মেট্রোপলিটন মন
কেবল রমণ করেছে এবং খবরের কাগজ পড়েছে এমন একটি জীব হল আধুনিক মানুষ। ক্যামু বলেছেন যে, এই একটি বাক্যেই নাকি আধুনিক মানুষের ‘ডেফিনিশন’ শেষ হয়ে যায়, তারপর আর কিছু বলার থাকে না। দুটোই যান্ত্রিক অভ্যাস, কোনোটাতেই প্রমাণ নেই, মন নেই। যেমন রমণের ধরন তেমনি খবরের কাগজ পড়ন। ধনতান্ত্রিক যান্ত্রিক সমাজে এই হল মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি। এই কথাটুকু ক্যামু যদিও বলেননি তাতে ক্ষতি নেই।
তনুক পসেদে পসাহনি ভাসলি
পুলক হু তইসন জাগু।
চুনি চুনি ভএ কাঁচুঅ ফাটলি
বাহুক বলআ ভাঁগু।।
ভন বিদ্যাপতি কম্পিত কর হো
বোলল বোল ন যায়।
‘দেহের প্রস্বেদে প্রসাধন ভেসে গেল, এমন পুলক জাগল যে কাঁচুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ফেটে গেল, বলয় ভাঙল। বিদ্যাপতি বলছেন, তারপর যা হল তা আর বলা যায় না, হাত কাঁপছে।’ তখন কবিরও হাত কাঁপতে ‘সেই’ কথা লিখতে। এখন আমাদের হাত কাঁপে না। অটোমোবিলের মতো অটোমেটিক লেখায় শুধু আধুনিক মানুষের জীবনের রমণ ও ভোজনের কথা অনর্গল বলা যায়। অথচ মানুষের সেই দেহ তো দেহই আছে কিন্তু সেই প্রস্বেদ নেই, যা আছে তার নাম ঘাম এবং দুর্গন্ধ ঘাম। অথচ সেই মানুষের গোনাগুনতি নার্ভগুলো একই আছে, একটিও বাড়েনি বা কমেনি। কিন্তু সেই রোমাঞ্চ নেই, সেই পুলক নেই, সেই শিহরন নেই যার ঝংকারের প্রতিধ্বনিতে একদা কাঁচুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ফেটে যেত, একদা বাহুর বলয় খানখান হয়ে ভেঙে যেত। ক্লান্তি আর অবসাদের বেড়া দিয়ে ঘেরা স্নায়ুগুলো যেন জীবনের সমস্ত নিবিড় অনুভূতি থেকে বঞ্চিত এবং মানুষ একটা নির্মম ঔদাস্যের দ্বীপে দ্বীপান্তরিত।
জর্জ সিমেল আধুনিক মানুষের এই মনোভাবকে বলেছেন ‘blase attitude’—নির্বাণ নয়, কতকটা নির্বিকারত্ব বলা যায়। কোনো কিছুতেই ‘বিকার’ নেই। সমস্ত ‘বিকার’ জনতার, নির্বিকার কেবল ব্যক্তি। ব্যক্তিসত্তা জনতাপিণ্ডে বিলীন। মনে হয় যেন অসংখ্য অকেজো অসাড় নার্ভের ঘাতপ্রতিঘাতে প্রত্যেকের নার্ভেই সাড়া জাগে এবং একটা—কি—দুটো তারে তীব্র ঝংকার ওঠে। জনতার বাইরে এসে যখন ‘ব্যক্তি’ দাঁড়ায় তখন সে ভয়ংকর নির্জন। শুধু নির্জন নয় যেন তার দেহের নার্ভগুলো একগোছা ছেঁড়া তারের বান্ডিল। বাইরের অবিরাম ঘর্ষণে ঘর্ষণে তার স্নায়ুর শিরাগুলো দপ দপ করে জ্বলতে থাকে। এই ‘intensification of nervous stimulation’ হল সিমেলের মতে ‘metropolitan type of individuality’-র বড় বিশেষত্ব। মহানাগরিক জীবনের গড্ডলপ্রবাহে ঘন ঘন উত্তেজনার উসকানিতে স্নায়ুগুলো যদি দপ করে জ্বলে ওঠে আর নিভে যায় তাহলে জীবনের ব্যক্তিগত পরিবেশে কোনো মোচড়েই তার আর সাড়া জাগানো যায় না। শহরের রাজপথে ঘূর্ণিঝড়ে ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তারের মতো স্নায়ুগুলো পড়ে থাকে এবং তার ভিতরে কোনো ‘কারেন্ট’ থাকে না।
নার্ভে যখন ‘কারেন্ট’ থাকে না তখন একটা মাংসের ডেলার মতো আমরা গড়িয়ে গড়িয়ে চলি যেমন মোটর চলে, ট্রাক চলে, টেম্পো চলে, স্কুটার চলে। খুব ব্যস্ত হয়ে সকলে ছুটোছুটি করি। ব্যস্ততার চেতনা—ছাড়া বাকি সব চৈতন্য উধাও। বাইরের কোনো দৃশ্য, কোনো দ্রব্য, কোনো ঘটনা মনে কোনো সাড়া জাগায় না। চলন্ত ট্রেনে অন্ধ প্যাসেঞ্জারের মতো বাইরের দিকে চেয়ে থাকি। চোখ অবশ্য আমাদের খোলা থাকে আর চোখের মণিতে দৃশ্যের পর দৃশ্য, দ্রব্যের পর দ্রব্য প্রতিফলিত হতে থাকে কিন্তু চোখের মণি থেকে মনের মণিকোঠায় তা পৌঁছোয় না। চোখ থেকেই ঠিকরে বিদ্যুৎঝলকের মতো সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়। মহানগরের রাজপথে নিরাশ্রয় অসহায় মানুষের মৃতদেহ বাসি হয়ে শুকিয়ে পড়ে থাকে আর লক্ষ লক্ষ মানুষ তার পাশ দিয়ে চলে যায়, হয়তো ধাক্কা লেগে হোঁচট খায় কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করে না। শহরের রাজপথে অভুক্ত মানুষের কাতরানি অসংখ্য ‘ভেইকল’—এর নিউম্যাটিক টায়ারের ঘড়ঘড়ানিতে ডুবে যায়, শোনা যায় না। প্রতিদিন জীবনের এই স্রোত বইতে থাকে, একঘেয়ে একটানা স্রোত, একশব্দ একসুর একতান একতাল একছন্দ। চোখের সঙ্গে মন এবং মনের সঙ্গে আরও গভীরে যে হৃদয়ের গুহা তার যাবতীয় যোগাযোগ ছিন্ন। টেলিফোনের তারগুলো ছিঁড়ে যায় আর চোখের রেটিনাতে রিং বাজে কিন্তু মনে বাজে না। মনে যদি কখনো রিং শোনা যায় তাহলে বুঝতে হবে সেটা ফলস রিং, কারণ হৃদয়ের গুহার সঙ্গে সংযোগের তারটি একেবারে ‘ডেড’ হয়ে থাকে। তার ফলে ‘হৃদয়’ নামক গুহাটি প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে এবং পেলিওলিথিক গুহার মতো তাকে খুঁজে বার করতে হয়। কিন্তু মহানগরের ইট—পাথর—কংক্রিট—স্টিলের মধ্যে পেলিওলিথিক গুহা কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?
মন্ত্রী যদি যন্ত্রের ব্যবহার না করে তাহলে যন্ত্রে মরচে ধরে যায় এবং তাতে আর কোনো কাজ হয় না। ধনতান্ত্রিক মহানগরের মানুষের কাছে হৃদয় পরিত্যক্ত। জীবনে এই বস্তুটি তার কোনো কাজে লাগে না। সেখানে আর বাস করা যায় না যেহেতু বাস করার প্রয়োজনও হয় না। নির্বংশ পরিবারের বাস্তুভিটের মতো শহরে মানুষের হৃদয়ে আজ ঘুঘু চরছে। এক খণ্ড ইট অথবা এক টুকরো পাথর অথবা একটা লোহার রড অথবা একবস্তা সিমেন্ট, এসবের দাম আছে কিন্তু হৃদয়ের কোনো দাম নেই। শহরের কোনো এক্সপার্ট নিলামওয়ালাও পাবলিক অকশনে তাকে এক পয়সা দামেও বেচতে পারবে না। বোদলেয়ার তার সুলভতা দেখে বেদনা পেয়েছেন। বোদলেয়ার যা তাঁর ‘জার্নাল’—এ ‘The cheapening of hearts’ বলেছেন তা যদি আজকের মনোপলি টেকনোলজির ভোগের স্বর্গে দেখতেন তাহলে আরও অনেক বেশি অবাক হয়ে বিলাপ করতেন। বস্তুত কার্ল মার্কস ধনতান্ত্রিক সমাজের এই মর্মান্তিক ব্যক্তিবিচ্ছিন্নতার (alienation) ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আমার মনে হয় শুধু সুলভ বললে আজকের নাগরিক হৃদয়ের কথা কিছুই বলা হয় না। হয়তো বোদলেয়ারের কালে শতাধিক বছর আগে বুর্জোয়া সভ্যতার সংস্পর্শে বাজারের বহু পণ্যের প্রতিযোগিতায় হৃদয়পণ্যের মূল্য যখন কম ছিল তখন এই কথাটাই ঠিক ছিল। কিন্তু এখন হৃদয় শুধু সস্তা নয়। সস্তা জিনিসেরও সত্তা আছে কিন্তু নাগরিক জীবনে হৃদয়ের কোনো সত্তাই নেই। যে মহানগরে চোখ আছে, মন নেই এবং মনের সঙ্গে হৃদয়ের কোনো যোগ নেই সেই মহানগরে খবরের কাগজ, প্রাচীর দেওয়াল, মানুষের মুখ সবকিছু দিয়ে শুধু অপরাধের দুর্গন্ধ ঘাম চুঁইয়ে পড়ে (‘everything sweats with crime’)।
সকালে উঠে খবরের কাগজ দেখলে বোদলেয়ারের বিবমিষা হত। আমাদেরও হয় তবে ভোরে ঘুম ভাঙলে স্নায়ুগুলো যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তখন খবরের কাগজের উত্তেজক চোলাই দিয়ে একবার চারিয়ে নিয়ে সেগুলোকে জাগাতে হয়। এটাও নাগরিক জীবনের অনেক অভ্যাসের মতো একটা যান্ত্রিক অভ্যাস। সেদিন সকালে উঠে কাগজ পড়তে পড়তে হঠাৎ ‘বোল্ড’ টাইপের এই সংবাদটির দিকে নজর পড়ল :
S E A R C H F O R
CAR OWNER
WHO SAVED A LIFE
By a Staff Reporter
A Bengali family of Calcutta is searching for a car with the number WBA 2280 to offer its thanks to its owner who saved from death the head of the family, a field-surveyor of the Geological Survey of India. The 44-year old field-surveyor had suffered a coronary stroke immediately after he had alighted from a tram at the crossing of Chowringhee and Red Road on his way to office on Tuesday morning. As he crouched on the road, many pedestrians and cars passed by without caring to look at him or help him.
Out of the stream of passing cars, one stopped. Its owner came out and lifted the disabled man into his car and took him to the G.S.I Office on Chowringhee where the colleagues of the field-surveyor got him admitted to a hospital.
The Statesman, 10 July 1965
অটোর অনর্গল বন্যার মধ্যে WBA 2280 গাড়ির মালিককে আমিও অনেকদিন খুঁজেছি। কেন খুঁজেছি জানি না তবে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত পথ চলতে চলতে কেবল গাড়ির নম্বরের দিকে তাকিয়ে দেখতাম। ‘পরশপাথর’ নয়, কিন্তু ওই ধরনের কিছু একটা যেন খুঁজতাম কলকাতা রাজপথে। নির্জলা মরুভূমির মধ্যে ওয়েসিস? হয়তো তা—ই কিন্তু চারদিকের পাথর আর লোহার মধ্যে জল কোথায়?
এখানে জল নেই শুধু পাথর
কালো পাথর জল নেই অনাবৃত মরুপথ
পাহাড়ের বুক চিরে আঁকাবাঁকা পথ
পাথর—ঢাকা পাহাড়ে এক ফোঁটাও জল নেই
জল যদি থাকত
আমরা দাঁড়াতাম
একটু জল খেতাম।
কিন্তু পাথরের বুকে কি কেউ দাঁড়াতে পারে
না একটু ভাবতে পারে?
ঘামও শুকিয়ে যায়
পা দুটো বালিতে আটকায়।
যদি একটু জল থাকত
পাথরে
একটু জল
মৃত পাহাড়ের দাঁতে বা জিবে কোথাও জল নেই
এখানে কেউ না পারে দাঁড়াতে
না পারে বসতে
না পারে জিরোতে
এ পাহাড়ে স্তব্ধতাও নেই
কেবল খরা বিদ্যুতের গর্জন
বৃষ্টিহীন
এখানেও একটু নির্জনতা নেই
শুধু লাল লাল ক্রুদ্ধ মুখের ভ্রূকুটি
আর দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণ।
মাটিঘরের ফাটা দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে
যদি একটু জল থাকত এখানে!
এবং যদি না পাথর থাকত—
অথবা পাথর থাকত
এবং জলও থাকত
একটু জল
ছোট একটা ঝরনা
পাহাড়ের বুকে একটা আবর্ত—অথবা
শুধু যদি জলের শব্দ শোনা যেত
ঝরঝর—
ঝিরঝির— (টি. এস. এলিয়ট অনুসরণে, লেখককৃত)
পাথরের মধ্যে ২২৮০—কে দেখতে পাইনি। ২২৮০—র মালিক বা চালক যে—ই হোন—না কেন তাঁর চোখের সঙ্গে মনের এবং মনের সঙ্গে আদিম অন্তঃকরণের সংযোগ ছিন্ন হয়নি। কেন হয়নি কে জানে!
সংবাদটা পড়ে মনে হল মানুষ কত ক্ষুদ্র, কত নগণ্য এই স্থূলকায় মহানগরে। মনে হল কোন সভ্যতা, কোন সমাজ মানুষকে আজ এত হেয়, এত নগণ্য জীবে পরিণত করেছে। যদি মহানগরের ‘মাল্টিস্টোরিড স্কাইস্ক্রেপার’—এর ইস্পাত—কঙ্কালের পাশে যে—কোনো মানুষের হাড়ের কঙ্কাল দাঁড় করিয়ে দূর থেকে দেখা যায় তাহলে শহরে মানুষ মাপার স্কেলটা চোখের সামনে বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন কেন, হাজার মানুষ কি লক্ষ মানুষ যখন এই অট্টালিকাসারির কোল দিয়ে চলতে থাকে তখন তার চুড়ো থেকে দেখলে মনে হয় যেন কীটের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কীটের মন নেই। কিন্তু কোনো অক্ষম অসহায় কীটকে অন্য কীটেরা ফেলে যায় না, সকলে মিলে তাকে বহন করে নিয়ে যায়। ধনতান্ত্রিক মহানগরের মানুষ তা—ও করেন না। মৃত মানুষ, অবশ্যই নিরাশ্রয় নিঃসম্বল মৃত মানুষ, মহানগরের শান—বাঁধানো পেভমেন্টে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। শুকনো গাছের ডালের মতো ঝড়বৃষ্টিতে রাজপথের পাশে পড়ে থাকে আর তার পাশ দিয়ে লোকের স্রোত বয়ে যায় কিন্তু কীটের মতো অন্যান্য পোকার মতো যেমন পিঁপড়ের মতো কেউ তাকে বহন করে নিয়ে যায় না। দু—দিন পরে হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানের লোক আসে অথবা কর্পোরেশনের ধাঙড়—ডোমরা তার সৎকারের ব্যবস্থা করে। মহানগরে প্রতিষ্ঠান বড়, ইনস্টিটিউশন বড়, জনসভা বড়, জনতা বড় কিন্তু ব্যক্তি ছোট, মানুষ নগণ্য। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, মানুষের মানুষত্ব স্থূলকায় জনতার জড়পিণ্ডে বিলীন। মহানগরের জনস্রোতে প্রত্যেকটি মানুষ তাই নির্মম নির্বিকার।
রেড রোড আর চৌরঙ্গির মোড়ে অসংখ্য অটোর ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ের মধ্যে একটি গাড়িকে থমকে দাঁড়াতে হল। একজনকে তো দাঁড়াতেই হবে, কারণ তা না হলে তো সবই থেমে যাবে। একটি গাড়িও যদি না থমকে দাঁড়াত, যদি ২২৮০ গাড়ির মালিক অটোর বন্যায় নিরেট কাষ্ঠখণ্ডের মতো ভেসে যেতেন আরও সকলের মতো তাহলে তো সমাজের হৃৎস্পন্দনটাই থেমে যেত। এখনও তা থেমে যায়নি বলে তাই ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটোছুটির মধ্যে একজন গাড়ির মালিক থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। করোনারি স্ট্রোকে আক্রান্ত ভদ্রলোক যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, তাঁর চেতনা ছিল না, তা না হলে এই অপূর্ব চলচ্চিত্র সজ্ঞানে দেখলে তিনি কী বলতেন কে জানে!
সেইদিনই সন্ধ্যায় এক অনভিজাত সাধারণ শরাবখানায় অপরিচ্ছন্ন নোংরা পরিবেশে হাউলিং হট্টগোলের মধ্যে বসে কলকাতা শহরের কথা ভাবছিলাম। কী আর ভাবব! ভিড়ের মধ্যে আমার নির্জনতায় আঘাত লেগেছে অনেকবার। এপাশ—ওপাশ থেকে অনেকের উলটোপালটা প্রশ্নে অনবরত জর্জরিত হতে হয়েছে। মুটেমজুর, মধ্যবিত্ত সকলের প্রশ্ন। ঠিক প্রশ্ন বলা যায় না। ক্লেদ আর গ্লানি আর অবসাদ আর হতাশার একটা দরবিগলিত ধারা, এক নম্বর, দু—নম্বর, তিন নম্বরের শ্রাবণধারার মতো অবিশ্রান্ত ঘরের মধ্যে বর্ষণ হচ্ছে। মানুষগুলো সব ক্রন্দনে—উল্লাসে কখনো গর্জে উঠছে, কখনো বা ককিয়ে উঠছে। কর্ণপটাহভেদী বজ্রনির্ঘোষ, তার সঙ্গে নেড়িকুকুরের নাকিকান্না :
এই চালে ভাই জীবনের শেষ
এই চালে ভাই দুনিয়ার শেষ
প্রচণ্ড বজ্রনির্ঘোষে নয়
নেড়িকুকুরের নাকিকান্নায়।
(এলিয়ট অনুসরণে)
হঠাৎ উত্তেজনার অগ্নি উদগিরণে ঘরের ভিতরটা মনে হল চুল্লির মতো, যেন মুখ থেকে মুখে, দাঁত থেকে দাঁতে আগুনের হলকা ছুটতে থাকল। তার পরমুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেল সব। লাল আভাটা কালো হয়ে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। মুখগুলো যেন কেমন ছাই মাখা। সকলের ভয় হল আবার সেই বাইরের একঘেয়ে জীবনে ফিরে যেতে হবে ভেবে। জীবনটা শরাবখানা নয়। যদি তা—ই হত! তারা জানে এই জীবনটার শেষ হবে বজ্রের আওয়াজে নয়, নেড়িকুকুরের নাকিকান্নায়। তারা জানে এই রাতটুকু ভোর হতে—না—হতেই এবং এই এক—দুই—তিন নম্বরের নেশাটুকু কাটতে—না—কাটতেই আবার কাল থেকে কলকাতার ক্লান্তিকর কলের চাকায় জীবনের শরাবটুকু আখমাড়াইয়ের মতো নিংড়ে বেরিয়ে যাবে, কারণ যন্ত্র শুষবে, মুনাফাখোরদের যন্ত্র।
ভদ্রলোককে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে চুপিচুপি। বসে বসে সেই কথা ভাবছিলাম। হাসপাতালে রোগীদের করুণ আর্তনাদ শোনা যায়, শারীরিক যন্ত্রণার আর্তনাদ। শরাবখানাও হাসপাতাল। শারীরিক নয়, মানসিক ব্যাধি আর যন্ত্রণার গোঙানি শোনা যায় সেখানে। বেদনার বোঝা সারাদিনের ক্লান্তির পর শরাবখানায় কিছুক্ষণের জন্য নামিয়ে রেখে মনটা হালকা করা যায়। যদি শরাব না থাকত। শরাবখানা না থাকত। তাহলে হাড়েমজ্জায় ঘুণ—ধরা এই ধনবৈষম্যজর্জর সমাজটাকে মানসিক ব্যাধির হাসপাতালে ছেয়ে ফেলতে হত। এইসব শরাবখানায় কতদিন কত লোককে দেখেছি অঝোরে কাঁদতে। কে বলেছে মানুষের মন নেই? মন যে ছিল বা আছে তা এখানে বোঝা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতো মনটা স্নায়ুস্তরের অনেক তলায় সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছে। স্তরের পর স্তর স্নায়ুর তলা থেকে তাকে খুঁড়ে বার করতে হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো সরাব তা—ই করে শরাবখানায়। অভিজাতদের bar-হোটেলে এ দৃশ্য দেখা যায় না। সেখানে ককটেল আর টুইস্টের আবর্তে কালো টাকা ওড়ানোর উল্লাস বজবজিয়ে ওঠে। বান্ডিল বান্ডিল নোটের লাটাই খুলছে আর ফুর্তির ঘুড়ি উড়ছে ফুরফুর করে, ব্লুফক্স আর স্কাইরুমের আকাশে সাধারণের শরাবখানায় তা হয় না। সেখানে সারাদিনের মজুরি অর্ধেক খরচ করে মনের বোঝা নামানো হয়। বুর্জোয়া সভ্যতা মানুষের সমাজকে খণ্ড খণ্ড করে, মানুষের মনকে টুকরো টুকরো করে, মানবসমাজকে যে কী বীভৎস পাগলাগারদে পরিণত করেছে তা সাধারণ—অসাধারণ যে—কোনো শরাবখানায় গেলে বোঝা যায়।
আড়াইশো বছরের কলকাতা শহর চলচ্চিত্রের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল। দু—শো বছর আগেও কলকাতা শহরে অনেক ট্যাভার্ন ছিল কিন্তু সেগুলো ছিল ইংল্যান্ডের জনসন যুগের ট্যাভার্নের মতো। একালের শরাবখানার মতো জীবনের নালা নর্দমার সংগম ছিল না সেকালের ট্যাভার্নে। সেই ট্যাভার্নও আর নেই এবং সেই কলকাতা শহরও আর নেই। জোব চার্নক আর জনসনের যুগ কবে শেষ হয়ে গিয়েছে। পুরো আঠারো শতক, পুরো উনিশ শতক পার হয়ে বিশ শতকের বার্ধক্যে পৌঁছেছি আমরা। ৬৭ বছর বয়স হল বিশ শতকের। কলকাতা শহরও বয়সের দিক থেকে অতিবৃদ্ধ। বার্ধক্যজনিত ভীমরতি আর জরার চিহ্ন তার মনে, তার সর্বাঙ্গে। চার্নক থেকে কুমোরটুলির কালানায়েব, গোবিন্দরাম মিত্র ও শোভাবাজারের নবকৃষ্ণর আমল পর্যন্ত গোটা আঠারো শতকের কলকাতাকে নাগরিক সভ্যতার আদিযুগ বলা যায়। নতুন ইংরেজ রাজাদের রাজসভা, প্যারেড আর বর্ধিষ্ণু রাজধানীর নতুন—পুরাতনের মিশ্ররূপ তখন ছিল কলকাতা শহরের বড় বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগের নগরের সমস্ত উত্তরাধিকার নিয়ে কলকাতার নাগরিক পত্তন হয়েছে এবং তার বাল্যকাল ও কৈশোরও কেটেছে। কলকাতার অধিকাংশই ছিল তখন গ্রাম্য প্রাকৃতিক নিদর্শনে ভরা। ধানখেত, পুকুর, বাঁশবন পথে বেরোলেই দেখা যেত। সবুজের অভাব ছিল না। গোবিন্দরাম আর নবকৃষ্ণরা তাই সতেজ সজীব মন নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কর্ম—অপকর্ম যা—ই করুন তাঁরা সবই জ্যান্ত মানুষের মতো করেছেন। প্রতাপ ছিল তাঁদের। চার্নক যখন কুঠি বাঁধতে এসেছিলেন তখন কলকাতার গ্রামগুলোতে আট হাজারের মতো লোক থাকত। আঠারো শতকের গোড়াতে গ্রামগুলোতে প্রায় ত্রিশ হাজার লোক হল এবং শুধু ইংরেজদের এলাকায়—সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও ডিহি কলিকাতা এই তিনটি গ্রামে—লোক হল প্রায় পনেরো হাজার। আরও পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আঠারো শতকের মাঝামাঝি লোক বেড়ে হল ইংরেজ এলাকায় প্রায় দেড় লক্ষ এবং সব মিলিয়ে প্রায় তিন লক্ষ। আরও পঞ্চাশ বছর পরে উনিশ শতকের গোড়ায় কলকাতার লোক হল পাঁচ লক্ষ। এই পাঁচ লক্ষ লোক নিয়ে ওয়েলেসলির আমলে কলকাতা মধ্যযুগের উত্তরাধিকার ঝেড়ে ফেলে আধুনিক শহরের রূপ ধারণ করতে থাকল। তার পথঘাট, ঘরবাড়ি বদলাতে আরম্ভ করল যদিও মধ্যযুগের ভূত শহরের স্কন্ধ থেকে পুরো নামল না এবং আজও নামেনি, কারণ কলোনিয়াল শহরের অভিশাপ।
পুরো উনিশ শতকে দেখা যায় লোকসংখ্যা খুব বাড়েনি, একশো বছরে দ্বিগুণও হয়নি, পাঁচ লক্ষ থেকে সাড়ে আট লক্ষ হয়েছিল (১৯০১)। কলকাতা শহরের বাড়িঘরের সংখ্যাবৃদ্ধি থেকেও তার বিকাশের একটা হদিশ পাওয়া যায়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতা শহরে একতলা বাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় ছ—হাজার, দোতলা প্রায় সাড়ে ছ—হাজার, তিনতলা প্রায় সাতশো, চারতলা দশটি, পাঁচতলা একটি। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে (১৯০১) এই বাড়ির সংখ্যা বেড়ে হয় একতলা বাইশ হাজার, দোতলা তেরো হাজার, তিনতলা তিন হাজার, চারতলা তিনশো, পাঁচতলা একুশখানা। লোকসংখ্যার অনুপাতে বাড়ির সংখ্যা বেশি বেড়েছিল দেখা যায়। বর্ধিষ্ণু শহরের বসবাসের কোনো সমস্যা উনিশ শতকে দেখা দেয়নি। ওয়েলেসলির আমল থেকে লটারি কমিটি, নগর উন্নয়ন কমিটি এবং তারপর কর্পোরেশনের কাজকর্ম থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে নতুন ধনতান্ত্রিক—সামাজিক জীবনের তাগিদে অন্যান্য দেশে যেমন আধুনিক শহরের বিকাশ হয়েছে আমাদের দেশেও আঠারো—উনিশ শতকে কলকাতায় তা—ই হয়েছিল। সামাজিক প্রয়োজনের বৈচিত্র্য এবং সেই প্রয়োজন পরিতৃপ্তির কলাকৌশলের জটিলতা শহরে ক্রমে বাড়তে থাকল। শহরের সময় (time) অফুরন্ত নয়। অজ্ঞাতসারে ঢিমেতালে সূর্যের প্রদক্ষিণের ছন্দে শহরের সময় কাটে না। কোনো একটিমাত্র ‘বর্তমান’—এর স্বেচ্ছাচারিতা শহরে নেই, কোনো একটিমাত্র ‘ভবিষ্যত’—এর একঘেয়েমিও নেই, যে ভবিষ্যৎ অতীতের পুনরাবৃত্তি মাত্র। সময়টা শহরে প্রতিটি সেকেন্ডের টুকরোয় ভাগ করা এবং বুর্জোয়াদের বিচারে প্রতিটি সেকেন্ডের অর্থমূল্য আছে। তাই প্রতিটি সেকেন্ডের রং বদলায়। বহু বিচিত্র রঙে রঙিন, বহু বিচিত্র ছন্দে আন্দোলিত শহরের সময়তরঙ্গ। তারই বর্ণচ্ছটা নতুন শহরের মানুষের জীবনে প্রতিফলিত। যেমন সময় তেমনি কর্ম। ছকবাঁধা কর্মের শৃঙ্খলে শহরের মানুষের জীবন বংশানুক্রমে বাঁধা থাকে না। কুলগত বন্ধন ছিন্ন করে কর্মময় জীবন সমাজের বহুমুখী দিগন্তবিস্তৃত পথে ধাবিত হয়।
জীবনের একটা সিম্ফনি উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত কলকাতা শহরে শোনা গিয়েছিল যে সিম্ফনির কথা মামফোর্ডের মতো নগরবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করতে ভোলেননি। সময়ের রং এবং সামাজিক কর্মের ছন্দের মধ্যে তখন একটা সংগতি ছিল। এই সিম্ফনি এবং সংগতির ফল হল উনিশ শতকের উপরতলার উদ্ভট নবজাগরণ। যদিও তার ভিত আদৌ দৃঢ় ছিল না ঔপনিবেশিক পরিবেশে, তাহলেও নতুন জীবনের চলার ছন্দে ও সুরে নবযুগের একটা নতুন ঐকতান সমাজজীবনের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ক্ষীণসুরে ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। ঘোড়া আর স্টিম ইঞ্জিনের গতি দিয়ে জীবনের গতি তখন নিয়ন্ত্রিত হত। বর্তমান বিশ শতক থেকে এই সিম্ফনির সুর বদলাতে থাকে। ১৯০১ সালের সাড়ে আট লক্ষ লোক ১৯২১ সালে হয় নয় লক্ষ—১৯৩১ সালে এগারো লক্ষ—১৯৪১ সালে একুশ লক্ষ—১৯৫১ সালে পঁচিশ লক্ষ—১৯৬১—৬৬ সালের মধ্যে চল্লিশ—পঁয়তাল্লিশ লক্ষ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত বিশ শতকের প্রায় চল্লিশ বছরে, দশ—বারো লক্ষ লোকসংখ্যা বৃদ্ধি এমন কিছু বেশি নয়। মহাযুদ্ধের পর গত কুড়ি বছরের মধ্যে কলকাতার লোকসংখ্যা এত বেড়েছে যা তার আগের দু—শো বছরেও বাড়েনি। প্রায় আট কোটি লোকের কণ্ঠের আওয়াজে বেঠোফেনের সিম্ফনি যে আর শোনা যাবে না অথবা কোনো ভাগনার—বেঠোফেনের পক্ষেই যে আর সেই পুরোনো সিম্ফনি ‘কম্পোজ’ করাও সম্ভব নয় তা পরিষ্কার বোঝা যায়। পঞ্চাশোর্ধ্ব কলকাতার লোকজীবনের নতুন সিম্ফনি যিনি বা যাঁরা রচনা করবেন সেই সুরশিল্পীদের আজও আবির্ভাব হয়নি। যতদিন তা না হয় ততদিন কলকাতার জীবনে আর ‘সিম্ফনি’ শোনা যাবে না, শুধু শোনা যাবে কুৎসিত কর্কশ ‘ক্যাকোফনি’ এবং শুনতেও হবে তা—ই, শান্তির গজদন্তমিনার ফেটে চৌচির হয়ে যাবে সেই ক্যাকোফনিতে।
শহরের সবচেয়ে বেশি কর্মপ্রধান অঞ্চলকে ‘down-town area’ বলা হয়। কলকাতা শহরে এই ডাউনটাউন অঞ্চল গত আড়াইশো বছর ধরে একটি অঞ্চলেই আছে। লালদিঘি অর্থাৎ ডালহৌসি স্কোয়্যার কেন্দ্র করে ধর্মতলা পর্যন্ত ব্যাসার্ধ ধরে একটি বৃত্ত টানলে যে অঞ্চলটি হয়, সেইটাই কলকাতার ‘ডাউনটাউন অঞ্চল’। বিশ শতকের চল্লিশের মধ্যে কলকাতার মানচিত্রে এই অঞ্চলে শতাধিক স্কাইস্ক্রেপার আকাশমুখো ঠেলে উঠেছে। শহরের মানুষের চোখের সামনে থেকে দিগন্তের রেখাটুকু পর্যন্ত মুছে গেছে। মাথার উপরে নীল আকাশটুকুও ক্রমে ঢেকে যাচ্ছে। রাজপথের উপরে আকাশ, দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ঠিক পথেরই মতো এবং তার দু—পাশে কংক্রিটের প্রাসাদে দৃষ্টি অবরুদ্ধ। মনে হয় আকাশটা যেন একটা আয়না আর কলকাতা শহর তার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ দেখছে। আকাশটা খণ্ড খণ্ড হয়ে আঁকাবাঁকা অলিগলি ও ছোটবড় রাজপথে পরিণত হয়েছে। পথ চলতে মাথার উপরে আকাশের এই টুকরোগুলোকে দেখা যায়। আকাশ যেখানে টুকরো হয়ে যায় দৃষ্টিপথে সেখানে মন আর খোলা আকাশের মতো উদার থাকবে কী করে? শহরের মানুষ আকাশের উদারতা থেকেও বঞ্চিত।
আকাশ মাটি আর সবুজ। আকাশ খণ্ডিত। মাটি প্রায় অবলুপ্ত। যেমন বড়বাজারে মাটি কোথায়, ডালহৌসিতে মাটি কোথায়, চিৎপুরে, বউবাজারে পিচ—পাথর—খোয়া—বাঁধানো পথে ইট—পাথর—লোহা—কংক্রিটের বাড়ি। মাটি নেই। কর্পোরেশনের আইন অনুসারে পাশে—পশ্চাতে হয়তো মাটি আছে চার ফুট আর দশ ফুট যেমন মাটি আছে শহরের পার্কে পার্কে। কিন্তু শহরের ইট—পাথর—লোহার কঠিন অবয়বের মধ্যে মাটি আর সবুজের টুকরোগুলোকে মামফোর্ড বলেছেন ‘soiled handkerchief’ বা নোংরা ময়লা রুমালের মতো। শহরের বুকে মাটি আর সবুজের স্পর্শ রাখার এই কঠোর প্রয়াস নিতান্তই হাস্যকর। এই পাথরের মরুভূমিতে পার্কগুলো মরূদ্যানের মতো বিরাজ করবে বলে একদা যাঁরা কল্পনা ও পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা আজ সেগুলির অপরিচ্ছন্ন অবস্থা দেখলে শিউরে উঠবেন। পার্ক শুধু পার্ক নয়, খোলা বস্তি। শহরের যত ব্যাধিগ্রস্ত ভিখিরি, ছদ্মবেশী পলাতক, চোর—ডাকাত—গুন্ডা, ভবঘুরে নিরাশ্রয় নোঙরহীন লোক, যারা ধনতান্ত্রিক সভ্যতারই অভিশপ্ত প্রতীক, তাদের উন্মুক্ত ধর্মশালা কলকাতা শহরের পার্ক। পঁচিশ—তিরিশ বছর আগেও শহরের এই পার্কগুলিতে একটু খোলা জায়গা, এক টুকরো সবুজের উপর একটু নিভৃতে হয়তো একটা ফুলগাছের পাশে অভিভাবকদের আড়ালে অতিসন্তর্পণে ভয়ে ভয়ে শহরের তরুণ—তরুণীদের প্রথম প্রেমের রোমান্স জমে উঠত। এখন ভুলেও কেউ পার্কের দিকে পা বাড়ায় না। খোলা ময়দানে, লেক বা গঙ্গাতীরের ক্ষণস্থায়ী বুফে—কফি হাউস, রেস্তরাঁ বা হোটেল অথবা কোনো মোটেল হল বর্তমান কলকাতার তরুণ—তরুণীদের ‘give-and-take’—এর আদর্শ স্থান, কারণ প্রেম এখন ‘ফিজিয়োলজিক্যাল অ্যাবারেশন’ আর রোমান্স হল ইনস্যানিটির লক্ষণ। কাজেই হোটেল অথবা মোটেল তার পাপড়ি মেলার চরম কেন্দ্র। কিন্তু যা বলছিলাম অর্থাৎ পার্কের কথা। পার্ক এখন শহরের ঘৃণিত উপেক্ষিত আবর্জনা তুল্য মানুষের ডাস্টবিন, নোংরা রুমাল বললেও তাকে ট্রিবিউট দেওয়া হয়। পার্কের মাটি সুস্থ মানুষ স্পর্শ করে না। সকাল থেকে উঠে ম্যাকাডামাইজড রাস্তার উপর দিয়ে আমরা চলতে থাকি, ঘর থেকে বেরিয়ে অফিসে যাই, অফিস থেকে বেরিয়ে ঘরে আসি, পায়ের তলায় মাটির ছোঁয়া লাগে না। দেহের সঙ্গে মাটির সংযোগ নেই। এক কামরা, দু—কামরা বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়িতে আমরা থাকি, শান—বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে উঠি আর নামি, আট স্কোয়্যারফুট বারান্দায় টবে ফুলের বাগান করি, ছ—ইঞ্চি টবের মধ্যে প্রকৃতিকে বন্দি করে আমরা জীবনে সবুজের তৃষ্ণা মেটাই। টবের বাইরে কলকাতাকে মনে হয় ধূসর শহর যেন আমাদের ধূসর জীবনের প্রতিবিম্ব।
জীবনে আকাশ নেই, মাটি নেই, সবুজ নেই। মহানগরের জীবনে এক—কামরার ফ্ল্যাটবাড়ির রুদ্ধ ঘরের টবেরর ফুলগাছের মতো শহুরে মানুষের মন। আকাশের সূর্যকিরণ তাকে স্পর্শ করে না। মাটির বুক থেকে সে রস সঞ্চয় করে না। একটা অস্বাভাবিক পরিবেশে শুধু একটু কলের জল আর কয়লার ধোঁয়ার স্পর্শে তার বিকাশ হয়। এই নাগরিক মনে তাই ফুল ফোটে না। যদিও বা ফোটে তাহলেও তার রং ও রূপ বিকৃত হয়ে যায়। এই টবের মন নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের কর্তব্য পালন করি মেট্রোপলিটন শহরে।
Yet we have gone on living.
Living and partly living.
Eliot
পরিপূর্ণ বেঁচে থাকি না, আংশিক বেঁচে থাকি। শহরের মানুষের এই বাঁচার জন্য কত অনুষ্ঠানের যে সমারোহ তা বলে শেষ করা যায় না। সিনেমা ককটেল বার ঘোড়দৌড় ক্লাব নাইটক্লাব গেট টুগেদার জুয়ার আড্ডা নেশার আড্ডা শেয়ার মার্কেট—এরকম বহু অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের আয়োজন। মেট্রোপলিটন শহরের ‘party living’-এর আয়োজন। তাদের শতচ্ছিন্ন মন স্নায়ুর ছেঁড়া তারগুলোকে যত দূর সম্ভব উত্তেজনার মোচড় দিয়ে চাঙ্গা করার কী নিদারুণ ক্লান্তিকর প্রয়াস! ঢালু পাহাড়ের গায়ে সিসিফাসের পাথরের বোল্ডার তোলার চেষ্টার মতো, প্রাণপণে ঠেলে পাথরখণ্ড খানিকটা তোলা যায়, তারপর আবার গড়িয়ে পড়ে। মনের ছেঁড়া তারগুলো যত বেসুরো হয়ে যায়, যত অসাড় ও শব্দহীন হয় তত নাগরিক উত্তেজনার বৈচিত্র্য বাড়তে থাকে। সব উত্তেজনার বড় উত্তেজনা sex কিন্তু তাতেও তো তেমন কাজ হয় না। নেশাখোর যখন সমস্ত নেশাকে জয় করে ফেলে—আফিম, ভাং, মদ, কোকেন—তখন তাকে সাপের বিষ অথবা তার চেয়েও বিষাক্ত কোনো ড্রাগ ইঞ্জেকশন নিতে হয়। বিজ্ঞাপনে সেক্স, সিনেমায় সেক্স, পোস্টারে সেক্স, সংগীতের সুরভঙ্গিতে সেক্স, সাহিত্যে সেক্স, রাস্তায় চলাফেরায় সেক্স—শেষ পর্যন্ত সেক্সের ভাণ্ডারও শূন্য প্রায়। বাকি থাকে সেক্সের ইঞ্জেকশন। বিষ হজম করতে করতে নীলকণ্ঠের মতো অবস্থা হলে হয়তো উত্তেজনার এমন ডোজ ইঞ্জেক্ট করতে হবে যে রুগিই মারা যাবে। উত্তেজনার বালুচরে শহরের লোকের জীবনের এই সৌধ গড়ে তোলার চেষ্টা নিছক পাগলামি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। একেই মামফোর্ড বলেছেন—‘the sensation of living without the direct experience of life–a sort of spiritual masturbation’। জীবনের সঙ্গে জীবনের প্রত্যক্ষ সংযোগ ও অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তেজনানির্ভর এই বাঁচার প্রচেষ্টা হল এক ধরনের ‘আত্মিক আত্মমৈথুন’। সেই মার্কসীয় alienation-এর চূড়ান্ত পরিণতি।
প্রসঙ্গত মনে পড়ছিল ‘ক্যালকাটা ক্রনিকল’ পত্রিকার প্রায় পৌনে দু—শো বছর আগেকার একটি সংবাদের কথা (১৭৯২)। কসাইতলার (বর্তমানে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট) আস্তাবলে বন্দি একটি ক্রীতদাসী বালিকার সংবাদ। নতুন বুর্জোয়া যুগের কসাইদের কলকাতা শহরে নগরজীবনের যে নাটক ভবিষ্যতে অভিনীত হবে, কসাইতলার আস্তাবলের ঘটনা তার পূর্বরঙ্গ মাত্র। মানুষের মন তখনও সাদা কাগজের মতো একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে যায়নি। অনুভূতির আঁচড় তার উপর একটু—আধটু পড়ত যদিও ভগবানের ভাগ্যবান সন্তানরা সাধারণ মানুষকে পশুর চেয়েও অধম মনে করত। ক্রীতদাসী বালিকাটিকে অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে একটি আস্তাবলে বন্দি করে রাখতে তার প্রভু কোনো দ্বিধাবোধ করেনি যদিও একমুঠো করে খাবার তাকে রোজ দেওয়া হত। অনুভূতির এই হিজিবিজি আঁচড়টুকু পরবর্তীকালে কলকাতার মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে মুছে গিয়েছে, ক্রমে যত কলকাতা ‘polis’-এর স্তর থেকে ‘metropolis’-এর স্তর অতিক্রম কবে ‘necropolis’-এর স্তরের দিকে অগ্রসর হয়েছে।*
মামফোর্ড Parasito-Patholopolis-এর দুটি স্তরকে একত্র করে Tyrannopolis নাম দিয়েছেন, কারণ তিনি বলেছেন যে এই দুই স্তরের মধ্যে কালের ব্যবধান বিশেষ লক্ষ করা যায় না। কলকাতা শহরের জীবনে দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম স্তরের মধ্যে কালের ব্যবধান সামান্য, খুব বেশি হলে পঁচিশ—তিরিশ বছরের বেশি নয়। আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকের তিরিশের শেষ পর্যন্ত (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু) কলকাতা শহরের বিকাশ প্রাথমিক polis-এর স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। যদিও উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে রেলপথ গড়ে ওঠার ফলে কলকাতা শহর কেবল জলপথনির্ভর না হয়ে স্থলপথের বৃহৎ যোগাযোগকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এবং বিশ শতকের গোড়া থেকেই ‘automotive era’-র সূত্রপাত হয়েছিল কলকাতায়। তাহলেও ১৯৩৯—৪০ সালের আগে পর্যন্ত কলকাতার দ্বিতীয় স্তরের মেট্রোপলিটন রূপটাই স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পায়নি। তার কারণ কলোনিয়াল শহর বলে কলকাতার অর্থনৈতিক আত্মবিকাশের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। পাশ্চাত্য শহরের মতো অর্থাৎ লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, নিউ ইয়র্ক প্রভৃতির মতো তাই কালক্রম বজায় রেখে দু—শো বছরের মধ্যেও তার দ্বিতীয় স্তরের মেট্রোপলিটন জীবনেরই রূপান্তর ঘটেনি। অতিদ্রুত সমস্ত স্তর ডিঙিয়ে একপুরুষের মধ্যে নেক্রোপলিসের দিকে কলকাতার যাত্রা শুরু হয়েছে। ভারতচন্দ্র, হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রার যুগ থেকে ঈশ্বর গুপ্ত, মধুসূদন, হেমচন্দ্রর যুগ পার হয়ে রবীন্দ্রনাথের যুগ শেষ করে মনে হয় কলকাতা শহর যেন রাতারাতি ‘বিট’ ও ‘হাংগ্রি’ জেনারেশনের কবিদের যুগে পদার্পণ করেছে।
কলকাতার মেট্রোপলিটন স্তরের বিকাশ আমরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যে দেখেছি। তারপর রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পর কখন যে এই মেট্রোপলিটন স্তর মেগালোপলিটন, প্যারাসিটোপলিটন ও প্যাথলোপলিটন স্তরগুলির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল তা দাগ টেনে বলা যায় না। সমাজজীবনের অখণ্ডতা নাগরিক জীবনের মেট্রোপলিটন স্তরে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়, টুকরো টুকরো অনেক সমাজ গড়ে ওঠে, হয়তো অনেক কাছাকাছি, তবু মনে হয় যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। শহরের মেট্রোপলিটন দেহ ক্রমেই ফুলতে—ফাঁপতে থাকে দ্রুত লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে। চারদিক থেকে লোক যেন পড়ি—কি—মরি করে ছুটতে থাকে শহরের দিকে জীবিকার ধান্দায়, অর্থের ধান্দায়, আশ্রয়ের ধান্দায়, স্বার্থের ধান্দায়, এমনকী নিধান্দার নৈরাজ্যে গা ভাসিয়ে দেবার ধান্দায়। আঠারো বা উনিশ শতকে কলকাতা শহরের দিকে গ্রাম থেকে যে অভিযান হয়েছিল তাকে বাস্তবিক ‘অভিযান’ বলা যায়। সে অভিযান ছিল পর্বত অভিযানের মতো, সমুদ্র অভিযানের মতো। এরকম অভিযান আঠারো শতকে কলকাতা শহর অভিমুখে রামমোহন করেছিলেন এবং কলকাতার বড় বড় প্রাচীন পরিবারের পূর্বপুরুষরা করেছিলেন। উনিশ শতকে পথের মাইলস্টোন গুনতে গুনতে বিদ্যাসাগর করেছিলেন যেমন ইংরেজি—শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের তরুণ বয়সে করেছিলেন। কিন্তু বিশ শতকের মেট্রোপলিটন পর্বের শহরমুখী মানুষের দৌড়টা হল ছত্রভঙ্গ জনতার দৌড়ের মতো। শহরের ঠাসাঠাসি করে তারা বসবাস করে, শহরের সীমানা ভেঙেচুরে এগিয়ে নিয়ে যায়, কোথাও মানুষের বাঁচার মতো প্রাকৃতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে ওঠে না। জনকুণ্ডলীর এক—একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মেট্রোপলিটন শহরের বুকে ভেসে ওঠে। সেখানে বাতাস না হলেও মানুষ বেঁচে থাকে, ঘুম না হলেও মানুষ বেঁচে থাকে, আকাশের নীল রং বা সূর্যের আলো না হলেও মানুষ বেঁচে থাকে, চলার স্বচ্ছন্দ গতি না থাকলেও মানুষ বেঁচে থাকে, বাঁচার মতো খাবার না পেলেও মানুষ বেঁচে থাকে। মেট্রোপলিটন শহরের এই বিচ্ছিন্ন জনতার ঘেঁষাঘেঁষি দ্বীপগুলিকে মামফোর্ডের ভাষায় ‘do-without areas’ বা ‘না হলেও চলে’ অঞ্চল বলা যায়। কিছু না পেলেও তবু মানুষের জীবন গড়িয়ে চলে। শহর বাড়তে থাকে কিছু হাওয়ায় যেমন বেলুন বাড়ে তেমনি। কেবল যে গা—ঘেঁষাঘেঁষি করে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসীদের মতো মানুষ বসবাস করে তা নয়, মেট্রোপলিটন শহরের সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠান জনকুণ্ডলীর চাপে যত ফাঁপতে থাকে তত ভিতরটা তার ফাঁপা হয়ে যায়। হাসপাতাল স্কুলকলেজ খেলার মাঠ সিনেমা হোটেল যানবাহন পথঘাট বাজার সর্বত্র স্ফীতকায় জনতার ভয়াবহ রূপ দেখা যায়। কোথাও স্থান নেই রুগি আছে, মুমূর্ষু রুগি, কোথাও স্থান নেই ছাত্র আছে, কোথাও স্থান নেই দর্শক আছে, কোথাও স্থান নেই যাত্রী আছে। জনকুণ্ডলীর রূপ সব জায়গায় একরকম। সমাজবিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘growth by civic depletion’–বিলীয়মান নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে দ্রুতবর্ধমান নাগরিক বিস্তার। দেবালয় থেকে টাউন হল, অ্যাসেম্বলি থেকে কর্পোরেশন, পাড়ার মুদির দোকান থেকে নগরকেন্দ্রের সমবায়িকা ও ডিপার্টমেন্ট স্টোর, সিনেমা হল থেকে খেলার ময়দান, কিন্ডারগার্টেন থেকে স্কুল—কলেজ—বিশ্ববিদ্যালয়, বাস—স্ট্যান্ড থেকে রেলওয়ে স্টেশন—সর্বত্র যেন জনকুণ্ডলীর নাভিশ্বাস উঠেছে। একমাত্র শহরের রাজপথে এই জনকুণ্ডলীর স্থানসংকুলান হয় কিন্তু সেখানেও হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগের চিহ্ন নেই। অভিন্নতাবোধ আছে শুধু রাজপথের যান্ত্রিক যানবাহনের বিপুল স্রোতের সঙ্গে, যেখানে ‘জনকুণ্ডলী’ ও ‘যন্ত্রকুণ্ডলী’ ক্রাউড ও অটোমোবিল এক হয়ে ‘জনযন্ত্র’ হয়ে যায়। এই জনযন্ত্রের না আছে চোখ, না আছে মন, না আছে বিবেক, পথের পাশে কে করোনারি স্ট্রোকের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তা দেখার মতো না আছে সময়—আছে কেবল উদব্যস্ত শহরে হাপরের মতো দুটো ফুসফুসের ক্রিয়ায় নিঃসারিত নাভিশ্বাস আর নির্বিকার মনের জৃম্ভণ।
মেট্রোপলিটন শহরে প্রকৃতির সবুজ নেই, শুধু আছে কাগজের কারখানার কাগজ। এই পুঁজিবাদী শহরে মানুষের স্বপ্ন পর্যন্ত কাগজ দিয়ে তৈরি। শুধু কাগজ আর সেলুলয়েডের স্বপ্ন শুধু কাগজ আর সেলুলয়েডের আনন্দ। মেট্রোপলিটন শহরের মহাধ্বনি হল কাগজের শব্দ ‘সুইস ও ক্র্যাকল’ এবং মহাছন্দ হল যান্ত্রিক। কাগজের ভিতর দিয়ে জীবনের সত্যকে প্রতিদিন এখানে দেখতে হয়। জীবনের যা—কিছু কাজকর্ম ভাবনাচিন্তা ধ্যানধারণা সবই কাগজের সঙ্গে লিপ্ত। প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং হল মেট্রোপলিসের প্রধান শিল্প। ট্যাবুলেটিং মেশিন জার্নাল লেজার কার্ড—ক্যাটালগ ডিড—কন্ট্রাক্ট—মর্টগেজ প্রসপেকটাস বিজ্ঞাপন ম্যাগাজিন সংবাদপত্র সমস্ত মিলিয়ে একটা প্রাত্যহিক কাগজের মহোৎসব। থিয়েটারে সাহিত্যে সংগীতে শিল্পকলায় ব্যাবসাবাণিজ্যে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি হয় কেবল কাগজে।* মেট্রোপলিটন শহরে শাসন, অর্থনৈতিক সামাজিক পরিকল্পনা সবকিছু যে কত বিরাট ও ব্যাপক, কতখানি জনকল্যাণের মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা কেবল কাগজের স্তূপ দেখলে বোঝা যায়। শহরে জলাভাব, অমনি কাগজের স্তূপ জমতে থাকল কর্পোরেশনে আর সেক্রেটারিয়েটে। শহরে বাসস্থান নেই, অমনি ঘরবাড়ির পরিকল্পনাসহ কাগজের পাহাড় জমতে থাকল। পুলিশের নির্যাতন, কালোবাজারির মুনাফা মনোপলিস্টের মুনাফা, মন্ত্রীদের অন্যায়—অবিচার, শিক্ষার গলদ, শিক্ষক ও ছাত্রদের অভিযোগ ইত্যাদি—প্রভৃতি অনেক সমস্যা যখন জমা হয়ে উঠল তখন একটার পর একটা তদন্ত কমিশন বসল এবং মাসের পর মাস তদন্ত হল তার হাজার হাজার পৃষ্ঠার রিপোর্ট প্রথমে কাগজে টাইপ করা হল, তারপর কাগজে ছাপা হল এবং হাজার পৃষ্ঠার নোট বিরাট গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল, অবশেষে রেকর্ডরুমে স্থানান্তরিত ও সমাধিস্থ হল। কোনো মানুষ সেই রিপোর্ট পড়ল না অথবা তার বিশাল চেহারার দিকে তাকিয়েও দেখল না, কারণ পড়া বা দেখা সম্ভব নয় যেহেতু ধৈর্য নেই, সময়ও নেই। কিন্তু সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেল কাগজে। সমস্ত অভিযোগ, সমস্ত দাবি কাগজে মেটানো হল। কাগজের বুরোক্রেসি কাগজের ডেমোক্রেসি কাগজের ন্যায্য দাবি কাগজের অভিযোগ কাগজের ট্র্যাজেডি কাগজের কমেডি, কাগজের খ্যাতি কাগজের বিদ্যা কাগজের স্কলারশিপ কাগজের ঘৃণা কাগজের প্রেম কাগজের স্বপ্ন সমস্ত মিলিয়ে বিরাট একটা কাগজের মেট্রোপলিটন শহর। অফুরন্ত একটা কাগজের রিলের দুঃস্বপ্ন মেট্রোপলিটন মানুষের জীবন।*
এই পণ্যময় কাগজময় অবাস্তব নাগরিক পরিবেশে জীবনের ভোগ্য বিলাসিতা সুখস্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ—উল্লাস কখনো স্বাভাবিক বা সত্য হয় না। সমস্ত আনন্দ সমস্ত উপভোগ আয়াস বিলাস কেবল নিপাতনে ক্লেদনিঃসরণ মাত্র। স্বাভাবিক সুস্থ মনের স্ফূর্তি নয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আগাগোড়া সমস্ত জীবনটা ‘Birth and Copulation and Death’-এর চক্রবৎ যান্ত্রিক আবর্তন। স্ত্রী—পুরুষের যৌনসম্ভোগও ‘commercialized’-এবং মেট্রোপলিটন শহরে যেহেতু অবিবাহিত নরনারীর সংখ্যা অনেক বেশি তাই স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন আর্থিক—সামাজিক কারণে মরুমায়ার মতো অলীক অবাস্তব বলে মনে হয়। ঘরে স্থান নেই, রাস্তায় স্থান নেই, ট্রেনে—ট্রামে—বাসে স্থান নেই, অফিসে স্থান নেই, ইডেন উদ্যান থেকে শ্মশান কোথাও তিলধারণের স্থান নেই। সর্বত্র জনতার চাপ আর জনতার উত্তাপ। চলার পথে কোথাও কোনোখানে পুরুষের পৌরুষ অথবা নারীর নারীত্ব প্রকাশের অবকাশ নেই। যেমন পুরুষ তেমনি নারী সকলে ওয়েদারপ্রুফ ওয়াটারপ্রুখ শকপ্রুফ টাচপ্রুফ এবং স্বভাবতই অ্যান্টিম্যাগনেটিক। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর জৈবিক ভেদাভেদও জনপিণ্ডের স্টিমরোলারের চাপে দলিত—মথিত। কারও কোনো অঙ্গের সামান্য স্বাতন্ত্র্যবোধও নেই, যেন কেউ রক্তমাংসের মানুষ নয়, প্রত্যেকে রবার ও প্লাস্টিকের পুতুলের মতো একটা বৈদ্যুতিক শক্তির ক্রিয়ায় চলেফিরে বেড়ায়, ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
ঘুরছে তো ঘুরছেই। দেহের সঙ্গে দেহের ঘাতপ্রতিঘাতে অটোমেটিক যন্ত্রের মতো ঘুরছে। মেট্রোপলিটন শহরে জনতার খণ্ড খণ্ড দৃশ্য হল অন্যতম নয়নাভিরাম নাগরিক দৃশ্য। লক্ষ মানুষ চলছে নির্বিকার উদাসীন, জৈবিক আত্মরক্ষার চিন্তায় নিমজ্জিত। হয় অফিসের দিকে, না—হয় ঘরের দিকে চলছে। হঠাৎ হয়তো এমন সময় চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে একজন যাত্রী পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দশ—বিশ হাজার লোকের ভিড় জমে গেল, গলার শির ও হাতের মাসল ফুলে উঠল, একখানা—দুখানা—তিনখানা বাস পুড়ে গেল, ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আধমরা অবস্থায় হাসপাতালে গেল, আশপাশের দোকানপাট লুঠ হল, পুলিশ এসে টিয়ারগ্যাস ছাড়ল, গুলি করল, বারোজন আহত ও চারজন নিহত হল, রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রী এসে প্রচণ্ড শব্দ করে বক্তৃতা দিলেন, জনতার কণ্ঠে বজ্রের মতো নিনাদিত হল ‘তদন্ত চাই’, ফলে কমিশন বসল, তদন্ত হল, দেড় হাজার পৃষ্ঠা কাগজে ছাপা এক রিপোর্টে বেরুল, কত টন কাগজ লাগল, কেউ তার খোঁজ রাখল না, রিপোর্ট কেউ দেখল না, কারণ সে কথা তখন আর কারও মনে নেই। সামান্য উত্তেজনার শলাকা থেকে আরম্ভ এবং প্রচণ্ড উত্তেজনার অগ্ন্যুদগিরণে তার ক্লাইম্যাক্স। তারপর স্তূপাকার ফাইল আর রিপোর্টের টন টন কাগজের মধ্যে তার সমাপ্তি তথা সমাধি। কোনো জীবন্ত মানুষ অথবা মানবোত্তর জীব—কলকাতা যখন মহেঞ্জোদাড়ো হয়ে দ—শো ফুট মাটির তলায় চলে যাবে তখনও—এইসব ফাইল বা রিপোর্ট পড়ে দেখবে না। আকাশ থেকে মহাযুদ্ধের বোমাবর্ষণে কাগজের মেট্রোপলিটন শহর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ছেঁড়া কাগজে কাগজ তৈরি হয় কিন্তু ছাই দিয়ে কাগজও তৈরি হবে না।
ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সংযোগ ও সান্নিধ্য মেট্রোপলিটন শহরে দ্রুত কমতে থাকে। সংযোগ ঘটে টেলিফোনে, বেতারে অথবা খুব বেশি হলে চিঠিপত্রে। দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব উভয়ের মধ্যে, অনেক কিছু লেনদেনও হয়, পরস্পরের নাম জানে, কিন্তু মুখ দেখেনি কেউ। মুখ চেনে, নাম জানে না, কেউ নাম জানে, মুখ চেনে না। কাগজের বন্ধুত্ব কাগজের সান্নিধ্য বৈদ্যুতিক তারের বন্ধুত্ব তারের সান্নিধ্য। মেট্রোপলিটন শহরে তাই জনসংযোগ ও জনসমাবেশের একমাত্র উপায় হল উত্তেজনা। খেলার মাঠের উত্তেজনা সিনেমার উত্তেজনা রাস্তাঘাটে যে—কোনো উত্তেজনা দাঙ্গা—স্ট্রাইক—মারামারির উত্তেজনা ঘোড়দৌড়ের উত্তেজনা সাইকেল রেসের উত্তেজনা মোটর রেসের উত্তেজনা কুকুরদৌড়ের উত্তেজনা সাঁতারের উত্তেজনা বক্সিং—কুস্তির উত্তেজনা প্রদর্শনীর উত্তেজনা মেলা—বারোয়ারি পুজোর উত্তেজনা ক্লাবে—হোটেলে সুরানৃত্যের উত্তেজনা বাজারে বাসে—ট্রামে লোকাল ট্রেনে আর কিছু নাহোক প্রচণ্ড তর্কাতর্কি থেকে ঘুসোঘুসির উত্তেজনা। মোট কথা, যাহোক উত্তেজনা কিছু একটা চাই তা না হলে অসাড়—অচৈতন্য নাগরিককে চেতিয়ে তোলা সম্ভব নয়। সামান্য একটু উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গ হলেও যথেষ্ট। তা—ই থেকে অগণিত জনসমাবেশ, তারপর জনতায় অবশ্যম্ভাবী অগ্নিসংযোগ। মেট্রোপলিটন শহরে কেবল উত্তেজনার মহোৎসব এবং তার সঙ্গে জনতার বহ্নুৎসব। দেবালয় থেকে বিদ্যালয়, বিদ্যালয় থেকে বিধানসভা, বিধানসভা থেকে কর্পোরেশন, কর্পোরেশন থেকে স্থানীয় অ্যাসোসিয়েশন ও বিদ্বৎসভা সর্বত্র একই উত্তেজনার উৎসব। যাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র, যাঁদের সামাজিক মর্যাদা আছে, যাঁরা বরেণ্য, সভাসমিতি থেকে বিধানসভা পর্যন্ত তাঁদের যেরকম আচরণ ও ব্যবহার, ঠিক রাস্তার উপেক্ষিত ড্রেনপাইপ—আঁটা বাউন্ডুলেদেরও সেই একই আচরণ ও ব্যবহার। শহরের পাতালপুরীতে জুয়াড়ি ও মাতালের ‘ডেনে’ যে দৃশ্য, ঠিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে অ্যাসেম্বলি ও পার্লামেন্টের ভূস্বর্গেও সেই একই দৃশ্য। মানুষ যে আসলে জন্তু এবং যূথচর জন্তু—এই সত্যটাই ধনতান্ত্রিক মেট্রোপলিটন শহরে প্রকট হয়ে ওঠে। উত্তেজনা বিতাড়িত বিকট জনযোগে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। বাইরের প্রকৃতি ও মানুষের প্রকৃতি এই কৃত্রিম নাগরিক পরিবেশে বিকৃত হয়ে বিধ্বংসীরূপে প্রতিঘাত করে এবং প্রতিশোধ নেয়। তখন ‘negative vitality’-র যাবতীয় উপাদান থেকে সঞ্জীবনী শক্তি খুঁজতে হয় শহরের মানুষকে। ড্রাগ সিডেটিভ হিপনোটিক অ্যাসপিরিন অ্যালকোহল কিছুই বাদ থাকে না। মনে হয় পুরাণের নরকের বর্ণনা নিঃশেষ করে ফেললেও এই মহাবিকৃত পুঁজিবাদী মেট্রোপলিটন শহরের রূপ ফুটিয়ে তোলা যায় না। জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’—এর লিওপোল্ড ব্লুমরা এই মেট্রোপলিটন নরকেই বাস করেন। তাঁরা খবরের কাগজ পড়েন হাই তোলেন রেডিয়ো শোনেন কালী মন্দিরে পুজো দেন তারকেশ্বরে মানত করেন সরীসৃপের মতো কালোবাজারে চলাফেরা করেন ঘুমের পিল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন দুঃস্বপ্নের কিল খেয়ে ধড়ফড় করে জেগে ওঠেন। মনে হয় যেন মেট্রোপলিটন শহর কলকাতা একটা ‘vast manless moonless womoonless marsh’ এবং ‘lugugugubrious’ (James Joye)।
তবু মেট্রোপলিটন শহর বাড়তে থাকে, ফাঁপতে থাকে যেমন বর্তমানে কলকাতা শহর বাড়ছে তো বাড়ছেই, ফাঁপছে তো ফাঁপছেই। তাই তো হবে কারণ, ‘aimless acquisition: rechless expansion: progressive disorganization’ (Mumford)—এই তিনটি হল মনোপলি ক্যাপিটালের স্বর্গপুরী মেট্রোপলিটন শহরের বড় লক্ষণ। লক্ষ্যহীন অনির্বাণ লোভ ও অর্জনেচ্ছা আর কাণ্ডজ্ঞানহীন সম্প্রসারণ এবং ধারাবাহিক অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা মেট্রোপলিটন শহরে ব্যাধির উপসর্গের মতো দেখা দেয়। একদা প্রাচীন কলকাতায় ‘ডাউনটাউন’ অঞ্চলের কাছে অর্থাৎ শাসন—বাণিজ্যকেন্দ্রের কাছে কলকাতার অভিজাত—পল্লি ছিল। তারপর কেন্দ্রস্থলের কোলাহল যত বাড়তে থাকে তত অভিজাত ও বিত্তবানদের বসবাস কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে স্থানান্তরিত হতে থাকে। সমাজবিজ্ঞানের নিয়মানুসারে তা—ই অবশ্য হবার কথা। এই সময় কলকাতার চারদিকে শহরতলির উৎপত্তি হতে থাকে। কলকাতার এই পুরোনো শহরতলির মধ্যে ছিল সিঁথি কাশীপুর পাইকপাড়া চিৎপুর টালা উলটোডাঙা সিমলা শুঁড়া শিয়ালদা ইন্টালি তপসে ডিহিশ্রীরামপুর চক্রবেড়ে ভবানীপুর বালিগঞ্জ মুদিয়ালি সাহানগর ওয়াটগঞ্জ একবালপুর খিদিরপুর গার্ডেনরিচ প্রভৃতি অঞ্চল। উত্তর শহরতলি দক্ষিণ শহরতলি মানিকতলা ও টালিগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটির অধীন ছিল এইসব শহরতলি অঞ্চল। শহরের পুবদিকে উলটোডাঙা থেকে শিয়ালদা পর্যন্ত অঞ্চলে কলকাতার ধনী লোকদের বড় বড় বাগানবাড়ি ছিল যেমন ব্যারোটো সুকিয়া উমিচাঁদ গোবিন্দরাম মিত্র হুজুরিমল শোভারাম বসাক এবং বড় বড় সাহেবদের। গার্ডেনরিচ অঞ্চলেও ইংরেজদের বড় বড় বাগানবাড়ি ছিল। বেলভেডিয়ার ও আলিপুরে ক্যাপ্টেন টালি (যিনি আদিগঙ্গার নালা কেটেছিলেন এবং যাঁর নামে টালির নালা ও টালিগঞ্জ) ও ওয়ারেন হেস্টিংসের বিখ্যাত বাগানবাড়ি ছিল বেলভেডিয়ার হাউস ও হেস্টিংস হাউস। ক্লাইভের বাগানবাড়ি ছিল দমদমে, টেলরের গার্ডেনরিচে, কর্নেল ওয়াটসনের ওয়াটগঞ্জে। ওয়াটসনের নাম থেকেই ওয়াটগঞ্জ। বেলগাছিয়ায় অকল্যান্ডের বিখ্যাত বাগানবাড়ি ছিল, পরে দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনে নেন এবং তারপরে ঠাকুররা পাইকপাড়ার রাজাদের বেচে দেন। ‘বেলগাছিয়া ভিলা’ এখনও পাইকপাড়ার রাজাদেরই আছে। দক্ষিণের রসা—পাগলা বাঁশদ্রোণী টালিগঞ্জ বালিগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলেও সাহেবদের ও এ দেশি বড়লোকদের বড় বড় বাগানবাড়ি ছিল। বাগানবাড়িগুলি দেখতে রাজবাড়ির মতো হলেও সামন্তযুগের পরিবেশকে বিশেষ বিকৃত করেনি। কলকাতার পুরোনো শহরতলি অঞ্চলে গ্রাম্য নিসর্গেরই প্রাধান্য ছিল এবং গ্রাম্য লোকের বাস ছিল। তাদের কুঁড়েঘর বাগান পুকুর চাষের খেত ধানজমি আর মধ্যে মধ্যে অবস্থাপন্ন গ্রাম্য মধ্যবিত্তদের একতলা—দোতলা পাকা বাড়ি। এই সমস্ত sacked ও invaded গ্রামের অধিবাসীরা তখনও জানত না যে শহরের ধনিক ও মধ্যবিত্ত বা বিবেকহীন ল্যান্ড স্পেকুলেটাররা ধীরে ধীরে তাদের গ্রামগুলি গ্রাস করে ফেলবে, ময়াল সাপের মতো শহর তার দানবীয় বাহু বিস্তার করে এগিয়ে আসবে তাদের দিকে। তাই এসেছিল। উনিশ শতকের মধ্যে কলকাতার পুব—পশ্চিম উত্তর—দক্ষিণের এইসব পুরোনো শহরতলির অনেকটা অংশ কলকাতার সীমানাভুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
নতুন শহরতলির (new suburbia) বিকাশ হয়েছে গত পঁচিশ—তিরিশ বছরের মধ্যে। পুরোনো শহরতলির সীমানা ভেদ করে পতিত জমি আবাদি জমি ধানখেত জলাজমি ডোবা পুষ্করিণী জঙ্গল বাগান ইত্যাদির উপর শহরের প্রবল জনজোয়ারের ঢেউ ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে। হিংস্র হাঙরের মতো একশ্রেণির জমির স্পেকুলেটাররা শতগুণ—হাজারগুণ মুনাফা করে new suburbia-র বৃদ্ধি ও বিস্তারের পথ পরিষ্কার করেছেন। পুরোনো শহরতলির মতো নতুন শহরতলিতেও জমির মুনাফাখোরদের শিকার হয়েছে গ্রামের অসহায় চাষিরা। তবে পুরোনো শহরতলি যেমন বসতিগ্রাম আক্রমণ করে, লুণ্ঠন করে খোলস পালটে শহর হয়েছে, নতুন শহরতলি তা হয়নি। নতুন শহরতলির ভিত গড়ে উঠেছে ‘wasteland’ বা পতিত জমির উপর যদিও তার মালিক বেশির ভাগ গ্রামের মধ্যবিত্ত চাষিরা। প্রধানত কলকাতার দক্ষিণ ও পুবদিক হল নতুন শহরতলির বিস্তারের ক্ষেত্র। কলকাতা শহর এইভাবে মেট্রোপলিসের স্তর থেকে কখন যে মেগালোপলিসের স্তরে এগিয়ে গিয়েছে তা বোঝা যায়নি।
এর মধ্যে কলকাতার নিজস্ব রূপের এত দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে যে বর্তমান যুগের তরুণ ও যুবকরা যদি মাত্র তিরিশ বছর আগের কলকাতা শহর সম্বন্ধেও কোনো ধারণা করতে চায় তাহলে পুরোনো ফিলম বা ফোটোগ্রাফ দেখে তা করতে হবে। রাতারাতি যেন কলকাতা রূপকথার অতিকায় দানবের মতো রূপধারণ করেছে। ‘Bigness and power’ এবং ‘Shapeless giantism’—অতিকায়ত্ব ও শক্তির ঔদ্ধত্য আর কিমাকার স্থূলত্ব ও জড়পিণ্ডত্ব হল মেগালোপলিসের প্রধান বিশেষত্ব। কলকাতার আফিসইনস্টিটিউশন সরকারি কোয়ার্টার মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাটবাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট হাউস সবই এখন আকাশমুখী স্ট্রিমলাইনড—ইয়াঙ্কি স্থাপত্যের নির্বুদ্ধি নিদর্শন। শহরের সর্বস্থানে সর্বক্ষেত্রে standardisation—এর সিলমোহর, এমনকী সাহিত্য—সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তার ছাপ সুস্পষ্ট।* আকার বিরাট কিন্তু অন্তঃসারশূন্য। সুন্দর শালপ্রাংশু সুপুরুষ কিন্তু ভিতরে মন নেই। সুন্দর ছিমছাম ষোলোতলা বাড়ি কিন্তু ভিতরে জীবনের স্পন্দন নেই। সুন্দর প্রচ্ছদসহ বিশালকায় দেড় হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাস, বর্তমান কলকাতার কথাসাহিত্যের নিদর্শন, কিন্তু ভিতরে ঠাসা রাবিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার ঠিকাদারদের দেওয়া অনেক ডিগ্রি অনেক অক্ষরে গ্রথিত কিন্তু আসলে প্রায় গণ্ডমূর্খসমান। মেগালোপলিটন কলকাতায় ইট পাথরের দেহই হোক আর রক্তমাংসের দেহই হোক তার স্থূলতা ও যান্ত্রিক শক্তির ঔদ্ধত্যের প্রকাশটাই বড় voluminous কিন্তু significance নেই—অর্থাৎ সব আছে, শুধু মনটা নেই আর সারবস্তুটুকু নেই।
মেগালোপলিস কলকাতা অজ্ঞাতে ও অতর্কিতে কখন যে গেডেসের প্যারাসিটোপলিস—প্যাথলোপলিস—এর স্তরে (মামফোর্ডের ‘টিরানোপলিস’) উন্নীত হয়েছে তা—ও আমরা বুঝতে পারিনি। নেক্রোপলিসের (মৃতের শহর) পূর্বস্তরে কলকাতা শহর বিশ শতকের ষষ্ঠ দশকে পৌঁছে গিয়েছে। বর্তমানের টিরানোপলিস কলকাতার জীবনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শাসকরা তাঁদের কাজকর্মে সামান্য শালীনতাটুকুও বজায় রাখতে পারেন না। যত রকমের নোংরামি, অসাধুতা ও অন্যায় আজ সরকারি ও বাণিজ্যিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। জীবন থেকে ন্যায়বোধ নীতিবোধ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। নগরকর্তাদের নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ বলে কিছু নেই। দল হোক, ব্যক্তি হোক, সকলেরই কাম্য ও লক্ষ্য হল ‘ওলটপালট করে দাও, লুটেপুটে খাই।’ যাঁরা উৎপাদন করেন—আর যাঁরা ভোগ করেন সমাজের এই দুই প্রধান শ্রেণির মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। শহরের রাজপথ থেকে অলিগলি পর্যন্ত সর্বত্র লুচ্চা—গুন্ডা—অপগণ্ডরা ডাস্টবিনের মাছির মতো ভনভন করছে, কারণ তারা যেমন মুনাফাখোর সমাজের সৃষ্টি তেমনি আবার মুনাফাখোর শোষকদের পোষ্য কুকুর। গণতন্ত্রের যুগে লুম্পেনরাও পূর্ণাঙ্গ নাগরিক, দাবিদাওয়া তারাও দৃপ্তকণ্ঠে জানায়, mass-গণতন্ত্রের গড্ডলপ্রবাহে তারাও তাদের অধিকারের স্লোগান দিতে দিতে চলে। দলবদ্ধ লুঠতরাজ, দলবদ্ধ রাহাজানি, গুন্ডামি হল মেট্রোপলিটন শহরের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকী সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম উপসর্গ। এরকম নাগরিক সমাজে respectable লোকেরা criminal-এর মতো আচরণ করতে কুণ্ঠিত হন না এবং criminal—দেরও ‘respectable’ হবার পথ চারদিকে খোলা থাকে।
মেট্রোপলিটন শহর তার সমস্ত অস্বাভাবিকতার উপসর্গ নিয়ে দুরন্ত গতিতে চারদিকের গ্রামের দিকে এগিয়ে যায়। সেইটাই হল সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ। গ্রামের আত্মরক্ষার অবগুণ্ঠন খুলে ফেলে তাকেও নিজের মতো নির্বিবেক ও নির্মানুষ করতে চায় মেট্রোপলিটন শহর। করার পথে কোনো বাধা নেই। অটোমোটিভ যুগে রিবনরোড রবিরশ্মির মতো শহর থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে—রেলরোড নয়, মোটররোড—শহরের ব্যাধিগ্রস্ত জীবনের বিষাক্ত বীজাণুর বাহক। পথের দৃশ্য একরকম, যেন মেট্রোপলিসের এক—একটা বিচ্ছিন্ন টুকরো। সেই ঘিঞ্জি বাজার সিনেমা লাউডস্পিকার, রাস্তার ধারে ধারে সমাজকর্তাদের পোষ্য লুম্পেন ও সমাজবিরোধীদের চক্র আর বিষফোড়ার মতো সারিবদ্ধ সব ব্লক—বাড়ি, টেকনোলজিক্যাল যুগের নয়াবস্তি। শিরা—উপশিরার মতো এইসব রিবনরোডের উপর দিয়ে শহর থেকে গ্রামে নাগরিক ব্যাধির বীজাণু ছড়িয়ে পড়ছে হাইস্পিড অটোর গতিতে। সেই একটানা একঘেয়ে জীবন, বিকৃত বেহাগে ক্লান্তিকর জীবনের বিষণ্ণতার প্রলাপ, সেই সেলুলয়েডি সুর এবং কণ্ঠের ও যন্ত্রের মিলিত ক্যানেস্তারার আওয়াজ। এইভাবে মেট্রোপলিটন শহরের জীবনের ধূসরতা গ্রাম্য জীবনের শ্যামলতাকে গ্রাস করে ফেলতে থাকে। শহরের মন গ্রামের মানুষের মধ্যেও বাসা বাঁধে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নির্মেঘ জীবনের খররৌদ্রে তৃণের মতো মন দগ্ধ হয়ে যায়। গ্রাম ও শহরের চিরকালের ব্যবধান নিশ্চিহ্ন করে মেট্রোপলিটন শহরের মানসিক শূন্যতা সমস্ত মনুষ্যলোককে যেন গ্রাস করতে উদ্যত হয়। মনে হয় মেট্রোপলিটন শহর থেকে মরুভূমি দূরে নয়। মনে হয় :
এখান থেকে মরুভূমি দূরে নয় সাহারায়
মরুভূমি তোমার আমার চারিদিকে,
মরুভূমি তোমার পাশে চলন্ত ট্রেনের ভিড়ে
মরুভূমি মহানগরে
মরুভূমি মনে
মরুভূমি দূরে নয় সাহারায়।
অ্যালবিয়র ক্যামুর ‘Outsider’ মেট্রোপলিটন শহরের বিষবৃক্ষের ফল অ্যালজিরিয়ান নায়কের মন একালের মুনাফাখোরের মেট্রোপলিটন শহরের মানুষের মন। মা মারা গিয়েছেন, অফিসের কাজ থেকে নায়ক ছুটি নিতে এসেছেন। বস জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মা কবে মারা গেছেন?’ নায়ক উত্তর দিলেন: ‘Mother died today, or may be yesterday. I can’t be sure.’ উত্তরের মধ্যে নির্মম ঔদাস্যের সুর—’মা আজ মারা গেছেন। গতকালও হতে পারে। ঠিক বলতে পারি না।’ প্রাত্যহিক জীবনের প্রেমিকা তাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’ ‘I replied, much as before, that the her question meant nothing or next to nothing, but I supposed I didn’t’ ‘মেয়েটি যখন বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল আমি তাকে ভালোবাসি কি না, তখন আগের মতোই আমি তাকে বললাম যে তার এই প্রশ্ন আমার কাছে একেবারে অর্থহীন, তবু প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, আমার মনে হয় আমি ভালোবাসি না।’ মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারে যেমন, দিনসঙ্গিনীর প্রেমের ব্যাপারেও ঠিক তেমনি, নায়ক নির্মম উদাসীন। কিছুতেই তার কিছু আসে—যায় না। মনটা সাদা কাগজের একটা রিল, কোনো কিছুরই ছাপ পড়ে না সেখানে। খুনের জন্য নায়কের প্রাণদণ্ড হল। গম্ভীর কণ্ঠে প্রসিকিউটার জুরিদের সম্বোধন করে বললেন, ‘আপনারা শুধু এইটুকু ভেবে দেখুন, এই লোকটি তার মায়ের অন্ত্যেষ্টির পর সেইদিনই সুইমিং—পুলে যায়, একটি মেয়ের সঙ্গে স্ফূর্তি করে বেড়ায় এবং কমিক ফিলম দেখে। এর বেশি আর কিছু আপনাদের বলতে চাই না।’ অর্থাৎ প্রসিকিউটার বলতে চান যে মায়ের অন্ত্যেষ্টির দিনেও যে ব্যক্তি এরকম চিত্তবিনোদনে কালযাপন করতে পারে তার আর যা—ই হোক হৃদয় বলে কোনো পদার্থ নেই এবং মন বলে কিছু নেই। খুন করা তার পক্ষে কিছুই নয়।
প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত আসামি নির্জন সেলে অপেক্ষা করছে। পুরোহিত এসে তাকে ধর্মবাক্য শোনাতে লাগল, মৃত্যুর আগে অনুশোচনায় সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে বলল। পুরোহিতের ধর্মের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে নায়কের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হাতের মুঠোয় সজোরে পুরোহিতের কলার ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে সে বলল: ‘থামুন, চুপ করুন। ওসব অনেক শুনেছি। আমার কাছে কোনো জিনিসের কোনো মূল্য ছিল না কোনোদিন। কেন ছিল না তা—ও জানি। শুনুন—আমার ভবিষ্যতের অন্ধকার দিগন্ত থেকে সবসময় একটা বাতাস মৃদু অথচ স্থিরগতিতে আমার দিকে বয়ে এসেছে। আসার পথে ওই বাতাসের গতিতে জীবনের ধ্যানধারণা স্বপ্ন আশা কল্পনা সমস্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশে গেছে। আমার প্রাণদণ্ড হয়েছে তাতে কী? সকলকেই তো একদিন প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। বিচারকের এই দণ্ড থেকে কারও মুক্তি নেই। আপনি যে একজন ধর্মের যাজক, পুণ্যের বাহক, ঈশ্বরের দূত, আপনারও মুক্তি নেই। তাহলে আপনার সঙ্গে আমার তফাত কী? আপনি পুণ্যবান বলে একদিন আপনার প্রাণদণ্ড হবে অর্থাৎ আপনারও মৃত্যু হবে। আর আমি। আমি মা—র মৃত্যুতে কাঁদিনি, তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সেরে সুইমিং—পুলে সাঁতার কেটেছি আর মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করেছি আর কমিক ফিলম দেখেছি এই তো? কাজেই আমার মতো নিষ্ঠুর আর কেউ নেই এবং খুন করা আমার কাছে হাত—মুখ ধোয়ার মতো। বিচারক রায় দিয়েছেন আজকেই আমার প্রাণদণ্ড হবে। খুব ভালো কথা। আপনারও একদিন হবে এবং দুইয়ের মধ্যে তফাত কোথায়, আমি তো জানি না।’
অনুশোচনা Outsider-এর জন্য নয়। যেমন Meursault তেমনি হেমিংওয়ের ‘Soldier’s Home’ গল্পের নায়ক Krebs–দু—জনের একই নির্বিকার মেট্রোপলিটন মন। মা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করছেন—
Don’t you love your mother, dear boy?
No, said Krebs.
His mother looked at him across the table. Her eyes were shiny.
She started crying.
I don’t love anybody, Krebs said.
এরপর Krebs-এর মা যখন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি তোর মা, ছেলেবেলায় কোলে করে বুকে করে তোকে মানুষ করেছি আর তুই এই কথা বললি? তখন Krebs felt sick and vaguely nauseated.’
কলকাতা শহরে চৌরঙ্গি ও রেড রোড দিয়ে সেদিন যাঁরা যান্ত্রিক অটোস্রোতে ভেসে চলেছিলেন, করোনারি স্ট্রোকের যন্ত্রণায় কাতর ৪৪ বছরের ফিল্ড—সার্ভেয়ারের দিকে না চেয়ে, তাঁরা এই ধনতান্ত্রিক মেট্রোপলিটন শহরের Outsider এবং Meursault ও Krebs-এর সগোত্র। তাদের দিকে চেয়ে মনে হয় :
যদি পথ আছে—তবু কোলাহলে শূন্য আলিঙ্গনে
নায়ক সাধক রাষ্ট্র সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে;
প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো
কী এক বিরাট অবক্ষয়ের মানবসাগরে।
জীবনানন্দ দাশ
মেট্রোপলিটন শহরে বৈদ্যুতিক আলোকোজ্জ্বল পথে জীবনের অন্ধকার ঘনিয়ে আসে এবং বিরাট এক অবক্ষয়ের মানবসাগরের দিকে প্রত্যেকটি মানুষ অটোর গতিতে ছুটে চলতে থাকে। মনে হয় এই মুনাফাখোরের মেট্রোপলিটন মহানগরে অ্যালিসের মতো Down, down, down Would the fall never come to and end?
১৯৬৭
Lewis Mumford : The Culture of Cities
(3rd ed. London 1944)
Lewis Mumford : City Development (London 1946)
Lewis Mumford : The Condition of Man (London 1944)
Paul K. Hatt and
Albert J. Reiss ed. : Cities and Society–The Revised Reader in Urban Sociology (N.Y. 1963)
‘Urbanism as a way of life’ by Louis Wirth
‘Metropolitan Dominance and Integration’ by Vance and Smith
‘The Rise of Metropolitan Communities’
by R. D. Mckenzie
‘The Metropolis and Mental Life’
by George Simmel
‘The Personailty and an Urban Area’
by James S. Plant
Patrick Geddes : Cities in Evolution (London 1915)
Arnold W. Green : Socielogy : An Analysis of Life in Modern?’ Society (4th ed. N.Y. 1964)
Frank Lloyd Wright : The Living City (N.Y. 1958)
: An Autobiography (N.Y. 1943)
Karl Mannheim : Diagnosis of Our Time
(6th imp. Lond. 1954)
William F. Ogburn : Social Characteristics of Cities
(N.Y. 1937)
Census Reports : Calcutta–1881, 1891, 1901, 1951 & 1961.
Calcutta Metropolitan Planning Organisation :
1. First Report 1962
2. Basic Development Plan, Calcutta
Metropolitan District 1966-68
3. Regional Planning for West Bengal
1965
……………
* ১৯৭১। কিছুদিন আগে (৮ মার্চ ১৯৭১) ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকা ‘Calcutta is Alive’ নামে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে মোটামুটি এই কথা বলতে চেয়েছেন যে কলকাতার প্রাত্যহিক প্রাণ হানাহানির মধ্যেও তার আনন্দ—উৎসব নাচ—গান—হল্লা আমোদপ্রমোদ মিলিয়ে যে উচ্ছল জীবনধারা তা ব্যাহত হয়নি। বাস্তবিকই তা—ই। এমনকী প্রতিদিন দেশের তরুণদের প্রাণোৎসর্গের মর্মান্তিক কাহিনি এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের লোমহর্ষক সংবাদেও কলকাতার আমোদপ্রবাহে ভাটা পড়েনি। না—পড়বারই কথা। কারণ কসাইখানার স্যাঁতসেঁতে গলিতে আঠারো শতকে ব্রিটিশ শাসনকালে কলকাতার যে মন, যে বিবেক তৈরি হয়েছিল তা নব্যধনিকের তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও বিবেক এবং পরবর্তীকালে কলকাতার লৌহপ্রস্তর রূপায়ণের সঙ্গে সেই বিবেকই আজ পাথর—লোহা—কংক্রিটের রূপ ধারণ করেছে।
১৯৭৭। আজ তাই তরুণ—তরুণী ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের উপর পুলিশের ও জেলখানার জল্লাদদের বর্বরতম নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও নির্বিকারচিত্তে শহুরে আমোদে মত্ত হয়ে যাই, প্রতিবাদ করতে কুণ্ঠিত হই।
* The scholar with his degrees and publications, the actress with her newspaper-clippings, and the financier with his shares and voting proxies, measure their power and importance by the amount of paper they can command.
Mumford : The Culture of Cities
* The world of paper, paper profits, paper achievements, paper hopes and paper lusts, the world of sudden fortunes on paper and equality grimy paper tragedies…. (Mumford : op. cit)
* ‘Standardization largely in pecunlary terms, of the cultural products themselves in art, literature, architecture, and language… bigness takes the place of form: voluminousness takes the significance’…(Mumford : op. cit)