মেলায় চুরি – ২

মেলায় চুরি – ২

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

বাড়ীওয়ালীর নিকট পূৰ্ব্ববর্ণিত বিষয় সকল অবগত হইয়া ওই স্ত্রীলোক কয়েকটি একবার দেখিতে ইচ্ছা করিলাম। বেলা ও লুসি আমাদিগের নিকটেই ছিল, এমি, মেরী ও এলিকে আমাদিগের সম্মুখে ডাকাইলাম। উহারা আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইলে পাঁচজনকেই একত্রিত করিলাম ও তাহাদিগকে উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম উহাদিগের প্রায় প্রত্যেকের অঙ্গেই একখানি না একখানি ছোট ছোট নতুন অলঙ্কার রহিয়াছে। উহার সমস্তগুলিই সূবর্ণনির্ম্মিত ও দুই একখানি প্রস্তরের দ্বারা শোভিত। 

ইতিপূর্ব্বে যখন একটি স্ত্রীলোকের পরিধানে একখানি অলঙ্কার দেখিতে পাইয়াছিলাম, তখনই আমাদিগের মনে নানারূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। মহামেলায় যাঁহার দোকান হইতে অলঙ্কার সকল অপহৃত হইয়াছিল, সেই সময়েই তাঁহাকে সেই স্থানে আনিবার নিমিত্ত একজন কর্মচারীকেও প্রেরণ করিয়াছিলাম। পাঁচটি স্ত্রীলোককে এক স্থানে সমবেত করিবার অব্যবহিত পরেই সেই দোকানদার সাহেব সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ওই স্ত্রীলোকদিগকে তাঁহাকে দেখাইয়া দিয়া কহিলাম “দেখুন দেখি মহাশয়, যে সকল নূতন অলঙ্কার এই স্ত্রীলোকদিগের অঙ্গে পরিহিত রহিয়াছে, তাহার কোনখানি আপনার অপহৃত অলঙ্কার বলিয়া অনুমান হয় কি?” 

আমাদিগের কথা শুনিয়া সাহেবকে একটু ইতস্ততঃ করিতে দেখিলাম। তাঁহার ভাবগতিক দেখিয়া অনুমান হইল, তিনি যেন একটু বিশেষ বিপদে পতিত হইয়াছেন। তিনি কিরূপে স্ত্রীলোকদিগের অলঙ্কার সকল উত্তমরূপে দেখিতে সমর্থ হইবেন, তাহাই যেন ভাবিতেছেন। সেই দোকানদার সাহেব খাস বিলাতী। ইংরাজগণ স্বদেশীয় স্ত্রীলোকদিগকে যেরূপ সম্মান করিয়া থাকেন, তাহা পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই উত্তমরূপে অবগত আছেন। সাধ্যানুসারে তাঁহারা কখনও কোন স্ত্রীলোককে কোনরূপ অবমাননা করিতে সমর্থ হন না, বা স্ত্রীলোকগণের হৃদয়ে যে কার্য্যের নিমিত্ত কোনরূপ বেদনা পাওয়া সম্ভব বোধ করেন, সেই কার্য্যে কিছুতেই তাঁহারা হস্তক্ষেপ করিতে চাহেন না। এরূপ অবস্থায় সেই স্ত্রীলোকদিগের পরিহিত অলঙ্কারগুলি তিনি যে কিরূপে উত্তম করিয়া দেখিতে সমর্থ হইবেন, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। 

তিনি না পারেন সেই স্ত্রীলোকদিগের অঙ্গে হস্ত প্রদান করিয়া অলঙ্কারগুলি দেখিতে, বা না পারেন তাহাদিগের অঙ্গ হইতে সেই সকল অলঙ্কার উন্মোচন করাইতে; সুতরাং একরূপ বিষম বিপদে পড়িয়াই তিনি স্থিরভাবে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাঁহার অবস্থা দেখিয়া আমরা বেশ অনুমান করিতে সমর্থ হইলাম, যে তিনি কিরূপ বিষম বিপদে পতিত হইয়াছেন। 

তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া আমরা সেই বাড়ীওয়ালীকে কহিলাম, “এই স্ত্রীলোকদিগের পরিধানে যে সকল নূতন অলঙ্কার আছে, তাহা আমরা একবার উত্তমরূপে দেখিতে চাই। সুতরাং তুমি উহাদিগকে বল, উহারা যেন ওই সকল অলঙ্কার উন্মোচিত করিয়া আমাদিগের সম্মুখে রাখিয়া দেয়।” 

আমাদিগের কথা শুনিয়া বাড়ীওয়ালী ওই সকল অলঙ্কার উন্মোচিত করিয়া দিবার নিমিত্ত তাহাদিগকে কহিল। কিন্তু তাহারা কেহই ওই সকল অলঙ্কার সহজে উন্মোচিত করিতে সম্মত হইল না। 

উহাদিগের এই অবস্থা দেখিয়া ওই সামান্য কার্য্য সম্পন্ন করিতেও আমাদিগকে হস্তক্ষেপ করিতে হইল। কোনরূপ মোকদ্দমা অনুসন্ধান করিবার কালীন কোন কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী যেরূপ ভাবে আসামীগণের সহিত সদ্ব্যবহার করিয়া থাকেন, যা সময় সময় তাহাদিগের উপর যেরূপ ভাবে মিষ্ট কথা প্রয়োগ করিয়া থাকেন, পরিশেষে আমাদিগকেও সেইরূপ করিতে হইল। আমাদিগের সেই সময়ের অবস্থা দেখিয়া ও আমাদিগের নিকট হইতে দুই চারিটি মিষ্ট কথা শুনিবার পর, তাহারা আপনাপন অঙ্গ হইতে নূতন অলঙ্কার সকল উন্মোচিত করিয়া আমাদিগের সম্মুখে রাখিয়া দিল। দোকানদার সাহেব তখন সেই সকল অলঙ্কার আপন হস্তে উঠাইয়া লইয়া উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, “আমার দোকান হইতে যে অলঙ্কার চুরি হইয়া গিয়াছে, তাহার মধ্যে এইরূপ অলঙ্কার বিস্তর ছিল; সুতরাং বোধ হইতেছে এই সকল অলঙ্কার আমারই। আমার সমস্ত অলঙ্কারের সহিত এক একখান টিকিট সংযুক্ত আছে, উহাতে ওই অলঙ্কারের মুল্য লিখিত আছে; কিন্তু এই অলঙ্কারগুলিতে সেই টিকিট না থাকায় আমি শপথ করিয়া বলিতে পারিতেছি না যে, এই সকল অলঙ্কার আমার। পরন্তু আমার যেন অনুমান হইতেছে, এই সকল অলঙ্কার আমার ভিন্ন আর কাহারও নহে। 

সাহেবের কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে আর এক নূতন চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, যে ব্যক্তি দোকান হইতে অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, অলঙ্কারের সহিত যে সকল টিকিট ছিল, তাহা কি এখন পর্যন্ত সে গহনার সহিত রাখিয়া দিয়াছে? আমরা বিশেষরূপ পরিশ্রম করিয়া কোন গতিকে যদি এই মোকদ্দমার কিনারা করিতে সমর্থ হই ও অলঙ্কারগুলিও যদি কোন গতিকে বাহির করিতে পারি, আর অলঙ্কারগুলিতে যদি টিকিট না থাকে, তাহা হইলে উহা ফরিয়াদী তাঁহার নিজের দ্রব্য বলিয়া সনাক্ত করিবেন না,—তাহা হইলে এই মোকদ্দমার পরিণামই যে কি হইবে, তাহাই বা কে বলিতে পারে? সে যাহা হউক, সাহেবের সেই কথার দিকে আমরা কর্ণপাতও না করিয়া ওই সকল অলঙ্কার সেই সাহেবের দোকান হইতে অপহৃত অলঙ্কার বলিয়াই স্থির করিয়া লইলাম। কারণ, আমাদিগের বেশ প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, ওই সকল অলঙ্কার যাহারই হউক না কেন, এই ফিরিঙ্গী মেমদিগের কোন প্রকারেই হইতে পারে না। যাহাদিগের ঘরে কপদকমাত্র সম্বল নাই, তাহারা এইরূপ অলঙ্কার কিরূপে খরিদ করিতে সমর্থ হইল? সুতরাং, উহাদিগকে অপর কেহ উহা প্রদান না করিলে বা উহারা আপনারা কোন স্থান হইতে ওই সকল অলঙ্কার অপহরণ করিয়া না আনিতে পারিলে, কোনরূপেই উহা উহারা পাইতে পারে না। স্ত্রীলোক হইয়া যে উহারা ওই সকল মূল্যবান অলঙ্কার অপহরণ করিয়া আনিতে পারিবে, তাহা সহজে অনুমান করা যাইতে পারে না; অথচ সভ্যতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে না হইতে পারে, এরূপ কোন কার্য্যও প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না; কিন্তু, বিশেষরূপ অনুধাবন করিয়া দেখিলে স্পষ্টই অনুমান হয় যে, ওই সকল অলঙ্কার তাহারা অপর কোন ব্যক্তির নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে, –কিন্তু কাহার নিকট হইতে ইহাদিগের উহা পাইবার সম্ভাবনা? 

আমরা এখন যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে দুইটি লোকের নিকট হইতে উহারা এই সকল গহনা পাইতে পারে। এক আমাদিগের সমভিব্যাহারী এই ফিরিঙ্গী-যুবক, না হয় উইনসু নামক সেই চিনাম্যান। যাহা হউক, একটু পীড়াপীড়ি করিয়া অনুসন্ধান করিতে পারিলেই সকল কথা ক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়িবে। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া মেমসাহেবদিগকে আরও কিছু কিছু জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিলাম। এবার কিন্তু তাহাদিগকে সকলের সম্মুখে সকলকে জিজ্ঞাসা করিলাম না। সকলকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিয়া এক একজনকে পৃথক করিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিতে আরম্ভ করিলাম। 

এবার সর্ব্বাগ্রে ডাকিলাম এমিকে। সে আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “উইনসু তোমার ঘরে কতদিবস হইতে যাতায়াত করিতেছে?” 

এমি। উইনসু কে? 

আমি। উইনসুকে তুমি চেন না? 

এমি। না, কোন্ উইনসু? 

আমি। কয়জন উইনসু তোমার নিকট পরিচিত? আমি তোমার উপ-পতি উইনসুর কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। 

এমি। আপনারা ভদ্র মহিলাগণকে এরূপ অকথ্য কথা কহেন? আপনারা কিরূপ ভদ্রলোক বলিতে পারি না। আমাদিগের সদৃশ মহিলাগণকে এরূপভাবে অবমাননা-সূচক কথা বলা আপনাদিগের কোনরূপেই কর্তব্য নহে। 

আমি। আমরা তোমাদিগকে কোনরূপে অবমাননা করিবার ইচ্ছা করিয়া এখানে আসি নাই। আমরা এখানে আমাদিগের কর্তব্য পালন করিতে আসিয়াছি ও কর্তব্য প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত যে সকল কথা প্রকৃত বলিয়া আমাদিগের বিশ্বাস, তাহাই আমরা তোমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। এখন নিতান্ত সরল অন্তঃকরণে ওই সকল কথার উত্তর প্রদান করিবে কি না, কেবল তাহাই আমরা এখন জানিতে চাই। পরিশেষে আমাদিগের যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা আমরা করিব। তোমাদিগের যাহা কর্ত্তব্য, তাহাও তোমরা করিও। এখন বল, উইনসু কতদিবস পৰ্য্যন্ত তোমার ঘরে যাতায়াত করিতেছে? 

এমি। আমি উইনসুকে চিনি না। 

আমি। যে ব্যক্তি প্রত্যহ তোমার ঘরে থাকে, ও তোমার ঘরে আহারাদি করে, তাহার নাম কি? 

এমি। আমার ঘরে কেহ থাকে না ও আমার ঘরে কেহ আহারাদি করে না। 

আমি। যাহার সহিত তোমরা কল্য বাহির হইয়া গিয়াছিলে, তাহার নাম কি? 

এমি। আমরা কল্য কাহারও সহিত বাহির হইয়া যাই নাই। 

আমি। কল্য তোমরা কেহ বাহিরে গমন কর নাই? 

এমি। না। 

আমি। সমস্ত রাত্রি দিন বাড়ীতেই ছিলে?

এমি। ছিলাম। 

আমি। উঃ তোমরা কি ভয়ানক মিথ্যাবাদী! 

এমি। মেমেরা কখনও মিথ্যা কথা কহে না। 

আমি। গাউন পরিলেই যদি মেম হয়, তাহা হইলে আর ভাবনা থাকিত না। তোমার সদৃশ চোর মিথ্যাবাদী আর কেহ আছে বলিয়া অনুমান হয় না। আচ্ছা, ও সকল কথা যাউক, তোমার পরিধানে যে সকল অলঙ্কার ছিল, ও যাহা আমরা খুলিয়া এই স্থানে রাখিয়া দিয়াছি, তাহা কাঁহার? 

এমি। উহা আমার গহনা। 

আমি। ওই সকল অলঙ্কার তুমি পাইলে কোথায়? 

এমি। আমার ছিল। 

আমি। তোমার ছিল তাহা আমি জানি, কিন্তু তুমি কোথা হইতে উহা পাইলে? 

এমি। আমার নিকট উহা অনেক দিবস পৰ্য্যস্ত আছে। 

আমি। অনেক দিবস, কত দিবস? 

এমি। ৮/১০ বৎসর। 

আমি। তাহা হইলে তুমি বলিতে চাহ, এই সকল অলঙ্কার তোমার নিকট গত ৮/১০ বৎসর পর্য্যন্ত আছে?

এমি। হাঁ। 

আমি। তুমি কি ভয়ানক স্ত্রীলোক? ৮/১০ বৎসর হইল এই সকল অলঙ্কার তোমাকে কে দিয়াছিল? 

এমি। আমি আমার পিতামাতার নিকট হইতে ওই সকল অলঙ্কার পাইয়াছিলাম। 

আমি। তোমার পিতামাতা কোথায়? 

এমি। তাঁহারা মরিয়া গিয়াছেন। 

আমি। উভয়েই মরিয়া গিয়াছেন? 

এমি। হাঁ। 

আমি। কতদিবস হইল তাঁহারা মরিয়া গিয়াছেন? 

এমি। আমার মাতা মরিয়াছেন ৭ বৎসর হইল, ও আমার পিতা মরিয়াছেন ৫ বৎসর হইল। 

আমি। পূর্ব্বে ভাবিয়াছিলাম, অপর কোন ব্যক্তি এই সকল অলঙ্কার চুরি করিয়া আনিয়া তোমাদিগকে দিয়াছে। তোমার কথা শুনিয়া এখন অনুমান হইতেছে, তাহা নহে; তুমি নিজেই এই সকল অলঙ্কার অপহরণ করিয়াছ ও নিজের প্রাণ বাঁচাইবার মানসে সমস্তই মিথ্যা কথা কহিতেছ। কিন্তু জানিও, তুমি যত কেন মিথ্যা কথা কহ না, কিছুতেই আমাদিগকে বঞ্চনা করিতে পারিবে না। প্রকৃত কথা অনেকটা আমরা অবগত হইয়াছি, যাহা জানিতে এখনও বাকী আছে, তাহা তোমদিগের নিকট হইতেই জানিয়া লইব। জানিও, এখন হইতে আমরা তোমাকে চোর স্থির করিয়া লইলাম ও এখন হইতে চোরগণ আমাদিগের নিকট যেরূপ ব্যবহার প্রাপ্ত হইয়া থাকে, জানিও সেইরূপ ব্যবহার এখন হইতে তোমার অদৃষ্টে ঘটিতে চলিল। 

এই বলিয়া এমিকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না, একজন প্রহরীর জিম্মায় তাহাকে অন্য আর একস্থানে বসাইয়া রাখিলাম। ইহাতেও দেখিলাম, এমি এখন পৰ্য্যন্ত ভীতা হয় নাই, বা আমাদিগের প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দিতে সে এখন পর্যন্ত প্রস্তুত নহে। 

এমিকে সেই স্থানে হইতে বিদায় দিয়া মেরীকে ডাকিলাম। তাহার সহিত দুই চারিটি কথা কহিবার পরই যেন বুঝিতে পারিলাম, বেলা, লুসি বা এমি যে উপাদানে নির্ম্মিত, এ সে উপাদানে নির্ম্মিত নহে। ইহার উপাদান স্বতন্ত্র। ইহার কথা শুনিয়া অনুমান হইল, এ কোন কথা গোপন করিবে না। যে সকল বিষয় যতদূর মনে আছে, – জিজ্ঞাসা করিলে সে তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার নাম মেরী?” 

মেরী। হাঁ, উহাই বলিয়া সকলে আমাকে ডাকিয়া থাকে। 

আমি। তুমি এই বাড়ীতে কতদিবস পর্য্যন্ত আছ? 

মেরী। প্রায় দুই বৎসর হইতে। 

আমি। তোমার কে আছে? 

মেরী। আমার মা আছেন। তিনি এই বাড়ীতে থাকেন না। আমি ও আমার স্বামী এই বাড়ীতে বাস করি। 

আমি। তোমার স্বামী কি করেন? 

মেরী। তিনি কোন গবর্ণমেণ্ট আফিসে সামান্য কেরাণীগিরি কার্য্য করেন।

আমি। তুমি এই ফিরিঙ্গী যুবককে চিন? 

মেরী। চিনি, সে আমাদিগের বাড়ীতে প্রায়ই আসিয়া থাকে। 

আমি। এই মুসলমান যুবক? 

মেরী। সেও সর্বদা আসিয়া থাকে। 

আমি। এমিকে তুমি কত দিবস হইতে চিন? 

মেরী। যতদিবস আমরা একত্রে বাস করিতেছি। 

আমি। তাহার স্বামী আছে? 

মেরী। শুনিয়াছি, আছে। 

আমি। তিনি কোথায়? 

মেরী। তাহা আমি অবগত নহি। শুনিয়াছ, আসামে বা কোথায় চাকরি করে। তাহাকে কখনও দেখি নাই, সে কখনও এখানে আসে নাই। 

আমি। এমির চলে কি প্রকারে? 

মেরী। কেন উহার ভাবনা কি, উহার আজকাল সময় খুব ভাল। যে লোক উহার ঘরে যাতায়াত করিতেছে, সে উহাকে অনেক অর্থাদি দিয়া থাকে। 

আমি। কে উহার ঘরে যাতায়াত করিতেছে? 

মেরী। উইনসু নামক একজন সাহেব। সে চিন দেশীয় লোক শুনিয়াছি। 

আমি। উইনসু যেমন এমিকে অর্থাদি দিয়া থাকে, সেইরূপ তোমাদিগকেও মধ্যে মধ্যে সাহায্য করে কি? মেরী। করে বৈকি! দেখুন না আমাদিগকে সে কেমন এক একখানি গহনা দিয়াছে। 

আমি। কোন্ গহনা? 

মেরী। যাহা আমাদিগের অঙ্গ হইতে আপনারা গ্রহণ করিয়াছেন। 

আমি। এই সকল অলঙ্কার তাহা হইলে তোমরা উইনসুর নিকট হইতে পাইয়াছ? 

মেরী। হ্যাঁ। 

আমি। তিনি তোমাদিগকে এই সকল অলঙ্কার দিলেন কেন? 

মেরী। তিনি আমাদিগের সকলকে একটু ভালবাসেন বলিয়াই বোধ হয়, ওই সকল অলঙ্কার আমাদিগকে প্রদান করিয়াছেন। 

আমি। তোমাকে তিনি কয়খানি অলঙ্কার প্রদান করিয়াছেন? 

মেরী। একখানি। 

আমি। বেলাকে? 

মেরী। তাহাকেও একখানি দিয়াছেন। 

আমি। লুসিকে? 

মেরী। তাহাকে বোধ হয় দুইখানি দিয়াছেন। 

আমি। এমিকে? 

মেরী। তাহাকে কোন অলঙ্কার দিয়াছে কি না, তাহা আমরা অবগত নহি; কারণ, সে আমাদিগের সহিত গমন করে নাই। 

আমি। এমি তাহার নিকট হইতে কয়খানি অলঙ্কার প্রাপ্ত হইয়াছে? 

মেরী। তাহা ঠিক বলিতে পারি না। তাহাকে কিন্তু অনেকগুলি অলঙ্কার পরিতে দেখিয়াছি; কিন্তু তাহাকে যে কি কি অলঙ্কার প্রদান করিয়াছে, তাহা আমরা বিশেষরূপ অবগত নহি। কারণ উইনসুর এখনকার বর্ত্তমান স্ত্রীই ওই এমি। এমির হাতেই উইনসুর সর্ব্বস্ব ও উইনসুর হাতেই এমির যাহা কিছু। সুতরাং তাহাদিগের মধ্যে কখন কিরূপ হইয়া থাকে, তাহার দিকে আমরা লক্ষ্য রাখি না ও সেই সকল বিষয় আমাদিগের কোন প্রকার অনুসন্ধান করাও কৰ্ত্তব্য নহে; কারণ, আমরা যাহা কিছু পাইয়াছি, তাহার কারণও এমি। এমি আমাদিগকে একটু ভালবাসে বলিয়াই উইনসু আমাদিগকে এক একখানি অলঙ্কার প্রদান করিয়াছে। নতুবা উইনসু আমাদিগকে মূল্যবান অলঙ্কার সকল প্রদান করিবে কেন? তাহার সহিত আমাদিগের অপর কোন সম্বন্ধ নাই। 

আমি। তোমরা উইনসুর সহিত কোথায় গমন করিয়াছিলে? 

মেরী। অনেক স্থানে গিয়াছিলাম 

আমি। অনেক স্থানে, কোথায়? 

মেরী। আমরা সকলে একখানি গাড়ি করিয়া ভোর পাঁচটার সময় বহির্গত হই। কলিকাতার নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া, ও নানা হোটেলে আহারাদি ও আমোদ আহ্লাদ করিয়া, পরিশেষে হাবড়ায় গমন করি। সেই স্থানে গিয়া আমাদিগের গাড়ি ছাড়িয়া দি, ও রেলের গাড়িতে উঠিয়া চন্দননগরে গমন করি। সেই স্থানের হোটেলে গিয়া আহারাদি করিয়া অপর এক স্থানে গমন করি। সেই স্থানে রাত্রির অনেক সময় অতিবাহিত করিয়া, পরিশেষে আমরা কলিকাতায় ফিরিয়া আসি। 

আমি। তোমরা একসঙ্গে যে যে গিয়াছিলে, সকলেই কি ফিরিয়া আইস? 

মেরী। সকলেই ফিরিয়া আসি; কেবলমাত্র উইনসু আমাদিগের সহিত আগমন করে নাই। সে সেই স্থানেই থাকিয়া যায়।

আমি। তাহা হইলে তোমরা উইনসুকে চন্দননগরে ছাড়িয়া আসিয়াছ? 

মেরী। হাঁ। 

আমি। চন্দননগরের কোন্ স্থানে তোমরা তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছ? 

মেরী। একটি মেমসাহেবের বাড়ীতে। যে বাড়ীতে আমরা অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত অতিবাহিত করিয়াছিলাম, সেই বাড়ীতে। 

আমি। তোমরা তাহাকে সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া আসিলে কেন? 

মেরী। তিনি সেই স্থানেই থাকিলেন, আমাদিগের সহিত আসিলেন না বলিয়াই তাঁহাকে সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া আসিতে হইল। 

আমি। তোমরা সকলে যখন তাহার সহিত সেই স্থানে গমন করিলে, তখন তাহাকে সেই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া আসিলে কেন? 

মেরী। তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া আসার ইচ্ছা আমাদিগের ছিল না; কিন্তু যখন কিছুতেই আসিলেন না, তখন আমাদিগকে কাযেই তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া আসিতে হইল। কারণ, বাড়ী হইতে যাইবার সময় আমরা কাহাকে বলিয়া যাই নাই। আমরা সকলে মিলিয়া, কোথায় গিয়াছি, তাহা কেহই অবগত ছিলেন না। এরূপ অবস্থায় একটু গোলযোগ হইবার সম্ভাবনা। ইহা ভাবিয়া আমাদিগকে কার্যেই প্রত্যাগমন করিতে হইল। বিশেষ যে সময় আমি গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় আমার স্বামী তাঁহার কর্ম্ম স্থানে ছিলেন; সুতরাং, তিনি আসিয়া যখন আমাকে বাড়ীতে দেখিতে পাইবেন না, অথচ আমরা কোথায় গিয়াছি তাহাও জানিতে পারিবেন না, তখন তিনি বিশেষরূপ ভাবিত হইতে পারেন; এরূপ অবস্থায় আমাকে ফিরিয়া না আসিলে কোনরূপেই চলিবার সম্ভাবনা ছিল না; সুতরাং, ফিরিয়া আসিবার জন্য আমি অতিশয় জিদ করিলাম। বেলা ও লুসি আমার মতে মত দিয়া আমার সহিত প্রত্যাগমন করিতে প্রবৃত্ত হইল। এমির আসিবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু যখন আমাদিগের সকলকেই সে আসিতে প্রস্তুত দেখিল, তখন সেও আমাদিগের সঙ্গে সঙ্গে বাহির হইয়া পড়িল; কাযে কাযেই আমরা সকলেই সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিলাম। 

আমি। আসিবার সময় এমি কিছু বলিয়া আসিয়াছিল? 

মেরী। আসিয়াছিল। 

আমি। সে কি বলিয়া আসিয়াছিল? 

মেরী। এমি উইনসুকে এই বলিয়া আসিয়াছিল, “আমরা সকলে একবারে কলিকাতায় গমন করিতেছি। সেই স্থানে আমাদিগের জিনিষপত্র ঠিক করিয়া রাখিয়া কল্য পুনরায় এখানে আসিয়া উপস্থিত হইব। আমার সহিত যদি কেহ উহারা আসে, তাহা হইলে উহাদিগকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিব। নতুবা একাকী আসিয়াই উপস্থিত হইব।” 

আমি। কেবল ইহাই বলিয়া আসিয়াছিল? 

মেরী। তাহাই আমার মনে হইতেছে। 

আমি। কোন্ স্থানে আগমন করিলে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে, তাহা কিছু জিজ্ঞাসা করিয়াছিল? 

মেরী। হাঁ, তাহাও জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। 

আমি। কি জিজ্ঞাসা করিয়াছিল? 

মেরী। এমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করে, “কল্য যখন আমরা পুনরায় এখানে আগমন করিব, তখন তোমার সহিত কোথায় সাক্ষাৎ হইবে?” 

আমি। এই কথার উত্তরে সে কি কহে? 

মেরী। এই বলে “যে বাড়ীতে তোমরা আমাকে রাখিয়া যাইতেছ, দুইদিবস পর্য্যন্ত আমি এই বাড়ীতেই তোমাদিগের জন্য অপেক্ষা করিব। দুই দিবসের মধ্যে আসিলেই আমাকে এই স্থানে দেখিতে পাইবে। আর যদি আমাকে এখানে একান্তই দেখিতে না পাও, তাহা হইলে আমি যেস্থানে যাইব, তাহা এই বাড়ীতে বলিয়া যাইব। এই স্থানে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবে, যে আমি কোথায় আছি; এবং সেই স্থানে গমন করিলেই আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। 

আমি। আচ্ছা তোমাকে আরও দুই চারিটি কথা আমি জিজ্ঞাসা করিতে চাই। তুমি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিবে কি? 

মেরী। আপনারা আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি তখনই তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিব। আমি মিথ্যা কথা কহিব কেন? মিথ্যা কথা বলিয়া আমার লাভ কি? 

আমি। লাভ নাই তাহাই বলিতেছি, বরং প্রকৃত কথা কহিলে লাভ আছে। 

মেরী। আমি মিথ্যা কথা কহিব না। 

আমি। এমির ঘরে উইনসুর যাতায়াত আছে। স্বামী স্ত্রীর ন্যায় তাহারা বাস করিয়া থাকে। তাহাকে না হয় উইনসু বহুমূল্য অলঙ্কার প্রদান করিতে পারে, কিন্তু তোমাদিগকে সে উহা প্রদান করিল কেন? 

মেরী। কেন যে প্রদান করিল, তাহা আমি বলিতে পারি না; কিন্তু, সে যে আমাদিগকে উহা প্রদান করিয়াছে, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র ভুল নাই। 

আমি। কিরূপ অবস্থায় সে ওই সকল অলঙ্কার তোমাদিগকে প্রদান করিল? 

মেরী। রাত্রি আন্দাজ ২/৩টার সময় এমি আমাদিগকে ডাকে। আমাদিগের কাহার ঘরে, কোনরূপ ভাঙ মদ্যাদি আসিলে আমরা একাকী প্রায়ই তাহা খাইতাম না। সকলকে ডাকিয়া সকলে মিলিয়া আমোদ আহ্লাদ করিয়া উহা পান করিতাম; ইহা আমাদিগের একরূপ নিয়মের মধ্যে পরিগণিত ছিল। সেই রাত্রিতে উইনসু কয়েক বোতল ভাল ভাল মদ কোথা হইতে আনিয়াছিল। উহা পান করিবার সময় এমি আমাদিগকে ডাকে। এমির কথা শুনিয়া আমরা তাহার ঘরে গমন করিয়া সকলে মিলিয়া সেই স্থানে বসিয়া, মদ্যপান করিতে আরম্ভ করি। ক্রমে আমাদিগের সকলেরই একটু একটু নেশা হয়। সেই সময় দেখিতে পাই, এমির অঙ্গে কয়েকখানি নূতন অলঙ্কার রহিয়াছে। ইহা দেখিয়া আমরা এমিকে জিজ্ঞাসা করি, “তুমি এ সকল অলঙ্কার কোথায় পাইলে?” সে কহে “উইনসু আমাকে দিয়াছে।” উইনসুর ও সেই সময় একটু নেশা হইয়াছিল, আমরা এই অবস্থা দেখিয়া উইনসুকে কহি, “এমি তোমার স্ত্রী; সুতরাং, সে তোমার নিকট হইতে নানারূপ অলঙ্কার পাইবার যোগ্যা। কিন্তু আমরা তোমার বন্ধু হইয়াও কি তোমার নিকট হইতে এক একখানি অলঙ্কারের প্রত্যাশা করিতে পারি না?” আমাদিগের কথা শুনিয়া উইনসু প্রথমে কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। এমিরও সেই সময় অনেকটা নেশা হইয়া আসিয়াছিল। সে আমাদিগের কথা শুনিয়া কহে, “নিশ্চয়ই তোমাদিগের পাওয়া উচিৎ। যখন আমি পাইয়াছি, তখন তোমরাই বা না পাইবে কেন?” এই বলিয়া সে উইনসুকে কহে, “তোমার নিকট অনেক অলঙ্কার আছে। ইহাদিগকে এক একখানি প্রদান কর না কেন? ইহাদিগকে এক একখানি অলঙ্কার প্রদান করিলেই তোমার সমস্ত অলঙ্কার কিছু ফুরাইয়া যাইবে না। 

আমি। এই কথা শুনিয়া উইনসু কি কহিল? 

মেরী। সে কহিল “তাহা ত সত্য, যখন তুমি কিছু পাইয়াছ, তখন ইহাদিগেরও কিছু পাওয়া উচিৎ।” এই বলিয়া সে তিন চারিখানি অলঙ্কার বাহির করিয়া আমাদিগকে প্রদান করিল। আমরাও উহা তখনই আমাদিগের অঙ্গে পরিধান করিলাম। 

আমি। এ সকল অলঙ্কার কোথা হইতে বাহির করিয়া সে তোমাদিগকে প্রদান করিল? 

মেরী। একটি কোরিয়ার ব্যাগ হইতে? 

আমি। ওই ব্যাগটি কত বড়? 

মেরী। নিতান্ত ছোট নহে, প্রায় ১ হাত লম্বা হইবে। 

আমি। যখন উহার ভিতর হইতে অলঙ্কার বাহির করিয়া তোমাদিগকে প্রদান করিল, সেই সময় সেই ব্যাগের মধ্যে আর অলঙ্কার ছিল কি? 

মেরী। আরও অনেক অলঙ্কার ছিল। 

আমি। তুমি তাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছ? 

মেরী। দেখিয়াছি। 

আমি। কিরূপে দেখিলে? 

মেরী। উইনসু তাহার ব্যাগটি খুলিয়া তাহার ভিতর হইতে কতকগুলি অলঙ্কার বাহির করিয়া বিছানার উপর রাখিয়া দেয়। এমি একটি আলো আনিয়া সেই স্থানে বসে। ওই আলোর সাহায্যে উইনসু ওই সকল অলঙ্কারের মধ্য হইতে ৩/৪ খানি অলঙ্কার বাহির করিয়া লইয়া আমাদিগকে প্রদান করে। তাহাই আমি উহা দেখিয়াছি। 

আমি। তোমাদিগকে অলঙ্কার প্রদান করিবার পর বিছানার উপর যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহা সে কি করে?

মেরী। তাহার সমস্তগুলি উঠাইয়া লইয়া পুনরায় সে সেই ব্যাগের ভিতর রাখিয়া দেয়। 

আমি। ব্যাগের চাবি? 

মেরী। চাবিও সে তাহার নিকট রাখিয়া দেয়। 

আমি। ওই সকল অলঙ্কার দেখিতে কেমন? 

মেরী। দেখিতে সুন্দর। অনেকগুলিতেই হীরা পান্না প্রভৃতি পাথর বসান আছে। আমি। ওই সকল অলঙ্কার উইনসু কোথায় পাইয়াছে তাহা কিছু বলিতে পার?

মেরী। না, তাহার কিছুই আমরা বলিতে পারি না। 

আমি। এ সম্বন্ধে তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে কি? 

মেরী। না, কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। 

আমি। তাহার পর তোমরা কি করিলে? 

মেরী। গাড়ি করিয়া তাহার সহিত বাহির হইয়া গিয়াছিলাম। 

আমি। তাহার সহিত গমন করিলে কেন? 

মেরী। আমরা যে কেন তাহার সহিত গমন করিয়াছিলাম, তাহার প্রকৃত কথা আপনি কি অবগত হইতে চাহেন?

আমি। প্রকৃত কথা জানিতে চাহি বলিয়াই ত তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। 

মেরী। সেই সময় সে আমাদিগকে যাহা কহিয়াছিল, আমরা তাহাতেই সম্মত হইয়াছিলাম; কারণ, আমাদিগের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, উহার সহিত সেই সময় থাকিতে পারিলে, কালে অসময়ে হউক, খোসামোদ করিয়া হউক, বা সুযোগ পাইলে অপহরণ করিয়া হউক, আরও দুই একখানি অলঙ্কারের যোগাড় করিতে সমর্থ হইব। কারণ, এরূপ সুযোগ যে আর কখনও ঘটিবে, তাহা বোধ হয় না। 

আমি। সেরূপ সুযোগ কিছু করিয়া উঠিতে পারিয়াছিলে কি? 

মেরী। পারিয়াছিলাম বৈকি। 

আমি। কিরূপ করিয়া উঠিতে পারিয়াছিলে? 

মেরী। সুযোগমাত্র আমরা দুই একখানি অলঙ্কার অপহরণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। 

আমি। সকলেই? 

মেরী। সকলেই; আমরা যে যে তাহার সহিত গমন করিয়াছিলাম, তাহারা সকলেই।

আমি। ওই সকল অলঙ্কার তোমরা কি করিলে? 

মেরী। আছে। 

আমি। কোথায় আছে? 

মেরী। আমাদিগের ঘরে। 

আমি। কাহার ঘরে? 

মেরী। আমাদিগের প্রত্যেকের ঘরেই আছে, চাহিলে সকলেই বাহির করিয়া দিবে। 

আমি। তাহা হইলে ওই সকল অলঙ্কার রাখিবার নিমিত্ত তোমরা বাড়ীতে আসিয়াছিলে? 

মেরী। তাহাও একটি কারণ। 

আমি। সেই সকল অলঙ্কার এখন কোথায়? 

মেরী। কোন্ অলঙ্কার? 

আমি। যে সকল অলঙ্কার ব্যাগের ভিতর ছিল? 

মেরী। সেই সকল অলঙ্কার উইনসুর নিকটেই আছে। মুহূর্ত্তের নিমিত্তও সে সেই ব্যাগ কোন স্থানে রাখিয়া দেয় নাই, বরাবরই নিজের নিকট রাখিয়া দিয়াছে। 

আমি। তাহার নিকট অলঙ্কার ব্যতীত কিছু নগদ টাকা আছে? 

মেরী। আছে। 

আমি। কত টাকা আছে? 

মেরী। তাহা বলিতে পারি না; কিন্তু হোটেল প্রভৃতি স্থানে যখন যে টাকার প্রয়োজন হইয়াছে, তখনই সে উহা বাহির করিয়া দিয়াছে। 

আমি। টাকা সে কোথা হইতে বাহির করিয়া দিয়াছে? 

মেরী। সেই ব্যাগের ভিতর হইতে। 

আমি। তাহা হইলে সেই ব্যাগের ভিতর যেমন অলঙ্কার আছে, সেইরূপ নগদ টাকাও আছে? 

মেরী। আছে। 

আমি। এখন যদি তোমাদিগকে সঙ্গে লইয়া যাই, তাহা হইলে যেস্থানে উইনসু এখন আছে, তাহা তুমি আমাদিগকে দেখাইয়া দিতে পারিবে? 

মেরী। যে বাড়ীতে সে আছে, তাহা আমি চিনিতে পারিব; কিন্তু রাস্তা চিনিয়া সেই স্থানে গমন করিতে পারিব কি না, তাহা এখন বলিতে পারিতেছি না। সে রাস্তা দিয়া রাত্রিকালে গাড়ি করিয়া আসিয়াছি, সেই রাস্তা সহজে যে চিনিয়া উঠিতে পারিব, তাহা আমি এখন বলিতে পারিতেছি না। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

মেরীর কথা শুনিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, যে সে যাহা বলিয়াছে, তাহার একটি কথাও মিথ্যা নহে; সমস্তই প্রকৃত। মেরীর কথা শুনিয়া বেলা, লুসি প্রভৃতি সকলকে পৃথক পৃথক করিয়া পুনরায় ডাকাইলাম। তাহাদিগকে ওই সকল কথা পুনরায় জিজ্ঞাসা করা প্রথমতঃ সকল কথা অস্বীকার করিল; কিন্তু পরিশেষে তাহাদিগকে অনেক কথা স্বীকার করিতে হইল। 

ওই সকল স্ত্রীলোকদিগের নিকট অপর যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার মধ্য হইতে কেহ কেহ সহজেই দুই একখানি বাহির করিয়া দিল, কেহ কেহ বা অলঙ্কারের সমস্ত কথা অস্বীকার করিল। পরিশেষে অনন্যোপায় হইয়া উহাদিগের প্রত্যেকের ঘর আমাদিগকে অনুসন্ধান করিতে হইল। বলা বাহুল্য, কাহারও কাহার ঘর হইতে দুই একখানি অলঙ্কারও বাহির হইল। 

এইরূপে ওই বাড়ীর মধ্যে সেই সময় অনুযায়ী সমস্ত অনুসন্ধান শেষ করিয়া আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। যে সময় আমরা সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। 

আমরা সেই স্থান হইতে আসিবার সময় বেলা, লুসি, এমি, মেরী প্রভৃতি সকলকেই সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিলাম। মেরী আমাদিগের নিকট সমস্ত কথা পূৰ্ব্ব হইতেই স্বীকার করিয়াছিল, ও তাহার নিকট যে কিছু অলঙ্কার ছিল, তাহা সে নিজেই বাহির করিয়া দিয়াছিল; তদ্ব্যতীত, উইনসুকে দেখাইয়া দিতে সে সৰ্ব্বতোভাবে প্রস্তুত, একথা আমাদিগকে বলিয়াছিল; সুতরাং, তাহাকে আসামী-শ্রেণীভুক্ত না করিয়া সাক্ষীরূপেই আমরা সঙ্গে করিয়া আনিলাম। অপরাপর স্ত্রীলোকগণ যাহারা আমাদিগের সহিত নানারূপ অসদ্ব্যবহার করিয়া, আমাদিগের নিকট রাশি রাশি মিথ্যা কথা কহিয়া আমাদিগকে সম্পূর্ণরূপে প্রবঞ্চনা করিতে সাধ্যমত চেষ্টা করিয়াছিল, ও পরিশেষে যাহাদিগের ঘর অনুসন্ধান করিয়া কোন কোন অলঙ্কার বাহির করিতে হইয়াছিল, তাহাদিগকে আমরা কয়েকখানি গাড়ির ভিতর উচিতমত প্রহরী সমভিব্যাহারে আসামীরূপে গ্রহণ করিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম ও সকলকে লইয়া একেবারে থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

ক্রমে রাত্রি হইয়া আসিতে লাগিল। এরূপ অবস্থায় আমাদিগের কি করা কর্তব্য, তাহাই একবার ভাবিলাম। ভাবিলাম, এই রাত্রিকালে চুপ করিয়া থাকিয়া পরদিবস প্রাতঃকাল হইতে এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া কৰ্ত্তব্য কি না? 

পুনরায় মনে হইল, নিরর্থক যদি রাত্রি অতিবাহিত হইয়া যায়, আর উইনসু এখন যে স্থানে আছে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করে, তাহা হইলে তাহাকে পাওয়া নিতান্ত সহজ হইবে না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবিলাম, আমরা এই রাত্রিকালেই উইনসুর অনুসন্ধানে গমন করিলেই বা কিরূপে সেই কার্য্য সমাধা করিতে পারিব, তাহা বলা যায় ‘না; কারণ, ওই স্থান ইংরাজ-রাজত্বের বহির্ভূত। ওই স্থানে একাকী গমন করিয়া কোনরূপ অনুসন্ধান করিবার ক্ষমতা আমাদিগের নাই। উহা ফরাসী রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত। ওই স্থান সম্বন্ধে ইংরাজ ও ফরাসীদিগের মধ্যে কিরূপ সন্ধি আছে জানি না; কিন্তু ইংরাজ-রাজত্বের পুলিস ওই স্থানে গিয়া কোনরূপ অনুসন্ধানেই প্রবৃত্ত হইতে পারে না। যদি ওই স্থানের অন্তর্গত কোন স্থানে কোনরূপ অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন হয়, তাহা হইলে ইংরাজ-শাসনকর্তাকে ফরাসী-শাসনকর্তার নিকট ওই সম্বন্ধে পত্র লিখিতে হয়। ওই পত্র পাইবার পর তিনি তাঁহার অধীনস্থ পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণকে ওই বিষয়ের অনুসন্ধান করিতে আদেশ প্রদান করেন। ওই আদেশ পাইয়া তাঁহারাই অনুসন্ধান বা আসামী ধৃত করিয়া পরিশেষে ইংরাজ-শাসনকর্তাকে সংবাদ প্রেরণ করিয়া থাকেন। ওই সংবাদ প্রাপ্ত হইলে যদি জানিতে পারা যায়, যে ওই স্থান হইতে কোন আসামী প্রভৃতিকে আনিতে হইবে, তাহা হইলে ইংরাজ-রাজত্বের পুলিস-কৰ্ম্মচারী পুলিসের পোষাক বিহীন হইয়া সেই স্থানে গমন করিলে তাঁহারা ওই আসামী প্রভৃতি তাঁহাকে প্রদান করেন। যদি কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী না জানিয়া ওই নিয়মের বিপরীত কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন, অর্থাৎ তিনি স্বয়ং ওই স্থানে গমন করিয়া কোন মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করেন, তাহা হইলে ফরাসী-রাজত্বের পুলিস তাঁহাকে ধৃত করিয়া ‘তুরুকে’ আবদ্ধ করিয়া রাখে। 

‘তুরুকে আবদ্ধ’ বা ‘তুরুংঠোকার’ কথা পাঠক পাঠিকাগণের মধ্যে অনেকেই শুনিয়াছেন; কিন্তু, উহা যে কি, তাহা অনেকেই অবগত নহেন। 

দুইখানি কাঠফলক ‘তুরুং’ রূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। উহার এক একখানি প্রায় ৯/১০ ফুট লম্বা, ১২ ইঞ্চি চওড়া ও ২ হইতে ৩ ইঞ্চি উচ্চ। ওই দুইখানি কাষ্ঠ উপর্যুপরি চওড়া করিয়া খাড়া করিলে উহার পরিসর প্রায় দুই ফুট হয়। ওই কাষ্ঠফলকদ্বয়ের দুই প্রান্ত এরূপ ভাবে লৌহ দ্বারা নির্ম্মিত যে, ওই দুইখণ্ড তক্তা ওই রূপে একত্রিত করিলে ওই লৌহ দ্বারা এরূপে আবদ্ধ করা যায়, যে উহা সহজে কোন প্রকারেই বিভিন্ন করা যায় না। ওই কাষ্ঠফলকদ্বয় যে পার্শ্বে সংযুক্ত করা যাইতে পারে, তাহাতে এক এক ফুট ব্যবধানে একটি একটি বড় বড় ছিদ্র করা থাকে। ওই ছিদ্রের পরিমাণ ২/৩ ইঞ্চের কম নহে। ওই ছিদ্র সম্পূর্ণরূপে একখানি কাষ্ঠফলকে থাকে না। উহার প্রথম অর্দ্ধেক একখানিতে ও অপর অর্দ্ধেক আর এক খানিতে এরূপ ভাবে প্রস্তুত হয়, যে উভয় ফলক একত্র যোজিত করিলে উহা একটি একটি সম্পূর্ণ ছিদ্র রূপে পরিণত হয়। যে কোন ব্যক্তিকে তুরুকে বন্ধ করিবার প্রয়োজন হয়, তাহাকে ধরিয়া ওই কাষ্ঠফলকের নিকট লইয়া যাওয়া হয়। একখানি কাষ্ঠ উঠাইয়া ওই ব্যক্তির পদ যুগল দুইটি ছিদ্রের মধ্যে রাখিয়া উপরের কাষ্ঠখানি তাহার উপরে সংস্থাপিত করা হয়। উহাতে ওই ছিদ্রের মধ্য হইতে তাহার পদ সে কোনরুপেই আর বাহির করিয়া লইতে পারে না। তাহাকে অনন্যোপায় হইয়া সেই স্থানেই পড়িয়া থাকিতে হয়। যাহার উপর যেরূপ কঠোর দণ্ডের আদেশ হয়, তাহার পদদ্বয় সেইরূপ দূরের ছিদ্রের মধ্যে প্রবিষ্ট করাইয়া দেওয়া হয়; অর্থাৎ কাহারও পদদ্বয় ১ ফুট, কাহারও ২ ফুট, কাহারও ৩ ফুট, কাহারও বা ৪ ফুট বা কাহারও অধিক ব্যবধানে আবদ্ধ করিয়া রাখা যায়। যাহার পদদ্বয় যত দূরবর্ত্তী থাকে, তাহার কষ্ট সেইরূপ অধিকতর হয়। ইহাতে যে কিরূপ কষ্ট হইয়া থাকে, তাহা ভুক্তভোগী ভিন্ন অপরে সহজে অনুমান করিতে পারিবেন না। আমি নিজে ওই ভয়ানক কষ্টে পড়িতে পড়িতে কোন গতিকে একবার পরিত্রাণ পাইয়াছিলাম; কিন্তু আমার সমভিব্যাহারী একজন পশ্চিম দেশীয় কনেষ্টবলকে প্রায় ৪/৫ দিবস এই কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছিল। 

প্রায় ২০ বৎসর অতীত হইল, কোন একটি ফেরারী আসামীর অনুসন্ধান উপলক্ষে আমাকে সহর পরিত্যাগ করিতে হয়। আমার সহিত কেবলমাত্র একজন হিন্দুস্তানী কনেষ্টবল ছিল। তাহাকে লইয়া ওই আসামীর অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্রমে আমি হুগলিতে গমন করি। সেই স্থান হইতে সংবাদ পাই, যে, ওই আসামী চন্দননগরের মধ্যে বড়বাজার নামক স্থানে অবস্থিতি করিতেছে। ওই স্থানে কিরূপ ভাবে মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে হয়, তাহা আমি সেই সময় সম্পূর্ণরূপে অবগত ছিলাম না; সুতরাং, তাহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমরা উভয়েই একেবারে ওই বড়বাজার নামক স্থানে গমন করি ও সেইস্থানে আমরা ফেরারী আসামীর অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। সেই স্থানের পুলিস এই সংবাদ জানিতে পারিয়া তাঁহাদিগের বিনা অনুমতিতে আমরা তাঁহাদের এলাকার মধ্যে অনুসন্ধান করার নিমিত্ত আমাদিগের উপর বিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হন, ও আমাদিগকে ধৃত করিয়া তুরুকে আবদ্ধ করিবার বন্দোবস্ত করেন। আমি এই সংবাদ অবগত হইতে পারিয়া সেই স্থানে আর তিলার্দ্ধও দণ্ডায়মান না হইয়া পলায়নের চেষ্টা করি। কিন্তু পলায়ন করিবার পূর্ব্বেই সেই স্থানের পুলিস আমাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত আমদিগের পশ্চাৎ ধাবমান হন। অনন্যোপায় হইয়া আমরা দুইজন দুইদিকে দৌড়িয়া পলাইতে আরম্ভ করি। আমি কিয়দ্দূর গমন করিবার পরই দেখিতে পাই, সম্মুখে ভাগীরথী। আমি জানিতাম ভাগীরথী ইংরাজ-রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, আর কোনদিকে লক্ষ্য না করিয়া আমি ভাগীরথী গর্ভে প্রবেশ করি ও কিয়দ্দূর সন্তরণ পূর্ব্বক গমন করিবার পর, একখানি ছোট পান্‌সি ধরিয়া তাহাতে আরোহণ পূর্ব্বক আপনার জীবন রক্ষা ও তুরুকের হস্ত হইতে আপনাকে রক্ষা করিতে সমর্থ হই। যে পাসিতে আমি আরোহণ করিয়াছিলাম, কয়েকজন লোক উহাতে আরোহণ করিয়া কলিকাতায় আগমন করিতেছিলেন। তাঁহারাই অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক আমাকে সেই পাসিতে স্থান প্রদান করেন ও আমাকে সঙ্গে লইয়া কলিকাতায় আগমন করেন। আমার সমভিব্যাহারী সেই পশ্চিমদেশীয় কনেষ্টবল যে কোনদিকে গমন করিয়াছিল, ও তাহার ভাগ্যে যে কি ঘটিয়াছিল তাহার কিছুই আমি সেই সময় অবগত হইতে পারি নাই; কিন্তু পরে শুনিয়াছিলাম, যে, সে সেই স্থানের পুলিশের হস্তে পতিত হইয়া থানায় নীত হইয়াছে ও সেই স্থানে তুরুকে আবদ্ধ অবস্থায় আছে। আমাদিগের পুলিস বিভাগের সর্বপ্রধান কর্মচারী এই সংবাদ জানিতে পারিয়া, ইংরাজ-শাসনকর্তাকে এক পত্র লেখেন। তিনি ফরাসী-শাসনকর্তাকে পত্র লিখিলে সেই কনেষ্টবল পরিশেষে অব্যাহতি পায়। পত্রাদি লিখিতে ও তাহার উত্তর প্রভৃতি আসিতে প্রায় ৫ দিবস অতিবাহিত হইয়া যায়। এদিকে ওই কনেষ্টেবলকে ৫ দিবস ওই তুরুকে আবদ্ধ থাকিতে হইয়াছিল। 

সেই রাত্রিতেই আমাদিগের চন্দননগরের মধ্যে প্রবিষ্ট হওয়া কৰ্ত্তব্য কি না, তাহা ভাবিবার সময় আমার সেই পুরাতন কথা মনে আসিল। ভাবিলাম, এরূপ অবস্থায় ঊর্দ্ধতন কর্মচারীকে সবিশেষ বৃত্তান্ত না বলিয়া, বা তাঁহার আদেশ গ্রহণ না করিয়া আমাদিগের সেই স্থনে গমন করা কোনরুপেই কৰ্ত্তব্য নহে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া সেই সময় আসামী প্রভৃতি সকলকে সঙ্গে লইয়া আমাদিগের সর্বপ্রধান কর্মচারীর বাসস্থানে গিয়া উপনীত হইলাম। 

নবম পরিচ্ছেদ 

আমরা যে সময় সৰ্ব্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় তিনি তাঁহার বাসায় উপস্থিত ছিলেন না। কিয়ৎক্ষণ সেই স্থানে অপেক্ষা করিবার পরই তিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমাদিগের নিকট সমস্ত অবস্থা শুনিয়া, ও মেরী প্রভৃতির নিকট সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া, তিনি অনেকক্ষণ পর্যন্ত স্থিরভাবে কি চিন্তা করিলেন, ও পরিশেষে আমাদিগকে এই আদেশ প্রদান করলেন “তোমরা যে কয়জন কৰ্ম্মচারী অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছ, তাহারা সমস্ত ও আরও কয়েকজন কার্যক্ষম ও বিশ্বাসী কৰ্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া এখনই সেই স্থানে গমন কর। তোমাদিগের সহিত দুইজন প্রধান কর্ম্মচারীও গমন করিবেন। তাঁহাদিগকে আমি এখনই আদেশ প্রদান করিতেছি। যেরূপ উপায়ে হউক, তোমরা এখনই সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইবে; কিন্তু ফরাসী রাজত্বের ভিতর কোনরূপে প্রবেশ করিও না। আমি যতদূর অবগত আছি, তাহাতে আমি তোমাদিগকে এই মাত্র বলিতে পারি, যে ওই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া ইংরাজ-রাজত্বের ভিতর আগমন করিতে না পারিলে, সে অপর কোন স্থানে পলায়ন করিতে সমর্থ হইবে না। আর ওই স্থান হইতে বহির্গত হইবার ৪/৫টি ভিন্ন পথ নাই। তোমরা সকলে সেই স্থানে গমন করিয়া ৪/৫ দলে বিভক্ত হইয়া ইংরাজ-রাজত্বের মধ্যে অবস্থান পূর্ব্বক দেখিবে, উইনসু কোনরুপেই যেন ফরাসী-রাজত্বের মধ্য হইতে পলায়ন করিতে সমর্থ না হয়। যদি সে ফরাসী-রাজত্ব পরিত্যাগ পূর্ব্বক ইংরাজ-রাজত্বের মধ্যে আগমন করে, অমনি তাহাকে যেন ধৃত করা হয়। ইত্যবসরে ইংরাজ-শাসনকর্তাকে লিখিয়া বা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যেরূপ বন্দোবস্ত করার প্রয়োজন হয়, তাহা আমি করিতেছি।” 

সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া আমরা সকলকে সঙ্গে লইয়া সেই সময় হাবড়া ষ্টেসনে গিয়া উপনীত হইলাম। বলা বাহুল্য, দুইজন প্রধান কর্মচারী ও অপর কয়েকজন কর্মচারী আসিয়া আমাদিগের সহিত হাবড়া ষ্টেসনে মিলিত হইলেন। আমরা সকলে যে সময় হাবড়া ষ্টেসনে গিয়া উপনীত হইয়াছিলাম, সেই সময় সেইদিবসের আর কোন গাড়িই ছিল না, সমস্তই চলিয়া গিয়াছিল। আমার অর্থাৎ ডিটেকটিভ পুলিসের প্রধান ইংরাজ-কর্মচারী একজন অতি সুচতুর লোক ছিলেন। তিনি স্টেসন-মাস্টারের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দেখিতে দেখিতে আমাদিগের সকলের চন্দন নগরে যাওয়ার বন্দোবস্ত স্থির করিয়া ফেলিলেন। সেই সময় একখানি মালগাড়ি হাবড়া ষ্টেসন হইতে বৰ্দ্ধমান অভিমুখে যাইবার নিমিত্ত প্রস্তুত ছিল। ষ্টেসন-মাষ্টারের আদেশক্রমে আমরা সকলেই সেই মালগাড়িতে আরোহণ পূর্ব্বক সময়মত চন্দননগরের ষ্টেসন গিয়া উপনীত হইলাম। প্রধান কর্ম্মচারীদ্বয় চিন্তা পূর্ব্বক পরামর্শ করিয়া তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারীগণকে এক এক দিকে প্রেরণ করিলেন। তাঁহারা সকলে পুলিসের বিনা পোষাকে এক একখানি ঘোড়ার গাড়িতে আরোহণ করিয়া এক এক দিকে গমন করিলেন। চন্দননগর হইতে বহির্গত হইয়া হুগলির দিকে গমন করিবার পথে একদল গমন করিলেন। কলিকাতা হইতে পদব্রজে গমন করিলে যে রাস্তা দিয়া চন্দননগর প্রবেশ করিতে হয়, সেই স্থানে আর একদল গমন করিলেন। চন্দননগর হইতে বাহিরে বহির্গত হইবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপর যে কয়েকটি রাস্তা আছে, সেই সকল স্থানেও কয়েকজন গমন করিয়া আদেশ প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। আমি আমাদিগের প্রধান কর্ম্মচারী ও অপর কয়েকজন কর্মচারীর সহিত ষ্টেসনের রাস্তায় রহিলাম। এইরূপে চন্দননগরের তিন দিক আমরা অবরোধ করিলাম সত্য, কিন্তু এক দিক সম্পূর্ণরূপে খোলা রহিল। পাঠকগণের মধ্যে প্রায় সকলেই অবগত আছেন, যে ওই স্থানের একপার্শ্ব দিয়া ভাগীরথী প্রবল বেগে প্রবাহিত, অর্থাৎ ভাগীরথীর পার্শ্বেই ওই নগরী সংস্থাপিত। কিন্তু ওইদিকে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার উপায় সেই রাত্রিকালে হইতে পারে না। অথচ উহার যে কোন স্থানে একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া যে কোন ব্যক্তি যেস্থানে ইচ্ছা সেই স্থানে অনায়াসেই গমন করিতে সমর্থ হন। কয়েকখানি নৌকা ভাড়া করিয়া তাহাতে আরোহণ পূর্ব্বক ওই স্থানের সমস্ত নৌকার প্রতি উত্তমরূপে নজর না রাখিতে পারিলে ওই পথ কোনরূপেই রুদ্ধ হইতে পারে না। কিন্তু সে বন্দোবস্ত রাত্রিকালে কোনরূপেই হইতে পারে না। কারণ,নৌকা ভাড়া করিতে হইলে ফরাসী-রাজত্বের ভিতর গমন করিতে হয়, ও ফরাসী-রাজত্বের মধ্যে দণ্ডায়মান হইয়া নৌকাভাড়া প্রভৃতির বন্দোবস্ত করিতে হয়। এরূপ অবস্থায় সেই স্থানের পুলিস সমস্তই জানিতে পারেন, ও আমাদিগের সমস্তপরামর্শ ব্যর্থ হইয়া যায়। সুতরাং রাত্রির নিমিত্ত আমাদিগকে ওই আশা পরিত্যাগ করিতে হইল। 

আমরা ইংরাজ-রাজত্বের মধ্যে বসিয়া সমস্ত রাত্রি রাস্তার লোকজনের দিকে বিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিতে আরম্ভ করিলাম যে রজনীতে আমরা সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই রজনীতে যে কিরূপ ভয়ানক শীত পড়িয়াছিল, তাহা এখন পৰ্য্যন্ত আমি বিস্মৃত হই নাই। জীবনে কখনও যে তাহা সহজে ভুলিব, তাহাও বোধ করি না। মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত দিবাভাগে যখন আমরা বহির্গত হইয়াছিলাম, সেই সময় আমাদিগের পরিধানে যে সকল কাপড় ছিল, রাত্রিকালেও সেই পরিচ্ছদ আমাদিগের পরিধানে ছিল। উহা পরিবর্ত্তন করিবার বা কোনরূপ গরম কাপড় সঙ্গে লইবার সাবকাশ আমরা প্রাপ্ত হই নাই বলিয়াই সেই রাত্রিতে শীতে আমাদিগকে অতিশয় কষ্ট ভোগ করিতে হয়। কেবলমাত্র আমরাই যে অতিশয় শীত ভোগ করিয়াছিলাম, তাহা নহে। আমাদিগের সমভিব্যাহারী প্রধান সাহেব-কর্মচারীদ্বয়ের অবস্থা আরও অতিশয় শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছিল। তাঁহাদিগকে যে অবস্থায় সেই রাত্রি অতিবাহিত করিতে হইয়াছিল,তাহা তাঁহারা কেন আমরাও সহজে বিস্মৃত হইব না। তাহাদিগের পরিধানে কেবল একটি একটি পেণ্টুলেন, ও একটি একটি ছোট কোট ছিল মাত্র। প্রবল কম্পজ্বরের কম্পের সময় রোগী যেরূপ কাঁপিতে থাকেন, সাহেবগণের অবস্থাও ঠিক সেইরূপ হইল। সেই প্রবল কম্প তাঁহার কিছুক্ষণ সহ্য করিয়া আর কোনরূপেই তাহা সহ্য করিয়া উঠিতে পারিলেন না। তখন তাঁহারা ষ্টেসনের প্লাটফর্ম্মের উপর গমন করিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িতে লাগিলেন। সেই সুদীর্ঘ প্লাটফর্মের উপর কিয়ৎক্ষণ পর্য্যন্ত এদিক ওদিক করিয়া দৌড়াইতে দৌড়াইতে তাঁহাদিগের সেই কম্প দূরীভূত হইল। তখন তাঁহার পুনরায় একস্থানে আসিয়া উপবেশন করিলেন। কিয়ৎক্ষণ বসিবার পরই পুনরায় কম্প আরম্ভ হইল, পুনরায় উঠিলেন, পুনরায় দৌড়িতে আরম্ভ করিলেন, পুনরায় আসিয়া বসিলেন। এইরূপে সেই প্লাটফর্ম্মের উপর দৌড়াদৌড়ি করিয়া তাঁহারা কোন গতিকে সেইরাত্রি সেই স্থানেই অতিবাহিত করিলেন। 

যে প্রধান ইংরাজ কর্মচারী আমার সহিত ছিলেন, তিনি অতিশয় সুচতুর লোক এ কথা আমি পূৰ্ব্বেই পাঠকগণকে বলিয়াছি। ভোর হইবামাত্র তিনি আমাকে একখানি গাড়ি আনাইতে কহিলেন। ষ্টেসনের নিকট গাড়ির প্রায়ই অভাব থাকে না। সেই স্থান হইতে আমি একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ি আনাইয়া লইলাম। গাড়ি আসিলে তিনি সেই গাড়িতে আরোহণ করিলেন, আমাকেও তাঁহার সহিত সেই গাড়িতে উঠিতে কহিলেন। আমিও তাহাতে উঠিলাম। গাড়িতে উঠিয়াই তিনি চালককে কহিলেন “বড় সাহেবের কুঠিতে চল।” 

সাহেবের কথা শুনিয়া চালক কহিল, “কোন বড় সাহেব? লাউ সাহেব?” 

উত্তরে সাহেব কহিলেন- হাঁ। 

শকটচালক আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া চলিতে লাগিল। কিছুদূর গমন করিবার পর ভাগীরথীর সন্নিকটে একটি বাড়ীর সম্মুখে আমাদিগের গাড়ি লইয়া উপস্থিত হইল ও কহিল “এই লাউ সাহেবের বাড়ী।” 

সাহেব গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ নামিলাম। বাড়ীর সম্মুখে একজন বন্দুক হস্তে বসিয়া বসিয়া পাহারা দিতেছিল। তাহার নিকট সাহেব গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “সাহেব বাড়ীতে আছেন?” উত্তরে সে কহিল “আছেন, আমি এখনই গিয়া তাঁহাকে সংবাদ প্রদান করিতেছি।” এই বলিয়া সেই প্রহরী বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমরা সেই স্থান হইতেই দেখিতে পাইলাম, গৃহকার্য্যে একটি মেমসাহেব নিযুক্ত আছেন। সে তাঁহার নিকট গিয়া কি কহিল। তিনি একবার আমাদিগের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া আস্তে আস্তে উপরে উঠিলেন। পরিশেষে আমরা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, ওই মেমসাহেবই লাউ-পত্নী। 

মেম সাহেব উপরে উঠিবার অতি অল্পক্ষণ পরেই একটি সাহেব উপর হইতে নামিলেন, ও আমাদিগের নিকট সেই দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও সাহেবকে যাহা কহিলেন, তাহার এক বর্ণও সাহেব বা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমাদিগের এই অবস্থা দেখিয়া তিনি আমাকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন ও নীচের একটি কামরায় আমাদিগকে বসিতে দিয়া, সেই প্রহরীকে ডাকিলেন ও তাহাকে কি কহিলেন। সে তাঁহার কথা শুনিয়া আস্তে আস্তে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই প্রহরী একজন বাঙ্গালীকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইনি ফরাসী ভাষা জানিতেন। ইনি আসিয়া আমার সাহেবকে ইংরাজী ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনারা কে, কোথা হইতে আসিয়াছেন, এবং প্রয়োজনই বা কি?” 

তাঁহার কথার উত্তরে আমাদিগের সাহেব যাহা বলিলেন, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ:–”আমরা কলিকাতা পুলিসের কর্ম্মচারী। কলিকাতার মহামেলায় একটি ভয়ানক চুরি হইয়া গিয়াছে। একজন চিনা ওই চুরি করিয়া অপহৃত দ্রব্যাদির সহিত এই স্থানে পলাইয়া আসিয়াছে। যাহারা তাহাকে এই স্থানে দেখিয়া গিয়াছে, তাহাদিগকে আমরা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিতে আপনাদিগের বিশেষ সাহায্যের প্রয়োজন; সুতরাং, ইংরাজ-শাসনকর্তার নিকট এই সংবাদ প্রেরণ করা হইয়াছে। তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিয়া পত্র লিখিবেন। কিন্তু যে সময় পত্র আসিয়া আপনার নিকট উপস্থিত হইবে, সেই সময় পর্যন্ত ওই ব্যক্তি এখানে থাকিবে কি না, তাহা বলিতে পারি না। যদি এই স্থান হইতে পলায়ন করে, তাহা হইলে তাহাকে সহজে যে আর পাওয়া যাইবে, তাহা বোধ হয় না। এই নিমিত্ত আমরা আপনার নিকট আসিয়াছি; আপনি যদি অনুগ্রহ করিয়া আপনার পুলিসকে এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিতে আদেশ প্রদান করেন, তাহা হইলে সেই ব্যক্তির পলায়ন করিবার আর কোনরূপ সম্ভাবনা থাকে না। এ বিষয়ে আমাদিগের অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন নাই, বা সেই আদেশ আমরা প্রার্থনাও করি না। আমাদিগের নিবেদন এই যে, আপনার পুলিস ইহার অনুসন্ধান বা তাহাকে ধৃত ও অপহৃত দ্রব্যাদির পুনরুদ্ধার করুন। তবে আমাদিগকে যেরূপ ভাবে সাহায্য করিতে কহিবেন, আমরা সেইরূপ ভাবেই সাহায্য করিব। এইরূপ অনুসন্ধান করিয়া যদি আসামীকে পাওয়া যায়, তাহা হইলে আপনারা তাহাকে এই স্থানেই রাখিয়া দিবেন, ও পরিশেষে আমাদিগের শাসনকর্তার পত্র পাইলে আপনাদিগের যেরূপ ভাল বিবেচনা হয় তাহাই করিবেন। এই সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত আমরা আপনার বহুমুল্য সময় কোনরূপেই নষ্ট করিতে আসিতাম না; কিন্তু অপহৃত দ্রব্যের সহিত ওই আসামীর এই স্থান হইতে পলায়ন করিবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা আছে বলিয়াই আপনাকে বিরক্ত করিতে আসিয়াছি।” 

শাসনকর্তা সাহেবকে নিতান্ত ভদ্রলোক বলিয়া অনুমান হইল। আমাদিগের সাহেব যাহা যাহা কহিলেন, তাহার সমস্ত কথা সেই দ্বিভাষী বাঙ্গালী বাবু তাঁহাকে ফরাসী ভাষায় উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলেন। তিনি ওই সমস্ত কথাগুলি স্থির ভাবে শ্রবণ করিয়া তাঁহার নিজের ভাষায় সেই বাবুকে অনেকগুলি কথা কহিলেন। ওই বাবু পরিশেষে উহা ইংরাজীতে আমাদিগকে বুঝাইয়া দিলেন। তিনি যাহা বলিয়ছিলেন, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ:- 

তিনি আমার সাহেবের কথার উত্তরে কহিলেন “আপনারা যখন আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, তখন আমার কর্তব্য আপনাদিগকে সাহায্য করা; কিন্তু, সেই সাহায্য করিতে হইলে ইংরাজ- গবর্ণমেন্টও ফরাসী-গবর্ণমেন্টের মধ্যে যে সন্ধি স্থাপিত আছে, তাহার অন্যথাচরণ করা হয়; কিন্তু যখন আপনি বলিতেছেন, যে আপনাদিগের শাসনকর্তা এ বিষয়ে আমাকে পত্র লিখিয়াছেন ও সেই পত্র শীঘ্রই পাইবার সম্ভাবনা আছে, তখন আমি আপনার কথায় বিশ্বাস করিয়া যাহাতে আপনাদিগের কার্য্যের কোনরূপ ক্ষতি না হয়, তাহা করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু আপনারা এখানে কোনরূপ অনুসন্ধানে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবেন না। আমার পুলিসের প্রধান কর্ম্মচারী অর্থাৎ শহর- কোতয়ালের হস্তে আমি অনুসন্ধানের আদেশ প্রদান করিতেছি। যাহা করিতে হয়, তাহা তিনি নিজেই করিবেন। আপনারা তাঁহারই সহিত উপস্থিত থাকিয়া কেবল তাঁহাকে সাহায্য করিবেন মাত্র। আসামী, কি অপহৃত দ্রব্য যদি পাওয়া যায়, তাহা হইলে তাহাকে আপনারা এখন লইয়া যাইতে পারিবেন না। যে পৰ্য্যন্ত আপনাদিগের শাসনকর্তার পত্র এখানে না আসিবে, সেই পৰ্য্যন্ত আসামী বা মাল আমাদিগের নিকটেই থাকিবে; পত্র পাইলে উহা আপনাদিগের প্রাপ্য হইবে। তখন আপনারা অনায়াসেই উহা লইয়া যাইবেন।” 

এই বলিয়া তিনি তাঁহার নিকট যে বাঙ্গালী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাকে কি কহিলেন। তিনি আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। বাড়ীর বাহিরে আসিয়া তিনি আমাদিগকে কহিলেন “চলুন, আমি আপনাদিগকে সঙ্গে লইয়া সহর কোতয়াল সাহেবের নিকট যাইতেছি, ও তাঁহাকে শাসনকর্তার আদেশ বলিয়া দিয়া এই মোকদ্দমার যাহাতে ভালরূপ অনুসন্ধান হয়, তাহা করিতে বলিয়া দিতেছি।” এই বলিয়া তিনি আমাদিগের গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিলেন ও কোচম্যানকে কহিলেন “ কোতয়াল সাহেবের বাড়ীতে চল।” কোচম্যান সেই স্থানেরই; সুতরাং, সে কোতয়াল সাহেবের বাড়ী চিনিত। কার্যেই সে আর কোন কথা না বলিয়া তাহার গাড়ি চালাইতে লাগিল। কিছুদূর গমন করিয়া একটি সঙ্কীর্ণ গলির ভিতর আসিয়া তাহার গাড়ি থামাইল। সেই বাবুটি গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন। আমরাও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ নামিলাম। সেই অপ্রশস্ত গলির মধ্য দিয়া সামান্য দূর গমন করিবার পরই তিনি একখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র একতালা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, বলা বাহুল্য, আমরাও তাঁহার পশ্চাৎ ছাড়িলাম না। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, একটি কৃষ্ণবর্ণ মেমসাহেব ওই বাড়ীর মধ্যে একস্থানে উপবেশন করিয়া কতকগুলি অপরিষ্কার কাপড় সাবান দিয়া পরিষ্কার করিতেছেন। আমাদিগকে দেখিয়াই তিনি সেই সমস্ত কাপড় পরিত্যাগ পূর্ব্বক আমাদিগের সমভিব্যাহারী সেই বাবুর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও হিন্দুস্থানীতে কহিলেন “বাবু! এইরূপ অসময়ে আসিবার কারণ?” উত্তরে বাবু কহিলেন “তোমার স্বামীর নিকট বিশেষ প্রয়োজন আছে বলিয়া শাসনকৰ্ত্তা সাহেব আমাকে তাঁহার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। তিনি কোথায়, তাঁহাকে ডাকিয়া দেও।” মেমসাহেব করিলেন “তিনি অনেকক্ষণ হইল বাজারে গিয়াছেন, এখনই আসিয়া এখানে উপস্থিত হইবেন। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন।” এই বলিয়া একখানি চেয়ার ও দুই তিনখানি টুল তিনি বাহির করিয়া দিলেন। আমরা তাহাতে উপবেশন করিলাম। মেমসাহেব সেই সাবকাশে তাঁহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাঁহার পরিহিত অপরিষ্কার কাপড় পরিত্যাগ করিয়া একটি পরিষ্কার গাউন পরিধান পূর্ব্বক পুনরায় আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

মেম সাহেব আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইতে না হইতেই কোতয়াল সাহেব কতকগুলি তরি তরকারী হস্তে লইয়া আগমন করিলেন ও সেই সমস্ত দ্রব্য একস্থানে রাখিয়া দিয়া আমাদিগের নিকট আসিলেন ও হিন্দীতে কহিলেন, “কি বাবু! এ সময় কী মনে করিয়া?” 

কোতয়াল সাহেব একজন কৃষ্ণকায় ফিরিঙ্গী। বয়স অনুমান ৫০ বৎসরের কম নহে। দেখিতে কৃশ ও লম্বা। তাঁহার কথা শুনিয়া বাবু শাসনকর্তার আদেশ তাঁহাকে জ্ঞাপন করিলেন। আদেশ পাইয়া তিনি আমার সাহেবকে ওই মোকদ্দমার সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। 

সাহেব তাঁহাকে সমস্ত কথা প্রথম হইতে কহিলেন। তখন তিনি কহিলেন “যে স্ত্রীলোকগণ তাহাকে চিনিবে, তাহারা কোথায়?” তাঁহার কথা শুনিয়া আমাদিগের সাহেব বেলা, লুসি প্রভৃতি যে স্ত্রীলোকগণকে আমরা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহাদিগকে সেই স্থানে আনিবার নিমিত্ত আমাকে আদেশ প্রদান করিলেন। আমি সেই গাড়িতে উঠিয়া তাহাদিগকে আনিবার নিমিত্ত গমন করিলাম। স্ত্রীলোকগণ যে যে স্থানে ছিল, আমিও সেই সেই স্থানে গমন করিয়া তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় কোতয়াল সাহেবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। বলা বাহুল্য, আমাদিগের যে সকল কৰ্ম্মচারী ইহা জানিতে পারিলেন, তাঁহারাও আমাদিগের সহিত সেই স্থানে আসিলেন। 

আমরা সকলে সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলে, ওই স্ত্রীলোকগণকে কোতয়াল সাহেব অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার কথার উত্তরে তাহারা যাহা কহিল, তাহাতে অনুমান হইল, যে স্ত্রীলোকের বাড়ীতে উইনসুকে তাহারা ছাড়িয়া গিয়াছিল, তাহা তিনি বুঝিতে পারিয়াছেন। 

সেই স্থানে আর কালবিলম্ব না করিয়া এখন অনুসন্ধানে গমন করাই স্থির, ইহা সাব্যস্ত করিয়া আমাদিগের সকলকে কোতয়াল সাহেব গাড়িতে উঠিতে কহিলেন। আমরা সকলেই সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া আমাদিগের সমভিব্যাহারে যে সকল গাড়ি ছিল, তাহাতে আরোহণ করিলাম। যে দুইটি স্ত্রীলোক আমাদিগকে সাহায্য করিয়া আসিতেছিল বা যাহারা ওই স্থান দেখাইয়া দিতে পারিবে বলিয়াছিল, তাহাদিগকে এক গাড়িতে উঠাইয়া দিলাম। উহার মধ্যে আরও দুইজনের স্থান রহিল, অর্থাৎ আমাদিগের সাহেব ও কোতয়াল সাহেব ওই গাড়িতে আরোহণ করিবেন, ইহাই আমরা স্থির করিয়াছিলাম। আমরা সকলে গাড়িতে উপবেশন করিবার ২/৩ মিনিট পরেই আমাদিগের সাহেব ও কোতয়াল সাহেব সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। তাঁহাদিগের নিমিত্ত আমরা যে গাড়ি রাখিয়া দিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাদিগকে দেখাইয়া দিলে আমাদিগের সাহেব প্রথমেই উহাতে আরোহণ করিলেন। সেই সময় সেই বাবু কোথা হইতে আসিয়া সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলেন। গাড়ি পূর্ণ হইয়া গেল; সুতরাং কোতয়াল সাহেবের আর স্থান হইল না দেখিয়া তিনি একবার এদিক ওদিক দেখিয়া আস্তে আস্তে সেই গাড়ির কোচবাক্সের উপর উঠিয়া উপবেশন করিলেন। এই অবস্থা দেখিয়া আমরা কয়েকজন একখানি গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া তাঁহাকে সেই গাড়িতে উঠিতে কহিলাম; কিন্তু, তিনি কোন গতিকেই সেই কোচবাক্স হইতে অবতরণ করিলেন না। সুতরাং আমরাও অনন্যোপায় হইয়া আপন গাড়িতে পুনরায় আরোহণ করিয়া চলিতে লাগিলাম। কোতয়াল সাহেব যে গাড়িতে ছিলেন, সেই গাড়ি অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিল। কিয়দ্দূর গমন করিবার পর ওই গাড়ি গিয়া একস্থানে উপনীত হইল। বুঝিলাম, উহা তাঁহাদিগের একটি থানা বা ফাঁড়ি। উহার দরজায় এক ব্যক্তি বসিয়াছিল। কোতয়াল সাহেব তাহাকে কহিলেন “ব্রিগেদিয়ারকে ডাকিয়া দেও।” এই কথা শুনিয়া সে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। দেখিতে দেখিতে একটি বাঙ্গালী যুবক সেই গাড়ির নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কোতয়াল সাহেব তাঁহাকে তাঁহার সহিত আসিতে কহিলেন। তিনি দ্রুতগতি পুনরায় তাঁহার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া একটি কোচ ও একটি টুপি হস্তে লইয়া আমাদিগের গাড়ির নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমরা তাঁহাকে আমাদিগের গাড়ির ভিতরই একরূপ বসাইয়া লইলাম। বুঝিতে পারিলাম, ইনি সেই থানা বা ফাঁড়ির প্রধান পুলিস কর্ম্মচারী। 

কোতয়াল সাহেবের আদেশ মত ওই গাড়ি পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিল। অনেক গলি প্রভৃতির মধ্য দিয়া পরিশেষে ওই সকল গাড়ি এক স্থানে গিয়া উপনীত হইল। সেইস্থানে কোতয়াল সাহেব অবতরণ করিলেন। আমরাও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ নামিলাম। স্ত্রীলোকগণকে গাড়ি হইতে নামাইয়া তিনি কহিলেন “দেখ দেখি যেস্থানে তোমরা সেই চিনা সাহেবকে ছাড়িয়া গিয়াছিলে, তাহা এই স্থান কি না?” স্ত্রীলোকগণ অনেকক্ষণ পর্যন্ত এদিক ওদিক করিয়া দেখিল, ও পরিশেষে একটি গলির ভিতর প্রবেশ করিয়া সম্মুখের একটি বাড়ী দেখাইয়া দিয়া কহিল “বোধ হইতেছে ওই বাড়ীতে আমরা তাহাকে রাখিয়া গিয়াছিলাম।” 

তাহাদিগের কথা শুনিয়া কোতয়াল সাহেব কহিলেন “হইতে পারে, ওই বাড়ীতে কয়েকজন ফিরিঙ্গী স্ত্রীলোক বাস করে, তাহাদিগের চরিত্রও ভাল নহে।” এই বলিয়া তিনি ওই বাড়ীর ভিতর গমন করিলেন। আমাদিগের সাহেবও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। আমরা কিন্তু সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম না। ওই বাড়ীর চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িলাম। আমাদিগকে সেই স্থান দেখিয়া পাড়ার অনেকেই সেই স্থানে আসিয়া সমবেত হইতে লাগিল। কেহবা আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিল, আমরা কে, ও কেনইবা এখানে আসিয়াছি। কেহবা জিজ্ঞাসা করিল, আমরা কাহার অনুসন্ধান করিতেছি। এইরূপে অনেকে অনেক কথা আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। আমরা কাহারও কথার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে লাগিলাম, কাহারও কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিলাম না। সেই সময় কয়েকজন স্ত্রীলোক একস্থানে দণ্ডায়মান ছিল। তাহাদিগের মধ্যে একটি স্ত্রীলোক আমাদিগকে দেখিয়া কহিল, “আপনারা যাহার অনুসন্ধান করিতেছেন, সে এখানে নাই, এখান হইতে চলিয়া গিয়াছে।” 

তাহার কথা শুনিয়া আমি কহিলাম “আমরা কাহার অনুসন্ধান করিতেছি, তাহা তুমি কি প্রকারে জানিলে?” উত্তরে সে কহিল “তাহা কি আর কাহারও জানিতে বাকী আছে। কাল যখন আমরা তাহাকে দেখিয়াছিলাম, তখনই আমাদিগের সন্দেহ হইয়াছিল। আপনারা একজন সাহেবের অনুসন্ধান করিতেছেন।” 

আমি। সে এখানে নাই? 

স্ত্রীলোক। এখান থেকে কাল রাত্রিতেই চলিয়া গিয়াছে। 

আমি। সে কোথায় গিয়াছে তাহা বলিতে পার? 

স্ত্রীলোক। না, তাহা আমি জানি না। ওই স্ত্রীলোকের সহিত যখন আমাদিগের কথা হইতেছিল, তখন সেই স্থানে একটি বালক দাঁড়াইয়াছিল। সে কহিল, সেই সাহেবকে চৌরাস্তার চণ্ডুর আড্ডার বারাণ্ডায় এখনই আমি দেখিয়া আসিতেছি। ওই বালকের এই কথা শুনিয়া আমি ওই বাড়ীর মধ্যে সাহেবদিগের নিকট গমন করিলাম। তাঁহাদিগের নিকট হইতে অবগত হইতে পারিলাম, যে ওই বাড়ীর স্ত্রীলোকগণের মধ্যে কেহই স্বীকার করে নাই, যে সেই সাহেব তাহাদিগের বাড়ীতে আসিয়াছিল। এই কথা শুনিয়া আমি আর কাল বিলম্ব করিলাম না। সেই স্ত্রীলোক ও বালকের নিকট হইতে যাহা যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাদিগকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া তাঁহারাও আমার সহিত বাহির হইয়া আসিলেন। কোতয়াল সাহেব ওই স্ত্রীলোককে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়াই একখানি গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিলেন। আমাদিগের সাহেব কতকগুলি কর্ম্মচারীকে সেই স্থানে থাকিতে আদেশ প্রদান করিয়া তাঁহার সহিত গমন করিলেন। কোন কোন কর্ম্মচারী সেই স্থানে বসিলেন; আমরা কয়েকজন তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অপর একখানি গাড়িতে আরোহণ করিয়া গমন করিতে লাগিলাম। কিছুদূর গমন করিবার পরই সাহেবের গাড়ি একটি চৌরাস্তার মোড়ের উপর স্থাপিত একটি দোতালা বারাণ্ডাওয়ালা বাড়ীর দরজায় গিয়া দাঁড়াইল। সাহেবদ্বয় গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া উহার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। আমরা উপরে না উঠিয়া ওই বাড়ীর চতুর্দিকে দাঁড়াইয়া রহিলাম। বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগে যেস্থানে আমি দাঁড়াইয়া ছিলাম, তাহার নিকটে একটি জঙ্গল ছিল। বোধ হইল, উপর হইতে কি যেন ওই জঙ্গলের মধ্যে পতিত হইল। ইহা দেখিয়া আমি সেই জঙ্গলের মধ্যে গমন করিলাম। দেখিলাম উহার মধ্যে একটি কোরিয়ার ব্যাগ পড়িয়া রহিয়াছে; উহা বন্ধ। আমি কোরিয়ার ব্যাগটি উঠাইয়া লইয়া আস্তে আস্তে সেই বাড়ীর উপর উঠিলাম। দেখিলাম, সাহেবগণ আসামীকে পাইয়াছেন; কিন্তু অপহৃত দ্রব্যের কিছুই প্রাপ্ত হন নাই। সেই ঘরের মধ্য হইতে কেবলমাত্র অর্দ্ধমণ আফিঙ বাহির হইয়াছিল। 

আমি উপরে গিয়া ওই কোরিয়ার ব্যাগ আমাদিগের সাহেবের হস্তে প্রদান করিলাম ও যেরূপে উহা পাওয়া গিয়াছে, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম। তিনি উহা খুলিয়া ফেলিলেন। দেখিলাম, যে সকল বহুমূল্য অলঙ্কার মহামেলা হইতে অপহৃত হইয়াছিল, তাহার প্রায় সমস্তই উহার ভিতর রহিয়াছে। এই স্থানেই আমাদিগের অনুসন্ধানের কার্য্য শেষ হইয়া গেল। কোতয়াল মাল, আসামী, আফিঙ ও যাহার চণ্ডর দোকান তাহাকে, ও যে সকল স্ত্রীলোকের বাড়ীতে সে পূর্ব্বে গমন করিয়াছিল, তাহাদিগকে লইয়া প্রস্থান করিলেন। আমাদিগকে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিতে হইল। এই ঘটনার প্রায় ১৫ দিবস পরে শাসনকর্তার আদেশ অনুসারে আমরা মাল ও আসামীকে কলিকাতায় আনিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। উইনসুকে আনিতে গিয়া যখন আমরা তাহাকে প্রথমে দেখিতে পাই, তখন তাহাকে হঠাৎ চিনিয়া উঠিতে পারি না। ধৃত হইবার সময় তাহার যেরূপ চেহারা ছিল, এখন তাহার কিছুই নাই। তাহার শরীর ক্ষীণ হইয়া গিয়াছে, বৰ্ণ মলিন হইয়া পড়িয়াছে, তুরুঙে আবদ্ধ হইয়া মৃতের ন্যায় পড়িয়া রহিয়াছে। সে আমাদিগকে দেখিয়া নিতান্ত কাতরোক্তিতে ক্রন্দন করিতে থাকে ও আমাদিগকে কহে, “প্রথমে আমাকে কিছু আহার দেও, অনাহারে প্রাণ যাইতেছে। এইরূপ অবস্থায় আমাকে যদি আর ২/৪ দিবস থাকিতে হইত, তাহা হইলে আমার জীবন এই স্থানেই শেষ হইত।” 

উইনসুর কথা শুনিয়া আমাদিগের হৃদয়ে প্রকৃতই দয়ার উদ্রেক হইয়াছিল। সেইদিবসই আমরা তাহাকে সেই তুরুঙ হইতে বাহির করি ও ষ্টেসনে আনিয়া তাহাকে উত্তমরূপে আহার করাইয়া, পরিশেষে তাহাকে কলিকাতায় লইয়া আসি। 

কলিকাতার বিচারালয়ে এই মোকদ্দমার বিচার হয়। ফরিয়াদী অপহৃত দ্রব্য সনাক্ত করিতে প্রথমতঃ যে সকল গোলযোগের কথা উত্থাপিত করিয়াছিলেন, বিচারালয়ে তাহার কিছুই করিতে হয় না। উইনসু মুক্তকণ্ঠে আপনার সমস্ত দোষ স্বীকার করিয়া লয়; সুতরাং, বিচারকও তাহার উপর দয়া প্রকাশ করিয়া আর তাহাকে বিচারার্থ সেসন আদালতে প্রেরণ করেন না, নিজেই তাহার উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করেন। 

বেলা, লুসি প্রভৃতি স্ত্রীলোকগণ মেমসাহেব বলিয়া পরিচিত; সুতরাং, তাহারা আমাদিগকে যৎপরোনাস্তি কষ্ট প্রদান করিলেও পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী তাহাদিগকে আসামী শ্রেণীভুক্ত হইতে অব্যাহতি দিয়া সাক্ষী-শ্ৰেণীভুক্ত করিয়া দেন। বলা বাহুল্য, এই মোকদ্দমায় তাহাদিগের সকলকে সাক্ষ্য পর্য্যন্তও প্রদান করিতে হয় নাই। 

(সম্পূর্ণ)

[ মাঘ, ১৩০৭ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *