মেয়েদের কথা

মেয়েদের কথা

খেরোর খাতার শেষ কথা মেয়েদের নিয়ে বললেই সবচেয়ে ভাল হয়, কারণ ঘরে ঘরে সব তর্কে মেয়েদেরই শেষ কথা থাকে। তবে মেয়ে বলতে আমি এখনকার মেয়েদের কথাও বলছি না, আমার যৌবনকালের মেয়েদের কথাও বলছি না। এখনকার মেয়েদের আমি সবসময় মেয়ে বলে চিনতে পারি না। কী চেহারায়, কী সাজে, কী কর্মদক্ষতায়, কোনও দিক দিয়েই তারা ছেলেদের চেয়ে আলাদা নয়।

আমি ভাবছিলাম একশো বছর আগেকার মেয়েদের কথা। কী তেজ ছিল তাঁদের! গায়েও কী জোর! আজকালকার মেয়েরা তো পুরুষদের সমান হয়ে গেছে, সমান চাকরি করে, সমান মাইনে পায়, সমান ভোট দেয়, সমান আন্দোলন করে। তা হয়তো করে, কিন্তু সে এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। দাঁড়াক তো এরা সেকালের গিন্নিদের পায়ের কাছে!

কী রাঁধতেন তাঁরা—হ্যাঁ, আমি একশোবার বলব ঘরকন্নাও হল মেয়েদের এলাকা, তার বাইরে যে অধিকারই থাকুক না কেন—রেঁধে গাঁসুদ্ধ সব্বাইকে হাতের মুঠোর মধ্যে রেখে দিতেন। দেখতে হয়তো সবাই এখনকার মেয়েদের মতো সুন্দরী ছিলেন না। মুখেও কিছু মাখতেন না; নুড়ো করে নখ কাটতেন, মাথায় উব্‌কো খোঁপা বাঁধতেন—বিশ্বাস করুন, এসবে সুন্দর না দেখাতে পারে, কিন্তু যেমনি আরাম, তেমনি কাজে সুবিধে। প্রায় চল্লিশ বছর করে দেখেছি। গিন্নিরা বাড়িতে সাদা কাপড় পরতেন, বেরুলে হয়তো গরদ, তসর। ভারী ভারী সোনার গয়না থাকলে পরতেন, না থাকলে শাঁখা আর লোহা। নকল জিনিস গায়ে তুলতেন না। সে যাক্‌ গে, আসলে রূপের কথা বলছিলাম না, বলছিলাম তেজের কথা।

পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর ঠাকুমা কি ওইরকম কিছু হতেন লক্ষ্মীদেবী। মজিলপুরে ওঁদের বাড়ি ছিল। কলকাতার মাইল ত্রিশেক পুব-দক্ষিণে; সুন্দরবনের গা ঘেঁষে। সে সুন্দরবন এখনকার সুন্দরবন নয়। এখন তো শুনি বাঘের চাষ করতে হয়। সেকালে ওখানে বাঘ কিলবিল করত। অবিশ্যি নিশ্চয়ই খুব ভাল মাছ পাওয়া যেত, নইলে লোকে থাকবে কেন? তবে ওঁদের বেশিরভাগই বৈদিক ব্রাহ্মণ ছিলেন, নিরামিষ খেতেন।

কিন্তু বাঘরা তো আর নিরামিষ খেত না। শীতকালে হরদম এসে তারা গাঁয়ে ঢুকে হামলা করত। তাদের ভয়ে ওরা একটা বুদ্ধি করেছিল। ছয়-সাত ঘর আত্মীয়কুটুম্ব কাছাকাছি বাড়ি তৈরি করে, চারদিক ঘিরে দু’মানুষ উঁচু পাঁচিল দিত। বাঘ সে পাঁচিল টপকাতে পারত না।

সামনের দিকে পাঁচিলের গায়ে একটিমাত্র সদর দরজা। সেটি বন্ধ করে দিলেই অনেকটা বাঁচোয়া। মুশকিল হল, যার যার আলাদা খিড়কি-দোর। প্রাণের ভয়ে যে যার খিড়কি আগলাত। তবে মাঝেমধ্যে ভুলও হত।

শীতকালে এক দিন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। শিবনাথের ঠাকুরদার বাবা সন্ধ্যা-আহ্নিক করছেন। তাঁর ছেলে আহ্নিক সেরে, খড়ম পায়ে দিয়ে উঠোনে পায়চারি করছেন। তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী রান্না চড়িয়েছেন।

এমন সময় পাশের বাড়ি থেকে চিৎকার! ‘বাঘ! বাঘ! বাঘ এসেছে!’ কী ব্যাপার দেখবার জন্য ঠাকুরদা যেই না সেদিকে এগিয়ে গেছেন, অমনি বাঘের সঙ্গে এক্কেবারে মুখোমুখি! ঠাকুরদা তো কাঠ! তারই মধ্যে একবার কোনওমতে চেঁচিয়ে বললেন, ‘বাবা! সত্যি বাঘ! আমাকে নিল বলে!’

বুড়ো বাবা বলেন, ‘দাঁড়িয়ে থাক্‌! নড়িসনে! বাঘের দিকে পেছন ফিরিসনে! তাহলেই বাঘে নেয়!’ হাঁকডাক শুনে যে যেখানে ছিল দৌড়ে এল। কিন্তু এ অবস্থায় কী করা উচিত স্থির করবার আগেই উনুন থেকে মস্ত এক জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে, ‘তবে রে!’ বলে লক্ষ্মীঠাকরুণ ছুটে এলেন!

সেই গন্‌গনে আগুন আর সম্ভবত লক্ষ্মীঠাকরুণের ওই উগ্র বেপরোয়া চেহারা দেখে, বাঘমশাই ল্যাজ তুলে খোলা খিড়কি-দোর দিয়ে সেই যে পালাল আর এমুখো হল না। বলাবাহুল্য সঙ্গে সঙ্গে খিড়কি বন্ধ হল। রাগারাগি, বকাবকি।

আমার ঠাকুরদার ঠারাইন-পিসির জাঁদরেল দশাসই চেহারা ছিল। লম্বায় চওড়ায় প্রায় সমান। কুচকুচে কালো রং। চুলগুলো পুরুষদের মতো ছাঁটা। পরনে থান। একদিন বিকেলে বড়-বাগানে নারকোল পাড়াচ্ছেন। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে নাতনি এসে বলল, ‘তেঁতুলতলায় তোমার সাদা বাছুরকে বাঘে ধরেছে!’

আর যায় কোথা! নারকোল রইল পড়ে, হাতে এক জোড়া ডাব ছিল, তাই নিয়ে পিসি ছুটলেন তেঁতুলতলায়। সেই সুযোগে বাকিরা ‘বাঘ! বাঘ!’ বলে হাঁক পাড়তে পাড়তে, মাঠের দিকে ছুটল!

চ্যাঁচামেচি শুনে, মাঠে যারা কাজ করছিল তারা কাস্তে, কুড়ুল, লাঠি, খেঁচা, যে যা পেল নিয়ে দৌড়ে এল। তেঁতুলতলায় পৌঁছে দেখে দু’-চক্ষু লাল করে পিসি ডবল-ডাব দিয়ে বাঘের মাথায় পিটিয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে তাঁকে টেনে আনতে হল।

সেকালের গিন্নিরা এইরকম ছিলেন। গল্প শুনেছি ঢাকার ওদিকে বাড়িতে ডাকাত পড়লে মা-কালী সেজে বিকট গর্জন করে কাদের বাড়ির গিন্নি ডাকাত ভাগিয়েছিলেন।

জানেন, আমি আমার বাবার ৮৪ বছরের মামিকে দেখেছি পদ্মফুলের মতো সুন্দর, বসে বসে হুঁকো খাচ্ছেন! তবে আবার আধুনিক কাকে বলব? এই বলে খেরোর খাতা বন্ধ করলাম।

_____

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *