মেয়েমানুষ অথবা কলাগাছ
১৮ই জুলাই। রাত ১১টা। ৫ নম্বর ট্যাংক।
বিদিশা ও চিনু।
জলে জাহাজ প্যাটার্ন বাড়ির ছায়া। আধখানা হওয়া চাঁদের ছায়া। জল ছুঁয়ে আসা হালকা হাওয়ায় মাধবী ফুল আর ডিজেলের গন্ধ। ঘাটের কাছটাতে নড়ছে মাখনের শূন্য প্যাকেট। লোড শেডিং। জাহাজবাড়ি থেকে ভেসে আসা স্টিরিয়োর পপ-এ মিশে আছে জেনারেটারের ঘট ঘট।
চিনু—একটু সাঁতার দিমু বউদি?
বিদিশা—না।
চিনু—অল্প একটু?
বিদিশা—আচ্ছা। ঠিক এক মিনিট।
চিনু—আমাদের হৃদয়পুরের মামার বাড়ির পিছনে একটা পুকুর আছিল।
কত শাপলা, লাল শাপলা, আর চোককুনি মাছ। ঘাটের কাছে চোককুনি মাছেরা ঘুরঘুর করত, কী সুড়সুড়ি লাগত।
বিদিশা—পুকুরের পাড়েটাড়ে কেউ দাড়িয়ে আছে নাকি রে?
চিনু—না, কেউ নাই।
বিদিশা—তবে আমার পিঠে সাবানটা একটু ঘষে দিবি?
তখন মাখন প্যাকেটের পাশে ভাসে মহীশুর স্যান্ডাল সোপের খালি প্যাকেট। চিনু ক্ষীর রং সাবানটা মুঠোয় নিয়ে গন্ধ নেয়। বিদিশা ব্লাউজ খোলে। সাদা পিঠে ভাঙা চাঁদের আবছা আলো। পিঠময় ঘুরে যায় ওই সাবান। চিনুর সাবানটা চিনু আনেনি। ওর সাবান হল সোমা। রেশনের। চিনু ইচ্ছে করেই আনেনি, আজ এই সাবানটাই মাখবে। ওর পিঠে মাখা হবে না, কে মাখিয়ে দেবে? বউদিকে কি বলা যায় পিঠে মাখিয়ে দাও…। বিদিশার পিঠে জলের ছিটে দেয় চিনু। ম্যাকসিমাম টেম্পারেচার থার্টি নাইন, রেইন ফল নিল। আবার জলের ছিটে, বৃষ্টির মতো।
বিদিশা—আঃ।
চিনু—ঠান্ডা লাগে বউদি?
বিদিশা—কী আরাম! বাড়ির ট্যাংকের জল কী গরম, না?
চিনু—আমি তো কতদিন কইছি চলেন বউদি, পুকুরে যাই।
বিদিশা—আমরা পারি না রে, লোকে কী ভাববে!
চিনু—আমি? আমারেও তো পুকুরে আসতে দেন না!
বিদিশা—তুই আমাদের বাড়িতেই তো আছিস…।
আলোগুলো জ্বলে উঠল। চার কোনায় চারটে টিউব আলো। আলো জ্বলে উঠতেই বিদিশা ঝপাং করে জলে নেমে যায়। আলোর দৌরাত্ম্যে চিনুর আর সাঁতার কাটা হল না। ওরা দু’জন কোনওরকমে ডুব দিল। বিদিশা টার্কিশ তোয়ালে এবং চিনু গামছা পেঁচিয়ে কালো রাস্তায় জলের ফোঁটার চিহ্ন ফেলে বাড়ি ফেরে। মাধবীলতা ছাওয়া গেট। শ্বেতপাথরে লেখা শিবশম্ভু ধাম।
শিবশম্ভু ধাম।
১৮ই জুলাই রাত ১২টা।
নীলাঞ্জন ও বিদিশা।
টেবিলে ঢাকা দেওয়া প্লেট, সন্দেশ আছে। নারায়ণকে তুলসী দেওয়া হয়েছিল সকালে, সেই প্রসাদ। বাড়িতে নারায়ণ আছে, বীরেশ্বরবাবু নিজেই পুজো করেন। বীরেশ্বর ভট্টাচার্য। নীলাঞ্জনের বাবা। টেবিলে সানন্দা। তন্দুরী চিকেনের ছবি। বিদিশা ছবিটা দেখছে। চন্দনের গন্ধ। বিদিশার গায়ের। গায়ের পাউডারের। একটা ট্যাক্সি থামল। নীলাঞ্জন এল।।
নীলাঞ্জন—আজ একটু রাত হয়ে গেল।
বিদিশা—রোজই তো হয়।
নীলাঞ্জন—হিতেশ তরফদার ফোন করেছিল?
বিদিশা— করেছিল।
নীলাঞ্জন—ভাল করে কথা বলেছিলে তো?
বিদিশা—ভাল করে মানে?
নীলাঞ্জন—মানে না বোঝার কথা না।
বিদিশা—লোকটা বদ।
নীলাঞ্জন—কিন্তু আমার বস।
বিদিশা—তাতে আমার কী!
নীলাঞ্জন—এই তুমি আমায় ভালবাস?
বিদিশা—তোমার মুখ থেকে ভীষণ মদের গন্ধ বেরুচ্ছে।
নীলাঞ্জন—লায়নস ক্লাবের লোকাল সেক্রেটারি হলাম এ বছর।
বিদিশা—কনগ্রাচুলেশন। তরফদার যেন তুমি না থাকলে ফোন না করে।
নীলাঞ্জন—লায়নসের সেক্রেটারির অনেক দায়িত্ব।
বিদিশা—হাত মুখ ধুয়ে নাও। প্রসাদ রেখে গেছেন বাবা, খাবে তো খেয়ে নাও।
নীলাঞ্জন—বাবাকে চ্যবনপ্রাশ দিয়েছিলে ঠিক মতো?
বিদিশা—হ্যাঁ।
নীলাঞ্জন—হললিকস?
বিদিশা—কী, ব্যাপারটা কী?
নীলাঞ্জন—না, এমনি, ইয়ে, চিনু কী বলছে? চলে যাবে-টাবে বলছে না তো আর?
বিদিশা—ওকে বোঝানো হয়েছে।
নীলাঞ্জন—প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে?
বিদিশা—জানি না।
নীলাঞ্জন—ও এখন রিসকি হয়ে গেছে। অথচ বাবার এমন প্রেজুডিস যে বামুন ছাড়া চলবে না।…এই, জানো, আমার কমপিটিটার কে ছিল জানো? সুশান্ত সান্যাল। ইন্ডিয়ান ফয়েলের। পাত্তাই পায়নি। তরফদার গেইভ মি হেভি সাপোর্ট। তরফদারকে আর একটু ফিট করতে পারলে প্রমোশনটা হয়ে যায়। ম্যানেজারিয়াল পোস্ট। গাড়ি পাব, তোমার ইচ্ছে করে না?
(মাই…ডট্-ডট্… অফিস থেকে ফিরে এসে ফ্রিজ খুলে কাস্টার্ড আর আনারস নিয়ো… এই কথাটা লিখবার সময় প্রথমবার একটু হাত কেঁপেছিল বিদিশার। এখন কী অবলীলায় ব্যবহার করে ফ্রিজ, পুডিং, ভি সি আর। ওকে বাইরে যেতে হয় টুকটাক। হাসমী স্মরণ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বস্তিবাসীদের সান্ধ্য স্কুল, মহিলা সমিতির মিটিং। কলেজে পড়ার সময় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মী ছিল বিদিশা। বিদিশা কি একদিন এরকমই অবলীলায় লিখবে ডার্লিং তিনটের সময় গাড়িটা একবার পাঠিয়ো। মার্কেটিং আছে।)
বিদিশা—নাঃ, আমার এসব লাকসারি ইচ্ছে করে না।
নীলাঞ্জন—বাজে কথা বোলো না। পেলে তো ছাড়বে না। তোমাদের নেত্রী অনিতাদিকে দেখলাম মিছিলের পর গাড়িতে বাড়ি ফিরছেন। তুমিও নিয়ো। সর্বহারা নেত্রী।
বিদিশা—তুমি আমাকে সর্বহারা নেত্রী বলে ব্যঙ্গ করার চেষ্টা করলেও আমি বেশ জানি তুমি এটাই চাও। একটু একটু এসব করলে তোমারও স্ট্যাটাস বাড়ে। তুমি বেশ চাও পার্টিটা ক্রমশ মধ্যবিত্ত হয়ে উঠুক, বাবু হয়ে উঠুক।
নীলাঞ্জন—খচে যেয়ো না তো, কাছে এসো।… একটা গাড়ি খুব দরকার, বুঝলে না, এটা লাকসারি নয়। রিকোয়ারমেন্ট। ভি সি আরটা কিনবার সময় বাগড়া দিয়েছিলে। এখন সখীদের নিয়ে চার্লি চ্যাপলিন দেখছ না? দিন বদলায়, বুঝেছ? গাড়িও হবে। এই কাছে এসো…
বিদিশা—তুমি তো জানোই, অ্যালকোহলের গন্ধ আমার অসহ্য।
নীলাঞ্জনা—আজ সেলিব্রেট করব। জলের জারটা এখানে থাক।
বিদিশা—খাবে না কিছু?
নীলাঞ্জন—শুধু কিস।
বিদিশা—ইমপসিবল।
নীলাঞ্জন—খোলো।
বিদিশা—মদের গন্ধ ভাল লাগে না আমার।
নীলাঞ্জন—খুলে ফ্যালো।
বিদিশা—তোমার প্রমোশনের জন্য হ্যাংলামো ভাল লাগে না আমার।
নীলাঞ্জন—না হলে ছিঁড়ে ফেলব।
বিদিশা—তোমাকে ভাল লাগে না আমার, ভাল লাগে না, ভাল লাগে না…
নীলাঞ্জন—এদিকে ফেরো।
বিদিশা—প্লিজ…
১৯শে জুলাই। সকাল প্রায় সাতটা। রাস্তার ধারের বারান্দা।
নীলাঞ্জন, বিদিশা এবং পাড়া প্রতিবেশীগণ।
মুখার্জি—গুড মর্নিং নীলাঞ্জনবাবু, কাগজ পড়েছেন? ধর্ষণের কেসটা নিয়েছে?
নীলাঞ্জন—ধর্ষণ?
মুখার্জী—হ্যাঁ। শুনলুম গতকাল রাত্রে একটা বিচ্ছিরি রেপ হয়ে গেছে এখানে… দেখি তো একটু কাগজটা.. অ্যাই, একটুখানি দিয়েছে। মধ্যরাতে গণধর্ষণ। রেপ বড্ড বেড়ে গেছে, বলুন। বাজারে ইলিশ উঠেছে খুব। ভাগে কিনলাম। বাজার যাবেন না? চলি।
ঘোষ—দেখেছেন নীলাঞ্জনবাবু, খবর কাগজে আমাদের পাড়ার নাম উঠেছে। কাল রাতে খালধারের ঝুপড়িগুলোতে না, ছ্যাঃ মন্টুর নাম শোনা যাচ্ছে, ওই যে, জমির দালাল। শুনলুম রনচাও ছিল। রনচাই না আপনার গ্রিল-ট্রিল রং করল? আপনাদের বারান্দায় সেদিনও বসে থাকতে দেখেছি?
বিদিশা—ঘোষবাবু এত উত্তেজিত কেন?
নীলাঞ্জন—কাগজ দ্যাখো, এইখানে।
বিদিশা—এই রে, তাই ভাবি বাসন্তী কেন এত দেরি করছে। চিনু এই চিনু—বাসনগুলো মেজে ফেল না, বাসন্তী বোধ হয় আসবে না।
রায়গিন্নি—এই বিদিশা, শোনো, তোমাদের কাজের লোক এসেছে? আমাদের রেবা এখনও আসেনি।
বিদিশা—দিদি, বোধ হয় ও এবেলা আসতে পারবে না। ওদের একটা বিপদ হয়ে গেছে।
রায়গিন্নি—সে রকম তো শুনছি। আচ্ছা, কার কার হয়েছে বলো তো, শুনলুম তো চার-পাঁচ জনের হয়েছে। আমাদের রেবার হয়নি? ও তো দেখতে বেশ ইয়ে। কাগজে নাম দেয়নি? তুমি শুনেছ কার কার হয়েছে?
বিদিশা—কাগজে কি সব নাম দেয়? কাগজ কি জানে কাল রাতে কোথায় কোথায় আর কত কী হয়েছে।
রায়গিন্নি—কী কেলেঙ্কারি বলো তো, যদি হয় ওকে আর রাখা যায়?
অলোক—নীলাঞ্জনদা, শুনেছ তো খালধারে ঝুপড়িতে কাল রাতে অ্যান্টি সোস্যালরা একটা গ্যাং রেপ করেছে। আজ সন্ধ্যাবেলা থানার সামনে একটা প্রোটেস্ট আছে। বিদিশাদি, আপনি থাকবেন। মহিলা সমিতির পক্ষ থেকেই ব্যাপারটা অরগানাইজ করা হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি পোস্টারিং করা যাচ্ছে না। অনিতাদিরা স্পটে আছেন। যদি পারেন একবার গেলে ভাল হয়।
বিদিশা—আচ্ছা, ও অফিসে যাক, তারপর যদি…
নীলাঞ্জন—ব্যাপারটা কী হয়েছিল, ইন এ নাটশেল…
আলোক—ব্যাপারটার মূলে আছে জমির দালালদের ইন্টারেস্ট। কেষ্ট আর মন্টু। কেষ্ট আর মন্টু আগে একটাই গ্রুপ ছিল। ওরা বেশ কিছুদিন ধরে ইট সাপ্লাই, মাটিফেলা, জমির দালালি এইসব করছিল। ওরা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে দেখলেই জোর-জবরদস্তি করত। ওদের মধ্যে রিসেন্টলি বখরা নিয়ে গণ্ডগোল বাধে। কেষ্টকে ক’দিন ধরে খুঁজছিল মন্টু। কেষ্ট নাকি ঝুপড়িতে একটা মেয়ের ঘরে রাত্রে মাঝে মাঝে যেত। কাল রাত্রে মন্টু ড্রিঙ্ক ফ্রিঙ্ক করে, রনচা, গিল্টি, ক’জন সাকরেদ নিয়ে ওই ঘরে যায়। কেষ্টকে তো পায় না, না পেয়ে মন্টু নাকি ওই মেয়েটাকেই…আর অন্য সাকরেদগুলো আশেপাশের ঘরে হানা দিয়ে যাকে পেয়েছে তাকেই… কেউ অ্যারেস্ট হয়নি এখনও…।
রায়গিন্নি—মেয়েগুলোর নাম জানো ভাই?
অলোক— সে তো তিন-চার জন… নামটাম কী যেন সব, ওদের যেমন নাম হয় আর কী…
বিদিশা—বাসন্তী নামের কেউ?
অলোক—হ্যাঁ, হ্যাঁ বাসন্তী। ওর ঘরেই তো মন্টু প্রথমে গিয়ে..
রায়গিন্নি—রেবা? রেবা নামের কেউ?
অলোক—রেবা? হতে পারে কী রেবু না রেবা কী যেন বলছিল ওরা…।
রান্নাঘর। ২১ শে জুলাই। সন্ধ্যাকাল।
চিনু, বাসন্তী, পুলিশ সাব ইনস্পেকটর, নীলাঞ্জন, বিদিশা, রিপোর্টার, মহিলা সমিতির লোকজন ও মি. তরফদার।
সামনের নর্দমায় ভেজা চা পাতা, কাপ। কাপে উচ্ছিষ্ট চায়ের তলানি, ভাসছে পোড়া সিগারেট। অনেক জুতো বারান্দায়, মিটিং। মিটিং-এ অনেক কথা। কথার মধ্যে হাসির শব্দ। রান্নাঘরে গালে হাত দেয়া চিনু ও বাসন্তী। গ্যাস উনুনে প্রেসার কুকার। বিদিশা ওঘর থেকে ডাকল। চিনুকে ডাকল। চিনুর কান্না পেল। কতবার বলতে হয়েছে এসব। চিনু বাসন্তীর দিকে তাকায়। বাসন্তীর ঠোঁটে চাপা দাঁত।
বিদিশা—চিনু এসেছিস? থানা থেকে এসেছে, তোর সঙ্গে কথা বলবে।
পুলিশ সাব-ইনস্পেকটর—আপনাদের বাড়িটা বুঝলেন মি. ভট্চার্য, দারুণ জায়গায়। সামনেই ট্যাংক। ক’বিঘে হবে?
নীলাঞ্জন—তা বলতে পারব না।
পুলিশ—বিঘে আষ্টেক তো হবেই। জলের বাতাস পান। ওটা বুঝি বাঁকুড়া থেকে আনা ঘোড়া?
নীলাঞ্জন—ঠিকই ধরেছেন।
পুলিশ—পুলিশের চাকরি করতে হচ্ছে বটে, আমি খুব কালচার মাইন্ডেড।
বিদিশা—মেয়েটাকে ছেড়ে দিন।
পুলিশ—তোর নাম…ইয়ে, তোমার নাম চিনু?
চিনু—হ৷
পুলিশ—পুরো নাম?
চিনু—চিন্ময়ী চক্রবর্তী।
পুলিশ—রনচাকে ক’ বছর চেনো?
চিনু—এখানে আইত, রং করত।
পুলিশ—ক’ বছর ধরে চেনো।
চিনু—গত পূজার আগের পূজায়…
পুলিশ—ঘুরতে?
চিনু—দুই দিন।
পুলিশ—সিনেমা?
চিনু—দুইটা।
পুলিশ—বিয়ে করতে চেয়েছিল?
চিনুর মাথা নিচু, মাটি যেন ফাঁক হয়ে যায়।
পুলিশ—একটু থানায় যেতে হবে।
বিদিশা—থানায় কেন?
পুলিশ—আমরা একটু জিজ্ঞাসাবাদ করব। রনচাকে অ্যারেস্ট করেছি।
মাটি যেন ফাঁক হয়ে যায়, এক্ষুনি।
বিদিশা—তা জিজ্ঞাসাবাদ এখানে হয় না?
অনিতাদি—পুলিশকে কাজ করতে দাও..
নীলাঞ্জন—একটু পরেই আমাদের কয়েকজন বিশেষ গেস্ট আসবেন, বাড়িতে কাজটাজ আছে। কাল সকালেই থানায় যাব আমরা।
বিদিশা—কাল সকালেই যাবে। অনিতাদি, আমি বলছি, নিজে পৌঁছে দেব।
চিনু
ভাসাইলা। ভাসতে ভাসতে বেউলা সুন্দরী গেল কই? গেল সগ্গে। মাছে খাইল তার সিচরণ। আমারে ভাসাইলা মা, ভাসাইলা। কইলা—কইলকাতা চল। কইলকাতা গেলে কি কারবালা পার হওন লাগে? কইলকাতা কি কাফিরের দ্যাশ? জহর মিলে পানি মিলে না। কইলা কইলকাতা মামার বাড়ি যা তুই। সোমত্ত হইচস। মাইয়া-রক্তে বিধবা মায়ের বড় ভয়, বড় ডর। কেবলই কও, সোমত্ত হইচস মাইয়া, বড় হইচস। তখন চাইদ্দিকে একুইশারি ফেবরুয়ারি ভুলব না ভুলব না। চাইদ্দিকে আওয়াজ উঠে জয় বাংলা, তখন চাইদ্দিকে খান সেনা, চাইদ্দিকে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেবরুয়ারি…রক্তে বড় ভয়, বড় ভয়। পাকিস্তানে বড় ভয়। কইলকাতা চললা। কইলকাতা অর্থাৎ হৃদয়পুর। কইলকাতা বিশমাইল। হৃদয়পুরে মামার বাসা। মামার বাসায় হৃদয় নাই। বাসন মাজি, জল তুলি। আর তুমি কাঁথার মধ্যে সুঁচের ফোঁড়ে ফুল তুল, রান্নাঘরে কচুর শাক রান্ধ, লতিপাতুড়ি রান্ধ। চাঁদমার্কা হারিকেন চিমনি নাই, এখানে গণেশ মার্কা হারিকেন চিমনি, মুছি। জবর আলির সিনেমা নাই, সুখেন দাসের বই, ইঁচার নাম চিংড়ি, আকরির নাম কাঁকরোল, জলহাজা হইলে মুস্তাক আলির ইলেকট্রিক লোসন নাই, বোরোলীন।
মায়ের হঠাৎ ভীষণ অসুখ। ঘাড় শক্ত, হাত-পা শক্ত, ধুম জ্বর। মা মরল তিন দিনে। কাঁদলাম, চোক্ষের জল চোক্ষে শুকাইল। মামাবাড়ির রেশন আনি, বাজার যাই, মা-র কাজগুলি করি। মাইয়ার কাজগুলি করি। কলেজপড়া মামাতো ভাই আমারে একা একা চায়, মুদিদোকানের অনিল ঘোষ আমারে একা একা চায়। মাইজা মামাতো ভাইডারে একদিন অনিলের ভাই কয়—কও তো দেখি আমের ছাল? আমের ছাল। তোর পিসতুতো বোন আমাদের গেরামের মাল। মামা কয় চিনুরে, এই বাড়িতে আর থাকিস না। তোর দিকে চ্যাংড়াগো কুনজর। তোরে এক ব্রাহ্মণের বাড়ি দি। খাবিদাবি, থাকবি ভাল। বিয়ার সম্বন্ধ দেখি, কিছু হইলে খবর দিমু।
আইলাম ভটচাইজ বাড়ি। শিবশম্ভু ধাম। বড়ুদাদু ব্রাহ্মণের হাতে ছাড়া খায় না। আগের বামনী চইলা গেছে, বউদির নিজের রানতে লাগে, বউদির কষ্ট। আমারে পাইয়া য্যান চান্দ পাইল হাতে। ভাল ভাল দুইখান শাড়ি দিল, ফুলতোলা ব্লাউজ দিল, সাবান দিল, পাউডার দিল, কইল পুরী গিয়েছিস কোনও দিন? পুরী? ভালভাবে থাক, পুরী নিয়ে যাব একদিন। মামার আর দ্যাখা নাই, খোঁজও লয় না। কত মাইয়ার বিয়ার বাজন বাজে, আমি শুধুই ইচা কুটি, কুচা কুটি, ঘর মুছি, গ্রিল মুছি। রনচা আইল। গ্রিল রং-এর মিস্তরি।
গ্রিলের কাম শেষ হইলে দাদাবাবু কইল দরজা জানলা রং কর। আমারও খুশি লাগল মনে। রং লাগল। আরও ক’দিন তবে রনচা আছে। রং-এর পোচে দরজার কাঠ চকচকায়, জানলার কাঠ চকচকায়। আমি ওর রং করা দেখি। রং-এর দিন শেষ হইল। রনচা কইল, ক’টা দিন ভালই কাটল চিনু। আজ শেষ। রনচারে চায়ের লগে বিস্কুট দিলাম। রনচা কয়, তুমি বড় ভাল চিনু, মনের মতো। রনচা রোজদিন তাকাইতে তাকাইতে যায়, আমিও বারিন্দায় থাকি। চোখে চোখে কথা হয়। দাদা বউদি না থাকলে কই, বস, চা খাও। একদিন সিনেমায় গেলাম। সুচিত্রা সেন যখন উত্তমকুমারের বুকের উপর আছাড়ি পাছারি খায়, আমি রনচার হাত ধইরা কানে কানে কইলাম, আমারে বিয়া করবা তুমি? রনচা কয়, তুমি রাজি তো আমিও রাজি।
বউদি কইল, মাথা খারাপ? ও তোকে খাওয়াতে পারবে? কত আয় করে ও। ফ্যানের হাওয়া ছাড়া ঘুম হয় না তোর, টিভি দেখিস রোজ, বাড়ির মেয়ের মতো আছিস। আমরাই দেখে শুনে বিয়ে দেব।
রনচার বাড়ি গেলাম একদিন। ছিঁড়া মাদুরে অর বুড়া বাবা। ছোটভাই রিশকা চালায়, টালিরচালে নীল প্লাসটিক। কাঠের জালে লইট্যা মাছ রান্ধে রনচার মা। রনচা হাসতে হাসতে কয়, আমার ঘর। ডিশে কইরা লইট্যা মাছের টুকরা দিয়া কয়, খাও। আমি ঝালে হু-হা করি, রনচা হাসে।
রাস্তায় দেখা, কয়—কবে কালীঘাট যাবে? আমি কই—করুম না। রনচা কয়, পালটি খেয়ে গেলে? আমি কিছু কই না। রনচা কয়, ব্যাপারটা কী? আমি কইলাম, সারা জীবন কষ্ট কইরাও বিয়ার পরে কষ্টে থাকুম? রনচা মুখ হাঁড়ি কইরা চইলা গেল। কতদিন দেখা নাই। একদিন হঠাৎ আইল। কইল, চিনু, একটা বছর মাইরি কোথাও যেয়ো না। রোজগার বাড়াচ্ছি। টেপ কিনব, টিভি কিনব, সব কিনব। জমির লাইনে ঢুকেছি। মন্টুদার কাজ করছি৷ ই এস সি কারখানার সাইরেন বাজলে বারান্দায় দাঁড়িয়ো চিনু একবার করে দেখব।
পাঁচ কাপ চা কর চিনু, একটা চিনি ছাড়া। বাসন্তী আছে তো। এখানে, ওকে আসতে বল তো একবার…
বাসন্তী কপাল কুঁচকায়। এ নিয়ে যে কতবার হল! কতবার ওর লজ্জার কথা বলতে হয়েছে কত জনের কাছে। পুলিশের কাছে, ডাক্তারের কাছে, পার্টির লোকেদের কাছে, কত পার্টি, কত মাতব্বর, কত খবর কাগজের লোক, ‘উঃ’ শুনেছে, ‘আঃ’ শুনেছে, আর পারে না। ডাক্তারের কাছে ওর দেখাতে হয়েছে সব। কত জায়গায় কাপড় সরাতে হয়েছে, কান্না পেয়েছে কতবার। মিছিলে যেতে হয়েছে বাসন্তীকে, মিছিলের কথা উচ্চারণ করতে পারে না বাসন্তী তবু কাল গেছে বন্দেমাতরম। আজ গেছে ইনকিলাব। কালও নাকি যেতে হবে, দিদিমণি বলেছে। ধর্ষিতা নামে একটা শব্দ শুনছে দু’দিন ধরে, মাইকে মিছিলে কতরকম করে কতবার। কত লোক ওর দিকে কতরকম করে তাকিয়ে থাকে। কে বাসন্তী, কই বাসন্তী, দেখি দেখি… বাসন্তী মাথা নিচু করে থাকে। মিছিলের ভাষা ঠিক ঠিক বলতে পারে না ও। এখন আরও ভয় লাগে ঝুপড়িতে। ভালমানুষদের জন্য ভয়! খালধারের ঝুপড়ি ছেড়ে এবাড়ি এসে বলেছিল, দু’দিন থাকতে দেবেন? আর পারি না! বিদিশাদিদি থাকতে দিয়েছিল!
বিদিশা—এ আর একজন ভিকটিম। বাসন্তী।
রিপোর্টার— ও, এ বাসন্তী। বাঃ। একটু কথা বলব।
বিদিশা—খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন। ও খুব টায়ার্ড। এই সব বদারেশন অ্যাভয়েড করানোর জন্যই ওকে শেলটার দিয়েছি আমি।
বিজয়া— কাল পরশুও ওকে আটকে রেখে দাও। সনাতনবাবুদের র্যালিতে যেন না যেতে পারে।
অনিতা—বিজয়া, তুমি বড্ড বাজে কথা বলল।
রিপোর্টার—আপনার বয়স কত?
বাসন্তী— ক’তি পারব না।
রিপোর্টার—বিবাহিত?
বাসন্তী—হ্যাঁ।
রিপোর্টার—বাচ্চা?
বাসন্তী—একটাই কচি। খকা।
রিপোর্টার—আপনার স্বামী কী করছিল যখন ওরা আপনাকে…
বাসন্তী—মোর সোয়ামি ফেলি থুয়ি চলি গেছে ঔ খকা হবার আগে আগে।
রিপোর্টার—আপনি একা থাকতেন?
বাসন্তী—আমি আর আমার কচি।
রিপোর্টার—কেউ আপনার ঘরে যেত?
বিদিশা—এসব আমি পরে ব্রিফ করে দেব।
রিপোর্টার—মন্টু আপনার ঘরে ঢুকে কী বলেছিল?
বাসন্তী—বলল কিষ্টদা কোথায়? আমি ক’লাম আমি ক’তি পারবনি। সে হাত ধরি ঝাঁকি দিয়ি বলল—তবে তুই যাবি ক’নে।
রিপোর্টার—বাইরে নিয়ে গেল, না কি ভিতরেই…
বাসন্তী—খালধারে।
রিপোর্টার—একটা ছবি নিচ্ছি।
অনিতা—না। কেন? এদের ছবি দেখিয়ে আপনার কাগজ বিজনেস করবে?
রিপোর্টার—তবে যেখানে যেখানে ইনজুরি হয়েছে সেই ছবি তুলতে পারি তো?
অনিতা—ছবি তোলার কী হল? এমনি রিপোর্টিং করুন না।
রিপোর্টার—না, একটা ডকুমেন্ট প্রুফ।
অনিতা—বাসন্তী, এখানে এসো তো, আমার দিকে মুখ করে দাড়াও…
সরানো আঁচল মুখে চাপা দিয়ে বাসন্তী হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।
বাসন্তী
ভাসায়ি দিলে। আট মাসের গভবো তখুন। বাজার যাচ্ছি বলি সেই যে গেলে গো পুরুষ, আর আলে না। আমি ভাবি নোকটা গেল কনে। বাস নরী যা সাঁই সাঁই চলে, হোল কী মানুষডার। দু’দিন ঘুম নাই, খাওয়া নাই। ও হরি! শুনি তিনি বে করিচেন। কাঁচা মেয়া, রসের মেয়া বে করিছেন। আমারে ভাসালে।
খকা এল পিরথিমীতে। খকা। ফুলির মতো। পিরথিমী কঠিন ঠাঁই। কচি খকা। ফেলি থুয়ি যাব কনে? কিষ্টবাবুর দয়া হয়। কিষ্টবাবু খাতি দেয়। কোথা পাব উড়কি ধানের মুড়কি। কিষ্টবাবু পাউরুটি দেয়। কোথা পাব খকার তরে আম কাঁঠালের ছায়া, ইষ্টিকুটুম পাখি? খালধারের বাজে পোড়া গাছটার মরা ডালে শকুন। খাট নাই, পালং নাই,নীল পেলাস্টিকে কাঁদে আমার খকা। নোকের বাড়ি কাজে যাই, খকা আমার হাঁটি হাঁটি পা পা করে। কিষ্টবাবু লজেন দেয়, বিস্কুট দেয়। কিষ্টবাবু তো পুরুষ, পুরুষ ঘরে আসে। আমার ভাঙা ঘরে আসে। সেদিন ঘরে আসে মন্টু। সেই রাতে। বলে কিষ্ট কই? কিষ্ট?
নাই।
কেষ্ট নাই তুই রাধা। কিষ্টর নাং। চিত হ।
ডাক্তার বলে, দেখি তোর চিত হবার দাগ। মাতব্বর বলে, দেখি তোর চিত হবার চিহ্ন। খবরের কাগজের বাবুরা চিত হবার আকিবুকি আর শুকনা রক্তের দাগ কেবলই ছবি করে রাখে।
আর পারি না, সোনা যাদু আমার, সোনামণি আমার। তুই কবে বড় হবি।
মি. তরফদার—সরি নীলাঞ্জন, একটু দেরি হয়ে গেল।
নীলাঞ্জন—না না, ঠিক আছে। এতক্ষণ মহিলা সমিতির মিটিং চলছিল। বিদিশা ওয়াজ রিয়েলি বিজি উইথ দেম। এইমাত্র ওরা গেল।
বিদিশা—হ্যালো তরফদারদা, ভাল?
তরফদার—এই যে বিদিশা। বাঃ দারুণ দেখাচ্ছে। টায়ার্ডনেসেরও একটা বিউটি থাকে।
নীলাঞ্জন—ঠিকই ধরেছেন তরফদারদা, ওর বেশ ধকল যাচ্ছে।
তরফদার—আরে প্রেস কী শুরু করেছে দেখেছ। বড় বড় করে লিখেছে ধর্ষণ, বলাৎকার, —বলাৎকারের খণ্ডতটা বড় অশ্লীল, একটা বাজে ইমেজ তৈরি করে, বুঝলে না? নারীনিগ্রহ লিখলেই তো হয়। অ্যাম আই রাইট?
নীলাঞ্জন—ঠিক ধরেছেন। বিজনেস বিজনেস।
তরফদার—তা বিদিশা, তোমরা তো অনেক কিছুই করছ। প্রোটেস্ট, মিছিল, বিবৃতি, শাস্তিদাবি, এই সব ভিকটিমদের কথা কিছু ভেবেছ? এনি সর্ট অফ কমপেনশেসন?
বিদিশা—আমরা এভাবে ভাবি না। তা ছাড়া এর আবার কমপেনশেসন হয় নাকি?।
তরফদার—না, ধরো, লায়নস ক্লাব যদি হেলপ করে ওদের, ধরো এনি ফর্ম অফ মানিটারি হেলপ? কিংবা শুনেছি বাসন্তী না কে যেন প্রসটিটিউশন করত, ওকে যদি লায়নস ক্লাব একটা সেলাই মেশিন দেয় কেমন হয় ব্যাপারটা? এই আর কেউ আসছে না কেন? মাথুর তো অনেক আগেই আসবে বলেছিল…
বিদিশা—আপনারা সবাই আসবেন ভেবে কতগুলি মাংস চাপিয়েছি…।
তরফদার—মাংস? বাঃ। থ্যাংকিউ। লক্ষ্মী মেয়ে।
বিদিশা—থ্যাংক ইউ এমনি বললেও তো পারেন। গায়ে হাত কিন্তু আমি পছন্দ করি না।
তরফদার-রেগে গেলেও তোমাকে দারুণ দেখায়। উওম্যান লায়ন।
নীলাঞ্জন—বড় আনসোস্যাল হয়ে যায় ও মাঝে মাঝে। আসলে সারাদিন যা টেনশন গেছে না। …অ্যাই বিদিশা, হুইস্কিটা নিয়ে এসো।
তখনই ফস করে প্রেশার কুকার। মাংস গন্ধ। আর তখনই বিদিশার কান্না আসে। স্টিরিও অন করে। বোতলটার গলা টিপে ধরে। তখন ঠাকুর ঘরে ঘণ্টার শব্দ। বাবা ঠাকুর শয্যা দিলেন।
বিদিশা
আমাকে ভাসাল। না বুঝে। না বুঝে কারে তুমি ভাসালে আঁখিজলে না বুঝে।
ইঞ্জিনিয়ার ছেলের হাতে বড় সুখে সম্প্রদান করেছিলে বাবা। মৃত্যুশয্যায় জিজ্ঞাসা করেছিলে ইঞ্জিনিয়ারটা আসে না কেন? আমি বলেছিলাম, ও বড় ব্যস্ত। মিথ্যে বলেছিলাম। বলেছিলে সুখী তো? বলেছিলাম সুখী। মিথ্যে বলেছিলাম। কত শাড়ি আমার, গার্ডেন, সাউথ ইনডিয়ান, নাইলন জর্জেট, কত ছবি আমার অ্যালবামে— পিছনে তাজমহল, পিছনে জলপ্রপাত, পিছনে গাছের ফুল। নিজস্ব বাড়ি আমার, প্লিনথ এরিয়া বারোশো স্কোয়ার ফুট। কত লোক কত কষ্টে থাকে। ঘেঁষাঘেষি। ঝুপড়িতে মুরগির খাঁচার মতো। তবু ভয় করে। খাঁচার ভিতরে মুরগিরও ভয় করে মাংসের দোকানে? মুরগি কি ভয় বোঝে? খাঁচার ভিতরে বসে মুরগি অন্য মুরগিটার মাংস হয়ে পলিথিন প্যাক হয়ে যাওয়া নিশ্চুপ দেখে।
আমি তো চেঁচিয়েছিলাম। নারী নিগ্রহের প্রতিকার চাই। দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি চাই। বাসন্তীদের কথা মিছিলে বলেছি। কতদিন পরে।
কতদিন পরে মিছিলে অলোককে দেখেছিলাম সেদিন। একসঙ্গে এস এফ আই-এর অলোক। অলোক কী ভাল ছেলে ছিল। ব্রিলিয়ান্ট। কী দারুণ বক্তৃতা দিত, কী দারুণ কথা বলত, সুকান্ত, সুভাষ মুখার্জি…ওর ঠিকানা আমার কাছে একটা টুকরো কাগজে বহুদিন ছিল।
ইঞ্জিনিয়ারের বউ এই বিদিশা ট্যাক্সি থেকে দেখেছিল ওকে। ট্যাক্সি থেমেছিল জ্যামে। ও থমকানো গাড়ির ফাঁকে এঁকেবেঁকে রাস্তা পার হচ্ছিল। ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি। ডাকিনি। কী হবে ডেকে?
২৩ শে জুলাই।
মধ্যরাত
নীলাঞ্জন
ঘুম আসে না। ফুলস্পিড ফ্যানেও ঘামছি। কোথা যেতে পারে বিদিশা? আজ ফিরে আসবে ভেবেছিলাম। আসেনি। পুলিশে খবর দিইনি। প্রেস্টিজের ব্যাপার। বাবাকে মিথ্যে বলেছি। বলেছি ওর দাদার কাছে গেছে। ওর দুই দাদার বাড়ি গেছিলাম। আশা করেছিলাম ওখানেই আছে। ওদের কিছু বলিনি। কাল কোথায় খোঁজ করব? চিনুটা পালিয়েছে। সেদিন থানায় ওর যাবার কথা ছিল, সকালে উঠে দেখি ও নেই। কীসের ভয় ছিল ওর? পুলিশের? নাকি রনচার সামনে দাঁড়ানোর ভয়? একটু পরেই পালাল বাসন্তী। চিনুর হৃদয়পুরে মামার বাড়ি। ওখানে গেছে নাকি? ঠিকানা জানি না। বাসন্তী কোথায় যাবে? আর বিদিশা? বিদিশা কি ওদের খুঁজতে গেল? কী আশ্চর্য। কাল অফিস থেকে ফিরে দেখি বিদিশা নেই। বুড়ো বাবা বারান্দায়। বলছে বৌমা নেই! কিছু লিখেও যায়নি ও। সব খুঁজলাম। কিছু নেই! এখন রাত ক’টা? দুটো? রাস্তায় কেউ নেই। পুকুরপাড়ে তবু হাওয়া। জল খেয়েও জলতেষ্টা যায় না। পুকুরের ধারে যাই। পুকুরের জল কাঁপে।
জলে কী? কী ওটা পুকুরের মাঝখানে? কী ওটা লম্বা মতো? কী ভাসছে মানুষ? মেয়েমানুষ? উপুড় হওয়া মেয়েমানুষ? রাস্তার টিউব আলো পুকুরের মাঝখান পর্যন্ত যায় না। আকাশে ভাঙা চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে আবছা আভা দেয়। মাঝজলে স্থির কী ওটা! মানুষ জলে ডুবে গেলে আবার ভেসে ওঠে। ভেসে উঠতে ক’দিন লাগে? কী ওটা? মানুষ? মানুষ কি এত সরু? এত লম্বা? দু’হাত সামনে মেলা। ওটা কি হাত? হাত কি এতবড় হয়? তবে কী ওটা? কলাগাছ? কলাগাছ জলে ভাসে। ওপারের দত্তদের বাড়ি কলাগাছ আছে! কলাগাছ এমনই। কলা খাওয়া হয়ে গেলে মানুষ গাছ কেটে ফেলে দেয়। তবে কী ওটা? কলাগাছ? কিছু বোঝা যায় না। অস্পষ্ট! কী ওটা? মানুষ? বাসন্তী? বিদিশা? চিনু? নাকি কলাগাছ?
অমৃতলোক, ১৯৯০