মেজর সেবকরাম

মেজর সেবকরাম

সন্ধ্যার পর আজ বেশ একটু সময় নিয়ে আর বেশ একটু যত্ন করে প্রসাধন পর্বে মনোনিবেশ করেছেন মিসেস সেবকরাম। মুখখানা হাসি-হাসি। হাসি-হাসি কেন, আয়নায় নিজের দিকে চেয়ে মাঝে মাঝে হাসছেনও মিটিমিটি। কিছুদিন আগেও পার্টি শুনলে গায়ে জ্বর এসেছে। গোমড়ামুখ করে প্রসাধন সেরেছেন। বিশেষ করে মেস ক্লাবের ডিনার পার্টি শুনলে না যাবার ফিকির খুঁজেছেন এই বয়সেও। যে হৈ-হুঁল্লোড় কাণ্ড সব, বয়সের বাছবিচার নেই, ছেলে-বুড়োতে মিলে ফষ্টি-নষ্টির হাট! মিসেস সেবকরাম একবার এক বছরের একটা লিস্ট করেছিলেন–গোটা বছরে কতগুলো পার্টি হল। তাতেও অফিস পার্টি অর্থাৎ যাতে তাদের নিমন্ত্রণ নেই, সেগুলো বাদ দিয়েছিলেন। তারপর কর্তাকে ঠাট্টা করেছিলেন, মিলিটারী চাকরি মানে তো শুধু পার্টি আর পার্টি!

এই ঠাট্টার পরেই অবশ্য দুর্দৈব ঘটেছিল। চীনা আক্রমণে হিমালয়ের শান্তি নড়ে উঠেছিল। তখন এক এক কর্মক্ষেত্রেরই আবার আর এক রূপ দেখেছেন মিসেস সেবকরাম। সার্ভিসের লোকগুলোকে নিয়ে যেন হরির লুট লেগেছিল। কে কোথায় ছিটকে পড়েছিল ঠিক নেই। আজ যে এখানে কাল সে কোন সীমান্তে ঠিক নেই। সেদিনের কথা মনে পড়লেই একখানা হাসি-হাসি-মুখ বুকের তলায় খচখচ করে মিসেস সেবকরামের। তার থেকে অনেক ছোট অথচ কি নজরে যে দেখেছিল তাকে, কে জানে।–ক্যাপ্টেন বিঠঠল; বড় জোর চল্লিশ হবে বয়স। মিসেস সেবকরাম কোন পাটিতে গেলেই কাছে কাছে ঘুরঘুর করত, তিনি এদিক ওদিক তাকালেই পাঁচবার করে ছুটে আসত কিছু চাই কিনা জিজ্ঞাসা করতে। চাই বললে খুশি হত, চাই না। বললে মুখখানা বেজার করত। মিসেস সেবকরাম তার ওপরঅলার স্ত্রী, সেই হিসেবে। কিছুটা অনুকম্পার পাত্র। তা এসব পার্টিতে লেডিদের অনুকম্পার পাত্র সকলেই—-সে লেফটেনেন্ট কর্ণেলই হোক আর নবাগত লেফটেনেন্টই হোক। সম্মিলিত পার্টিতে সামান্য অফিসারের স্ত্রীর রাজরাণীর মর্যাদা।

তবু বড় অফিসারদের স্ত্রীদের ছোট অফিসাররা নিজেদের অগোচরেও কিছুটা সমীহ করে থাকে। কিন্তু সেদিন ক্যাপ্টেন বিঠলের পানের মাত্রা বোধ হয় একটু বেশী হয়ে গিয়েছিল। সবিনয়ে চুপি চুপি প্রস্তাব করেছিল, মাদাম, আজ যদি অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে নাচেন! মিসেস সেবকরাম পার্টির এই অধ্যায়টা বরাবর সন্তর্পণে পরিহার করে এসেছেন। আঠার-কুড়ি বছর বয়স থেকেই এই এক ধকল তাঁকে সামলে আসতে হয়েছে। বুড়ো বুড়ো ওপরঅলা অফিসারগুলো পর্যন্ত হ্যাংলার মত এই অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছে। কিন্তু মিসেস সেবকরাম নাচ শেখেনইনি মোটে। গোড়ায় গোড়ায় মেজর চেষ্টা করেছিলেন শেখাতে–অবশ্য চেষ্টা যখন করেছিলেন তখন তিনি মেজর নন, নতুন বয়সের লেফটেনেন্ট। ছদ্ম কোপে তখন চোখ পাকিয়েছেন মিসেস সেবকরাম, তোমাদের মিলিটারী চাকরিতে এত বউ ধরে টানাটানি কেন, নিজেরা যা করছ করোগে।

কিন্তু এই বয়সে বিঠঠলের ওই প্রস্তাবে যেমন অবাক হয়েছেন তেমনি বিরক্ত হয়েছিলেন। মেজরকে বলেছিলেন, ছোকরার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করো, ওর মাথায়। গণ্ডগোল হয়েছে, আজ আবার আমার সঙ্গে নাচতে চেয়েছিল!

মেজর সেবকরাম হা-হা করে হেসে উঠেছিলেন, বলেছিলেন, এবার থেকে তোমার বয়সের একটা কার্ড তুমি গলায় ঝুলিয়ে যেও।

সেই ক্যাপ্টেন বিঠঠলের বিদায় পার্টি ছিল সেদিন–সুদূর ফ্রন্ট-এ হাজিরা দেবার নির্দেশ এসেছিল তার উপর। বিদায় সম্বর্ধনার পরে মেজরের সামনেই সে এসেছিল মিসেস সেবকরামের কাছে। সৌজন্যের রীতি অনুযায়ী মিসেস সেবকরাম তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, সুস্থ পরমায়ু কামনা করেছিলেন। ছেলেটা চুপচাপ খানিক তাকিয়েছিল তার দিকে, তারপর অনুমতি প্রার্থনা করেছিল, আপনার হাতখানা ধরতে। পারি?

মিসেস সেবকরাম বিব্রত বোধ করেছিলেন, ওদিকে স্বামী নীরবে একটু ইশারা করেছিলেন। মিসেস সেবকরাম একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দুই হাতে প্রগাঢ় আবেগে সেই হাতখানা নিয়ে নিজের ঠোঁটে ঠেকিয়েছিল ক্যাপ্টেন বিঠঠল। তারপরেও ধরে রেখেছিল কয়েক মুহূর্ত। তারপর সসম্ভ্রমে ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, মাদাম, এই দুটো বছর আপনাকে বড় ভালো লেগেছে। হাসি-খুশি দরদ মর্যাদাবোধ–সব মিলিয়ে আপনাকে দেখলেই মনে হয়েছৈ, ইউ রিপ্রেজেন্ট মাদার ইণ্ডিয়া।

মিসেস সেবকরাম স্বামীর দিকে চেয়ে দেখেছেন, চোখ দুটো তার অদ্ভুত চকচক করছে। দেশের প্রসঙ্গে এই চোখ তিনি জীবনে অনেক দেখেছেন।

মাসখানেকের মধ্যে ফ্রন্ট থেকে ক্যাপ্টেন বিঠঠলের মৃত্যুসংবাদ এসেছে। তার। বীরত্ব আর দুঃসাহসিক মৃত্যুবরণের বিবরণও এসে পৌঁচেছে। সকলে গর্ব অনুভব করেছে। গোপনে অনেকবার চোখের জল মুছেছিলেন মিসেস সেবকরাম।

এর কিছুদিন বাদেই নিজের স্বামীকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। মেজরকে হাজিরা দিতে হয়েছে সুদূর লদাকে। সেই দীর্ঘ সময়টা কি ভাবে কেটেছিল মিসেস সেবকরামের তিনিই জানেন। এই দুটো ঘটনার পর থেকে বাকি একটা বছর পার্টির অনেক প্রগলভ হৈ-চৈ এমন কি অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অশালীন ফুর্তি দেখেও তিনি বিরক্ত হননি।…আহা, কে কবে আছে আর নেই কে জানে, জীবনের তো এই দাম সব!

কিন্তু আজ নিজের খুশির আমেজেই সুচারু প্রসাধন সম্পন্ন করছেন মিসেস সেবকরাম। তার বয়স পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। চুলের বোঝার ফাঁকে ফাঁকে অনেকগুলোতে পাক ধরেছে। কিন্তু সাজগোজ করে পার্টিতে গেলে সেখানকার পঞ্চাশোর্ধরা তার দিকেই বেশি ঘেঁষে। মেজরের এখন আটান্ন, সব চুল সাদা। দুই ছেলে মিলিটারী কলেজে ভবিষ্যৎ সৈনিক হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মেজর ঠাট্টা করেন, আমার সঙ্গে তোমার পার্টিতে যাওয়ার অনিচ্ছার কারণটা বুঝতে পারি, ছেলেদের যখন বড় বোন ভাবে লোকে তোমাকে, আমাকে কি ভাবে কে জানে!

এই বেপরোয়া রসিকতারও হেতু আছে। ছেলেরা সেবারে ছুটিতে বাড়ি আসতে একজন সদ্য পরিচিত ভদ্রলোক মিসেসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এঁরা দুটি আপনার ছোট ভাই নাকি?

কিন্তু মুখে যাই বলুন মেজর, তার ওই চুলই শাদা হয়েছে। এখনো চওড়া বুকের ছাতি, পরিপুষ্ট হাতের কজা। আনন্দে অনেক নব্য তরুণের হাত ধরে ঝাঁকুনি দেন। যখন, তাদের কাঁধের হাড়ে লাগে। এই রসিকতা শুনলেই মিসেস সেবকরাম রাগ করেন আবার হেসে ফেলেন।

কিন্তু প্রসাধনরত মিসেস সেবকরাম আজ হাসছেন অন্যকারণে। আজকের বিশেষ পার্টি বিশেষ করেই তাদের জন্যে–সেই কারণেও নয়। জীবনের এক বিরাট অধ্যায় শেষ হয়ে গেল, চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করছেন মেজর সেবকরাম–সেই বিদায়। উপলক্ষে এই সাড়ম্বর পার্টি। কিন্তু মিসেস সেবকরামের ঠোঁটের ফাঁকে কৌতুকের। হাসিটুকু লেগে আছে একেবারে ভিন্ন কারণে। আজও এই খানিক আগে স্বামীর সঙ্গে সেই চিরাচরিত ব্যাপার নিয়ে ছদ্ম বাকবিতণ্ডা হয়ে গেছে একপ্রস্থ। ঠোঁটের হাসিটুকু তারই রেশ। মেজর বলেছিলেন, যার জন্যে জীবনের ঠিক এইখানটায় আজ এসে দাঁড়ানো গেছে, তাকে সত্যি সত্যি কেউ চিনল না।

মিসেস সেবকরাম হাসি চেপে দেয়ালের মস্ত অয়েলপেন্টিং ছবিটা দেখিয়ে নিরীহ মুখে জবাব দিলেন, কর্নেল ব্রাউনের কথা বলছ?…চিনবে না কেন, মস্ত নামী লোক তার ওপর তোমার মত এমন একজন মেজর তৈরি করে গেল!

সেবকরাম মাথা নেড়েছেন, কর্নেল ব্রাউন নয়, আমি আমার ঝুমরির কথা বলছি। আজকে এই জায়গায় এসে দাঁড়ানোর পিছনে ঝুমরিবাঈয়ের কেরামতি কতখানি কেউ জানলই না, বোকাগুলো জীবনভোর শুধু আমাকেই বাহবা দিয়ে গেল।

মিসেস সেবকরামের নাম ঝুমরিই বটে, ঝুমরিবাঈ। কিন্তু এখন ভদ্রলোকটিও তাকে ঝুমরি বলে ডাকলে লজ্জা-লজ্জা করে–কেমন ছেলেমানুষ লাগে নিজেকে। ছেলেদের সামনে ডাকলে তো চোখ রাঙান তিনি। মহিলাদের উদ্যোগের কোনো চাঁদার খাতাটাতায় সই করতে হলেও সংক্ষেপে লেখেন মিসেস জে, সেবকরাম। ঝুমরিবাঈ শুনলে তবু একরকম, শুধু ঝুমরি শুনলে বয়স যেন অর্ধেক কমে যায়।

সেই রকমই ভ্রূকুটি করেছিলেন ঝুমরিবাঈ, এই প্রসঙ্গ উঠলে যেমন করে থাকেন। বলেছিলেন, হু, আমার কেরামতি কত জানা আছে! আসলে যার কেরামতি সে তোমার ওই গলায় ঝুলছে–তোমার এই চাটুবাক্যে যে ভুলবে সে একটি আস্ত বোকা!

মেজরের গলায় ঝুলছে বড় লকেটসুষ্ঠু একটা হার। আজ ছত্রিশ বছর ধরেই এটা গলায় ঝুলছে তার। ছত্রিশ বছর আগে প্রথম যখন ফৌজের চাকরিতে ঢোকেন তিনি–তার ঠাকুরদা এটি উপহার দিয়েছিলেন তাকে।

উপদেশ দিয়েছিলেন, মন্ত্রপূত কবচের মত এটি যেন সর্বদা গলায় রাখা হয়। ঠাকুরদা ছিলেন দূর অতীতের স্বাধীন মারাঠা বীর সৈনিকবংশের সন্তান।

পরদেশী ফৌজে চাকরি নেবেন তাঁর নাতি এটা আদৌ মনঃপূত ছিল না। নিলেনই যখন, এটা তখন তার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার দেশের সম্মান তোমার গলায় থাকল। সেই থেকে অনেকবার হার ছিঁড়েছে আর বদলেছে, কিন্তু মূল জিনিস অর্থাৎ সেই লকেট তেমনি আছে। ঝুমরিবাঈ এটা ইঙ্গিত করেই মুখঝামটা দিয়েছিলেন। আর তারপর প্রসাধন করতে করতে আপনমনেই হাসছিলেন।

.

সভার মধ্যে মেজর যে এই কাণ্ড করে বসতে পারেন, ঝুমরিবাঈ তা কল্পনাও করেননি।

জীবনের যে একটি বিশেষ ঘটনা মেজরের কর্মজীবনে সোনার অক্ষরে চিহ্নিত হয়ে আছে, সেই কাহিনীটিই আন্তরিক আনন্দে সভার বৃদ্ধ সভাপতি জুনিয়র অফিসারদের শোনালেন। মেজরের সেই কাহিনী অনেকে অনেকবার শুনেছে, তবু বরাবরকার মতই সরস লাগল আবারো। আনন্দের সাড়া পড়ে গেল। ঝুমরিবাঈ তখনো খুশিতে গর্বে মাঝে মাঝে স্বামীর মুখখানা দেখে নিচ্ছিলেন। এবারে মেজরের কিছু বলার পালা। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, আমি এই দীর্ঘদিন ধরে খানিকটা অপরের প্রাপ্য অপহরণ করে আসছি। আজকের বিদায়ের দিনে সেটুকু স্বীকার করে যাওয়াই ভালো–এইমাত্র জীবনের যে ঘটনা– শুনে আপনারা আমাকে অভিনন্দন। জানালেন তার সবটুকু আমার প্রাপ্য নয়।

এ পর্যন্ত বলে তিনি অদূরে ঝুমরিবাঈয়ের দিকে তাকালেন একবার। মিসেস সেবকরামের শঙ্কটাপন্ন অবস্থা দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে তিনি যেন নীরবে নিষেধ করতে চেষ্টা করলেন। এখানকার হুল্লোড়ের ব্যাপার তিনি জানেন।

কিন্তু মেজর তা দেখেও দেখলেন না, উৎসুক শ্রোতাদের দিকে চেয়ে বলে গেলেন, বয়সকালে একটি মেয়েকে মনে ধরেছিল আমার, তাকে বিয়ে করার জন্য ভিতরে ভিতরে ক্ষেপেই উঠেছিলেন, কিন্তু তখন ফৌজে সেই সামান্য চাকরি করি আর জীবনটা কবে আছে কবে নেই ভেবে সেই মেয়ের বাপ আমার সঙ্গে তার বিয়ে দিতে রাজি নন। যেদিন আমি ওই কাণ্ড করে আপনাদের কাছে ফেমাস হয়েছিলাম, ঠিক তার আগেই বিয়ের নাকচপত্র এসেছিল। ফলে আমার মাথায় তখন আগুন জ্বলছিল–এবং যা আমি করে বসেছিলাম সেই মেয়েটিকে না পাওয়ার সম্ভাবনার প্রতিক্রিয়াতেই বোধ। হয় করতে পেরেছিলাম। অতএব আমার সেই ছেলেমানুষি বীরত্বের সঙ্গে একটি মেয়েরও পরোক্ষ কৃতিত্ব জড়িত ছিল–সেদিনের সেই মেয়েটি উনি–ওই মিসেস সেবকরাম।

হিয়ার হিয়ার! হিয়ার হিয়ার! ওয়াণ্ডারফুল! আরো শুনব! আরো শুনতে চাই আমরা!

আনন্দে খুশিতে সভাস্থল সরগরম। মিসেস সেবকরামের মুখ টকটকে লাল। আনন্দোচ্ছল অজস্র জোড়া দৃষ্টির আঘাতে তিনি ফাঁপরে পড়লেন।

মেজর সেবকরাম গম্ভীর। বললেন, আপনারা আজ আমায় বিদায় দিচ্ছেন, কিন্তু উনি তো দিচ্ছেন না। তাই নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে আমি আর একটি কথাও বলব না।

সভা এইবার মিসেস সেবকরামকে নিয়ে পড়ল। তাঁকেও কিছু বলতেই হবে। বিব্রত বিড়ম্বিত মুখে মিসেস সেবকরামকে উঠে দাঁড়াতে হল। শ্রোতারা উন্মুখ।

মিসেস সেবকরাম বললেন, পুরুষেরা মেয়েদের চিরদিনই নির্লজ্জ তোষামোদ করে থাকেন, মেজরের উক্তি সেই নির্লজ্জতারই চরম নিদর্শন। আসলে কার অপমান বরদাস্ত করতে না পেরে তিনি সেদিন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সেই বিচিত্র কাণ্ড করে বসেছিলেন, তার সঠিক প্রমাণ আছে আপনাদের মেজরের গলার ওই হারের লকেটটিতে। আপনারা ওটি দেখলে খুশি হব।

এবারে মেজর বিড়ম্বিত। চারদিক থেকে তরল রব উঠেছে, দেখব, দেখব–উই মাস্ট সি!

সভাপতি হাত বাড়াতে নিরুপায় মেজরকে গলা থেকে হারটা খুলে দিতে হয়। তারপর সেই লকেটসুদ্ধ হার সকলের হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। সকলের মুখেই। শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রম।

লকেটের পিছনে সুন্দর করে খোদাই করা ভারতের মানচিত্র, তার মধ্যে ভারতমাতা দাঁড়িয়ে।

পার্টি শেষ হতে গাড়ি বাড়ির দিকে ছুটেছে। পিছনের সীটে মেজর এবং মিসেস সেবকরাম দুজনে দুধারে বসে। মাঝখানে ফুলের বোঝা। তাঁদের ছদ্ম গাম্ভীর্যে ফাটল ধরছে মাঝে মাঝে। আড়ে আড়ে এক-একবার দুজনেই দুজনকে দেখে নিচ্ছেন।

ফুলের আড়াল দিয়ে একখানা হাত মিসেস সেবকরামের হাতে ঠেকল। ড্রাইভারের অলক্ষ্যে তিনিও ঈষৎ আগ্রহেই হাতখানা ধরলেন।

গাড়ি নির্দিষ্ট পথে ছুটে চলেছে।

.

এবারে বহুকালগত মেজরের জীবনের সেই স্মরণীয় ঘটনাটি ব্যক্ত করলে এই কাহিনী সম্পূর্ণ হতে পারে।

সেই নতুন বয়সে মেজর সেবকরাম ছিলেন এক তোপখানার হাবিলদার মেজর। হাবিলদার মেজর থেকে হওয়া আর মন্ত্রী দপ্তরের আরদালী থেকে মন্ত্রী হওয়া প্রায় একই পর্যায়ের বিচিত্র ব্যাপার। মেজর সেবকরাম তাই হয়েছিলেন।

ইংরেজ আমলে তোপখানার তিনি সিপাই হয়ে ঢুকেছিলেন। খাওয়া পরা ছাড়া। তখন মাইনে ছিল মাসে আট টাকা। অল্প লেখাপড়া জানতেন, সাহেবী আমলের ভাঙা ইংরেজী বলায় তার সুনাম ছিল। আর ছিল প্রচুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা। ফলে ওপরের অফিসার ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। সিপাই থেকে নায়েক হয়েছেন, নায়েক থেকে হাবিলদার এবং সেই অল্প বয়সেই হাবিলদার থেকে মেজর। মাইনে তখন অলফাউণ্ড কুড়ি টাকা–তাদের পর্যায়ে সেদিনের। মস্ত চাকরি। হাবিলদার মেজর নিজের ইউনিটের জোয়ানদের মধ্যে সর্বেসর্বা। তাঁকে ডিউটি ভাগ করে দিতে হয়, জোয়ানদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়। জোয়ানেরা যেমন সমীহ করত তেমনি ভালও বাসত তাকে। মোট কথা সেই অল্প বয়সেই জোয়ানদের আকাঙ্ক্ষার স্বর্ণচূড়ায় উঠে বসেছিলেন হাবিলদার মেজর সেবকরাম।

কিন্তু এই উন্নতির তেমন কদর ছিল না শুধু ঝুমরির বাবার কাছে।

সেবকরাম ফৌজে চাকরি করে, বছরের ছুটিতে একবার মাত্র দেশে আসে, কোনো গণ্ডগোল বাধলে কোথায় কোথায় চলে যেতে হবে জামাইকে– এইসব ভেবে ঝুমরির বাবার এই বিয়ে মনঃপূত ছিল না। তার থেকে ফলের ব্যবসায়ী প্রভুজীর ছেলেকেই বেশি পছন্দ তার।

ঝুমরি সেবকরামের পড়শিনী, ছেলেবেলা থেকে ভারী ভাব দুজনের। বড় হয়ে ফৌজে ঢোকার ফলে সেবকরাম ভেবেছিলেন তার কদর বাড়ল। কিন্তু উল্টো ব্যাপার দেখে তার চক্ষুস্থির। পারলে তক্ষুনি চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু ফৌজের চাকরিতে একবার ঢুকলে ছাড়তে প্রাণান্ত। ঝুমরির বাবাকে চিঠিপত্রে অনেক বোঝালেন তিনি। ওদিকে ঝুমরিবাইও দোটানায় পড়লেন, গোলামী করতে যাওয়াটা তার আদৌ পছন্দ ছিল না। তাছাড়া বাপও ন্যায্য কথাই বলছেন মনে হল, বিয়ের পরেও তো জীবনের অর্ধেক ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকা।

কর্মস্থলের প্যারেড গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে মায়ের লেখা ওদের শেষ জবাব পড়লেন সেবকরাম। মা লিখেছেন, ওরা শেষ পর্যন্ত এই বিয়েতে রাজি হল না।

চিঠি পড়ে সেবকবামের দুনিয়া রসাতলে পাঠানোর আক্রোশ। পায়ে পায়ে তিনি চললেন টেন্ট-এর দিকে।

এদিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে এক নতুন ক্যাপ্টেন এসেছেন তখন। গ্রাউণ্ডে দাঁড়িয়েই তিনি তাকে কম্যাণ্ডিং অফিসার–অর্থাৎ এই ইউনিটের সর্বাধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল ব্রাউনের কাছ থেকে কিছু জ্ঞান আহরণ করছিলেন। জোয়ানদের ভালোভাবে জেনে বুঝে পরিচালিত করার সুবিধে হয় এরকম কোনো বই আছে কিনা খোঁজ করছিলেন। নতুন উৎসাহী ক্যাপ্টেনটি।

লেফটেনেন্ট কর্নেল ব্রাউন জবাব দিলেন, আছে কিন্তু তার কিছু দরকার নেই। জাস্ট গিভ দেম এ কিক অন দি ব্যাক অ্যাণ্ড দে উইল ডাই ফর ইউ! অর্থাৎ পিছনে একটি করে লাথি কসাবে, তাহলেই তারা তোমার জন্যে প্রাণ দেবে।

ঠিক সেই সময়েই সেবকরাম তাঁদের পিছন দিয়ে যাচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেনের প্রশ্ন কানে আসতে দাঁড়িয়ে গেলেন আর কম্যাণ্ডিং অফিসারের জবাব শুনে পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এলেন। তারা পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে।

পিছন থেকে আচমকা এক বিপুল পদাঘাতে তিন হাত দূরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন কম্যাণ্ডিং অফিসার ব্রাউন। নবাগত ক্যাপ্টেন বিমূঢ় হঠাৎ। কম্যাণ্ডিং অফিসার মটি থেকে উঠে দেখলেন পিছনে কে দাঁড়িয়ে।

সেবকরাম শান্ত মুখে প্রশ্ন করলেন, ইউ মিন হি সুড কিক দিস ওয়ে সর? অর্থাৎ, কি এইভাবে লাথিটা মারতে বলছেন কে?

কম্যাণ্ডিং অফিসারের কোমরে রিভলভার থাকলে হয়ত তক্ষুনি সব শেষ হয়ে যেত। তার হাতে ছিল একটা স্টিক। তাই নিয়েই বাঘের মত সেবকরামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। তারপর লপটা-লপটি দুজনে।সেবকরামের কপাল ফেটেছে, কম্যাণ্ডিং অফিসারেরও নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে।

মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই ব্যাপার ঘটে গেল। তারপরেই লোকজন ছুটে এলো। সেবকরামকে অ্যারেস্ট করা হল, নিরস্ত্র করা হল।

এরপর কোর্ট মার্শাল। যুদ্ধের সময় হলে এই অপরাধে সেবকরামের মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে জানা কথাই।

কোর্ট মার্শাল শুরু হল। আইন অনুযায়ী নিচু পর্যায়ের তিনজন ভারতীয় অফিসার ও থাকবেন। তারা চেষ্টা করতে লাগলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যদি বারো-চৌদ্দ বছরে এনে দাঁড় করানো যায়। এদিকে এই বিচারে আসামী নিজেরও একজন সমর্থক বা আইনজ্ঞ দাঁড় করানোর রীতি। যত টাকা খরচ হোক, সরকার তাকে আসামীর ইচ্ছানুযায়ী এনে দিতে বাধ্য।

সমর্থক প্রসঙ্গে সেবকরাম তার প্রিয় অফিসার ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর শরণাপন্ন হলেন। চতুর ক্যাপ্টেন ব্যানার্জী আবার এক ইংরেজ লেফটেনেন্ট কর্নেলকেই এনে দাঁড় করালেন সেবকরামের হয়ে সওয়াল করার জন্য–এমন লোক বাছাই করলেন যাঁর সঙ্গে ওই অফিসার কমাণ্ডারের খুব সদ্ভাব ছিল না। এই ইংরেজ লেফটেনেন্ট কর্নেল এসেই হৈ-চৈ কাণ্ড বাধিয়ে দিলেন, প্ররোচনার কারণ থাকলে কবে কোথায় কোন ইংরেজ সৈনিক অফিসারকে লাথি মেরেছিল তার নজির বার করলেন। অফিসার কম্যাণ্ডার অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেনকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন সেটা অস্বীকার করেননি। সেটাই তো প্ররোচনা! নিপুণ সুদক্ষ কর্মী সেবকরামের দেশপ্রীতির জন্য শাস্তি না। হয়ে তার পুরস্কার পাওয়া উচিত বলে গলা ফাটালেন তিনি।

হুলস্থুল বেধে গেল এই নিয়ে। শেষ পর্যন্ত অফিসার কম্যাণ্ডারের সম্মান রক্ষার্থেই কোর্ট মার্শালে মাত্র একমাস কারাদণ্ড হল সেবকরামের। হাবিলদার মেজরের পদমর্যাদা অবশ্য গেল, দণ্ডের মেয়াদ ফুরালে আবার সিপাই থেকেই কাজ আরম্ভ করতে হবে তাকে।

ওদিকে সেবকরামের দেশে পর্যন্ত নানাভাবে পল্লবিত হয়ে এই খবর চলে গেছে। সেখানে তিনি বারের আসন লাভ করেছেন। ঝুমরিবাঈ ঘোষণা করেছেন, জেল থেকে। বেরুলে সেবকরামকেই বিয়ে করবেন তিনি। তার বাবা এবারে হৃষ্টচিত্তে সায় দিয়েছেন।

জেল থেকে বেরিয়েই সেবকরাম দেখেন, সামনে দাঁড়িয়ে সেই কম্যাণ্ডিং অফিসার ব্রাউন যাঁকে তিনি পদাঘাত করেছিলেন। দুজনে দুজনকে দাঁড়িয়ে দেখলেন কয়েক মুহূর্ত। সাহেব এগিয়ে এসে তার সঙ্গে হ্যাঁণ্ডশেক করলেন। হেসে বললেন, আমার মাজায় এখনো ব্যথা আছে!

নিজে কাধ ধরে নিয়ে গিয়ে কাজে বহাল করলেন, আর তক্ষুনি আবার হাবিলদার মেজরের পদে প্রমোশন দিলেন তাকে।

বিয়ে কর্মস্থলেই হল। কম্যাণ্ডিং অফিসার ব্রাউন বউ দেখতে এলেন। এসে এক ফাঁকে খুশী হয়ে বউকে বললেন, বি কেয়ারফুল; হি ক্যান কিক্ ওয়েল!

হাবিলদার মেজর সেবকরাম সলজ্জে হেসে এই প্রথম ক্ষমা চাইলেন তার কাছে। বললেন, সাহেব, সেই দিন ঝুমরির বাবা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল আর এই দেখো বলে গলার লকেটটা তাকে উল্টে দেখিয়েছিলেন, বলেছিলেন, সেই ব্যথার ওপর তুমি আরো কোথায় ব্যথ্যা দিয়েছিলে দেখো-এই দেশ যে আমার প্রাণ সাহেব! সাহেবের দুই চক্ষু চকচক করছিল। একবার ঝুমরিকে দেখছিলেন তিনি, একবার কেরামের গলার লকেটটা।

এরপর কম্যাণ্ডিং অফিসার ব্রাউন ক্রমশ অনেক ওপরে উঠেছেন, পুরোদস্তুর কর্নেল হয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে অলক্ষ্য থেকে সেবকরামকেও টেনেছেন। সকলে অবাক হয়ে দেখেছে–হাবিলদার মেজর সেবকরাম হঠাৎ ভাইসরয়েস কমিশনড় অফিসার হয়েছেন একদিন–লেফটেনেন্ট হয়েছেন। তারপর প্রশস্ত রাস্তা, লেফটেনেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন থেকে মেজর। এর অনেক আগেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। কর্নেল ব্রাউন বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু যাবার আগে তিনি এঁদের সঙ্গে দেখা করে যেতে ভোলেননি। সেই পুরনো ঠাট্টাও করেছেন মিসেস সেবকরামের দিকে চেয়ে, হি কি ওয়েল–দ্যাট ওয়ান ব্রিলিয়ান্ট কিক ব্রট বোথ ইউ অ্যাণ্ড মি নিয়ারার–ডোন্ট ইউ এগ্রি উইথ মি ম্যাডাম?