মেজোকে বড়র জুতো দান
বড়মামার হঠাৎ কি যে হল। হঠাৎ নয়, জিনিসটা বেশ কিছুদিন মাথায় ঢুকছিল একটু একটু করে। যোগী পূর্ণানন্দের সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে মাঝে মাঝেই বলতে শুরু করেছিলাম ‘জীবনটাকে একেবারে বদলে ফেলতে হবে। আকাশ থেকে শক্তি নামছে, সেই শক্তিকে ধরতে হবে, ধারণ করতে হবে। মৃত্যুকে জয় করতে হবে। তোর মেজোমামার মতো বিষয়ী স্বার্থপর লোকদের আমি দেখিয়ে দেবো, যোগের শক্তি কাকে বলে!’
‘সব ছেড়ে মেজোমামাকে কেন? যোগের শক্তি নেমে এলে সবাই দেখবে। শুধু মেজোমামা কেন বড়মামা!’
‘সেদিন সামান্য একপাটি চটির জন্যে কি সাংঘাতিক অপমান করল, তুই ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি।’
‘মেমোমামার মাথার ঠিক ছিল না বড়মামা।’
‘মেজোর মাথা কবে ঠিক থাকে? সব সময়েই তো বাবুর হট হেড!’
‘সেদিন কিন্তু আপনার কুকুর ভীষণ অসভ্যতা করেছে।’
‘কুকুরের কাজ কুকুর করেছে। মানুষের কাজ কী তোর মেজোমামা কোনও দিন করেছে? কুকুর মানুষ চেনে রে। তোর মেজোমামার মতো মানুষদের হাড়ে হাড়ে চেনে।’
‘কুকুর মানুষ চেনে ঠিকই তবে সবচেয়ে ভালো চেনে জুতো। আপনার চটি আর মেজোমামার চটি পাশাপাশি খোলা ছিল। চিনে চিনে ঠিক মেজোমামার চটিটাই ছিঁড়ে ফালাফালা করল কেন?’
‘কৃপণদের ওই অবস্থাই হয় রে। কোত্থেকে এক জোড়া কাঁচা চামড়ার চটি কিনে নিয়ে এল। ওয়ান পাইস ফাদার মাদারদের ওই হালই হয় রে। সস্তার তিন অবস্থা।’
বড়মামার ঘরের বাইরে দিয়ে মেজোমামা ঠিক সেই সময়েই কি কারণে যাচ্ছিলেন কে জানে! শেষ কথাটা ঠিক কানে গেছে। মেজোমামা পর্দা সরিয়ে শরীরের ওপরের অংশটা ঘরে ঢুকিয়ে বললেন :
‘জুতোর আবার কাঁচাপাকা কী হে! এ কী পেয়ারা! ডাঁসা পেয়ারা পাকা পেয়ারা!’ মেজোমামা মাথাটা সরিয়ে নিচ্ছিলেন। বড়মামা ডেকে বললেন, ‘ওহে শোন শোন।’
পর্দার বাইরে থেকে মেজোমামা বললেন, ‘কি আর শুনব? তোমার পক্ষপাতিত্ব আমার জানা আছে। কুকুর ছাড়া পৃথিবীতে তোমার আপনজন কে আছে! কুকুরপ্রেমী সুধাংশু মুকুজ্যে!’
‘শোনো, শোনো, শুনে যাও। তুমি অধ্যাপক হতে পারো, শিক্ষার কিন্তু অনেক বাকি আছে।’
মেজোমামা পর্দা সরিয়ে ঘরের চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি না হয় ওয়ান পাইস ফাদার মাদার, তুমি তো দাতা কর্ণ, তা তোমার পেয়ারের কুকুরদের রোজ একপাটি করে নতুন জুতো চিবোবার জন্যে কিনে দিলেই পারো, কৃপণের জুতো ধরে টানাটানি না করলেই হয়।’
‘ও যত জুতোই দাও, কাঁচা চামড়ার জুতো পেলে ওদের আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।’
‘যে কুকুর জুতো খায় সে কুকুর অতি নিকৃষ্ট ধরনের কুকুর, নীচ জাতের কুকুর, নের অধম।’
‘তাই নাকি, বুলটেরিয়ার, ফক্স ফেরিয়ার, এসব হল নীচ জাতের কুকুর, আর তোমার জুতোটা হল উঁচু জাতের!’
‘কি বলে রে!’
বড়মামা সমর্থন পাবার আশায় আমার দিকে তাকালেন। দু মামার সঙ্গেই আমার সমান ভাব। একটু পরেই মেজোমামা আমাকে মর্নিং শোতে ইংরেজী ছবি দেখাতে নিয়ে যাবেন। আবার বিকেলবেলা বড়মামা আমাকে গান্ধীঘাটে বেড়াতে নিয়ে যাবেন বলেছেন, বড়মামার নতুন মোটর সাইকেলে করে। মহা মুশকিল হয়েছে আমার। কোনও পক্ষেই সহজে যাবার উপায় নেই।
মেজোমামা বললেন, ‘জুতোর জাত-ফাত আমি জানি না। ও নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো সময়ও আমার নেই। জুতো পায়ে দিয়ে ফটাস ফটাস করে হাঁটা যায় ইটুকুই জানি। আর জানি কিছু জুতো আছে, পায়ে লাগে। পরলে কষ্ট হয়। কিছু আছে পায়ে লাগে না।’
‘অধ্যাপকদের ওইরকম জ্ঞান হওয়াই স্বাভাবিক। জুতো পায়ে দিয়ে নাকে চামড়ার বদগন্ধ পাও না?’
‘জুতো থাকবে পায়ে, নাক থেকে পায়ের দূরত্ব মিনিমাম সাড়ে চার ফুট। জুতো তো আর গোলাপ ফুল নয়, নূরজাহানের মতো নাকের কাছে কেউ বোঁটা ধরে বসে থাকবে!’
‘তোমার সঙ্গে আমি তর্কে পারব না। এই দেখ আমার জুতো। দস্তুরমতো পয়সা খরচ করে কেনা। পাকা চামড়ার জুতো। নাকের কাছে ধর…’
বড়মামা জুতোটা পা থেকে খুলে নিজের নাকের কাছে ধরলেন, ‘কোনও গন্ধ পাবে না। রোজ পাউডার দিই বলে, একটু পাউডারের গন্ধ পাবে।’
বড়মামা জুতোটা নাকের কাছে ধরে আছেন, এমন সময় মাসিমা ঘরে এলেন হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে মাসিমা ট্রেটা আর একটা টেবিলে রাখতে বললেন, ‘উঁহু, উঁহু বড়দা, জুতো দিয়ে চা খেও না। বিস্কুট দিয়ে চা খেতে হয়।’
বড়মামা মাসিমার নাকের কাছে জুতোটা ধরে বললেন, ‘কোন গন্ধ পাচ্ছিস কুসি!’
মাসিমা মুখটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘একি, একি, পায়ের জিনিস নাকের কাছে কেন?’
‘একে কি বলে জানিস? হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। তুই একবার ওর জুতোটা শুঁকে দেখ। আমি এখানে বসে গন্ধ পাচ্ছি। ভাগাড়ের পচা চামড়া দিয়ে তৈরি।’
মেজোমামা বললেন, ‘তোমার ঘরে ডেকে এনে সাতসকালে এভাবে অপমান করার কি মানে হয় বড়দা?’
‘অপমান! এতে মান অপমানের কি হল শুনি! তোমাকে আমি শিক্ষা দিচ্ছি। জ্ঞান দিচ্ছি। যা এই বাচ্চা ছেলেটা জানে, তুই তা জানিস না।’
মাসিমা বললেন, ‘তোমাদের দুজনে মুখোমুখি হলেই কী কথা কাটাকাটি! এখন দুজনে শান্তিতে একটু চা খাও দেখি। সাতসকালেই জুতো নিয়ে শুরু হল! এখনও সারাটা দিন পড়ে আছে।’
মেজোমামা চটপট শব্দ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দরজার পর্দার কাঠটা খটাখট শব্দ করে উঠল। বাইরে থেকে হেঁকে বললেন, ‘কুসি, আমার চা-টা আমার ঘরে দে। আমার জুতোয় গন্ধ, আমার গায়ে গন্ধ। ওনার কুকুরের গায়ে আতরের গন্ধ।’
বড়মামা প্রতিবাদ করে বললেন, ‘মিথ্যে বল না। তোমার গায়ে গন্ধ একথা কিন্তু একবারও আমি বলিনি।’
‘ওই হল। এরপর তোমার কুকুর যদি আমাকে আমাকে কামড়ে দেয়, তুমি বলবে তোর গাটা পচা চামড়া দিয়ে তৈরি। তুমি হলে ওয়ান আইয়েড বুল।’
‘তুমি হলে টু আইয়েড কাফ।’
মাসিমা বড়মামাকে একটু ধমক দিলেন, ‘কি হচ্ছে বড়দা! এবার কিন্তু ভীষণ ছেলেমানুষী হয়ে যাচ্ছে।’
‘তুই বল কুসি, কাঁচা চামড়ার জুতো কিনেছে, কুকুর গন্ধ পেয়ে ছিঁড়ে দিয়েছে, তার আমি কি করব! আমার জুতো জোড়াও তো পাশে ছিল।’
‘কিছু মনে করো না বড়দা, তোমার সবক’টা কুকুরই ভীষণ শয়তান। সারা বাড়িতে একটা না একটা অনিষ্ট করে চলেছে। ওই তো ওঘরে সোফায় গদীটা ছিঁড়েছে।’
বড়মামার মুখটা হঠাৎ খুব করুণ হয়ে গেল। মাসিমা চলে গেলেন। গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘কে বলেছিলেন, জীবে দয়া করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর?
‘স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন বড়মামা।’
‘তাহলে দ্যাখ, মহাপুরুষের কথা যারা মেনে চলতে চায় তাদের কি অবস্থা হয়। সে একঘরে হয়ে যায়। তাকে ভাই এসে অপমান করে যায়, তাকে তার বোন এসে বলে আদিখ্যেতা। এই যাঃ।’
বড়মামা চায়ের কাপটাকে বিষের কাপের মতো টেবিলে নামিয়ে রেখে, মহা অপরাধীর মতো মাথায় হাত দিয়ে বসে, মুখে চুক চুক শব্দ করতে লাগলেন।
‘কি হল বড়মামা?’
‘আর কি হল, সর্বনাশ হয়ে গেল রে, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়ে গেল।’
‘কি প্রতিজ্ঞা?’
‘আজ থেকে আমার চা ত্যাগ করার কথা। চা ত্যাগ, মাছ মাংস ত্যাগ। বিলাসিতা ত্যাগ।’
বড়মামা যেভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন, একটু শান্ত করা দরকার। বললুম, ‘তাতে কি হয়েছে বড়মামা? ছুটির দিন আপনি বিশ কাপ চা খান, এখনও উনিশ কাপ বাকি। সেই উনিশ কাপ না হয় খাবেন না!’
‘তাহলে এই কাপটা খেয়ে নোব বলছিস? আর সিকি কাপ মাত্র পড়ে আছে। বড়মামা চোঁ করে চা-টা খেয়ে নিলেন। তারপর চোখ বুজিয়ে বসে রইলেন চুপ করে। অপরাধ করে ফেলেছেন। এখন চোখ বুজিয়ে ভগবানের কাছে ক্ষমা চাইছেন।
মেজোমামার ঘরে ঢুকে দেখি সেখানে আর এক কাণ্ড চলেছে। মেঝের ওপর বেশ বড় করে খবরের কাগজ বিছিয়েছেন। তার ওপর পাশাপাশি দুপাটি চটি। মেজোমামার হাতে একটা স্প্রেয়ার। মুখের চেহারা বেশ কঠিন। ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে বারকতক স্প্রে করে ছুটে জানালার দিকে চলে গেলেন, পাছে নাকে ঝাঁজ লেগে যায়। মেজোমামার আবার হাঁচির অসুখ আছে। ধুলো, স্প্রে, ফুলের গন্ধ, পাউডার, ধূপের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। বড়মামা মেজোমামা এই ব্যামোর নাম রেখেছেন ঘোড়া রোগ। ঘোড়ারা নাকি এইভাবে ফ্যাঁচোর ফ্যাঁচোর করে অনবরতই হাঁচে।
মেজোমামা শুনে বলেছিলেন, ‘গো-বৈদ্যরা এই কথাই বলবে, তবে প্রকৃত ডাক্তাররা এই অসুখের বেশ সভ্যভব্য নাম রেখেছেন—অ্যালার্জি। মানুষের চিকিৎসা করলে তুমিও জানতে, হাওয়েভার দেশে তো মানুষের সংখ্যা খুবই কম তাই ডাক্তার সুধাংশু মুকুজ্যে করে খাচ্ছে।’
মেজোমামার কথা শুনে বড়মামা অবশ্য রাগ করেননি, হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘গরুরাই গরুদের ভালো চেনে, তাই সারা দেশে তারা মানুষ দেখতে পায় না।’
কিন্তু মেজোমামার এ কী কেরামতি!
‘মেজোমামা, জুতোয় কি ছারপোকা হয়েছে?’
মেজোমামা জানলার কাছ থেকেই বললেন, ‘আগে এদিকে পালিয়ে আয় তারপর বলছি, ওদিকে কি উড়ছে দেখতে পাচ্ছিস না!’
‘ওতে আমার কিছু হবে না মেজোমামা।’
‘হলে তখন রক্ষে থাকবে না, বিগব্রাদার তেড়ে আসবে।’
মেজোমামা রেগে গেলেই বড়মামাকে বিগব্রাদার বলেন! পুবের জানলা দিয়ে ঘরে বাঁকা হয়ে একফালি রোদ এসে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। সেই রোদের রেখায় অজস্র তেল মেশানো কীটনাশক পদার্থের কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। খবরের কাগজে তেলের ছিটে ছিটে দাগ ধরেছে।
জানলার দিকে সরে যেতেই মেজোমামা বললেন, ‘জুতোর গন্ধ মারছি। এরপর ওর ওপর এক টিন পাউডার ঢেলে, একমাস কাগজে মুড়ে ফেলে রেখে দেবো।’
‘তাতে কিছু হবে মেজোমামা?’
‘আলবাৎ হবে। ওর বাবা হবে। পাউডারে ঘামের গন্ধ চলে যায় জুতোর গন্ধ যাবে না?’
‘আমাদের সিনেমার কি হবে মেজোমামা?’
‘হবে, যাওয়া হবে। আমি তো আর বিগব্রাদারের মতো নই, কথায় কথা ব্লাফ। তুমি রেডি! আমি তো রেডি হয়েই আছি। পাঞ্জাবি চড়াবো, পুরনো স্লিপারটা পায়ে গলাব, আর বেরিয়ে পড়ব।’
‘আমিও রেডি। কেবল জুতোর ফিতে বাঁধতেই যা একটু সময় লাগবে।’
‘তুই চটি পরিস না কেন? চটি কত হাল্কা!’
‘বড়মামা বলেছেন, জুতো ছেড়ে চটি পরলে পা বাইশ শো বাইশ হয়ে যাবে, যেমন আপনার হয়েছে!’
‘কে বলেছে? বিগব্রাদার! বিগব্রাদার বলেছে—তাই না।’
মেজোমামার চশমার কাচের আড়ালে বড় বড় চোখ আরও বড় বড় হয়ে উঠল। হাতের স্প্রেয়ারটা ঠক করে জানলার গবরেটে রাখলেন।
এই রে, সেরেছে রে! আর এক অশান্তি পাকিয়ে উঠল। কেন মরতে বলতে গেলুম। মেজোমামা টেবিলের টানা থেকে একটা স্কেল বের করলেন। স্কেলটা হাতে নিয়ে সোজা বড়মামার ঘরে। আমাকেও পেছন পেছন যেতে হল। কি থেকে কি হয়ে যায়! সামাল দিতে হবে।
বড়মামা চোখে একটা কালো গগলস লাগিয়ে চুপ করে চেয়ারে বসে আছেন। হাত দু’টো কোলের ওপর নেতিয়ে আছে। মনে হয় ধ্যানস্থ! চশমার আড়ালে চোখ দু’টো বোজানো মনে হয়। ঠিক তাই।
মেজোমামা দুম করে ঘরে ঢুকতেই শান্ত গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘কে এলি!’
মেজোমামা কাজের মানুষ। উত্তর-টুত্তরের ধার ধারেন না। বড়মামার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে ডান পা-টা ধরে টানাটানি শুরু করেছেন। স্কেলের ওপর পা-টা তুলতে চাইছেন। মাপ নেবেন। বড়মামা চোখ খোলেননি। সেই একইভাবে বসে থেকে বলছেন, ‘কে সন্তু এলি? ঠিক আছে, ঠিক আছে, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হবে না, আশীর্বাদ করি দীর্ঘজীবী হ’ শরীর ভালো থাক, জীবনে উন্নতি হোক; ওভাবে পায়ে খোঁচা মারিসনি। নখটা আজ কাটবি। করছিস যখন দু’পায়েই প্রণাম কর। এক পায়ে প্রণাম কলে গোদ হয় না!’
মেজোমামা ঝট করে নিজের পা-টাও মেপে নিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এক সেণ্টিমিটার কম। বুঝলে, আমার পায়ের মাপ তোমার চেয়ে এক সেন্টিমিটার কম।’
বড়মামা বললেন, ‘তাতে কি হয়েছে, জল পড়লে সব কাপড়ই একটু টেনে যায়। তোমার তো তবু এক সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে গেছে। আমার কি হয়েছে জানো, এই সেদিন যে নতুন পাঞ্জাবিটা করালুম, যেই জলে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে দু’দিক থেকে টেনে গিয়ে, হাত দুটো উঠে গেল কনুইয়ের কাছে। আর ঝুল? তুমি অবাক হয়ে যাবে, ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছে। তুমি এক কাজ কর না, আমার আর একটা নতুন পাঞ্জাবি—ব্র্যাণ্ড নিউ। হাল্কা চাঁপা ফুলের মতো রং। ভারি সুন্দর মানাবে তোমাকে। তোমার চেহারাটা পাঞ্জাবিতে খোলে ভালো।’
বড়মামা চেয়ার থেকে উঠে কাপড় আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন। মেজোমামা হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বড়মামা আলমারি খুলে এ তাক সে তাক ঘেঁটে ফিকে হলদেটে রঙের একটা পাঞ্জাবি বের করলেন। বেশ সুন্দর দেখতে। পাঞ্জাবিটা ঝেড়ে পাট খুলে মেজোমামার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এসব জিনিস প্রফেসারদেরই মানায়। রংটা দেখেছিস? তখন ঝোঁকে পড়ে নিজের জন্যে করিয়েছিলুম। একদিনও গায়ে উঠল না। কখন পরব বল? তুই পর। বেশ মানাবে তোকে। ফর্সা টকটকে চেহারা। মনে হবে ঠিক যেন সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছিস।’
মেজোমামা পাঞ্জাবিটা হাতে নিলেন। চমৎকার সেন্টের গন্ধ বেরোচ্ছে।
বড়মামা জামাকাপড়ের মধ্যে খালি ধূপের প্যাকেট গুঁজে রাখেন।
মেজোমামা—’তোমার পাঞ্জাবি আমার গায়ে হবে কি?’
‘আলবাৎ হবে। আমাদের দুজনেরই এক হাইট এক বুকের মাপ।’
‘কেবল পায়ের মাপটাই যা আলাদা।’
‘তা হতে পারে, কিছু মনে করিসনি, তোর পা দুটো একটু অডসাইজ, অনেকটা তুষার মানবের মতো।’
‘ওইটা তোমার কমপ্লিটলি ভুল ধারণা। তুষার মানবের মতো পা হল তোমার। ইয়া বাইশ শো বাইশ।’
বড়মামা একটু শব্দ করে হেসে বললেন, ‘এই তো আমার পায়ের ধুলো নিলি। কি মনে হল তোর? মনে হল না যেন গৌরাঙ্গদেবের পায়ে হাত দিচ্ছিস? এসব পা ছবিতে দেখা যায়। শ্রীরামচন্দ্রের পা। তোর পা-টা রামায়ণেই পাবি! তবে এ পক্ষে নয় ও পক্ষে। রাবণ-টাবনের মনে হয় এই রকম পদযুগল ছিল।’
মেজোমামার এক হাতে পাঞ্জাবি অন্য হাতে স্কেল। চোখ দুটো আবার বড় বড় হচ্ছে। মেজোমামা বললেন, ‘দেখেছ, আমার হাতে কি?’
বড়মামা এতক্ষণে মেজোমামার হাতের স্কেলটার দিকে নজর পড়ল।
‘স্কেল দিয়ে কি করবি? পেটাবি নাকি?’
মেজোমামা যেন একটু লজ্জিত হলেন, ‘ছি ছি, পেটাব কেন? স্কেল দিয়ে কেউ পেটায়! স্কেল হল মাপের জিনিস। তুমি যখন চোখ বুজিয়ে বসেছিলে তোমার পা-টা আমি মেপে ফেলেছি।’
‘জুতো কেনার জন্যে কেউ স্কেল দিয়ে পা মাপে? ভগবান তোকে কবে একটু সাধারণ বুদ্ধি দেবেন! মাথা বোঝাই অসাধারণ বুদ্ধি। আর আমার এখন জুতো কি হবে? আমার তিন চার জোড়া রয়েছে। জুতো দরকার তোর। আমার এই কুকুরটা, চার্লসটা, ওর স্বভাবটা বিশেষ ভালো নয় রে। খাস আইরিশ কুকুর হলে হবে কি, পশ্চিমবাংলার আবহাওয়ায় কী রকম বিগড়ে গেল। তা’ না হলে তোর জুতোটা ওভাবে চিবোয়! আমি তোকে এক জোড়া দামী স্লিপার প্রেজেন্ট করব। লি ওয়ার দোকানের হাল ফ্যাশানের স্লিপার। কাগজ কেটে মেপে তোর পায়ের মাপটা খালি আমাকে দিয়ে যা। ও, তুই তো আবার মাপ নিতেই জানিস না। স্কেল হাতে ঘুরছিস। দাঁড়া, আমি মাপটা একেবারে নিয়ে তোকে ছেড়ে দি।’
মেজোমামার আবার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে। বড়মামা একটা ফালি কাগজকে ভাঁজ করে করে সরু মতো করে মেজোমামার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসেছেন। আমাকে বললেন, ‘টেবিলের ওপর থেকে পেনসিলটা দাও তো!’ পেনসিলটা হাতে নিলেন। মেজোমামাকে বললেন, ‘নাও, তোমার ডান পা-টা এই কাগজটার ওপর ফেলো।’
মেজোমামা একটু ইতস্তত করছেন।
‘কি, হল কি তোমার? রাখো পা-টা রাখো।’
‘তুমি গুরুজন। তুমি আমার পায়ে হাত দেবে কী!’
‘অদ্ভুত তোর কথা! আমি যেমন তোর দাদা তেমনি তোর বন্ধু। আমার চেয়ে বড় বন্ধু তোর কে আছে রে ব্যাটা। নে, পা-টা রাখ? দেখছিস তখন থেকে উবু হয়ে বসে আছি। ভুঁড়িতে টেরিফিক চাপ পড়ছে।’
মেজোমামা অবশেষে ডান পা-টা মেঝেতে পাতা ফালি কাগজটার ওপর রাখলেন। আঙুলটার মাথায় এই পেনসিলের দাগ দিলুম। নাও, পা তোলো।’
মেজোমামা পা তুলে নিলেন। বড়মামা কাগজটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
‘এই হল তোমার পায়ের মাপ। এইবার আমি লি ওয়ার দোকানে গিয়ে এটা ফেলে দিয়ে বলব—জুতো নিকালো। সব কিছু শিখতে হয় প্রফেসার! এই কায়দাটা আমি শিখেছি আমার বাবার কাছ থেকে।’
‘আচ্ছা, এবার তোমার পা-টা ওর ওপর ফেল তো বড়দা। দাঁড়াও তার আগে তোমাকে একটা প্রণাম করি।’
মেজোমামা বড়মামাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘এটা আমি কার কাছে শিখেছি জানো? আমার বাবার কাছে।’
‘তোর আর আমার তো একই বাবা রে!’
দু’মামা অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কত বড় এটা আবিষ্কার! কিছুক্ষণ পরে দুজনে হো-হো করে হেসে উঠলেন। আর ঠিক সেই সময় মাসিমা দুকাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বড়মামা বললেন, ‘আঃ, জাস্ট ইন টাইম! তুই হাত গুনতে জানিস রে কুসি।’
দুই মামাই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ফুড়ুৎ ফুৎ করে চুমুকে চুমুকে চা চলছে দু’ভায়ের। আমেজে কারুর মুখেই কোনও কথা নেই। বড়মামাকে আমিই মনে করিয়ে দিলুম, ‘বড়মামা, আপনি কিন্তু আজ সকাল থেকে চা খাওয়া ত্যাগ করেছেন।’
ঠোঁটের কাছে কাপটা ধরা ছিল। সবে আর একটু চুমুকের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। থেমে গেলেন। কাপটা নেমে এল। বড়মামার মুখটা ভীষণ করুণ দেখাচ্ছে। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা দুবার চেটে নিলেন।
‘ইস! ভাগ্যিস মনে করিয়ে দিলি। প্রায় আধ কাপ চা খেয়ে ফেলেছি রে।’
মেজোমামা বললেন, ‘এতে কিসের কী আছে? চা তো খাবারই জিনিস।’
‘আমি যে চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি রে।’
‘কেন, তোমার কি লিভার বিগড়েছে? না, রাতে ঘুম হচ্ছে না?’
‘না না, ওসব নয়। ধর্মীয় কারণে, ধর্মীয় কারণে।’
‘রাখো তোমার ধর্ম। কোন ধর্ম চা খেতে বারণ করেছে—এমন সাত্ত্বিক নির্ভেজাল পাতা ফোটানো জল! খেয়ে নাও।’ বড়মামা এক চুমুকে চা-টা খেয়ে নিলেন। খালি কাপটা রাখতে বললেন, ‘জয় গুরু।’
মেজোমামা বললেন, নাও, জামা কাপড় পর। আমাদের সঙ্গে সিনেমায় যাবে। মর্নিং শো।’
‘সিনেমা? সিনেমা যে আর দেখবো না রে। দেখলেও ওই চৈতন্য মহাপ্রভু, কি বামাখ্যাপা কিম্বা যুগবতার জাতীয় ছবি। আমার গুরু পরমানন্দ…’
‘রাখো তোমার পরমানন্দ। এই নিয়ে তোমার সাতজন গুরু হল। কোন গুরুকেই তো শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারো না।’
‘না রে, এবার খুব ধরেছি। দুজনেই দুজনকে। মোক্ষম ধরেছি। একেবারে কাছিমের কামড়।’
‘ঠিক আছে, সে তোমরা কামড়াকামড়ি কর। এখন পাঁচ মিনিট সময় দিলুম, রেডি হয়ে নাও। নইলে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাবো।’
‘হ্যাঁ, বড়মামা’—বলে, আমি কোমর জড়িয়ে ধরলুম। ‘যেতেই হবে। যেতেই হবে।’
তিনজনে পাশাপাশি বসে মজা করে সিনেমা দেখা হল। বড়মামা একবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমরা প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। মেজোমামা এক সময় বললেন, ‘কার যেন নাক ডাকছে!’
‘বড়মামার, মেজোমামা।’
আমি বসেছিলুম মাঝখানে। মেজোমামা বললেন, ‘ডেকে দে। আস্তে একটা খোঁচা মার।’
বড়মামা চোখ চেয়ে বললেন, ‘কি করব বল? এটা লাইন ইংরিজী বুঝতে পারছি না। অ্যামেরিকানরা কি ভাষায় কথা বলে বল তো? মেজোকে জিগ্যেস কর তো, ফাইটিং-টাইটিং কখন হবে?’
‘এইবার হবে, তুমি জেগে থাকো।’
বড়মামা সাঁ করে এক টিপ নস্যি নিলেন। পর্দায় তখন সবে একটা প্লেন উড়ছে। শব্দে শব্দ মিলে গেল। তা না হলে ওপাশের লোকটি বড়মামার উপর বিরক্ত হতেন।
বড়মামা হল থেকে বেরিয়ে বললেন, ‘বেশ জম্পেস বইটা।’
মেজোমামা বললেন, ‘তুমি আর দেখলে কোথায়? তোমার তো নাক ডাকছিল।’
‘দূর, নাক ডাকবে কেন? নাকটা বুজে গিয়েছিল। যেই নস্যি নিলুম ছেড়ে গেল। ফাসক্লাশ হয়ে গেল। বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলুম রে মেজো!’
‘কি আবার হল?’
‘ওই কুকুরটা। কুকুরটা দেখলি? মেমসাহেবের কোলে ছিল। ওই রকম একটা ল্যাপ ডগ কোথায় পাওয়া যায় বল তো?’
আমরা বড়মামার গাড়িতেই এসেছি। গাড়ি স্টার্ট নিল। বড়মামার সেই এক কথা—একটা ল্যাপ ডগ…
গাড়ি বাজারের রাস্তায় ঢুকতেই বড়মামা ড্রাইভারকে বললেন, ‘লি ওয়ার দোকানের সামনে দাঁড় করাও তো।’
লি ওয়ার বউ লম্বা টেবিলে চুরি দিয়ে আনাজ কাটছিল। ভেতরের ঘরে সেলাই কল চলার খটখট আওয়াজ হচ্ছে। বড়মামা বললেন, ‘সায়েব কোথায়?’
চীনেরা সবসময় যেন হেসেই আছে। হাসলে ওদের মুখে কী সুন্দর টোল পড়ে! চীনে মেমসাহেব ওদের দেশের ভাষায় তড়বড় করে কি সব বলতেই ভেতরের ঘর থেকে কাঁচি হাতে ঝকঝকে চেহারার এক চীনে সায়েব বেরিয়ে এলেন। বড়মামা বললে, ‘এই যে তাই চুং, এই মাপের তোমার তৈরি বেস্ট এক জোড়া চটি লাগাও।’
চুং সাহেব কাগজটা হাতে নিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের একটা স্কেলের ওপর ফেললেন। স্কেলটার একটা দিকের কোণাটা উঁচু। মেপে-টেপে স্ত্রীকে বললেন—নাম্বার সেভেন ডায়নামো।
মেজোমামা বললেন, ‘দেখলে তো বড়দা, স্কেল দিয়েই পা মাপে।’
‘সে তো অ্যালুমিনিয়ামের একটা স্কেল, নট ইওর প্লাস্টিক।’
মই বেয়ে ওপরে উঠে মহিলা একটা বাক্স ছুঁড়ে দিলেন। চীনে সায়েব খপ করে লুফে নিলেন। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছি, মহিলা কি করে খড়ম পায়ে অমন অক্লেশে মই বেয়ে ওপরে উঠলেন। জুতোটা ভারি সুন্দর। বড়মামা মেজোমামার হাতে জুতোটা দিয়ে বললেন, ‘কী, পছন্দ?’
মেজোমামা লাজুক লাজুক মুখে বললেন, ‘বেড়ে দেখতে। একটু শুঁকে দেখব বড়দা?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখ না, এসব পাকা চামড়ার জুতো।’
মেজোমামা জুতো শুঁকছেন, সায়েব জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি পরবেন বাবু?’
বড়মামা বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই তো পরবে।’
সায়েব অবাক হয়ে বললেন, ‘তাহলে কাগজে মাপ এনেছেন কেন? দেখি, পা দেখি। পা থাকতে কাগজে কেন?’
গাড়িতে বসে বড়মামা বললেন, ‘আই অ্যাম এ ফুল।’
মেজোমামা বললেন, ‘আই অ্যাম অলসো এ ফুল।’
দু’মামার মাঝখানে জুতোর বাক্স।
দুজনে কোরাসে বললেন—’আমরা দুজনেই দুটো পাঁঠা। হে হে হে।’