তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি
পরিচিতির রাজনীতি
উপস্থাপনের রাজনীতি
অনুভূতির রাজনীতি

মেয়েদের প্রেক্ষিত ও মৌখিক ইতিহাস গঠনের পদ্ধতি – কবিতা পাঞ্জাবী

মেয়েদের প্রেক্ষিত ও মৌখিক ইতিহাস গঠনের পদ্ধতি – কবিতা পাঞ্জাবী

ইতিহাসে মেয়েদের স্বর অলিখিত। সাহিত্যে বা শিল্পে সেই স্বর বারংবার উপস্থাপিত হলেও ইতিহাস, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিদ্যাচর্চায় নারী-স্বরের জন্য খুব স্বল্প কতগুলি পরিসর লক্ষ করা যায়। মেয়েদের ইতিহাসকে জানবার, তাদের স্বরকে ইতিহাসে ফুটিয়ে তুলবার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে মৌখিক আখ্যান বা মৌখিক ইতিহাস(Oral Narratives/ Oral History)-এর কথা ভাবা সম্ভব। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন মৌখিক ইতিহাস বলতে কিন্তু আমরা ‘জবানবন্দি’-র কথা বলছি না। আখ্যানের কথা বলছি। সাধারণত সাহিত্যের ক্ষেত্রে আখ্যান শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ‘আখ্যান’ নিজেই একটি বৃহৎ সন্দর্ভ। আখ্যান বিভিন্ন রকমের হয়, মৌখিক আখ্যান বলতে একটি বিশেষ ধরনের আখ্যান বোঝায়। আজকের বিদ্যাচর্চামহল সাধারণত আক্ষরিক জ্ঞানকেন্দ্রিক, মৌখিক জ্ঞানের গুরুত্ব সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে, যদি-বা থাকেও, তা থাকে জবানবন্দি হিসেবে, আক্ষরিক জ্ঞানের অনুষঙ্গ হিসেবে। অন্য দিকে মৌখিক আখ্যান কিন্তু কেবল সাক্ষাৎকার বা কর্মসমীক্ষা নয়, বৃহৎ অর্থে এটি বক্তা ও শ্রোতার মধ্যেকার নানাবিধ সম্পর্কের বয়ান, সেই সংক্রান্ত নানান প্রশ্ন নিয়ে খেলা করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন প্রশ্নকর্তা কোন পরিপ্রেক্ষিতে কী ধরনের প্রশ্ন নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে যাবে অথবা সেই প্রশ্নগুলিকে নিয়ে সে কোন পন্থায় তার কাজের দিকে অগ্রসর হবে, নিজের প্রশ্নকে বেশি গুরুত্ব দেবে না বক্তার বক্তব্যের সূত্র, ইঙ্গিত প্রভৃতিকে বেশি মূল্য দেবে, বক্তব্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কীভাবে করবে? এই ধরনের প্রশ্ন, সমস্যাপট নিয়ে গড়ে ওঠে মৌখিক আখ্যানের সন্দর্ভ।

লাতিন আমেরিকায় সত্তরের দশকে Testimonio নামক এক ধরনের ঐতিহাসিক রচনার চল হয়, যেটা মূলত সাক্ষাৎকার; অন্য সংস্কৃতির গবেষকেরা এসে, লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক কর্মীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল সেই সময়। এবং এই সংরূপ তৈরি হওয়ার মূল ভিত্তিই ছিল সেই সময়ের লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক বিপ্লব— যে বিপ্লবে বহু মহিলা অংশগ্রহণ করেছিল। এই Testimonio-গুলির মধ্যে বিখ্যাত নোবেলজয়ী (১৯৯২) Rigoberta Menchu-র গ্রন্থ। এ ছাড়া Domitila Barrios–এর লেখা Testimonio বা আপাতত যার বাংলা করা যেতে পারে সাক্ষ্য–সাহিত্য যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৌখিক আখ্যানের মধ্যে দিয়েই নির্মিত হয়েছে। Testimonio বা সাক্ষ্য-সাহিত্য হচ্ছে মূলত কোনও একটা রাজনৈতিক ঘটনা বা বিপ্লবের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের জবানবন্দি। সমাজের নিচুস্তরের পরিপ্রেক্ষিত থেকে উঠে আসা এক ধরনের জবানবন্দি, সমাজের মূল থেকে উঠে আসা Collective struggle বা সম্মিলিত সংগ্রামের সাক্ষ্য। আর সাক্ষাৎকারী যদি বহু বছর পর সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করে তাহলে সময়ের ব্যবধানের ফলে সংরূপের মধ্যে বড় ধরনের চরিত্রগত পার্থক্য তৈরি হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি বিপ্লবের সাক্ষ্য-সাহিত্যর মধ্যে প্রধানত প্রকট কিছু সমষ্টি-মনের পরিচয় পাওয়া যায় কিন্তু বহুদিন পর সেই বিপ্লবের মৌখিক জবানবন্দি সংগ্রহ করার কাজ শুরু হলে বিপ্লবের সেই তপ্ত, সদ্যোজাত ব্যষ্টিচেতনাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। সে-চেতনা হারিয়ে যায়— এই কথাটি ভিত্তিহীন, বলা যেতে পারে সময়ের ব্যবধানে সে-চেতনা ভীষণভাবে প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, অন্যান্য রূপে প্রকাশিত হয়। এককথায় বললে, সাক্ষ্য-সাহিত্য সংরূপটি মৌখিক আখ্যানের ভিত্তিতে সাধারণত নির্মিত হয় (যদিও এর ব্যতিক্রমও আছে বা থাকতে পারে), সমাজের নীচের তলার সম্মিলিত সংগ্রামের সাক্ষ্য ফুটিয়ে তোলে। আর অন্য দিকে মৌখিক আখ্যান বলতে আমরা বলতে পারি, যে-আখ্যান মৌখিকতার মধ্যে দিয়ে সংবিত্ত (Communicated) হয় এবং সাধারণত জনসমষ্টির প্রেক্ষিত, ইতিহাস নিয়ে কারবার করলেও মৌখিক আখ্যান একক ব্যক্তি মানুষ নিয়েও একইভাবে গঠিত হওয়া সম্ভব (এমন উদাহরণও আছে)।

মৌখিক ইতিহাসের বিভিন্ন সংরূপের মধ্যে সাক্ষ্য-সাহিত্য হল একটা। মৌখিক ইতিহাসের সামান্যীকরণ কীভাবে সম্ভব? মৌখিক ইতিহাসের বৈধতা ও মূলধারার ইতিহাস লিখন পদ্ধতির সঙ্গে এর প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিরিখে, মৌখিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যগুলিকে কীভাবে ভাবা সম্ভব? এক দিকে হয়তো মহিলা রাজনৈতিক কর্মীদের মৌখিকভাবে বর্ণিত ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সাক্ষ্য-সাহিত্য একটা সংরূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু অন্য দিকে প্রান্তীয় মানুষের প্রশ্ন এবং অবশ্যই সমস্ত স্তরের জীবনে মেয়েদের প্রেক্ষিতকে আলোচনাভুক্ত করে, আধিপত্যশীল ইতিহাসদের ভেঙে দেওয়ার মতন ব্যাপ্তি মৌখিক ইতিহাস বহন করে চলে; মৌখিক ইতিহাস স্বভাবতই অনেকখানি ব্যাপ্ত।

মৌখিক ইতিহাস লিখনের ক্ষেত্রে বা সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমাদের কতগুলো বিষয় খেয়াল রাখা উচিত। এক্ষেত্রে দেগে দেওয়া কোনও নিয়মকানুন অবশ্যই নেই, প্রতিটি সমাজ, সভ্যতা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ, সেগুলিকে মাথায় রাখলে মৌখিক ইতিহাসের সাধারণ কোনও নিয়ম খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। খুব আলগোছে আমরা মৌখিক আখ্যান রচনার কিছু সাধারণ অবয়ব, শর্ত বা আঙ্গিকের কথা ভাবতে পারি। যে-সমস্ত মানুষের জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করে মৌখিক আখ্যান লিখিত হয় তাদের জীবন কিন্তু তাদের কাছে বিদ্যাচর্চার উপাদান নয়। যিনি ঐতিহাসিক তাঁর অভিজ্ঞতা, মতাদর্শ, জীবনবোধের উপর নির্ভর করে যে, তিনি কতখানি ইতিহাস গড়তে পারেন। যার সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে তার আখ্যানের ধারণাটি ঠিক কেমন? সে কি প্রতিষ্ঠিত বয়ানের মোড়কে নিজের কথা গুছিয়ে নিতে খুব পটু, তাহলে তার সেই বৈশিষ্ট্যটিকে আলাদা করে নজর করা প্রয়োজন। ঐতিহাসিক তার নিজস্ব ধারণা থেকে কতগুলি প্রশ্ন যদি সাজিয়ে নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে যান এবং যদি সেইগুলির উত্তরই কেবল খুঁজতে চান তাহলে প্রথমত, ঐতিহাসিকের ধারণার সঙ্গে বক্তার ধারণার গরমিলগুলি খুব কাঠামোগতভাবে অবহেলিত হবে এবং সেই সূত্রেই দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক কেবল সেটুকুই শুনতে পাবেন যা তিনি শুনতে চান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব সাধারণভাবে বললে, ঐতিহাসিক যদি বক্তার সামনে নিজেকে অনেকখানি পরিবর্তন করতে না পারেন, যেমন নিজের বিষয়ে কিছু বলতে না পারেন, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বক্তার বক্তব্যকে জড়িয়ে নিতে না পারেন তাহলে, বক্তা-শ্রোতার মধ্যবর্তী ব্যবধানকে কমিয়ে আনা কঠিনতর হয়ে উঠতে পারে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো বক্তার বলার ধরন আলাদা হতে পারে, বক্তার পরিপ্রেক্ষিতে, বক্তার নিজের জীবন, রাজনীতি, চেতনা অন্যরকম হতে পারে; ঐতিহাসিককে নিজের প্রথাবদ্ধ পূর্বসিদ্ধান্তগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখেই খানিকটা মাঠে নামতে হবে— এই পদ্ধতিতে কাজ করলে ঐতিহাসিকের নিজের শেখার ও বোঝার পরিসর অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। Daphne Patai, যিনি ব্রাজিলের যুবতীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মৌখিক আখ্যান রচনার কাজ করেছিলেন, এ বিষয়ে তাঁর একটি মজার মন্তব্য ছিল। তিনি একজন বক্তার বিষয়ে বলেছিলেন যে, ওই বক্তাকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন এক, আর ওঁর মনে হয়েছিল বক্তা উত্তর দিয়েছিলেন আরেক। দাফ্‌নে (Daphne) সেই মুহূর্তে তাঁর উত্তর পাননি। কিন্তু পরে যখন তিনি ওই মহিলাকর্মীদের সমাজ, চেতনা সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন, তখন তিনি তাঁর উত্তর খুঁজে পান। এক্ষেত্রে গল্পটা কতকটা এইরকম— ব্রাজিলের ওই যুবতীরা তাদের কর্মব্যস্ত সপ্তাহের শেষে, প্রতিটি রবিবার বিদ্যালয় যেত। দাফ্‌নে সেই বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সেই বিদ্যালয়ের প্রভাব বিষয়ে যখন জিজ্ঞাসা করেন তখন প্রায় সকল বক্তাই বলে যে তারা সেখানে অনেক আনন্দে ছিল, একসঙ্গে বিদ্যালয়ে আনন্দে সময় কাটাত। এই আপাত অসংলগ্ন উত্তরটি গভীরতর হয়ে ওঠে যখন দাফ্‌নে আবিষ্কার করেন যে, রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্যে যে ঐক্যের ধারণা আছে, এই ব্রাজিলীয় মহিলারা তাদের রবিবারে বিদ্যালয়ের ঐক্য, সমষ্টির আনন্দ, অভিজ্ঞতা থেকেই তা সঞ্চয় করে। তাই তারা বিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে কেবল ওই আনন্দের কথাটুকুই বলেছিল। ঠিক একইরকমভাবে কোনও ক্ষেত্রে বক্তার যদি আখ্যানের প্রতিষ্ঠিত রীতি বিষয়ক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে হয়তো বক্তা একটি বাক্যে অভিজ্ঞতা জানাবে, অথবা একটি শব্দে, কিংবা হয়তো নিশ্চুপ থাকবে কোথাও কোথাও। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধরে রেখে ঐতিহাসিককে ক্রমে, ধীরে বক্তার জীবনের অভিজ্ঞতাকে বুঝতে হয়, সুস্পষ্টভাবে বয়ানের চৌহদ্দিতে তুলে আনতে হয়। এইরকমভাবে কোথায় ঐতিহাসিক প্রশ্ন করবে আর কোথায় সে শুনবে, এক দিনে যতগুলি প্রশ্ন সে করতে পারত সবগুলিই কি তার পক্ষে করা সম্ভব হবে, না বার বার যেতে হবে ঐতিহাসিককে এবং বার বার ফিরে ফিরে পড়তে হবে বক্তার বয়ান— তা সবসময়ই নির্ভর করবে ঐতিহাসিকের জানবার ও শিখবার উদ্দেশ্য এবং প্রবণতার উপর। এ প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা এই যে, মৌখিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে একই মানুষের কাছে বার বার সাক্ষাৎকারের জন্য যেতে হতে পারে, এক ঘণ্টা বা এক দিনের মধ্যে বক্তার জীবন, অভিজ্ঞতার গূঢ় খবর লাভ করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব। তাই বারংবার সাক্ষাৎকার নেওয়ার মধ্যে দিয়ে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে এক ধরনের নিবিড় সম্পর্কও তৈরি হয়। এবং এই সম্পর্ককে ঐতিহাসিক কীভাবে বুঝবে, সেটার সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে পড়বে— অনেক ক্ষেত্রে সেটাই ঠিক করে দেয় ঐতিহাসিকের কাজ কোন দিকে যাবে, কাজের চরিত্র কেমন হবে, গুণগত মান কেমন হবে। এবং এই সম্পর্ক বা আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে ঐতিহাসিক যা শিখবে তার প্রতি একটা সচেতন সজাগ দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি কাজের মধ্যে ফুটে উঠতে পারে।

