মেজাজ বদল
সত্যিই কিন্তু ভারি আশ্চর্য এই নতুন সভ্যতা, যার নাম ধনতন্ত্র। এর মধ্যে যে ফাঁকির দিক নেই তা নিশ্চয়ই নয়। তবু সামন্ত সভ্যতা থেকে এই সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলা যেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পা বাড়ানো। তাই এদিকে এগিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের মেজাজটাই বদলে গেলো; এই মেজাজ-বদলের বিদেশী নাম হলো রেনেসাস। ব্যাপারটা কী রকম? এর আগের যুগটায় ধর্মের মোহ মানুষের মনকে অন্ধ, পঙ্গু, অকৰ্মণ্য করে রেখেছিলো। মেজাজ বদলের ফলে মানুষ যেন জেগে উঠতে চাইলো। পরকালের স্বপ্ন দেখে আর লাভ নেই; তার বদলে চাই সত্যিকারের জ্ঞান, চাই ভালো শিল্প, চাই বিজ্ঞান। আগেই বলেছি, গ্রীকরা খুব ভালো ভালো বই লিখেছিলো; কিন্তু ইতিমধ্যে মানুষ সেগুলোর কথা প্ৰায় ভুলতে বসেছিলো, ভুলতে বসেছিলো ভালো ছবি আঁকবার, ভালো মূর্তি গড়বার মর্যাদা। মন যখন নতুন করে জেগে উঠলো তখন মানুষের সেই সব পুরোনো আর ভুলে যাওয়া কীর্তিগুলোকে নতুন করে খোজ করবার তাগিদ দেখা দিলো। নতুন নতুন বইও লেখা শুরু হলো, নতুন কাব্য, নতুন নাটক, নতুন সব জ্ঞানের বই। পণ্ডিতেরা বলতে শুরু করলো : আত্মা আর পরকাল নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে ইহকালের কথাটাই ভালো করে ভেবে দেখা দরকার। মনে রাখতে হবে এই মাটির পৃথিবীর কথা আর রক্তমাংস গড়া এখানকার মানুষের কথা। কেউ কেউ বললো, খ্ৰীষ্টান ধৰ্মকেই মানতে হবে কিন্তু একেবারে শুধরে নিয়ে। নতুন করে খ্ৰীষ্টান ধর্মকে শুধরে নেবার চেষ্টা দেখা গেলো; এই চেষ্টার নাম দেওয়া হয় রেফর্মেশন। শুধরে নেওয়া খ্ৰীষ্টান ধৰ্মটা অমন অন্ধ, অমন গোঁড়া নয়। তার চেয়ে বেশি বেশি উদার, অনেক বেশি মুক্ত। ইওরোপে এই সময়টা বরাবরই মানুষ কাগজ তৈরি করতে শিখলো, শিখলো ছাপাখানা বানাতে। তার আগে পর্যন্ত হাতে-লেখা পুঁথিপত্র। ছাপাখানা আর কাগজ পাবার দরুন দেশে লেখাপড়ার প্রচার অনেক বেড়ে গেলো।
দেখা দিলো বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক। নানান বিজ্ঞানে নানান রকম নতুন নতুন আবিষ্কার। ভূগোল, পদার্থ-বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শরীর-বিজ্ঞান, কতোই না। কোপার্নিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন, বেকন, হার্ভে— কতো সব নামকরা-করা বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার এই যুগটায়। অবশ্যই, পুরোনো পৃথিবীর যারা প্রতিনিধি-ওই রাজা-জমিদার আর পাদ্রী-পাণ্ডার দল-ওরা তখন মরীয়ার মতো বিজ্ঞানের পথ রুখতে চেয়েছে। তারা চেষ্টা করেছে বৈজ্ঞানিকদের পুড়িয়ে মারতে, ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে, নির্বাসন দিতে দেশ থেকে। তবু বিজ্ঞানের পথ তারা রুখতে পারে নি। তার কারণ, তখনকার দিনের বণিক-ব্যবসাদারদের উৎসাহ। বিজ্ঞানকে এরা কাজের ব্যাপার বলে চিনেছিলো, যে-নতুন সভ্যতা গড়ে তোলবার জন্যে তাদের আয়োজন বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করতে না পারলে সে-সভ্যতা গড়া যায় না।
তারপর ধরো, নতুন দেশ আবিষ্কারের কথা। আগেই বলেছি, তখনকার দিনের বণিকেরা পৃথিবী জুড়ে সওদাগরি করবার আশায় কেমন করে বড়ো বড়ো নাবিকদের সাহায্য করতো আর সেই সাহায্য পেয়ে নাবিকেরা কেমন করে আবিষ্কার করলো নতুন নতুন দেশ।
এই মেজাজ-বদলের পরিচয় আরো নানান দিকে। যেমন বলা হয়, জাতীয়তাবোধ আর দেশপ্ৰেম। জাতীয়তা-বোধ মানে কি? নিজের দেশ, নিজের জাতি নিয়ে গর্ববোধ; তার সম্মানটা সবচেয়ে বড়ো করে দেখা! ইংরেজরা ভাবতে শুরু করলো : আমরা ইংরেজ, ওটাই আমাদের সম্বন্ধে বড়ো কথা। ফরাসীরা ভাবলো, ফরাসী হবার মতো গর্বের কথা আর নেই। জার্মানরাও ভাবতে শুরু করলো এই ধরনের কথাই। কিন্তু সামন্ত যুগে এমনতরো কথা কারুর মাথায় আসতো না। বরং নানান জাতির রাজা-মহারাজাদের মধ্যে কুটুম্বিতার দরুন সবগুলো মিলে যেন জোট পাকিয়ে ছিলো। তাছাড়া, তখন সমস্ত ইওরোপ জুড়ে খ্ৰীষ্টান ধর্মের প্রবল প্রতাপ ; তাই পুরো ইওরোপটাই যেন একটা জাত, খ্ৰীষ্টানদের জাত। কিন্তু সামন্ত যুগের পরমায়ু যতোই ফুরিয়ে আসতে লাগলো ততোই কমতে লাগলো রাজা-মহারাজা আর পাদ্রী-পুরোহিতের দাপট : নতুন যুগে আগুয়ান দল হলো নতুন ধরনের মানুষ, তাদের নাম ব্যবসাদার-সওদাগর। এ-দেশের সওদাগরদের সঙ্গে ও-দেশের সওদাগরের রেষারিষি, ঝোঁকটা তাই এ-দেশ আর ও-দেশের মধ্যে যে তফাত তার ওপরই। ব্যবসাদার-সওদাগরদের মনের কথা হলো, দেশের মানুষ নিজের দেশটাকে সবচেয়ে আপন বলে চিনতে শিখুক, তাহলে নিজের দেশের ঐশ্বর্য্য বাড়বে, তার মানে ফোঁপে উঠবে, ফুলে উঠবে নিজের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই ছড়িয়ে পড়তে লাগলো দেশপ্রেমের কথা।