মেদিনীমন্ডলে বৌদ্ধধর্ম : সেকাল ও একাল – চিন্ময় দাশ
মেদিনীপুর চিরদিনই মহৎ ভাব ও সাধনের সমাদর করিয়াছে। এইজন্য দেখা যায়, যুগে যুগে বাঙ্গালা দেশে যে ধর্ম যখন সমাদর লাভ করিয়াছে, তাহা সর্বাগ্রে এই জেলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। আর্য-সভ্যতা ও দ্রাবিড়-সভ্যতা মিলিয়া ভারতের এক নূতন সভ্যতার সৃষ্টি করিয়া জগৎকে একদিন বিস্মিত করিয়াছিল, সেই দুই সভ্যতার মিলন-কেন্দ্র ছিল এই মেদিনীপুর। মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত নগরী ছিল সেই মিলন-কেন্দ্রের পুণ্যতীর্থ।
এই জেলায় বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের বিস্তৃতি যেমন ঘটেছিল, তার পর নিরঞ্জন পথ, যোগমত, ধর্মপূজা প্রভৃতিরও বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠা এই জেলায় ছিল।
তমলুক বা সেকালের তাম্রলিপ্ত নগরীতে বৌদ্ধ সংঘারামের কথা বহুল আলোচিত, সকলেই জানেন। বৌদ্ধদের প্রাচীন ষোড়শ মহাস্থবিরের একজন ছিলেন তাম্রলিপ্তবাসী ‘স্থবির কালিক’। বৌদ্ধশাস্ত্র অনুসন্ধিৎসু চীনা শ্রমণ ও পরিব্রাজক ফাসিয়ান চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারত পর্যটনে আসেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন হুই-চিং, তাও-চিং, হুই-হিং এবং হুই-ওয়েই নামক তাঁর চারজন সতীর্থ। তাঁর সঙ্কল্প ছিল, চীনদেশের বিহারগুলির জীবনযাত্রার অশুদ্ধিকর ও অসম্পূর্ণ নিয়মাবলিগুলির পরিবর্তে, বৌদ্ধধর্মের আদি প্রচারক্ষেত্র ভারতভূমি থেকে সম্পূর্ণ ধর্মানুশাসনগুলির প্রতিলিপি সংগ্রহ করে সেগুলিকে চীনা ভাষায় অনুবাদপূর্বক স্বদেশে প্রচার করা, যাতে করে তাঁর স্বদেশবাসী নির্ভুল পথে ভগবান বুদ্ধের অনুগামী হতে সক্ষম হন ও তথাগতের কৃপারাশি থেকে বঞ্চিত না হন। ভারত পরিক্রমাকালে পাটলিপুত্র নগরী থেকে গঙ্গাস্রোত ধরে রওনা হয়ে একদিন তাম্রলিপ্তে এসে হাজির হয়েছিলেন ফাসিয়ান। বহুল প্রচারিত ও প্রসারিত বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্র তাম্রলিপ্ত নগরীতে তখন বাইশটি বিহার ও বহুসংখ্যক বৌদ্ধভিক্ষু অবস্থান করতেন। ফাসিয়ান এখানে দু-বৎসর কাল অবস্থান করে বহু সূত্রের প্রতিলিপি এবং বুদ্ধমূর্তির প্রতিকৃতি নকল করেছিলেন। এখান থেকেই তিনি সমুদ্রপথে সিংহলে গমন করেন। এর পরে সপ্তম শতাব্দীর প্রথম পর্বে চীনা পরিব্রাজক সুয়ান জাং তাম্রলিপ্ত নগরীতে এসেছিলেন। তখন এখানে দশটি সwঘারাম এবং হাজারজনের মতো ভিক্ষুর অবস্থান ছিল। আরও পরে ইৎ-সিং এখানে এসেছিলেন। যোগেশচন্দ্র বসু প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা বলে থাকেন যে, সেকালে তমলুকের পাশাপাশি আরও তিনটি স্থানে একটি করে বৌদ্ধবিহারের অবস্থান ছিল—১. ময়না, ২. বাহিরী এবং ৩. দাঁতন। সেকালের বৌদ্ধধর্মমন্ডল প্রসঙ্গে আমরা তাই তমলুক বাদ দিয়ে বাকি তিনটি এলাকার কিছু বিবরণ এখানে সংক্ষেপে নিবেদন করছি।
ময়না
সেকালে ময়না ছিল নরপতি লাউসেনের সুরক্ষিত রাজধানী। ময়নাগড়ের নিকটবর্তী এক গ্রাম বৃন্দাবনচক। এখনও সেখানে এক ধর্মঠাকুরের অবস্থান দেখা যায়। এই দেবতা রাজা লাউসেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এমন অভিমত প্রচলিত আছে। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা ভিন্ন মত অবলম্বন করেন। মেদিনীপুর জেলার বিশিষ্ট ইতিহাসকার যোগেশচন্দ্র বসু বলেছেন:
ময়নাগড়ে বৌদ্ধ নরপতি লাউসেনের রাজধানী ছিল। ময়নার নিকটবর্তী বৃন্দাবনচকে এক ধর্মঠাকুর আছেন, তাঁহাকে অনেকে লাউসেনের প্রতিষ্ঠিত বলিয়া থাকেন। ময়নাগড় এখনও ধর্মপূজার প্রধান পীঠস্থান বলিয়া পরিচিত। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, আমাদের দেশের ধর্মপূজা বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর মাত্র; বুদ্ধদেবই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মনামে পূজা পাইতেছেন। বৌদ্ধদের শূন্যবাদের উপর ধর্মদেবের পৌরাণিক আখ্যান প্রতিষ্ঠিত।
বৌদ্ধদের শূন্যবাদ কীভাবে ধর্মদেবের পৌরাণিক আখ্যানে রূপান্তরিত হয়েছিল, সেসম্পর্কেও বিশ্লেষণ করেছেন যোগেশচন্দ্র:
হাড়ী এবং ডোম জাতীয় আচার্যগণই প্রথমে ধর্মের পূজক ছিলেন। পরে ব্রাহ্মণেরা দেবতার পূজা ও পদ্ধতি ঈষৎ পরিবর্তিত করিয়া নিজেরা পুরোহিত হইয়াছেন। ময়নাগড়ে ও তন্নিকটবর্তী অনেক স্থানে এখনও ধর্মপূজার প্রচলন আছে। ধর্মপূজার প্রচলনের জন্যই এক সময়ে বঙ্গ-সাহিত্যে ‘ধর্মমঙ্গল’ নামক গ্রন্থের আবির্ভাব হইয়াছিল। ধর্মমঙ্গলগুলি বৌদ্ধরাজা ও ভিক্ষুগণের মহিমা কীর্তন করিতে প্রথমত রচিত হইলেও পরে ব্রাহ্মণগণের হস্তে শ্রমণগণ হৃতসর্বস্ব ও পরাভূত হইলে, ধর্মমঙ্গল গ্রন্থগুলিও দেবলীলা-জ্ঞাপক হইয়া পড়ে। কিন্তু তাহা হইলেও এখনও উহার মধ্যে ক্ষীণ ও পরাভূত বৌদ্ধধর্মের লুকায়িত ছায়া পরিলক্ষিত হয়।
শ্রীযুক্ত বসুর এই অভিমত ও বিশ্লেষণটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। একারণে যে, ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের Census Report Of Bengal গ্রন্থের ‘Discovery of Living Buddhism in Bengal’ নামক নিবন্ধে এই একই অভিমতের গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ এবং সমর্থন পাওয়া যায়।
রাজা বা নরপতি লাউসেন দেবমাহাত্ম্য প্রচারের জন্য নির্মিত কাহিনির কোনো কল্পিত রাজা, নাকি তাঁর চরিত্রের কোনো ঐতিহাসিকত্ব আছে, সেটি সংক্ষেপে হলেও বিচার করে নেওয়া যেতে পারে। প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু, সাহিত্যাচার্য দীনেশচন্দ্র সেন, ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্যান্য ঐতিহাসিকগণেরও অভিমত যে, ধর্মমঙ্গল-এর ধর্মপাল এবং দন্ডভুক্তির ধর্মপাল একই ব্যক্তি ছিলেন। ধর্মমঙ্গল এই আছে যে, দন্ডভুক্তির সেই রাজা ধর্মপালের কর্ণসেন নামে একজন মহাসামন্ত ছিলেন। তিনি সেনভূম ও গোপভূমের রাজা ছিলেন। ইছাই ঘোষ কর্ণসেনকে পরাজিত করে তাঁর রাজ্য অধিকার করে নিলে, ধর্মপাল ময়নাগড়ে কর্ণসেনকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেকালে ময়না ছিল দন্ডভুক্তি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। কেবল তাই নয়, ধর্মপাল নিজ শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সাথে কর্ণসেনের বিবাহ দেন। এই রঞ্জাবতীর গর্ভে কর্ণসেনের স্বনামধন্য বীরপুত্র লাউসেনের জন্ম হয়। যিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে ইছাই ঘোষকে পরাজিত করেন। খ্রিস্টীয় দশম কি একাদশ শতাব্দীতে লাউসেনের স্থিতিকাল নিরূপণ করেছেন দীনেশচন্দ্র সেন। হান্টার-এর Annals Of Rural Bengal গ্রন্থেও উল্লেখ আছে যে, অজয় নদের তীরে ইছাই ঘোষের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান আছে। যোগেশচন্দ্র মন্তব্য করেছেন:
লাউসেনের যত্নেই সাধারণের উপযোগী বৌদ্ধধর্মের একাঙ্গ ধর্মপূজা-পদ্ধতি প্রচারিত হয়। রামাই পন্ডিত সেপদ্ধতির প্রথম প্রচারক। মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, আমাদের দেশের ধর্মপূজা বৌদ্ধধর্মের রূপান্তরমাত্র। বুদ্ধদেবই পশ্চিমবঙ্গে ধর্ম নামে পূজা পাইতেছেন।
এই সকল উপাদান থেকেই শ্রীবসু সিদ্ধান্ত করেছেন যে, ময়নাগড়েও বৌদ্ধদের একটি সংঘারামের অবস্থান ছিল। আমরাও তাতে সহমত পোষণ করি।
বাহিরী
কাঁথি শহর থেকে সামান্য উত্তরে বাহিরী একটি সুপ্রাচীন জনপদ। গ্রামটি প্রাচীন, তার প্রমাণ—১. এই এলাকার পুষ্করিণী ইত্যাদি খননের সময় সাত-আট ফুট মাটির নীচে প্রায়ই এক-একটি বঁাধানো কূপ বের হতে দেখা যায়। সবগুলি কূপই পোড়ামাটির চাটি ইট দিয়ে নির্মিত। ইটগুলি তেরো-চোদ্দো ইঞ্চি দীর্ঘ, সাত ইঞ্চি প্রস্থ এবং দুই ইঞ্চি উচ্চতাবিশিষ্ট। ২. বাহিরী গ্রামের ভূপৃষ্ঠে এবং ভূগর্ভে প্রায়ই প্রাচীন ইটের সন্ধান পাওয়া যায়। ৩. এককালে যে মৃত্তিকাস্তরে প্রাচীন গৃহাদি নির্মিত হয়েছিল, কালক্রমে তার উপর পাঁচ-সাত ফুট মাটির স্তর সঞ্চিত হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিক ভাবেই আজকের বাহিরী যে অতীতের একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ ছিল, ঐতিহাসিকদের এমন অনুমান অবাস্তব নয় বলেই মনে হয়।
যাই হোক, তাম্রলিপ্তের পাশাপাশি বাহিরী গ্রামেও সেকালে যে একটি সংঘারাম ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে কিছু যুক্তি উপস্থিত করা যেতে পারে।
১. চারটি মৃত্তিকাস্তূপ
বাহিরী গ্রামে ভীমসাগর, হেমসাগর, লোহিতসাগর ইত্যাদি নামের কতকগুলি প্রাচীন পুষ্করিণী আছে। কিন্তু এগুলির চেয়েও প্রাচীন চারটি ‘মৃত্তিকাস্তূপ’ আছে এই গ্রামে। চারটি স্তূপই সুউচ্চ। চারটি স্তূপই পৃথক পৃথক নামে অভিহিত হয়—‘পালটিকরী’, ‘শাপটিকরী’, ‘ধনটিকরী’ এবং ‘গোধনটিকরী’। এই এলাকায় কিংবদন্তি প্রচলিত আছে যে, এখানে মহাভারতের কালে মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের একটি গোগৃহের অবস্থান ছিল। এই স্তূপগুলি সেইসকল গোগৃহেরই ধ্বংসাবশেষ। যদিও এই অনুমানের কোনোরকম ভিত্তি নেই। কোনো ঐতিহাসিকই এর সমর্থন করেননি। অপরদিকে এই স্তূপগুলি যে আদিতে কোনো বৌদ্ধ সংঘারামের বিহার ছিল, এরকম অনুমানই তাঁরা ব্যক্ত করেছেন। ‘বাহিরীর এই স্তূপগুলি আমাদের মনে বৌদ্ধযুগের স্তূপের কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়। আমাদের অনুমান, বৌদ্ধযুগে দাঁতন ও ময়নাগড়ের ন্যায় বাহিরীতেও একটি সঙ্ঘারাম ছিল।’
২. বাহিরী নামের উৎস
গ্রামের নাম বাহিরী। গ্রামের মধ্যে একটি স্থান আছে, যার নাম ‘বিধু বাহিরী’। দেখা যায় এই ‘বাহিরী’ এবং ‘বিধু’ দু-টি শব্দ থেকে ঐতিহাসিকেরা তাঁদের অনুমানের পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন। ‘সংঘারাম’ শব্দের অর্থ বৌদ্ধমঠ। আর ‘বিহার’ শব্দের অর্থ বৌদ্ধদেবালয়, সুগতালয়, মঠ, মন্দির। সংঘারামের অভ্যন্তরে অবস্থিত ‘বিহার’ শব্দটিই কালক্রমে ‘বাহিরী’তে রূপান্তরিত হয়েছে, এমনই বলা যায়। বাহিরী নামটিও সেই প্রাচীন ‘বিহার’ শব্দেরই হীন পরিণতি বলে ঐতিহাসিকেরাও অনুমান করেন। সেভাবেই তাঁরা বলেন, যা এককালে ছিল ‘বুদ্ধ বিহার’, তা-ই কালক্রমে অপভ্রংশে ‘বিধু বাহিরী’ নামে পর্যবসিত হয়েছে।
৩. প্রাচীন প্রস্তরমূর্তি
বাহিরী গ্রাম এবং নিকটবর্তী এলাকায় পুষ্করিণী ইত্যাদি খননের সময় প্রাচীন কূপ আবিষ্কারের কথা আমরা উল্লেখ করেছি। মাঝে মাঝে দু-একটি পাথরের মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। পাথরের শ্রেণি এবং মূর্তিগুলির নির্মাণরীতির পুরাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে, সেগুলি বৌদ্ধযুগে নির্মিত হয়েছিল। ওই সকল মূর্তির গঠনপ্রণালী দেখলে শিল্পীর অদ্ভুত শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখেরবিষয় মূর্তিগুলি প্রায় ভগ্ন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র এই এলাকায় থাকাকালীন মূর্তিগুলি দেখে খেদোক্তি করেছিলেন—‘পুতুলগুলাও আধুনিক হিন্দুর মত অঙ্গহীন হইয়া আছে।’
বাহিরী থেকে পাওয়া একটি প্রস্তরমূর্তি কাঁথি শহরে এনে মহকুমা শাসকের অফিস প্রাঙ্গণে রাখা হয়েছে। সেই মূর্তির শিল্পনিপুণতা এবং গঠনপ্রণালী থেকে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন যে, উড়িষ্যার খন্ডগিরির প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের মূর্তিগুলির সাথে এর সাযুজ্য রয়েছে। মূর্তিটির দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুট। দু-টি বাহুই নষ্ট। এ ছাড়াও নাসিকা, চিবুকের নিম্নাংশ ও উভয় পার্শ্বস্থ মূর্তিচতুষ্টয়ের মুখগুলি ভগ্ন অবস্থায় আছে। এতদ্ভিন্ন মূর্তিটির অন্যান্য অংশ, বেদী ও বেদীর উপরে চিত্রিত মূর্তি দুইটি ও অন্যান্য চিত্রগুলি সুস্পষ্ট অবস্থায় আছে:
কতশত বৎসর হইল মূর্তিটি নির্মিত হইয়াছে—অঙ্গে ছাতা পড়িয়াছে, রঙ জ্বলিয়া গিয়াছে, অঙ্গহীন হইয়াছে, তথাপি এখনও উহার শিল্পনৈপুণ্য ও গঠনপ্রণালী দেখিলে আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়। উড়িষ্যার খন্ডগিরির উপরে এইরূপ বহু মনোমুগ্ধকর প্রস্তরগঠিত রাশি দৃষ্ট হয়।
তবে এই মত বিচারের ক্ষেত্রে একটু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কেননা, কোনো একটি স্থানে প্রাপ্ত বা আবিষ্কৃত হলেই, মূর্তিটি যে প্রকৃতপক্ষে সেই স্থানেরই হবে, এমনটা নাও হতে পারে।
৪. প্রাচীন মঠ
বাহিরীতে তপোবনের মতো রমণীয় একটি স্থানে একটি প্রাচীন মঠ আছে। ঐতিহাসিকেরা এই মঠটিকেও কোনো বৌদ্ধমঠ বলে অনুমান করেন। বাহিরীর এই মঠের প্রসঙ্গে তাঁরা স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠেন—:
কে জানে উহা সেযুগের কোনো বৌদ্ধ মঠের রক্তমাংসহীন কঙ্কাল কিনা! মঠটিতে এক্ষণে রামচন্দ্রের মূর্তি আছে। কিন্তু একদিন হয়ত সেখানে বুদ্ধদেবের মূর্তিই বিদ্যমান ছিল; শ্রমণগণ তাঁহারই পূজায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর কাটাইয়া দিতেন। আচার্যগণ সেই স্থানে বসিয়া গম্ভীর আরাবে ‘নির্বাণ-মুক্তি’র অপূর্ব সত্য দেশবাসীকে শুনাইয়া দিয়া ডাকিতেন, ‘এস এস নরনারী,– আমরা অমৃত পাইয়াছি, সেঅমৃত তোমাদিগকেও দিব।’ সেদিন চলিয়া গিয়াছে! কালের কঠোর হস্ত আজ সেখানে অনেক পরিবর্তন আনিয়া দিয়াছে। এখন সেখানে সেই মহাযোগীর লোকমধুর চরিত্রকাহিনী বা তাঁহার পবিত্র নিবৃত্তি ও আত্মসংযমের কোনো আলোচনা দূরে থাক, মঠবাসিগণ কেহ তাঁহার নাম পর্যন্ত জানেন না!
দাঁতন
দাঁতনে বৌদ্ধ সংঘারামের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে দাঁতন নামের সৃষ্টি বিষয়ে দু-চারটি কথা আলোচনা করা দরকার। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পূর্ব এলাকা যে সময়কালে সুহ্ম বা তাম্রলিপ্ত রাজ্যের অন্তর্গত ছিল, সেসময় দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা কলিঙ্গ বা উৎকলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উৎকলের ইতিহাসে বৌদ্ধযুগ হল এক গৌরবময় অধ্যায়। উৎকলের গিরিগাত্রে খোদিত লিপিতে, কারুকার্যখচিত বিভিন্ন আকারের শত শত গুহায়, মন্দিরে এবং ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অসংখ্য সুরম্য অট্টালিকার ভগ্নাবশিষ্ট প্রস্তরখন্ডে সেপরিচয় পাওয়া যায়। এই উৎকল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সেকালের দন্তপুর। দন্তপুর নামের উদ্ভব সম্পর্কে বহু মন্তব্য এবং বিবরণ আছে। যোগেশচন্দ্র বসুর বিবরণটি এখানে পেশ করা হল:
খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের একটি দন্ত তাম্রলিপ্ত নগর হইতে সিংহলে প্রেরিত হইয়াছিল। বৌদ্ধগ্রন্থ দাঠাবংস হইতে জানা যায় যে, ক্ষেম-নামা বুদ্ধ-শিষ্য বুদ্ধদেবের চিতা হইতে একটি দন্ত সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তিনি ঐ দন্তটি কলিঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্তকে প্রদান করেন। ব্রহ্মদত্ত উহার উপর মন্দির নির্মাণ করাইয়া তাহার অভ্যন্তরভাগ স্বর্ণমন্ডিত করিয়া দেন। যে নগরে ঐ মন্দির নির্মিত হইয়াছিল, তাহা দন্তপুর বা দন্তপুরী নামে অভিহিত হয়।
দন্তপুরের স্বর্ণমন্ডিত মন্দিরে যে বুদ্ধদন্তটি রক্ষিত হয়েছিল, সেটিই পরবর্তীকালে তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে সিংহলে প্রেরিত হয়েছিল। এর কারণ বিষয়ে কিছু ঘটনার উল্লেখ করতে হয়:
ব্রহ্মদত্তের বংশে ৩৮০ হইতে ৩৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গুহশিব বা শিবগুহ নামে একজন রাজা ছিলেন। শিবগুহ ব্রাহ্মণ্যধর্মের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করিতেন। কিন্তু একদিন দন্তপুর নগরের দন্তোৎসব দেখিয়া, তিনি মুগ্ধ হইয়া, বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। ইহাতে ব্রাহ্মণেরা ক্রুদ্ধ হইয়া পাটলিপুত্রাধিপতির নিকটে তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিলে, তিনি বুদ্ধদন্ত সহ শিবগুহকে বন্দী করিয়া লইয়া যাইবার জন্য চিত্তযান-নামক এক সামন্ত-নরপতিকে প্রেরণ করেন। পাটলিপুত্রে দন্তটি আনীত হইলে বহু অভূতপূর্ব কান্ড ঘটিতে থাকে। পাটলিপুত্রাধিপতি তাহা দেখিয়া বুদ্ধদন্তের ভক্ত হইয়া পড়েন। শিবগুহ দন্তটি সহ দন্তপুরে প্রেরিত হন। পাটলিপুত্রাধিপতির মৃত্যুর পরে ক্ষীরধার-নামক পার্শ্ববর্তী এক নৃপতির জামাতা অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে শিবগুহের রাজ্য আক্রমণ করেন। শিবগুহ যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হইলে তাঁহার কন্যা হেমকলা ও জামাতা উজ্জয়িনী-রাজকুমার ছদ্মবেশে পবিত্র দন্তটি লইয়া তাম্রলিপ্ত বন্দরে উপস্থিত হন ও তথা হইতে পোতারোহণে সিংহলে গমন করেন। সিংহলাধিপতি মেঘবাহন তাঁহাদের নিকট হইতে দন্তটি সাদরে গ্রহণ করিয়া ‘দেবানাম পিয়’ তিষ্য নির্মিত ধর্মমন্দিরে রক্ষা করেন। উহা তদবধি সিংহলে রক্ষিত ও পূজিত হইতেছে।’
বাংলা বিশ্বকোষ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে সিংহলে অবস্থানকালে চৈনিক পরিব্রাজক ফাসিয়ান মহাসমারোহের সাথে বুদ্ধদন্ত প্রতিষ্ঠার বাৎসরিক উৎসব প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
এখন দেখা গেছে যে, এই দন্তপুরে অবস্থান নিয়ে পুরাতত্ত্ববিদগণের বিপুল মতপার্থক্য আছে। রোমক-পন্ডিত প্লিনীকে অনুসরণ করে কানিংহাম সাহেবের অভিমত হল যে, অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামাহেন্দ্রীই দন্তপুর নগর। ফার্গুসন সাহেবের মত হল বর্তমান পুরীই হল সেকালের দন্তপুর এবং জগন্নাথদেবের মন্দিরটিই প্রাচীন দন্তমন্দির। হান্টার সাহেবও একই অভিমত পোষণ করেছেন। আমাদের দেশীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র কিংবা প্রাচ্য-বিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে করিঙ্গপত্তন, রাজামাহেন্দ্রী, পুরী এবং দাঁতনের দূরত্ব বিচার করে মত প্রকাশ করেছেন যে, রাজামাহেন্দ্রী বা পুরী নয়, মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত দাঁতন নামক স্থানটিই প্রাচীন দন্তপুর নগর।
একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, জনৈক রাজেন্দ্র চোল দন্ডভুক্তির রাজা ধর্মপালকে পরাজিত ও হত্যা করেন। এর পরে পালবংশীয় রাজা মহীপাল প্রজাবিদ্রোহে সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হন। এরকমই কোনো এক সময়ে উৎকলে কেশরীবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। বিক্রমকেশরী নামে জনৈক রাজা ছিলেন দন্ডভুক্তি প্রদেশে। তাঁর রাজধানী ছিল দাঁতনের সামান্য উত্তরে অমরাবতী নামক প্রাচীন পুরীতে। এই বিক্রমকেশরীর কন্যা সখিসোনা বা শশিসেনা এবং জামাতা অহিমানিকের প্রেমকথা নিয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তিটির কথা আমাদের সকলের জানা। সেখানে ‘সখিসোনার পাঠশালা’ নামে পরিচিত একটি ঢিবিও সুদূর প্রাচীনকাল থেকে অবস্থিত আছে।
মোগল সম্রাটের সেনাপতি টোডরমল ও মুনিম খাঁ এবং পাঠান ওমরাহ সুলেমান কররানির বিদ্রোহী পুত্র দায়ুদ খাঁর দুই যুযুধান বাহিনীর ভয়ানক যুদ্ধের কারণে বিক্রমকেশরীর রাজধানী অমরাবতী পরবর্তীকালে মোগলমারি নামে পরিচিত হয়েছে। সেদিনের সেই অমরাবতী কিংবা আজকের মোগলমারিতেই ছিল সেকালের একটি সংঘারাম ও বৌদ্ধবিহার। সম্প্রতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মোগলমারিতে যে পুরাতাত্ত্বিক উৎখনন হয়েছে, তা থেকে পন্ডিতগণের এই অনুমানই সপ্রমাণিত হয়। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই দন্ডভুক্তি রাজ্যের মধ্যে দিয়ে কনৌজ থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত সমুদ্র-উপকুল বরাবর করমন্ডলম নামে একটি বাণিজ্যপথ ছিল। তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকেও একটি শাখাপথ ছিল দন্ডভুক্তি পর্যন্ত। সেই পথের পাশেই সেদিনের অমরাবতীর অবস্থান। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে সেই অমরাবতীতেই একটি সুরম্য বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল। সুয়ান জাং, ফাসিয়ান বা ইৎ সিং-এর মতো চৈনিক পরিব্রাজকেরা তাম্রলিপ্ত নগরী ছাড়াও সন্নিহিত এলাকায় যেসকল বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ শ্রমণদের কথা তাঁদের বিবরণে উল্লেখ করেছিলেন, মনে করা হয়, দাঁতনের অমরাবতী বা আজকের মোগলমারিতে আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারটি তারই একটি।
একাল
অতীত কথার পর্বে আমরা দেখলাম, ময়না, বাহিরী বা দাঁতনে বৌদ্ধধর্মের সাক্ষ্য বহনকারী কিছু নিদর্শন আছে মাত্র। কিন্তু সেকালের এই বৌদ্ধকেন্দ্রগুলিতে বর্তমানে বৌদ্ধধর্ম বা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর কোনো অবস্থান পাওয়া যায় না। এমনকী তমলুকের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। এবার আমরা দৃষ্টি ফেরাব বর্তমানের দিকে। দেখা যাচ্ছে, মেদিনীপুর নগরীতে এবং তৎসংলগ্ন খড়গপুর-হিজলী রেলশহরে কিছুসংখ্যক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করেন এবং তাঁরা নিয়মনিষ্ঠভাবে বৌদ্ধধর্মকেই অনুসরণ করেন। একটি নিবিড় সমীক্ষা চালিয়ে এসম্পর্কে যে তথ্য উঠে এসেছে, রিপোর্টাকারে তা এখানে পেশ করা হল। সাম্প্রতিককালে এই জেলার দক্ষিণ সীমান্তবর্তী মোগলমারি নামক স্থানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক উৎখননে যে বিশাল বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হচ্ছে, তা থেকে প্রমাণ হয়, সেকালে বৌদ্ধধর্ম কেবল তাম্রলিপ্ত বা সংলগ্ন অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। জেলার বহু অঞ্চলেই তার বিস্তৃতি ঘটেছিল। বিশেষত বৌদ্ধ পরিব্রাজক ও ধর্মপ্রচারকদের শান্তি ও মৈত্রীর বাণী সাধারণ জনসমাজকেও সৎ, ন্যায়বান ও পরমতসহিষ্ণু করে তুলেছিল। ফলে, সামাজিক সুস্থিতিরও কারণ হয়ে উঠেছিল সেই ধর্মপ্লাবন। কিন্তু সেই সময়কালে বর্তমানের মেদিনীপুর শহর এলাকায় এই ধর্মের কতটা প্রভাব ছিল, তা সঠিকভাবে পরিমাপ করা যায় না।
অতি প্রাচীনকালে মেদিনীপুরে বজ্রযানীরা একটি কেন্দ্র স্থাপন করে তাঁদেরগুরুবাদী ধর্মমত প্রচার করেছিলেন। ‘সকল জীবকে এমনকী অন্ত্যজ, জরায়ুজ, সংস্বেদজ, উপপাদুক (অশ্বাদির ন্যায় ক্ষুরবিশিষ্ট), রূপী, অরূপী, সংজ্ঞী, অসংজ্ঞী, নৈবসংজ্ঞানাসংজ্ঞী অর্থাৎ চৈতন্য বা অচৈতন্যের বহির্ভূত সকল প্রাণীকে বোধিসত্ত্ব নির্বাণে প্রতিষ্ঠিত করিবেন—এই সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা-র কথাই তাঁরা মানুষের মধ্যে প্রচার করেছিলেন। এই জেলার বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধযুগের বহু মূর্তি এখনও দেখা যায়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কিছু মানুষও আছেন এই জেলায় এবং তন্ত্রযানী বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এদেশের ধর্মঠাকুর, জ্বরাসুর ইত্যাদি লৌকিক দেবতার পূজাপদ্ধতির মধ্যে দেখা যায়।
বর্তমানে মেদিনীপুর শহরে ক্ষুদ্র হলেও বৌদ্ধধর্মের একটি সচল স্রোতধারা প্রবাহিত আছে। এই প্রবাহের নব সূচনা হয় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মুষ্টিমেয় কয়েকটি উদবাস্তু বৌদ্ধ পরিবারের তৎপরতায়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের ডিডিপিআই শ্রীদেবব্রত বড়ুয়ার উদ্যোগে স্থানীয় বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরে সমারোহ সহকারে একটি বুদ্ধজয়ন্তী উদযাপনের আয়োজন হয়। সেই সমাবেশ থেকেই ‘মেদিনীপুর বৌদ্ধ সমিতি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করে। সমিতির লাগাতার প্রচেষ্টায় কয়েক বছরের মধ্যে একখন্ড জমি ক্রয় করা হয়। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে নিজেদের দান এবং নানা স্থান থেকে সংগৃহীত অর্থে নিজেদের আত্মানুকূল্যে সেই জমির উপর একটি ছোটো মন্দির নির্মাণ করে একটি বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
২০১০ খ্রিস্টাব্দে পূর্বের সমিতির নাম পরিবর্তন করে ‘পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বৌদ্ধ সমিতি’ রাখা হয়েছে। বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে মন্দিরের কলেবরেও। বর্তমান মন্দিরগৃহটি দ্বিতলবিশিষ্ট। সারা পশ্চিমবঙ্গে মেদিনীপুরের এই বৌদ্ধবিহারটি দ্বিতীয় বৃহত্তম। বৃহত্তম মন্দিরটির অবস্থান কলকাতার বেহালায়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরের এই মন্দিরে থাইল্যাণ্ড থেকে আনীত অষ্টধাতুনির্মিত একটি বৃহৎ বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মূর্তি। প্রথম মূর্তিটি আছে দিগবেড়িয়ায়।
মেদিনীপুর বিহারে ভিক্ষু আছেন শ্রীল সুনির্মল ভিক্ষু। গেরুয়াধারী এই সন্ন্যাসী-যাজক মানুষটি আদতে ত্রিপুরার অধিবাসী। কলকাতার সন্নিকটে শ্যামনগরে একটি বৌদ্ধসংঘ এবং একজন প্রবীণ সুম্বুধী মহাস্থবির আছেন। কিন্তু মেদিনীপুরের বিহারটি দিল্লি বৌদ্ধসংঘের অধীন। মেদিনীপুরের ভিক্ষু সেকারণে দিল্লির ‘সংঘরাজ’ শ্রীল সত্যপাল মহাথেরো কতৃক নিযুক্ত হয়েছেন।
মেদিনীপুরের মন্দিরটি এই জেলার কেন্দ্রীয় বিহার। মেদিনীপুর শহরের ২০-২৫টি পরিবারের সাথে খড়গপুর শহরের ৪০-৪৫টি বাঙালি পরিবার ও প্রায় সমসংখ্যক মারাঠি পরিবার এবং সালুয়ার নেপালি পরিবারগুলিও মেদিনীপুরের এই কেন্দ্রীয় বিহারের বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে নিয়মিত শামিল হন। অবশ্য আকারে ছোটো হলেও খড়গপুরে মারাঠিদের এবং শালুয়ায় নেপালিদের নিজস্ব বৌদ্ধমন্দির আছে।
মেদিনীপুরের বিহারে সকাল-সন্ধ্যা প্রার্থনাসহ নিত্য পূজা হয়। কোনো কোনো পরিবার নিজেরা দুপুরের ‘আহার্যপূজা’ নিয়ে আসেন ভগবান বুদ্ধের জন্য। আশ্বিনী পূর্ণিমা এবং বৌদ্ধ পূর্ণিমা পালন হয় ঘটা করে।
‘কঠিন চীবর দান’-এর অনুষ্ঠানও হয় এখানে। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে যে ভিক্ষু বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে অবস্থান করেন, কেবল তিনিই চীবর দানের অধিকারী। আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত একমাস কালব্যাপী কঠিন চীবর দান উৎসব পালিত হয়। মেদিনীপুরের মন্দিরে যথেষ্ট সমারোহের সাথে পালিত হয় এই উৎসব। সমবেত প্রার্থনা, সংঘদান,পঞ্চশীল গ্রহণ করেন সমবেত ভক্তরা। পঞ্চশীল গ্রহণ করেন মন্ত্র উচ্চারণ করে—
১. পানাধিপাতা বেরোমনি শিক্ষপদং সমাধিয়ামি।
২. আদিন্যাদানা বেরোমনি শিক্ষপদং সমাধিয়ামি।
৩. মুসাবাদা বেরোমনি শিক্ষপদং সমাধিয়ামি।
৪. সুরামেরায়া মাজ্যা পামাদাঠ্যানা বেরোমনি শিক্ষপদং সমাধিয়ামি।
৫. কামেসু মিথ্যাচারা বেরোমনি শিক্ষপদং সমাধিয়ামি।
এর পাশাপাশি ব্রাহ্মণদের উপনয়ন কিংবা খ্রিস্টানদের ব্যাপ্টিজম-এর মতো বৌদ্ধ পরিবারের কিশোরদের ‘প্রব্রজ্যা গ্রহণ’-এর অনুষ্ঠানও হয় মাঝেমধ্যে। সেসময় মস্তক মুন্ডন করে মন্দিরের ভিক্ষুর কাছ থেকে ‘চীবর’ গ্রহণ করতে হয় নতুন শ্রমণকে। তাকে ৭ দিন মন্দিরেই অবস্থান করতে হয় এই প্রব্রজ্যার সময়কালে। প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেই একজন ব্যক্তি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। শ্রামণ্যধর্ম গ্রহণের পর ২০ বছর বয়স হলে, ‘উপসম্পদা’ গ্রহণের বিধান আছে। এই উপসম্পদা গ্রহণ করলে তবেই ভিক্ষু হতে পারা যায়।
তথ্যসূত্র :
• বৃহৎবঙ্গ—দীনেশচন্দ্র সেন।
• বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)—নীহাররঞ্জন রায়।
• মেদিনীপুরের ইতিহাস—যোগেশচন্দ্র বসু।
• পাল-সেন যুগের বংশানুচরিত—ড. দীনেশচন্দ্র সরকার।
• বিদেশীদের চোখে ভারতবর্ষ : ফা-হিয়েন—শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মুখোপাধ্যায় (Travels of Fa-hien by Legge গ্রন্থের অনুবাদ)
• Annals Of Rural Bengal—W.W. Hunter
• Orissa—W.W. Hunter