মৌখিক আখ্যান বা ইতিহাস, প্রথাগত মহাফেজখানার ঐতিহাসিকদের কাছে ইতিহাস হিসেবে তেমন বিবেচিত হয়নি, বরং বার বার সমালোচিত হয়েছে। সমালোচনার একটি আবশ্যিক কারণ ছিল সত্যতার প্রশ্ন। ঐতিহাসিক যাকে প্রশ্ন করছে সেই বক্তা যা বলছে সেটা কতখানি সত্য তা আমরা কী করে বলব? এর সত্যতায় সন্দেহ প্রকাশ করার অনেকগুলি কারণ থাকতে পারে— এক, হতে পারে বক্তা যা বলছে তার সত্যতা সম্পর্কে সে নিজেই সচেতন নয়, বক্তার স্মৃতি যে বক্তাকে প্রতারণা করছে তা বক্তা নিজেই জানে না; হয়তো বক্তা বিশ্বাস করেই কোনও একটা কথা বলছে কিন্তু সেই তথ্যটি অসত্য। দুই, বক্তা যে সময়ের ঘটনার কথা বলছে শুধু সেটাই নয়, যে-সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর আখ্যানকে হাজির করছে, সেই সময়ের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও একটা প্রভাব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তিন, হতে পারে বক্তা তার স্মৃতি থেকে যে কথাকে যেভাবে তুলে আনছে, ঐতিহাসিক সেই কথাকে ঠিক বিপরীত বা অন্যরকম করে বুঝছেন। চার, হতে পারে বক্তা জেনে-বুঝে, সামাজিক, রাজনৈতিক বা মানসিক কোনও কারণে সত্য গোপন করছে (এই প্রসঙ্গে আমরা পরে ফিরে আসব)।

নব্বইয়ের দশকে আমি একদিন সকালবেলায় উঠে কলকাতার একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়, সংবাদের একটি শিরোনাম দেখে চমকে উঠি; শিরোনামটি কতকটা এইরকম ছিল: Is Rigoberta Menchu a Liar? সংবাদপত্রের খবর অনুসারে David Stoll ১৯৯৯ সালে তাঁর বইয়ে দাবি করেছেন রিগোবের্তা-র গ্রন্থে কয়েকটি তথ্য সম্পূর্ণ ভুল, যেমন, রিগোবের্তা বলেছিলেন যে তার ভাইকে নাকি তার পরিবারের সদস্যদের সামনে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ডেভিড গবেষণার মধ্যে দিয়ে দেখান যে আসলে তার ভাইকে পুড়িয়ে নয়, গুলি করে হত্যা করা হয়। তথ্যের প্রেক্ষিতে ডেভিডের গ্রন্থটির সঙ্গে দৃঢ় কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নামতেই পারেন। কিন্তু এখানে মজার বিষয় হল, ভাই বলতে রিগোবের্তা কি নিজের ভাইয়ের কথাই বলতে চেয়েছেন? তাঁর পরিবারের অন্যান্য সম্পর্কের ভাই বা তার বন্ধু বা পাড়ার দাদা বা কমরেড বন্ধুদের কথাও তো বলে থাকতে পারেন? একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর মধ্যে যখন একটি বিশেষ ধরনের হত্যার/হিংসার স্মৃতি (এক্ষেত্রে পুড়িয়ে মারা) প্রবল হয়ে ওঠে, তখন একটি ব্যক্তিমানসেও কি সেই স্মৃতি জমাট বাঁধে? সব হত্যাকেই একরকম মূল্যে এবং আঙ্গিকে বাঁধতে শুরু করে? এক দিকে সমষ্টিজীবন এবং অন্য দিকে ‘ভাই’ শব্দের দু’টি ভিন্ন প্রেক্ষিত ও অর্থ। বাংলা ভাষাতেও ‘ভাই’ বলতে আমরা যেমন কেবল নিজের ‘ভাই’কেই বুঝি তা নয়। ‘ভাই’ সম্পর্কটির অনেক প্রকার উদাহরণ পাওয়া সম্ভব। বক্তার কাছে সেটা ঠিক যে-অর্থে এসেছে, ঐতিহাসিক কিন্তু সেই অর্থে বুঝতে বা মেনে নিতে পারছেন না। বক্তার মধ্যেকার একটা তীব্র সমষ্টিভাব বক্তার বিশ্বাসকে এমন এক জায়গায় তুলে নিয়ে গেছে— যে-বিশ্বাস থেকে রিগোবের্তা মনে করছেন, যা তাঁর কমরেডদের সঙ্গে হয়েছে, সেটাই যেন তাঁর সঙ্গেও হয়েছে। এই বিশ্বাসের তফাত কি কেবলই ব্যক্তিমানুষের তফাত, না কি সংস্কৃতির, চেতনার তফাতও বটে? ফলত এক্ষেত্রে জটিলতর প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়— মৌখিক ইতিহাসে কীভাবে দু’টি ভিন্ন সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক একটি পাঠ্যের নির্মাণ করে, ভিন্ন সংস্কৃতির অন্তর্বর্তী ব্যবধানগুলি কীভাবে একটু একটু করে ঘুচে যায় এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত ও মতের পার্থক্য কীভাবে এই প্রকল্পের মধ্যে মধ্যে লেখা হয়ে যেতে থাকে। ডেভিড আরও বলেছেন যে, রিগোবের্তা কোনও বিদ্যালয়ে কখনও পড়েননি এ কথা মিথ্যা। ডেভিডের মতে, তিনি আসলে বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে আসলে রিগোবের্তা একটি ঘরোয়া পরিবেশে খানিকটা পড়াশুনো করেছিলেন, সেটাকে কি রিগোবের্তা আদৌ বিদ্যালয় বলে মনে করেছিলেন? মৌখিক আখ্যানে এরকম নানা প্রশ্নই থেকে যায়, বক্তার বক্তব্যের সত্যতা ও সত্যের বিভিন্ন ভাষ্যকে কেন্দ্র করে। সত্যের সঙ্গে যেন একটা খেলা চলে মৌখিক আখ্যানে, যেমন চলে স্মৃতির খেলা। কোনও পুরনো গল্পের বর্তমান সময়ে উঠে আসা বয়ান— বর্তমানের আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভয়, মিলেমিশে যায় বক্তব্যে। একই কথা একসময়ের সাক্ষাৎকারে একরকম থাকে অন্যসময়ের সাক্ষাৎকারে বদলে যায়। বিভিন্ন জনের সাক্ষাৎকারে একই ঘটনা অন্য অন্য গল্প, বয়ান নিয়ে আসে। একই বক্তার সঙ্গে, প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিনের সাক্ষাৎকার স্বল্প-বৃহৎ তফাতে বদলে বদলে যেতে থাকে। বক্তা কীভাবে তার অতীতকে, তার গোষ্ঠীর, সমষ্টির অতীতকে দেখে, বর্তমান বক্তাদের কীভাবে দেখবার জন্য প্ররোচিত করে, দায়বদ্ধ করে, সবটাই নির্ধারণ করে দেয়, মৌখিক ইতিহাসের সত্যতাকে। যেমন, বুন্দেলখণ্ডের হরবোলাদের কণ্ঠে উঠে আসা ঝাঁসির রানির বীরত্বকে ঘিরে রচিত, সুভদ্রা কুমারী চৌহানেরবিখ্যাত কবিতায় যে মর্দানি রানির কল্পনা বা নির্মাণ ছিল, তার জাতীয়তাবাদী, গোষ্ঠীবাদী সত্যতা কিন্তু হরবোলাদের মৌখিকতার মধ্যে, সমসাময়িকতার মধ্যেই প্রকাশ পায়, এটাই তারা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে। ঝাঁসির রানির আদৌ কবিতার মতন তলোয়ার ছিল কি না বা ওভাবে যুদ্ধ করেছিলেন কি না সেই ‘সত্য’র প্রশ্নটা, মৌখিক ইতিহাসে খানিকটা অবান্তরই বটে। এই কবিতা ঝাঁসির রানির দুর্জয় সাহসী রণমূর্তির কাব্যিক নির্মাণ। ঝাঁসির রানির মর্দানি বুন্দেলখণ্ডের হরবোলাদের মনে কীরকমভাবে নির্মিত হয়েছিল এবং সেই নির্মাণ কেমনতর ছাপ রেখেছিল, প্রভাব ফেলেছিল, কীভাবে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের লড়াইয়ে উৎসাহ জুগিয়েছিল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর এখান থেকে ঝাঁসির রানির সেই বীরত্বগাথা কীভাবে কিংবদন্তি হিসেবে ১৯৪০-এর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে সেই ইতিহাসও একই মৌখিক আখ্যানের আঘাত থেকে উঠে আসে। এবং এই আঘাত সময় থেকে সময়ে, আন্দোলন থেকে আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়ে স্মৃতির উপর ভর করে। ঘটনার ঐতিহাসিক সত্য নয় বরং ঐতিহাসিক ঘটনার কাব্যিক নির্মাণ কীভাবে একটা গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে কিংবা আঘাত (Affect বলা যেতে পারে) করে এবং একটা সমষ্টির সত্যকে নির্মাণ করে, বদলে দেয়— সেটাকে তুলে ধরাই আসলে মৌখিক আখ্যানের উদ্দেশ্য। তাই ঐতিহাসিক ‘আদত’ বা ‘আসল’ মৌখিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তার প্রাসঙ্গিকতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। তার বদলে যেটা প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয় তা হল কাব্যিক সত্য। এবং সেই সত্যের মধ্যে দিয়েই মৌখিক আখ্যান ইতিহাসের বৃহৎ প্রতিষ্ঠিত সত্যের ফাঁকগুলিকে চিহ্নিত করে বা সেগুলিকে আলোকিত করে।

প্রথাগত মহাফেজখানার ইতিহাসের ঘটনাগত সত্য বা বলা যায় প্রাতিষ্ঠানিক সত্যের বিরুদ্ধে মৌখিক ইতিহাস তুলে ধরে ইতিহাসের কাব্যিক সত্যকে। Alessandro Portelli-র মতে মৌখিক ইতিহাসের এই কাব্যিক সত্য আসলে বস্তুগত সত্যের থেকেও অনেক বেশি করে সম্ভাবনাময় সত্যকে তুলে ধরে। এটা যেন এক ধরনের মৌখিক সত্য, নিত্যনৈমিত্তিক, প্রতিদিনের সত্য। এই সত্যের ক্ষেত্রে চারটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ: ১) কোনও সমাজ বা সংস্কৃতি কীভাবে একটা রাজনৈতিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করছে; ২) কীভাবে গ্রহণ করছে, বছরের পর বছর নিজের মধ্যে লালন করছে; ৩) এবং সেই গৃহীত, লালিত ঘটনার প্রতি সেই সমাজ, সমষ্টির নান্দনিক প্রতিক্রিয়াটা ঠিক কেমন হচ্ছে ও সেই প্রতিক্রিয়া কীভাবে সেই গোষ্ঠীর ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করছে; ৪) এবং সেটার প্রতিক্রিয়া থেকেই কীভাবে একটা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করছে। এগুলিই মৌখিক ইতিহাসে কাব্যিক সত্যের ভূমিকাকে নির্ণয় করে। যেমন ১৯৪৩ সালে মন্বন্তরের সময় গ্রামের মহিলারা শহরের প্রায় প্রতিটি রান্নাঘরের জানলায় এসে ‘একটু ফ্যান দে মা’ বলে কাতর কণ্ঠে ফ্যান ভিক্ষা করত। শহরের লঙ্গরখানায় অভুক্ত গ্রামীণ মানুষদের জন্য কিছু ব্যবস্থাও ছিল, এটা আমরা মন্বন্তরের ইতিহাস থেকে জানি সরকারি লঙ্গরখানার অভাবে কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব উদ্যোগে অনেকগুলি লঙ্গরখানা তৈরি করা হয়। এবং অন্য দিকে সেইসময় বামপন্থী দলের তরফ থেকে মহিলাদের জন্য বিদ্যালয়ে রাজনৈতিক পাঠচক্রের আয়োজন করা হয়েছিল। তেভাগা আন্দোলনেরপ্রায় পঞ্চাশ হাজার এইরকম মহিলাদের কথা জানা যায়। কিন্তু পরে যখন তারা নিজেদের রাজনৈতিক বিপ্লবের ডাকে সারা দেওয়ার প্রসঙ্গে কথা বলে, তখন কিন্তু তাদের কাছে শহরের পথে পথে ফ্যান চেয়ে বেড়ানো ওই দরিদ্র মহিলা এবং তাদের উপরের অমানবিক অত্যাচারের কথাই বলে। সেই অভুক্ত মহিলাদের ফ্যান দিয়ে বাঁচানোর জন্য তারা ভাতের ফ্যানকে আরও বেশি তরল করে খাওয়ানো শুরু করে। শহুরে রান্নাঘরের জানলায় এমন অমানবিক আঘাত আসলে সেই দশকের শহুরে মহিলাদের চৈতন্যকে আঘাত করেছিল। ১৯৪৩ তাদের আমূল বদলে দিয়েছিল। এবং দুর্ভিক্ষে গ্রামীণ মহিলাদের এইরূপ দুর্দশাকে চোখের সামনে দেখার ফলে, তেভাগা আন্দোলনের মহিলা রাজনৈতিক কর্মীদের সামাজিক বিপন্নতার অভিজ্ঞতার বেশিরভাগটাই গড়ে উঠেছিল দুর্ভিক্ষের এই বিশেষ কিছু অভিজ্ঞতাগুলি থেকে। এক্ষেত্রে অনুভবের এই কাব্যোচিত বাস্তবতা কিন্তু কেবলমাত্র ব্যক্তিচৈতন্যের পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বহুসংখ্যক শহুরে মহিলারা, বলা যায় বাংলার একটা গোটা শহুরে মহিলা প্রজন্ম, আন্দোলনের জন্য উজ্জীবিত হয়। এমন একটি সূক্ষ্ম অথচ অপরিহার্য অভিজ্ঞতার কথা প্রথাগত মহাফেজখানার ইতিহাসে না থাকলেও, মৌখিক ইতিহাস এই ধরনের বৃহত্তর অভিজ্ঞতা ও অনুভবের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। মৌখিক আখ্যানে বক্তার স্মৃতি, যা মৌখিক ইতিহাসের ঐতিহাসিকের আকর উপাদান, দু’টি ধরনে বিভক্ত হয়ে যায় যেন। এক দিকে যদি থাকে প্রথাগত ইতিহাস, আদত ঘটনা, প্রাতিষ্ঠানিক সত্য, যাকে বলা চলে ঘটনামূলক পৌর্বাপর্য স্মৃতি এবং অন্য দিকে প্রতিষ্ঠিত ঘটনার ব্যঞ্জনার ভিতর গড়ে ওঠা, বাগার্থিক স্মৃতি।

ইতিহাসের বৃহৎ আখ্যানে, যে মোটাদাগের ঘটনাবলি থাকে, তাকে আমরা পৌর্বাপর্য স্মৃতি বলতে পারি, আর মৌখিক ইতিহাস আসলে সেই প্রতিষ্ঠিত ঘটনার ফাঁক গলে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া স্মৃতি, যে স্মৃতি আসলে তৈরি হয় ইতিহাসের আঘাতে, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায়, জীবনযাপনে, জীবনের অর্থময়তায়। তাই একে আমরা বাগার্থিক স্মৃতি বলতে পারি। মানব‘জীবন’-এর গল্প কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পৌর্বাপর্য স্মৃতি থেকে বাগার্থিক স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়। ঐতিহাসিকের বয়ানে স্মৃতিপটের যেমন ঐতিহাসিক পরিবর্তন হয়, তেমনি মৌখিক ইতিহাস-লেখকও ঘটনাগত জ্ঞান থেকে ক্রমে উত্তীর্ণ হয় বিশ্লেষিত সিদ্ধান্তের পরিসরের মধ্যে। কতগুলি ঘটনা যা থেকে একজন ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করে, ক্রমে সেগুলির বিচার, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে একটি নতুন জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থানে সে পৌঁছায়। এই যাত্রা যেন শব্দ-অর্থের যাত্রা। মৌখিক ইতিহাসে, দু’টি স্তরে, এই দু’টি সমান্তরাল রূপান্তর ও পরিবর্তনের যাত্রা একত্রে চলতে থাকে। কীভাবে এক ধরনের জ্ঞান, গৃহীত ও বিশ্লেষিত হয় এবং সেই বিশ্লেষণ কীভাবে ভবিষ্যৎকে পালটে দিতে থাকে এটাই ক্রমে মৌখিক ইতিহাসের কাজ হয়ে ওঠে। এখানে উল্লেখ্য যে ঐতিহাসিকের যে-বিশ্লেষণাত্মক যাত্রা, তার সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে বিষয়িতা (Subjectivity) ও আন্তঃবিষয়িতার বা আন্তঃব্যক্তিত্বের (Inter-Subjectivity) প্রসঙ্গ, সম্পর্ক। একটু পরেই আমরা সে প্রসঙ্গে আসব।

আমাদের জ্ঞানের সম্ভাবনা একদিক থেকে অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের সঙ্গে আমাদের আঞ্চলিকতার সম্পর্কের উপর। জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোয় নিমজ্জিত যে জ্ঞান আমাদের, তার বেশিরভাগটাই নির্ভর করে আমাদের সঙ্গে আমাদের সমাজের সম্পর্কের উপর। তাই সর্বদাই জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক, লৌকিক বিশেষত্বগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে ঐতিহাসিক যখন তার আপন সংস্কৃতির থেকে প্রকটরূপে ভিন্ন সংস্কৃতিকে পাঠ করতে নামে, তখন তার নিজের প্রশ্নের উত্তরগুলো খুব তাড়াতাড়ি আসে না, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে উপস্থিত হয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, আমি যখন তেভাগা আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণের মৌখিক ইতিহাস লিখতে যাই, তখন রানি দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার নিই। প্রথম দিন তিনি নিজের বিষয়ে কিছুই বলতে চাননি। তাঁর মতে আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে নেমে তিনি কখনওই নিজের গুণগান করবেন না। পরে তাঁর স্বামী অজয় দাশগুপ্ত (যিনি নিজে শ্রমিক নেতা ছিলেন) রানিকে বোঝান যে, তিনি যদি তৎকালীন মেয়েদের বিষয়ে কথা না বলেন তাহলে তেভাগা আন্দোলনে মেয়েদের অবস্থানের প্রসঙ্গটা হারিয়ে যাবে। এরপর রানি সেই আন্দোলনের মেয়েদের নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে বারংবারই ব্যষ্টিচৈতন্যের প্রসঙ্গ ফিরে ফিরে আসে। তাঁর চোখে যে চল্লিশের দশককে খুঁজে পাওয়া যায়, সেখানে নারীর প্রসঙ্গ অনেকটাই সাম্যের তর্কে নিমজ্জিত। পাশ্চাত্য নারীবাদের মধ্যে সুগঠিতভাবে গড়ে ওঠা ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে নারীবাদ, যার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল পিতৃতন্ত্রের সমালোচনা, ঠিক সেরকমটা তেভাগা আন্দোলনের মধ্যে খুব প্রকটভাবে হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছু উদাহরণ অবশ্যই দেওয়া সম্ভব, যেমন: দিনাজপুরের মতন জায়গায় একজন মহিলা, রাজনৈতিক সভার জনপরিসরে তার স্বামীর দিকে আঙুল তুলে বলেন— ‘আমার কমরেডের কি অধিকার যে সে আমার গায়ে হাত তুলবে?’ কিন্তু সেক্ষেত্রেও ‘কমরেড’ শব্দটা জরুরি। কমরেডের স্বধর্মবিচ্যুতির বিরুদ্ধে এবং সাম্যের পক্ষে এই মহিলার সওয়াল। সাম্যের রাজনীতি চল্লিশের দশকে অন্য রূপে অন্য পন্থায় নারীবাদকে চালনা করছিল, সে খবরও আমরা এখান থেকে পাই। এবং একইসঙ্গে গোষ্ঠীর, সমষ্টির ধারণা তেভাগার নারীচেতনাকে রাজনৈতিক করে তোলে— সেটাও আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু রানি দাশগুপ্তের বক্তব্যে একটা কূটাভাস আমি পাই। তিনি বলেছিলেন, তেভাগা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে পিতৃতন্ত্র ছিল কিন্তু লিঙ্গ-পরিচিতির (Gender) ভিত্তিতে বৈষম্য ছিল না। পরবর্তীকালে যখন আমি কাজ করতে শুরু করি আশি-নব্বইয়ের দশকে, ব্যক্তিচৈতন্যের ভিত্তিতে সংগঠিত নারীবাদের পাঠের সঙ্গেই আমি পরিচিত ছিলাম, আমার ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা পরিচিত ছিল। নারীবাদের এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো দিয়ে সমষ্টির চিন্তা-চৈতন্যকে কীভাবে বুঝব? সেটা বোঝার ক্ষেত্রে কি আমার কোনও অপারগতা কাজ করে বা করবে? কোনও একটা বিশেষ জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিধি কি তেভাগার সমষ্টিকেন্দ্রিক নারীচৈতন্য, সাম্যবাদী নারী রাজনীতিকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে না? এটা আমার কাছে একটা মস্ত বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। আমার মনে হয়, তেভাগা আন্দোলনের মহিলা রাজনৈতিক কর্মীদের বিশ্বাস, ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক হিসেবে আমার নিজের বিশ্লেষণী যাত্রাটাও অনেক দীর্ঘ হয়ে যায়, বা বলা যায় অনেকটাই জটিল, বহুমুখী ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

মৌখিক ইতিহাসে, ঐতিহাসিকের সঙ্গে বক্তার সম্পর্কের সূত্রে উঠে আসে বিষয়িতার প্রসঙ্গও। ঐতিহাসিক যার বা যাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তাদের বিষয়িতা নির্মাণের ক্ষেত্রে দু’ ধরনের প্রভাব কাজ করে মূলত। এক দিকে থাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যষ্টিগত চেতনা যা প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্যের বোধকে জাগরিত করে, আর অন্য দিকে থাকে আত্মচেতনা, অন্তরের অনুভব-মহল। উভয় মাত্রাই একে অন্যকে প্রভাবিত করে এবং গড়তে সাহায্য করে। সর্বোপরি মৌখিক আখ্যানের বয়ানবিশ্বে একটি সদেহ নারী-বিষয়ীর জন্ম হয়। যে বিষয়ীর বস্তুত্ব থাকে এক দিকে মতাদর্শ, অভিজ্ঞতা, গার্হস্থ্যের রাজনৈতিকতায় অন্য দিকে গার্হস্থ্য থাকে সাম্য, ব্যষ্টির চৈতন্যমণ্ডলে। যার একটা দিক যেমন ইতিহাসের আঘাতে সংগঠিত হয় তেমনি অন্য দিক ইতিহাসের সম্ভাবনাকেও নিয়ন্ত্রণ করে, প্রত্যাঘাত করে। যেমন রানি দাশগুপ্ত সহ আরও অনেক মহিলা রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেই কিন্তু ব্যষ্টিচেতনার ভাব তাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিচৈতন্যকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। আবার তাদের দুর্ভিক্ষের ব্যক্তিঅভিজ্ঞতা একটা ব্যষ্টিচৈতন্যকে নির্মাণ করতেও সাহায্য করেছিল। এখানে, নারীর ব্যক্তিচেতনা থেকে ব্যষ্টির সাম্যচৈতন্যে এক রকমের রূপান্তরের কথা আমরা ভাবতে পারি। এবং তেভাগার কথা পড়তে গিয়ে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিকের বিভেদ এবং আমাদের পিতৃতন্ত্রের তথাকথিত ধারণা সম্পর্কে বার বার সন্দিগ্ধ হয়ে পড়তে হয়।

বক্তার এই বিষয়িতার সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে, আগেই বলছিলাম, আন্তঃবিষয়িতার প্রশ্ন। যে আন্তঃবিষয়িতার এক পিঠে থাকে ঐতিহাসিকের নিজের বিষয়িতা। মূলকথা হল, বক্তার বিষয়িতাকে বুঝতে গিয়ে, ধরতে গিয়ে ঐতিহাসিকের নিজেরও যেন এক প্রকারের আন্তঃবৈষয়িক পরিবর্তন হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়: বাংলাদেশের দিনাজপুরে উত্তরপালিয়া গ্রামে রাজনৈতিক কর্মী রানি মিত্তির১০ গিয়েছিলেন। তিনি সেখানকার মানুষ হেলেকেতু সিংহের স্ত্রী জয়ার সঙ্গে কাজ করতেন। ওখানকার মহিলাদের উনি রানি ভিক্টোরিয়ার গল্প বলতেন। যে গল্পের মধ্যে দিয়ে ওঁদের মনে প্রত্যয় জন্মায় যে, ইংলন্ডে যদি একজন মহিলা দেশ চালাতে পারে, তো এখানকার মহিলারাও বিপ্লব করতে পারবে। এবং এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাকে কাজে লাগিয়ে রানি মিত্তির ওখানকার পুরুষদের মনেও নারীবাদী একটা প্রস্থানের পরিসর খুলে দিতে পেরেছিলেন। এই উদাহরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তা ঘটছিল সম্পূর্ণ অন্য প্রেক্ষিতে ও পদ্ধতিতে। শহুরে কর্মী রানি মিত্তির ও গ্রামের জয়ার মধ্যে এখানে এক রকমের আন্তঃবিষয়িতার সম্বন্ধ গড়ে উঠছে। মণিকুন্তলা সেন১১-এর সেদিনের কথা গ্রন্থের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই যে, শহুরে মহিলা কর্মী কীভাবে নিজের সঙ্গে দরিদ্র গ্রামীণ মহিলাদের সাংস্কৃতিক দূরত্ব দূর করতে গিয়ে সাবান ব্যবহার করা বন্ধ করছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে লুতসুই নামক আরেক জন কর্মীর কথা বলেছিলেন, যিনি গ্রামীণ মহিলা চাষিদের কাছে গিয়ে হঠাৎ গোধূলির লাল আকাশের সৌন্দর্যের কথা বলাতে মহিলারা তার থেকে দূরে সরে যায়; এবং পরে লুতসুই জানতে পারেন যে, ওই মহিলারা আসলে সেই আকাশ দেখে দুঃখ পেয়েছিল, কারণ সেই আকাশে বৃষ্টি না হওয়ার, ফসল না ফলার সংকেত ছিল। অর্থাৎ এক দিকে যেমন বিষয়িতার বৈচিত্রপট হয়ে ওঠে একটি সমাজ–সংস্কৃতির মৌখিক ইতিহাসের মূলগত উপাদান তেমনি অন্য দিকে মৌখিক ইতিহাসে ঐতিহাসিক ও বক্তার আন্তঃবিষয়িতায় একইসঙ্গে আধুনিক জীবনের চরিত্রও ধরা পড়ে।

কিন্তু মৌখিক আখ্যান রচনার এতরকম করণকৌশল নিয়ে আলোচনা করার পরেও গূঢ় কিছু জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতা থেকে যায়। বক্তা কি গোপন করছেন তা ঐতিহাসিকেরা কীভাবে জানবেন? যিনি ঐতিহাসিক তিনি কী করে বিশ্বাস করবেন যে বক্তা তার কাছে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য, অনুভবগুলি ভাগ করে নেবেন? ভাগ করে না নেওয়ার পিছনে অন্তত তিন ধরনের কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব: ১) বক্তা মনে করতে পারেন যে, বক্তার সেই পরম গোপন অনুভবকে যখন বক্তা বলবেন তখন হয়তো তত গুরুত্বপূর্ণ করে তিনি প্রকাশ করে উঠতে পারবেন না, হয়তো তাঁর সেই গুরুত্বপূর্ণ গোপন অনুভব প্রকাশ্যে এসে আপন মর্যাদা হারাবে। ২) অথবা বক্তার মনে হতে পারে যে, সে-অনুভব যদি ব্যক্তও হয়, ঐতিহাসিক কি সেই অনুভব বুঝবেন? ৩) কিংবা কিছু জিনিস গোপন করে রাখা, বক্তার নিজস্ব রাজনৈতিক বাছাই হতে পারে, তিনি এটিকে নিজের অধিকার বলে মনে করতে পারেন। গোপন রাখার মধ্যে দিয়ে তাঁর সাংস্কৃতিক সচেতনতা, রাজনৈতিক দাবি প্রকট হয়ে উঠতে পারে। এই সূত্রে Rigoberta Menchu-র জীবনের একটি ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চমৎকার। রিগোবের্তা যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে ওঠেন, তখন তিনি প্রথমেই Quiche (k’iche) ভাষায় একটি প্রার্থনা দিয়ে শুরু করেন এবং তার অনুবাদ তিনি করেন না। কিন্তু কেন করেন না? কোনও জ্ঞানতাত্ত্বিক কারণ, না কি কোনও রাজনৈতিক কারণ? হার্ভার্ডের লোকেরা, মায়ান (Mayan)-এর লোকেদের বিশ্বাস আর পরিবেশ যার মধ্যে থেকে এই প্রার্থনাটা তৈরি হয়, সেটা কি বুঝত? অথবা রিগোবের্তা কি অনুবাদের সম্ভাবনাকে রাজনৈতিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন? তাঁর গ্রন্থে, তাঁর বক্তব্যের অনেক জায়গাতেই তিনি বলেন যে তিনি কিছু বিষয় বুঝিয়ে বলতে পারবেন না। কারণ উত্তর আমেরিকার শ্রোতারা সেটা বুঝবে না। আরও বিশেষভাবে বললে বলা যায় যে, রিগোবের্তা বোঝাতে চান না। ততটুকুই বোঝান যতটুকু তিনি নিজে বোঝাতে চান, যতটুকু তার রাজনীতি তাঁকে বোঝানোর সম্মতি দেয়। নিজের আঞ্চলিকতা, সংস্কৃতির দায়ভার, নিজের জনগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার স্বার্থ তথা আপন রাজনীতিকে তিনি রক্ষা করেন এবং সেই রাজনীতির দাপুটে প্রকাশ হিসেবে, মৌখিক আখ্যানে বারংবার তাঁর নৈঃশব্দ্যকেই পারফর্ম করে চলেন।

টীকা সূত্রনির্দেশ

. এককথায় বলতে গেলে মৌখিক ইতিহাস বিষয়টা কোনও ঘটনা, ব্যক্তি বা পরিবার বিষয়ক কিছু মৌখিক তথ্য, সাক্ষাৎকার, ভিডিয়ো, টেপ— এই ধরনের ‘অলিখিত’ সূত্র থেকে একটা ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টা।

. Rigoberta Menchu, I Rigoberta Menchu: An Indian Woman in Guatemala, ed. Elizabeth Burgos-Debray, trans. Ann Wright (London: Verso, 1984).

. Domitila Barrios de Chungara, Let Me Speak! Testimony of Domitila, a Woman of the Bolivian Mines (New York: Monthly Review Press, 1978).

. উনিশ শতকের নতুন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটির কথা লিখতে গিয়ে ডুরখেইম একটি ধারণার কথা বলেছিলেন, যাকে বলা হয় ‘Collective Consiousness’। ‘সমষ্টি মন’ বলতে সেইরকম কোনও একটা কিছুর কথাই প্রাথমিকভাবে মনে হয়। তবে চেতনা শব্দটার বদলে মন শব্দটা ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটাকে এভাবেও ভাবা যায় যে, একদল মানুষের চিন্তার ধরন-গড়ন একইরকম। এই অর্থে জিনিসটাকে বোঝা সম্ভব।

. Daphne Patai, ‘Constructing a Self: A Brazilian Life Story’, Feminist Studies, Vol. 14, No. 1, 1988, pp. 143-166.

. David Stoll, Rigoberta Menchu and the Story of All Poor Guatemalans, Westview Press, 1999.

. সুভদ্রা কুমারী চৌহান (১৯০৪-১৯৪৮)-এর অন্যান্য কবিতা তেমন বিখ্যাত না হলেও ‘ঝাঁসি কি রানি’ কবিতাটি খুবই জনপ্রিয়।

. Alessandro Portelli, The Death of Luigi Trastulli and Other Stories: Form and Meaning in Oral History (Albany: State University of NewYork Press, 1991).

. ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ কিসান সভার (কমিউনিস্ট পার্টির কৃষকশ্রেণির মঞ্চ) নেতৃত্বে যে কৃষক আন্দোলন হয়, সেটাই ভারতের ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলন শুরু হয় বাংলা থেকে। এই বিষয়ে আরও বিশদে জানার জন্য এই বইটি দেখুন: Kavita Panjabi, Unclaimed Harvest: An Oral History of the Tebhaga Women’s Movement (New Delhi: Zuban, 2016)।

১০. মিত্তির ছিল তাঁর বিবাহপূর্ব পদবি, বিবাহের পর পদবি হয় দাশগুপ্ত।

১১. মণিকুন্তলা সেন, সেদিনের কথা (কলকাতা: নবপত্র প্রকাশন, ১৯৮২)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *