মেয়েদের বিষয়ে গান্ধীজীর মত – অনিন্দিতা দেবী

মেয়েদের বিষয়ে গান্ধীজীর মত – অনিন্দিতা দেবী

সিন্ধুপ্রদেশের হায়দ্রাবাদ শহরের ‘উন্নতি’ নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্রের প্রতিনিধি আজকালকার সবিশেষ আন্দোলিত কয়েকটি বিষয়—যথা সহশিক্ষা, অসবর্ণ বিবাহ ও পর্দাসম্বন্ধে গান্ধীজীর মতামত জানিবার জন্য ওয়ার্দায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাহার বিবরণ ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় যাহা উদ্ধৃত হইয়াছে তাহার অনুবাদ নিম্নে দেওয়া হইল—

প্রশ্ন : আজকালকার যুবকদের বিশ্বাস মাসিক ১৫০ কি ২০০ টাকা আয় না থাকিলে বিবাহের কথা মনেই স্থান দেওয়া যায় না। এদিকে তাহাদের মধ্যে ক্রমেই অধিকসংখ্যক ছেলেরা মনে করিতেছে যে, বিবাহের দায়িত্ব গ্রহণ না করিয়াও অন্য নানা উপায়ে যৌনবৃত্তির চরিতার্থতা দোষের বিষয় নয়। এরূপ মনোভাব সম্বন্ধে আপনার মত কি?

উত্তর : একান্ত লজ্জা ও দুঃখের বিষয় ভিন্ন ইহা আর কোনোভাবেই দেখা যায় না। এরকম মনোভাব আত্মহত্যার দিকেই চালিত করে। ইহা যে কতগূর হীন ও নিকৃষ্ট, যেসব যুবকেরা ইহা উপলব্ধি করিয়াছে, বিশুদ্ধ জীবন ও সদাচারের দ্বারা তাহাদের ইহার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই ইহার একমাত্র প্রতিকার।

প্রশ্ন : যেসব বালিকাদের বাধ্য ইহয়াই অবৈবাহিত থাকিতে হয় বা যাহারা বিবাহে অনিচ্ছুক, তাহাদের সম্বন্ধে আপনার উপদেশ কি?

উত্তর : এই সকল বালিকাদের আপনাদের ক্ষুদ্র শ্রেণী, এমনকী আপনাদের প্রদেশ হইতেও বাহির হইয়া যোগ্য সঙ্গীর অনুসন্ধান করা উচিত। প্রাদেশিক ও জাতের গণ্ডি হইতে আমরা যত শীঘ্র মুক্ত হইতে পারি ততই মঙ্গল। একজন শিক্ষিত তামিলকে কেন তামিল সঙ্গীই খুঁজিতে হইবে? ছেলেমেয়ে যেই হোন, সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্য হইতেই কেন তিনি সমযোগ্য সঙ্গী নির্বাচন করিবেন না, ইহার কারণ আমি বুঝি না। তবে পাশববৃত্তির বশবর্তিতা নয়, জাতীয় উন্নতি এবং চিত্তপ্রকর্ষই ইহার প্রেরণা হওয়া উচিত।

প্রশ্ন : ‘নরনারী সকলকেই আত্মপ্রকাশের পরিপূর্ণ সুবিধা দেওয়া উচিত’—এই যদি আপনার মত হয়, তাহা হইলে আপনি কি উপদেশ দেন যে তরুণ—তরুণীরা পিতামাতার রক্ষা, উপদেশের কোনো অপেক্ষাই না রাখিয়া তাঁহাদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পরস্পরের অবাধ মেলামেশা করিবে? আর মেয়েদেরও ঠিক ছেলেদের মতোই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করিতে দেওয়া উচিত কিনা?

উত্তর : অবশ্যই নয়। মধ্যপথেই আমার বিশ্বাস। অধিকাংশ বালকবালিকারই পিতামাতা, গুরুজনের উপদেশানুসারে চলা এবং আপনাদের চালিত করাই উচিত। গুরুজনদেরও তেমনি আবার যেসব ছেলেমেয়েরা তাঁহাদের রক্ষাধীনে থাকে তাহাদের স্বাধীনতার সম্নান রক্ষা করিয়া চলিতে হয়। দেশের তরুণের বিশুদ্ধ রাখিতে হইলে কোনোরকম গোপনীয়তার ভাব থাকা উচিত নয়।

প্রশ্ন : প্রবীণেরা বলেন, সিন্ধুদেশের বিশেষ অবস্থার জন্য পর্দা—দূর এখানে নিরাপদ নয়। এদিকে নবীনেরা আবার স্বভাবতই ইহার বিরুদ্ধ মতের; তাহারা ইহা একান্তই কদাচার বলিয়াই জ্ঞান করে। প্রবীণ—নবীনের এই মতদ্বৈধে কি করা যায়?

উত্তর: পর্দাপ্রথায় আমার কখনই বিশ্বাস নাই। আমার মনে হয় যে মেয়েরা সাহস করিয়া পর্দা ছিন্ন করিয়া প্রতিবেশীদের দেখাইতে পারে যে তাহাতে তাহাদের কোনোই ক্ষতি হয় নাই, তাহারাই এ—সম্বন্ধে ভয় ও কুসংস্কার—দূর বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ হইতে পারে। পর্দা ছিন্ন করা বলিতে অবশ্য মেয়েরা যেখানে—সেখানে ঘুরিয়া বেড়াইবে ইহা বোঝায় না। লোকের কাছে আপনাদের মুখ ঢাকিয়া রাখা আমি মানুষের বৃদ্ধি ও আত্মপ্রকাশের পক্ষে সবিশেষ অনিষ্টকর বলিয়া মনে করি। নম্রতাই সর্বোৎকৃষ্ট পর্দা ও রক্ষা।

প্রশ্ন : সহশিক্ষা সম্বন্ধে আপনার মত কি?

উত্তর : সুচিন্তিত ও সুনিয়ন্ত্রিত সহশিক্ষায় আমার খুবই বিশ্বাস আছে।

এই সূত্রে মনে আসিল যে নানা গ্রন্থ, পত্রিকাদিতে প্রকাশিক গান্ধীজীর নানা বিষয়ের মতামত চন করিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য ছাত্র শ্রীযুক্ত নির্মলকুমার বসু এম. এস—সি সংকলিত একটি সবিশেষ সুনির্বাচিত সংগ্রহপুস্তক শীঘ্রই প্রকাশিত হইতেছে। বাহির হইলে তাহা পাঠ করিবার জন্য সকলকে অনুরোধ করিয়া এখানে তাহা হইতেও মেয়েদের বিষয়ে মহাত্মাজির কয়েকটি উক্তির অনুবাদ দেওয়া যাইতেছে—

বিবাহের আদর্শ

শারীর—মিলনের মধ্য দিয়া আত্মিক—মিলনই বিবাহের আদর্শ। ইহাতে যে মানুষ—প্রেমের সৃষ্টি, ঐশ্বরিক ও সর্বভূতে প্রেমসঞ্চারের তাহাই সোপান।

পত্নী স্বামীর ক্রীতদাসী নহেন, তাঁহার সঙ্গিনী ও সমস্ত সুখদুঃখের সমভাগিনী, সহায়িকা। আর স্বামীর মতোই নিজপথ নির্বাচনেও তাঁহার স্বাধীনতা।

বিবাহের পাত্রপাত্রী নির্বাচন

মেয়েদের এ—বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনতাই আমার একান্ত কাম্য। বালিকা বিধবা দেখিলেই আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। সদ্য বিপত্নীক স্বামীকে জঘন্য তাচ্ছিল্যের সহিত আবার বিবাহ করিতে দেখিলেও রাগে আমার গা কাঁপিতে থাকে। দণ্ডণীয় ঔদাসীন্যের সহিত ঝপমাকে মেয়েকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, নিরক্ষর রাখিয়া শুদু ধনী দেখিয়া বিবাহ দিবার জন্য প্রতিপালন করিতে দেখিলেও আমার দুঃখের অবদি থাকে না, তবে রাগ, দুঃখ হইলেও সমস্যার কাঠিন্যও আমি উপলব্ধি করি। মেয়েদের ভোট এবং আইনত সমাধিকার পাওয়া নিতান্তই আবশ্যক কিন্তু সেইখানেই সমস্যার শেষ নয়। জাতীয় রাষ্টনৈতিক আলোচনায় মেয়েদের যোগাদন হইতে ইহার আরম্ভমাত্র।

বিবাহ যেমন হ্যয়া উচিত, তেমনি পবিত্র কর্ম নূতন জীবনারম্ভই যদি হয় তাহা হইলে মেয়েরা সম্পূর্ণ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়াই তবে বিবাহিত হওয়া উচিত। এবং জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাহাদের কিছু হাত অন্ততও থাকা চাইই। তাহাদের কাজের ফল কি তাহাও তাহাদের জানা দরকার। শিশুদের মিলনকে বিবাহ আখ্যা দিয়া তারপর তথাকথিত স্বামীর মৃত্যুতে বালিকাকে বিধবা বলিয়া ঘোষণা, মানুষ—ঈশ্বর দুইয়ের বিরুদ্ধে মহাপাপ।

বাল্যবিবাহ

ছোট শিশুদের সম্বন্ধে আবার কন্যাদান কি—সন্তানেরা কি পিতার সম্পত্তির অন্তর্গত? পিতা তাহাদের রক্ষাকর্তা, মালিক নহেন। আর রক্ষাদীন সন্তানদের স্বাধীনতা লইয়া কেনাবেচা করিলে পিতা সেই অধিকারচ্যুত হইয়া থাকেন।

যে পিতা এইভাবে বিশ্বাসভঙ্গ করিয়া বৃদ্ধ বা বালকের সহিত শিশুকন্যার বিবাহ দেন কন্যার বৈধব্যের স্থলে তাহার পুনবির্বাহ দ্বারাই মাত্র তাঁহার যাহা কিছু পাপস্খালন হইতে পারে। এইরকম বিবাহ যে প্রথম হইতেই বাতিল হওয়া উচিত তাহাও তো আমি আগেই বলিয়াছি।

বিবাহবিচ্ছেদ

বিবাহ অন্য সকলকে ছাড়িয়া দুইজনের মিলনের অধিকার দিয়া থাকে। যখন দুইজনেরই ইহা ইচ্ছানুমত, তখন পর্যন্তই ইহার অধিকার। কিন্তু একজন সঙ্গীর ইচ্ছায় অপরের অবশ্যবাধ্যকতার অধিকার ইহাতে নাই। যখন সঙ্গীদের একজন নৈতিক বা অন্য কোনো কারণে অপরের ইচ্ছামতো চলিতে অক্ষম হয়, তখন কি কর্তব্য তাহা স্বতন্ত্র প্রশ্ন। কিন্তু আমি নিজে হইলে এরকমস্থলে নৈতিক প্রকর্ষের বাধা অপেক্ষা বিবাহচ্ছেদও বাঞ্ছনীয় বলিয়া মনে করি। অবশ্য উহা সম্পূর্ণ নৈতিক ও আত্মিক কারণ হওয়া আবশ্যক।

বিবাহ বিবাহ

১৯২১ সনে বিধবার সংখ্যা আগের বিশ বৎসরের তিনগুণে দাঁড়াইয়াছে। হিন্দু বালিকা বিধবার প্রতি অন্যায়ের পরিমাণ ইহাতে ভালো করিয়াই প্রকাশ করিতেছে। গো—রক্ষার জন্য আমরা ধর্মের নামে চীৎকার করি, কিন্তু বিধবা বালিকাগণ আমাদের কাছে কোনো রক্ষাই পায় না। বিবাহ কি, তাই যাহারা জানে না, এমন তিন লক্ষ বালিকার উপর আমরা ধর্মের নামে বৈধব্য চাপাইয়া দিই। কচি বালিকাদের উপর বলপূর্বক বৈধব্য নিক্ষেপের জঘন্য পাপের ফল আমরা হিন্দুরা প্রতিদিন ভালো করিয়াই পাইতেছি। আমাদের বিবেক যদি সত্যই জাগ্রত হইত, তাহা হইলে বৈধব্য দূরে থাক, ১৫ বৎসরের পূর্বে আমরা বালিকার বিবাহই দিতাম না। (২৩.৮.২৬ তারিখে গান্ধীজী একস্থলে লিখিয়াছেন, সাধারণত ১৮ বৎসরের নীচে কোনো বালিকার বিবাহ দেওয়া উচিত নয়)। আর এই তিন লক্ষ বালিকার বিবাহই হয় নাই বলিয়অ আমরা মনে করিতাম। জীবনসঙ্গীর প্রতি প্রেমে স্বেচ্ছাবৈধব্যে জীবন সম্পন্ন ও মহিমামণ্ডিত করিয়া থাকে, কিন্তু ধর্ম ও প্রথার দায়ের বাধ্যতামূলক বৈধব্যে গুপ্ত পাপে গৃহমলিন ও ধর্ম অধোগতিপ্রাপ্ত হয়।

আমরা যদি শুদ্ধ হইতে চাই হিন্দুধর্মকে রক্ষা করিতে চাই, তাহা হইলে বাধ্যমূলক বৈধব্যের বিষয় আমাদের দূর করিতে হইবে। যাঁহার গৃহে বালিকা বিধবা আছে তাঁহার ভালো বিবাহের জন্য সাহসে ভর করিয়া তাঁহাকেই উঠিয়া—পড়িয়া লাগিতে হইবে। ইহারপুনর্বিবাহ নয়; উহাদের বিবাহ হয়ই নাই।

পর্দা

সচ্চরিত্রতা কাচের ঘরের ঢাকা দেওয়া বস্তু নয়। পর্দার চার দেওয়ালের বেড়াতেও ইহাকে রাখা যায় না। অন্তরেই ইহাকে জন্মলাভ করিয়া বাঁচিতে হয়। আর সকলরকম অযাচিত প্রলোভন জয় করিবার শক্তি ইহাতে চাই।

নারীর বিশুদ্ধতার জন্যই বা কেন এই অদ্ভুত ব্যবস্ততা—পুরুষের বিশুদ্ধি সম্বন্ধে মেয়েরা কি কিছুই বলিতে পায়? পুরুষের চরিত্র বিষয়ে মেয়েদের ব্যস্ততার কথাও তো কই শুনিতে পাওয়া যায় না! নারীর বিশুদ্ধতা সম্বধে আইনকানুন বানাইবার অহঙ্কার পুরুষে কেন করিয়া থাকে? ইহা বাহির হইতে চাপাইবার জিনিস নয়, উহা অন্তরের অভিব্যক্তি, সুতরাং আত্মচেষ্টার উপরই ইহা নির্ভর করে।

জয়শ্রী, পৌষ ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *