

ভালো কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার একটু আপত্তি আছে।

আপত্তি? কেন? কী সে আপত্তি?

আপত্তিটা এখানেই যে, নিছক একটা বস্তু আর ঈশ্বর এক করে দেখার কথা বলছি। আপনার কি মনে হয় এমন একটা উক্তির মধ্যদিয়ে যথেষ্ট অশ্রদ্ধার ভাব প্রকাশ পাচ্ছে আপনার কি মনে হয় বলুন তো?

রোগী মি. ভি নীরব রইলেন। মি. পি-র তার মধ্যে কতখানি প্রভাব বিস্তার করল, কি আদৌ করল না, তা বুঝতে পারল না। আসলে মি. পি-র কথাটা তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল সে-রকম কোনো ভাবই তার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে না।

তাই রোগী মি, পি-র কথার তাৎপর্যটুকু হৃদয়ঙ্গম করার আগেই তিনি তাঁর কাছে। প্রসঙ্গটা আর একবার পারলেন। মি. ভি এবার মুখ খুললেন–মি. পি, বলুন তো, বস্তুকে মনের চেয়েও কম শ্রদ্ধা করা হবে কেন? কোনো যুক্তি কি আপনার জানা আছে, বলুন তো?

মি. পি এ প্রশ্নের উত্তরে কি বলবেন, ভাবতে-না-ভাবতেই মি. ভি-ই ক্ষণিক বিরতির পর আবার সরব হলেন–দেখুন মি. পি, আত্মাকে যে-সব শক্তিধারক জ্ঞান করা হয়, সে-সব শক্তির অধিকারী হয়েও ঈশ্বর তো মূলত বস্তুরই পরিপূর্ণরূপ, আপনার মনে কোনো দ্বিধা আছে কী?

মি. পি নীরব চাহনি মেলে তার দিকে তাকিয়ে থেকে আমতা আমতা করতে লাগলেন। আসলে তার প্রশ্নের সঠিক জবাব গুছিয়ে উঠতে পারলেন না।

তাকে নীরব দেখে মি. ভি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলেন–হুম।

মি. পি অনেক ভেবে-চিন্তে মুখ খুললেন–আপনি তো এ-কথাই বলতে চাইছেন, যে, কণাবিহীন বস্তু চলমান হয়ে পড়লেই সেটা চিন্তার রূপ পায়, ঠিক কিনা?

হা, মোটামুটিভাবে আমি এটাই বলতে চাইছি। সত্যি কথা বলতে চাইছি। সত্যি কথা কি, এ-চলমানই তো সার্বিক মনের সার্বিকচিন্তা। এই চিন্তাই তো সৃষ্টির মূলে কাজ করে থাকে, অর্থাৎ এ-চিন্তাকেই আমরা বলব সৃষ্টির কারণ।

হুম।

অতএব আমরা বলতে পারি, যাবতীয় সৃষ্টিবস্তু তো ঈশ্বরেরই চিন্তার ফসল।

তবে আপনি এ-কথাটাকে বলছেন, মোটামুটিভাবে এই তো?

ঠিক এটাই আমি বোঝাতে চাইছি–সার্বিক মনই হচ্ছে ঈশ্বর।

তারপর? আর কিছু?

হ্যাঁ আরও আছে, নতুন ব্যক্তি বিশেষের জন্য বস্তু অত্যাবশ্যক।

কিন্তু আপনার বক্তব্য অনুযায়ী আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি–আপনি কিন্তু বর্তমানে বস্তু আর মন-এর কথা তত্ত্ববিদদের মতোই ব্যক্ত করছেন–ভুল বলেছি?

না। ঠিকই বলেছেন বটে। কেন এমনটা বলছি–তাই তো জানতে চাইছেন?

হ্যাঁ, ঠিক এটাই আমার জিজ্ঞাস্য। বলুন, এ-বিষয়ে আপনার মত কী?

শুনুন তবে বলছি–বিভ্রান্তি এড়াবার জন্যই আমাকে এ-পথ বেছে নিতেই হয়েছে। আমি যখন মন কথাটা উল্লেখ করি তখন পরম বস্তু অর্থাৎ কণাবিহীন বস্তুকেই বোঝাই। আর যখন বস্তু কথাটা ব্যবহার করি তখন পরম বস্তু ছাড়া অন্য সবকিছুর কথা বোঝাই।

তবে দেখা যাচ্ছে, আপনি এ-কথাই বলছিলেন যে, বস্তুর প্রয়োজন নতুন ব্যক্তিত্বের জন্য–ঠিক কিনা?

হুম্। এ-কথা তো বলছিলাম।

কারণ কী, দয়া করে বলবেন?

অবশ্যই। যখন মন একীভূত হওয়ার পরিবর্তে অস্তিত্বশীল হয়, সে তো তখনই ঈশ্বর। কেমন করে–জানতে চাইছেন? ঐশ্বরিক মনের অংশকে চিন্তাশীল ব্যক্তি সত্ত্বাকে সৃষ্টি করার তাগিদে দেহধারী করে তোলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

তবে ঈশ্বর সম্বন্ধে আপনার বক্তব্য–দেহবিমুক্ত মানুষই হচ্ছেন ঈশ্বর এই তো?

দীর্ঘ সময় ধরে ইতস্তত করে মি. ভি এক সময় মুখ খুললেন–এমন কথা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

কেন? সম্ভব নয় কেন?

কি করে বলব? এ তো পুরোপুরি স্ববিরোধী কথা।

আপনি তো এ-কথা অবশ্যই বলেছেন–দেহ খাঁচা থেকে মুক্ত হলেই মানুষ ঈশ্বর হয়ে যায় বলেননি?

অবশ্যই, অবশ্যই বলেছি। শুধু বলেছি নয়, আরও দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছি– এটাই সত্য। দেহ-খাঁচা থেকে মুক্তি পেলেই, মানুষ ঈশ্বর হয়ে যায়, ব্যক্তি হয়ে যায় বৈশিষ্টহীন।

কিন্তু মানুষ কি কখনও এভাবে দেহ-খাঁচা বিমুক্ত হতে পারে?

না, তা অবশ্য পারে না, অন্তত পারবেও না কখনই। আরে, মানুষ যে একটা। প্রাণী। প্রাণীরাই তো ঈশ্বরের যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা। আর চিন্তার স্বরূপই হচ্ছে, তা অপরিবর্তনীয়–এবার বুঝলেন কী?

না, মাথায় ঠিক ঢুকল না তো।

কিছুই বুঝতে পারলেন না?।

সে রকমই তো মনে হচ্ছে। আপনি বলছেন, মানুষের পক্ষে কোনোদিনই দেহখাঁচাকে ছাড়া সম্ভব হবে না, তাই না?

কোনোদিনই দেহহীন হওয়া সম্ভব হবে না।

আমি যেন কেমন ধন্ধে পড়ে যাচ্ছি।

ধন্ধ?

হ্যাঁ। মানে আমার সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। দয়া করে একটু খোলাসা করে বলবেন কি?

বলছি তবে শুনুন। দুপ্রকার দেহের অস্তিত্ব বর্তমান।

দু প্রকার!

হ্যাঁ। এক প্রকার হচ্ছে, আমি আর দ্বিতীয় প্রকার সম্পূর্ণ। মনে করতে পারেন কীট আর প্রজাপতির দুটো অবস্থার মতো। আমরা কাকে মৃত্যু আখ্যা দিয়ে থাকি, বলতে পারেন?

মি. পি-কে নীরব দেখে মি. ভি-ই আবার বলতে আরম্ভ করলেন। আমরা যাকে মৃত্যু আখ্যা দিয়ে থাকি সেটাকে আসলে বেদনাময় রূপান্তর ছাড়া আর কি-ই বা ভাবা যেতে পারে?

হুম!

আমাদের এই যে বর্তমান মূর্তি, যে রূপ নিয়ে আমরা অবস্থান করছি তা তো প্রগতিশীর আর সাময়িক। আর আমাদের ভবিষ্যৎ! পরম, পূর্ণ অমর আমাদের ভবিষ্যৎ। পরম জীবনকেই আমরা পূর্ণ পরিকল্পনা বলে থাকি।

আমাদের মধ্যে তো কীটের রূপান্তর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণাই বিদ্যমান।

আমাদের তো অবশ্যই সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। কিন্তু কীটের? তাদের তো এসম্পর্কে কোন ধারণাই নেই।

একটা কথা, একটু আগে তো আপনি স্পষ্টই বললেন, মেসমেরিক অবস্থাটা প্রায় মৃত্যুরই সম পর্যায়ের, ঠিক কিনা?

হ্যাঁ, তা-তো বলেছি-ই।

সেটা কি, খুলে বলুন।

দেখুন, আমি যখন বলছি, সেটা অবিকল মৃত্যুরই অনুরূপ, তখন আমি এটাই বলতে চেয়েছি, সেটা পরম জীবনেরই অনুরূপ। আশা করি এবার প্রশ্নটা আপনাকে বোঝাতে পেরেছি, কি বলেন?

তা তো বলেছিই।

ভালো কথা, আর একটা প্রশ্ন–মানুষ ছাড়া অন্য কোনো আদিম চিন্তাশীল জীবের আছে কি?

মি. ভি-র দিক থেকে আর কোনো জবাবই পাওয়া গেল না। তার মধ্যে একটা আকস্মিক পরিবর্তন প্রকট হয়ে পড়ায় তিনি বেশ কিছু সময় মৌনই রইলেন।

বেশ কয়েক মুহূর্ত নীরবতার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে মি. ভি বিরাট হাই তুললেন। তারপর আগের মতো ক্ষীণকণ্ঠেই বলতে লাগলেন মি. পি, সে বিরল বস্তুটাকে আমরা নেবুলা বলতে পারি না, যা অবশ্যই নেবুলা নয়, তাকে সে অগণিত প্রকারের পিণ্ডীকরণের মাধ্যমে নেবুলা, সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ আর অন্য মূর্তিতে রূপান্তর ঘটানো হয়। তার একমাত্র ও গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য তো হচ্ছে, অগণিত আদমি প্রাণীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গের খাদ্যবস্তু যোগান দেওয়া, বুঝলেন?

মি. পি প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন–হুম।

দেখুন মি. পি, পরম জীবনের পূর্বক আদিম জীবনের প্রয়োজন যদি না-ই থাকত তবে তো এসব দেহ সৃষ্টি হওয়া অবশ্যই সম্ভব হত না। আদিম জীবনের

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মি. পি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–আপনি যে বক্তব্যটার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তা হচ্ছে–যদি আদিম জীবনের প্রয়োজন না থাকত তবে কোন তারাই থাকত না–তাই তো?

ঠিক তাই। আমি এটাই বোঝাতে চাচ্ছি।

সে তো বোঝলাম। কিন্তু এ প্রয়োজনটা কেন হল–যুক্তি কি?

জীবন আর বস্তু দুরকম–অজৈব জীবন আর অজৈব বস্তু। অজৈব জীবনের আর অজৈব বস্তুর–উভয় ক্ষেত্রেই ঐশ্বরিক ইচ্ছাশক্তিরই অনুরূপ একটা শহজ-সরল এবং অদ্বিতীয় বিধানের কাজকে প্রতিরোধ করার মতো আর কিছুই থাকতে পারে না, নেইও।

এ বাধা বা প্রতিরোধের প্রয়োজনে কি হয়েছিল?

জৈব জীবন আর বস্তুসমহূহের সৃষ্টি সম্ভবনাময় হয়ে উঠেছিল।

হ্যাঁ, আমার অসুখটা আমাকে আচ্ছা করে জেঁকে ধরেছিল। যে মুহূর্তে তার ব্যামোটা ক্ষীণকণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করছিল, তখন আমি তার মুখের দিকে অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে তাকালাম। অদ্ভুত, একেবারেই বিস্ময়কর একটা ভাবভক্তি তার মুখে প্রত্যক্ষ করে আমি রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমি তখন ভয়ে কুঁকড়ে যাবার যোগার হলাম। আতঙ্কে আমার বুকের ভেতরে নিরবচ্ছিন্নভাবে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল যার থামার কোন লক্ষণই আমার চোখে পড়ল না।

ব্যাপার স্যাপার দেখে আমার মনে হল, মুহূর্ত মাত্রও দেরি না করে মেসমেরিক অবস্থা থেকে তাকে জাগিয়ে তোলা একান্ত দরকার।

আমি আর এক মুহূর্তও দেরি করতে ভরসা পেলাম না। তিনি মেসমেরিক দশা কাটিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে পান তার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি মিটিয়ে ফেললাম।

জাগিয়ে দেওয়ামাত্র তার সারামুখে অত্যুজ্জ্বল একটা হাসির ছোপ ঝিলিক দিয়ে উঠল।

তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যাওয়ার পরমুহূর্তেই তিনি ঘোলাটে চোখের মণি দুটো মেলে বার কয়েক এদিক-ওদিক তাকাল। তার পরই তার মাথাটা আচমকা বালিশের ওপর এলিয়ে পড়ল। তিনি মারা গেলেন। সব শেষ!

আমার চোখের সামনেই তার মৃতদেহটা এক মিনিটের মধ্যেই পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল।

কৌতূহলবশত তার ভ্রতে হাত রাখলাম। দেখলাম জ্বটা মুহূর্তের মধ্যেই বরফ শীতল হয়ে গেছে।

সাধারণ পরিস্থিতিতে এজরায়ের হাত দিয়ে তার হাতটাকে মুঠো করে চেপে ধরার ফলে এমন অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটা সম্ভব।

তবে? আমি তবে এখন কি মনে করব, মেসমেরিক রোগগ্রস্ত লোকটা কথোপকথনের শেষের দিকের বক্তব্য যা-কিছু আমাকে বলেছিল, সবই ছায়ার জগৎ থেকেই বলেছিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *