মেমসায়েবদের মতিগতি

মেমসায়েবদের মতিগতি

শ্বেতাঙ্গিনীদের ‘মেমসায়েব’ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ ভারতীয়দের মধ্যে চালু থাকলেও, বস্তুত, শ্বেতাঙ্গিনীরা শুধুই মেম। ‘মেমসায়েব’ শব্দ যুগলের মধ্যে সায়েবের সঙ্গে মেমের উপস্থিতি অনিবার্য মনে হয়। কিন্তু কোম্পানির আমলে প্রথম দিকে কলকাতার সায়েব সমাজ ছিল প্রায় মেমশূন্য। কারণ, এদেশে মেমদের আসার পথে বড়ো বাধা ছিল কোম্পানির খোদ কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা। পরিচালক সমিতি কোনও ইংরেজ কুমারীকে ভারতে আসার অনুমতি দিত না। লুকিয়ে-চুরিয়ে এলেও পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেওয়া হত তার স্বদেশ, বিলেতে।

১৭৫৫ সালের ৩১ জানুয়ারি এক চিঠিতে পরিচালক সমিতি কলকাতার কাউন্সিলকে জানায়, ‘হার্ডউইক’ জাহাজের ক্যাপ্টেন স্যামসন তার জাহাজে মিস্‌ ক্যাম্পবেল নামে এক ইংরেজ তরুণীকে তুলে নিয়ে মদিরা দ্বীপে পাড়ি দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ক্যাম্পবেল ওই জাহাজে বাংলায় গিয়ে নামতে পারে। যদি তেমন ঘটে, ‘হার্ডউইক’ জাহাজের মালিকের খরচে যেন প্রথম যে জাহাজ ইংল্যান্ডে আসবে, তাতে ফেরত পাঠানো হয়। বিলেতে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ কোনও ভাবেই চাইত না, এদেশে শ্বেতাঙ্গিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। প্রতি বছর কলকাতার সায়েবদের তালিকা পাঠানো হত বিলেতে। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হত সেই তালিকা। কোনও অবিবাহিতা ইংরেজ মহিলার নাম তালিকায় থাকলে, হুকুম হত তাকে বিলেতে ফেরত পাঠানোর জন্য। এক বছর আগে মিস্‌ ক্রিশ্চিয়ানা রসকে ইউরোপে ফেরত পাঠানো হয়েছিল একটা ফরাসি জাহাজে।

সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৫৬ সালে যখন কলকাতা আক্রমণ করেন, সারা বাংলায় সায়েবের সংখ্যা ছিল ৬৭১, মেমের সংখ্যা মাত্র ৮০। চুয়ান্ন বছর পরে ১৮১০ সালে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪০০০ ও ২৫০। কোম্পানির আমলে সব সময়ই কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে সায়েবরাই সংখ্যার বিচারে প্রভুত্ব করত। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় কুমারী মেমের আকাল সায়েবদের জীবনে কী পরিমাণ হতাশা সৃষ্টি করত, তা বোঝা যেত বিলেত থেকে কলকাতায় একটা জাহাজ এলে। সায়েবরা হন্যে হয়ে খুঁজত যাত্রী তালিকায় কুমারীর নাম। বন্দরে জাহাজ ভিড়লে শুধু অবিবাহিত তরুণ সায়েবরাই নয়, বয়স্ক ধনী বিপত্নীকরাও জড়ো হত জাহাজ ঘাটে। লটারিতে পুরস্কার পাওয়ার মতো কপাল ঠুকে অপেক্ষা করত সকলে গভীর প্রত্যাশায়। জাহাজ ঘাট ছাড়াও সায়েবদের ভিড় জমত গির্জায় যেখানে মেমসায়েবরা যেত অন্তত রবিবারের দিনটিতে। এমনকী, কলকাতায় এসে মেমসায়েবরা যে বাড়িতে উঠত, সেই বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করত অবিবাহিত সায়েবরা। পর পর তিনটে দিন সেই কুমারী মেমের দরজা খোলা থাকত তাদের জন্য। মেমসায়েব এক রকম প্রায় দরবার বসাতেন। এক এক করে প্রত্যেক পাণিপ্রার্থীকে সুযোগ দেওয়া হত কুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। দরবার শেষ হওয়ার আগেই অসংখ্য প্রস্তাব জমা পড়ত কুমারীর কাছে। কুমারী মেমের অভাবে কোনও মেমসায়েব বিধবা হলে আবার নতুন জীবনসঙ্গী পেতে অসুবিধে হত না। কোনও শ্বেতাঙ্গিনী পতি হারালে, তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হতে না হতেই তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসত ভূরি ভূরি। এমন ঘটনাও ঘটত যে, কোনও সায়েব মরণাপন্ন, জীবনের আশা নেই। ওই অবস্থাতেই তার পত্নীর সম্মতি প্রার্থনা করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাত কোনও অবিবাহিত সায়েব। সঙ্গে অনুরোধ থাকত, বিধবা হওয়ার পর তার প্রস্তাবটা যেন বিবেচনা করা হয়। বেগম জনসনের বারো বছর বয়সে প্রথম বিয়ে হয়। উনিশ বছর বয়সে পঞ্চমবার বিয়ে হতে তার অসুবিধে হয়নি।

১৮৩৮-এ শ্রীমতী পোসটানস (Postans) তাঁর স্মৃতিকথায় একজন গোলন্দাজের বিধবা পত্নীর কথা লিখেছেন। ‘বিধবাটি ছিল যথার্থই আকর্ষণীয়া। তার স্বামীর মৃত্যুর এক ঘণ্টা পরে তার স্বামীর তিনজন সহকর্মী তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এক সপ্তাহের মধ্যে ঘুচে যায় তার শোকাবেশ। কিন্তু মহিলার দ্বিতীয় স্বামীও মারা যায় এবং সে তৃতীয়বার বিয়ে করে। আবার বিধবা হয় সে। হাইমেন (Hymen-গ্রিক বিবাহ দেবতা) আবার তার রহস্যময় বিবাহবন্ধন ঘটান। শেষবারের মতো বিধবা হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে।’ এমন ঘটনাও ঘটত যে, স্বামী বেঁচে থাকতেই মেমসায়েব তার প্রেমিককে বাগদান দিয়ে ফেলত। ভরসা রাখত প্রকৃতির ওপর। বিরূপ জল-হাওয়ায় স্বামীর অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে। ১৭৬৭-তে জনৈক স্টারনে (Sterne) এলিজা ড্রাপারকে (Eliza Draper) লিখেছিলেন, ‘বিধবা হওয়ার কথা বলছ— এলিজা, আমি প্রার্থনা করি, যদি কখনও ওইরকম তোমার কপালে কিছু ঘটে, নিজেকে কোনও ধনী নবাবের হাতে তুলে দেওয়ার কথা চিন্তা করবে না। আমি তোমাকে বিয়ে করার কথা ভেবে রেখেছি। আমার স্ত্রী বেশিদিন বাঁচবে না।’

বিধবাকে বিয়ে করার প্রতি সায়েবদের আগ্রহের একটা বিশেষ কারণ ছিল। এদেশে শ্বেতাঙ্গ সমাজে একটা মজাদার প্রবাদ প্রচলিত ছিল— ‘বছরে তিনশো, মৃত অথবা জীবিত।’ এর অর্থ হল, একজন সিভিলিয়নকে বিয়ে করা মানে বছরে তিনশো পাউন্ডধারী পতিলাভ। দুর্ভাগ্যক্রমে পতির মৃত্যু হলেও একই পরিমাণ পেনশনের অধিকারিণী হত বিধবাটি। সুতরাং বিধবাকে বিয়ে করে সায়েবরা লাভবান হত দু’ভাবে, পত্নীলাভ এবং তার অর্থ লাভ। এই নিয়মটা অবশ্য পরে কিছুটা পালটে যায়। শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়, বিধবার মৃত পতির কার্যকাল যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক বছর পার হয়ে থাকে, তবেই বিধবা পেনশন ভোগ করতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, অনেক সায়েব কোম্পানির ফৌজে ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে কাজ করত। তারা কিন্তু কোম্পানি কিংবা রাজকীয় বাহিনীর নিয়মিত সৈনিকের মতো পেনশন পেত না। তাদের বিধবারা বলা বাহুল্য, সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। এর পরিণাম ছিল দুঃখজনক। স্বামীর মৃত্যুর পর চরম আর্থিক সংকটে পড়ে তারা বাধ্য হত বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করতে। এরকম তিনজন শ্বেতাঙ্গিনী বিধবার জবানবন্দিতে উঠে আসে তাদের পতিতাবৃত্তি গ্রহণের প্রেক্ষাপট। অ্যাবি ম্যাকটাগেট (Abby Mactagget) বিবৃতিতে বলেছে, তার স্বামী রাজকীয় বাহিনীতে ভাড়াটে সেনা হিসেবে গাজিপুরে কর্মরত ছিল। মহিলাটি তিন বছর হল এদেশে এসেও স্বামীর সাক্ষাৎ পায়নি। কলকাতায় সহায়-সম্বলহীন হয়ে দিন কাটাচ্ছে। রেবেকা ডোভ (Rebeca Dove) তার স্বামীর সঙ্গে এসেছিল এদেশে। স্বামী তাকে কলকাতায় রেখে চলে যায় শ্রীলঙ্কায় তার বাহিনীর সঙ্গে। কয়েক মাস পরে ফেরার পথে মৃত্যু হয় জাহাজেই। যা সামান্য কিছু অর্থ ছিল, নিঃশেষ হওয়ার পথে। একই ভাবে ব্রিগেট গোগিনস (Bridget Goggins)-এর স্বামীর মৃত্যু হওয়ায় সে চরম অর্থ সংকটে পড়ে। তাই পতিতাবৃত্তি গ্রহণ।

তারা লালবাজার এলাকায় বাস করত। ওই এলাকার সম্ভ্রান্ত, ভদ্র সায়েব পরিবারগুলো এতে আপত্তি তোলে। ভদ্র এলাকায় তাদের উপস্থিতি সরকারের পক্ষেও উদ্বেগের কারণ ছিল। এদেশের শাসক ইংরেজ। নেটিভদের চোখে তাদের চরিত্রের এই অবাঞ্ছিত দাগটা বিড়ম্বনায় ফেলেছিল সরকারকে। কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে কর্তৃপক্ষ ওই তিন মহিলাকে সাময়িকভাবে কেল্লায় পাঠিয়ে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে স্বদেশে পাঠাবার নির্দেশ দেয়।

আঠারো বা উনিশ শতকের প্রথম দিকে কোম্পানির কর্মচারীদের বিধবা পত্নীর পেনশন পেতে অসুবিধে হত না। এদেশে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ বিলেতের অনুমোদন পাওয়া যাবে, এরকম নিশ্চিত হয়েই বিধবাদের পেনশন মঞ্জুর করত। কিন্তু বিধবাদের পেনশন দেওয়ার নিয়ম-কানুন ক্রমশ কড়া হতে থাকে। উনিশ শতকের তিরিশের দশকে দেখা যায়, কলকাতার কর্তৃপক্ষ পেনশনের সমস্ত আর্জি পাঠিয়ে দিচ্ছে বিলেতে। তাদের অনুমোদন পাওয়ার পর পেনশন মঞ্জুর করা হত। J.W. Ricketts ১৮০৭ থেকে তেইশ বছর কোম্পানির চাকরি করেছিলেন। ১৮৩৫-এর ৮ আগস্ট তাঁর বিধবা পত্নী গভর্নর জেনারেল মেটকাফের কাছে আর্জিতে বলেন, দুই মেয়ে এবং পাঁচ ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। পেনশন না পাওয়ায় বিশেষ কষ্টে আছেন। উত্তরে সরকার থেকে তাঁকে জানানো হয়, সরকারের পেনশন মঞ্জুর করার ক্ষমতা নেই। তাঁর আর্জি বিলেতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে অনুমোদনের জন্য।

আঠারো শতকে কলকাতায় কোনও কুমারী মেমের একা থাকার প্রশ্নই উঠত না। Hartly House-এর লেখিকা লিখেছেন, গির্জায় মেয়েরা পৌঁছলেই পুরনো প্রথানুযায়ী পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সমস্ত অফিসাররা হাত বাড়িয়ে দিত তাদের আসন গ্রহণে সাহায্য করতে। জাহাজ এসে পৌঁছলেই তারা ঠিক করে নিত, গির্জায় গিয়ে কে কোন সুন্দরীর সেবা করবে। দেখা যেত, এরপরই কোনও রকম আনুষ্ঠানিক পরিচয় বিনিময় ছাড়াই তাদের দু’হাত এক হয়েছে।১০

আঠারো শতকে কলকাতা থেকে যেসব সায়েব স্বদেশে ফিরে যেত, তাদের মধ্যে কারওর কারওর অকল্পনীয় অমিতব্যয়িতা দেখে বিলেতের কুমারীদের চোখে রঙিন সুখের ছবি ভেসে উঠত। ক্লাইভ তো বিলেতে ফিরে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছে প্রায় কল্পতরু হয়ে উঠেছিলেন। দু’হাতে অর্থ বিলিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে। তাই একবার কলকাতায় পৌঁছে একজন সিভিলিয়নকে বাগে এনে জীবনসঙ্গী করতে পারলে ভোগের সব উপচার হাজির হবে জীবনে, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল বিলেতের কুমারীদের মনে। আঠারো শতকে কলকাতায় মেমদের সংখ্যাল্পতার কারণে অনেক অবিবাহিত সায়েবের শরীরে প্রৌঢ়ত্ব ঘনিয়ে আসত একজন জীবনসঙ্গিনী লাভের আগেই। তারা ব্যগ্র হয়ে উঠত কলকাতায় সদ্য আসা ইংরেজ সুন্দরীর পায়ে তাদের অর্জিত সম্পদ ঢেলে দিতে। বিত্তহীন তরুণ সায়েবরা ধনী, পরিণত বয়সের সায়েবদের কাছে হেরে যেত তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে।

পরিস্থিতি দ্রুত পালটাতে থাকে উনিশ শতকে, বিশেষ করে এই শতকের চল্লিশের দশক থেকে। ইংল্যান্ডে তখন চরম দারিদ্র্য।১১ এদিকে এদেশে আঠারো শতকের সেই টাকার গাছ মুড়িয়ে গেছে। দুঃসংবাদটা অজানা ছিল ইংরেজ ললনাদের। Victor Jacquemont তাঁর ‘Letters from India, 1829-1932’ গ্রন্থে লিখেছেন, কপর্দক শূন্য যেসব তরুণী বিলেতে বর জোটাতে ব্যর্থ হত, তারা জাহাজ ভর্তি হয়ে পাড়ি দিত ভারতের উদ্দেশে। লক্ষ্য ছিল, এদেশে এসে কোনও সামরিক অফিসার বা সিভিলিয়নের কাছে নিজেকে বেচে দেওয়া,১২ বয়স যাই-ই হোক না কেন। এই মন্তব্যকে মেনে নিতে পারেননি এমা রবার্টস। তাঁর মতে, বিলেতের মেয়েরা এদেশে কোম্পানির এলাকায় আসত কোনও বয়স্ক ধনী সায়েব-নবাবের হাতে নিজেদের তুলে দিতে, এই ধারণা ভ্রান্ত। কারণ, ওই ধরনের ইংরেজ পুরুষ তখন কলকাতায় বিরল। পরিণত বয়সের সায়েবরা হয় এদেশে আসার সময় বিবাহিতা পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে আসত, কিংবা চিরকুমার থাকার পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসত। কোনও শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরীর চমক দেওয়া চোখ, হাসিমাখা অধর কিংবা গালের রমণীয় টোল তাদের নিস্তরঙ্গ চিত্তে ঢেউ তুলতে পারত না। কোনও বয়স্ক ধনী সায়েব পাণিপ্রার্থী হয়ে তাদের পায়ে সোনা-মুক্তোর রাশি উজাড় করে ঢেলে দেবে, নীল নয়না সুন্দরীদের এই আশা ছিল ভ্রান্ত। এদেশে আসার পর বাস্তব সম্পর্কে বোধোদয় হত। তারা সিদ্ধান্ত নিত, বিয়ে যদি করতেই হয়, প্রেম করে করতে হবে। আধ ডজন সাবালটার্নের প্রস্তাবের মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সেই মামুলি প্রেমিক পৌঁছে যেতে পারে উঁচু সামরিক পদে।১৩

বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, কলকাতায় মেমসায়েবদের আসার ভাটায় জোয়ার আসতে শুরু করে মোটামুটিভাবে ১৭৭০-এর দশক থেকে। ১৭৫৪ পর্যন্ত কলকাতায় শ্বেতাঙ্গিনীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। ফলে, সায়েব সমাজে বিয়ের ঘটনাও ছিল বিরল। ১৭১৩ থেকে ১৭৫৪, একচল্লিশ বছরে কলকাতায় সায়েব-মেমের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল ৪১৭টা, অর্থাৎ বছরে গড়ে মাত্র দশটার মতো। মেমদের মধ্যে একাশিজন ছিল বিধবা অথবা বিবাহ বিচ্ছিন্না। একশো সাতজন কলকাতার শ্বেতাঙ্গিনী।১৪

১৭৮০-র দশকের কোনও একটা সময় থেকে বিলেতের মেয়েরা অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, দীর্ঘ সমুদ্র পথে ভ্রমণের ধকল স্বীকার করে ভারতের উদ্দেশে পাড়ি দিতে শুরু করে প্রতি বছর। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল কোনও অর্থশালী ইংরেজ বা ইউরোপীয়কে বর হিসেবে বড়শিতে গেঁথে তোলা।১৫ তারা বেশির ভাগ ছিল মধ্য বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ধনী সায়েব-বর জোটানো ছিল কষ্টকর। অনেক কুমারীর বিশেষ পছন্দ বলে কিছু ছিল না। কারণ শুধু বরের খোঁজ নয়, সেই সঙ্গে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার তাগিদও ছিল। বিলেতে বেঁচে থাকার জন্য অনেককেই নির্ভর করতে হত অনাথত্রাণ ভাণ্ডারের ওপর। বেশির ভাগ তরুণী অবস্থার চাপে বাধ্য হত তাদের বিবাহিতা বোন বা দূরসম্পর্কিত আত্মীয়ের সঙ্গে ভারতে চলে আসতে। এদেশে এসে পাত্র পাকড়াও করে বিয়ে করতে ব্যর্থ হলে মনে করা হত সেটা তাদের অপরাধ। বিলেতের মানুষ অবশ্য মনে করত ভারতে বিয়ের বাজারে পাত্রের মজুত মাত্রা ছাপিয়ে গেছে।১৬ এলিজাবেথ জেন স্যানডারসনের (Elizabeth Jane Sanderson) মতো রুচিসম্পন্ন মহিলা এবং এমা র‌্যাঙ্গহ্যামের (Emma Wrangham) মতো অসাধারণ রূপসী, গুণবতী ও ভীষণ চতুর মেমদের বর জোটাতে বিলম্ব হয়নি। কিন্তু অনেকের কপালে সেই সৌভাগ্য দেখা দিত না। ১৭৭৫-এর ২১ নভেম্বর ফিলিপ ফ্রান্সিস কলকাতা থেকে শ্রীমতী ক্লাইভকে লিখেছিলেন, ‘অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো আর একটা ঘটনা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। যে সুন্দরীদের আমরা এনেছিলাম, তাদের একজনেরও বিয়ে হয়নি। অনুমান করি, বাজারে জোগান বড্ড বেশি, দর দেওয়ার লোকের অভাব। মনে হয়, বাবাদের উচিত, কুমারী আমদানি আপাতত মুলতুবি রাখা, অন্তত যতক্ষণ না আমরা যা মজুত আছে, তার একটা ব্যবস্থা করে উঠতে পারি।’১৭ অথচ ১৮৩৪ সালেও The Asiatic Journal লিখেছে, ‘এখনও যোগান চাহিদার সমান নয়।’১৭ক মনে হয়, কোনো বিশেষ বিশেষ কারণে কলকাতায় মেমদের আসা কখনও বৃদ্ধি পেয়েছে, কখনও পেয়েছে হ্রাস।

বিলিতি সমাজের উঁচুতলার লেখাপড়া জানা মেয়েরা অবশ্য সকলে বরের সন্ধানে কলকাতায় আসত না। পি জে মার্শাল মনে করেন, আঠারো শতকের শেষ দিকে যেসব মেয়ে ধনী বরের তল্লাশে বিলেত থেকে একাকী এদেশে আসত, তারা বেশ মন্দ স্বভাবের ছিল।১৮ হেনরি ফ্রেডেরিক থম্পসন তাঁর Intrigues of a Nabob গ্রন্থে লিখেছেন, অনেক মেয়ে ভারতে আসার আগে পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত ছিল।১৯ কুমারী মেমদের কলকাতায় বর খুঁজতে আসা ছিল বেপরোয়া জুয়া খেলার সামিল। অনেক সময় তাদের হাতে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার মতো পাথেয় থাকত না। অভীষ্ট সিদ্ধ না হলে কোনও শ্বেতাঙ্গ পরিবারে গভর্নেস হওয়া ছাড়া উপায় থাকত না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো শেষ পর্যন্ত বিত্তহীন কোনও তরুণকে বিয়ে করত। যাদের কপালে বর জুটত না, স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সংগতি থাকত, তারা ফিরে যেত, শূন্য মনে, একাকী।

ইংরেজ তরুণীরা কলকাতায় এসে দেখত, শহরের অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ হয় সামরিক কিংবা অসামরিক কর্মচারী। একজন ফৌজি ক্যাপ্টেন কবে বলনাচের অনুষ্ঠান করবে, সেই আশায় কুমারী মেমরা অপেক্ষা করত অধীর আগ্রহে চাতক পাখির মতো। সকলেই আমন্ত্রিত হত বলনাচের আসরে। সদ্য আগত মেমরা আসার সময় যেটুকু অর্থ নিয়ে আসত, তা উজাড় করে কিনে ফেলত ঝলমলে পোশাক। তারপর সেই পোশাকে সেজেগুজে আশা পূরণের একটা আশা মনের মধ্যে পুষে হাজির হত সেই আসরে। কিন্তু যেসব ইংরেজ এদেশে বেশ কিছুকাল কাটিয়ে একটু সৌভাগ্যের দর্শন পেয়েছে, বিয়ের ব্যাপারে গড়িমসি করত জীবনকে আর একটু উপভোগ করার উদ্দাম বাসনায়। মজার ব্যাপার হল, তাদের অধিকাংশ ছিল অসুস্থ, লিভারের অসুখে পাণ্ডুবর্ণ।২০

‘ক্যাপ্টেন বল’-এর নাচের আসরে কুমারী মেমদের বর লাভের প্রত্যাশা নিয়ে হাজির হওয়াটা একই সঙ্গে কৌতুকাবহ ও করুণা সৃষ্টিকারী ঘটনা। বলনাচের আসরে তারা বৃত্তাকারে নাচত যতটা সম্ভব রমণীয় ভঙ্গিতে। কোনও তরুণ প্রস্তাব করবে এই আশা নিয়ে অপেক্ষা করত চূড়ান্ত উদ্বেগ মনের মধ্যে চেপে রেখে। তাদের মধ্যে কেউ প্রস্তাব পেলে বাকিরা ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকত তার দিকে।২১ অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটত যে, কলকাতায় আসার পর তিন মাস কেটে গেছে। বর জোটেনি কপালে। তখনও অদত্তা রয়ে গেছে। তাই একবার শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা যৌথভাবে বলের আয়োজন করত নিজেদের খরচে। শহরের সমস্ত অবিবাহিত সায়েবদের আমন্ত্রণ জানানো হত। তাতেও যদি স্বপ্ন পূরণ না হত, ভগ্ন হৃদয় নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া গতি থাকত না। বস্তুত, কলকাতার বলনাচের আসর ছিল বরাতে বর জোটানোর একমাত্র ভরসা স্থল।২২

শ্রীমতী কিন্ডারসলি লিখেছেন, কোম্পানির কর্মচারীরা কলকাতার বাইরে কর্মক্ষেত্র হওয়াটা পছন্দ করত, কারণ তাতে কতকগুলো সুবিধে ছিল।২৩ কিন্তু অন্যান্য তথ্য সূত্র থেকে জানা যায়, ঘটনাটা বিপরীত। ইংরেজ ললনাদের চোখে পতি হিসেবে প্রথম পছন্দ ছিল সামরিক অফিসাররা। আবার তাদের মধ্যে যোগ্যতম ছিল তারাই, যাদের কর্মস্থল ছিল কলকাতা। বলা বাহুল্য, কলকাতা ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ার সুবাদে নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই শহরের প্রতি সায়েব-মেমদের আকর্ষণ একটা ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছিল প্রথম থেকেই। সামরিক অফিসাররা প্রথম পছন্দের পাত্র হয়ে ওঠার অন্য একটা কারণ ছিল। তারা ছিল তুলনামূলক ভাবে তরুণ, স্বাস্থ্যবান এবং প্রতিকূল জল-হাওয়া যুঝতে সমর্থ। পত্নীর প্রিয় ইচ্ছেগুলো পূরণ করার সাধ ও সাধ্য থাকত তাদের। এ ব্যাপারে তারা সচেতনও থাকত। পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে সমঝোতা হয়ে গেলে বিয়ের পাট চুকিয়ে ফেলতে বিলম্ব হত না। তবে সেজন্য জরুরি ছিল গভর্নর জেনারেলের সবুজ সংকেত। তা না হলে বিয়েটা আইনি মর্যাদা পেত না।২৪

উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে আর্থিক সংকটের কারণে প্রতি বছর মধ্যম রকম সুন্দরীদের ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় চালান দেওয়া হত জাহাজ ভরতি করে। ঘটনাটা ওই শতকে বাংলায় কুলীনদের জন্য নৌকো ভরতি করে ঘটকদের মেয়ে আনার কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের বলা হত ‘ভরার মেয়ে’। যেসব তরুণ সায়েব কলকাতার অনাথা শ্বেতাঙ্গিনীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অনূঢ় অবস্থায় থাকত, তারাও অপেক্ষা করত বিলেত থেকে জাহাজ আসার জন্য। জাহাজ এলে নিজের জীবনসঙ্গিনী করে নিত পছন্দ মতো তরুণীকে বেছে নিয়ে। তবে উনিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে ছবিটা একটু পালটে যায়। মেমদের জোগান তখনও চাহিদার সমান না হলেও, চাঁদপাল ঘাটে যুবতী মেমরা জাহাজ থেকে নামলে আগের মতো তেমন সাড়া জাগত না সায়েব সমাজে।

আর্থিক সংকট ছাড়াও উনিশ শতকে কলকাতায় মেমসায়েবদের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে কারণ ছিল। এই শহরের তিরিশ ও চল্লিশের দশকে অনেক সায়েব স্বদেশে বিয়ে করে এদেশে চলে আসত বউ নিয়ে। অনেক মেমসায়েব নিজেরা স্বাধীনভাবে একাই চলে আসত। উঁচুদরের সিভিলিয়নদের মেয়েরা যারা শৈশবে কলকাতা ছেড়ে বিলেতে চলে যেত লেখাপড়ার জন্য, শিক্ষা শেষে তারাও কলকাতায় ফিরে আসত মা-বাবার কাছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিত তাদের বিয়ের প্রশ্নে। সুন্দরী এবং শিক্ষিতা রুচিশীলা মেয়েরা সাধারণ অজ্ঞ মেয়েদের হারিয়ে দিয়ে ধনী ও প্রভাবশালী স্বামী পেয়ে যেত। অনেক সময় সেসব স্বামী হত বয়স্ক, প্রায় দাদুর বয়সী। পরে হতাশা ছিল অনিবার্য পরিণতি।২৫

ভিক্টর জ্যাকুমেন্ট (Victor Jacquement) ১৮২৯ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি লক্ষ করেন, কলকাতার সম্ভ্রান্ত ইংরেজ পরিবারের অতি আধুনিকা এবং সুন্দরী তরুণীরা যারা বিলাস-ব্যসনের মধ্যে বড় হত, তাদের অসুবিধে হত না ম্যাজিস্ট্রেট বা কালেক্‌টরের মতো পদস্থ পাত্র পেতে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, তাদের মধ্যে কিছু কিছু নাক উঁচু সুন্দরী বেশ কিছুদিন বিয়ে এড়িয়ে কুমারী থেকে জীবন উপভোগ করা পছন্দ করত। শেষ পর্যন্ত অভিভাবকদের চাপে বাধ্য হত কোনও পদস্থ পাত্রকে বিয়ে করতে। ফলে আতান্তরে পড়ত বিবাহার্থী একেবারে ঘরোয়া সাধারণ মেমরা। তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হত নিচু পদ ও সম্মানের অধিকারী কোনও জুনিয়র অফিসার, দোকানদার প্রভৃতি মামুলি ইংরেজ তনয়কে পতিরূপে বরণ করতে। এটা তাদের কাছে কখনওই ঈপ্সিত ছিল না। তাই দাম্পত্য জীবনে জমাট বাঁধত হতাশা আর অ-সুখ।২৬

এমা রবার্টস লিখেছেন, এদেশে অনেক শ্বেতাঙ্গিনী তরুণীর অবিভাবকরা তাদের মেয়েদের কোনও রকমে বিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চাইত। তাই, বিয়েতে সায়েব পরিবারের মেয়েদের মতামতের মূল্য না দেওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। দেখা যেত, কোনো সায়েব কলকাতায় বিশাল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে চায় জীবনের বাকি দিনগুলো আরামে-বিলাসে কাটানোর জন্য। য়াওয়ার আগে পরিবারের অনূঢ়া মেয়েদের পাত্রস্থ করা দরকার। তাই কার হাতে মেয়েকে সম্প্রদান করতে যাচ্ছে, তা বিন্দুমাত্র বিবেচনা না করে তাকে জীবনভোর কষ্টের মুখে ঠেলে দিয়ে বিলেতে চলে যেত চিরকালের জন্য। তরুণীকে বলা হত, একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে এবং তাকে তাতে সম্মতি দিতেই হবে। তার ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক, এই নির্দেশ পালন করতে হত অবস্থার চাপে।২৭

একেবারে সাদাসিধে, উন্নত রুচিহীন ইংরেজ তরুণীদের, বিশেষ করে যাদের বয়স পঁচিশ অতিক্রান্ত, তাদের বিয়ের সমস্যা ছিল প্রকট। জনৈক অজ্ঞাতনামা গ্রিফিন (ইউরোপ থেকে নবাগত) উনিশ শতকের দ্বিতীয় পাদে লিখেছেন, কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজের যে-কোনও স্তরের অবিবাহিত সায়েব পরিণত বয়সের মেয়েদের থেকে কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে করা পছন্দ করত। যদিও একজন পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যবয়সী পুরুষের পক্ষে উপযুক্ত পাত্রী পঁচিশ বছরের কুমারী, তথাপি সতেরো বছরের কুমারীর দিকে তার নজর পড়ত বেশি করে।২৮ বেশি বয়সের কুমারীদের বিয়ে হলেও তাদের কপালে সেই সব সিভিলিয়ন স্বামী জুটত যাদের কর্মস্থল হত কলকাতার বাইরে মফস্‌সলে, কখনও বা আরও দূরে বেনারস, আগ্রা, দিল্লির মতো শহরে যেখানে কলকাতার স্বাচ্ছন্দ্য অমিল। কলকাতার কোনও সদ্যযৌবনপ্রাপ্তা মেম এই রকম পতি পছন্দ করত না। তাই, কলকাতার বাইরে যেসব সায়েবের কর্মস্থল, তারা বাধ্য হত পঁচিশ বা তার ঊর্ধ্বের কুমারীকে জীবনসঙ্গিনী করতে। মুশকিল হল, বেশি বয়সের কুমারীরা আত্মীয়স্বজনের চাপে অপছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সুখী হত না। আঠারো শতকের শেষ দিকে কলকাতার বাইরে কর্মরত জনৈক অফিসারের এক মজাদার মন্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য— ‘সুখী ব্যক্তিরা! কলকাতায় তোমাদের সুযোগ রয়েছে নিজেদের সুন্দরীদের পছন্দের পাত্র করে তোলা। আমাদের মতো দূরবর্তী জনপদে কর্মরত হতভাগাদের মাথায় এই আশীর্বাদ ঝরে পড়ার আশা ক্ষীণ। আমি তোমাদের পরামর্শ দিচ্ছি, সব ভদ্রলোকেরা মিলে বিচারপতিদের কাছে আর্জি জানাও, আদালত যেন সুন্দরীদের সমান ভাবে ভাগ করে দেয়।’২৯

বয়স্ক সিভিলিয়ানরা যে কচি মেমসায়েব পছন্দ করত বউ হিসেবে, তার পেছনে কারণ ছিল। দেখা যেত, কুড়ি বছরের কম বয়সী তরুণী দাম্পত্য জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পটু। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া প্রাণোচ্ছল পত্নী খুব সহজে সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারত। তার মধুর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে পরিচালিত হত কুড়িজন দাস-দাসী। পত্নী পরিণত যুবতী হলে সেটা সম্ভব হত না। তার তিরিক্ষি মেজাজ, কর্কশ কণ্ঠের হুকুম সব বানচাল করে দিত।৩০ ব্যতিক্রমী ছিল সেইসব মেয়েরা যারা স্বদেশে কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় এদেশে এসে হাজির হত। এখানে হঠাৎ স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে কৃতজ্ঞ থাকত তাদের পতিদের কাছে, যারা তাদের সৌভাগ্যবতী করেছে বিয়ে করে। এসব মেয়েরা কিন্তু ভাল মা ও পত্নী হয়ে উঠত।

The Asiatic Journal৩১ মেমসায়েবদের মধ্যে চরিত্রের বৈপরীত্য দেখাবার জন্য The English in India উপন্যাসের তিন মেমসায়েবের কথা উল্লেখ করেছে। একজন হলেন কুমারী হ্যারিয়েট আলবানি (Harriet Albany)। অসাধারণ রূপবতী, শিক্ষিতা, এবং রুচিশীলা হয়েও প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রে কপট হওয়ার ফলে তাঁর জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল ভারতে আসার পর। তাঁর চরিত্র ছিল মেকি গুণের আধার। তিনি তাঁর মতো একই চরিত্রের মানুষের সঙ্গে অশোভন প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। সায়েব ভদ্রলোক সুপুরুষ হলেও অত্যন্ত স্বার্থপর, হিসেবি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল। বস্তুত, আলবানি ও তাঁর মা যে ধরনের পাত্র পছন্দ করতেন, সায়েবটি ছিল তার চেয়ে অনেক নিকৃষ্ট। আলবানিকে সে ভালবাসত, তার অনুরাগী ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ের প্রস্তাব দিতেই বেঁকে বসে। আলবানি অবশেষে বিয়ে করেন এমন একজনকে যাকে তিনি আসলে ঘৃণা করতেন। শুধু আপস করেছিলেন তার পদমর্যদার কথা বিবেচনা করে। পরিণতিতে তিনি ডুবে যান অপরাধে, আর অর্জন করেন অপমান।

বিপরীতে আর একজন নারী চরিত্র, কুমারী মিডলটোন। ভারতে এসেছিলেন উঁচু পদমর্যাদাধারী ধনীর তল্লাসে নয়। তেমন কোনও উচ্চাশা তাঁর ছিল না, যা তাঁর হৃদয়ের কোমলবৃত্তি এবং নিঃস্বার্থপরতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। তিনি সুখী হয়েছিলেন এক সামান্য সাবালটার্নের আদর্শ পত্নী হয়ে।

অনেক সময় বিবাহিতা মেমসায়েবরা কীভাবে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে ব্যভিচারে ডুবে যেত তার দৃষ্টান্ত আর এক চরিত্র, শ্রীমতী টমকিনস (Tomknis)। বিবাহিত হয়েও তিনি গোপনে সহবাস করতেন ক্যাপ্টেন সিমার-এর (Symour) সঙ্গে। এক সময় কেলেঙ্কারির কথা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। টমকিনসের স্বামী খুবই নগণ্য এবং অবজ্ঞার পাত্র হলেও তার ন্যায়-অন্যায় বোধ ছিল প্রখর। তিনি তাঁর স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করেন। শ্রীমতী সমস্ত যুক্তি-বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে তুলে দেন ক্যাপ্টেনের হাতে।

উনিশ শতকে বলকাতায় ইংরেজ কুমারীদের তিনটে শ্রেণি ছিল। প্রথম, সিভিলিয়ন, মার্চেন্ট এবং অন্যান্য ফৌজি অফিসারদের মেয়েরা। এসব সায়েব এদেশেই বাস করত। তারা মেয়েদের অল্প বয়সে বিলেতে পাঠিয়ে দিত পড়াশোনার প্রয়োজনে। মেয়েরা ফিরে আসত ষোলো থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে। বিয়ের বাজারে প্রতিষ্ঠিত এবং মোটা বেতনধারী অনূঢ় ইংরেজ তনয়ের চোখে এই সব ইংরেজ ললনা ছিল লোভনীয়। দ্বিতীয়, ভারতে কোনও ইংরেজ বধূর বোন বা আত্মীয়া, যারা কলকাতায় আত্মীয়স্বজনের স্নেহের আকর্ষণে অথবা বিলেতে অভাবের তাড়নায় ভারতে আসত। তৃতীয়, কলকাতা কিংবা বাংলার কোনও স্থানের বৈধ ও অবৈধ অনাথ বালিকা। তারা খিদিরপুরে অনাথ আশ্রমে লালিত হত। এদের সংখ্যা ছিল যেমন প্রচুর, অবস্থাও ছিল তেমনি শোচনীয়। শহরে যাদের পদস্থ এবং সম্পন্ন আত্মীয়স্বজন থাকত না, তাদের ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত। এসব মেয়েরা চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত সরকারি আর্থিক সাহায্য পেত। তারপর তাদের সামনে খোলা থাকত তিনটে পথ— কারওর পত্নী হয়ে অপরিণত বয়সে মাতৃত্ব লাভ, অনাহারে মৃত্যু অথবা বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ।৩২

অবিবাহিত সায়েবরা অনেক সময় বিয়ে করার মানসে এসব অনাথা বালিকাদের সাক্ষাৎকার নিত। ইস্কুলে পরীক্ষার সময় সেখানে হাজির হয়ে তারা বেছে নিত সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী মেয়েদের। পছন্দ হলে সায়েব অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করত। সাক্ষাৎকার সফল হত তখনই, যখন যুবকটি অনাথ বালিকার মনে এই প্রত্যয় সৃষ্টি করতে পারত যে, তার অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছল। তা না হলে বালিকাটি সরাসরি নাকচ করে দিত বিয়ের প্রস্তাব। তবে শুধুমাত্র নিচুতলার অবিবাহিত সায়েবরা যেমন, দোকানদার বা ছোট ব্যবসায়ীরা যেত অনাথ আশ্রমে বালিকাদের খোঁজে।

অনাথ আশ্রমে লালিতা যেসব মেয়েদের অনাথ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য লাভ ছাড়া অন্য কোনও ভাবে অর্থলাভের উপায় ছিল না, তারা খিদিরপুরে একটা বড়ো বাড়িতে বাস করত। আর যাদের অন্য কোনও ভাবে অর্থলাভের উপায় থাকত, তারা বাস করত ইস্কুলের বোর্ডার হয়ে। সেখানেই অপেক্ষায় থাকত যদি কোনও তরুণ অফিসার তাদের কারওর প্রতি আকৃষ্ট হয়, এই আশায়। আগে বলনাচের অনুষ্ঠানের রেওয়াজ অনুসারে আমন্ত্রণ জানানো হত অনেক অবিবাহিত তরুণ সাহেবকে। বর খোঁজার এই বেআব্রু পদ্ধতি উনিশ শতকের সৌজন্যবোধের বিরোধী হওয়ায় বাতিল হয়ে যায় কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে। ফলে মেয়েদের অনাথ ইস্কুল পরিণত হয় এক ধরনের সন্ন্যাসিনী মঠে। বস্তুত, চার দেয়ালের ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দি মেয়েদের কোনও পাণিপ্রার্থীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগই ছিল না। সুযোগ ঘটত কলকাতায় কোনও বন্ধু-বান্ধব মাঝে-মধ্যে আমন্ত্রণ জানালে কিংবা কারোর রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে।৩৩ সমস্যা তীব্র ছিল অ-ইংরেজ এবং আধা-মেম বা ইউরেশিয়ান কুমারীদের ক্ষেত্রেও। পর্তুগিজ মেয়েদের কাছে ব্রিটিশ অফিসাররা পছন্দের হলেও তাদের মধ্যে বিয়ের ঘটনা ছিল খুব বিরল। সম্ভাব্য কারণ, ধর্মীয় গোড়ামি। পর্তুগিজরা ক্যাথলিক আর ইংরেজরা প্রোটেস্টানন্ট। আর ইউরেশিয়ান মেয়েরা তো ইংরেজদের কাছে অপাঙ্‌ক্তেয় ছিল।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতায় কুমারী মেমদের বিয়ের সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠায় কুমারীরা গড়ে তোলে ‘কুমারীদের গোপন সংঘ’ বা ‘Spinsters’ Secret Societies’। এইসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য ছিল সদস্যাদের জন্য উপযুক্ত অবিবাহিত ইংরেজ পাত্র জোগাড় করা। সেই সঙ্গে এমন কিছু ব্যবস্থা করা বা উপায় বের করা, যাতে তাদের জন্য উপযুক্ত পাত্র পেতে অসুবিধে না হয়। J. H. Stocqueler এ প্রসঙ্গে এক মজার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। জনৈক ভদ্রলোক এক ডিনার পার্টিতে কুমারী ল্যাঙ্গুয়িস-এর (Miss Langyish) দিকে এগিয়ে আলাপ করতে গিয়ে লক্ষ করেন, মেয়েটির হাতের রুমালের ভাঁজ থেকে এক টুকরো কাগজ মেঝেতে পড়ে গেল। ভদ্রলোক সেটা কুড়িয়ে নেন কিন্তু ভুলে যান ফেরত দিতে। পরদিন সকালে অদম্য কৌতূহল দমাতে না পেরে ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়লেন। তাতে লেখা আছে, ‘Notice— On Saturday the 22nd of February 1822, a secret meeting of the Spinsters of Calcutta will take place at the residence of Miss Flounce, to enquire into the cause of the infrequency of marriage, during the late cold season… to consult upon the best means of making an impression on adamantive hearts of the young men of the present day.’৩৪

ঠিক এমনই প্রতিষ্ঠান কলকাতার অবিবাহিত তরুণ ইংরেজরা গড়ে তুলেছিল আঠারো শতকে যখন শ্বেতাঙ্গিনী দুষ্প্রাপ্য ছিল কলকাতায়। বিলেত থেকে মেমসায়েবরা কলকাতায় এসে পৌছনো মাত্র তাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসত ঝাঁকে ঝাঁকে। মেমসায়েবের জোগান কম, সায়েবদের চাহিদা বেশি। ফলে অনেক প্রস্তাবই বাতিল হয়ে যেত। ব্যর্থ প্রেমিকরা সেজন্য উনিশ শতকের ‘কুমারীদের গোপন সংঘ’-এর মতো ‘জবাব ক্লাব’ গড়ে তোলে। দুটো প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যের মধ্যে অবশ্য পার্থক্য ছিল। ‘জবাব’ আসলে একটা হিন্দি শব্দ। চাকরি থেকে কাউকে বরখাস্ত করাকে বলে ‘জবাব’ দেওয়া। যেসব তরুণ ইংরেজের দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে মেমসায়েবরা ‘জবাব’ দিত, অর্থাৎ না-মঞ্জুর করত, তারাই হত এই অভিনব সংগঠনের সদস্য। উদ্দেশ্য ছিল, ব্যর্থ প্রেমিকরা যাতে সমবেত হয়ে পরস্পরকে সান্ত্বনা দিতে পারে।৩৫

জবাব ক্লাবের সভাপতি ও সহ-সভাপতি হত তারাই যারা বেশ কয়েকবার মেমসায়েবদের কাছ থেকে ‘জবাব’ পেয়েছে। যে সব সায়েব জবাব পেত, তারা তাদের ব্যর্থতা গোপন রাখতে পারত না। যুবতী মেমরা তাদের করুণ অবস্থা দেখে লজ্জা পেত। যদিওবা কোনও মেয়ে হতাশাগ্রস্ত প্রেমিককে দেখে পুনর্বিবেচনার কথা ভাবত, বাধা দিত তার বান্ধবীরা। তারা তেমন বিবেকনিষ্ঠ হতে পারত না। এই নিষ্ঠুর আচরণের ফলে একজন ব্যর্থ প্রেমিকের বিপর্যস্ত মনের ছবি ফুটে উঠেছে তার কথায়। সে তার বন্ধুকে বলে, ‘আলফ্রেড, ওই মিথ্যাচারিণী, বেইমান, অকৃতজ্ঞ মেয়েটার কথা একদম বলবে না।’ বন্ধু বলে, ‘শোনো, শান্ত হও। বিষয়টা দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখ। সে একটা খুকি মাত্র। ওর এসব বোঝার বয়স হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তোমাদের মধ্যে বয়সের ফারাক ব্যাপারটাকে দুঃখজনক ঘটনায় পরিণত করেছে। মনে কর তুমি ভাগ্যবান।’

‘না, আলফ্রেড না। ব্যাপারটাকে আমি গ্রাহ্য করতাম না। ভাবতাম ভালই হয়েছে। কিন্তু একবার ভেবে দেখ, কী অপমানিত হয়েছি আমি। ওই হৃদয়হীন প্রাণীটা আমাকে সরাসরি নাকচ করে দিল!’৩৬

উনিশ শতকে কলকাতায় বিয়ের যোগ্য মেমদের জোয়ার আসায় সে সময় বাঙালি মায়েদের মতো কুমারী মেমদের মায়েদেরও ঘুম উড়ে গিয়েছিল মেয়েদের বিয়ের চিন্তা-ভাবনায়। এটা খুব একটা অবাক হওয়ার কথা নয় যে, একটু ভবিষ্যৎ আছে এমন কোনও অবিবাহিত ছোকরা মায়ের নজরে পড়লে মায়েরা তাদের আশকারা দিয়ে মাথায় তুলত। অনেক সময় তাদের পছন্দ গিয়ে পড়ত কোনও জুনিয়ার সামরিক অফিসারের ওপর যে হয়তো ছুটি কাটাতে এসেছে কলকাতায়। অথবা নজর পড়ত কোনও রাইটারের ওপর যে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে ভারতীয় ভাষা শিখছে। মেমদের মায়েদের প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে উঠত সায়েব ছোকরাদের জীবনে। একেই কচি বয়স, তার ওপর বাস্তব জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। হবু শাশুড়ির আশকারা পেয়ে লেখাপড়া বিসর্জন দিয়ে মেতে উঠত ভাবী বউকে নিয়ে। ফলে কলেজে ভারতীয় ভাষার পরীক্ষায় ফেল করে বসত। পরিণাম, সিভিল সার্ভিস হাতছাড়া এবং সম্মান খুইয়ে স্বদেশে ফেরার জাহাজে যাত্রী হওয়া।৩৭

উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্বেতাঙ্গিনীরা জীবনসঙ্গী পছন্দের ব্যাপারে যেমন ছিল খুঁতখুঁতে, তেমনি সাবধানী। তারা বরং একা থাকাই পছন্দ করত, কিন্তু কোনও ভাবেই আজেবাজে, কম্বলসম্বলকে ভোট দেওয়া নয়। কাউকে ভাল পাত্র মনে করলে মেমসায়েবদের বিয়ের তর সইত না। তাদের এই প্রত্যয় অনেক সময় সায়েবদের কাছে বিড়ম্বনার ব্যাপার হয়ে উঠত। কারণ, মেমসায়েব যখন বুঝতে পারত, তার প্রেমে পাগল পুরুষটির কোনও উচ্চাশা নেই, যথেষ্ট বিত্ত নেই, পদ-মর্যাদা নেই, তৎক্ষণাৎ সে জবাব দিয়ে দিত সেই পাণিপ্রার্থীকে।৩৮ পদস্থ প্রভাবশালী ও বিত্তশালী সিভিলিয়নদের কন্যারা পছন্দ করত একমাত্র প্রতিষ্ঠিত এবং সম্ভাবনাময় সিভিলিয়নদের। অনেক সময় তারা কেবল প্রেমের ভান করত। সাদামাটা মামুলি তরুণ অনুরাগীদের হৃদয় ভাঙত নির্দয় হয়ে। M. Grand ডাকসাইটে সুন্দরী কুমারী স্যানডারসনের রূপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশ হন। সুন্দরী মেমসায়েব বিয়ে করেন প্রভাবশালী রিচার্ড বারওয়েলকে।৩৯

আঠারো শতকে যখন কলকাতায় মেমদের জোগান কম, তখন একজন নীলনয়না সুন্দরী একদিনেই গোটা তিনেক বিয়ের প্রস্তাব পেত। প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করার পর যদি দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রস্তাব বেশি ভাল মনে হত, প্রথম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না। উনিশ শতকে যখন শহরে শ্বেতাঙ্গিনীদের জোয়ার আসতে শুরু করেছে, তখনও মেমসায়েবদের মতিগতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কোনও সুন্দরীর চোখে প্রস্তাব গ্রহণের ঝলকানি দেখতে পেয়ে প্রেমিক হয়তো পরের দিন ছুটে যেত তার বাড়িতে, আর গিয়ে দেখত আর একজন প্রতিযোগী ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়ে এগিয়ে গেছে দৌড়ে। তবে সুন্দরী অনেক প্রস্তাব পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করলেও সতর্ক থাকত বেশি সময় ধরে না খেলার ব্যাপারে। শেষে দেখা যেত, কোনও অশ্বারোহী বাহিনীর অফিসারকে চূড়ান্ত ভাবে মন দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সে তার অহংবোধ ত্যাগ করে অফিসারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে কি না, সে সন্দেহ থেকে যেত।৪০

যদি কোনও তরুণী শহরে আসার এক বছরের মধ্যে বিয়ের প্রস্তাব কোনও পরিস্থিতির চাপে নাকচ করতে বাধ্য হত, অবিবাহিত সায়েবদের মূল্যায়নে তার অবস্থান হত একেবারে নীচের দিকে। যত রূপসী বা আকর্ষণীয়া হোক না কেন, তার অবস্থা হত সেই অভিনেত্রীর মতো যে প্রথম আবির্ভাবে হতাশ করেছে দর্শককে।৪১ বিপরীত ছবিও চোখে পড়ে। যে কুমারী মেম বিয়ের প্রথম প্রস্তাব হাতছাড়া করতে নারাজ, প্রস্তাব গ্রহণের পর যদি জানতে পারত, যে যুবক প্রস্তাব দিয়েছে সে ইতিমধ্যে কয়েকবার জবাব পেয়ে জবাব ক্লাবের সদস্য হতে যাচ্ছিল, তা হলে সর্বনাশ। যুবক জবাব পেয়ে যেত তৎক্ষণাৎ।

বিয়ের সমস্যা ছিল সায়েব-মেম উভয়েরই। কলকাতার এক মেমসায়েব বিলেতে তার বান্ধবী কলকাতায় বর খুঁজতে আসার মতলবের কথা জানতে পেরে সতর্ক করেছিল এই বলে যে এই প্রচেষ্টা ‘folly and impropriety…’।৪২ অন্যদিকে কম সামাজিক মর্যাদার অধিকারী কিংবা কম বেতনধারী অবিবাহিত ইংরেজ তরুণ কলকাতার মেমদের কাছ থেকে বার বার ‘জবাব’ পেলে তার মনে এক সময় ভেসে উঠত বিলেতে ফেলে আসা ছেলেবেলার সেই খেয়ালি ভালবাসার পাত্রীটি। একদিন তার সুপ্ত ভালবাসাকে পাঠিয়ে দিত আবার জাগিয়ে দিয়ে। বাল্যের সেই প্রেমিকা যদি তখনও একাকী থাকত, তা হলে সাড়া দিত তার প্রস্তাবে। এক সময় এসে পৌঁছত কলকাতায়। মিশে যেত বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা দুটো হৃদয়।

সায়েবমেমের বিয়েতে কিন্তু মোটা খরচ বইতে হত বরকে। কনের তরফে খরচ তেমন ছিল না। বিয়েটা যদি শীতকালে না হত, মধুচন্দ্রিমা মধুর হত না কলকাতার ভ্যাপসা গরমের ঠেলায়। বর-কনেকে সন্তুষ্ট থাকতে হত কোনও বন্ধুর পল্লিনিকেতনে অতিথি হয়ে। গরিব দম্পতিরা গৃহবন্দি হয়ে থাকত। নবদম্পতিরূপে তাদের পরিচয় সায়েব সমাজে তেমন কোনও আগ্রহ সৃষ্টি করত না। এখানেই কলকাতার সায়েব সমাজে শ্রেণিবৈষম্যের চেহারাটা ভেসে ওঠে।

কোম্পানির আমলে কলকাতার সায়েবমেমদের দাম্পত্য জীবন কতটা সুখী ছিল, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য মেলে। এমা রবার্টস লিখেছেন, ভারতে সায়েবমেমের বিয়েতে তেমন জাঁকজমক না থাকলেও বিয়ের ফসল ছিল দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য সুখ।৪৩ পত্নীর মূল্য সায়েবরা উপলব্ধি করত, কারণ তারা চাইত প্রবাস জীবনের একাকিত্ব এবং একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে। De Gradpre সায়েবমেমদের দাম্পত্য জীবনে সুখের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, বিলেতের মেয়েরা আসত অত্যন্ত দুঃস্থ অবস্থা থেকে। এখানে বিয়ের পর সচ্ছলতার মুখ দেখে কৃতজ্ঞ থাকত স্বামীর প্রতি।৪৪ দাম্পত্য সুখের কারণ Hartly House-এর লেখিকার বিচারে ভিন্ন। তাঁর মতে, সে সময় কলকাতায় সায়েব সমাজে অবৈধ প্রেম ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারণ লোকচক্ষুর অন্তরাল বলে কিছুই ছিল না। সব কিছু খোলামেলা। দরজা-জানলা সব হাট করে খোলা থাকত। বাড়ির চাকর-বাকর খালি পায়ে নিঃশব্দে বাড়ির মধ্যে ঘোরাফেরা করত প্রেতের মতো। তারা ছিল ‘ব্যভিচারের বিরুদ্ধে চলমান মূর্তি।’৪৫ লুকিয়ে-চুরিয়ে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। ক্ষুদ্র সায়েব সমাজে সকলে সকলের পরিচিত।৪৬ ট্রেন ছিল না যে পালিয়ে চলে যাবে অনেক দূরে। অপরাধী যুগল যে অজানা মানুষের মধ্যে হারিয়ে যাবে, তেমন লোক সংখ্যাও ছিল না শহরে।

W. H. Carey দাবি করেছেন, এদেশে কিছুকাল বসবাসের পর মেমদের চরিত্র এবং আচরণের সঙ্গে সমসাময়িক ইউরোপের মহিলাদের বিশেষ পার্থক্য থাকত না। তিনি লিখেছেন, ‘Our young ladies are, for the most part, to be seen at home, happy, contented, amiable. They are daughters and sisters, not mere husband-hunting spinster.’৪৭ সুখী দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে তিনি ঢালাও শংসাপত্র দিয়েছেন। কিন্তু তিনিই আবার তাঁর গ্রন্থে অন্যত্র এক বিপরীত ছবি তুলে ধরেছেন।

এক ইংরেজ তরুণীকে পতিলাভের উদ্দেশ্যে এদেশে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১৭৭৯ সালে সে তার এক তুতো বোনকে তার সৌভাগ্য খোঁজার পরিণাম বর্ণনা করে একটা চিঠি লেখে। সেই বোন তাকে অনুরোধ করেছিল তার অ্যাডভেঞ্চারের ফলাফল জানিয়ে পরামর্শ দিতে যে, ওই একই উদ্দেশ্যে তার ভারতে পাড়ি দেওয়া সংগত হবে কিনা। তরুণী লিখেছিল,—

‘আমার প্রিয়তমা মারিয়া, তুমি অনুরোধ করেছিলে বলে এখানে এসে বিয়ের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে আমার অভিমত তোমাকে জানাচ্ছি। এখানে আসার বোকামি ও ভুলটা আমি তোমাকে করতে বলি না।’

এরপর সে লেখে, যে পরিকল্পনা চমৎকার বলে এতদিন ইংরেজ ললনারা মনে করত, তা বস্তুত অত্যন্ত অবাস্তব। ‘এটা সত্যি যে আমি বিবাহিতা। যে মতলব নিয়ে একদিন ভারতে এসেছিলাম, তা সফল হয়েছে। হ্যাঁ, একজন পতি পেয়েছি। কিন্তু ফেলে এসেছি সেই সুখ ও আনন্দ যা ভোগ করতাম আমার স্বদেশে। আমার স্বামী অবশ্যই ধনী, বেশ বলার মতো, যা আমি প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছে। সেই সঙ্গে তার মেজাজও। সে আমাকে তার জীবনসঙ্গিনী রূপে নয়, নিজের প্রয়োজনে আমাকে গ্রহণ করেছে তার জীবনে। সে আমার ওপর এমন নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায়, যেন আমি তার পালকি বেহারার মতো একজন ক্রীতদাসী। অবস্থা এমন যে, পত্নীর সুখ-শান্তি নির্ভর করছে সেই মানুষটার মৃত্যুর ওপর, যে তার সুখানন্দের একমাত্র উৎস হতে পারত। ভারতে এটাই সত্যি। পত্নী অপেক্ষায় থাকে মৃত্যু কবে তার স্বামীকে তার জীবন থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে মুক্তি দেবে।… এটা কোনও অতিশয়োক্তি নয়, তোমাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি।’৪৮ তরুণীর বক্তব্যের সমর্থনে এক তথ্য পেশ করা যেতে পারে। ১৮১৪ সালে সামরিক আদালত ক্যাপ্টেন চার্লস হোয়াইটকে বরখাস্ত করে তার পত্নীর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাবার অপরাধে।৪৯

চটজলদি বিয়ের পরিণাম অনেক সময় সুখের হত না পতি-পত্নী উভয়ের অমানবিক আচরণে। অনেক সময় স্ত্রী সামান্য অসুস্থ হলে সেই অজুহাতে স্বামীকে ছেড়ে চলে যেত স্বদেশে। অন্যদিকে স্বামী ডাক্তারকে ঘুষ দিয়ে স্ত্রীর জল-হাওয়ার পরিবর্তনের পরামর্শ জোগাড় করে পাঠিয়ে দিত স্বদেশে। আবার এমন ঘটনাও ঘটত, যেখানে মেমসায়েব সন্তানদের বিলেতে পাঠিয়ে দিয়ে স্বামীকে নিয়ে এদেশে ঘর-সংসার করত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে। এর পেছনে কারণ ছিল। বরের খোঁজে যারা কলকাতায় আসত তারা ছিল নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে স্বামী পেয়ে হাতছাড়া করতে চাইত না। স্বামীকে ত্যাগ করে স্বদেশে ফিরে গিয়ে জীবনধারণের মতো আর্থিক সংগতির অভাবে তারা ছিল অসহায়। আবার পরিণত বয়সের সায়েবরা প্রায় কিশোরীকে পছন্দ করলেও সেই বিয়ে সুখের হত না। বয়স্বী সায়েব বিয়ের পর আবিষ্কার করত, কচি মেমপত্নীর প্রতি তার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। William Huggins মনে করেন, অন্যের দাম্পত্য জীবনের অ-সুখ এবং অশান্তি দেখে অনেক সায়েব আশঙ্কিত হয়ে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশের ঝুঁকি নিত না। সিদ্ধান্ত নিত চিরকুমার হয়ে থাকার।৫০

কিছু ইংরেজ মহিলা এদেশের সবকিছু অপছন্দ করত। সব কিছুতেই তাদের বিতৃষ্ণা। এখানে বিবাহিত জীবন কাটানো তাদের কাছে বড্ড কষ্টের এবং দুঃখদায়ক মনে হত। অনেক সিভিলিয়ন স্বদেশে বিয়ে করেও বউকে আনতে পারত না এদেশে, কলকাতায়। জন শোর ১৭৮৫ সালে বিলেতে গিয়ে বিয়ে করেন। কিন্তু নবপরিণীতা বধূ বাংলার প্রচণ্ড প্রতিকূল জল-হাওয়া নিয়ে এতই আতঙ্কিত ছিলেন যে, কলকাতায় আসেননি স্বামীর সঙ্গে।৫১ কিছু মেমসায়েব অবশ্য স্বামীর প্রতি আনুগত্যবশত এবং ভালবাসার টানে তার সঙ্গে থেকে যেত এই শহরে। কিন্তু তাতেও তাদের দাম্পত্যজীবন সুখের হত না, কারণ পতি-পত্নী দু’জনেই থাকত মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্যে। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সস্ত্রীক স্বদেশে ফিরে যাওয়া চলত। তবে সে সাহস হত না। বিলেতে ফিরে গিয়ে কী কাজ পাবে, কী-ই বা খাবে— এই দুশ্চিন্তা ছিল ফিরে যাওয়ার পথে বড় বাধা। এসব ক্ষেত্রে মেমসায়েবদের জীবনে ক্লান্তিকর একঘেয়েমি ছিল প্রধান শত্রু। বিদ্যে-বুদ্ধি, রুচিতে পিছিয়ে থাকায় তাদের সময় কাটত মদ খেয়ে আর কলকাতার সায়েব সমাজের কুরুচিকর কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি আলোচনা করে। উনিশ শতকে কলকাতার অধিকাংশ ধনী বাঙালি পরিবারের বউ-মেয়েদের রুচির সঙ্গে এই মেমসায়েবদের আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

তবে উনিশ শতকে মেমসায়েবদের চরিত্রের একটা উজ্জ্বল দিক আলোচনা না করে পারা যায় না। তা হল, তাদের অপরিসীম ভ্রাতৃস্নেহ। সে সময় অনেক মেমসায়েবের ভ্রাতৃস্নেহের দৃষ্টান্ত অবাক না করে পারে না। কলকাতার সামরিক ও অসামরিক অফিসাররা তিরিশের আগে বিয়ের কথা ভাবতে পারত না। দুটো কারণে। প্রথম, এদেশে এসে প্রথম অবস্থায় যেভাবে দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়ত, তাতে পত্নী নিয়ে ঘর-সংসার করা সম্ভব হত না। দ্বিতীয়, সরকারিভাবে তাদের নিরুৎসাহ করা হত, কারণ তাদের ঘন ঘন বদলি করা হত এক জায়গা থেকে অন্যত্র। দম্পতির জন্য উপযুক্ত বাসস্থানের যথেষ্ট অভাব ছিল। একজন সামরিক অফিসারকে অন্তত মেজরের পদ পর্যন্ত পৌঁছতে হত, তবেই সে আর্জি পেশ করতে পারত বিয়ের জন্য। বিবি না রেখে এই বিলম্বে বিয়ের ফলে অফিসারদের অবিবাহিতা বোনেদের ভারতে পাঠানো একটা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা অনেক ক্ষেত্রেই সারা জীবন অনূঢ়া থেকে ভাইদের ঘর সামলাত। কলকাতার গোরস্থানে ১৮৩৪-এর এক সমাধি ফলকে লেখা আছে, ‘Mary Bird, daughter of R. Bird of Taplan, Bucks and sister of R. M. Bird Esq. C. S. who had quitted her home and country to comfort an afflicted brother…’ ভাইয়ের স্ত্রী কলেরায় মারা যাওয়ার পর Mary Bird কলকাতায় আসেন ভাইয়ের সংসার সামলাতে। আর এই শহরেই নিজের জন্ম দিনে তার মৃত্যু হয় কলেরায়।৫২

বাংলা তথা কলকাতার মেমসায়েবরা হাবা-গোবা ছিল না মোটেই। তবু কিছু নতুন করে ভাবা, জীবনচর্যায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা তাদের প্রায় কারওরই ছিল না। আসলে, এই গুণ অর্জন করতে গেলে শিক্ষার যে ভিতটার প্রয়োজন সেটাই ছিল না তাদের। এখানকার ধনী, প্রভাবশালী সিভিলিয়ন বা মার্চেন্টদের মেয়েদের খুব অল্প বয়সে লেখাপড়া শেখার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হত বিলেতে। তাদের বেশির ভাগ ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই এদেশে ফিরে আসত মা-বাবার কাছে। খুব বেশি হলে, ইস্কুলের পড়া সাঙ্গ করে হয়তো কিছুদিন চারুকলার চর্চা করত। তার বেশি নয়। ওইটুকু পুঁজি নিয়ে তারা এদেশে নিজেদের সুরুচিসম্পন্না বলে জাহির করার চেষ্টা করত। এইসব মেয়েদের কখনওই প্রজ্ঞাপারমিতা বলা যেত না। ওই পরিচয় লাভের কোনও আগ্রহও ছিল না তাদের। কলকাতায় এসেই তারা ডুবে যেত বল, পার্টি প্রভৃতি বিনোদনে।

বলনাচের ব্যবস্থা করা হত প্রায় প্রতি সপ্তাহে। নাচের আসরে মাঝে মাঝে প্রেম-দেবতার আবির্ভাব ঘটত। ম্লান চোখের ঝলকানি, সুন্দর ক্ষীণ কটি, অপূর্ব ছন্দে নৃত্য পরিবেশনা তরুণ সায়েবের চোখে গোপন সৌন্দর্যের ঝাঁপি খুলে দিত। এখানেই বেছে নিত জীবনসঙ্গিনী। যে মেয়েটা তখনও কৈশোর সীমা ডিঙোতে পারেনি, বিলেতে থাকলে আদা মেশানো কেক আর বাদামের জন্য বায়না করত, সে পরিণত নারীর মতো ছোট মাথাটা নেড়ে আলোচনা করত ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী সম্পর্কে তার পছন্দ-অপছন্দের কথা। কিশোরী মেয়েরা যুবতী নারী হয়ে উঠত মনের দিক থেকে। William Huggins মনে করেন, এই ধরনের নারী-শিশু (Women-children) বিলেতে দেখা যেত না। এর কারণ, ভারতের উষ্ণ জলবায়ু তাদের মধ্যে এনে দিত অকাল পক্বতা।৫৩

The Asiatic Journal-এর মতে কলকাতার শ্বেতাঙ্গিনীরা তাদের সমাজে রীতিমতো অলংকার হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি তাদের তা হতে দিত না। তার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী ছিল।৫৩ক পার্টিতে নাচের প্রতি প্রবল আসক্তি ছিল তাদের একটা ক্ষতিকারক অভ্যেস। বলরুমের নাচে তাদের উদ্যম ও কর্মশক্তিতে কোনও খামতি থাকত না। ১৭৯৩ থেকে উনিশ শতকের সূচনা পর্যন্ত দেখা যেত মেমরা বলরুমে রাত ন’টা থেকে পরদিন ভোর পাঁচটা পর্যন্ত নেচে চলেছে। উনিশ শতকের বিশের দশকেও এমন নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন হত। ১৮২৯-র ১২ জানুয়ারি Asiatic Mirror এমনই একটা খবর ছেপেছিল। ৬ জানুয়ারি জেনারেল গ্রাসটিন (General Grastin) ফোর্ট উইলিয়মে যে পার্টি দেন, তা শেষ হয় রাত একটায়। অতিথি ছিলেন প্রায় ১৭০-১৮০ জন। পার্টির শেষে সকলে খেতে বসলে বাধা পড়ে। শুরু হয়ে যায় নাচ। সে নাচ শেষ হয় পরদিন, শুক্রবার ভোরবেলায়।৫৪ নাচের বিরতির সময়ও তারা বিশ্রাম নিত না। জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়াত নাচের হলে। এই অদম্য উদ্যম-উত্তেজনা আঘাত হানত তাদের শরীর-স্বাস্থ্যে। এর সঙ্গে ছিল মদ্যপান। লর্ড ভ্যালেনসিয়া উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অনেকের ঘন ঘন ক্ষয়রোগের শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এজন্য তিনি দায়ী করেছেন নাচের প্রতি তাদের অতি আসক্তিকে।৫৫

নাচের পরিণতি সম্পর্কে এক ব্যক্তি লিখেছিলেন, ‘আমার যেন মনে হয়, ইউরোপীয় সুন্দরীদিগের গণ্ডদেশ হইতে স্বাভাবিক গোলাপী রঙ বিদুরিত হইয়া তৎপরিবর্তে যে মলিন পাণ্ডুবর্ণ দৃষ্ট হয়, তাহা অপেক্ষা তাম্রবর্ণ বদনের সমুজ্জ্বল দীপ্তি লক্ষগুণে শ্রেষ্ঠ… ইউরোপীয় সুন্দরীদিগের মুখের বর্ণ দেখিলে কবর হইতে উন্বিত ল্যাজেরসের কথা মনে পড়ে।… কল্পনানেত্রে ভাবিয়া দেখ দেখি, তোমার হৃদয়ের প্রেমপুত্তলি গ্রীষ্মতাপে মৃত-প্রায়া, প্রত্যেক অঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, প্রত্যেক প্রত্যঙ্গ শ্রমে বিকৃতি প্রাপ্ত হইতেছে, বৃহদাকার স্বেদবিন্দুসহ তাঁহার বদনমণ্ডলে মুক্তাকারে সজ্জিত হইয়াছে, আর তাহার নৃত্য-সহযোগী প্রত্যেক হস্তে এক একখানি মসলিন রুমাল লইয়া তাহার মুখমণ্ডল মুছিয়া দিয়া অপার আনন্দ উপভোগ করিতেছে।’৫৬ নাচের প্রতি এই অপ্রতিরোধ্য আসক্তির শিকার হয়ে মেমসায়েবরা গোরস্থানের পথে পা বাড়ালেও তাদের হুঁশ হত না। সেই করুণ পরিণতির ছবি ফুটে উঠেছে ফোর্ড-এর ‘The Broken Heart’ নাটকে—

‘When one news straight came huddling

On another

Of death, and death, and death, still I

Danced on.’৫৭

বলনাচের কতকগুলো নিয়ম ছিল। বিবাহিতা মেমরা যুগল-নৃত্যে (minuet) অংশগ্রহণ করত স্বামীর পদমর্যাদা অনুযায়ী সঙ্গীর সঙ্গে। কৌলীন্যহীন চাকুরে সায়েবের পত্নীরা যুগল-নৃত্যে অংশগ্রহণের যোগ্য বলে বিবেচিত হত না। উল্লেখযোগ্য যে, বল-নৃত্যে পরিণত বয়সের রমণীর দর্শন পাওয়া যেত না। আঠারো শতকে কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজে প্রৌঢ়া ছিল দুর্লভ। একটা বয়সের পরে অধিকাংশ সায়েবমেম চলে যেত স্বদেশে।৫৮

নাচ শেখানোর বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। একশো টাকার বিনিময়ে ১৭৮৩ সালে Bengal Military Orphan Society নাচের ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করে খিদিরপুরে রিচার্ড বারওয়েলের পরিত্যক্ত বাড়িতে। বেশির ভাগ নাচের অনুষ্ঠান হত Old Court House-এ, যেটা তিরিশ বছর ধরে সরকারি বিনোদনের কেন্দ্র ছিল। আঠারো শতকের শেষ দিকে এখানে অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় নিরাপত্তার অভাবে। বলনাচ চলে যায় সায়েবদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেদের বাড়িতে। সরকারি উদ্যোগে নাচের অনুষ্ঠান হত সাধারণত কোনও যুদ্ধ জয়, শান্তি প্রতিষ্ঠা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধি উপলক্ষে। এইসব অনুষ্ঠানে সরকার উপুড় হস্তে অর্থ ব্যয় করত। কোম্পানির দেওয়ানি লাভ উপলক্ষে ১৭৬৬-র পয়লা জানুয়ারি যে নৃত্যোৎসবের আয়োজন করা হয়, তাতে খরচ হয়েছিল ২৯,২২৩-৮-৩ টাকা। আলাদাভাবে মদে খরচ হয় ৫,৪৫১-৯-০ টাকা।৫৯

বলনাচে মেমসায়েবরা যতই উদ্যম, উৎসাহ দেখাক না কেন, এমনিতে তাদের জীবন ছিল অনন্ত অলসতায় ভরপুর। সামান্য কাজকে মনে হত বড় পরিশ্রমসাধ্য। কোনও কারণে কোচ ছেড়ে উঠতে হলে বিরক্ত হত। সারাটা দিন ঝিমোত, শরীরের অঙ্গগুলো যেন অবশ, নাড়ির স্পন্দন নেই, বোধশক্তি নেই, হৃদয় নেই। সম্ভবত কলকাতার অসহ্য প্রতিকূল উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ু এর কারণ।৬০ টানা পাখা ছিল নিত্যসঙ্গী। এই বিশাল বস্তুটির এক্তিয়ারের বাইরে থাকাটা তারা ভাবতে পারত না। কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া মেমসায়েবরা কেউ কারওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করত না। নবাগতা কোনও সুন্দরী একা বলনাচে উপস্থিত থাকলেও কোনও যুবক এগিয়ে গিয়ে তাকে প্রস্তাব দিত না নাচের সঙ্গিনী হতে। আর তা করলে তাকে প্রায় একঘরে করত তার ছেলে-মেয়ে বন্ধুরা মিলে।

মেমসায়েবদের অন্তরঙ্গ বান্ধবীর দল চোখে পড়ত না সচরাচর। বেশির ভাগ মেমেদের কাছে পুরুষের সান্নিধ্য ছিল সম্মানের ব্যাপার। কোনও মেম পুরুষ সঙ্গীর বাহুতে হাত রেখে বলরুমে উপস্থিত হচ্ছেন এটাই ছিল সায়েব সমাজের দস্তুর। পুরুষের মনোযোগ এবং তোষামোদ নবাগত শ্বেতাঙ্গিনীকে ভুলিয়ে দিত বান্ধবীর সঙ্গলাভের অভাব। কিছু মেয়ে অবশ্য বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অনাবিল আনন্দ হারিয়ে বিমর্ষ হত, স্বদেশে যেটায় তারা অভ্যস্ত ছিল। বলরুমে দেখা যেত, যারা পরস্পরের পরিচিত, তারা হাসি-ঠাট্টায় মশগুল। যারা নবাগতা তারা উপেক্ষিতা, তাদের প্রতি সকলের শীতল মনোভাব, উদাসীন আচরণ। এক সময় দেখা যেত, এইসব মেয়েরা নিজেদের নারী-সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে পুরুষসঙ্গীবেষ্টিত হয়ে যারা এদেশে কিছুকাল কাটিয়ে ফিরে যেত স্বদেশে, তাদের কাছে মনে হত, ভারত ছিল স্বর্গ। শীতকালে এই ছবিটা অবশ্য একটু পালটে যেত। দেখা যেত মেমসায়েবরা শীতের সকালে দলবেঁধে দোকানে যাচ্ছে কেনা-কাটা করতে। কলকাতার মেমদের মধ্যে হয়তো সহমর্মিতার একটু অভাব ছিল কিন্তু ঈর্ষাকাতরতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা তেমন নজরে পড়ত না। সম্ভবত এই কারণে যে, কলকাতার মেমরা সৌজন্য প্রকাশের নিয়মগুলো খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলত, যেটা সমসাময়িক ইউরোপের রঙ্গপ্রিয় নারী সমাজে দেখা য়েত না।৬১

Stocqueler দাবি করেছেন, আদর্শ পত্নী ও মা হিসেবে কলকাতার মেমসায়েবরা ছিল স্বদেশের মহিলাদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ।৬২ দাবিটা যথার্থ বলে মনে হয় না। অন্য তথ্য ভিন্ন কথা বলে। কলকাতার মেমসায়েবরা সন্তান পালনে নির্ভর করত এদিশি আয়ার ওপর। অবশ্য কিছুটা নাচার হয়ে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিলেতে স্তন্যধাত্রী নিয়োগের রেওয়াজ উঠে গেলেও ভারতে প্রতিকূল জল-হাওয়ার কারণে উনিশ শতকেও এই ব্যবস্থা বহাল ছিল।৬৩ মেমরা একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ত কলকাতার উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুতে। ক্রান্তীয় অসুখ-বিসুখের শিকার হত। ফলে, তাদের পক্ষে সব সময় সন্তানকে স্তন্য পান করানো সম্ভব হত না। বিকল্প ছিল আয়া। শ্রীমতী ম্যাকফারলান (Ann McFarlan) প্রথম সন্তানকে নিজের স্তন্য পান করাতে পারলেও, দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠেনি। তিনি তখন জন্ডিসে আক্রান্ত। এমনকী, মেমসায়েব সুস্থ হয়ে সন্তানকে আপন মাতৃদুগ্ধ দিতে সক্ষম হলেও অনেকের বিশ্বাস ছিল, মেমসায়েবের মাতৃদুগ্ধ এদিশি মহিলাদের মতো তত বলকারক নয়। কারণ, তারা অনেক বেশি স্বাস্থ্যবতী এবং তাদের শারীরিক গঠন এমন যে, এখানকার জল-হাওয়ার সঙ্গে যুঝতে সক্ষম।৬৪

আয়ারা যতদিন মেমসায়েবের সন্তানকে স্তন্য দান করত, ততদিন তাদের নিজেদের পরিবারে যেতে দেওয়া হত না। আয়ার নিজের সন্তান অবহেলিত থাকত। শ্বেতাঙ্গ শিশু পুষ্টিলাভ করত কৃষ্ণাঙ্গী আয়ার স্তন্য পান করে। সে দৃশ্য দেখে শ্রীমতী শেরউডের হৃদয় মথিত হয়েছে করুণায়। লিখেছেন, ‘It is touching to see the European babe hanging on the breast of the black women, and testifying towards her all the tenderness which is due to its own mother.’৬৫ তিনি আরও লিখেছেন, ‘এটা খুব অস্বাভাবিক দৃশ্য নয় যে, কোমল, সুন্দর একটা কচি হাত তার পালিকা-মায়ের কালো মুখের ওপর আলতোভাবে চাপড়াচ্ছে, আর পালিকা-মা শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে স্নেহ-প্রলিপ্ত হাসিমাখা মুখে। আমি বিশ্বাস করি, এটা অকৃত্রিম অফুরন্ত স্নেহ উপলব্ধির প্রকাশ মাত্র।’৬৬ তিনি সেই ছোট্ট শিশুর জন্য গভীর বেদনা অনুভব করেছেন, যার প্রাপ্য মাতৃদুগ্ধ পান করছে তাঁর কন্যা লুসি। কেউ কেউ একে ঔপনিবেশিক সম্পর্কের নজিরবিহীন নজির হিসেবে দেখেছেন। তাদের মনে হয়েছে, শাসক জাতির শিশুর জন্য উপনিবেশিত মা তার নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করেছে। অনেকের সন্দেহ, আয়ার যে শিশু সন্তান মাতৃদুগ্ধের অভাবে নিঃশব্দে মারা যেত, সে নিশ্চয়ই কন্যা সন্তান।৬৭ তাই এই অবহেলা।

দিশি আয়া বা দাইয়ের প্রতি এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সকল শ্বেতাঙ্গিনীর ছিল না। তার অন্যতম দৃষ্টান্ত শ্রীমতী ফেনটন। একজন নিচু জাতের দাই তাঁর পোশাক পরিবর্তনে সাহায্য করবে, এটা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। দাইয়ের হাতের প্রসাধনী তেলের গন্ধ তাঁর এতই অসহ্য মনে হত যে, তাঁর ঘরে দাইয়ের প্রবেশ পছন্দ করতেন না। তারা সব সময় বোঝাতে চাইত, দাই মেমসায়েবের কাছে অপরিহার্য। এখানেই ছিল তাঁর আপত্তি। তিনি তাদের প্রতি এতই বিরক্ত ছিলেন যে, বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘I have lost all good will for them.’ শ্রীমতী জেমিমা কিন্ডারসলিও কখনও দিশি মেয়েদের গাত্রবর্ণের সঙ্গে আপস করতে পারেননি।৬৮ একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। মেমসায়েবদের সন্তান পালনের দায়িত্বে থাকা দিশি মহিলাকে বলা হত ‘আয়া’। ‘দাই’-রা নিযুক্ত থাকত মেমসায়েবদের ব্যক্তিগত পরিচারিকা হিসেবে।

এদেশে যেসব মেমসায়েবের জন্ম, তাদের মধ্যে অনেকে ঘর-কন্নার কাজ নিজের হাতে করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু তাদের স্বামীদেরই সেটা পছন্দ ছিল না। ধনবতী মেমসায়েবদের মধ্যে চলত ফ্যাশন, পার্টি, নতুন পোশাক নিয়ে প্রতিযোগিতা। কলকাতায় সায়েব-দোকানে সাজানো থাকত আমদানি করা দ্রব্যসম্ভার। অবস্থাপন্ন মেমসায়েবরা সেই সব দোকানে গেলে এক সকালের মধ্যেই সাজ-গোজের জন্য হেলায় খরচ করে ফেলত তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা।৬৯ ১৭৮৪-র ১২ আগস্ট কলকাতার এক মেমসায়েব বিলেতে তার বান্ধবীকে একটা চিঠিতে লিখেছিল—

‘I rise fatigued, almost expended,

Yet suddenly when breakfast’s ended,

Away we hurry with our fops

To rummage o’er the Europe shops.’৭০

The Calcutta Review-এর একজন লেখক বলতে চেয়েছেন, কলকাতার বিলিতি মেয়েদের কাজের সুযোগ ছিল কম। স্বদেশের তুলনায় বিপরীত। ইংল্যান্ডে বেশিরভাগ সেবামূলক কাজকর্ম করত মেয়েরাই। এদেশে তাদের সে কাজ সীমাবদ্ধ ছিল কিছু টাকা-পয়সা দান-ধ্যানের মধ্যেই।৭১ কিন্তু তারা যে বিভিন্ন পেশা, যেমন, টুপি-পোশাক তৈরির কাজ, ট্যাভার্ন বা হোটেলের কাজকর্ম সামলানোর কাজে ব্যস্ত থাকত তার অনেক তথ্য আছে। ইসথার লিচ (Esther Leach) কিছু সময়ের জন্য ১৮৪১ সালে স্থাপিত সানস্‌সুসি (Sans Souci) থিয়েটারের মালকিন ছিলেন।৭২ ফ্রান্সিস লা গালাইস (Francis Le Gallais) কলকাতায় ষোলো বছর একটা ট্যাভার্ন চালিয়ে ১৭৯১ সালে মারা গেলে তার বিধবা পত্নী ব্যাবসা দেখতে শুরু করে।৭৩ উনিশ শতকে বিলেত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা কলকাতায় আসত বারমেড বা পানশালার পরিবেশনকারিণীর চাকরি করতে। সেবামূলক কাজেও কলকাতার মেমসায়েবরা খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। তারা Ladies Society গড়ে তুলেছিল এদেশের মেয়েদের শিক্ষার জন্য। European Female Orphan Society পরিচালনা করত মেমসায়েবরা। হেনরি মিরিডিথ পারকার (Henry Meredith Parkar) অসুস্থ মানুষের প্রয়োজনে কলকাতায় একটি বরফ-ঘর গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কলকাতার মেমসায়েবদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানালে তারা সাড়া দেয় আন্তরিকভাবে। কয়েক দিনের মধ্যে তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় তিন লক্ষ টাকা।৭৪

এটা ঘটনা যে, আঠারো শতকের বিলেতের সম্ভ্রান্ত বংশের মেমসায়েবরা কলকাতায় আসতে চাইত না ভয়ে। এখানকার জল-হাওয়া এবং প্রকৃতি সম্পর্কে তাদের আতঙ্কের সীমা ছিল না। কলকাতা তাদের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এ শহরের প্রচণ্ড দাবদাহ, সায়েবমেমদের সামান্যতম অসাবধানতার কারণে মৃত্যু, ক্ষুধামান্দ্য শ্রীমতী কিন্ডারসলিকে হতাশ করেছিল। এ শহর এবং শহরের মানুষ তাঁর মনকে কাড়তে পারেনি। অথচ শ্রীমতী এলিজা ফে-এর অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বিপরীত। মামুলি ভালবাসা নয়, কলকাতা তাঁর মনে এক অদ্ভুত আবেশ সৃষ্টি করেছিল, ইংরেজিতে যাকে বলে obsession। ভারতে আসা, কলকাতায় বাস করা ছিল তাঁর অনুক্ষণ চিন্তা।৭৫ ১৭৭৯ সালে তিনি যখন কলকাতায় আসেন, তখন তিনি তেইশ বছরের তরুণী। কোনও রকম আশঙ্কা তাঁকে কলকাতায় আসা থেকে বিরত করতে পারেনি। এটা তাঁর জানা ছিল যে, তখন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। ভারতে যেতে গেলে ফ্রান্সের পাশ দিয়ে যেতে হবে। তবুও শত্রু দেশের গা ঘেঁষে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন তিনি। সেকালে বিলেত থেকে সমুদ্র পথে কলকাতায় আসার ধকল ছিল অপরিসীম। এক-আধ দিন নয়। ছ’টা মাস ভেসে থাকতে হত সমুদ্রে। তার ওপর ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা। প্রতি পদে ছিল জীবনের ঝুঁকি। তা সত্ত্বেও এলিজা ফে একবার নয়, চারবার কলকাতায় আসার কষ্ট স্বীকার করেছিলেন এই শহরের টানে। ভালবেসেছিলেন কলকাতার মানুষ-জনকে। কলকাতার হিন্দুদের জন্য তাঁর মনে ছিল একটা নরম উপলব্ধি। তাঁর মনে হত, তাদের মধ্যে একটা যেন রহস্য লুকিয়ে আছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি মনে করি, এই লোকগুলো ছল-চাতুরী দিয়ে কারওর সঙ্গে প্রতারণা করে না। তাদের মুখের অনুগ্র ভাব এবং বিনম্র আচরণ আমাকে ভীষণ কৌতূহলী করে তোলে।’৭৬ কলকাতা তাঁর মনে যে আবেশ সৃষ্টি করেছিল তার প্রকাশ ঘটে তাঁর একটা উক্তিতে, ‘The city for which I have so long sighed, to which I have looked innumberable hopes and fears…’৭৭ শ্রীমতী ফে কলকাতায় শেষবার আসেন ১৮১৬ সালে। কলকাতা তার এই প্রেমিকাকে আর ফিরে যেতে দেয়নি। ষাট বছর বয়সে এই শহরেই তিনি সমাহিত হন শরতের এক উজ্জ্বল দিনে।

মুর্শিদাবাদে কোম্পানির রেসিডেন্ট ওয়াটস পলাশি যুদ্ধের কিছুদিন আগে সস্ত্রীক কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন নবাবের ভয়ে। ১৭৬০ সালে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। কয়েক বছর পরে মারা যান সেখানেই। শ্রীমতী ওয়াটস্‌ অনেক বছর এদেশে থাকার ফলে এদেশীয় জীবনচর্চায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাই রেভারেন্ড উইলিয়ম জনসনকে বিয়ে করে থেকে যান এই শহরে। বিয়েটা সুখের হয়নি। কয়েক বছর পরে জনসন বিলেতে চলে গেলেও শ্রীমতী জনসন যেতে পারেননি কলকাতাকে ছেড়ে। লর্ড ওয়েলেসলির কাছ থেকে একখণ্ড জমি চেয়ে নিয়েছিলেন সেন্ট জন চার্চের আঙিনায়। শেষ ইচ্ছে ছিল, সেখানে সমাহিত হবেন। মৃত্যুকালে ওয়েলেসলি ছিলেন না। কিন্তু পরম আড়ম্বরে তাঁর শোক মিছিল হয়েছিল। ছ’ ঘোড়ায় টানা সরকারি কোচে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সমাধি ক্ষেত্রে। শোক মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন কাউন্সিলর সদস্য ও বিচারপতিদের মতো সম্ভ্রান্ত মানুষ।৭৮

কুমারী পার্সি (Miss Percy) কলকাতায় পা রেখেই মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘What a charming place this must be to live in! How spacious! How imposing!’৭৯

অনেক মেমসায়েব গভীর ভাবে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়তেন কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে। ফ্যানি পার্কস তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই শহর ছেড়ে যাওয়ার অন্তিম ক্ষণে তাঁর মন কী গভীর বেদনায় ডুবে গিয়েছিল, তা বোঝা যায় তাঁর কথায়। তিনি লিখেছেন, ‘আসার আগে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আমার ঘর ছেড়ে যেতে চাইনি। যখন বলা হল, সব কিছু প্রস্তুত, আমি সিঁড়ি ভেঙে একবার ওপর তলায় উঠে আবার নিচে এলাম ঘোড়ার গাড়ির কাছে। তারপর আবার একটা অজুহাতে ফিরে গেলাম বাড়ির ভেতরে। প্রত্যেকটা ঘরে একবার করে উঁকি মারলাম, যেন অনেক বন্ধুকে ছেড়ে বিদায় নিচ্ছি। আর কখনও দেখা হবে না তাদের সঙ্গে।’৮০

সম্ভবত ফ্যানি পার্কসের মতো আরও অনেক মেমসায়েবের হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল শেষবারের মতো কলকাতার কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে। ইতিহাসে তাদের কথা লেখা নেই। কিন্তু অনুমান করতে অসুবিধে হয় না।

সূত্রনির্দেশ

১. James Long, A Peep into the Social Life of Calcutta during the second half of the 18th century, P.T. Nair, (ed.), British Social Life in Ancient Calcutta, Calcutta 1983, p. 47.

২. James Long, Selections from Unpublished Records of Government, Calcutta (1973), No. 181.

৩. Suresh Chandra Ghosh, The social condition of British Community in Bengal, p. 81.

৪. P. J. Marshall, The White Town of Calcutta under the Rule of the East India Company (Modern Asian Studies, vol, 34, Part-I, February 2000), p. 311)

৫. Theon Wilkinson, Two Monsoons, London (1976), p. 114.

৬. তদেব।

৭. W. H. Carey, The Good Old Days of Honaorable John Company, Calcutta (1980), প্রথম প্রকাশ 1882, p. 129.

৮. Judicial (Criminal) Proceedings, 20 August 1819, No. 13.

৯. General (General), Proceedings, 19 August, 1835, No. 48-50.

১০. Hartly House, Calcutta, Calcutta (1908) pp. 22-23.

১১. Sarmistha De, Marginal European in Colonial India: 1860-1920. Kolkata (2008) p. 43.

১২. P. T. Nair, (ed.), Calcutta in the 19th Century, Calcutta (1989), p. 508.

১৩. Emma Roberts, Scenes and Characteristics of Hindostan with Sketches of Anglo-Indian Society, vol. I, London (1835) pp. 18-19.

১৪. Bengal Past and Present, vol. X, July-October, 1914,pp. 217-237.

১৫. R. V. Vernede (ed.), British Life in India, New Delhi (1996), P. 2.

১৬. The Asiatic Journal, New Series, vol. 18, 1935, p. 129.

১৭. Suresh Chandra Ghosh, প্রাগুক্ত, p. 64.

১৭ক. New Series, vol. 13, p.109.

১৮. P. J. Marshall, প্রাগুক্ত, p. 312.

১৯. E. M. Collingham, Imperial Bodies, Malden (USA), 2001, p. 37.

২০. W. H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 98.

২১. তদেব, p. 99.

২২. তদেব,

২৩. Kindersley, Letters from the East, London (1777), p. 87.

২৪. W. H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 99.

২৫. Abhijit Dutta, European Women and Children in 19th Century Bengal, Calcutta (1992), p. 7.

২৬. তদেব, p. 8.

২৭. Emma Roberts, প্রাগুক্ত, p. 32.

২৮. Anonymous Griffin, Sketches of Calcutta, Glasgow (1843), p. 207.

২৯. তদেব।

৩০. তদেব, p. 208.

৩১. The Asiatic Journal, New Series, Vol. 17, 1835, p. 2.

৩২. T. R. Barret, Calcutta, Kolkata (2014), p. 360.

৩৩. P. T. Nair, (ed.), Calcutta in the 19th Century, p. 201.

৩৪. P. T. Nair, (ed.), British Social Life in Ancient Calcutta, p. 202.

৩৫. তদেব, p. 208.

৩৬. তদেব,

৩৭. G. S. A. Ranking, History of the College of Fort William, Bengal Past and Present, vol. XXIII, (1992), p. 149.

৩৮. Abhijit Dutta, প্রাগুক্ত, p. 13.

৩৯. The Calcutta Review, May-August, 1844, p. 327.

৪০. The Asiatic Journal, New Series, vol. 20, 1836, p. 101.

৪১. তদেব, P. 98.

৪২. Suresh Chandra Ghosh, প্রাগুক্ত, p. 65.

৪৩. Emma Roberts, প্রাগুক্ত, p. 26, 32.

৪৪. Douglas Dewar, In the Days of the Company, London (1920), p. 146.

৪৫. তদেব, p. 147.

৪৬. তদেব, p. 148.

৪৭. W. H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 111.

৪৮. তদেব, p. 97.

৪৯. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, Calcutta (1994), p. 9.

৫০. William Huggins, Sketches in India, London (1824), p. 95.

৫১. Suresh Chandra Ghosh, প্রাগুক্ত, p. 74.

৫২. Theon Wilkinson, প্রাগুক্ত, p. 120.

৫৩. William Huggins, Sketches in India, London (1824), p. 102.

৫৩ক. The Asiatic Journal, Jan-April, 1833, p. 115.

৫৪. The Asiatic Journal, September 1829, p. 275.

৫৫. Calcutta Review, May-August, 1844, p. 328.

৫৬. রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব, কলিকাতার ইতিহাস, কলিকাতা (১৯৮৯) পৃ. ২২৮।

৫৭. Calcutta Review, May-August, 1844, p. 328.

৫৮. W. H. Carey, প্রাগুক্ত, p. 129.

৫৯. Kathleen Blechynden, Calcutta: Past and Present, New Delhi (2003), (প্রথম প্রকাশ ১৯০৬), p. 116.

৬০. William Higgins, প্রাগুক্ত, p. 103.

৬১. The Asiatic Journal, New Series, vol. 10, 1833, p. 107.

৬২. P. T. Nair (ed.), British Social Life in Ancient Calcutta, প্রাগুক্ত, p. 116.

৬৩. E. M. Collingham, প্রাগুক্ত, p. 95.

৬৪. তদেব।

৬৫. Ketaki Kushari Dyson, A Various Universe, New Delhi (2006), p. 175.

৬৬. তদেব, p. 176.

৬৭. তদেব, p. 175.

৬৮. তদেব, p. 89.

৬৯. Hartly House, p. 51.

৭০. W. S. Seton Karr, Selections from Calcutta Gazettes, vol. I, Calcutta (1984), p. 24.

৭১. P. J. Marshall, প্রাগুক্ত, p. 326.

৭২. E. W. Madge. ‘The Sans Souci and its star’, Bengal Past and Present, CIX (1990), pp. 104-5.

৭৩. Bengal Past and Present, vol. 109, 1990, p. 107.

৭৪. H. E. Cotton, Calcutta Old and New, Calcutta (1980), p. 153.

৭৫. E. M. Forster (ed.), Eliza Fay, Original Letters from India, 1779-1815, London (1986), প্রথম প্রকাশ ১৯২৫, M. M. Kaye-এর ভূমিকা।

৭৬. Ketaki Kushari Dyson, প্রাগুক্ত, p. 126.

৭৭. Rabindra Kumar Dasgupta, Old Calcutta as presented in literature. (Sukanta Chaudhuri (ed.), প্রাগুক্ত, pp. 118-127.

৭৮. Kalthleen Blechynden, প্রাগুক্ত, p. 149.

৭৯. Ferdinand De Wilton Ward, Life in Calcutta, English at Calcutta, vol. 1, London (1828), p. 125.

৮০. Ketaki Kushari Dyson, প্রাগুক্ত, p. 115.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *